You dont have javascript enabled! Please enable it! Joi Bangla! The Children of Bangladesh - Ettagale Laure, Jason Laure (বাংলা অনুবাদ) - সংগ্রামের নোটবুক

পূর্বকথা

আধুনিক বাংলাদেশের শুরু হয় ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারত স্বাধীন হবার সময়। ধর্মীয় রেষারেষির কারণে এই অঞ্চল ভারত ও পাকিস্তান এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়। অঞ্চলগুলো যথাক্রমে হিন্দু ও মুসলমান অধ্যুষিত। কিন্তু একটি কমিটির মাধ্যমে তৈরি হওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভৌগলিক অবস্থান ছিলো অস্বাভাবিক। শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে যুক্ত থাকা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নামক দুইটি আলাদা ভূখণ্ডের মাঝে ভারতের প্রায় হাজার মাইল ভূখণ্ড বিদ্যমান ছিলো।

তুলনামূলক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী উজ্জ্বল চামড়ার পশ্চিম পাকিস্তানিরা উর্দুতে কথা বলত। এবং মধ্যপ্রাচ্যের শুষ্ক অঞ্চলের মানুষের সাথে তাদের ভালো মিল ছিলো। অপেক্ষাকৃত দুর্বল শারীরিক গঠনের অধিকারী বাঙালিরা বাংলায় কথা বলত। এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আদ্র দেশগুলোর অধিবাসীদের সাথে তাদের মিল ছিলো।

যদিও পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা বেশী তবুও কেন্দ্রীয় সরকার ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানে। সরকারি প্রায় সকল সিদ্ধান্ত পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থের অনুকূলে নেয়া হতো; যদিও বৈদেশিক আয়ের ৫৫ থেকে ৭০ ভাগ আসতো পূর্ব পাকিস্তানে উৎপাদিত পাট থেকে। বিনিময়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সরকারি বরাদ্দ থাকতো খুবই কম।

পশ্চিম পাকিস্তানিরা সম্পূর্ণভাবে সরকার নিয়ন্ত্রণ করতো এবং সেনাবাহিনী, সিভিল সার্ভিস, ব্যাংকিং এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদের লোকজনই থাকতো। সরকারি ভাষা হিসেবে শুধুমাত্র উর্দুকে রাখায় স্বভাবতই বাঙালিদের জন্য উঁচু পদে যাওয়াটা কঠিন ছিলো। ১৯৫২ সালে হতাশ বাঙালি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। যারা বাংলা ভাষা শিক্ষাকে সমর্থন করতেন তাদের ‘ইন্টেলেকচুয়াল ক্রাইম’ দেখিয়ে জেল দেয়া হয়। সরব সমর্থকদের অন্যতম একজন, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র, তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের বিপ্লবী নেতা; নাম তাঁর শেখ মুজিবুর রহমান।

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান বিশ বছরের বেশী সময় ধরে বিশৃঙ্খলার সাথে টিকে থাকে। ১৯৬২ সালে জেনারেল ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে তিনি সাধারণ নির্বাচন এবং বেসামরিক শাসনতন্ত্র চালুর প্রতিশ্রুতি দেন। এবং ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের ফলাফল পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রভাবশালী অবস্থানে প্রচণ্ড নাড়া দেয়।

সাধারণ জনগণ সমর্থিত রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ পরিষদের ১৬৯ টি আসনের ১৬৭ টি আসনে জয়লাভ করে। আওয়ামীলীগের অবিসংবাদিত নেতা, শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি মুজিব নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত, তিনি ইয়াহিয়া খান এবং সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে আলোচনা শুরু করেন। তারা তিনজন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় নির্বাচনের পর থেকে শুরু করে প্রায় মার্চের পুরোটা নতুন সরকারের গঠন নিয়ে বারবার বৈঠক করেন। কিন্তু এই আলোচনা ছিলো মূলত মুজিবকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রাখার জন্য সময়ক্ষেপণ। ক্ষমতায় থাকার জন্য যথেষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানি আসন ইয়াহিয়া খানের ছিলোনা। ফলে অবস্থা দাঁড়াল যে শেখ মুজিবই হবেন প্রধানমন্ত্রী যিনি একজন বাঙালি।

এটাকে মেনে না নেয়ার পরিকল্পনা স্বরূপ ইয়াহিয়া তার সামরিক শাসন বলবৎ রাখেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তিনি ঢাকার জনগণের উপর নির্মম গণহত্যা শুরু করেন। কোন পূর্বসতর্কতা ছাড়াই এবং নিজেদের রক্ষা করার কোন সুযোগ না দিয়েই পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালিদের দেখামাত্র হত্যা করতে শুরু করে। যেখানে যাকে পাওয়া যায় – ছাত্রদের তাদের হলের বিছানায়, ব্যবসায়ীকে তার দোকানের পেছনে, জনগণকে রাস্তায় হত্যা করতে থাকে। দোকান-পাট জ্বালিয়ে দেয়া হয়। যারা ভেতরে আটকা পড়েছিলো তারা পুড়ে মরে, আর যারা বাইরে বেরিয়ে আসছিলো তাদেরকে সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করছিলো।

সাধারণ মানুষকে এভাবে হত্যা করার এই পর্বকে ‘ক্র্যাকডাউন’ বলা হলো। সেনাবাহিনী ও ট্যাংক নিয়ে তারা প্রথমেই টার্গেট করে ছাত্রদের – কারণ পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক আন্দোলনের ঐতিহ্যিক উৎস ছিলো ছাত্ররা।

সারা রাত হত্যাযজ্ঞ চলে। মাঝরাতে শেখ মুজিব গ্রেফতার হন এবং তাকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি সেখানে বন্দী থাকেন, যিনি স্বাধীনতার জন্য নয় মাস ধরে চলা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রামের প্রতীক।

ক্র্যাকডাউনের দ্বিতীয় দিনে সৈন্যরা ঢাকার আরও কয়েকটি স্থানে চলে যায়, যার মধ্যে পুরনো ঢাকা অন্যতম, যেখানে অধিকাংশ হিন্দু জনগোষ্ঠী বসবাস করে। ঘন্টার পর ঘন্টা তারা এই “পুরাতন শহর” যতোটা সম্ভব ধ্বংস করে। ঘর-বাড়ী পোড়ায় এবং যারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে। সেই রাতে, স্থানীয় বাঙালি সহযোগীরা সৈন্যদের সঙ্গে রাস্তায় টহল দেয় এবং তারা আওয়ামী লীগের কর্মীদের ঘরবাড়ী চিনিয়ে দেয়। এগুলো তারা জ্বালিয়ে দেয়।

২৭শে মার্চ ঢাকায় কারফিউ তুলে নেয়া হয়। সাথে সাথে মানুষ শহর ছেড়ে যেতে শুরু করে। পরবর্তী আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় দশ মিলিয়ন লোক ঘরবাড়ী ছেড়ে নিরাপত্তার খোঁজে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যায়। শরণার্থীদের এই অবিরাম প্রবাহ, যাদের বেশিরভাগ ছিলো হিন্দু, তারা ভারতের অর্থনীতিতে অসহনীয় চাপ সৃষ্টি করে, কারণ তাদের তখন নিজস্ব লোকেদের খাওয়াতেই সংগ্রাম করতে হচ্চিলো।

বন্দী হবার প্রাক্বালে মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও তাঁকে কারাগারে নিয়ে যাওয়ায় নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। ক্র্যাকডাউনের পরপরই স্বাধীন বাংলাদেশের লোক হিসেবে আপামর জনতা সংগ্রাম শুরু করে। সৃষ্টি হয় নতুন এক ‘বাঙালি জাতি’র।

পরবর্তী কয়েক মাস পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালির ওপর তাদের ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে। কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত ক্র্যাক ফোর্সের ৮০,০০০ সৈন্য বাংলাদেশের প্রধান প্রধান অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এই সময়ে অন্যতম প্রতিরোধ আসে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে। এই ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈন্যরা পরবর্তীতে স্বাধীনতাকামী বাঙালি মুক্তিবাহিনী গঠনে অন্যতম ভূমিকা রাখে।

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে পালিয়ে যায়। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে তারা সংগঠিত হয়, এবং তারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের উপর পুনঃআক্রমণের জন্য ফিরে আসে। তারা পাকিস্তানি অস্ত্রাগারের ওপর হামলা এবং অভিযান চালায়।

পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়াতে শুরু করে তখন বাঙালি তাদের উপর গেরিলা আক্রমণ শুরু করে। উভয় পক্ষই একে অপরের ক্ষতিসাধন করতে থাকে। এবং ১৯৭১ সালের পুরোটা জুড়েই যুদ্ধ চলে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রচুর অতিরিক্ত সৈন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসতে শুরু করে।

যদিও পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানিদের আধিপত্য ছিলো না, তবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও তার উপদেষ্টারা বিশ্বাস করতেন বিদ্রোহের অবসান ঘটবে এবং দেশ পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সময়ে তারা শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে, যদিও জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই গ্রামে বাস করতো।

নভেম্বরের শেষে, ভারতে শরণার্থী পরিস্থিতি হতাশাজনক হয়ে উঠেছিলো। নিজস্ব ৫৬০ মিলিয়ন জনসংখ্যার বাইরে প্রায় দশ মিলিয়ন শরণার্থীর চাপ বহন করা তাদের জন্য মারাত্মক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের পাশে অবস্থিত, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যে, অবস্থা অসহনীয় ছিলো। ৭ মিলিয়ন শরণার্থী সেখানে ক্যাম্পে ভীড় করেছিলো, কোলকাতায় কাজের জন্য পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব অনুন্নত লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথে তারা যুক্ত হলো।

সংগ্রামরত জনগণের পক্ষে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ভারতের অন্য একটি কারণ ছিলো। ১৯৪৭ সালে আলাদা দেশভাগের পরেও আরও দুইবার পাকিস্তানের সাথে তারা যুদ্ধ করেছে। যদি বাঙালিরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে, তবে ভারত তার পূর্বাঞ্চলে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী নিশ্চিত করতে পারে। সেক্ষেত্রে ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ১৩০০ মাইল সীমান্তের সুরক্ষার প্রয়োজন হবেনা। পাকিস্তান তার পশ্চিমাঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে এবং আনুমানিক ৬০ শতাংশ জনসংখ্যা কমবে ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৫৫ থেকে ৭০ শতাংশ হ্রাস পাবে। এই দুর্বলতার কারণে এশীয় উপমহাদেশে প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের অবস্থান নিশ্চিত হবে।

১৯৭১ সালের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতীয় ও পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষ চলেছে। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর, ভারত খোলাখুলিভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে চলে যায়। আকাশপথে ভারী আক্রমণে ব্যাপক সংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানিদের উপর একটি বড় যুদ্ধের অবতারণা হয়। প্রথম সপ্তাহে ভারত ঢাকা বিমানবন্দরে বোমা বিস্ফোরণ করে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সেনা এবং রসদ সরবরাহের সমাপ্তি ঘটায়।

যদিও ১৯৭১ সালের গ্রীষ্মের শেষ দিকেই মুক্তিবাহিনী শক্তি অর্জন করে এবং লড়াই চালিয়ে যায়, তথাপি ভারতের সেনাশক্তি এবং আকাশপথে আক্রমণ গেরিলা যুদ্ধকে একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক বিজয়ে রূপান্তরিত করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং গৃহযুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। বিশ্বের বুকে নতুনতম এবং অষ্টম সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ হিসেবে “বাংলাদেশ” আবির্ভূত হয়।

১৪ ডিসেম্বর, যখন এটি প্রায় স্পষ্ট ছিলো যে পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত, তখন ধর্মতাত্ত্বিক ধারণা নিয়ে সৃষ্ট বাঙালি মুসলমানদের একটি গোষ্ঠী – আলবদর, একটি ভয়ংকর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করে। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মুসলমানেরা বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে, এটা দেখে তারা প্রায় তিনশত বুদ্ধিজীবীকে গ্রেফতার করে এবং তাদের অধিকাংশকেই ভয়ংকর নির্যাতন করে হত্যা করে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পত্রিকার শিরোনামে লিখিত হয়, ‘DHAKA FALLS’। পশ্চিম পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পনের এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। সে সময়ে আমি কোলকাতায় আসি।

‘বাংলাদেশ’ নামের নতুন একটি দেশের জন্ম হচ্ছে, সাংবাদিক হিসেবে এমন একটি ঘটনার সাক্ষী হিসেবে থাকতে পারা ও এটিকে কাভার করার জন্য আমার তর সইছিলো না।

কোলকাতা, সাত মিলিয়নের বেশি জনসংখ্যায় কানায় কানায় পূর্ণ পশ্চিমবঙ্গের এই শহর মুক্তিযুদ্ধের সময় লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। যুদ্ধের শিকার বাঙালিরা শরণার্থী শিবিরে অত্যন্ত অমানবিক জীবনযাপন করেছে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে, তারা নিজেদের স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশে ফিরে আসা শুরু করে; যে দেশের স্বপ্ন তারা দেখেছিলো; নতুন জীবন শুরু করার জন্য। প্রথম প্রত্যাবর্তনকারী শরণার্থীদের কয়েকজনের সাথে আমি নতুন দেশ, বাংলাদেশে প্রবেশের পরিকল্পনা করি।

ক্যাম্পে আমি শরণার্থীদের মধ্যে একজন, নাম অমল গাঙ্গুলি, তার সাথে পরিচিত হই। অনেক শিক্ষিত বাঙালীর মতো, সেও কথোপকথন ধরে রাখার জন্য যথাসম্ভব ইংরেজিতে কথা বলছিলো। সে ভান্দুবিলা থেকে এসেছিলো। ভারত সীমান্ত থেকে ৩০ মাইল ভেতরে একটি শান্ত গ্রাম এটি। অমল একজন হিন্দু, এবং এই দেশের একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু। পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা বাঙালিদের প্রতি কোন দয়া দেখায়নি, যদিও তাদের বেশীরভাগই মুসলিম, তবে হিন্দুদের প্রতি তাদের নির্যাতন ছিলো নির্মম। অমলের স্ত্রী মারা গেছেন। ভান্দুবিলায় থাকা অমল এবং তার তিন সন্তানের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তাই তারা ভারতের পথে পা বাড়ায় এবং গত ৭ মাস কোলকাতার শরণার্থী শিবিরের একটি ছোট্ট তাঁবুতে বাস করেছে। তারা বর্ষাকালে প্রবল বৃষ্টি সহ্য করেছে এবং পুরো শিবির তখন কাঁদা আর রোগশোকের দোযখে পরিণত হয়েছিলো। তাদের দুঃখের কোন সীমা ছিলোনা যখন আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা কারো কিছু করার ছিলোনা – শুধু অপেক্ষা কখন পরবর্তী খাবারটুকু আসবে।

আমি পৃথিবীর সেই অংশে গিয়েছিলাম সেসব ঘটনা চিত্রায়িত করতে। আর একটি নতুন জন্ম নেয়া জাতির কথাগুলো শুনতে। আর এটা করার জন্য সবচেয়ে ভালো পথ হলো তাদের সাথে ফিরতি পথে রওনা দেয়া। ইতিহাস তৈরির মুহূর্তের সাক্ষী হবার এই দুর্লভ সুযোগ পাওয়াটা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।

হাজার হাজার শরণার্থী যারা নিজের দেশে ফিরে যাবার জন্য রওনা দিয়েছে, তাদের সাথে অমলের পরিবার এবং আমিও রওনা দিলাম। অমলের মতো, তারাও দীর্ঘদিন অতি ক্ষুদ্র একটু জায়গায় একসঙ্গে ক্যাম্পে অমানবিক জীবন যাপন করেছে। অমল নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করে, কারণ তার সন্তানরা তার সাথে ছিলো। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার সময় তাড়াহুড়ায় অনেক পরিবারই সারাজীবনের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

ফিরে আসা শরণার্থীরা ছিলো খুবই খুশী। পুরো পথ তারা চিৎকার করে গান গাইছিলো, চিৎকার করে আনন্দের সাথে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো, “জয় বাংলা! বাংলাদেশ চিরজীবী হোক!” সবাই হাসছিলো এবং উদ্বেলিত ছিলো, যদিও তারা জানত না তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। কিন্তু তারা একটি সম্পূর্ণ নতুন জীবনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। গাছের ছায়া ঘেরা সুন্দর একটি পথ দিয়ে আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম। সাথের মানুষগুলোকে দেখে মনে হচ্চিলো, তারা যেন কোন বিজয়ী সেনাবাহিনীর দল, যেন জীর্ণদশাগ্রস্ত ক্ষুধার্ত কোন মানুষ নয়। অথচ, প্রকৃতপক্ষে তারা ছিলো প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত এবং তাদের অবস্থা ছিলো সত্যিই খুব জীর্ণশীর্ণ।

অমলের সাথে বাংলাদেশে ফিরে আসার সময়কার আবহাওয়া ছিলো আরামদায়ক গরম ও শুষ্ক। রাতে আমরা রাস্তার পাশে তারাভরা খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়েছিলাম। যদিও অমল খুব ভালো ইংরেজি বলে, তবে তার সন্তানরা কেবল বাংলা বলতে পারতো। আমি তাদের ইংরেজি কয়েকটি শব্দ শিখিয়েছিলাম, বিনিময়ে তারাও আমাকে কিছু বাংলা শিখিয়েছে। আমি যখন প্রথম একটি বাংলা শব্দ উচ্চারণ করতাম, তারা তখন শুধু হাসত। তারপর তারা সঠিকভাবে আবারো শব্দটা বলতো এবং আমি এটি পুনরাবৃত্তি করতাম। ফিরতে মোট ৪ দিন লেগেছিলো এবং পুরো রাস্তা আমি আর অমল গল্প করেছি।

আমাদের সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় ছিলো অমল যখন তার বাড়ী খুঁজবে তখন সে কী দেখবে। এমন কী হতে পারে যা আমার আর অমলের ধারণার বাইরে? অমলের সমস্ত আশা ধূলিস্মাত হয়ে গেলো যখন সে তার বাড়ীর ধ্বংসস্তূপ দেখলো। যা একসময় ছিলো তার নিজের ঘর। ছাদ নেই। বাড়ীর ভেতরটা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। তার ঘরে সাপের বাসা হয়েছে। তার খামারের পশুগুলোকে জবাই করা হয়েছে আর তার নারকেল গাছগুলো ধ্বংস করা হয়েছে।

যখন আমরা ভারত অতিক্রম করছিলাম, তখন বাংলাদেশ সীমান্তে ক্লিয়ারেন্স হাউস – যেখানে কর্মকর্তারা পোশাক, কম্বল, নগদ অর্থ বিতরণ এবং দুই সপ্তাহের খাদ্য সরবরাহ করছিলো – অমল সেটি এড়িয়ে সরাসরি বাড়ী ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। কারণ তার মনে হয়েছিলো দুই দিন অপেক্ষা করে এগুলো নেবার কোন প্রয়োজন আসলে হবেনা যদি সে তার বাড়ীটা ঠিকঠাক অবস্থায় পায়। কিন্তু এখন আমাদের সেখানে ফিরে যেতে হবে। অমলের সাথে ভান্দুবিলাতে ফিরে আসার পর আমি তার পরিবারের সাথে আরো কিছুদিন কাটালাম এবং তারপর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় চলে যাই।

অমলের সাথে সেটাই ছিলো আমার শেষ দেখা। ইতোমধ্যে সে তার কৃষি যন্ত্রপাতি এবং চিকিৎসা সরবরাহ পেয়েছে যা নতুন জীবন শুরু করার জন্য সরকারিভাবে সহায়তা হিসেবে দেয়া হয়েছিলো।

ঢাকা আসার পর আমি পেনশনে একটি রুম পেলাম। এটি হলো ব্যক্তিগত মালিকানার বাড়ীতে রুম ভাড়া নিয়ে থাকা। এখানে কিছু ত্রাণকর্মীরাও ছিলো। যেহেতু এটি শহরের আবাসিক এলাকায় ছিলো আমি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আসার জন্য যোগাযোগ করলাম। এখানে বিশ্বের নানা দেশের সাংবাদিকরা অবস্থান করছিলো।

যখনই আমি হোটেলে আমার মেইল দেখার জন্য যেতাম, আমি লক্ষ্য করতাম, পার্কিং-লট গেটের কাছে একটি মেয়ে ফুল বিক্রি করে। তার মুখে সবসময়ই হাসি লেগে থাকতো। আমি প্রায়ই তার কাছ থেকে ফুল কিনতাম, ইংরেজি বা বাংলায় কিছু কিছু শব্দ বিনিময় হতো। এমন একটা মেয়েকে রাস্তায় দেখা – বিশেষ করে রাত্রিবেলায় দেখে আশ্চর্য লাগতো, এবং আমি প্রায়ই তার নিরাপত্তার বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করতাম। মাঝে মাঝে চিন্তা হতো – না জানি তার ভাগ্যে কী আছে।

জানুয়ারির প্রথম দিকে, বাংলাদেশের অবিসংবাদিত এবং একমাত্র প্রকৃত নেতা, মুজিব, পাকিস্তানের নতুন রাষ্ট্রপতি ভুট্টো কর্তৃক জেল থেকে মুক্তি পান। ৯ মাস কারাবাসের সময় মুজিব যুদ্ধ এবং তার জনগণের কোন খবর জানতেন না। তাকে কোন পত্রিকা বা রেডিও শোনার অনুমতি দেয়া হয়নি। ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে তিনি ঢাকা ফেরেন এবং ফুল-বিছানো একটি ট্রাকে করে বিমানবন্দর থেকে যাত্রা করেন। প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য পথের প্রতিটি অংশ কানায় কানায় পূর্ণ করে ফেলে। এটি ছিলো একজন বীরের আগমন যিনি বাঙালিকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশে প্রায় চার মাস কাজ করার পর, আমি আমেরিকায় ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করতে শুরু করলাম। নতুন এই জাতি বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম অব্যাহত রাখল, কিন্তু আমার কাজ মনে হলো শেষ হয়েছে। বাংলাদেশের শিশুরা আমাকে ভীষণ ভীষণ পছন্দ করলো । ফুল বিক্রেতা মেয়েটির মতো আরো অনেকেই ছিলো? আমি আশ্চর্যান্বিত হলাম। আমি দেখেছি ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঢাকার ভয়ানক বিপজ্জনক ভীড়ের রাস্তায় রিক্সা চালাচ্ছে। আমি যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই দেখেছি শিশুদেরকে কাজ করতে। তারা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ছিলো, কিন্তু তাদের ভবিষ্যতে আসলে কী লেখা ছিলো?

আমি এই শিশুদের এবং তাদের জীবন সম্পর্কে বিশ্বকে বলতে চেয়েছি। একটি জাতি ব্যক্তিগত স্বকীয়তার মাধ্যমে প্রকাশ পায়, জীবনের গল্প থেকে প্রকাশ পায়। যুদ্ধ একটি জাতির ঘটে না, যুদ্ধ ঘটে বিপর্যস্ত মানুষের জীবনের ওপর। বাংলাদেশের এই ছোট্ট শিশুদের নিয়ে একটি বই লেখা আমার স্বপ্ন ছিলো।

নিউ ইয়র্ক ফিরে আসার পর আমার মাথায় শুধু বাংলাদেশের এবং সেখানকার মানুষের ছবি ভেসে আসছিলো। এর এক বছর পর, আমি পরিকল্পনা করলাম সারা বিশ্ব ভ্রমণের, যার প্রাণকেন্দ্রে থাকবে বাংলাদেশ। আমি যখন পরিকল্পনা করছিলাম আমার মাথায় অনেক প্রশ্ন আসছিলো। আমার কি সেখানে এমন কোনও মানুষের সাথে দেখা হবে যে আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো? সেই ফুল বিক্রেতা মেয়েটি কেমন আছে? সেই শিশুরা এখন কেমন জীবন যাপন করছে?

