You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.19 | জয় বাংলা ১৯ মে ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা + Unicode - সংগ্রামের নোটবুক

জয় বাংলা ১৯ মে ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা

মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

জয় বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র
মুজিবনগরঃ ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যাঃ বুধবার, ৪ঠা জৈষ্ঠ্য, ১৩৭৮, ১৯শে মে ১৯৭১
আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট
রাওয়ালপিন্ডি -ইসলামাবাদসহ পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্র এই মর্মে এক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে ইচ্ছুক। তবে দুটিমাত্র শর্তে। তা হলো সামরিক সরকারের হাত থেকে ক্ষমতা নেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সকলকে তারই দেয়া একটি অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র মেনে নিতে হবে। তারপর জাতীয় পরিষদ যে শাসনতন্ত্র রচনার করবে তাও হুবহু অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্রের অনুরূপ হতে হবে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানী পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের উপর আদৌ গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে পারছিনা। পশ্চিম পাকিস্তানিরা ইয়াহিয়া বা অন্য কারো দেয়া শাসনতন্ত্র গ্রহণ করবে কি করবে না, তা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। তারা যদি রোজ কেয়ামত পর্যন্ত সামরিক আইনে শাসিত হতে চায় তাহলেও আমাদের বলার কিছুই নেই। কেননা ওটা তাদের ঘরোয়া ব্যাপার। তারা একটা আলাদা রাষ্ট্র।
আমাদের বিশ্বাস, সামরিক সরকারের ইঙ্গিতে পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলো আলোচ্য সংবাদটি গুরুত্বসহকারে বাজারে ছেড়েছে। কেননা, পাকিস্তানের সংবাদপত্র সমূহের উপর সামরিক আইনের যে ক্ষুব্ধ হয়ে আছে তার প্রেক্ষিতে কোন সংবাদপত্রের পক্ষেই সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ ধরনের কিছু প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কার ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে যে উলটাপালটা সংবাদ ছাপিয়ে পাকিস্তানের জঙ্গি শাসকদের ক্ষেপিয়ে তুলবে?
বিশ্বের ইতিহাসে যখন কোন বিদেশি শক্তি অস্ত্রের জোরে পরের দেশ দখল করেছে তখনই তারা চেষ্টা করেছে সে দেশে একটা শিখণ্ডী সরকার খাড়া করার। ইয়াহিয়া ভুট্টো টিক্কা খান ও আজ মহাজনী পন্থার আশ্রয় নিয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা, তাদের মনোবল নষ্ট করা, চূড়ান্ত বিজয় সম্পর্কে তাদের মনে সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করা। অতীতে কোনশক্তি সাময়িকভাবে সফল হলেও তাদের সফলতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি-ইয়াহিয়া ভুট্টো চক্রেরও হবেনা, হতে পারেনা। শোষক, নিপীড়ক, বর্বর এই পশ্চিম পাকিস্তানী চক্র হয়তো ভেবেছে যে আওয়ামী লীগকে অবৈধ ঘোষণা করে শিখন্ডীদের তারা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করাবে। তাই তারা আজ সওয়ার হয়েছে নুরুল আমিন, হামিদুল হক, সবুর খান, ফকা চৌধুরী, ফরিদ আহমদ, মাহমুদ আলী, সুলায়মান, খয়ের উদ্দিন প্রমুখ কুখ্যাত, গণধিকৃত, সুবিধাবাদী ও জনগণ বর্জিত লোকের ঘাড়ে। এদেরকে বাঙালিরা ডাস্টবিনের আবর্জনা ছাড়া আর কিছুই মনে করে না।
আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিতে চাই যে, ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা হস্তান্তর বা পাকিস্তানে শাসনতন্ত্র রচনার সাথে বাংলাদেশের মানুষের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা যখন ক্ষমতা চেয়েছিলাম তখন তা দেয়া হয়নি। তার বদলে আমরা পেয়েছি গুলি। এতে প্রাণ দিয়েছে আমাদের লাখ লাখ ভাই বোন, ইজ্জত হারিয়েছে আমাদের মা-বোনেরা, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়েছে লাখ লাখ পরিবার, গৃহহারা হয়েছে দেড় কোটির মত বাঙালি সন্তান। লাখো শহীদের লাশের তলায়, লাখো মায়ের অশ্রুর অতল তলে কবর হয়ে গেছে পাকিস্তানের। আমরা ঘোষণা করেছি স্বাধীনতা। আমাদের সন্তানরাও ধরেছে অস্ত্র, বহাচ্ছে খুনের বন্যা। আমরা লিপ্ত হয়েছি এক মরণপণ সংগ্রামে-হয় স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঁচবো না হয় মরবো। আজ আমাদের একটিমাত্র কথা -মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন’।
তাই আজও যারা ইয়াহিয়ার কাছ থেকে ক্ষমতার উচিষ্ট গ্রহণের জন্য ঢাকা -পিন্ডি ছুটাছুটি করছে, এক পা কবরে রেখে আরেক পানি ও সংহতির নামে বিবৃতি দানের জন্য রেডিও পাকিস্তানে দৌড়াচ্ছে তাদেরকে আমরা হুঁশিয়ার করে দিতে চাই -বাঙালির স্বার্থ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার দিন আর নেই। ১৭ জন সৈন্য নিয়ে বাংলাদেশ দখলের দিন ফুরিয়ে গেছে। এক মীরজাফরকে হাত করে পলাশীর যুদ্ধ জয় করার দিন অতীত হয়ে গেছে। শত মীরজাফরকে বসিয়েও বাংলাদেশকে আর পদানত রাখা যাবে না।
বাঙালি আজ জেগেছে। শেখ মুজিবের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছে। পশ্চিমা বর্বর শহীদের রক্তের প্রতি ফোটায় জন্ম নিয়েছে হাজার হাজার মুজিব। প্রয়োজনবোধে তারাই দেবে জাতিকে নেতৃত্ব। মীরজাফর বিশ্বাসঘাতকতার বাংলার ব্যাপারে নাক গলানোর প্রয়োজন বা অধিকার নেই। বাঙালি জাতি নিজেকে মুক্ত করবেই করবে। টিক্কা খান তিরিশ লাখ কেন তিনশত লাখ বাঙালি সন্তানকে হত্যা করেও শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না।একটি বাঙালি তরুণ বেঁচে থাকা পর্যন্ত ও সে অস্ত্র চালিয়ে দেবে বিদেশি হানাদারদের বিরুদ্ধে। কেননা, বাঙালি আজ বেঁচে মরতে চায় না, সে মরে বাঁচতে চায়।
নুরুল আমিন, হামিদুল হক প্রমুখরা অতীতে বাংলাদেশ ও বাঙালির অনেক সর্বনাশ করেছে। আর সেই সুযোগ তাদেরকে দেয়া হবে না। নুরুল আমিন মাতৃভাষায় কথা বলার দাবি করার অপরাধে আমাদের সন্তানদের গুলি করে মেরেছে। বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলার কোন অধিকার বাঙালি তাকে দেয়নি। গত ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত গণভোটের বাঙালি অধিকার দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার দলকে। “অতি বুদ্ধিমান” ও ধনকুবের হামিদুল হক চৌধুরীর পরামর্শেই যে পাফৌজ বর্বরের মতো ঢাকা সহ বাংলাদেশের সমস্ত বস্তি এলাকা ধ্বংস করে দিয়েছে তা আমাদের জানা হয়ে গেছে। অতীতেও বহুবার হামিদুল হক বাংলার স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছে। ফরিদ আহমদ, মোহাম্মদ আলী ও সোলায়মানের মতো সামাজিককীটগুলো তো দালালের দালাল তস্য দালাল। উপসংহারে আমরা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই যে, পাকিস্তান মরে গেছে। সেজন্য আমরা দায়ী নই- দায়ী ইয়াহিয়া ভুট্টো চক্র। তার কবর ও দিয়েছেন ইয়াহিয়া খান যথারীতি সামরিক কায়দায়। কবর থেকে লাশ তুলে আহাজারি করাতে কারো কোনো লাভ হবে না। যারা বাঙালি হয়েও এ লাশ নাড়াচাড়ার চেষ্টা করবে তাদেরকে আমরা জাতিদ্রোহী বলেই গণ্য করব। সাথে সাথে জাতিদ্রোহীতার একমাত্র শাস্তি যে মৃত্যুদন্ড তাও আমরা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেবো।
লাখো শহীদের লাশের তলায় পাকিস্তানকে কবর দিয়েছে কে -আমরা না তোমরা?