আমি যখন আবার ঢাকা ফিরে এলাম, আমি সরাসরি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে রওনা দিলাম। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব চেক ইন শেষ করেই আমি এক স্থানীয় বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম যে ত্রাণ সংস্থাগুলির সাথে কাজ করে।

তার মাধ্যমে আমি ২২ বছর বয়সী একটি কলেজ পড়ুয়া ছাত্রের সাথে পরিচিত হই। নাম জানে আলম। সে আমার দোভাষী হিসেবে কাজ করবে বলে ঠিক হলো। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই তার সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক ও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আমরা ঢাকা ও তার আশেপাশে ঘুরে বেড়াতাম এবং এই বইতে যেসব শিশুদের কথা আছে সেসব বিষয়ে কথা বলতাম।

বাংলা, উর্দু ও ইংরেজিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলতে পারার কারণে, জানে আলম আমার একজন গুরুত্বপূর্ণ পার্টনার হয়ে উঠল। যেন আমি আমার আগের বছরের স্বপ্ন পূরণ করেছি। আমরা একসঙ্গে এমন বাচ্চাদের খুঁজে পাই যারা বেশিরভাগ বাঙালির জীবনধারণকে প্রতিনিধিত্ব করে। এবং অবিশ্বাস্যভাবে, আমি সেই ফুল বিক্রেতা মেয়েটিকে খুঁজে পেয়েছিলাম, যে কয়েক বছর আগে আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। সেই বছর তার জীবন আরও কঠিন হয়ে উঠেছিলো, কিন্তু তার হাসিটি কখনো মুছে যায়নি। তার গল্প নিয়েই তৈরি হলো এই বইয়ের প্রথম অধ্যায়।

জয় বাংলা! বাংলাদেশ চিরজীবী হোক!
জেসন লর
নিউ ইয়র্ক সিটি
মার্চ ১৯৭৪


আছিয়া জেসমিন
এগারো বছর
ফুল বিক্রেতা

আছিয়া তার আসল নাম। আর জেসমিন তার ডাক নাম। সে বাংলাদেশের শক্তি, আশা এবং ইতিহাসের প্রতিনিধিত্ব করে। মাত্র এগারো বছর বয়সে তাকে নয় সদস্যবিশিষ্ট পরিবারের ভরণপোষণ চালানোর দায়িত্ব নিতে হয়। খুব দ্রুত শেখার ক্ষমতা, চটপটে মন ও সাহস নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে আছিয়া ঢাকার রাস্তায় ফুল বিক্রি করে। সে সম্ভবত মাসে দুইশ টাকা আয় করে (২৭ ডলার) যা দিয়ে সে তার পুরো পরিবারের, তথা – তিন বোন, তিন ভাই, বাবা-মা এবং তার নিজের জন্য খাবার কেনে এবং বাড়ী ভাড়া দেয়।

২৫ মার্চ ১৯৭১ তারিখে – যেটাকে বলা হয় ‘নাইট অব দ্যা জেনারেলস’ – সেই ক্র্যাকডাউনের রাতের কিছুদিন পরেই আছিয়া তার জীবন সংগ্রাম শুরু করে। বাঙালিদের দেখামাত্র গুলি করা হচ্চিলো বলে তার বাবা ভীত হয়ে কাজে যাওয়া বন্ধ করে দেন। পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু পরিবারের খাদ্য এবং আশ্রয়ের প্রয়োজন বন্ধ হয়না।

অবিশ্বাস্য সাহস এবং প্রতিজ্ঞা নিয়েই আছিয়া নিজেই ফুল বিক্রি করার মতো বিপদজনক কাজ শুরু করে। “শহরে আমার ফুল বিক্রি করার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের পাশ দিয়ে যেতে হতো। তাই আমি বিহারীর মেয়ে হিসাবে ভান করতাম।” পশ্চিম পাকিস্তানিরা বিহারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলো, কারণ তাদের সাথে তাদের অনেক মিল রয়েচে, যার একটি হলো উর্দু ভাষা। আছিয়া তাদের প্রশ্নের উত্তর উর্দু ভাষায় বেশ ভালো দিতে পারতো, যা তাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য যথেস্ট ছিলো। “সৈন্যরা প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করতো যে মুক্তিবাহিনী [বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা] কোথায় থাকে। ‘তাদের সম্পর্কে কিছুই জানিনা’ – সবসময় আমি এটা বলেই কোন কিছু জানার ব্যাপারটা অস্বীকার করতাম।”

তার পক্ষে বাইরে যাওয়াটা অনেক ঝুকিপূর্ণ ছিলো এবং বিশেষ করে সৈনিকদের সাথে কথা বলা। আছিয়া তার জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছিলো। কিন্তু সে তার ব্যাপারে বেশ পরিষ্কার ছিলো, কারণ, তার পরিবারের আর কোন আয়ের কোন উৎস ছিলো না। ‘বয়স কম’ – এই ব্যাপারটা তার পক্ষে ছিলো। কারণ সৈন্যরা প্রাপ্তবয়স্কদের সাথে যতোটা কঠোর আচরণ করতো, অল্প বয়স্কদের সাথে তেমনটা করতো না।

আছিয়া জানায়, “সৈন্যরা আমার কাছ থেকে ফুল কিনতো”, এক গুচ্ছ ‘১০ থেকে ১৫ টাকা [ ১.৫০ থেকে ২.০০ ডলার]। এইভাবে আমি আমার পরিবারের জন্য কিছুটা অর্থ উপার্জন করতে শুরু করেছিলাম। এটা ছাড়া আমাদের হয়ত না খেয়ে দিন কাটাতে হতো। আমি আমার ফুল বিমানবন্দরে সেনা ক্যাম্পের কাছে একটা দোকান, যেটা শিক কাবাব বিক্রি করতো সেখানে নিয়ে যেতাম। সৈন্যরা এখানে খেতে আসতো। ফুল বিক্রির জন্য এই জায়গাটা অনেক ভালো ছিলো। ফুল বিক্রি করে আমি মাসে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা উপার্জন করেছি।”

স্বাধীনতার পর, পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশ ছাড়ার পর আছিয়া তার ফুল-বিক্রির স্থান পরিবর্তন করে। “একদিন আমি ঘুরতে ঘুরতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কাছে চলে আসি। বিদেশীরা, বিশেষ করে বিদেশী সাংবাদিকরা, আমার থেকে অনেক ফুল কিনেছে এবং এরজন্য আমাকে অনেক টাকা দিয়েছে। আমি বুঝতে পারতাম একজন বাঙালির কাছে না বিক্রি করে একজন আমেরিকান বা ইউরোপিয়ানের কাছে ছোট্ট একগুচ্ছ ফুল বিক্রি করে আমি বেশী অর্থ উপার্জন করতে পারি। গুণে দেখলাম আমি দিনে ১৫ টাকা আয় করতে পারি। এটা আমার পরিবারের জন্য যথেষ্ট।”

“কিন্তু মাঝে মাঝে এই মূল্যবান জায়গায় দাঁড়ানো মাত্র হোটেলের নিরাপত্তাকর্মী তাকে অপদস্থ করতো। এই স্থানে দাঁড়ানোর অনুমতি দেয়ার বিনিময়ে তারা আছিয়ার কাছে তাদের ইউনিফর্ম এবং পদবী দেখিয়ে ঘুষ দাবী করতো। “সে আমাকে বলতো যদি আমি এখানে দাঁড়িয়ে ফুল বিক্রি করতে চাই তাহলে দিনে তাকে সাত বা আট টাকা দিতে হবে, যা আমার আয়ের অর্ধেক। অবশ্যই আমি এটা দিতে পারব না – কারণ এতে আমার কোন লাভ থাকতোনা। তাই আমি প্রধান সড়কের একটি জায়গায় অবস্থান নেই, যেটা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ঠিক উল্টোপাশে। কিন্তু এখানে বিক্রির সুযোগ খুব কম এবং আমার আয় আগের চাইতে অর্ধেক হয়ে যায়।” এটা আছিয়ার পরিবারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। সে হিসেব করে দেখে ভদ্রভাবে বেঁচে থাকার জন্য তাদের মাসে ৩৫০ টাকা প্রয়োজন। কিন্তু সে যে ২০০ টাকা আয় করে সেটাই তার বেঁচে থাকার সম্বল।

আছিয়া প্রতিদিন স্কুলে যায় এবং ফুল বিক্রির জন্য বের হবার আগে ঘরের টুকিটাকি কাজ করে। “আমি যে ফুল এবং মালা বিক্রি করি সেগুলো আমি ফুলের দোকান থেকে কিনি। দামের পার্থক্য থাকলেও তারা আমাকে ৫ থেকে ৭ টাকায় দেয়। আমি একটি তোড়ার জন্য ১০ থেকে ১৫ টাকা চাই একজন বিদেশীর কাছে।” সে বাঙালিদের কাছে বিক্রি করেনা কারণ তারা তাকে এই দাম দিতে পারেনা। “আমি সন্ধ্যা ৫ টা থেকে ৬ টার দিকে ফুল বিক্রির উদ্যেশ্যে বের হই এবং তার আগে ফুলের দোকানে ফুল কিনতে যাই। কোন কোন দিন আমি ১৫ থেকে ২০ টাকার ফুল কিনি।” এটা অনেকটা জুয়ার মতো। কারণ সে জানেনা এই সব ফুল তার বিক্রি হবে কিনা। “কোন কোন দিন কোন ক্রেতাই আসেনা এবং আমি যতো ফুল কিনেছিলাম সেগুলো সব বিক্রি করতে পারিনা। এমন দিনে আমি তাদেরকে ফুলগুলো এমনিতেই দিয়ে দেই। সাধারণত আমি সন্ধ্যা ৭ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত থাকি। কিন্তু মাঝে মাঝে যেদিন বিক্রি কম হয় সেদিন মধ্যরাত পর্যন্ত বাইরে থাকি।”

যদিও দেরি করার কারণে সে একটু ভীত থাকে, কিন্তু আছিয়া জানে তার আর কোন পথ খোলা নেই। সে যদি টাকা আয় না করে তাহলে ঘরে খাবার থাকবেনা। তার বাড়ীতে ক্ষুধার্ত সবাই অপেক্ষা করতে থাকে কখন সে খাবার কেনার জন্য টাকা নিয়ে ফিরবে এই আশায়।

আছিয়া যখন ফুল কিনতে যায় যখন তার বাবা তার সঙ্গে আসে। সে যখন ফুল বিক্রি করে, তার বাবা সবসময় কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকে, তার দিকে নজর রাখে। নিজে কোন চাকরী না করায় তিনি খুব লজ্জিত থাকেন এই ভেবে যে, তিনি তার পরিবারের জন্য কিছু দিতে পারেন না, এবং পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জন করার জন্য তার ছোট মেয়েকে রাস্তায় পাঠাতে হয়। দূর থেকে মেয়েকে দেখে রাখা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে যেদিন দেশে ফিরে আসেন সেই দিনটি মনে করে আছিয়া রোমাঞ্চিত হয়। তিনি সেদিন বীরের বেশে দেশে ফিরেছিলেন। “সেই দিনের কথা আমার পুরোপুরি মনে আছে। সেখানে একটি প্যারেড ছিলো এবং আমি ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার ফুলগুলো সেদিন মুহূর্তেই বিক্রি হয়ে গেলো কারণ মানুষ খুবই আনন্দিত আর ছুটির আমেজে ছিলো। শেখ মুজিব আসার সাথে সাথে আমি তাকে বড় একটা ফুলের তোড়া উপহার দিলাম। তিনি আমাকে টাকা সাধলেন, আমি নিতে চাইনি, কিন্তু তিনি জোর করে টাকা দিলেন।”

কিছু ছেলে ফুল বিক্রেতা ছিলো, যারা আছিয়ার প্রতিযোগী হিসাবে দেখা দেয়। কিন্তু, মেয়ে হবার কারণে বিদেশীদের তার প্রতি সহানুভূতি বেশী ছিলো। তাই বিদেশীরা তার কাছ থেকে ফুল কিনতেই বেশী আগ্রহী ছিলো। তবে তার একচেটিয়া ব্যবসার দিন আর রইল না।

আছিয়া বলে, “কখনও কখনও আমি ভয় পাই। এক রাতে একজন লোক, যে সম্ভবত মাতাল ছিলো, আমার হাত থেকে ফুল ছিনিয়ে নিয়েছিলো। আমি তাকে প্রতিরোধ করি এবং তার গলা থেকে একটি চেইন ছিঁড়ে ফেলি। আরেকজন লোক আমাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসে বলল, “কেন তুমি এই দরিদ্র মেয়ের থেকে ফুল ছিনিয়ে নিচ্ছ? তোমার এটা করার কোন অধিকার নেই।’ সেখানে আরও অন্যান্য সাক্ষীও ছিলো। তারপর আমি তাকে তার চেইনটা ফেরত দেই এবং সে চলে যায়।”

আছিয়া তার বড় বোন মাবিয়াকে নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ক্র্যাকডাউনের রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন তাদের শক্তি প্রদর্শন করছিলো সেই রাতে তারা মাবিয়াকে অপহরণ করেছিলো। সেনাবাহিনী ধর্ষণের জন্য ও ক্যাম্পে রাখার জন্য অনেক মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো তখন। তার পরিবার জানতনা মাবিয়া মারা গেছে নাকি বেঁচে আছে। স্বাধীনতার পর তারা পাকিস্তানের করাচী থেকে মাবিয়ার দুটি চিঠি পেয়েছে। সে লিখেছিলো সে ভালো আছে এবং সে অনুমতি পেলেই দেশে ফিরে আসবে। কিন্তু হয়ত আর কোনোদিন পরিবারের সাথে তার দেখা হবেনা।

তাকে দিয়ে হয়ত জোর করে চিঠি লেখানো হয়েছে। মাবিয়ার মতো যারা সুন্দরী মেয়ে ছিলো তারা কেউ কোনোদিন আর পরিবারের কাছে ফিরে আসতে পারেনি। এমনকি যদি ফিরেও আসে এদেরকে সইতে হয়েছে নানা বঞ্চনা। যে মেয়েদেরকে পাকিস্তানি সৈন্যরা হত্যা করেনি তারা ফিরে এসে অনেকেই বস্তিতে চলে যেতো। তারা হয় পতিতাবৃত্তি, নাহয় ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন ধারণ করতো। কারণ এমন মেয়েদেরকে কেউ বিয়ে করতে চাইতো না।

যদিও পাকিস্তানি সৈন্যরা আছিয়ার মতো মুসলমান, কিন্তু সে তাদেরকে কাফের বলে মনে করে। কারণ তারা বাঙালি মুসলমানদের দমন করতে এসেছিলো। যুদ্ধ এবং গোলাবর্ষণের প্রায় মাঝখানেই তাদের বাড়ী ছিলো। “আমরা এয়ারপোর্টের পাশে অবস্থিত ক্যান্টনমেন্টের খুব কাছেই বসবাস করতাম। শেলিং এর ভয়ে থাকতাম সব সময়। এবং আমি আমার ফুলগুলো নিয়ে একটি খালি পানির ট্যাংকের ভিতরে আশ্রয় নিতাম। কিন্তু আমি যখনই সুযোগ পেতাম তখনি ফুল বিক্রি করার চেষ্টা করতাম।”

যখন আছিয়া বিহারী মেয়ে হিসাবে ভান করতো এবং সৈন্যদের সাথে উর্দুতে কথা বলত, সেই সময় একদিন একটি ঘটনা ঘটল। “একদিন সৈন্যরা আমাকে আমার বাবার কাছে এনে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। বাবাও অনেক ভালো উর্দু বলতে পারতেন। তিনি উর্দুতে কথা বলতে শুরু করেন। তাই আমরা বিহারীদের মতো থাকতে সক্ষম হয়েছিলাম।” আছিয়া পাকিস্তানি সৈন্যদের নিজেদের মধ্যকার কথাবার্তা শুনে আরও কিছু বিহারী শব্দ রপ্ত করেছিলো। একইভাবে ঢাকার বিদেশীদের কথা শুনে সে কিছু ইংরেজি শিখে নিয়েছিলো। তার যেটুকু জানা দরকার সেটুকু সে শিখেছে।

সৈন্যদের ভয় পাবার মতো কারণ আছিয়ার ছিলো। “একদিন পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি ট্রাক আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তারা দুইজন বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীকে তাদের চুল ধরে মারতে শুরু করলো। ওরা ছিলো ভাই-বোন। সৈন্যরা ওদের রাইফেলের বাট দিয়ে মারছিলো যতোক্ষণ না তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাদের শরীরের বেশ কয়েকটি স্থান থেকে রক্ত ঝরছিলো। তারপর ছেলেটিকে সৈন্যরা গুলি করে। এবং মেয়েটিকে ট্রাকে করে ধরে নিয়ে যায়।” সম্ভবত তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে, এবং তার নাম হয়েছে বীরাঙ্গনাদের তালিকায় – যাদের আমরা বলি ‘ক্ষতিগ্রস্ত নারী’, অথবা ‘বীরাঙ্গনা’। আছিয়া ভয় পেত এই ভেবে যে একই রকম পরিস্থিতি তারও হতে পারতো। কিন্তু সে বিহারী হবার ভান করায় এবং সম্ভবত বয়স খুব কম হওয়ায় সৈন্যরা তাকে তুলে নিয়ে যায়নি।

“আমি ভারত আর পাকিস্তানের বিমানের লড়াইও দেখেছি এবং সেই সময় আমি খুবই ভয় পেয়েছিলাম। প্রচুর শেলিং হচ্চিলো। আমাদের পুরো পরিবার জড়সড় হয়ে ছিলাম এবং দোয়া পড়ছিলাম।”

ডিসেম্বর ১৯৭১ এর দিকে যুদ্ধ শেষের আগ দিয়ে যখন বোমাবর্ষণ আরও বাড়ল আছিয়ার পরিবার তখন ফরিদপুরে তাদের গ্রামে ফিরে গেলো। এই এলাকাতেই শেখ মুজিবের জন্ম। “যেহেতু পরিবহনের কোন খরচ আমাদের কাছে ছিলোনা তাই ফরিদপুর পর্যন্ত আমরা হেঁটে গেলাম। সেখানে যেতে আমাদের তিনদিন লাগলো। রাস্তায় খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য আমাদের সব কিছু আমরা বিক্রি করে দিতে হলো।” জানুয়ারিতে শেখ মুজিব দেশে ফিরে আসার কিছুদিন আগে তারা আবার ঢাকায় ফিরে আসে।

দেশ স্বাধীন হওয়া এবং শেখ মুজিব দেশে ফেরার কারণে আছিয়া তার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক আশান্বিত হলো। সে নতুন দেশ নিয়েও অনেক আশাবাদী। এবং পাকিস্তানি বাহিনী ফিরে যাওয়া মানে তারা এখন নিরাপদে জীবন যাপন করতে পারবে। কিন্তু করাচীতে বন্দী বোনের কথা ভেবে তার দুশ্চিন্তা লেগেই থাকলো।

আছিয়ার মাত্র দুই সেট জামা আছে। দুটোই তার অবস্থা দেখেছে তাকে বিদেশীরা দিয়েছে। আছিয়ার বাড়ী, যার মাসিক ভারা ২০ টাকা (৩ ডলার), সেটার অবস্থা খুবই শোচনীয়। এটি একটি কাঁচা ঘর – যা দ্বিতীয় শ্রেণির থেকেও অনেক খারাপ। “আমার পুরো পরিবার – মা-বাবা, ভাইয়েরা, বোনেরা, আমরা সবাই ময়লা মাটিতে একটি পাটি বিছিয়ে একই বিছানায় ঘুমাই। যখন বৃষ্টি হয়, ঘরে পানি চলে আসে, ঘরের ভেতর কাদা হয়ে যায়। এই ছোট্ট অসহনীয় ঘরে একটি পরিবারের পক্ষে বাস করা সম্ভব নয়। আমরা খুব চাই এখান থেকে চলে যেতে। আমরা ঢাকার একটি ভালো বাড়ীতে উঠতে চাই। কিন্তু তা অসম্ভব, কারণ ভাড়া অনেক বেশী।” এদিকে তার আয় কমে গেছে। এই অবস্থায় এখান থেকে ভালো কোথাও যাবার কথা চিন্তা করাও দুরহ।

“আমরা খাবার পানি পাই বাইরের একটি ট্যাপ থেকে। এটা অনেকেই ব্যবহার করে। আমরা আমাদের কাপড় ধোয়া ও গোসলের কাজও সেখানে করি। যদিও আমাদের ঘরের পেছনে একটি লেকের মতো জায়গায় অনেক পানি আছে কিন্তু সেটা ব্যবহারযোগ্য না। ঘরে আলো জ্বালানোর জন্য আমাদের একটি কেরোসিন কুপি আছে।”

আছিয়া ও তার পরিবারের প্রতিদিনের খাবার তালিকা খুব সাধারণ মানের বাঙালি খাবার। “সকালে আমরা রুটি খাই। এর সাথে ব্যবস্থা করতে পারলে অনেক সময় চা খাই, আর যদি চায়ের ব্যবস্থা না হয় তাহলে শুকনো রুটি খেয়ে ফেলি। এটা আমরা খুব সকালে – প্রায় সাতটার দিকে খাই। দুপুরের পরে আমরা ভাত খাই। রাতে আবারো রুটি। কারণ চাল অনেক দামী। গম চালের চাইতে সস্তা এবং একারণে আমরা দুইবার রুটি খাই। মাঝে মাঝে যখন আমার সামর্থ্য হয় তখন আমি বাজার থেকে মাছ বা মাংস কিনি – কিন্তু সেরকমটা খুব কম হয়। যখন আমি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কাছে ফুল বিক্রি করতাম, তখন আমার মাসিক আয় বেশী ছিলো। তখন খাবারের পেছনে ব্যয় করার জন্য আমাদের আরও কিছু টাকা থাকতো। তখন আমরা মাছ-মাংস বেশী খেয়েছি।”

যদিও আছিয়া অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে কিন্তু সে ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ভালো পরিবেশে থাকলে তার কমপক্ষে ক্লাস সিক্সে থাকার কথা ছিলো। কিন্তু পড়তে হলে তাকে তার স্কুলের খরচ দিতে হবে, যে কারণে তার স্কুল শুরু করতে বিলম্ব হয়। “প্রতি মাসে স্কুলে পড়তে হলে আমাকে অবশ্যই ১৫ টাকা দিতে হবে। যদিও একটি বিনামূল্যের স্কুল আছে, কিন্তু আমার মনে হয়না সেখানে যাওয়ার কোন মানে আছে। সেখানে ছাত্রছাত্রীরা মনোযোগী না এবং শিক্ষকরা ঠিক মতো পড়ান না। সেখানে অনেক গোলমাল হয়। এবং পড়াশোনা তেমন হয়না।” তাই সে যেখানে ভালো পড়ায় সেখানে টাকা দিয়ে পড়ে। আছিয়া স্কুলে দিনে ৪ ঘণ্টা থাকে। সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত। যদিও সে স্কুলে ইংরেজি পড়ে তথাপি সে বেশিরভাগ ইংরেজি শিখেছে বিদেশীদের সাথে কথা বলে বলে।

আছিয়ার সব বই নেই। কারণ তার সব কেনার সামর্থ্য নাই। মাঝে মাঝে সে তার সহপাঠীদের কাছ থেকে বই ধার করে। এত বাধার পরেও সে পড়তে পছন্দ করে এবং জানে যে যদি সে আগেই স্কুলে ভর্তি হতে পারতো তাহলে আরও বড় ক্লাসে পড়তে পারতো। যদি সে আরও বেশী টাকা আয় করতে পারতো, সে বাসায় একজন গৃহশিক্ষক রাখতে পারতো, যে তাকে আরও গাইড দিতো এবং তার পড়াশোনার গতি আরও বাড়তো। এর জন্য তার মাসে আরও ২০ থেকে ৩০ টাকা দরকার। আছিয়া তবুও বিশ্বাস করে যে সে তার বেসিক স্কুলিং শেষ করতে পারবে এবং কলেজে যেতে পারবে। এবং তার লক্ষ্য একজন সাংবাদিক হওয়া।

আছিয়া বলে, “আমার সাংবাদিক হতে খুব ইচ্ছে করে”। এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার যে যেহেতু সে মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরিবর্তী সময়ে সাংবাদিকদের আসা-যাওয়া লক্ষ্য করেছে, তাই তার এই ইচ্ছাটা হয়েছে। যদিও আছিয়ার একটি পত্রিকা কিনে পড়ার সামর্থ্য নেই তবুও সে জানে একজন সাংবাদিক কী করে। “যদি সাংবাদিক হতে পারি, আমি অনেক ঘুরতে পারবো এবং বিদেশে ভ্রমণ করতে পারবো। সেখানে আমি সংবাদ সংগ্রহ করতে পারব এবং অনেক ঘটনা খুঁজে বের করতে পারবো।” সম্ভবত যেহেতু সে এত বেশী সাংবাদিক দেখেছে যে তার ভেতরে ঘোরাফেরা করার একটা প্রবল আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সে তার স্বপ্নের দেশগুলোতে ঘুরতে যেতে চায়।

“আমি মনে করি, আমি সেখানকার অনেক গোপনীয় ঘটনা উদঘাটন করতে পারবো এবং অনেক কিছু জানতে পারবো।” আমরা যাদের ইন্টারভিউ নিয়েছি তাদের বেশীরভাগ তরুণ-তরুণীর মতো আছিয়া বাংলাদেশে থাকতে চায় না। সে জানায়, যদি সে পছন্দমতো কোন দেশ খুঁজে পায় তাহলে সে সেখানে থেকে যাবে। কারণ সে দেখেছে যে এই সমাজে সে সমালোচিত না হয়ে থাকতে পারেনা। পশ্চিমা দেশ সম্পর্কে সে মনে করে সেখানে আরও বেশী স্বাধীনতা আছে। এবং একজন রিপোর্টার হিসেবে সে অন্যের স্বাধীনতা নিয়েও কাজ করতে পারবে। আমেরিকা সম্পর্কে তার ধারণা, এটি খুব সুখী একটি দেশ। এখানে কোন দুঃখ নেই, কষ্ট নেই। এটি একটি স্বপ্নের মতো দেশ, যেখানে সবাই সুখী এবং প্রত্যেকেই জীবনকে উপভোগ করছে। তুলনামূলকভাবে তার দৃষ্টিভঙ্গি আমেরিকানদের মতো – রাশিয়ানদের মতো নয়। “রাশিয়ানরা আমার ফুল খুব কম কেনে। কিন্তু আমেরিকানরা বেশী কেনে এবং আমাকে বেশী টাকা দেয়।” সে লক্ষ্য করেছে, আমেরিকানদের ‘প্রচুর টাকা’ আছে। এগারো বছর হলেও তার দৃষ্টিভঙ্গি অবাক করার মতো।

“একদিন যখন আমি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের পাশে ফুল বিক্রি করছিলাম, তখন একজন জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেতা অলিভিয়া আমার সাথে কথা বলার জন্য দাঁড়ালেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কেন ফুল বিক্রি করছি এবং আমি তাকে আমার পরিবার সম্পর্কে বললাম। তখন সে আমাকে সিনেমায় অভিনয়ের একটা হাল্কা সুযোগ দেবার প্রস্তাব দিলো।’ কিন্তু আছিয়ার পরিবার এতে পুরোপুরি বাধা দেয়। ফিল্মে কাজ করা এদেশে খুব একটা সন্মানজনক পেশা ধরা হয়না। যদিও সে প্রচুর টাকা আয় করতে পারতো, তবে তার সন্মান চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে যেতো। অবাক করার বিষয় হলো, তার পরিবার যখন অভিনয় করতে বাধা দিলো সে তাতে মনঃক্ষুণ্ণ হয়নি। কারণ তার দৃষ্টিভঙ্গি তার পরিবারের মতই। সে মনে করে তার পরিবারের সিদ্ধান্ত তার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত। টাকা আয় করার চাইতে তার সন্মান বেশী গুরুত্তপূর্ণ। এই দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের মাঝে গভীরভাবে গেঁথে আছে এবং আছিয়া যদিও সম্পূর্ণ স্বাধীন একজন মানুষ তবুও তার চিন্তার সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

যদিও আছিয়া সব সময় হাসিখুশি থাকে তবুও সে তার বাকি সহপাঠীদের সাথে তার দূরত্বের ব্যাপারে সচেতন। তার সহপাঠীদের সবারই অনেক কিছু আছে যা তারও পেতে ইচ্ছা করে, এমনকি পড়াশোনার সুযোগটাও। তাদের কাছে বই আছে যা তারও দরকার। এবং সে বিব্রত বোধ করে কারণ তাকে ফুলই বিক্রি করতে হবে এবং এই কাজটা সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন কিছু নয়।

যেহেতু তার সহপাঠীদের চাইতে সে বয়সে বড় তাই তার বন্ধু নেই বললেই চলে। এবং যেহেতু সে আরও বৃহৎ পরিসরে চলাফেরা করে তাই এটাই স্বাভাবিক যে তার বন্ধুরা তার চাইতেও বয়সে বড় হবে। প্রকৃতপক্ষে তার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবীর বয়স ১৬ বছর যার সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে এবং যে অন্য রকম জীবন যাপন করছে। কাজেই আছিয়া অনেকটাই তার নিজের মতো করেই বেঁচে আছে।

যতোটুকু সময় সে তার বিনোদনের জন্য পায় সেই সময়টা সে তার ভাইবোনদের সাথে কাটায়। সে বলে অন্য শিশুদের সাথে সময় কাটালে সে আদৌ কোন আনন্দ পাবে কিনা সে ব্যাপারে সে সন্দিহান। এবং সে সব সময় তার যে বোনটিকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তার ব্যাপারে দুশ্চিন্তায় থাকে।

যদি আছিয়া তার এই দায়িত্বের বোঝা থেকে কখনো মুক্তি পায় এবং স্কুলে আরও বেশী সময় কাটাতে পারে তবে তার পরিবারকে নিশ্চই আয়ের বিকল্প পথ খুঁজে বের করতে হবে। একটা পথ হতে পারে যদি তার বাবা একটি মুদি দোকান চালাতে পারে। এবং সেখানে চাল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করতে পারে। এধরনের একটি মুদি দোকান খুলতে প্রাথমিকভাবে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা দরকার। এতে করে দিনে ২০ টাকা আয় হবে। অথবা বলা যায় পরিবারের খরচ চালানোর জন্য তখন যথেষ্ট আয় হবে।

দোকান হোক বা না হোক, খুব দ্রুত আছিয়াকে ফুল বিক্রি বন্ধ করতে হবে। “আমি জানি যখন আমি আরেকটু বড় হব, এবং আমাকে আরও একটু পরিণত মেয়েদের মতো লাগবে, তখন আমার পক্ষে রাস্তায় রাস্তায় ফুল বিক্রি করাটা কঠিন হবে।” তখন তাকে অনেক অপদস্থ হতে হবে এবং তার সন্মানহানি হবে। প্রতিটি দিন পেরুনোর সাথে সাথে আছিয়ার ফুল বিক্রির দিন শেষ হতে থাকে এবং তার পরিবার একমাত্র আয়ের উৎস হারানোর দুশ্চিন্তায় আরও বেশী মুষড়ে পড়তে থাকে। কেউ জানেনা, যখন আছিয়া জেসমিন একজন পরিণত নারীতে রূপান্তরিত হবে তখন তাদের ভাগ্যে কী হবে।

মোমিন উল্লাহ
ষোলো বছর
রিকশাওয়ালা

গ্রামের একটি ছেলের জন্য ‘শহর’ মানে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি। বিশেষত সে যদি তার বাবার জন্য অর্থনৈতিক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এবং তাই, চৌদ্দ বছর বয়সে, মোমিন উল্লাহ অনেক আশা নিয়ে ঢাকার পথে একটি কঠিন ও বিপজ্জনক যাত্রা শুরু করে।

সে মাত্র ৫ টাকা (এক ডলারেরও কম) নিয়ে গ্রামের বাড়ী নোয়াখালী জেলার দেলাই গ্রাম ছাড়ে। এই টাকা সে পেয়েছিলো নারিকেল এবং সুপারি বিক্রি করে। ঢাকা থেকে প্রায় ৭৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত দেলাই গ্রাম হতে চাঁদপুরের ট্রেন ধরতে মোমিন উল্লাহকে ৩ মাইল হেঁটে স্টেশনে যেতে হয়েছিলো। সেখান থেকে সে স্টিমারে মেঘনা নদী পার হয়। অতঃপর বাসে করে কিছুদূর যায়। এরপর আবারো স্টিমারে ওঠে এবং ঢাকার ফেরিঘাটে পৌঁছে। যদিও ঢাকা থেকে নোয়াখালীর সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথের দূরত্ব ৭৫ মাইল, তবুও এই ঘুরপথে তাকে আসতে হয় কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো ছিলোনা।

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল সমতল ও অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকা হওয়ায় নদীগুলো এখানে যোগাযোগের ভালো মাধ্যম তৈরি করেছে। আবার এসব নদীর উপরের অনেক সড়ক সেতু যুদ্ধের সময় ধ্বংস করে ফেলায় মোমিনের মতো অনেককেই কিছুদূর সড়ক পথ আর কিছুদূর নদীপথে পাড়ি দিতে হয়েছে।

যুদ্ধের কয়েক মাস পরেই মোমিন একা একা এতটা কঠিন একটা পথ পার হয়ে এসেছে। এতে সে সত্যিই যথেষ্ট সাহস ও উচ্চাশার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু এতে ঢাকা শহরের মতো নিষ্ঠুর পরিবেশে যেখানে ইতোমধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ মানুষ কাজের খোঁজ করছে সেখানে টিকে থাকার প্রস্তুতি মোমিনের নেই। ঢাকা আসার পথে সকল অর্থ শেষ হয়ে যাওয়ায় প্রথমদিন মোমিনকে না খেয়ে দিন পার করতে হয়েছে। কল্পনা করুন, একটি ঘনবসতিপূর্ণ শহরে আপনি কাউকে চেনেন না এবং চাকরী বা টাকা পাবার কোন সম্ভাবনা সেখানে নেই। তারপর কল্পনা করুন আপনার কোন দক্ষতা নেই, নেই কোন শিক্ষা। একা একা এই ঢাকা শহরে প্রথম চব্বিশ ঘণ্টায় ক্ষুধার্থ মোমিনের মাথায় একটি চিন্তাই শুধু ঘুরপাক খেয়েছে – আর তা হলো ‘স্যালভেশন’ – জীবনের জন্য টিকে থাকা।

মোমিন বলছিলো, “’ঢাকা আসার পর প্রথমে আমার মনে হয়েছে এটা খুবই আশ্চর্যজনক একটি শহর। কিন্তু অল্প কিছুদিন পর আমি বুঝতে পারি এটা শুধু বড়লোকদের শহর। গরিব লোক যাদের কোন টাকা নেই, চাকরী নেই, তাদের জন্য ক্ষুধা, অভাব আর মৃত্যু নিশ্চিত।”

প্রথম দিনের ভীতিকর সময় পার করার পর মোমিনের ভাগ্য প্রসন্ন হতে শুরু করে। নিজের জেলার একজন ভালো মানুষের সাথে তার পরিচয় হয়। সেই মানুষটি মোমিনকে কিছু টাকা ও খাবার দেয় । সে মোমিনকে একটি চায়ের দোকানে চা-কেক এগিয়ে দেয়ার চাকরীও জোগাড় করে দেয়।

২ মাস ধরে এই চৌদ্দ বছরের ছেলেটি দিনে ১৬ ঘণ্টা করে কাজ করে। মাসে মাত্র ২০ টাকা (মাত্র তিন ডলার) বেতনের জন্য এই ছেলেটি প্রতিদিন সকালে ৬ টা থেকে দুপুর ২ টা, এরপর বিকেল ৪ টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করতো। সাথে জুটতো বঞ্চনা। কাজের চাপে ভবিষ্যতের কথা ভাবার সময় তার হতো না। দোকান বন্ধ হলে চায়ের টেবিলে ঘুমানোর অনুমতি পাওয়াতেই সে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতো। শেষ পর্যন্ত যখন মোমিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম, স্বল্প বেতন, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনে অতিস্ট হয়ে গিয়েছিলো তখন তার দেশী সাহায্যকারী আবারো তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। সে মোমিনকে রিকশা চালানো শিখিয়ে দেয়। সে ছেলেটিকে একজন রিকশাওয়ালার কাজ জুটিয়ে দেয়। ঢাকার ব্যস্ত শহরে সে প্যাডেল করে চলে। অল্প কিছু কাজের জন্য যখন এত এত মানুষ প্রতিযোগিতা করছে সেই সময়ে এমন একজন মানুষ সে পায় যে তাকে কিছু একটা কাজ জুটিয়ে দেয়। এইটুকু সৌভাগ্যবান তাকে বলতেই হয়।

উন্নয়নশীল দেশে শুধুমাত্র ধনী ও আমলাদের গাড়ি থাকে। সাধারণ মানুষরা রিকশাতেই চলাফেরা করে। এমনকি ভিয়েতনামে হো-চি-মিন ট্রেইলও বাইসাইকেল চলার জন্য খোলা রাখতে হয়। বাংলাদেশের মানুষ রিকশায় অনেক দূরের পথ ভ্রমণ করে। সত্যিকার অর্থে, অল্প কিছু বিকল্পই আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক বাস ধ্বংস হয়েছে এবং যে কয়টি আছে সেগুলোতে প্রচণ্ড ভীড়।

বয়স ১৪ হলেও মোমিন একজন রিকশাওয়ালা হিসেবে তার কাজ শুরু করে। দিনে ২০ থেকে ২৫ টাকা আয় করে। এর মধ্যে ১০ টাকা তাকে রিকশার ভাড়া হিসেবে দিতে হয়। মোমিনের বয়স এতই কম যে রিকশা চালানোর মতো শ্রমসাধ্য কাজ করার জন্য সে পুরোপুরি সমর্থ নয়। এছাড়া তাকে তার চাইতে বয়স্ক এবং দক্ষ চালকদের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হয়। এই দক্ষ রিকশাচালকেরা বিদেশীদের তার রিকশায় তুলতে বাধা সৃষ্টি করে। কারণ বিদেশীরা দ্বিগুণ ভাড়া দেয় যা বাঙালিরা দেয় না। কিন্তু মোমিন কিছুটা আত্মনির্ভরশীল হয়েছে এবং মাসে মাসে কিছু টাকা সঞ্চয় করে – ১৫ থেকে ২০ টাকার মতো – যা সে বাড়ীতে বাবা-মা ও দুই বোনের কাছে পাঠায়।

মোমিন যখন ঢাকা আসে তখন সে কীই বা আশা করেছিলো? হয়ত যখন বাড়ী থেকে বেরিয়েছিলো তখন অনেক আশাই ছিলো তার মনে। নতুন জাতি হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি অনেক বিশাল। প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিব জনগণকে অনেক প্রেরণা জুগিয়েছেন।

মোমিন বলে, ‘আমি ভেবেছিলাম কোন সরকারি কর্মচারীর বাড়ীতে কাজ করব, এমন কেউ যে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল। আমি ভেবেছিলাম কিছুদিন আমি গৃহকর্মীর কাজ করব। এবং চেষ্টা করব মালিককে আমাকে একটা চাকরী জোগাড় করে দিতে। আমি ভেবেছিলাম এভাবে আমি কিছু টাকা উপার্জন করব এবং বাড়ীতে আমার ভাই-বোনদের পড়াশোনার খরচ দেব আর সংসারের খরচের জন্য কিছু পাঠাবো।’

যদিও মোমিনকে দেখলে মনে হয় সে লুঙ্গি পরা; লুঙ্গি এটি একটি ট্র্যাডিশনাল ‘অল-পারপাস’ পোশাক। তবে সে যেটা পরে সেটা হলো একটা চাদর। সে এটা শরীরের চারপাশে এমনভাবে জড়িয়ে রাখে যেন মনে হয় এটা একটা লুঙ্গি। এর সামনে একটা বিশেষ গিট্টূ থাকে। এই গিট্টুর মাঝে সে যত্নের সাথে তার টাকাপয়সা রাখে। কারণ তার কোন পকেট নেই – বা টাকা রাখার আর কিছু নেই। সে খালি পায়ে থাকে। একটি জামা ও এক জোড়া পায়জামা ছাড়া তার আর কিছুই নেই।

এই অবস্থায় তার স্বাস্থ্যের অবস্থা খুবই খারাপ হয়। সম্ভবত মোমিনের মারাত্মক আমাশয় হয়। প্রায় তিন সপ্তাহ সে প্রচণ্ড জ্বর ও আমাশয়ে ভোগে। সে হাসপাতালে যেতে পারছিলোনা। এবং ওষুধ কিনতে তার সমস্ত টাকা শেষ হয়ে যায়। চল্লিশ টাকা। এই টাকা ম্যানেজ করতে তাকে আরও ১৮ টাকা ধার করতে হয়। সুস্থ হয়ে ওঠার পর সে আবার কাজ শুরু করে এবং মাথায় ঋণের বোঝা যুক্ত হয়।

আবারো মোমিন পায়ের উপর নির্ভর করে ঢাকার রাস্তায় প্যাডেল চালাতে শুরু করে প্যাসেঞ্জারের আশায়। রবিবারে সে চেষ্টা করে কিছু অতিরিক্ত টাকা আয় করতে। সেই উদ্যেশ্যে সে সিনেমা হলগুলোর আশেপাশে রিকশা চালায় যেখানে মর্নিং শো চলে। এভাবে সে প্রায় ২০ থেকে ২৫ টাকা আয় করে। কখনো কখনো সে অফিস ছুটির সময়ে মতিঝিলে অবস্থান নেয় – যেটি ঢাকার একটি ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা। অথবা সে এমন একটি জায়গা বেছে নেয় যেখানে পরিবহনের মাধ্যম কম। যেমন, সরু কোন রাস্তা যেখানে অটো রিকশা বা কোন গাড়ি ঢুকতে পারেনা। (অটোরিকশার আরেকটি নাম ‘বেবি ট্যাক্সি’, যার পেছনে যাত্রী বসার জন্য একটি বেঞ্চের মতো স্থান থাকে)। এখন সে ভালো পরিমাণেই যাত্রী পায়।

মোমিন নিঃসন্দেহে একটি বুদ্ধিমান ছেলে – যে কেউ তার চোখের দিকে তাকালে তা বুঝতে পারবে। পাঁচ ঘণ্টার সাক্ষাৎকারে তার দেয়া উত্তরগুলো একদম সোজা এবং কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে সে অস্বস্তি বোধ করেনি। দুঃখজনক এটাই যে, যদি সে শিক্ষিত হতো, সে দেশকে আরও বেশী কিছু দিতে পারতো। পঞ্চম শ্রেণির পর তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় এবং আর কোনোদিন স্কুলে যাবার কথা সে ভাবতেও পারেনি। যদিও সে বুঝতে পারে যে ভালো পড়াশোনা থাকলে সে আরও কম শ্রমসাধ্য কাজ করতে পারতো।
মোমিনের অর্থনৈতিক সমস্যার সাথে যোগ হয় দুর্ঘটনার ঝুঁকি। ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বা ক্ষতির জন্য কোন ইনস্যুরেন্সের ব্যবস্থা নেই। এমনকি যদি রিকশা কোন গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগে সেক্ষেত্রেও কিছু করনীয় নেই। সে শুধু ড্রাইভার বা প্যাসেঞ্জারের কাছে কিছু সাহায্য চাইতে পারে। কিন্তু প্রায়ই যারা গাড়ির মালিক তারা উঁচু স্তরের মানুষ, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ড্রাইভার অভিযোগ অস্বীকার করে এবং দুর্ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত সরে পড়ে। তাই রিকশাওয়ালাকে অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণের বোঝা বইতে হয় যা দেয়া বেশিরভাগ সময় তার পক্ষে সম্ভব হয়না। যদি তার টায়ার নষ্ট হয় তাকে অবশ্যই সেটা মেরামতের মজুরি দিতে হবে। এবং অবশ্যই এই মেরামতকালীন সময়ে তার যথেষ্ট সময়ও নষ্ট হয়।

প্রতিদিন মোমিন উল্লাহর আসল চিন্তা থাকে কিভাবে বেঁচে থাকা যায় তা নিয়ে। দিনে সে যা আয় করে তা দিয়ে নির্ধারন হয় সে কী খেতে পারবে। দুপুরে হয়ত ভাতের সাথে সে একটি তরকারি – হয় সবজি বা গরু বা খাসির মাংস খায়। (যেহেতু মোমিন মুসলমান, তাই সে শুকরের মাংস খায় না)। কিন্তু যদি সে তা কিনতে না পারে তাহলে সে রুটি খায় যা ভাতের চেয়ে কম দামী। এবং এর সাথে একটু ডাল খায় স্বাদের জন্য। রাতে আবারো রুটি আর তরকারি খায়। দিনে গড়ে খাবারের জন্য সে চার টাকা খরচ করে।

মোমিন শনিবার কাজ করেনা। এই দিনে সে নিজেকে বিশ্রাম দেয় পুনরায় উজ্জীবিত হওয়ার জন্য। ‘আমি সেদিন যথেষ্ট পরিমাণ ঘুমাই এবং খাওয়া দাওয়া করি। এবং সন্ধ্যায় আমি ঢাকা স্টেডিয়ামে যাই ফুটবল ম্যাচ দেখতে। প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে আমি হাই কোর্টে যাই বাউল গান শুনতে।’

বাঙালি বাউলরা হলেন ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ফোক হিরো’। তারা সাধুদের মতো জীবনধারণ করতে পছন্দ করেন। তারা সারা দেশ ঘুরে বেড়ান। সাথে নিয়ে যান মানুষের গান। হাই কোর্টের জনসমাগমে মোমিন তার দুঃখকষ্ট লাঘবের চেষ্টা করে। ‘হাই কোর্ট’ একটি পার্কের সাধারণ নাম যেখানে একটি আইনি আদালত রয়েছে এবং পাশাপাশি একটি বড় খোলা জায়গা রয়েছে। এখানে অনেক লোকজন আসে। এসে আনন্দ করে; সময় কাটায়। মাঝে মাঝে আয়েশ করে তারা সিগারেট, বিড়ি (সাধারণ তামাকে তৈরি সস্তা সিগারেট) খায়।

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে ঢাকা রওনা দেবার আগে মোমিন তার অঞ্চলে, তার নিজেরই গ্রামেই যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছে। সে দেখেছে পাকিস্তানি সেনারা কিভাবে তাদের বাড়ী পুড়িয়ে দিয়েছে। তাদের গ্রামের বাকি সব ঘরগুলোও সেনাবাহিনী জ্বালিয়ে দেয়। তারা সন্দেহ করেছিলো সেখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে। কারণ গ্রামের লোকজন তাদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলনা। মোমিন জানত তার এক চাচা মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তার পরিবারের কাউকে হত্যা করা হয়নি। যদিও গ্রামের কয়েকজনকে তারা হত্যা করেছিলো।

যুদ্ধের সময় অনেক সুন্দরী যুবতি মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তাদেরকে ক্যান্টনমেন্টে চালান দেয়া হয়, এবং সৈন্যরা তাদের ধর্ষণ করে। এই মেয়েগুলো গ্রাম থেকে হারিয়ে গেছে, এবং সম্ভবত কোনোদিনও তারা ফিরে আসবেনা। কাউকে ক্যাম্পে হত্যা করা হয়েছে, কেউ আত্মহত্যা করেছে, আর কাউকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে তাদেরকে যৌনদাসী হিসেবে রাখা হচ্ছে। এঁদের কয়েকজনের জন্য সরকার কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। সরকারিভাবে কিছু এবরশন ক্লিনিক খোলা হয়েছে – যাতে করে ‘ক্ষতিগ্রস্ত নারী’ বা ‘বীরাঙ্গনা’রা যথাযথ চিকিৎসা পান।

মোমিনের কাছে মুক্তিবাহিনীর দেশ স্বাধীন করার বিষয়টা অবিশ্বাস্য লেগেছে। সে স্বভাবতই ভেবেছিলো পাকিস্তানি সেনারা অনেক শক্তিশালী – তাদের বিরুদ্ধে জেতার কোন সম্ভাবনা নেই। এই অনুভূতিটা আরও গেঁথে গিয়েছিলো যখন পাকিস্তান আর্মি তথাকথিত ‘শান্তি কমিটি’ তৈরি করে দিয়েছিলো স্থানীয়ভাবে। এইসকল প্রতিনিধি বা কমিশনাররা ছিলো স্থানীয় বাঙালি যাদের কাজ ছিলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করা – গ্রামে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক সৃষ্ট ‘সন্ত্রাস’ নির্মূল করা।

কিন্তু মোমিনের গ্রামে মুক্তিবাহিনী শান্তি কমিটির কমিশনারকে গুলি করে হত্যা করে। অন্যান্য সহায়তাকারীরা তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পরিচয় পরিবর্তন করে এবং মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। যেহেতু মোমিনের গ্রামে ভারতীয় সেনাবাহিনী আসেনি তাই মুক্তিযুদ্ধের সফলতায় তাদের বড় রকমের ভূমিকার ব্যাপারে মোমিনের কোন ধারণা ছিলোনা।

যুদ্ধের শেষ দিকে যদিও সে জানতে পেরেছিলো যে পাকিস্তান ও ভারতীয় সেনাদের মধ্যে যুদ্ধ চলছে এবং সে নিশ্চিত ছিলো যে ভারতীয় সেনারা তাদের দেশের স্বাধীনতা অর্জনে সাহায্য করবে।

কিসের আশায় মোমিন উল্লাহ ঢাকা এসেছিলো? “আমি ভেবেছিলাম যদি বাংলাদেশ স্বাধীন হয় এবং সব কিছু আমাদের হাতে আসে তাহলে আমাদের নাটকীয় উন্নয়ন হবে এবং দেশ আরও এগিয়ে যাবে। সবাই খুশিতে হাসবে। আমি ভেবেছিলাম ঢাকার পরিস্থিতি আমার গ্রামের চাইতে আরও ভালো হবে এবং আমি এখানে আরও ভালো জীবন যাপন করতে পারবো।”

রিকশাওয়ালা হিসেবে প্রথম দুই বছর মোমিন তার পরিবারকে মাত্র দুইবার দেখার সুযোগ পেয়েছে। এই একাকীত্ব খুবই কষ্টদায়ক। সে জানে পারিবারিক বন্ধন খুব জরুরী, কিন্ত বাড়ীর পথের যাত্রা বেশ দীর্ঘ এবং ব্যয়বহুল। এবং যে সময়টা সে বাড়ীতে থাকে তখন টাকা শেষ হয়ে যায়। তাই সে প্রতি মাসে বাড়ী থেকে যে ১/২ টা চিঠি আসে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। অনিয়মিত পত্র যোগাযোগ বাড়ীর সাথে তার দূরত্বকে বাড়াতে থাকে।

ধর্ম বাঙালিদের জীবনে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। এর প্রতি কিছুটা দায়বোধ তারা বহন করে। মোমিন উল্লাহ তা পূরণ করতে পারেনা। সে বলে, ‘আমি ধার্মিক, কিন্তু আমি নিয়মিত নামাজ পড়তে পারিনা। যেমনটা আমি আমার গ্রামে পড়তাম। নামাজের মূল নিয়ম অনুসারে একজনকে অবশ্যই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে। তাকে সঠিকভাবে পোশাক পরতে হবে এবং শরীর ঢাকতে হবে। আমার কোন ভালো পোশাক নাই। পরিষ্কার কাপড় নাই। তাই আমি মনে মনে প্রার্থনা করি। প্রথাগত পদ্ধতির বাইরে আমি আল্লাহর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করি।’

সুদূর ভবিষ্যতে, মোমিন উল্লাহ সে আশা করে মা-বাবার পছন্দেই সে বিয়ে করবে। সে তার নীতিতে খুব প্রতিজ্ঞ যে, সে যাকে বিয়ে করবে তাকে তার গ্রামেরই বাসিন্দা হতে হবে। আমি যদি আমার মা-বাবার পছন্দে আমার গ্রামের কোন মেয়েকে বিয়ে করি তাহলে আমার কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা।

বিয়ে, যদিও এটা এই মুহুর্তে মমিনের জন্য অসম্ভব একটা ব্যাপার, তবে সে চিন্তা করে যে তার ভাই-বোন সবাই আর্থিকভাবে সচ্ছলতা পেলে সে বিয়ে করবে। পাঁচ ভাই-বোনের মাঝে সবার বড় মোমিন হয়ত নিজের জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে এভাবেই এড়াতে চাইছে। সে জানে তার পক্ষে তার পরিবারের সব চাহিদা পূরন করা সম্ভব নয়।

কিন্তু তবুও মোমিন উল্লাহর মতো মানুষও স্বপ্ন দেখার সাহস করে। সে নিজে একটা রিকশার মালিক হবার স্বপ্ন দেখে এবং অন্যকে সেটা ভাড়া দেবার আশা রাখে। সেই লাভ থেকে সে দ্বিতীয় একটা রিকশা কিনতে পারবে এবং এভাবে সে আরও এগিয়ে যাবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন সফল হবার সম্ভাবনা খুব কম কারণ একটা নতুন রিকশার দাম প্রায় দুই হাজার টাকা। এর সাথে যুক্ত হবে রেজিস্ট্রেশন খরচ। এছাড়া আরও অনেক খরচ আছে যা আমলাতন্ত্রে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে আছে। সর্বমোট সম্ভবত আড়াই হাজার টাকা লাগবে। প্রথম রিকশাটা কেনার জন্য তাকে এই টাকা জমাতে হবে। যদিও আজও সারাদিন সে রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়েছে এবং কষ্টকর আরো একটা দিন পার করেছে, তবুও এই স্বপ্নটা সে মনের মধ্যে পুষে রাখে।


শাহিদা বেগম
এগারো বছর
ভিক্ষা করা সেই মেয়েটি

‘ধনী লোক, গরিব লোক, ভিক্ষুক, চোর…..’ এই শ্লোকটা হয়ত সব শিশুই জানে। কিন্তু ভিক্ষা করে বেড়ানো সেই মেয়েটিকে কে চেনে? ১১ বছর বয়সি সেই মেয়েটি, যার নাম শাহিদা, যে দিনে দুই থেকে আড়াই টাকা আয় করতে সারাটাদিন ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে বেড়ায়।

কেউ জানতেও চায়নি কেন শাহিদা ভিক্ষা শুরু করলো । কেউ তাকে ভিক্ষা শুরু করতে বলেনি। তার ঘনিস্ট বন্ধুও ভিক্ষা করে। হতে পারে সে তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। শাহিদার ভাষায় ভিক্ষা করাটা প্রয়োজন ছিলো, আর সে প্রয়োজন থেকেই সে এটা শুরু করেছিলো। একদিন খাবার জন্য ঘরে কিছু ছিলোনা। তার কোন জামা ছিলোনা। এবং হতাশ হয়েই সে ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছে।

শাহিদার চরম পরিস্থিতির পেছনে অনেক দুঃখগাঁথা এবং ঘটনা রয়েছে। যখন শাহিদা অনেক ছোট ছিলো তার প্রাণপ্রিয় বাবা ক্যান্সারে মারা যায়। তার সৎবাবা – যে আসলে বিনা কাজে শুধু ঘুরে বেড়ায় – একমাস ধরে বাড়ীতে বসে থাকে তারপর দুই তিন মাস কোথায় যেন চলে যায় – আবার আসে আবার যায় – এভাবে চলছে। যখন সে চলে যায় তখন ঘরে কোন টাকা থাকেনা। কিন্তু যখন সে বাড়ীতে থাকে তখনো সে তার আয়ের টাকা – যা সে রিকশা চালিয়ে আয় করে, সেটা ধূমপান আর মদ খেয়ে খরচ করে ফেলে। শাহিদার মা ঘরের বাইরে যেতে পারেনা কারণ তার কোন কাপড় নেই। এবং তার ভাই যে এই মুহূর্তে আটোমোবাইল মেকানিক হিসেবে কাজ করছে সে এখনো কিছু আয় করে না – যদিও পরিবারের সবার তাকে নিয়ে অনেক আশা।