পাকিস্তানের সামরিক জঙ্গী চক্রের নায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার জন্য আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে দায়ী করে যে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন তার প্রতিবাদে স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বিশ্ববাসীর অবগতির জন্য পূর্বাপর সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করে যে বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে জনাব তাজ উদ্দিন আহমেদ বলেনঃ
” বাংলাদেশে আজ যুদ্ধে লিপ্ত। পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ। এটা আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সংগ্রাম, আমাদের বাঁচা-মরার সংগ্রাম, এছাড়া আমাদের আর কোন গতান্তর ছিলনা।
বাংলাদেশ আজ যে ব্যাপক গণহত্যা চলছে পাকিস্তান সরকার তার সত্যতা গোপন ও বিকৃত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ কি কারণে আজ পার্লামেন্টারি রাজনীতির বদলে নিজেদের আশা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ধরতে বাধ্য হয়েছে তা বিশ্ববাসীর গোচরীভূত করা দরকার।
পাকিস্তানের সংহতি রক্ষায় সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে আওয়ামী লীগ ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করে। এর লক্ষ্য ছিল এক পাকিস্তানের আওতায় স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশ ছয় দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়ে আওয়ামী লীগ ৩১৩ সদস্যবিশিষ্ট পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসন দখল করে আওয়ামী লীগের বিজয় এত বিরাট ছিল যে বাংলাদেশে প্রদত্ত ভোটের মোট ভোটারের শতকরা ৮০ টি লাভ করে। এ বিচার ফলে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
নির্বাচনোত্তর সময়ে মানুষের মনে জেগে ওঠে বিরাট আশা-ভরসা, কেননা পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের ইতিহাসে আর কোন জাতি কোনদিন কোন দলকে এমন বিরাট ভাবে বিজয়ী করেনি। পাকিস্তানের উভয় অংশের মানুষের মনে বিশ্বাস এ বিশ্বাসের জন্ম নেয় যে অবশেষে ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্য একটি স্থায়ী শাসনতন্ত্র রচনা হতে চলেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু ও পাঞ্জাবে পাকিস্তান পিপলস পার্টি একক বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে কিন্তু নির্বাচনী অভিযানে ছয় দফাকে কোন সময় ইস্যুও করেনি। সুতরাং নির্বাচনোত্তরকালে ছয় দফার বিরোধিতা করার দায়িত্ব তাদের ছিল না। বেলুচিস্তানে জাতীয় আওয়ামী পার্টির ছয় দফার পূর্ণ সমর্থক ছিল। সীমান্ত প্রদেশের ন্যাপ প্রাদেশিক পরিষদে প্রাধান্য লাভ করে এবং তারাও সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ছিলেন। মোটকথা নির্বাচনে প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলির ভরাডুবির প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপামর দেশবাসীর আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল।
আশা করে গিয়েছিল যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান এর প্রস্তুতি লগ্নের রাজনৈতিক অঙ্গনে দেশের প্রধান প্রধান দলগুলোর মধ্যে আলোচনা ও বৈঠক শুরু হবে। পরিষদে যাবার পূর্বে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নের নীতি ব্যাখ্যা এবং অন্যদের বিকল্প প্রস্তাব আলোচনায় আওয়ামী লীগ কোন সময় বিমুখ ছিল না। তবে একটি নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করতো যে গোপন আলোচনার পরিবর্তে জাতীয় পরিষদে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নাদি আলোচিত ও চূড়ান্ত হওয়া উচিত। এই উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ তাড়াতাড়ি জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আহ্বান এর জন্য চাপ দিতে থাকে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে এই আশায় আশান্বিত হয়ে আওয়ামী লীগ দিবারাত্রি কাজ করে চলে ও ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রের একটি খসড়া প্রণয়নের প্রয়াস পায়। এবং অনুরূপ শাসনতন্ত্র রচনার ও তার বাস্তবায়নের জন্য সকল দিক থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয় জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে জেনারেল ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের মধ্যে। এই আলোচনায় জেনারেল ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগের ছয় দফার তাৎপর্য জানতে চান। আশা করা গিয়েছিল জেনারেল ইয়াহিয়া শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে তার নিজস্ব ধ্যান ধারণা ব্যক্ত করবেন। কিন্তু তিনি তা না করে এ ধারণাই ব্যক্ত করেন যে ছয় দফায় তেমন আপত্তির কিছুই নেই তবে তিনি এ ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টির সঙ্গে একটি বোঝাপড়ার উপর জোর দেন।
পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা ২৭শে জানুয়ারি থেকে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির মধ্যে। এই আলোচনার সময় জনাব ভুট্টো তার দলবল নিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হন।
ইয়াহিয়া খানের মতো জনাব ভুট্টো ও শাসনতন্ত্রের প্রকৃতি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন প্রস্তাব নিয়ে আসেনি। তিনি ও তাঁর উপদেষ্টারা প্রধানত ছয় দফা তাৎপর্য নিয়ে আলোচনাতেই আগ্রহী ছিলেন। প্রতিটি ব্যাপারে তাদের সাড়া নেতিবাচক হওয়ায় এবং শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে তাদের কোনো নির্দিষ্ট বক্তব্য না থাকায় আলোচনা বেশি গভীরে যেতে পারেনি। তাহলে হয়তো দুটি প্রধান দলের মধ্যে মতপার্থক্য দূর করা যেত। এটা স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল যে শাসনতন্ত্রের প্রশ্নের কোনো সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল না যেখান থেকে আলোচনা শুরু করা যেতে পারে।
পিপলস পার্টির নেতারা যখন ঢাকা ত্যাগ করেন, তখন তারা আভাস ইঙ্গিতেও কথা বলেননি যে আওয়ামী লীগের সাথে তাদের আলোচনায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বরং তারা এই কথা জানিয়েছিলেন যে আলোচনার সকল দ্বার উন্মুক্ত রয়েছে, এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সাথে আলোচনার পর তারা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় দফা আলাপ-আলোচনায় আওয়ামী লীগের সাথে মিলিত হবেন; অথবা তারা জাতীয় পরিষদে যোগ দেবেন এবং পরিষদের বিভিন্ন কমিটিতে বসে আলোচনার মাধ্যমে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে চূড়ান্ত ফয়সালা করবেন।
এমতাবস্থায় পরবর্তী পর্যায়ে জনাব ভুট্টোর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বয়কটের সিদ্ধান্ত সবাইকে বিস্মিত ও হতবাক করে। তার এই সিদ্ধান্ত এজন্য সবাইকে আরো বেশি বিস্মিত করে যে শেখ মুজিবের দাবি মোতাবেক ১৫ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান না করে (চলবে)
ইয়াহিয়া ভুট্টো চক্রের গোমর ফাঁক!
যা আশঙ্কা করে গিয়েছিল তাই ঘটতে শুরু করেছে। তবে এত তাড়াতাড়ি ঘটবে তা আমরা ভাবতে পারিনি। পশ্চিম পাকিস্তানের গণজীবনের ওপর পড়তে শুরু করেছে ইয়াহিয়া ভুট্টো টিক্কা খানের অঘোষিত যুদ্ধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া। শিল্পপতিদের কল কারখানার গুদামে জমে উঠেছে বিপুল পরিমাণ পণ্য। তাদেরকে করতে হয়েছে উৎপাদন হ্রাস। শ্রমিকদের অসহ্য হয়ে উঠেছে বেকারত্বের জ্বালা। অন্যদিকে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে শাঁ শাঁ করে। এসবের একমাত্র কারণ যুদ্ধের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানী পণ্যের একমাত্র বাজার -বাংলাদেশ আজ হাতছাড়া। পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতি পুঁজিপতি ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের বাপ-দাদার খাসতালুক -বাংলাদেশের বাজারে তাদের মাল আজ চলছে না।
অন্যদিকে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বন্ধক রেখে বিদেশ থেকে পাকিস্তান সরকার দুই হাতে যে সাহায্য, ঋণ, মঞ্জুরী, পশ্চিম পাকিস্তানকে শস্য-শ্যামলা করে তুলেছিলেন আর সেখানে গড়ে তুলেছিলেন শত শত কলকারখানা, সে ঋণ ও সাহায্যের কিস্তি পরিশোধ করা আজ আর সম্ভব হচ্ছে না। বাংলার পাট বিদেশে রপ্তানী করতে না পারলে কোনদিন পাকিস্তান সরকার তা পরিশোধ করতে পারবেও না। এদিকে বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যার জন্য ইয়াহিয়া সরকারের ব্যয় হচ্ছে দৈনিক এক থেকে দেড় কোটি টাকা। কিন্তু তাও পাবে কোথায়? বাংলাদেশ থেকে আজ তো আর আয় নেই।