তার উপর তারা এমন একটা বাড়ীতে থাকে যা ভাঙ্গাচোরা হলেও ব্যয়বহুল। সত্যিকার অর্থে এটাকে বলে কুঁড়েঘর। খড় আর বাঁশ দিয়ে বানানো। উপরের ছাদও খড়ের তৈরি। এইরকম একটা ঘরের জন্যও তাদের মাসে ৯৫ টাকা ভাড়া দিতে হয় (তের ডলার)। মাঝে মাঝে টাকা-পয়সার সমস্যার কারণে তারা একমাস ভাড়া দিতে পারেনা। তখন তাদের বাড়ী থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। এই বাড়ীর জন্য তাদের কোন ইজারা নেই – তারা মাস হিসেবে এখানে থাকে।

এসব কারণেই শাহিদা তার পরিবারকে সাহায্য করার জন্য দশ বছর বয়সে ভিক্ষা করতে শুরু করে। সে নিজে যথেষ্ট অপমানিত বোধ করে এই কাজ করার জন্য। তার মতো একটা লাজুক ধরণের মেয়ের জন্য এই কাজটা করা অনেক কঠিন ব্যপার ছিলো। সে খুবই অপমানিত বোধ করতো এ কাজ করতে কারণ এটা তার পছন্দের কোন কাজ ছিলো না, তারপরেও সে বাধ্য হয়েছিলো এই কাজটা করতে। সে যে এই কাজ করতে গিয়ে বিব্রত এটা তার আচরণ দেখলেই বোঝা যায়। তবুও সে রোজ রাস্তায় বের হয় কিছু টাকা পাবার আশায়।

শাহিদার ঘনিস্ট বান্ধবী শালিমা পাশের ঘরেই থাকে। তারা এত ঘনিস্ট যে শাহিদা তাকে আদর করে ‘সখী’ বলে ডাকে। এর মানে ‘বন্ধুর চেয়ে বেশী কিছু’। ‘বন্ধু’ শব্দের ইংরেজি অর্থ হলো ‘ফ্রেন্ড’ কিন্তু সখী আরও বিশেষ কিছু – অতি ঘনিস্ট একটি সম্পর্ক। প্রতিদিন সকালে দুই বান্ধবী বাড়ীর অদূরে আজিমপুরে যায় এবং তারা বিভিন্ন রাস্তায় ভাগ্যের উপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে যায়। শাহিদার দিন শুরু হয় সকাল ৯ টায়। “আমি সারা সকাল রাস্তায় থাকি। দুপুর পর্যন্ত থাকি। এরপর কিছু খাবার জন্য আমি বাড়ী যাই। বিকেল ৫ টায় আমি আবার বের হই এবং নিউ মার্কেট যাই। কারণ সেখানে অনেক ভিড় থাকে। ধনী বাঙালিরা এবং বিদেশীরা এখানে আসে।’ শাহিদা বুঝতে পারে যে বিদেশীরা অনেক বেশী দান করে। সে আরও জানায়, ‘টাকা ছাড়াও আমি মাঝে মাঝে পুরনো কাপড়, চাল বা খাবার পাই। এখানে অনেক লোকজন এবং গাড়ি আছে। ভিক্ষা করার জন্য এই জায়গাটা সবচেয়ে ভালো।’ শাহিদা রাত ৮ টার বেশী বাইরে থাকেনা। কারণ সে অনেক ছোট এবং রাত ৮ টার পরে তার বাইরে থাকা ঠিক না। শুক্রবার বন্ধ থাকায় এই দিন বাদে অন্য সব দিন সে নিউমার্কেট যায়।

প্রথম যখন শাহিদা ভিক্ষা করতে যায় সে অনেক হতাশ ছিলো। “আমি ভেবেছিলাম মানুষ আমাকে কোন টাকাপয়সা দেবেনা। কিন্তু পুরোটা সময় আমি আল্লাহর উপর নির্ভর করছিলাম এবং প্রার্থনা করছিলাম। আমি জানি আল্লাহ যা করবেন ভালোর জন্যই করবেন। আমি সবটা তার উপরেই ছেড়ে দিয়েছিলাম।”

যখন সে ভিক্ষা করছিলো, শাহিদা আল্লাহর নাম নিচ্ছিল আর বলছিলো, “সাহেব, আমি একটি গরিব মেয়ে, আমার কোন খাবার নাই, কাপড় নাই। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে কিছু টাকা দিন। আল্লাহ আপনার সহায় হবে।” শাহিদার এই আবেদন মানুষের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়। মানুষ যখন দেয় তারা সাধারণত ৫ বা দশ পয়সা (এক বা দুই সেন্ট) দান করে। শাহিদার সরল চিন্তায় যারা তাকে দান করে তারা দয়ালু এবং ভালো মানুষ; আর যারা দেয় না তারা রুক্ষ মেজাজের এবং মন্দ লোক।

কয়েক মাস ভিক্ষা করার পর শাহিদার হতাশা একটু দূর হলো। এবং সে সামান্য আশাবাদী হতে শুরু করলো । “’আমি এখন আশা করি প্রথম দিকে ভিক্ষা করে যা পেতাম এখন তার চাইতে আরও বেশী পাবো। এবং আরও বেশী খাবার ও অন্যান্য জিনিস দান হিসেবে পাবো।” শাহিদা আশা করে তার পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হবে। বিশেষ করে যখন তার ছোট ভাই মেকানিকের চাকরী পাবে। সেই সময়ে সে ভিক্ষা করা ছেড়ে দেবে। সে মনে করে তার ভাই তাদের পরিবারের জন্য যথেষ্ট টাকা আয় করবে এবং সে তখন স্কুলে যেতে পারবে।

ছবিঃ শাহিদা, শালিমা এবং শাহিদার অন্ধ চাচা

বর্তমানে শাহিদা শুধুমাত্র সকালে ১ ঘণ্টার জন্য ধর্মীয় শিক্ষা নিচ্ছে। “প্রতিদিন আমি একটি মসজিদে যাই। সেখানে আমি আরবি পড়তে, লিখতে ও বলতে শিখি। বিশেষ করে কোরআন পড়া শিখি। এটা মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। এছাড়া কিভাবে সঠিকভাবে দিনে পাঁচ বার নামাজ পড়তে হয় সেটাও শিখি।” শাহিদার পরিবারের সবাই ইসলাম ধর্মের মহানবী মুহাম্মাদকে সন্মান করে।

শাহিদার বাড়ী স্কুল থেকে অনেক দূরে স্থানান্তরিত হবার কারণে তাকে স্কুল ছেড়ে দিতে হয়। (সে শুধুমাত্র বর্ণমালা জানে এবং এলোমেলোভাবে কিছু লিখতে পারে)। সেই সময়ে সে মাত্র ছয় বছর বয়সী ছিলো এবং এতিমদের জন্য বিশেষ কোন সুবিধা সেখানে ছিলোনা। কিছু কার্যক্রম শুরু হলেও শাহিদার স্কুলে যাবার মতো ভালো কোন জামা নাই। তাছাড়া যে বই তাকে পড়তে হবে সেগুলো কেনার মতো টাকাও তার নাই। বই বিনামূল্যে দেয়া হয়না। যদিও নতুন আইনে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেও শিক্ষাকে বিনামূল্যে করানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যে সামান্য টাকা সে আয় করে সেটা দিয়ে বইয়ের পরিবর্তে কিছু চাল কেনাটা তার পরিবারের জন্য বেশী প্রয়োজন। শাহিদা আবার স্কুল শুরু করার ব্যাপারে আশাবাদী। এই সময় পর্যন্ত সে রোজ সকালে ভিক্ষা শুরুর আগে ধর্মশিক্ষার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

শাহিদা তার বাবার মৃত্যুর পরে পরিবারের অবর্ননীয় পরিস্থিতির বর্ণনা দেয়। “আমার বাবার ভালোবাসার কথা মনে পড়লে এখনো কান্না পায়। এখন বেশিরভাগ সময় আমি একা একা থাকি।” তার সৎবাবা তাকে ঠিক মতো দেখেনা। সে তাকে মারে না, তবে সে তার ব্যাপারে একদম অমনোযোগী। শাহিদার প্রতি আরও বেশী মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। সে মনে করে আরও বেশী আদর ও ভালোবাসা তার প্রাপ্য। যদিও তার মা তাকে অনেক ভালোবাসে কিন্তু এখন তার পক্ষেও সেটা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। শাহিদার চাচা তার মা এবং সৎবাবার বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলো। সে ভেবেছিলো এতে পরিবারের অবস্থার উন্নতি হবে। কিন্তু এতে কোন লাভ হয়নি। এবং এই অবস্থা থেকে মুক্তির কোন পথ তার মায়ের কাছে খোলা নেই।

বিকেল বেলাটা শাহিদার সবচেয়ে আনন্দের। “যখন কিছু টাকা আয় করে আমি বাড়ী ফিরি তখন আমি আমার মাকে রান্নায় সাহায্য করি। কখনো কখনো আমি কিছু চাল আর সবজি দয়ালু কারো থেকে দান হিসেবে পাই, সেগুলো খাই।” তাদের তরকারি রান্না হয় কিন্তু সেটা মাংস নয়। “দুপুরের খাবার পর আমি বন্ধুদের সাথে খেলতে যাই। সাধারণত আমরা দড়ি-লাফের খেলাটা খেলি। পরে আমি যখন বাড়ী ফিরে আসি, সন্ধ্যায় আমরা আমাদের খাবার খাই। শুধু রুটি আর ডাল। কখনো কখনো কোন ডাল থাকেনা। তখন আমরা শুকনো রুটি পানি দিয়ে ভিজিয়ে খাই। আমাকে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যেতে হয় কারণ আমাকে সকাল ৫টার সময় উঠতে হয়। তখনো বাইরে অনেকটা অন্ধকার থাকে।” তারপর সে আবারো দিন শুরু করে প্রথমে আরবি শিক্ষা দিয়ে – তারপরে চলে ভিক্ষাবৃত্তি।

অন্য বাঙালি মেয়েদের মতো শাহিদাও আশা করে কৈশোরের মাঝামাঝি সময়ে বিয়ে হবার। এবং সে মনে করে তার বিয়ে হবে অভিভাবকদের পছন্দে। ভালোবাসার বিয়ে সে আশা করেনা। ভালোবেসে বিয়ে করার মতো বিলাসিতা তাদের নেই।

পরিবারের দুরবস্থা সম্পূর্ণভাবে বোঝা যায় শাহিদার পরিধেয় পোশাক দেখে। এটা তাকে তার বাড়ীর মালিক দিয়েছে। এখন জামার পেছনের অংশ ছিঁড়ে গেছে। সে হাতে যে বাঙালি ব্রেসলেট পরে, সেটাকে ‘চুড়ি’ বলে। তার ভাই তাকে এটা কিনে দিয়েছে। তার কানের দুল আর কপারের নেকলেস তার মা তাকে দিয়েছে। এগুলো তার মা পেয়েছিলো শাহিদার বাবার কাছ থেকে।

যুদ্ধের ৯ মাস শাহিদা বস্তি এলাকায় ছিলো। সেই সময়ের ধ্বংসাত্মক কিছু দৃশ্যের কথা তার মনে আছে। “আমাদের এলাকায় তেমন বড় কোন যুদ্ধ হয় নাই। কিন্তু আমি একদিন দেখি একটি ছেলেকে পাকিস্তানি সেনারা চোখে বেঁধে ধরে নিয়ে যাচ্ছে এবং এর পরে পেছন থেকে তাকে দুইবার গুলি করে। আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম।”

সেই সময়টা পরিবারের জন্য খুব খারাপ সময় ছিলো। শাহিদা বাইরে যেতে ভয় পেত। তাদের পরিবার মারাত্মক অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে এবং মাঝে মাঝে তাদের কোন খাবার থাকতোনা। মাঝে মাঝে তারা কোনরকমে শুধু বেঁচে থাকার লড়াই করতো। যদিও তখন শাহিদার বয়স ছিলো মাত্র ৮ বছর, তবু সে জানত তারা বিপদের মধ্যে আছে। সে আল্লাহর কাছে বাঙালির নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করতো এবং স্বাধীনতা চাইতো।

যদিও সে জানেনা দেশপ্রেম বা নতুন জাতি গঠনের সুবিধা কী, তবে শাহিদা জানত একটি নতুন দেশ হলে সে বেশী খাবার, কাপড় আর টাকাপয়সা পাবে। তখন অনেক উন্নতি হবে।

কিন্তু এখন তার উচ্চাশা উড়ে গেছে। এখন তাকে নির্মম পরিস্থির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। প্রায় সময় খাদ্যাভাব, কাপড় নেই, টাকাপয়সা নেই। এবং তার প্রিয় বাবার পরিবর্তে এসেছে একজন সৎ বাবা যার তার প্রতি কোন নজর নেই।

শাহিদার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তার ভাইয়ের উপর। যখন সে অটোমেকানিক হয়ে যাবে তখন তার একটা চাকরী পাবার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশে টেকনিকাল কাজ জানা লোকের সংখ্যা খুব কম। যদিও দেশের বেশিরভাগ মানুষ গরিব, তথাপি আমলাদের একটি স্তরের লোকেরা ড্রাইভার চালিত যানবাহন ক্রয় করে থাকে। সেগুলো মেরামতের জন্য মেকানিক প্রয়োজন হয়। এবং শাহিদার ভাই যে পরিমাণ আয় করবে তাতে তার বোনের খরচ চালাতে পারবে। তখন সে সম্ভবত তার ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করতে পারবে, স্কুলে যাওয়া শুরু করতে পারবে এবং স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে।


সারোয়ার আলি
পনেরো বছর
বিহারী ছেলে

স্বাধীনতার আগে সারোয়ার আলির জীবন অনেক আনন্দদায়ক ছিলো। তার বাবা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টীমশিপ কোম্পানির ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতো এবং বড় আকারের এই পরিবারের ভরণপোষণ ভালোভাবেই করতে পারতো। সারোয়ার এবং তার পাঁচ বোন ঢাকার অন্যতম একটি স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ এলাকা মোহাম্মদপুরে পরিবারের সাথে থাকতো।

হঠাৎ পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হলো এবং সারোয়ার নিজেকে ‘শত্রু’ হিসেবে আবিষ্কার করলো । সারোয়াররা বিহারী – এরা ভারতের উত্তর-পূর্ব এলাকার বিহার রাজ্য থেকে এসেছে। তারা সেখানে মুসলমান সংখ্যালঘু হিসেবে ছিলো। তাই ভারত ভাগের সময় তারা কাছাকাছি পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। (ভারতের বেশিরভাগ মুসলমান পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত ছিলো)।

অর্থাৎ প্রায় ২৫ বছরের বেশী সময় আগে সারোয়ারের পরিবার ঢাকায় চলে আসে – তাদের স্বধর্মীয় লোকদের অঞ্চলে। চল্লিশের দশকের শেষ দিকে অনেক বিহারীকে পাকিস্তানি সরকার ভাতা দিতো – কারণ তাদের কাজে দক্ষ করবার প্রয়োজন ছিলো। বিহারীরা উর্দু ভাষায় কথা বলত। বাইরে থেকে দেখতে বিহারী এবং বাঙালিরা একটু ভিন্ন রকম। বিহারীরা সব সময় তাদের স্বজাতির মধ্যেই বিয়ে করতো। কোন বাঙালিকে তারা জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতো না। উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে তাদের মিল ছিলো। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে অনেক বিহারী পশ্চিম পাকিস্তানিদের সহায়তা করতে শুরু করে এবং বাঙালির শত্রুতে পরিণত হয়।

২৫ মার্চ ১৯৭১ ক্র্যাকডাউনের রাতে সারোয়ারের পরিবার বাড়ী ত্যাগ করে। এবং প্রায় ৭ দিন পর্যন্ত যুদ্ধ চলতে থাকে এবং পাকিস্তানি সেনারা এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে তারা নিরাপদে ফিরে আসে। প্রায় সকল বিহারীর মতো, সারোয়ারের পরিবারকে পাকিস্তানি সেনারা ভালো চোখে দেখত। এবং রেশন সহ তাদের যা যা লাগে তা দিতো। তাদের এই সহায়তার কারণে বিহারীদেরকে পরবর্তীতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন বাঙালিরা বিহারীদের উপর প্রতিশোধ নিতে থাকে। কেউ কেউ তাদের সাথে প্রতারণা করে। সারোয়ারের ভাইকে আটক করা হয় এবং জেল দেওয়া হয়। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এখন সারোয়ার এবং তার পরিবার তাদের জন্য বরাদ্দ জমিতে থাকে।

হাজার হাজার বিহারী যারা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় থাকতো- সবাই মোহাম্মদপুরে চলে আসল নিজেদের স্বগোত্রীয় লোকদের সাথে থাকার জন্য। যুদ্ধ যতোই আগাচ্ছিল তারা মোহাম্মদপুরে জড়ো হতে লাগলো। এক সময়কার সুন্দর আবাসস্থল বস্তিতে রূপান্তরিত হলো। জনসংখ্যা দশগুণ বাড়ল। হঠাৎ বাইরে থেকে আসা লোকেরা সেখানে তাঁবু গাড়তে শুরু করলো এবং রাস্তায় থাকা শুরু করলো। যেখানে একসময় ছিলো বাড়ী – সেটা হয়ে গেলো তাবুময় এক স্থান। ব্যাপক জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য এই পরিণতি হলো। রাস্তাকেই মানুষ খোলা পায়খানা হিসেবে ব্যবহার শুরু করলো । এদিকে প্রচুর বৃষ্টি এলাকা ডুবিয়ে দিলো। সবকিছু কাদা-জলে নষ্ট হয়ে গেলো। সেই সময় থেকেই সারোয়ার ঝুকিপূর্ণ সংখ্যালঘু হিসেবে এখানে বাস করছে।

সারোয়ারের বাবার চাকরীটা চমৎকার ছিলো। চাকরী থেকে পাওয়া আয়ের বাইরে তাদের তিনটা মুদি দোকান ছিলো। এগুলো বাঙালিরা দখল করে নিলো। বেশিরভাগ ঘরবাড়ীই এভাবে তারা দখল করে নিলো। যদিও সারোয়ারের বাবা বাঙালি অফিসারদের কাছে বলেছিলো; কিন্তু তারা তাদের স্বগোত্রীয়দের প্রতিই সহানুভূতি দেখিয়েছে এবং পরিস্থিতির উন্নয়ন করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। সারোয়ার এবং তার পরিবার কোনমতে তাদের ঘরটা রক্ষা করেছে। এখন শুধুমাত্র এটাই তাদের আছে। এখন বাঙালিরা তাদের ঘিরে রেখেছে যারা স্বাধীনতার পর এখানে এসেছে। তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতে এখানকার ঘরগুলোতে উঠে পড়ছে যেগুলো আগে বিহারীদের ছিলো।

সম্ভবত এই অবস্থায় সারোয়ারের জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো স্কুল পরিবর্তন। সে একটি পাকা স্কুলে যেতো। এখানে ম্যাট্রিক (ও লেভেল) পর্যন্ত পড়ানো হতো। যদি সে সেখানে পড়া চালাতে পারতো তবে সে তার একাডেমিক ক্যারিয়ারের প্রথম মাইলস্টোন সফলভাবে শেষ করতে পারতো। কিন্তু সেই স্কুলে আবারো যেতে সারোয়ার খুবই ভয় পায়।
সে বলে, “আমি খুব ভয়ে থাকি যে যদি আমি মোহাম্মদপুরের বাইরে আমার সেই আগের স্কুলে যাই তাহলে আমাকে হয়ত মেরে ফেলা হবে। আমি এখন একটি উর্দু স্কুলে পড়াশোনা করছি।“ এই স্কুলের শিক্ষকরা সারোয়ারের মতো অবাঙালি। কিন্তু এই স্কুলটি জুনিয়র হাই পর্যায়ের এবং শুধুমাত্র কাজ চালানোর জন্য করা হয়েছে। এটার একাডেমিক পরিবেশ অন্যগুলোর মতো ভালো নয়। এই স্কুলে এটাই সারোয়ারের শেষ বছর। এর পরে এখানে আর কোন ক্লাস নেই। এখানে ভালো দালানও নেই। এবং মসজিদের কিছু অংশ দখল করা হয়েছে। তাই নামাজের সময় এটা বন্ধ রাখা লাগে। কিন্তু সারোয়ারের আর কোন পথ নেই। কারণ মোহাম্মদপুরে আর কোন স্কুল নেই। এবং সে একা একা এলাকার বাইরে যেতে ভয় পায়। সবচেয়ে ভালো যা আশা করতে পারে তা হলো যদি তার দুলাভাই তাকে বাসায় পড়ায়, যে তার পরিবারের সাথে থাকে, এবং তার ভরণপোষণ তার বাবা বহন করে।

সারোয়ারের দৈনন্দিন জীবন তার স্কুলকে ঘিরে। আমি সকাল ৯ টা থেকে স্কুলে শুরু করি এবং ৩ ঘণ্টা স্কুলে থাকি।’ প্রখর রোদের কারণে বাংলাদেশে অনেক কিছু আগে আগে শুরু হয় এবং আগে আগে শেষ হয়। ‘আমি বাংলা, ইংরেজি, উর্দু এবং অংক করি।’ চারটা বিষয়ের মধ্যে তিনটাই ভাষার উপর। এটা তার কাছে উভয়সংকটের মতো একটা বিষয়। যদিও সারোয়ার ঘরে উর্দুতে কথা বলে কিন্তু মোহাম্মদপুরের বাইরে সে অবশ্যই বাংলায় কথা বলে। এটা শুধু তার কথা অন্যকে বোঝানোর জন্যই নয় -বরং তার যাতে কোন ঝামেলা না হয় সেটাও গুরুত্তপূর্ণ। কারণ বাঙালিরা বিহারীদের ভালো চোখে দেখেনা।

‘আমার ক্লাস যখন শেষ হয়ে যায় আমি তখন বাড়ী চলে যাই। বাড়ীতে আমাকে যে পড়া দেয়া হয়েছে সেটা করি। বিকেলে বন্ধুদের সাথে দেখা করি এবং ফুটবল খেলি, অথবা গল্প করে সময় কাটাই। সারোয়ারের তেমন কোন কাজ নেই। তার হকি খেলতে ইচ্ছা করে কিন্তু একটি বল ও হকি স্টিক কেনার জন্য দরকারি অর্থ তার নেই। সন্ধ্যায় সে পড়ে, তারপরে খাবার খায় এবং রাত ৯ টার দিকে ঘুমাতে যায়। সারোয়ারের এখনো কিছু বাঙালি বন্ধু আছে। যদিও তারা অনিবার্যভাবে এখন আলাদা হয়ে গেছে। তার আগের স্কুলের বন্ধুরা কেউই এই এলাকায় আর আসেনা।
যুদ্ধের ফলে সারোয়ারের মতো বিহারীদের একসময়কার আনন্দময় জীবন সম্পূর্ণ এলোমেলো হয়ে গেলো। সাধারণ মধ্যবিত্তের আরামদায়ক জীবন যাপনের পরিবর্তে এখন তাদের উপর নেমে এসেছে চরম দারিদ্র্য। তাদের সবকিছু বাঙালিরা নিয়ে গেছে। ‘মানুষ যখন বন্দুক নিয়ে আমাকে মারার জন্য হুমকি দিতে এসেছিলো আমি তখন ঘরের মধ্যে ছিলাম। বন্দুকের মুখে তারা সবকিছু নিয়ে যায়। আমাদের কিছু বলার ছিলোনা – আমাদের কোন অস্ত্র ছিলোনা। তারা বলেছিলো, তোমরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সাহায্য করেছে, তাদের সহায়ক হিসেবে কাজ করেছ, এখন আমরা তোমাদের দেখব। আমরা তোমাদের শেষ করে দিব। দিনেরবেলা সকলের সামনেই এই কাজগুলো হচ্ছিলো।

সারোয়ার যে জামাটি পরে সেটি তার বন্ধু তাকে দিয়েছে। যারা লুট করতে এসেছিলো তারা পরার জন্য একটা জামাও রেখে যায় নাই। এই জামা আর পায়জামা ছাড়া তার আর কোন পোশাক নেই। এমনকি তার কোন জুতা বা স্যান্ডেল নেই। যদিও তার পরিবারের কাউকে শারীরিকভাবে আঘাত করা হয়নি তবুও বাঙালি ডাকাতরা তাদের জন্য কোন জামাও রেখে যায়নি। মাঝে মাঝে তার ভাইবোনেরা কাপড়ের অভাবে বাইরে বের হতে পারেনা। স্কুলের বইয়ের বাইরে সারোয়ারের আর কিছুই নেই।

সারোয়ারের বাবা যুদ্ধের আগের সময়কার ভালো চাকরীটা হারিয়ে এখন একটি ফেরিবোটে পার্ট টাইম কাজ করে এবং সেই আয় দিয়ে সংসার চালায়। তবে মাসে যে দুইশত টাকা সে বেতন হিসেবে পায় তা দিয়ে ১১ জনের পরিবার চালানো খুব কঠিন। তাই তারা ধার করে খাবার কেনে। এবং রিলিফের আশায় থাকে। যদিও প্রতি সপ্তাহে তারা রেশন পাবার আশা করে কিন্তু মাঝে মাঝে দুই তিন সপ্তাহ পরে সেটা হাতে পায়।

রেশন হিসেবে তারা আটা পায়। বাঙালিদের মতো বিহারীরা ভাত খায় না। তাদের মূল খাবার গমজাত। আটা দিয়ে তারা রুটি বানাতে পারে। বেশিরভাগ সময় রুটিই তারা খায়। তারা দিনে তিন বেলা শুকনো রুটি খায়। যখন তারা চা কিনতে পারে তখন তারা রুটিগুলো চা দিয়ে ভিজিয়ে খায়। যখন সম্ভব হয় তখন তারা একটু সবজির তরকারির ব্যবস্থাও করে।

‘যখন আমার বাবা বেতন পায় তখন মাঝে মাঝে আমরা গরু বা খাসির মাংস খেতে পারি। এখন সেরকম সুযোগ আসলে সেটা আমাদের কাছে অনেক বড় একটা বিষয়। এখন শুধু কোন মতে আমরা বেঁচে আছি।

যদি সারোয়ারের বাবা চাকরী হারায় তাহলে পরিবারের সবাইকে রাস্তায় ভিক্ষা করতে হবে। কারণ তাদের সাহায্য করার মতো কেউ নেই। তারা হয়ত তাদের বাড়ীটা পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারে। এই বাড়ীর মধ্যে একটি দেয়াল দিয়ে দুইটা রুম করা। যদি তারা এটা হারায় তাহলে সত্যিকার অর্থে তাদের আর কিছুই থাকবে না।

মোহাম্মদপুর ক্যাম্পের বাইরে সারোয়ার নিজের নিরাপত্তার জন্য বাঙালি হিসেবে আচরণ করে। যদিও সে আগে একা একাই বের হতো, তবে এখন সে ঝুঁকি নেয় না। এখন বের হলে সে বাবা-মায়ের সাথে বের হয় – মাসে এক বা দুইবার। সে বাইরে খুব কম কথা বলে যাতে করে সহজে বোঝা না যায় যে সে বিহারী। যখন সে কথা বলে সে খুব মৃদু শব্দে কথা বলে যাতে করে তার উচ্চারণে কেউ বুঝে না যায়। যখন সারোয়ার ঢাকার অন্যান্য এলাকায় যায় সে খুব নার্ভাস এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।

সারোয়ার উর্দুতে কথা বলতে সবচাইতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। যখন সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্চিলো সে একজন উর্দু দোভাষীর সাথে কথা বলছিলো যে একজন শিক্ষিত বাঙালি এবং বাংলা, ইংরেজি ও উর্দুতে খুব দক্ষ।

স্বাধীনতার প্রথম বছরের মাঝেই বিহারীদেরকে নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করা হয়। কিন্তু সারোয়ার আশা করেনা যে ভবিষ্যতে বাঙালি ও বিহারীদের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকবে। “আমি বাংলাদেশে থেকে যাবার বিষয়ে চিন্তাও করতে পারিনা। আমি এখানে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি। এবং বিয়ে করা বা বাচ্চা নেয়ার কথা চিন্তাও করিনা।”

বেশিরভাগ বিহারী লোক যারা তাদের ব্যবসা ও সম্পত্তি হারিয়েছে তারা এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে চায়। তাদের স্বপ্ন পাকিস্তানে যাওয়া। যে দেশ তাদের মতো ধর্ম, ভাষা ও জীবন যাপনে অভ্যস্ত।

কিন্তু পাকিস্তানের মতো দেশে বসতি গড়তে হলে অনেক টাকা জোগাড় করতে হবে যেটা সঞ্চয় করার কথা সরোয়ারের পরিবার এখন ভাবতেই পারেনা। এবং যদি তারা সেখানে যাবার টাকা জোগাড় করতে পারে তবুও তাদের বাংলাদেশ সরকার আটকে দেবে। কারণ তারা অবাঙালিদের পাসপোর্ট দেয় না। এটা খুব ঠাট্টার বিষয় যে বিহারীরা এই দেশে এডপ্টেড হতে পারছেনা আবার তাদের পছন্দের দেশে যাবার অনুমতিও পাচ্ছেনা যারা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। (এটাও খুব সন্দেহজনক যে এত বিপুল পরিমাণ বিহারী শরণার্থীকে পাকিস্তানের অর্থনীতি সমর্থন করবে কিনা।)

বিহারীদের রাজনৈতিক কারণে পাসপোর্ট দেয়া হচ্ছেনা। ধারণা করা হয় যে তাদেরকে ততদিন এখানে রাখা হবে যতোদিন পাকিস্তানে বাঙালি যুদ্ধবন্দিরা থাকবে। যেসকল বিহারীরা পাকিস্তানিদের সাথে সহায়তা করেছে তাদের সাথে বাঙালির বোঝাপড়া এখনো শেষ হয় নাই। সারোয়ার যদিও ছোট এক বালক কিন্তু সে এর মধ্যে পড়ে গেছে। তার গোত্রের অন্য সবার মতো সে যুদ্ধের একজন ভুক্তভোগী।

কিছু বিহারী বাইরে গিয়েছে। ইন্টারভিউ শুরু হবার কিছু আগে সারোয়ারের চাচা পাকিস্তানের দীর্ঘ ঝুকিপূর্ণ ইতিহাস বলা শুরু করলেন। বাংলাদেশে দুর্নীতি নতুন নয়। এবং যার টাকা আছে সে চাইলে পাসপোর্ট জোগাড় করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের বাইরে যাওয়া মানেই যাত্রা শেষ নয়। সারোয়ার বিশ্বাস করে যে তার চাচা নেপাল পর্যন্ত গিয়েছিলো কিন্তু সেখানে গিয়ে আটকে যায়। তাকে হাজার মাইল দূরে পাকিস্তানে যেতেই হবে। ঝুঁকি যতো বড়ই হোক, সে বাংলাদেশে থাকার চাইতে সেই ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত।

সারোয়ারের কিছু বন্ধু বাংলাদেশ ছেড়ে এই কঠিন যাত্রায় রওনা করেছিলো এবং নেপাল পৌঁছেছিলো। বাকিরা যাত্রা শেষ করেছে এবং এখন পাকিস্তানে আছে। সারোয়ার মাঝে মাঝে সেখান থেকে তাদের নতুন জীবনের বর্ণনাসমৃদ্ধ চিঠি পায়। তার স্বপ্ন সেই সব বন্ধুদের পথ অনুসরণ করা। সে জানেনা তা সে কিভাবে করবে। সে এটাও জানেনা তারা কিভাবে গিয়েছে। কিন্তু যাবার খুব ইচ্ছা তার। সারোয়ারের নিজেকে অনেক অযোগ্য মনে হয় যখন সে দেখে এদের অনেকের বয়স তার চেয়েও কম ছিলো – এমনকি তেরো বছর।

যদি সে কখনো পাকিস্তান যেতে পারে তাহলে সারোয়ার তার চাচার সাথে থাকার ইচ্ছা পোষণ করে। সে ভাবে, তখন পড়ালেখা শেষ করা কোন সমস্যা হবে না এবং একটি একাডেমিক ক্যারিয়ার তখন পাওয়া যাবে। যেটা বাংলাদেশে বসে আশা করা সত্যিই খুব কঠিন।

কিন্তু সরোয়ার পাকিস্তানে যেতে চায় তার পরিবারসহ। যদিও তার কোন চাকরীর আশা নাই, তবুও সে স্বপ্ন দেখে যথেষ্ট টাকা আয় করার যাতে সে তার নিজের এবং তার বাবা-মা, ভাই-বোন, এবং দুলাভাইয়ের দেশ ছেড়ে যাবার টাকাও যোগাড় করতে পারে। দেশ ছেড়ে যেতে তার নিজের জন্য যে টাকা প্রয়োজন, সেটা যোগাড় করতে পারলেও পরিবার ছাড়া সে একা একা দেশ ছেড়ে যাবে না। এটাও কি আশ্চর্যজনক নয় যে, সে পরিবারের ১১ জনকেই সেখানে নিয়ে যাবার খরচ জোগাড় করার স্বপ্ন দেখে।


প্রতিভা রানী রায়
বারো বছর
হিন্দু ঘরের মেয়ে

মুসলমানের দেশে হিন্দু – এটাই প্রতিভা রানী রায়ের গল্প। ১৯৪৭ সালে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান সৃষ্টি করা হয় যারা হিন্দুদের দেশ ভারতে সমাদর পাচ্ছিল না। কিন্তু যে রেখা দিয়ে দেশ ভাগ করা হয় সেখানে কিছু কিছু হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার দিকে খেয়াল রাখা হয়নি। এভাবেই প্রতিভার পরিবার, তাদের মতো আরও অনেক পরিবারের সাথে, সংখ্যালঘু হিসেবে বছরের পর বছর এখানে রয়ে যায়।
যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রতিভা ও তার পরিবার (তার মা এবং ছোট দুই বোন) পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে যায়। তারা ভাগ্যবান ছিলো যে তাদের এলাকা সোনারগাঁয়ের একটি মুসলমান পরিবারের বাড়ীতে তারা লুকিয়ে থাকার সুযোগ পায়। বেশিরভাগ হিন্দু গৃহযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যায়। কিন্তু প্রতিভা ও তার পরিবারের পরিচিত কেউ ছিলো না যে তাদেরকে সোনারগাঁও থেকে ভারতের সীমান্তে যাবার পথ চিনিয়ে দেবে। এবং দূরত্বও নেহায়েত কম নয়। আবার এতটা পথ পাড়ি দেবার মতো টাকা তাদের ছিলোনা। তাদের একমাত্র রাস্তা ছিলো তাদের পরিচিত মুসলমান বাড়ীতে পালাক্রমে লুকিয়ে থাকা। তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ থেকে দূরে থাকার জন্য গ্রামাঞ্চলে অবস্থান করতো। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই নয় মাস তারা শুধু দৌড়েছিলো।

রাজাকারদের কারণে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছিলো। এরা ছিলো পাকিস্তানি বাহিনীর ‘স্টর্ম ট্রুপার্স’। এরা ছিলো স্থানীয় বাঙালি এবং কিছু বিহারীও পাকিস্তানিদের সাহায্যকারী হিসেবে নিয়োজিত ছিলো। তারা টাকা, খাদ্য আর কাপড়ের বিনিময়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে তথ্য সংগ্রহ করে দিতো। তাদের অন্যতম একটি কাজ ছিলো লুকিয়ে থাকা হিন্দুদের খুঁজে বের করা। যদি পাকিস্তানি বাহিনী বুঝতে পারে যে তারা মুক্তিবাহিনীর সদস্য তাহলে তারা তাদের হত্যা করতো। সোনারগাঁওয়ের কিছু হিন্দুকে সৈন্যরা হত্যা করে এবং কিছু নারীকে ধর্ষণ করে। কিন্তু প্রতিভা, তার মা এবং দুই বোন পাকিস্তানিদের থেকে লুকিয়ে থাকতে পেরেছিলো।

পাকিস্তানিরা হিন্দুদের খুঁজে খুঁজে বের করতো। কারণ তারা মনে করতো বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা করার পেছনের চক্রান্তে তারাই মূলত দায়ী। সৈন্যরা মনে করতো যে হিন্দুদের সাথে ভারতের সরকারের গোপন যোগাযোগ আছে। যদিও হিন্দুদের নিশ্চিতভাবেই এমন কোন যোগাযোগ ছিলোনা। বাঙালিদের প্রতি ভারতের সহানুভূতির কারণ ছিলো এই যে একটি ক্ষতিকারক দেশের চাইতে বন্ধুসুলভ প্রতিবেশী যদি পূর্বাঞ্চলে থাকে তবে সেটা তাদের জন্য ভালো। যখন বোঝা গেলো যে বাঙালিদের স্বাধীনতার জন্য বাইরের সাহায্য দরকার তখন ভারত তাদের সাথে যোগ দেয়। এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে সফলভাবে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটায়।

প্রতিভার ক্ষেত্রে যুদ্ধ প্রায় তার দোরগোড়ায় ছিলো। “আমরা যখন পাকিস্তানিদের থেকে পালিয়ে ছিলাম, সৈন্যরা মাঝে মাঝে ঘরের ভেতরে আসছিলো যেখানে আমরা ছিলাম। তখন আমি একজন মুসলমানের মেয়ে হিসেবে আচরণ করি।” যদিও দুই ধর্মের মধ্যে তেমন কোন তফাৎ নেই, এবং পোশাক-আশাকেও তেমন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়না, তবুও তাদের নাম একটু ভিন্ন ছিলো। “আমাকে একজন পাকিস্তানি সৈন্য যখন নাম জিজ্ঞেস করলো , আমি বলতাম রহিমা খাতুন। এটা ছিলো একটি স্বাভাবিক মুসলমান নাম যা আমি নিজের জন্য বেছে নিয়েছিলাম।” কেউ প্রতিভাকে এটা বলতে শেখায়নি। এটা বেঁচে থাকার আশায় তার বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তা থেকেই সে বলেছিলো।

সৈন্যরা হয়ত তাকে মাংস খাবার ব্যাপারে জোর করতে পারতো। হিন্দু ধর্মে একটি রীতিতে মাংস খাবার নিয়ম নেই। “যদি আমাকে কোন সৈন্য মাংস খেতে জোর করতো অথবা যদি তারা সন্দেহ করতো যে আমি আসলে মুসলমান নই, তাহলে আমি হয়ত মাংস খেতাম। এটা আমার জন্য ছিলো বাঁচা-মরার লড়াই।”

হিন্দু ছেলেদের ক্ষেত্রে মুসলমান না হিন্দু সেটা ধরে ফেলা খুব সহজ ছিলো। মুসলমান ছেলেদের খাৎনা করানো হয়, কিন্তু হিন্দুদের তা হয়না। কিন্তু বিবাহিত হিন্দু মহিলাদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বাইরে একটি চিহ্ন থাকে – আর তা হলো চুলের সিঁথিতে লাল রং করা – যেটাকে তারা ‘সিঁদুর’ বলে থাকে। সেই চিহ্ন যুদ্ধের সময় তারা কখনই দিতো না, কারণ তখন কাউকে হিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করা মানে তার মৃত্যু নিশ্চিত।

“যারা আমাদের লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করেছিলো তারাই আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছিলো। যখনই সম্ভব হতো তারা আমাদের সাথে মুসলমানদের মতো আচার-ব্যবহার করতো এবং এমনভাবে আমাদের সাথে কথা বলতো যেন আমরা তাদের আত্মীয়-স্বজন।”

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে যুদ্ধের শেষ দিকে যখন ভারত যোগদান করে তখন মুক্তিবাহিনী সোনারগাঁওয়ের রাস্তায় মাইন পুঁতে রেখেছিলো। “মাইকে আমাদের সবাইকে বলে দেয়া হয়েছিলো যাতে আমরা রাস্তায় না যাই। কারণ সেখানে যে মাইন আছে তাতে আমরা মারা যেতে পারি। যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যানবাহন সেই পথে যেতো তখন তাদের অনেকগুলোই ধ্বংস হয়ে যেতো। এর কিছুক্ষণ পরেই আরও সৈন্য ঘটনাস্থলে পাঠানো হলো এবং তারা প্রতিশোধ নেবার জন্য আশেপাশের গ্রামে আক্রমণ করলো । গ্রামের বেশ কয়েকজনকে হত্যা করা হলো। কিন্তু মুক্তিবাহিনী শক্তিশালী জবাব দিলো। অনেক পাকিস্তানি সৈন্য মারা গেলো। বাকিদের আটক করা হলো।” এর কয়েকদিন পরেই সোনারগাঁও এবং সমস্ত বাংলার যুদ্ধ শেষ হলো।

যুদ্ধের সময় যখন হিন্দুরা ভারতে পালিয়ে গেলো তখন তারা তাদের বাড়ীঘর ফেলে রেখে গিয়েছিলো। যারা থেকে গেলো তারা সেগুলো দখল করলো । যদিও সেগুলোতে যাদের কোন ঘরবাড়ী নাই অথবা যারা আরও গরিব তারা উঠেছিলো। এমনই একটা ঘরে প্রতিভা এবং তার পরিবারের বাকিরা ছিলো। ঘরটা এটা অনেক প্রশস্ত হলেও এর কিছু সমস্যা আছে। যেমন, খাবার পানির জন্য তাদের প্রায় আড়াইশো গজ দূরের একটি কূপে যেতে হতো।

প্রতিভার বাবা ছিলেন একজন কারখানা শ্রমিক এবং তাঁতি। প্রতিভার বয়স যখন ৮ বছর তখন তার বাবা মারা যায়। এখন পরিবারের একমাত্র উপার্জন হয় নিজেদের ৮ বিঘা জমি থেকে। তারা অন্যদেরকে জমিটা চাষ করতে দেয় এবং তারা সেখানে ধান ও সবজি চাষ করে। ফসল পাকলে প্রতিভারা অর্ধেক ফসল পায়। এই ফসলের কিছুটা তারা নিজেদের জন্য রেখে দেয় এবং বাকিটা বাজারে বিক্রি করে। এতে তাদের সামান্য আয় হয়।

তাদের পরিবার এখন যেভাবে থাকে সেটা আগের থেকে অনেক ভিন্ন। প্রতিভার বাবা মারা যাবার আগে তারা ভালো খেতে পারতো। ভালো পোশাক পরত। প্রতিভার আনন্দের জন্যও কিছু খরচ করতো। কিন্তু এখন শুধুমাত্র গায়ের জামাটাই তার আছে। আর কোন কাপড় নেই। সংসারের কিছু জিনিস তারা বিক্রি করে দিয়েছে খাবার ও অন্যান্য কিছু জিনিস কেনার জন্য। তাই তারা দিন আনে দিন খায়, এবং ক্ষেতের ফসলের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল।

ছবিঃ ফরিদা, প্রতিভার প্রতিবেশী ও বন্ধু

এই জমিটা প্রতিভাদের পৈত্রিক জমি। “আমি জানিনা আমাদের কতজন পূর্বপুরুষ এই সোনারগাঁয়ে ছিলেন। অনেক বছর হয়েছে যদিও। আমার দাদা এবং তার পূর্বপুরুষ সবাই এখানে বাস করতেন। এটা বাংলার প্রাচীন রাজধানী। আমার জানা মতে আমার দাদা সুলতানের কোর্টে কাজ করছেন বহু বছর আগে।”

এই গ্রামে হিন্দুর সংখ্যা এখন খুব কম। তাই প্রতিভার বেশিরভাগ বন্ধু মুসলমান। সে বলে এইসব বন্ধুদের সাথে চলতে তার কোন সমস্যা হয়না। তার স্কুলে প্রায় সবাই মুসলমান – মাত্র ২৩ জন হিন্দু ছাত্র। তার ক্লাসে শুধুমাত্র প্রতিভা আর একটি ছেলে হিন্দু।

প্রতিভার অল্প কিছু স্কুল বই আছে যেগুলো বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে। এছাড়াও তার কিছু বই আছে সেগুলোর দাম ১ বা দুই টাকা। এগুলো তাকে কিনতে হয়েছে। “আমি আশা করি ম্যাট্রিক বা দশম গ্রেড পর্যন্ত আমি পড়াশোনা করব। আমি কলেজেও পড়তে চাই। (তুলনায় এটা আমেরিকান হাই স্কুলের শেষ দুই বছরের সমতুল্য)। এরপর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই। কিন্তু আমি এতদূর যাবার সুযোগ পাবো কিনা সেটা নিয়ে চিন্তিত। আমার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সাহায্য করবে এমন কেউ নেই।” যদিও সেই সময়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পড়ানোর পরিকল্পনা হচ্চিলো। তবে এখন পর্যন্ত প্রতিভা পঞ্চম গ্রেড পর্যন্ত বিনামূল্যে পড়তে পারবে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত তাকে অবশ্যই সাত টাকা পঁয়ত্রিশ পয়সা (এক ডলার) করে মাসে দিতে হবে। এবং যদিও তাদের খাবার কেনার জন্য যথেষ্ট টাকা তাদের নেই তবে তার মায়ের বান্ধবী প্রতিভার প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ হলে বিষয়টা দেখবেন। ম্যাট্রিকুলেশনের এই পদ্ধতি ভারতে ব্রিটিশরা চালু করেছিলো এবং এটি এখনো কার্যকর আছে। যদি দশম শ্রেণি পর্যন্ত সরকার বিনামূল্যে পড়ানোর সুযোগ চালু করে তাহলে প্রতিভার ছোট দুই বোন যাদের বয়স যথাক্রমে দশ এবং চার বছর তারা এই সুবিধা পাবে।

এখন প্রতিভা শনিবার সহ মোট ৬ দিন স্কুলে যায়। “আমি পাঁচটি বিষয় পড়ি। ইংরেজি, বাংলা, সমাজ-বিজ্ঞান, অংক এবং বিজ্ঞান। সকাল ১০ টায় স্কুল শুরু হয় এবং বিকেল ৪ টায় শেষ হয়। স্কুল শুরু হবার আগে আমি এক ঘণ্টার মতো আমার পড়া পড়ি। এছাড়া আমি ক্লাসে যাবার আগে আমার বোনদের দেখাশোনা করি। বিকেলে স্কুল থেকে আসার পর দেরি করেই আমাকে দুপুরের খাওয়া শেষ করতে হয়। এরপর বিকেলের বাকি সময়টা আমি বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করে কাটাই। এরপর আমি আমার মাকে রান্না ও অন্যান্য কাজে সাহায্য করি।” একটি বড় পাত্রে করে প্রতিভা পরিবারের জন্য দূরের কুয়া থেকে পানি নিয়ে আসে। মাটি দিয়ে বানানো এই পাত্রটিকে সে বলে ‘কলসি’। রাতের খাবার ১০ টায় শেষ হয়।

ছবিঃ মুন্নি, প্রতিভার ক্লাসমেট

তিনবেলাই এই পরিবার ভাতের উপর নির্ভর করে। তারা রুটি খায়না। একই রকম পাঞ্জাবি খাবার আছে যেটাকে পরাটা বলে। এমনকি সকালেও তারা ভাত খায়। যেহেতু তারা কোন লাল মাংস খায় না, তাই তারা সবজির তরকারি রান্না করে। মাঝে মাঝে তারা মুরগির মাংস রান্না করে। কিন্তু ধর্মীয় কারণে তারা গরু-খাসি খায়না। কিন্তু কিছু কিছু হিন্দু খাসি খায়। প্রতিভাদের মতো যারা সনাতন ব্রত পালন করে তাদের এসব নিষেধ আছে।

জানুয়ারি এবং মার্চ – বছরে দুইবার সোনারগাঁয়ের লোক উৎসব পালন করে। জানুয়ারিতে ব্রাহ্মপুতি এবং মার্চে লোকনাথ উৎসব। এই উৎসবে স্রষ্টাকে উপহার সাধা হয়। গ্রামবাসীরা চিড়া (এক ধরণের ফ্রাইড রাইস), মুড়ি (এক ধরণের পপকর্ন), গুড় এবং কখনো কখনো ফল – যেমন- আম, কলা, আনারস এগুলো প্রসাদ হিসেবে দেবতাকে দেয়। যেহেতু তারা গরীব, তারা এর বেশী কিছু দিতে পারেনা। হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ভগবৎ গীতা থেকে গ্রামবাসীরা অনেক মন্ত্র পড়ে, উৎসব অনুযায়ী তারা ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্র পড়ে।

প্রতিভার মনেও বিয়ের ভাবনা রয়েছে। “কয়েক বছর পরে যখন আমি বড় হব আমার চাচা হিন্দু প্রথা অনুযায়ী আমার বিয়ে দেবেন। হিন্দুদের বিয়েতে গান-বাজনা খুব গুরুত্বপূর্ণ।” মুসলমানদের বিয়ে একটু নিরিবিলিভাবে হলেও হিন্দুদের বিয়েতে অনেক আনন্দ অনুষ্ঠান পালন করা হয়। বিয়ের খাওয়া-দাওয়া এবং গানবাজনা সারা রাত চলে। এমনকি দ্বিতীয় দিনেও চলে। প্রতিভার বিয়ের খরচ তার আত্মীয়দের কেউ দেবেন – বিশেষ করে তার মামা। তার স্বামী কে হবেন সেটা তার চাচা নির্ধারন করবেন – যিনি সংসারের অভিভাবক হিসেবে আছেন। বিয়ের এই অংশটি মুসলমানদের মতোই। প্রতিভা আশা করে সে ১৬ বা ১৭ বছর বয়সে বিয়ে করবে। তার অন্যান্য মুসলমান বান্ধবীদের মতো। এটাই বাঙালি হিন্দু বা মুসলমানদের ট্র্যাডিশনাল বিয়ের ধরণ।

“যদি আমার ভবিষ্যৎ স্বামীর বাড়ী ঢাকায় হয় তাহলে আমি সেখানে ভালোই থাকবো। কিন্তু যদি সে গ্রাম থেকে আসে এবং আমাকে সেখানে গিয়ে থাকতে বলে তাহলে আমি গ্রামে গিয়ে তার সঙ্গে থাকবো। এটা সম্পূর্ণ তার ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে।” প্রতিভা ঢাকা তেমন দেখে নাই। তার এক আত্মীয় আছে যে রক্ষীবাহিনীর সদস্য – সে তাকে একবার ঢাকায় তার দাদীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলো আট দিনের জন্য।” বড় শহর সম্পর্কে প্রতিভার ধারণা তেমন নাই। কারণ সে বেশিরভাগ সময় আত্মীয়পরিজনদের সাথেই ছিলো এবং বাড়ীর বাইরে বেরিয়েছে খুব কম। তবুও সে বলে, “ঢাকা শহর আমি খুব পছন্দ করি এবং আমার খুব ভালো লাগে।”

প্রতিভার ভবিষ্যৎ এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ দুটোই অনিশ্চিত। মার্চ ১৯৭১ সালে যখন স্বাধীনতা বাস্তবে রূপ লাভ করলো সে অনেক নিরাপদ এবং স্বাধীন অনুভব করছিলো। প্রথমে খবরটা মুখে মুখে শুনলেও পরে রেডিওতে শুনেছিলো। তার খুবই খুশি লেগেছিলো।

হিন্দু হিসেবে প্রতিভা চায় – বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্যে যেন একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে। কিন্তু সেই সম্পর্কের যদি অবনতিও হয় প্রতিভা এবং তার পরিবার তাদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাংলাদেশেই থাকতে চায়।


মাকসুদা বেগম
পনেরো বছর
গৃহকর্মী

“মার্চ ২৫, ১৯৭১ তারিখে ক্র্যাকডাউনের রাতে ঢাকা শহরে তান্ডব চলছিলো। আমাদের চারিদিকে খুবই অশান্ত অবস্থা ছিলো এবং আমরা শুধু শেলিং এর শব্দ শুনছিলাম। আমাদের পাশ দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্য বোঝাই ট্যাংক গড়গড় করে দৌড়ে যাচ্ছিল। আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম সৈন্যরা মানুষদেরকে কি নির্মমভাবে হত্যা করছিলো। এই দৃশ্য খুবই ভীতিকর ছিলো। তাই ভয়ে আমি এবং আমার মা শহর থেকে পালিয়ে যাই।”

যুদ্ধের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত ঢাকা শহর থেকে নিজেদের বাড়ী ফরিদপুরের নাজিমপুরে পালিয়ে আসার ঘটনা ১৫ বছর বয়সী গৃহকর্মী মাকসুদা এভাবেই বর্ননা করছিলো। অন্যান্য হাজার হাজার পালাতে থাকা মানুষদের সাথে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে মাকসুদা গ্রামে ফিরে যায়।