তাই ইয়াহিয়ার পত্র নিয়ে চরম বাঙালি বিদ্বেষী কুখ্যাত এম, এম আহম্মদ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দুয়ারে দুয়ারে ধরনা দিচ্ছেন আর্থিক ও সামরিক সাহায্যের আশায়। কিন্তু যে সরকার পুরাতন ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে অক্ষম বিদেশী রাষ্ট্র কোন আশায়ও ভরসায় তাকে নতুন করে ঋণ ও সাহায্য দিবে? এম এম আহমদ সাহেব পাকিস্তানের মুদ্রার মান অর্ধেক হ্রাস করার পর্যন্ত প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও “ভবি ভুলিল” না।
এদিকে বাংলার মানুষের গলা কাটতে গিয়ে আজ ইয়াহিয়া ভুট্টো টিক্কার নিজেদের গলাকাটা পড়ার উপক্রম হয়েছে। পাকিস্তানের স্বার্থের বদলে শুধুমাত্র নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ বজায় রাখার জন্য ইয়াহিয়া ভুট্টো টিক্কা খান চক্র পাকিস্তানকে বর্তমান বিপর্যয়ে নিক্ষেপ করছে প্রমূখ চক্র ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের অপরাপর রাজনীতিক ও ছাত্র সমাজের কাছে ধরা পড়ে গেছে। তাই মিয়া মোমতাজ দৌলতনা স্পষ্টভাবে ফাঁস করে দিয়েছেন জঙ্গী চক্রের সমস্ত গোমর। তিনি বলেছেন দুই পরিষদ গঠন তথা পাকিস্তানকে বিভক্ত করার প্রস্তাব শেখ মুজিব দেন নাই। এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান নিজে ভুট্টোর মনোরঞ্জনের জন্য। তিনি জানিয়েছেন যে ঢাকায় তার ও মুফতি মাহমুদ এর সাথে বৈঠকে ও ইয়াহিয়া খান নিজ মুখে এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সুতরাং তাঁর মতে পাকিস্তানকে বিভক্ত করার জন্য যদি কেউ দায়ী থাকে হয়ে থাকেন তবে তারা হচ্ছেন ইয়াহিয়া ভুট্টো চক্র, শেখ মুজিব নন। সারা পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ছাত্র শ্রমিকদের অনুরোধ প্রবনতার প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যেই থর থর করে কেঁপে উঠেছে ইয়াহিয়ার গদি। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে -এর শেষ কোথায়? তারা জানতে চেয়েছে পাকিস্তানের অপঘাত মৃত্যুর কি আদৌ প্রয়োজন ছিল। তাই ইয়াহিয়া সরকারকে রাজনীতিক ও সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ এবং ক্রমবর্ধমান শ্রমিক অসন্তোষ স্তব্ধ করার জন্য জারি করতে হয়েছে সামরিক আইনের নয়া বিধি।
এককালীন ব্রিটিশ ত্রাস মরহুম ইপীর-ফকিরের ভাগিনা পাঞ্জাবি চক্রান্ত ও শোষণের যাতাকল থেকে ৩০ লাখ পশতু ভাষী পাঠানের মুক্তির জন্য ডুরান্ড লাইন বরাবর অঞ্চলে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি একখানা ঘোষণাপত্র প্রচার করেছেন এবং তার একটা কপি আমাদের হস্তগত হয়েছে। উক্ত ঘোষণাপত্রে ইপীর-ফকিরের ভাগিনা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন যে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মতো সীমান্তের পাঠানরাও পাঞ্জাবি চক্র দ্বারা শোষিত হতে চান না। তিনি বাঙ্গালীদের বর্তমান মরণপণ সংগ্রামে তার ৩০ লাখ অনুগামীরা সর্বাত্মক সাহায্য ও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন এবং তাদের নিজস্ব মুক্তিসংগ্রামে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দলের সাহায্য কামনা করেছেন। এদিকে লন্ডন থেকে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ সাম্প্রতিক তথায় বসবাসকারী পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্র শ্রমিক ও বুদ্ধিজীবীদের এক সভায় পাকিস্তানের বর্তমান দুর্গতির জন্য সামরিক চক্রকে দায়ী করা হয়। সভায় উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং এই মর্মে পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে জনমত গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাদের মতে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া গতন্তর ছিল না।
মুক্তিফৌজ এর ডাক
বাংলাদেশের মানুষের কাছে মুক্তিফৌজের ডাকঃ
(১) দেশের প্রতিটি অঞ্চলে সংঘটিত হন। মুক্তিসেনায় যোগ দিন। এই যুদ্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করুন। তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করুন, মনোবল অক্ষুন্ন রাখুন। আমাদের এই লড়াইয়ে জনসাধারণেই শক্তির মূল উৎস।
(২) শত্রুর দুর্বল স্থান গুলো খুজে বের করুন। মুক্তিযোদ্ধাদের সে বিষয়ে অবহিত করুন। শত্রুর গতিবিধি সম্বন্ধে সংবাদ সংগ্রহ করে পৌঁছে দিন মুক্তি সেনার কাছে। শত্রুকে ঘায়েল করবার জন্য সঠিক সংবাদ একান্তভাবে দরকার। আপনার দেয়া একটি সংবাদ উৎখাত করতে সাহায্য করতে পারে একটা গোটা সেনাদলকে।