“সাধারণত নাজিমপুর যাবার জন্য আমরা স্টিমারে চড়ে সাভার যেতাম। এর পরে ফেরিতে করে আমাদের গ্রামে পৌঁছাতাম। কিন্তু যুদ্ধের সময় কোন স্টিমার চলছিলো না। তাই পুরো রাস্তা আমাদের পায়ে হেঁটে যেতে হয়। একদম শেষ পর্যন্ত আমরা পায়ে হেঁটে যাই।” অবিশ্বাস্যভাবে মাকসুদা এবং তার মা দুই দিনে ঢাকা থেকে সাভার পর্যন্ত ৫০ মাইল পায়ে হেঁটে পৌঁছায়। “আমরা এত ভয় পেয়েছিলাম যে কোন জায়গায় বেশিক্ষণ বিশ্রাম নিতে পারছিলাম না। যদিও রাতে আমরা থেমেছি, কিন্তু দুশ্চিন্তায় ঘুম আসেনি। আমি জানতাম যে সৈন্যরা আমাদের চারপাশেও আছে। আমি তাদের ভয়ে ভীত ছিলাম এবং আমার ভয় ছিলো যে তারা আমাকে ধরে ফেললেই ধর্ষণ করার চেষ্টা করবে।”

পুরো রাস্তায় পাকিস্তান থেকে আসা পাঞ্জাবি সৈন্যরা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনাদের সাথে লড়াই করছিলো। যে কোন জায়গায় দাঙ্গা বাঁধতে পারে। তাই মাকসুদারা সম্ভাব্য জায়গাগুলো এড়িয়ে চলছিলো। তাই তাদেরকে আঁকাবাঁকা পথে চলতে হচ্ছিলো।

যাত্রার শেষে মাকসুদা এবং তার মা নদী পার হবার জন্য একটি ফেরি দেখতে পেল। দুঃখের বিষয় হলো, নাজিমপুর পৌঁছে তারা দেখলো সেখানেও অরাজকতা চলছে এবং গ্রামবাসী নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

“পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রামের দিকে আসছিলো। যতো সময় যাচ্ছিল, তারা আরো কাছাকাছি চলে আসছিলো। সবাই গ্রাম থেকে গ্রামে পালিয়ে যাচ্ছে। চেষ্টা করছে সেনাবাহিনীকে এড়িয়ে চলতে। যখন সৈন্যরা অপারেশন চালাতে আমাদের গ্রামে আসল তখন আমি, আমার বান্ধবী এবং গ্রামের আরও কয়েকজন পাট ক্ষেতে পালিয়ে থাকলাম। পাট প্রায় ১৫ ফুট লম্বা হয় এবং পালানোর জন্য খুব ভালো জায়গা।” বিপদের প্রথম মুহূর্তেই মাকসুদা দ্রুত কাদামাটিপূর্ণ ধানক্ষেতে লাফ দিলো। সৈন্যরা চলে যাবার পরে তারা বেরিয়ে আসল এবং ধানক্ষেত থেকে লাগা কাদামাটি পরিষ্কার করে ফেললো এবং পরিবর্তী একশনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। এভাবে ক্রমাগত লুকোচুরি করা একজনের জীবনের জন্য অনেক কষ্টকর এবং পুরোটা যুদ্ধের সময় তাদের এটা করতে হয়েছে। ফরিদপুর জেলা ছিলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অন্যতম টার্গেট। কারণ এটা ছিলো প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মভূমি। সৈন্যরা ক্রমাগত এখানে তল্লাশি করছিলো। তারা মুক্তিবাহিনীর খোঁজ করছিলো।

“পুরো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমি গ্রামে ছিলাম। আমি সব সময় ভীতির মধ্যে ছিলাম। রাতে আমি চিন্তা করতাম আমাকে মনে হয় তুলে নিয়ে যাবে। এই চিন্তায় অনেক সময় আমি ঘুমাতে পারতাম না। আমি ভাবতাম পাকিস্তানি সৈন্যরা রাতে আসতে পারে। তাই আমি জেগে থাকতাম এবং সজাগ থাকতাম। যাতে আমি পালিয়ে যেতে পারি এবং লুকাতে পারি।”

মাকসুদার ভয়ের অন্যতম কারণ ছিলো তার গ্রামে সৈন্যদের বর্বরতার ঘটনাগুলো সে নিজে দেখেছিলো। “অনেক লোককে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। তাদের রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে। আমি তাদের জখম দেখেছি। কয়েকবার আমি মরা লাশ নদীর পানিতে ভেসে যেতে দেখেছি। এবং আমি জানি গ্রামের প্রায় ২০ টা মেয়েকে সৈন্যরা তুলে নিয়ে গিয়েছে এবং ধর্ষণ করেছে। এদের বেশিরভাগ ছিলো স্কুলপড়ুয়া এবং তাদের বয়স ১৬ বা ১৭ বছর। কয়েকজনকে গ্রামেই ধর্ষণ করা হয়েছে। আর কয়েকজনকে আর্মি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারা সবাই গ্রাম থেকে হারিয়ে গেছে এবং আর কোনোদিন গ্রামে ফিরে আসেনি।” তাদের মাঝে কয়েকজন হয়ত এই অত্যাচার সহ্য করেও বেঁচে ছিলো, কিন্তু তারাও আর কখনোই ফিরে আসেনি। তাদের অপমানবোধে এত বেশী ছিলো যে তারা সমাজে তাদের হারানো সম্মান আর কখনো ফিরে পাবেনা ভেবে নিজেদের ঘরে ফিরে আসতে পারেনি। দেশের কিছু অঞ্চলে এইসকল মেয়েদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র খোলা হয়েছিলো। যাদের সফলভাবে পুনর্বাসন করা গেছে তারা কেউ কেউ গ্রামে ফিরে এসেছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা মোট ভুক্তভোগীর সংখ্যায় তুলনায় খুব কম ছিলো।

এসব নিয়ে বলতে মাকসুদা খুব লজ্জা পাচ্ছিল। তবে সে এসব মেয়েদের সম্পর্কে জেনেছে। মাকসুদা বুঝিয়ে দিলো যে সে ‘ধর্ষণ’ শব্দের প্রয়োগটা জানে। তার এই তিক্ততা আরও বেড়েছে যখন সে দেখেছে গ্রামের স্থানীয়রা সৈন্যদের সহায়তা করেছে।

“সৈন্যদের এসব জঘন্য কাজে গ্রামের কিছু লোক সাহায্য করেছে। একজন সাহায্যকারী বাঙালি (রাজাকার/আলবদর) তাদের সাথে কাজ করতো যে সুন্দরী মেয়েদের চিনত এবং তারা কোন বাড়ীতে থাকে সেটা সৈন্যদের চিনিয়ে দিতো। আমাদের মনে হয় এইসব সাহায্যকারী বা রাজাকাররা কখনো কখনো ধর্ষনে অংশগ্রহণও করেছে। যুদ্ধের সময় আমাদের গ্রামে কোন শান্তি ছিলোনা। হয়ত আমার প্রতিবেশীদের কেউই ছিল রাজাকার।”

১৯৭১ সালের যুদ্ধের অনেক আগে মাকসুদা এবং তার মা বঞ্চনা আর দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তাদের ব্যক্তিগত জীবন যুদ্ধ শুরু করে। ৯ বছর বয়স পর্যন্ত মাকসুদা নাজিমপুরে আনন্দের সাথেই বসবাস করতো। হঠাৎ তার বাবার মাথায় সমস্যা হয় এবং একসময় সে নিখোঁজ হয়ে যায়। আজ পর্যন্ত সে নিখোঁজ আছে। যদিও মাকসুদা মনে করে সে এখনো জীবিত আছে। সে চলে যাবার পরে পরিবারের কোন আয় ছিলোনা। তাই মাকসুদার চাচা তার মায়ের জন্য ঢাকার এক সরকারি কর্মকর্তার বাড়ীতে গৃহকর্মীর চাকরী ঠিক করে দেয়।

“ঢাকায় কাজ করতে আসার আগে আমি আগে কোনোদিন গ্রামের বাইরে যাই নাই। যখন আমরা শহরে পৌঁছালাম আমার মনে হলো এটা একটা স্বপ্নপুরী। আমার বিশ্বাস হতো না যে মানুষ এত বড় দালান তৈরি করেছে, অথবা এত গাড়ি থাকতে পারে। আমাদের গ্রামের জীবন সাধারণ। কিন্তু এখানে মানুষকে আকর্ষণ করার মত অনেক কিছু আছে। আমি যা দেখতাম তাই দেখেই মুগ্ধ হতাম। আমি আর আমার মা প্রথম কয়েকদিন পায়ে হেঁটে শহর ঘুরে দেখতাম। আমি ভাবতাম এরকম একটা শহরে আমি খুব সহজেই চাকরী পাব এবং অনেক টাকা আয় করতে পারব।”

কিন্তু বাস্তবতার মুখোমুখি হবার সাথে সাথেই এসব চাকরীর স্বপ্ন এবং টাকা আয় করার চিন্তা দূর হয়ে গেলো। বাংলাদেশে শুধুমাত্র ধনীরাই গৃহকর্মী রাখতে পারে। তারা যে বেতন দেয় তা অত্যন্ত কম। মাকসুদার মা যে সরকারি অফসারের বাড়ীতে কাজ করতো সেখানে মাসে ১৫ টাকা (২ ডলার) বেতন পেত। সাথে থাকা-খাওয়া। মাকসুদা তার মায়ের সাথে থাকতো এবং বাসায় বাচ্চাদের দেখাশোনার কাজ করতো। যদিও তার বয়স মাত্র ৯ বছর, তবুও মাকসুদা বাড়ীর বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে পারতো। বাংলাদেশে ছয়-সাত বছরের শিশুদের পক্ষে তাদের পরিবারের ছোট বাচ্চাদের দেখাশোনা করার বিষয়টা অস্বাভাবিক নয়। যদিও বেতনবিহীন কর্মচারী হিসেবেই সে কাজ করে যাচ্ছে – তবুও সে তার নিজের থাকা-খাওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এভাবে তিন বছর চলে।

১২ বছর বয়সে মাকসুদা তার প্রথম চাকরীটা পায় গৃহকর্মী হিসেবে। তার বেতন মাসে ৫ টাকা। প্রথমদিকে সে পরিবারের সাথে তেমন যোগাযোগ রাখতে পারছিলোনা। নিজের সাথে মিলিয়ে চলতে পারছিলোনা এবং সে খুব একাকী বোধ করছিলো। প্রায় সব সময় সে কাঁদত। একমাসের মধ্যে যে পরিবার তাকে রেখেছিলো তারা মাকসুদাকে তার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়।

মাকসুদার জন্য আরেকটা চাকরী খোঁজার পরিবর্তে তার মা তাকে ঢাকার কয়েক মাইল বাইরে যেখানে মাকসুদার ছোট ভাইবোন আছে তাদের দেখাশোনার জন্য পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। বেশ কয়েকমাসের জন্য মাকসুদা মায়ের বিকল্প হিসেবে সেখানে কাজ করে। রান্না করা, তারা পরিষ্কার আছে কিনা দেখা এবং ঠিক মতো ঘুমাচ্ছে কিনা সেগুলো সব সে দেখাশোনা করতো। এটাও শেষ হলো যখন বাচ্চাদের নাজিমপুরে অন্যান্য আত্মীয়দের কাছে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা হলো।

এর মধ্যে মাকসুদা কাজ করার জন্য পরিণত হয়ে গেলো এবং সে ঢাকায় একজন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ারের বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ আরম্ভ করলো । তার মাসিক বেতন ছিলো ৭ টাকা। মাকসুদা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হবার আগ পর্যন্ত মোট ২ বছর এখানে কাজ করেছে। ১৯৭১ সালে সে এবং তার মা গ্রামে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। যে ইঞ্জিনিয়ারের বাসায় সে কাজ করতো সেও পালিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর মাকসুদা নাজিমপুরে এক বছর থাকে এবং তার পরিবারের অন্যান্য ছোট শিশুদের দেখাশোনা করে।

ঢাকায় ফেরার পর সে এখন একজন বিধবা মহিলার বাড়ীতে কাজ পায় যার স্বামী ছিলেন নিহত হওয়া প্রায় শতজন বুদ্ধিজীবীদের একজন। যুদ্ধের প্রায় শেষ দিনগুলোতে তাদের মেরে ফেলা হয়। সে যে বাড়ীতে কাজ করে সেখানে এরকম আরও অনেক বিধবা মহিলা ও তাদের সন্তানরা থাকে। এই সকল মহিলারাই শুধু তাদের স্বামীকে হারায়নি বরং দেশ হারিয়েছে তার সবচাইতে মেধাবী চিন্তার শক্তিগুলোকে।

“আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠি। সকালের নাস্তার আগে আমি ঘর মুছি, আসবাবপত্র পরিষ্কার করি এবং গোসলখানা পরিষ্কার করি। সকালে আমি সাধারণত রুটি খাই। নাস্তার পরে আমাকে পুরো পরিবারের সবার কাপড় ধুতে হয়। মোট ৬ জন এবং আমি। মেমসাহেব (বাড়ীর মালিক) বাড়ীর বাকিদের দুপুরের খাবার আয়োজন করেন এবং তারা একসাথে খাওয়া-দাওয়া করেন। এরপর আমি থালাবাসন পরিষ্কার করি এবং গোসল করে দুপুরের খাবার খাই। দুপুরের খাবার খেতে একটু দেরিই হয়ে যায়। যখন আমার কাজ শেষ হয় আমি নিজের জন্য ১ ঘণ্টা সময় পাই। বিকেলে আমি দুটো বাচ্চাকে দেখাশোনা করি এবং তাদের সাথে বাইরে খেলতে যাই। সন্ধ্যা হয়ে এলে আমি ঘরে ফিরে আসি এবং রাতের খাবারের আয়োজন করি। রাতের খাবারের পর আমি আবার থালাবাসন পরিষ্কার করি। দীর্ঘ সময় ধরে প্রচুর কাজ আমাকে করতে হয়।”

এত কাজ করার পরেও মাকসুদার মালিক তার উপর সন্তুষ্ট নন। এতে মাকসুদার খুব মন খারাপ হয়। এত কাজ করেও সে মাসে মাত্র ১২ টাকা আয় করে। সে এরচাইতে একটি ভালো বেতনের ভালো চাকুরী আশা করে। কিন্তু সে অন্য একটা কাজ খোঁজার চেষ্টা করতে পারেনা – কারণ যদি তার মালিক জেনে যায় তাহলে নির্যাতনের পরিমাণ আরও বাড়বে। মাকসুদার মা তার জন্য একটা চাকরী খুঁজছে। যতক্ষণ না সে একটা চাকরী যোগাড় করতে পারে ততক্ষণ মাকসুদাকে মুখ বুঝে সব সহ্য করে কাজ করে যেতে হবে। বেশী বেতনের চাইতে মাকসুদার ইচ্ছা একটি শান্তিপূর্ণ পরিবারে কাজ করা।

কাউকে চাকরী দেবার আগে একটি পরিবার কর্মচারীর স্বভাব-চরিত্র সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষন করে। এর মধ্যে সততাকে তারা সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। সেটা অর্জিত হবার পর কাজের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে বেতন নির্ধারন করা হয়ে থাকে। এটা নির্ভর করে পরিবারের আকারের উপর। কাজের লোক বাজার করতে পারবে কিনা, রান্না করতে পারে কিনা এসবের উপর। এই সকল বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে একটি প্রস্তাব দেয়া হয়।

১৫ বছর বয়সে মাকসুদা প্রথম স্কুলে যায়। অন্যান্য গৃহকর্মীদের স্কুলে যেতে দেখে মাকসুদাও তার মালিকের কাছে আবদার করে। তার মেমসাহেব তাকে দিনে ১ ঘণ্টার জন্য স্কুলে যেতে দিতে রাজি হয়। প্রতিদিন সে তার প্রাথমিক বাংলা বই ‘সবুজ সাথী’ পড়ে। সে বাংলা লিখতে ও পড়তে শিখছে এবং তার স্কুল চালিয়ে যেতে পারবে বলে আশা করে। কিন্তু এই অল্প পরিমাণ শিক্ষা মাকসুদাকে তাকে গৃহকর্মীর কাজ থেকে মুক্ত করতে পারবে না।

বেতনের বাইরে মাকসুদাকে থাকা-খাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এবং বিশেষ উৎসবে জামা-কাপড় দেওয়া হয়। এমন একটি উৎসব হচ্ছে ঈদ। এটা মুসলমানদের সবচাইতে বড় উৎসব। ১ মাস রোজা রাখার পরে তারা এই উৎসব পালন করে। এই সময়ে মানুষ একে অপরের সাথে দেখা করে এবং খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে। মাকসুদাকে হয় শাড়ি অথবা রুপার গয়না উপহার দেওয়া হয়। এবং মাঝে মাঝে তাকে কিছু টাকা দেয়া হয় যেটাকে ‘বকশিস’ বলা হয়।

মাকসুদার ভবিষ্যৎ বলতে এখন শুধু একটি বিষয়ই আছে। তা হলো বিয়ে। কম বেতনের জন্য তাকে বাধ্য হয়েই গৃহকর্মীর কাজ করে যেতে হবে। এবং একটি ভালো বিয়ের সম্বন্ধের অপেক্ষা করতে হবে। এটা তাকে এই ভৃত্যজীবন থেকে মুক্ত করতে পারে এবং তার নিজের একটা জীবন দিতে পারে। সেটা যতো গরিবী হোক না কেন।

মাকসুদার পারিবারিকভাবে বিয়ে হবার চাইতে ভালোবাসার বিয়ে হবার সম্ভাবনা আছে। তার সামান্য একটু স্বাধীনতা আছে। কারণ সে বাচ্চাদের সাথে বাইরে যেতে পারে যার ফলে কোন ছেলের সাথে তার পরিচিত হবার সম্ভাবনা আছে।

তাছাড়া, মাকসুদার মা তার জন্য একটা ছেলে দেখতে পারে। যদিও তার মায়ের সাথে তার অন্যরকম খোলামেলা সম্পর্ক আছে সেকারণে তার মতামতকে মূল্যায়ন করার সম্ভাবনা আছে। তবে তার বিয়ের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে তার মা।

বিয়ের পরে মাকসুদা ভিন্ন রকম জীবন আশা করে। “আমি পর্দা করব (এটি বাংলাদেশের মহিলাদের ট্র্যাডিশনাল একটি রীতি)। আমি বেশিরভাগ সময় বাড়ীতে থাকবো। আমি ধর্মের ব্যাপারে আরও মনোযোগী হব এবং স্বামীর সাথে মিলেমিশে চলবো।”

এভাবে মাকসুদা গৃহকর্মী হিসেবে তার অসুখী জীবনের ইতি টানবে এবং নিয়মমাফিক বিবাহিত ও আবদ্ধ জীবন বেছে নেবে। একজন আদতে নিরক্ষর, গরীব, পনেরো বছর বয়স্ক মেয়ের জন্য একটি পথই খোলা থাকে, আর সেটি হচ্ছে – বিয়ে।


মিশুক মুনির
তেরো বছর
মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে

যুদ্ধের শেষ দিকে, ধর্মতাত্ত্বিক ধারণা নিয়ে সৃষ্ট বাঙালি মুসলমানদের একটি গোষ্ঠী – আলবদর, একটি ভয়ংকর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করে। তারা প্রায় তিনশো বুদ্ধিজীবীকে গ্রেফতার করে এবং তাদের অধিকাংশকেই ভয়ংকর নির্যাতন করে হত্যা করে। এই এক ধাক্কায় একটি নতুন জাতি তার সবচাইতে শিক্ষিত শ্রেণিগোষ্ঠীকে হারায়।

নিহত এসকল বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম একজন হলেন মুনির চৌধুরী; মিশুকের বাবা। যিনি এই আলবদরের শেষ কামড়ের শিকার। মিশুকের বয়স ১৩ বছর এবং সে স্কুলে পড়ে। সব সুযোগ সুবিধা ঘিরে ছিলো মিশুককে। সে এমন একটি পর্যায়ে ছিলো যেখানে জীবনের ঝুঁকি খুব খুব কম। দিনের খাবার কোথা থেকে আসবে সেই চিন্তাও ছিলোনা। তার লেখাপড়া নিশ্চিত ছিলো। এবং খেলাধুলার জন্য যথেষ্ট সময় ছিলো। কিন্তু যে মেঘ তাকে ঢেকেছিলো তা গ্রামের দারিদ্রক্লিষ্ট একজনের ওপর যেমন হয় তার চাইতে কোন অংশেই কম নয়। সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না কিভাবে সে তার বাবাকে হারিয়েছে।

“আমি আমাদের বাসার ব্যালকণিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ আমি রাজাকারদের আমাদের বাসার দরজার দিকে আসতে দেখি। তারা একযোগে আসে এবং আমার বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। আমার মনে আছে তাদের কেউ কেউ ইউনিফর্মে ছিলো আর কেউ ছিলো সাধারণ পোশাকে। কিন্তু তাদের সবার কাছে বন্দুক ছিলো। আমার কিছুই করার ছিলোনা। আমার মা আমার ছোট ভাইকে তার কোলে নিয়ে বসে ছিলেন। এবং তিনি কাঁদছিলেন। আমার বৃদ্ধা অসহায় দাদীও কাঁদছিলেন। তিনি তার ছেলেকে তাড়াহুড়া করে ধরে নিয়ে যাবার দৃশ্য দেখেছিলেন। বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে এটা ভেবে আমরা স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। এবং সেদিন – ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। এর পর আর কোনদিন আমরা বাবাকে দেখতে পাইনি।”

মিশুকের বাবা একটা বড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন সেসময়। ঝুঁকি নিয়েই তিনি ঢাকায় থেকে গিয়েছিলেন। তিনি কোনভাবে ধারণা করেছিলেন যে তাকে গ্রেফতার করে জেলে দেয়া হতে পারে। কিন্তু শহর ছাড়ার মতো কোন ক্ষমতা তার ছিলোনা। ১৯৫০ সালে ‘ইন্টেলেকচুয়াল ক্রাইম’ এর অপরাধে জেল হলে তাঁর স্বাস্থ্য পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। জেলের অমানুষিক ভোগান্তির ফলে তাঁর মেরুদণ্ডের আর্থ্রাইটিস রোগ হয়। এর ফলে সে দুর্গম আন্ডারগ্রাউন্ড’ দিয়ে পালাতে পারেনি।

“অক্টোবরে আমার বাবা ভাবছিলেন যে তিনি এমন শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও ঢাকা ছেড়ে যাবেন। কিন্তু তিনি বললেন, ‘আমি এখন কেন যাব? স্বাধীনতা প্রায় হাতের মুঠোয়। আমাদের ভয়ের কিছু নেই।’ কিন্তু তাঁর ধারণা অত্যন্ত ভুল ছিলো। তাকে ধরে নিয়ে যাবার কয়েক দিন আগেও বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় হত্যাকাণ্ড ঘটছিলো। আমাদের সেটা জানার কোন উপায় ছিলোনা। এবং সময় মতো বিপদ সম্পর্কে জানতে পারিনি।”

মিশুকের বাবা ছিলেন দেশের স্বনামধন্য সাহিত্যিক। তাঁর ছেলের জন্ম হবার আগেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান ছিলেন। ১৯৫২ সালে তাঁর একজন সহকর্মী তাকে বাংলা ক্লাস নিতে বলেন। তখন পাকিস্তানের অফিসিয়াল ভাষা ছিলো উর্দু। এবং সরকার ব্যাপকভাবে বাংলাকে দমিয়ে রাখছিলো। মুনির চৌধুরী সরকারের এই সিদ্ধান্তের কঠোর বিরোধিতা করেন। এবং তাকে তাঁর ভাষা সংক্রান্ত কাজকর্মের জন্য তাকে জেলে ঢোকানো হয়। ১৯৭১ সালে আটকের সময় তিনি লেখক সমিতির সভাপতি ছিলেন এবং বাংলা একাডেমীর পরিচালক ছিলেন। বাংলা একাডেমী বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠান।

বুদ্ধিজীবী হিসেবে মিশুকের বাবার যে সুনাম ছিলো, সেটার চাইতে বাবা হিসেবে তাঁর যে আদর ও ভালোবাসা ছিলো সেটা মিশুকের কাছে অনেক বড় ব্যপার ছিলো। “আমি দেখেছি তিনি অন্যদের বাবাদের চেয়ে ভিন্ন রকম ছিলেন। তিনি সবার দেখাশোনা করতেন। তিনি প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পর আমার দাদীর সাথে দেখা করতেন। তিনি আসার আগে আমি স্কুল থেকে ফিরতাম। এবং আমি তাঁর জন্য অপেক্ষা করতাম। কারণ তিনি আসলে আমি তাঁর সাথে বাইরে ঘুরতে যাব। আমি গাড়িতে ঘুরতে পছন্দ করতাম এবং তিনি যেখানেই যেতেন, আমাকে নিয়ে যেতেন। আমরা খুব ঘনিস্ট ছিলাম। আমি যে কোন কিছুর চাইতে বাবাকে বেশী ভালোবাসতাম।”

আজপর্যন্ত মিশুক ভাবতে চায়না যে তার বাবা মারা গেছেন। কারণ তাঁর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে এখনো এই আশা আঁকড়ে ধরে আছে। কিন্তু ডিসেম্বরের ১২ থেকে ১৬ তারিখের মধ্যে যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদের অনেককেই পরে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। তাঁদের হাত পেছনে বাঁধা ছিলো, গায়ে নির্যাতনের চিহ্ন ছিলো এবং লাশগুলো বিগলিত ছিলো যে কারণে চেনা যাচ্ছিলনা।

“শেষ মুহূর্তের ‘হয় করো নয় মরো’ পরিস্থিতিতে তারা ঘৃণাবশত এগুলো করেছে। বুঝতে পেরেছিলো যে আমরা জিতে যাচ্ছি এবং যদি আমরা স্বাধীন হয়ে যাই তাহলে এই বুদ্ধিজীবী হত্যার কারণে এই স্বাধীন দেশটিতে একটি মেধা-শূন্যতার সৃষ্টি হবে। আমরা দেশের সবচাইতে মেধাবীদের সেবা থেকে বঞ্চিত হব। আমরা আমাদের সকল মহান মানুষগুলোকে হারিয়েছি এবং এই নিষ্ঠুরতায় কিছুই অর্জিত হয়নি।’

মিশুকের বাবা চলে যাবার পর তার জীবন এখন স্কুলকে ঘিরে। সম্ভবত সে দেশের ভবিষ্যৎ বুদ্ধিজীবীদের একজন হতে যাচ্ছে। তার সমস্ত মনোযোগ এখন দশম শ্রেণি পাশের দিকে সীমাবদ্ধ এবং এর পরে সে উচ্চশিক্ষা নিতে যাচ্ছে।

‘আমি সকাল সাড়ে ৮ টায় ক্লাস শুরু করি এবং ক্লাস দুপুর ১ টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত চলে। খাবার জন্য আধা ঘণ্টা বিরতি দেয়া হয়। আমাদের দিনে ৭ টা ক্লাস হয়। একেকটি ক্লাস ৪০ মিনিট দীর্ঘ।’ ব্রিটিশ শিক্ষাক্রম অনুযায়ী নবম শ্রেণিতে থাকাকালীন একজন শিক্ষার্থী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে ভবিষ্যতে সে কোন দিকে যাচ্ছে – অর্থাৎ বিজ্ঞান নাকি কলা শাখা। এই পূর্বগৃহীত সিদ্ধান্ত বেশিরভাগ শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে কার্যকর। এর ফলে ছাত্ররা দ্বাদশ শ্রেণির আগেই অনেকগুলো বিষয় পড়ার সুযোগ পায়। মিশুকের অন্যান্য বন্ধুরা আলাদা প্রোগ্রাম মেনে চলে। যদিও সাধারণ বিষয়গুলোতে তাদের মিল আছে।

মিশুকের ভাষা কোর্সের মধ্যে সাহিত্য এবং ভাষার ব্যবহারিক প্রয়োগ দুটো বিষয়ই আছে। তার ইংরেজি বিষয়ে কবিতা, গদ্য, চিঠি লেখা, ব্যাকরণ এবং অন্যান্য বিষয়গুলো আছে। ক্লাসটা ইংরেজিতে নেয়া হয়। যদিও শিক্ষক বোঝানোর সুবিধার্থে বাংলাতেও কিছু কিছু বলেন। অন্য সকল ক্লাস বাংলায় নেয়া হয়। স্বাধীনতার পূর্বেও বাংলাতেই সহজে বোঝানো হতো। মিশুক ইংরেজিতে খুবই দক্ষ এবং লেখকের সাথে খুব সহজেই কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিল। স্বাধীনতার পুর্বে মিশুককে উর্দুও শিখতে হতো।

মিশুকের স্কুলে মেয়েরা আলাদা ক্লাসরুমে ক্লাস করে। অন্যান্য কিছু স্কুল ছেলেমেয়েদের একই ক্লাসরুমে পড়ার অনুমতি দেয়। তবে সেখানে বসার আসন আলাদা। অর্থাৎ লম্বা বেঞ্চে ছেলেরা এক পাশে এবং মেয়েরা আরেক পাশে বসে ক্লাস করে। মিশুক শনিবার সহ সপ্তাহে ৬ দিন ক্লাসে যায়। প্রথম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্ররা সপ্তাহে ৫ দিন স্কুলে যায়। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় এক মাস সে গ্রীষ্মকালীন ছুটি ভোগ করে।

মিশুকের পরিবারে সাহিত্য, নাটক এবং যোগাযোগে অভূতপূর্ব অর্জনের দৃষ্টান্ত থাকায় তার ভবিষ্যৎ কোর্স কোনটা হবে তা এখনো নিশ্চিত না। পড়াশোনা শেষ হলে তার আশা সে সাংবাদিক হবে। বাংলাদেশে সাংবাদিকতার প্রতি একটি ব্যাপক আগ্রহী জনগোষ্ঠী রয়েছে।

মাসে দুইবার মিশুক এবং স্কুলের আরও কিছু বাচ্চা রেডিওতে একটি প্যানেল হিসেবে অংশগ্রহণ করে এবং তারা সমসাময়িক আগ্রহের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করে। এই প্রোগ্রামের জন্য সে সামান্য কিছু টাকাও পায়। এটা তাদের পরিবারের একটি রেওয়াজ বলা যায়। কারণ তার মা স্বনামধন্য একজন অভিনেত্রী যিনি ১৯৪০ সাল থেকে কাজ করছেন। এবং তিনি টেলিভিশনেও নিয়মিত কাজ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী অর্জনের পর মিশুক তার শিক্ষাকে আরও প্রসারিত করতে চায়। খুব সম্ভব সে ভারতের নয়া দিল্লীতে যাবে যেখানে তার বড় ভাই ভাষণ এই মুহূর্তে থিয়েটার আর্টস নিয়ে পড়াশোনা করছে। সেখানে সে গ্রাজুয়েশন করতে পারে।

জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা মিশুক শক্তভাবেই টের পায়। বুদ্ধিজীবীদের উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞে যে ক্ষতি হয়েছে, ব্যক্তিগত এবং নাগরিক – উভয় হিসেবেই সে তা বুঝতে পারে; অনেক শিক্ষিত যুবকরা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, কারণ যে ভবিষ্যৎ তারা এখানে পেতে পারত, দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার কারণে তারা সেটা আর পাচ্ছে না।

মাত্র ১৩ বছর বয়সেই মিশুক দেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। ‘আমি যেখানেই যাই সেখানেই সমস্যা দেখা যায়। সব যায়গায় অসততা বিরাজমান। পরীক্ষার হলে কত ছাত্ররা নকল করে।’ এই অধঃপতন যুদ্ধের কারণে হয়নি। মিশুক অনেক ছোট – তাই তার জানার কথা না। এগুলো ১৯৭১ সালের অনেক আগে থেকেই চলে আসছে যা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে পর্যবসিত হয়।

মিশুকের দর্শন তার ব্যক্তিগত দুঃখজনক অধ্যায়ের দ্বারা অনেকটাই প্রভাবিত। ‘যদি আমার পরিবারে এটা না ঘটত আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনন্দ আরও বেশি উপভোগ করতাম। এই ক্ষতির কারণে নতুন জাতি হিসেবে উদ্ভাসিত হবার ব্যাপারটা আমার কাছে তেমন কিছু মনে হয়না। আমার বাবাই আমার কাছে সবকিছু ছিলেন।’

মূল্যস্ফীতির ব্যাপারে মিশুকের চিন্তাভাবনা অন্যান্য বাঙালীর থেকে আলাদা। তার অভিযোগ ভিন্নরকম। ‘আজকাল জিনিসের দাম অনেক বেশি। যুদ্ধের আগে একটি ক্রিকেট বলের দাম ছিলো ৯ থেকে ১০ টাকা। এখন এর দাম ৫০ টাকা। এবং বলটা তেমন ভালো না। আপনি যদি বলটা ড্রপ করেন এটা উপরে ওঠেনা। নিচেই পড়ে থাকে। এখন আমরা যে পণ্য পাই এগুলোর কোয়ালিটি আগে যেগুলো পেতাম সেগুলোর থেকে নিম্নমানের। ক্রিকেট ব্যাটের মতো কিছু কিছু আইটেম একেবারেই পাওয়া যায়না। আপনি বাংলাদেশে একটি ক্রিকেট ব্যাট কিনতে পারবেন না।’

স্কুলের পর মিশুক বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলে। আবহাওয়া ভালো থাকলে তারা ৪ টা থেকে সাড়ে ৬ টা পর্যন্ত খেলে।

সে কিছু সময় তার মাকে বাড়ীর কাজে সাহায্য করে। কারণ তাদের বাড়ীতে কাজের লোক রাখার মতো কোন অবস্থা নেই। খাবারের পরে মিশুক টেবিল পরিষ্কার করে এবং মুছে রাখে। মাঝে মাঝে সে বাইরে খেতে যায়। সে তার ছোট ভাই তন্ময়কেও খাওয়ায়। ওর বয়স ছয় বছর।

সকালের নাস্তায় মিশুক অন্য বাঙালী ছেলেদের চাইতে একটু আলাদা কিছু খায়। সে টোস্টের সাথে মাখন, কমলালেবুর আচার, ডিম এবং ওভাল্টিন দেয়া দুধ খায়। ওভাল্টিন বাংলাদেশে একটি জনপ্রিয় পানীয় – অবশ্য যারা কেনার সামর্থ্য রাখে তাদের কাছে। দুপুরের আর রাতের খাবার সাধারণ বাঙালী ধাঁচের। সাধারণত ভাত, মুরগি আর ডাল। সাথে সবজি। ডিনারের জন্য ভাত, সাথে মাংস। অথবা রুটির সাথে মাংস। টিফিন পিরিয়ডে মিশুক স্কুলের ক্যাফেটেরিয়ায় যায় এবং হাল্কা নাস্তা করে। সে মাঝে মাঝে মাংসভর্তি একধরনের পেস্ট্রি খায় – যাকে সমুচা বলে।

যুদ্ধের কারণে মিশুকের স্কুলিংএ খুব সমস্যা হয়। সেই সময়ে তার পরিবার ধানমণ্ডিতে দাদার বাড়ীতে থাকতো। এটা ঢাকার ভেতর একটি অভিজাত এলাকা। আগেভাগে সতর্ক না করে মুক্তিবাহিনী এলাকায় আসল এবং এলাকায় তল্লাশি করতে লাগলো। মিশুক ভয় পেয় গেলো। “আমরা জানতাম না কি হতে যাচ্ছে। হঠাৎ তারা একটি গাড়ি উড়িয়ে দিলো এবং এটাকে আমাদের বাড়ীর সামনে রেখে গেলো। পাকিস্তানি পুলিশ আমাদের এখানে আসার আগেই আমরা এটা থেকে কোনমতে বাঁচলাম। আমরা একটি আর্মড ক্যাম্পে আটকা পড়ে গেলাম। যদিও আমি তখন সেটা জানতাম না যে আর্মি রাস্তা ব্লক করে রেখেছে।

এসব না জানার কারণে আমি আমার বন্ধুর বাড়ীতে যাচ্ছিলাম কিছু কমিকস বই ধার করতে। সে আমাকে ব্লকেড সম্পর্কে সতর্ক করলো। বাড়ী ফেরার পথে আমি গেটের কাছে পিছলিয়ে পড়ে গেলাম ভয়ের কারণে। পুলিশ আমাকে থামাল। তারা আমাকে প্রথমে জিজ্ঞেস করলো আমার ব্যাগে কী আছে। কমিকস বই ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। কিন্তু তারা বিনা কারণে আমাকে জেরা করতে লাগলো। তারপর তাদের একজন আমাকে লাথি দিলো। এবং বলল, ‘ভাগ’। আমি যখন বাড়ী ফিরলাম তখন আমি কাঁপছিলাম।”

ডিসেম্বরে যখন ভয়ানক যুদ্ধ শুরু হলো মিশুক ভারতীয় বিমানের আক্রমণের শব্দ পাচ্ছিল। “আমি হঠাৎ করে ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। আমি বুঝতে পারছিলাম না যে কী হচ্ছে। আমাদের বাসার সবাই নিচের তলায় চলে আসলো। এবং আমি শুনলাম তারা ভারতীয়দের আক্রমণের ব্যাপারে আলোচনা করছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না এর মানে কী। যুদ্ধের শেষ দুই সপ্তাহ আমি বাইরে তেমন একটা যাইনি। শুধুমাত্র বাসার পাশের রাস্তার সাথে এক প্রতিবেশীর বাড়ী ছাড়া আমাকে কোথাও যেতে দেয়া হতোনা।

আমাদের বাসা থেকে এয়ারপোর্ট মাত্র চার মাইল। তাই প্লেনগুলো একেবারে আমাদের মাথার উপর দিয়েই যাচ্ছিল। আমি নারকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সেগুলো উড়ে যেতে দেখতাম। আমি প্লেনগুলোর ডগফাইট দেখতাম এবং এক সময় কেউ একজন ভূপতিত হতো। প্লেন ধ্বংস হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি কালো ধোঁয়া বের হতে দেখতাম। আমি সব সময় ভয়ে থাকতাম যে হয়ত বাড়ীর উপর বোমা পড়তে পারে।
যদিও আমরা ভাবতাম ভারতীয়রা জিতে যাবে কিন্তু রেডিওতে পাকিস্তানিরা সব রিপোর্ট বদলে দিতো। তারা গর্ব করে ভারতীয় বিমান ভূপতিত করার গল্প বলতো এবং ভুয়া হতাহত রিপোর্ট পেশ করতো। এটা তারা আমাদের ভুল বোঝানোর জন্য করতো এবং আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করতো যে তারা জিতে যাচ্ছে। বিশেষ করে শেষ দিকে এটা তারা বেশি করতো। এমনকি তারা হাসপাতাল এবং এতিমখানায় বোমা মেরেছিলো। কিন্তু বলেছিলো যে ভারতীয়রা এটা করেছে। এটা গুজব ছিলোনা। অনেকেই এগুলো স্বচক্ষে দেখেছে।”

যুদ্ধ এবং বাবাকে হারানোর কারণে অনেক কিছুর উপর থেকেই মিশুকের বিশ্বাস উঠে গেছে। যদিও সে মুসলমান, কিন্তু সে এখন আর ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করেনা। মিশুকের ধর্ম শিক্ষা স্কুল থেকে শুরু হয় এবং ক্লাস সিক্স পর্যন্ত চলে। মুসলমান ধর্মের শুরুর ইতিহাস স্কুলজীবনে সকলেই শুনে থাকে।

মুসলমানদের মধ্যে দুই ধরনের বিশ্বাসী আছে। শিয়া এবং ছুন্নি। মিশুক এবং তার পরিবার ছুন্নির অনুসারী – অর্থাৎ তারা কোরআন, নবীর লিখিত চিন্তাধারা, এমনকি মৌখিক রীতিনীতিগুলো মেনে চলে। শিয়ারা মৌখিক রীতিনীতিগুলো মানেনা শুধু কোরআন এবং নবীর দুইজন নাতি হাসান ও হোসেন প্রণীত বিধিগুলো মেনে চলে। প্রতিবছর কারবালায় হুসেনের মৃত্যুকে স্মরণ করতে শিয়ারা মুহররম মাসে শোক পালন করে। তারা শ্লোগানের সাথে সাথে বুকের ওপর আঘাত করতে থাকে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ছুন্নি। কিন্তু পাকিস্তানের মুসলমানরা হলো শিয়া। এই বিভাজন দুই পাকিস্তান ভাগ হবার অন্যতম কারণ।

সাধারণত পুরুষেরা মসজিদে নামাজ পড়তে আসে। কিছু ভিক্ষুক মহিলা বাইরে অবস্থান করে। তারা মাটিতে বসে থাকে। তাদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়না।

সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হলো ঈদ। এটা বছরে দুইবার হয়। প্রথমটা হয় রমজান মাস শেষ হবার সাথে সাথে। রমজান মাসে মুসলমানরা রোজা রাখে। এই ঈদের নাম ঈদ-উল-ফিতর। এবং এই সময়ে সবাই আনন্দ করে এবং ভালো খাওয়াদাওয়া করে। দ্বিতীয় ঈদের নাম ঈদ-উল-আযহা। এই সময়ে তারা পশু কোরবানি দেয়।

মিশুকের স্কুলে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান সমানভাবে মিশতে পারে। ধর্ম ক্লাস হয় দিনের শেষ ক্লাসে। এতে যাদের ইচ্ছা তারা থাকতে পারে; আর বাকিরা চলে যেতে পারে। ক্লাসে মুসলমান ধর্মের উপর জোর দেয়া হয়। হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে খুব কম শেখানো হয়।

মিশুক ওয়েস্টার্ন অথবা ট্র্যাডিশনাল বাঙালী পোশাক পরে। সপ্তাহে দুই দিন স্কুলে সমাবেশ হয় এবং সবাইকে স্কুলের ইউনিফর্ম পরে যেতে হয়। নেভি ব্লু ট্রাউজার এবং হাল্কা নীল জামার সাথে সাদা স্ট্রাইপ। সব ছাত্রকে অবশ্যই তার নিজের ইউনিফর্ম পরতে হবে। যুদ্ধের আগে এর খরচ ছিলো প্রায় চল্লিশ টাকা। যেহেতু এখন এর খরচ প্রায় একশত টাকা তাই স্কুল কর্তৃপক্ষ এটাকে অনেকটা শিথিল করেছে। তবে তারা বলেছেন যতোটা সম্ভব মেনে চলতে। বাসায় এবং ঘুমানোর সময় মিশুক লুঙ্গি পরে। এটা একটা ট্র্যাডিশনাল পোশাক।

মিশুকের প্রতিদিনের জীবন যাপনে পশ্চিমা প্রভাব রয়েছে। কাপড়, খাবার, ভাষা – এগুলো তার অন্যতম। সে বাংলাদেশের অতি ক্ষুদ্র সংখ্যক মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন। দেশের যারা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ মিশুক তাদের একজন। দেশে থাকার ব্যাপারে মিশুক এখন অনেক হতাশায় ভোগে। সে অনেক ভুল দেখতে পায় সমাজে। যেমন মূল্যস্ফীতি প্রতিদিনের জীবনকে সংগ্রামের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। যদি দেশ এভাবে চলতে থাকে তাহলে এখানে থাকার মধ্যে ভালো কিছু সে দেখেনা। তবুও সে পরিবর্তন দেখতে চায়। ‘আমি মনে করি সবাই নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। আমি দোয়া করি এবং আশা করি সবাই যেন সেটা পারে। এবং কারো সাহায্য না লাগে। আমি এখানে আনন্দের সাথে থাকতে চাই।’


শেলি গোমেজ
এগারো বছর
এতিম মেয়ে

একজন এতিমকে যদি কোন পরিবার দত্তক নেয় তাহলে সেটা একটা পাসপোর্টের মতো গণ্য করা যায়। কিন্তু শেলি গোমেজের কাছে দত্তক মানে মায়া-মমতা আর ভালোবাসাহীন জীবন।

দুই বছর বয়সে তার বাবা-মা মারা যায়। এরপর তাকে চট্টগ্রামে একটি চার্চে নেয়া হয়। সেখানে সে চার বছর বয়স পর্যন্ত ছিলো। একটি নিঃসন্তান পরিবার তাকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু তাদের পারিবারিক কলহের কারণে এই অতিরিক্ত বোঝা তারা বইতে পারছিলোনা। কারণ এই পরিবার চরম অভাবের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল। শেলির কারণে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থায় আরও চাপ সৃষ্টি হয়। তারা অনেক সময় শেলিকে মারে, অপমান করে এবং তাড়িয়ে দিতে চায়। বিশেষ করে খাবার সময় তারা এরকম করে।

‘ঘরে আমার কোন শান্তি ছিলোনা। তাই আমি পালিয়ে এসেছি। এখন আমি একটি সুখী পরিবারের সাথে থাকি।’

যখন শেলির বয়স আট বছর এবং চার্চে থাকতো তখন ঐ চার্চের এক সাধক শেলিকে এই নতুন বাড়ীর খবর দিয়েছিলো। সাধক জানতেন এই পরিবারটি একটু বড় এবং দেখাশোনা করার জন্য তাদের একটি মেয়ে দরকার। শেলির এই দ্বিতীয় বাড়ীতে অনেক আত্মীয়স্বজন মিলে একসাথে থাকতো। এটি একটি বৃহদাকার একান্নবর্তী পরিবার। সে এখানে অনেক আনন্দে থাকতো যদিও এখানে কাজের চাপ বেশি।

শেলির মূল কাজ ছিলো এক দম্পতির বাচ্চা দেখাশোনা করা। তার পালক মা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষিকা। তিনি সবচেয়ে ছোট বাচ্চাটির দায়িত্ব শেলিকে দিয়ে যেতেন। শেলির বয়স মাত্র এগারো বছর হলেও সে বাচ্চাদের সাথে তাদের মায়ের মতো আচরণ করতো। যখন তাদের মা বাইরে সে তাদের খাওয়াত, গোসল করাত এবং অন্যান্য সাধারণ দেখাশোনা করতো।

শেলি প্রথমে যে বাড়ীতে ছিলো সেখানে সে স্কুলে যেতো। স্কুল তার খুব ভালো লাগতো। কিন্তু এখানে স্কুলটাইমে তাকে কাজ করতে হয়। তাই তার নিয়মতান্ত্রিক লেখাপড়া আট বছর বয়সেই শেষ হয়।

“আমাকে শুধু বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে হয় তা না; এই পরিবারের সবাই নানান কাজে আমাকে ডাকে। সেগুলোও আমাকে করতে হয়। আমি থালা-বাসন পরিষ্কার করি। এবং বাচ্চাদের কাপড়চোপড় ধুই। এছাড়া সারা ঘরেই আমাকে কাজ করতে হয়।” শেলি মাঝে মাঝে তার কাজে আনন্দ পায়। যখন তার মন খারাপ হয় তখন সে একা থাকতে ভালোবাসে। তখন সে সব কাজ আর মানুষজন থেকে দুরে থাকতে চায়।

“আমার সবচেয়ে ভালো লাগে গান গাইতে আর ভারতীয় নাচ করতে। আমি এটা স্কুলে শিখেছিলাম।” মিশনারী স্কুলগুলো দেশের স্কুলের মতোই। গান এবং নাচ এদের শিক্ষাক্রমের একটি নিয়মিত অংশ। ঢাকা থেকে কয়েক মাইল দূরে মহতবাড়ীতে তার এক বান্ধবী থাকে। তার সাথে একসাথে নাচতে শেলির ভালো লাগে।

যদিও শেলি কিছুদিন স্কুলে গিয়েছিলো কিন্তু সে এখনো নিরক্ষর। দেশের বেশির ভাগ মানুষের মতো সেও সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত। জীবনে একবার সে সিনেমা দেখেছিলো। টেলিভিশন কী জিনিস সে জানেনা। তবে সে খুব সৌভাগ্যবান। কারণ অন্যান্য অনেক শিশুদের মতো তাকে খাবার, কাপড় আর আশ্রয়ের চিন্তা করতে হয়না। যদিও তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়; তবে খাবারের জন্য তাকে হন্যে হয়ে ফিরতে হয়না।

শেলির নিজের কিছু জিনিসপত্র আছে। তার দু’টি সাধারণ পোশাক আছে। যখন সে শাড়ি পরতে চায় তখন তার পালক মায়ের থেকে ধার করে পরে। শাড়ি বাংলার ঐতিহ্যবাহী একটি পোশাক। সব শাড়ি একই দৈর্ঘ্যের। এবং যুবতী বা বৃদ্ধা – যে কেউ তা পরতে পারে।

শেলি মনে করে স্বাধীনতার আগে সে ভালো ছিলো। যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিলো ৯ বছর। “আমি মানুষকে যুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে শুনতাম। কিন্তু আমি অতটা বুঝতাম না। কারণ আমি ছোট ছিলাম। আমি ভাবতাম এই বোধ হয় আমাদের বাড়ীতে কোন বোমা পড়বে আর আমি মারা যাব। যখনই কাছাকাছি কোন বিমান আসতো, আমি মারাত্মক ভয় পেতাম।”

যুদ্ধের সময় শেলির পালক পিতা-মাতা মুক্তিবাহিনীর লোকদেরদের সাহায্য করেছিলো। তাদের চাল ও টাকা দিয়েছিলো। তাদের এলাকায় গেরিলা অপারেশন তেমন হয়নি। কারণ চারপাশে অনেকখানি এলাকা জলমগ্ন ছিলো। এবং সেখানে অনেক স্রোত ছিলো। তাই পাকিস্তানি সৈন্যদের স্পিডবোট নিয়ে এখানে আসতে সমস্যা হতো। অনেক বাঙালী এখানে আশ্রয় নিয়েছিলো। এখানকার মানুষ মুক্তিবাহিনীর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলো। তাই যায়গাটা মোটামুটি নিরাপদ ছিলো।

শেলির জীবন চিন্তা করলে আমার মনে হয় সিন্ডেরেলার কথা। একটি ছোট্ট সুশ্রী মেয়ে যে ঘরের সব কাজ করছে অথচ তার পালক অভিভাবকের শ্রীহীন কন্যাকে কোন কাজ করতে হচ্ছেনা। একজন সুশ্রী রাজপুত্রই পারে শেলিকে এই দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে।

শেলির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তার বিয়ের উপর। পারিবারিকভাবে বিয়ের রীতি শত বছরের পুরনো। যদিও সে বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভাবছেনা। কিন্তু এই জিজ্ঞেস করাটাও রেওয়াজের অংশ। কোন মেয়ে তার নিজের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলুক এটাও সঠিক বলে ধরা হয়না। আসলে তার নিজের ব্যাপারে ভাবার সুযোগ খুব কম। সে ধনী হোক বা গরীব – বিয়েই তার শেষ পরিণতি। সে এই ব্যাপারে তার বান্ধবীদের সাথে কথা বলতে পারে – তবে অভিভাবকদের সাথে নয়। যদিও শেলি একজন খ্রিস্টান, তবুও তার বিয়ের অনুষ্ঠান প্রথাগত মুসলমান বিয়ের মতো করেই হবে।

যখন শেলির বয়স ১৫ বছর হবে তখন তার পালক অভিভাবক তার বিয়ের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু করবেন। একইভাবে কোন ছেলের বয়স ১৮ হলে তা প্রযোজ্য। প্রতিটা বাবা-মা তার সন্তানের জন্য সঠিক পাত্র-পাত্রী খুঁজে পাবার ব্যাপারে সচেতন।

শিক্ষিত পরিবারে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সন্তান-সন্ততিরা একে অপরের ঘনিস্ট হতে পারে যা অনেক সময় বিয়ের দিকে পরিণতি নেয়। কিন্তু শেলির পক্ষে অপরিচিত কারো সাথে কথা বলা নিষেধ। তবে পরিবারের ছেলেদের সাথে সে কথা বলতে পারে – কারণ তাকে পরিবারের অংশ হিসেবে দেখা হয়। যদিও তাকে নিয়ম মাফিক পালিত সন্তান হিসেবে গ্রহণ করা হয় নাই। হয়ত শেলি যখন পানি আনতে যায় শুধু তখনই অন্য কোন ছেলের সাথে কথা হবার সুযোগ থাকে।

শেলিকে তার বিয়ের জন্য অবশ্যই তার পালক পিতা-মাতার উপর নির্ভর করতে হবে। যদি তাদের মাথায় বিশেষ কোন ছেলের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা থাকে, তাহলে তারা ছেলের পিতা-মাতার পক্ষে থেকে প্রস্তাব আসার জন্য অপেক্ষা করবে। শেলির বিয়ের জন্য প্রস্তাব আসলে তার পালক অভিভাবক আগে ছেলেটির আচার-আচরণ, আয় অথবা সম্ভ্যাব্য আয় – এগুলো বিবেচনা করবেন। যদি এক বা একাধিক প্রস্তাব আসে শেলিকে এই আলোচনায় শামিল করা হবেনা। এমনকি কোন প্রশ্ন করাও চলবেনা। যখন তার পালক অভিভাবকেরা কোন একটি ছেলের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে তখন সেটা শেলিকে জানানো হবে। তখন যদি কোন কারণে শেলি দ্বিমত পোষণ করে তাহলে তারা কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন।