(৩) শত্রুকে ভুল করতে প্ররোচিত করুন। তাকে মিথ্যা ভুল খবর পরিবেশন করুন। শত্রুর অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচার করুন। সর্বত্র জনসাধারণকে সক্রিয় করে তুলুন।
(৪) শত্রুর সঙ্গে যেসব মীরজাফরের দল সহায়তা করছে সুযোগ পেলেই তাদের শায়েস্তা করুন। তাদের তালিকা ও বিবরণ প্রস্তুত করে গণবাহিনী ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের জানান।
(৫) আপনার অঞ্চলে যদি মুক্তিফৌজ না থাকে তবে মুক্তিফৌজ গড়ে তুলবার কাজে সাহায্য করুন। নিজেরা যোগদিন; চারিদিকে মুক্তিফৌজ বা গণবাহিনীর গোপন ঘাঁটি গড়ে তুলতে সাহায্য করুন।
(৬) আপনার প্রতিবেশীর কষ্ট মোচনে সহযোগিতা করুন। দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তি বজায় রাখুন। যারা লুটপাট করছে, অসামরিক ক্রিয়াকর্মে উস্কানি দিচ্ছে তাদের বাধা দিন, নির্মূল করুন, যাতে সাধারণভাবে দেশবাসীর মনে স্বস্তি জাগে। জেগে ওঠে নির্ভয় ভাব।
(৭) ভুলবেন না, এদেশ আপনার, আমার সকলের। এ যুদ্ধ আমাদের সকলের। স্বাধীন বাংলাদেশ ও বাঙালির জাতির অস্তিত্ব নির্ভর করছে আমাদের সকলের সক্রিয়তার উপর।
ভবিষ্যৎ আমাদেরঃ কেবল অস্ত্রের দ্বারা যুদ্ধে জয় লাভ করা যায় না। আলজিরিয়াতে পরাজিত হয়েছে ফরাসিরা। ভিয়েতনামে পরাজয়ের পথে প্রবল পরাক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। রাজনৈতিক চেতনা সম্পন্ন একটি সুসংগঠিত জাতির কাছে কোন শক্তি দাঁড়াতে পারে না।
বিশ্ব জনমত আজ আমাদের পক্ষে। আমরা আজ একা নই। সমস্ত বিশ্বের শুভেচ্ছাকে সাথে নিয়ে আমরা জয়ী হবো আমাদের সংগ্রামে। – জয় বাংলা।
কিন্তু কুম্ভকর্ণদের ঘুম ভাঙবে কবে?
থোক থোক রক্তের উপর প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এই শিশু ও নবগঠিত রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য নির্মূল করার জন্য নরঘাতক জঙ্গী ইয়াহিয়া লেলিয়ে দিয়েছে তারা হায়নাদের সবুজ বাংলার শ্যামল প্রান্তর। চলছে নির্বিচারে গণহত্যা শিশু, নারী, বৃদ্ধ, যুবক, যুবতী কোন ভেদাভেদ নেই। অবলীলায় ধ্বংস করছে সভ্যতার পিঠস্থান শিক্ষাঙ্গনকে মারিয়ে গুরিয়ে দিচ্ছে মসজিদ মন্দির; জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ, শিল্প-কারখানা, বিপণিকেন্দ্রে আর এই বর্বর হামলার ঘটনাকে চাপা দেওয়ার জন্য বুদ্ধিজীবী এবং সাংবাদিকদের করছে নিধন; ভাষ্য করে দিয়েছে স্বাধীন সংবাদপত্র অফিস গুলো।
সারা বাংলাদেশ আজ রণক্ষেত্র। বাংলার মাঠে জ্বলছে আগুন, বাতাসে তার রূঢ়তা, আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। আর চারিদিকে ভীত-বিহবল আতঙ্কগ্রস্থ অসহায় মানুষের চিৎকারে বাংলাদেশ হয়ে পড়েছে প্রেতপুরী। মানবতার এহেন অবমাননা আল্লাহর আরশ হয়তো থর করে কাঁপছে কিন্তু বিশ্বমানবতার এবং শান্তির সোল এজেন্ট জাতিসংঘের বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গের ঘুম ভাঙছে না, বিবেক দংশিত হচ্ছে না।
উ-থান্ট সাহেব কি জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদের কথা ভুলে গিয়েছেন? না শুধু বৃহৎ শক্তিবর্গের স্বার্থ জড়িত না থাকলে তার কণ্ঠে শান্তির ললিত বাণী বেরোতে বাঁধে? শুধু বিনয়ের উ-থান্ট সাহেব কে জানাতে চাই বাংলাদেশে যে মানব নিধনযজ্ঞ চলছে তা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়। এ যুদ্ধে একটি স্বাধীন জাতির সার্বভৌমত্ব রক্ষার যুদ্ধ-তাই সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করুন সিদ্ধান্ত নিন। যাতে জাতিসংঘের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে না ফেলে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তি আমেরিকা আজ নীরব। নীরব নিক্সনের কণ্ঠ। কিন্তু কেন? তিনিও কি ভাবেন এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়, তাই নাক গলানোর প্রয়োজন নেই? কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় নাক গলাতে তো তারা কোন পাত্রাপাত্র, স্থান-কাল বিচার করে না, তবে এখানে কেন এত চিন্তা- এত ভাবনা? ফুলব্রাইট এবং এডওয়ার্ড কেনেডি মতো প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ যখন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের দাবি জানিয়েছেন, তখনো নিক্সন কেন কোনো ব্যবস্থা করছেন না! আমেরিকার পত্র-পত্রিকা ও মানবতার এই ক্রন্দনে বেদনা ভারাক্রান্ত বিহ্বল।