যদি শেলির কোন পছন্দ থাকে – বা যদি তার বান্ধবীদের মাধ্যমে কারো সাথে পরিচয় হয়- তাহলে সে এই সম্পর্কে তার পালক অভিভাবককে সরাসরি কিছু বলবে না। সে হয়ত অন্য কোন ঘনিস্ট আত্মীয়কে জানাবে। হয় কোন চাচী বা বোন সম্পর্কের কাউকে। খুব সাহসী হলে সে হয়ত ঐ ছেলেকে বলবে তার বাবাকে প্রস্তাব নিয়ে শেলির পালক অভিভাবকের কাছে যেতে। এটাই হচ্ছে কাজটা সফল করার সন্মানজনক পথ।

যখন উভয় অভিভাবক মিলে একটি সিদ্ধান্তে আসবেন তখন ছেলেকে বাড়ীতে ডাকা হবে শেলির সাথে কথা বলার জন্য। শেলির পালক অভিভাবক তাকে জানাবে যে তারা ছেলেটির ব্যাপারে যথেষ্ট খোঁজ খবর নিয়েছেন এবং সে সচ্চরিত্রের ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে।

অবশ্য ছেলে পক্ষকেও মেয়েটির ব্যাপারে আস্থা অর্জন করতে হবে। ভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিয়ে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সেটা হোক হিন্দু-মুসলমান, হিন্দু-খৃস্টান অথবা খৃস্টান-মুসলমান। যদি কোন মেয়ে তার ধর্মের বাইরের কাউকে বিয়ে করে তাহলে তাকে পরিবার থেকে পুরোপুরি আলাদা করে দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে তারা ছেলেটির বাড়ীতে থাকতে পারে। মেয়েটি মাঝে মাঝে তার চার্চ বা ধর্মীয় গ্রুপের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।

সাধারণত মেয়েপক্ষ বিয়ের অনুষ্ঠানের যাবতীয় খরচ বহন করে। যদি ছেলে পক্ষ অনেক ধনী হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে চাইলে তারাও আয়োজন করতে পারে। যেহেতু শেলির পালক অভিভাবক তার সমস্ত দায়দায়িত্ব নিয়েছে তাই বিয়ের যাবতীয় খরচ তারাই বহন করবেন। পরিবারের অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত হবে যে বিয়ের আয়োজন কতটা ঘটা করে হবে। যদি মেয়ে তেমন যোগ্য না হয় তাহলে ছেলেপক্ষ অনেক সময় প্রচুর জিনিসপত্র দাবী করে। শহরে অনেক সময় উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাবার খরচও দাবী করা হয়। একটি প্রচলিত কথা আছে, যদি কারো মেয়ে সুশ্রী না হয় তাহলে মেয়ের বিয়ে দিতে হলে তাকে অনেক টাকা খরচ করতে হবে।

শেলি জানে তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার পালক অভিভাবকের মর্জির উপর। যদি তার ব্যবহার এবং কাজকর্ম ঠিক থাকে তাহলে সে এই পরিবারের সাথে তার বিয়ের আগ পর্যন্ত থাকতে পারবে। যদিও কেউ আশা করেনা বড়লোক ছেলে বিয়ে করার ব্যাপারে – তবে একজন যোগ্য পাত্র সবাই খোঁজ করে। হতে পারে সে কৃষক বা কৃষকের সন্তান। এই অবস্থার একটি ছেলে তার স্ত্রীর ভরন-পোষণ করতে পারে এবং সে তাকে তার বাবার বাড়ী নিয়ে আসে। অনেক তরুণ কৃষিকাজ করতে হতাশা বোধ করে। তারা স্বপ্ন দেখে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় গিয়ে চাকরী করবে। যদিও সেখানে গিয়েও অফিসের ছোট পদে থাকায় কাজের ভিড়ে অনেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে যায়। তারা সরকারের তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির পদে কাজ করে। এবং হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে টিকে থাকে। শহরে সব কিছুর দাম অনেক বেশি থাকায় তারা অতিরিক্ত কিছু অর্থ আয়ের চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গরিবী হালেই জীবন পার করে দেয়।

অন্যদিকে একজন কৃষকের সন্তান নিজের ভিটায় থাকতে পারে এবং সার্বক্ষণিক স্ত্রীকে পাশে পায়। সে একটি পরিবারের ভরণপোষণ করার সামর্থ্য রাখে। তাই কৃষক ছেলেই পাত্র হিসেবে শেলির বেশি পছন্দ। সৌভাগ্যক্রমে শেলির পালক পিতা-মাতার ভাষ্যে সে যথেষ্ট সুন্দরী একটা মেয়ে।

বিয়ের পর শেলির জীবন এখনকার মতো এত কঠিন হবেনা। সে সত্যিকার অর্থেই নিজেকে একজন ভবিষ্যৎ স্ত্রী এবং মা হিসেবে প্রস্তুত করছে। ছেলেদের সাথে একসাথে না খাবার রেওয়াজ সে রপ্ত করেছে। তবে এখন যেহেতু তার বিয়ের বয়স কাছাকাছি এসে গেছে তাই সে তার পালক মায়ের সাথে খায়।

শেলি তার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক আশাবাদী। কারণ এই দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটা এতিমের কোন পারিবারিক বন্ধন না থাকায় ভবিষ্যৎ বলতে তেমন কিছুই থাকেনা।


শামসুল হক
এগারো বছর
নৌকার মাঝি

শেখ মুজিবের দল আওয়ামীলীগ যখন দলের জন্য এমন একটা প্রতীক খুঁজছিলো যা দেখলেই জনগণের দল হিসেবে মনে হবে; তখন তারা বেছে নিলো ‘নৌকা’। হাতে চালানো নৌকা বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল সমতল এবং জলবেষ্টিত হওয়ায় নৌকাতেই সবাই যাতায়াত করে। এই অঞ্চলে বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টি হয়। বিশেষ করে জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে নৌকাই হয়ে ওঠে একমাত্র পরিবহন মাধ্যম।

১১ বছরের শামসুল হকের জন্য এই নৌকাই হলো বেঁচে থাকার সহজ অবলম্বন। সে কাঠের নৌকার প্রতীকের ব্যাপারে কিছু জানেনা। তার দিন চলে গতানুগতিকভাবে। সাভারে তার বাড়ীর পাশের নদীতে সারাদিন যাত্রী পারাপার করেই প্রতিটা দিন শেষ হয়।

শামসুল তার বাবা নালু ব্যাপারীর সাথে নৌকায় কাজ করে। তার বাবা চল্লিশ বছর ধরে নৌকা চালান। তিনি যে নৌকা ব্যবহার করেন সেটা তার নিজের। এটি কিনতে তার ৪৫০ টাকা (৬০ ডলার) বিনিয়োগ করতে হয়েছিলো। বিনিয়োগ অনেক হলেও নৌকাটা ভালো কাঠ দিয়ে বানানো নয়। সে এবং শামসুল সব সময় এটার তদারকি করে। একটা ভালো নৌকা প্রায় তিরিশ বছর চালানো যায়। কিন্তু এর যে দাম সেটা তাদের পক্ষে যোগাড় করা সম্ভব না। তাই তারা এই নৌকাটাই কিনেছে। কিন্তু দুই বছরের মাথায়ই এটায় ফুটো সৃষ্টি হয়েছে এবং অনেক পানি ঢুকে পড়ে। যখন এত পানি ঢুকবে যে সেঁচে শেষ করা যায়না তখন তারা এটাকে ভেঙ্গে ফেলবে এবং সেই কাঠ রান্নার লাকড়ি হিসেবে কাজে লাগাবে। তখন শামসুলের বাবা আরেকটি নতুন নৌকা কিনবে। প্রতি পাঁচ বছর পরপর তাদের এই কাজ করতে হয়।

শামসুল আহুইলা গ্রামে থাকে। তাদের ঘর পাকা; উপরে টিনের ছাদ। পরিবারের ৬ ভাই এবং ২ বোনের মধ্যে শুধুমাত্র এক ভাই আর বিবাহিত এক বোন এখানে থাকে। ছোট্ট ঘরে তিনটা কক্ষ আছে। একটা রান্নাঘর আছে। ১০০ গজ দুরে একটা টয়লেট আছে। খাবার পানির জন্য প্রায় আধা মাইল দুরে হেঁটে গিয়ে একটা কুয়া থেকে পানি আনতে হয়। কাপড় ধোয়া এবং গোসলের জন্য বাড়ীর পাশের একটি পুকুর ব্যবহার করে।

শামসুলের দিন শুরু হয় সকাল ৭ টার সময়। সে তখন ঘুম থেকে ওঠে এবং নাস্তা করে। সকালে মুড়ি (এক ধরনের পপকর্ণ), অথবা চিটা, অথবা রুটির সাথে গুড় – এগুলোর যেকোন একটা দিয়ে খাওয়া শেষ করে।

“যদিও আমার প্রধান কাজ নৌকা চালানো কিন্তু আমাকে গরুগুলোর দেখাশোনাও করতে হয়। আমি দিনে ১ ঘণ্টা এর পেছনে ব্যয় করি। প্রায় ১০ টার দিকে আমি বাবার সাথে ফেরি ঘাটে যাই। এবং আমাদের নৌকা চালানো শুরু করি।”

বেশিরভাগ সময় শামসুল যাত্রীদের পারাপার করে। প্রতিবার সে চার আনা (এক টাকার চার ভাগের এক ভাগ, প্রায় পাঁচ সেন্ট) ভাড়া নেয়। প্রতিদিন তার প্রায় পঁচিশ টাকা আয় হয়। গভীর রাত পর্যন্ত সে কাজ করে। রবিবার প্রায় চল্লিশ টাকা আয় করে।

‘মাঝে মাঝে আমি আর বাবা যাত্রীদের একদম ঢাকা পর্যন্ত নিয়ে যাই। এটা আমাদের জন্য অনেক লম্বা যাত্রা। সাভার থেকে ঢাকা যেতে আমাদের প্রায় পুরো একটা দিন লাগে।’

এধরনের ক্ষেত্রে তারা পঞ্চাশ টাকা ভাড়া নেয়। তারা নৌকায় একসাথে প্রায় তিরিশ জন যাত্রী নিতে পারে। কিন্তু যদি কোন মালামাল থাকে সেক্ষেত্রে লোকসংখ্যা কম নেয়া হয়। সকালে রওনা দিলে সন্ধ্যার দিকে ঢাকা পৌঁছায়। লম্বা বইঠা দিয়ে নৌকা চালানো হয়। বইঠার শেষ প্রান্ত নৌকার নিচ পর্যন্ত থাকে। তখন মাঝি উপরের প্রান্ত ধরে ধাক্কা দেয়। একই সময়ে সে এর নিচের অংশটিকে উপরের দিকে ওঠায়। (লেখক এই নৌকা চালানোর কাজটিকে বর্ননা করার চেষ্টা করেছেন যা ক্রমাগত বইঠা এবং পানির সাথে হয়। এটা দেখতে খুব সাধারণ মনে হলেও, কাজটা করা খুব কঠিন।)

“ঢাকা পৌঁছানোর পর সকাল হওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করি। রাতটা আমরা নৌকায় কাটাই। ঢাকা থেকে সাভারের যাত্রী আমরা তেমন পাইনা। যদিও মাঝে মাঝে আমরা নৌকাভর্তি মালামাল নেয়ার সুযোগ পাই।”

ঢাকা পর্যন্ত মোট পথ ১৫ মাইল। শামসুল যদি শুধু সাভারেই নৌকা পারাপার করতে থাকে তবুও তাকে একই পরিমাণ পথ পাড়ি দিতে হয়। ঢাকা থেকে ফেরার পথে তারা বাতাসের সুবিধা নিয়ে পাল তুলে আসে। এতে তাদের বাড়ী আসার গতি একটু বাড়ে। পরিশ্রমও কম হয়।

ঢাকা পর্যন্ত খুব বেশি যাওয়া হয়না। এধরনের যাত্রা হয়ত কয়েক মাসে একবার হয়। এবং এধরনের যাত্রায় শামসুল একা থাকেনা। কারণ নৌকা যখন বড় বড় নদী অতিক্রম করে তখন নৌকা নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব কষ্টকর হয়ে যায়।

“নিয়মিতভাবে ছোট নদীতেই নৌকা চালাই। আর এসব যায়গায় আমি একাই চালাই। মানুষ যখন তাদের গ্রামে বা বাজারে যেতে চায় তখন স্রোত খুব বেশি না হলে তিন চার মাইল পর্যন্ত আমি একাই চালাই। আর যদি নদীতে অনেক স্রোত থাকে তাহলে আমি আধা মাইলও চালাতে পারিনা। তখন আমাকে বাবার সাহায্য নিতেই হয়।’

প্রতিদিন শামসুল দুপুর ১ টা বা ২ টা পর্যন্ত নৌকা চালায়। তারপর দুপুরে খাওয়ার জন্য বিরতি দেয়। সে ডাল আর মাছের তরকারি দিয়ে ভাত খেতে বাড়ী আসে। সাথে অনেক সময় ভর্তা থাকে। এটি (ভর্তা) আলু সিদ্ধ দিয়ে করা হয়। সাথে মরিচ, পিঁয়াজ, তেল আর লবণ দিয়ে মাখানো হয়। এগুলো ভাতের সাথে মেখে এক সাথে খায়। খাওয়া শেষে সামসুল আবার নৌকা চালাতে ফিরে আসে। এভাবে রোজ রাত ৯ টা পর্যন্ত সে নৌকা চালায়। মাঝে মাঝে রাত ১০টা/ ১১টাও বেজে যায়। সারাদিন কাজ শেষে সে রাতের খাবার খেতে বাড়ী আসে। ভাতের সাথে তরকারি আর ডাল থাকে।

তিন বছর ধরে শামসুল নৌকায় যাত্রী আনা-নেওয়ার কাজ করছে। সে কোনোদিন স্কুলে যায়নি। যদিও তার বেশিরভাগ বন্ধুরা স্কুলে যায়। শামসুলের পরিবারের কেউ কোনোদিন স্কুলে যায়নি। সবাই নিরক্ষর। তবে স্কুলে যাবার কোন ইচ্ছা তার নেই। সে অনেকটা হাকলবেরি ফিনের মতো। তার ইচ্ছা স্বাধীন মতো নৌকায় ঘুরে বেড়ানো। একদম মুক্ত মনে।

‘আমার ইচ্ছা বাবার মতো একটা নৌকার মালিক হব। এবং আমার একদিন এমন একটা নৌকা থাকবে। আমি মনে করি আমার বয়স যখন ২৫ বছর হবে তখন আমার শক্তি আরও বেশি থাকবে। এবং তখন আমি আরও বড় নদীতে; এমনকি ঝড়ের রাতে নৌকা চালাতে সক্ষম হব। সেই শক্তি এবং সাহস ২৫ বছর বয়সে আমার হবে বলে আমি মনে করি।’

এখন শামসুল নৌকা চালানোর জন্য তার বাবার থেকে কোন বেতন বা ভাতা পায়না। যতোদিন না সে নিজের নৌকা কিনবে তার আগ পর্যন্ত এভাবেই চলবে। কিন্তু সে জানে যে যখন নৌকা কেনার সময় আসবে তখন তার বাবা তাকে নৌকা কিনে দেবার টাকা দেবে। প্রথম নৌকা কেনার পরে সে আরও কাজ করবে এবং টাকা জমাবে। তারপর দ্বিতীয় একটা নৌকা কিনবে। তখন সে সেটা কাউকে ভাড়া দেবে এবং তারপর আরও একটা নৌকা কিনবে। এভাবে চলতে থাকবে। এটা তার মাস্টার প্ল্যান। যদিও শামসুল ঢাকা শহর দেখেছে কিন্তু শহরের জীবন তার ভালো লাগেনা। “যখন আমি আব্বার সাথে ঢাকায় রাত পার করি তখন আমার শুধু বাড়ীর কথা মনে হয়। বন্ধুদের কথা মনে হয়। নৌকা চালানোর কথা মনে হয়।” শামসুল একজন সত্যিকারের গ্রামের ছেলে যে তার নিজের মাটিতে থাকতে আনন্দ পায়। বর্ষার তিন মাসে শামসুল এবং তার বাবা সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করে। বর্ষা শেষ হলে নদীগুলো আগের অবস্থায় ফিরে আসে। তখন অবস্থা এমন হয় যে অগভীর পানিতে নৌকা চালানো যায়না। সেই মাসগুলোতে শামসুল গরুটার দেখাশোনা বেশি করে, জমি চাষ করে এবং ঘরের অন্যান্য ছোট-খাট কাজ করে।

ডিসেম্বর মাসে তারা তাদের তিন বিঘা জমিতে ইরি ধান বোনে। বছরের অন্য সময়ে তারা সবজি চাষ করে অথবা তেলের জন্য সরিষার চাষ করে। শামসুল যদিও মাঠে কাজ করে কিন্তু তার ১৫ বছর বয়সী ছোট ভাই মূলত সেখানে কাজ করে। সে-ই পরিবারের মূল কৃষক। কে কী কাজ করবে সেটা তাদের বাবা ঠিক করে দিয়েছে। এতে শামসুল খুশী। কারণ তার নৌকা চালাতে ভালো লাগে।

শামসুলের ভাই তাদের তিনটি গরুরও দেখাশোনা করে। গরু থেকে যে দুধ পাওয়া যায় তা তারা বাজারে বিক্রি করে। এতে দিনে চার থেকে ৫ টাকা আয় হয়। অর্থাৎ এই পরিবারে জমি এবং নদী উভয় পথেই আয় হয়। তারা নিজেদের কিছু খাবার নিজেরা চাষ করে এবং প্রয়োজনীয় দুধের ব্যবস্থাও হয়ে যায়। এভাবে তুলনামূলকভাবে স্বনির্ভর একটি পরিবার হিসেবে তারা টিকে আছে।

শামসুল ২৫ বছর বয়সে নিজে একটি নৌকার মালিক হতে চায়। কিন্তু এর আগে ২২ বা ২৩ বছর বয়সে তার বিয়ে করার ইচ্ছা আছে। তার ভবিষ্যৎ স্ত্রীর ভরণ-পোষণ নিয়ে তার কোন চিন্তা নেই। কারণ সে আশা করে তাকে সে বাবার বাড়ীতে রাখতে পারবে যৌথ পরিবারের মতো। শামসুল নিজে আলাদা কোন ঘর বানাতে চায়না।

‘আমি বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে করতে চাই। আমি নিশ্চিত আমার জন্য তারা যে মেয়ে ঠিক করে দেবেন আমি তার সাথেই সুখী হব।’

যুদ্ধের সময় শামসুলের বাড়ী যুদ্ধকৌশলের দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ন অবস্থানে ছিলো। নদী হচ্ছে এদেশের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম। এবং শামসুলের বাড়ীর চারপাশের এলাকা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে পরিপূর্ণ ছিলো। যুদ্ধের সময় শামসুল তার গ্রামে অনেক হত্যাযজ্ঞ দেখেছে। ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। যদিও তার পরিবারের কেউ আক্রান্ত হয়নি। তারা তাদের গ্রাম থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করেছে যাতে পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি না হতে হয়। শেষ দুই সপ্তাহে ভারত যখন যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলো তখন তাদের গ্রামের পাশে ভারতীয় সেনারা বোমা ফেলেছিলো। ভারতের সেনারা নির্দিস্ট কিছু এলাকা থেকে পাকিস্তানি সেনাদেরকে উচ্ছেদ করতে চাচ্ছিলো। যে ফেরিঘাটে শামসুল তার নৌকা রাখে সেটা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো।

শামসুল বলে, ‘আমি বাঙালীর মুক্তির জন্য প্রার্থনা করতাম। আমি স্বাধীনতার জন্য প্রার্থনা করতাম। আমি খুব খুশী হয়েছিলাম যখন ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে আমাদের গ্রামে বাংলাদেশের নতুন পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিলো।’

ঘরে তার জিনিসপত্র তেমন নাই। যেহেতু সে বই পড়েনা তার কোন বই নেই। তার যা আছে তা হলো দুটি লুঙ্গি, এক জোড়া পায়জামা, দুটি জামা এবং হাডুডু খেলার (একটি গ্রাম্য খেলা) জন্য একটি সোয়েটার। হাডুডু একটা শারীরিক কসরতের খেলা, যেখানে টেনিস কোর্টের মতো একটি কোর্ট থাকে। দুই দলের প্রতি দলের সদস্য সংখ্যা থাকে ছয় জন। তারা কোর্টের মাঝামাঝি একটি দাগ পার হতে চেষ্টা করে। বাচ্চারাও এটাই খেলে। এখানে কোন ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন বা হকি খেলা নেই। হাডুডু এমন একটা খেলা যেখানে শুধু শরীর ছাড়া আর কোন খেলার উপকরণের প্রয়োজন নেই। যখন শামসুলের নৌকা চালানো বা ক্ষেতে কোন কাজ থাকেনা তখন সে তার বন্ধুদের সাথে এই খেলা খেলে।

এইভাবে শামসুল প্রতিদিনের কাজ করে সামনের বছরগুলো পার করার ইচ্ছা রাখে। সে আশা করে তার বিয়ে পারিবারিকভাবে হবে এবং ভবিষ্যতে তার নিজের নৌকার সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে।

শুধু একটি বিষয় খেয়াল করা হয়নি। শামসুলের বাবার বয়স এখন ৬০ বছর। শামসুলের পরিকল্পনা অনুযায়ী যখন তার বিয়ের বয়স হবে এবং নৌকার মালিক হবে; তখন তারা বাবার বয়স হবে ৭০। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এত কম যে এধরনের পরিকল্পনা কতটা বাস্তবসম্মত তা সন্দেহের বিষয়। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে,শামসুল, এগারো বছর বয়সী এক আশাবাদী বালক। সে তার নৌকা টেনে চলে এবং আশায় আশায় দিনের পর দিন পার করতে থাকে।

পুনশ্চ

১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারিতে, ঢাকার পতন ও পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পনের দু’বছরের একটু বেশি সময় পর পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দেয়। প্রথামাফিক বাংলাদেশ ও সাথে সাথে প্রাক্তন শত্রু কে স্বীকৃতি দেয়। এভাবেই এসব রাজনৈতিক চালের মাধ্যমেই উপমহাদেশের দেশগুলো নিজেদের মধ্যে ভ্রমণ, যোগাযোগ ও কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের দিকে প্রথম পদক্ষেপ নেয়।

স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনের কাজ ধীরে ধীরে আগাতে শুরু করে। যুদ্ধের সময় সামান্য যা কিছু ছিলো তার সব কিছুই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। এর পরপরই বাংলাদেশ ধারাবাহিক মূল্যস্ফীতির শিকার হয়। সৃষ্টি হয় খাদ্য সংকট। প্রায় ২০ শতাংশ শিক্ষার হার এবং বিশ্বের প্রায় সর্বনিম্ন মাথা পিছু আয়ের দেশ হিসেবে দারিদ্র্য আর ক্ষুধার সাথে লড়াই করার মতো কোন অস্ত্রই তাদের হাতে ছিলো না।

যদিও, প্রথম ৫ বছরের পরিকল্পনায় এই সমস্যাগুলো বাস্তবিকভাবে চিহ্নিত করা হয় এবং একটি অর্জনক্ষম সুনির্দিস্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য পুনর্গঠন প্রোগ্রাম হাতে নেয়া হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে সিনথেটিক ফাইবারের স্বল্পতার কারণে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য পাটের দাম বৃদ্ধি পায়। যদি বাংলাদেশ যুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ের মতো পাট উৎপাদন করতে পারে তাহলে উপার্জনের গুরুত্বপূর্ণ একটি পথ তৈরি হবে।

প্রায় ১ কোটি শরণার্থী যারা যুদ্ধের সময় ভারতে চলে গিয়েছিলো তারা সবাই ফিরে এসেছে এবং ভারতে অবস্থিত নব্বই হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীও পাকিস্তানে ফিরে গেছে। অসংখ্য বিহারীদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর আয়োজনও সম্পন্ন হয়েছে।

একটি শিশুর ভবিষ্যতের জন্য মূল উপাদান হলো শিক্ষা। যখন সরকারের দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হবে তখন অনেক বেশি পরিমাণে শিশু শিক্ষাগ্রহণ করতে পারবে এবং তাদের পূর্বপুরুষের চাইতে আরও বেশি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পাবে। তাদের আশা আছে – তাদের স্বপ্ন আছে।

মোমিন উল্লাহ নিজের একটি রিকশার স্বপ্ন দেখে, শামসুল হক স্বপ্ন দেখে অনেকগুলো নৌকার মালিক হবার। শাহিদা বেগমের স্বপ্ন নির্ভর করছে তার ভাইয়ের মেকানিক হিসেবে সফল হওয়া বা না হওয়ার উপর। এপ্রিল ১৯৭৪ সালে যেসকল বিহারীর আত্মীয়পরিজন পাকিস্তানে আছে তাদেরকে সেখানে নিয়ে যাবার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকার সম্মত হয়। অতএব, সারোয়ার আলী – যার চাচা পশ্চিম পাকিস্তানে আছে – সেই সূত্রে হয়ত সপরিবারে সে তার স্বপ্নের কাছে পৌঁছে যেতে পারবে।

এই শিশুরা বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্ম। দেশের প্রতিশ্রুতি। দেশের উজ্জ্বলতম আশা।

—————————–
জেসন লর। আমেরিকান সাংবাদিক। যুদ্ধকালীন সময়ে দেশে রয়ে যাওয়া শিশু-কিশোরদের অনুভূতি কেমন ছিলো? কেমন বাংলাদেশ দেখেছিলো তারা? তাদের পরিবারের গল্পটা কেমন ছিলো? স্বাধীনতার ঠিক পরের সময়ের অভিজ্ঞতাই বা কেমন? কী তাদের জীবন ভাবনা? এসবের সূক্ষ্ণ বর্ণনার সচিত্র বিবরণ দিয়েছেন জেসন।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অসামান্য দলিল এই বই। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে সেই সময়কার সাংবাদিকদের নিজেদের লেখা বইয়ের সংখ্যা সীমিত। তেমনই একটি দুষ্প্রাপ্য বই এটি।