কিন্তু নিক্সন সাহেবকে বাংলাদেশের সংঘটিত গণহত্যার ব্যাপারে নিজের এবং তার সরকারের দায়িত্ব এড়াতে পারেন? তার জানা উচিত বাংলাদেশে আজ যা ঘটছে তাতে তিনি মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারেন না। নিক্সন সরকারের পক্ষ থেকে হয়তো বলা যেতে পারে যে, ইয়াহিয়া জঙ্গি চক্র কমিউনিষ্ট চীনের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য প্রদত্ত মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র তাদের অনুমতি ব্যতিরেকে বাংলাদেশ নরমেধ যজ্ঞে ব্যবহার করছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও কি তাদের কিছু করনীয় ছিল না বা নেই? তারা কি চুক্তি ভঙ্গের অজুহাতে পাকিস্তানে জঙ্গিশাহীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতেন না? আসল কথা হলো ক্ষমতাসীন মার্কিন সরকারের গণতন্ত্র ফাঁকি। দেশে দেশে একনায়কত্ববাদীদের ফাঁকি। দেশে দেশে একনায়কত্ব বাদীদের পোষণের যে নীতি মার্কিন সরকার অনুসরণ করে আসছে পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কেননা মার্কিন সরকারের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য না পেলে পাকিস্তানের সামরিক চক্র বাংলাদেশ একদিনে যুদ্ধ চালাতে পারেনা আমাদের বিশ্বাস হয়না। মার্কিন সরকারের জেনে রাখা উচিত, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে আজ মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এ যুদ্ধে জয়লাভ করতে হবে। জয় তাদের অবশ্যম্ভাবী। মাঝখানে মার্কিন সরকার বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষ অবলম্বন না করে চিরকালের জন্য তাদের বন্ধুত্ব হারালেন -এই আমাদের দুঃখ।
ব্রিটেন ও একই পথের পথিক। ব্রিটেনের বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দিল মানবিক মূল্যের কথা। পাকিস্তান আজও কমনওয়েলথ এর অন্যতম সদস্য। বৃটেনের কাছ থেকে সে পাচ্ছে নানা রকম সাহায্য ও সহযোগিতা। সুতরাং ব্রিটেন সরকার ইচ্ছে করলে এই গণহত্যার বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারতো, কিন্তু তারা তা করেনি। কারণ পাকিস্তানের জঙ্গির শাসকচক্রের সাথে রক্ষণশীল ব্রিটিশ সরকারের বাণিজ্যিক ও অন্যবিধ সম্পর্ক জড়িত। ব্রিটিশ শ্রমিকদলের পীড়াপীড়ি সত্বেও প্রধানমন্ত্রী হিথ পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং ঘোষণা করেছেন যে পাকিস্তানে বৃটিশ সাহায্য অব্যাহত থাকবে।
পশ্চিমা শক্তি বর্গ ভাবছেন এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং বাংলাদেশ বিচ্ছিন্নতাবাদী। ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও টিক্কা চক্রের বক্তব্য ও এই। ভাবখানা এই- বায়াফ্রা নাগা ও মিজোদের মতো বাংলাদেশও একই পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু যুক্তির ধোপে তা কি টিকে? একটু আলোচনা করে দেখা যাক -বায়াফ্রা নাইজেরিয়ার একটি ক্ষুদ্র অংশ- সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক বন্ধনের দিক থেকে নাইজেরিয়ার অন্য এলাকার সাথে কোন পার্থক্য নেই। নাগা ও মিজোল্যান্ড ভারতের বিরাট অংশের দুটি ক্ষুদ্র এলাকা। তাদের দাবির সঙ্গে বাংলাদেশের বক্তব্যকে এক করে দেখার অর্থ জেগে ঘুমানোর মত। কারণ পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ জনের বাস বাংলাদেশে। ভৌগলিক দিক থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের দূরত্ব বার শত মাইল। মধ্যবর্তী স্থানে ভারত অবস্থিত। ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি ও সামাজিক বন্ধন এবং আচার অনুষ্ঠান সম্পূর্ন বিপরীতমুখী। এবং তথাকথিত পাকিস্তান সংহতির নামে বিগত তেইশ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলাদেশকে শোষণ করেছে, গণতন্ত্রের গলা টিপে হত্যা করে রাজনৈতিক অধিকার টুকুও ছিনিয়ে নিয়েছে। ৫৪ হাজার বর্গমাইল ভূমিকে তারা তাদের বাজারে পরিণত করে। অতএব অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও মানবিক মূল্যায়নের এই সংগ্রামকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে অভিহিত করা যায় না। চালিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা কে জাগ্রত বিশ্বের মানবদরদীদের কাছে ষড়যন্ত্র বৈ আর কিছুই নয়। সর্বোপরি একটি দেশের জনসংখ্যার সংখ্যাগুরু অংশ যদি পৃথক হয়ে যেতে চায় তাহলে তাদের কে একত্রে বাস করতে বাধ্য করার আইনগত নৈতিক বা অন্য কোনো অধিকার সংখ্যালঘুদের কি আছে?
বাংলাদেশ যখন ইয়াহিয়ার হায়নাদের ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত তখন রেড ক্রস এগিয়ে এসেছিল আর্তের সেবায় কিন্তু সামরিকজান্তা যেহেতু বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেননি সেহেতু তারা মানবতার সেবা করতে নিরস্ত্র রয়েছেন। তা নিরস্ত্র রয়েছেন বলে জঙ্গি চক্রের মানব নিধন যজ্ঞ বন্ধ হয়নি, বন্ধ হয়নি মানবতার ক্রন্দন। প্রশ্ন রয়ে যায় রেডক্রসের দায়িত্ব কি শেষ হয়ে গিয়েছে? বিশ্ব জনমত এর কাছে তারা এই নগ্নতার বর্বরতার বীভৎস করুণ চিত্র তুলে ধরে বৃহৎ শক্তিবর্গের ওপর আশু চাপ সৃষ্টির দাবি করতে পারেন না? আমরা আশা করব, তারা আর মুখ ফিরিয়ে থাকবেন না। আমরা এতদিন শুনে এসেছি চীন এশিয়ার গৌরব, নির্যাতিত-নিপীড়িত সংগ্রামী জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। বিশ্ববাসী জানতো বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ জানত বিশ্বের যেখানেই শোষণ, বঞ্চনা আর অত্যাচার সেখানেই আছে মহাচীনের শীতল স্পর্শ। সেখানেই মহাচীন নিপীড়িত মানুষের দুঃখ মোচনের চেষ্টায় সচেষ্ট। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার দখলদার বাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জীবন যখন আজ বিপন্ন, অর্থনৈতিক জীবন যখন বিপর্যস্ত, তখন চীন আক্রমনকারী হানাদারের পক্ষ অবলম্বন করছে এটা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়।
বলা যেতে পারে যে চীনের রাষ্ট্রনায়ক বাংলাদেশের গণমানুষের সত্যিকারের পরিচয় না জেনে জঙ্গী শাসকদের সমর্থন যোগাচ্ছেন। কিন্তু তাও বা আমরা কিভাবে বিশ্বাস করব? কারণ চীন বিশ্বের নারী নক্ষত্রের খবর রাখে, তারা সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের প্রকৃতি ও পরিচয় জানবেন না তা কোনভাবেই বিশ্বাস করা যায় না।
অবাক বিস্ময় তাকাতে হয় আরব জাহানের দিকে। ইসলামের শিক্ষা যেখানে অন্যায়, সেখানে জালিমের জুলুম তাকে প্রতিহত করতে হবে যে কোনো মূল্যে বিনিময় মজলুমকে দিতে হবে ছায়া কিন্তু তার তো কোনো নমুনা বিশ্ববাসী দেখছেন না। আরব জাহানের মানবতা ও বিবেক জাগ্রত হোক ইসলামের মূল মন্ত্র সাম্য স্বাধীনতা সৌভ্রাতৃত্বের স্নাত হোক বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ এ কথাই বিশ্ববাসীর চোখেমুখে বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
আরব জাহানের নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে জানা উচিত যে, কেবলমাত্র ধর্মীয় বন্ধনের জোড়ে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী এক রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারে না। যদি তাই হতো তাহলে একই ভাষা, একই ভূগোল, একই ধর্ম ও সংস্কৃতির অধিবাসী হয়ে আরব জনগণ আজ এতগুলো রাষ্ট্রে বিভক্ত কেন?
মানবতার এই অবমাননা ও বৃহৎ শক্তিবর্গের এই ন্যাক্কারজনক পলায়নী মনোভাবের মধ্যেও সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র নিরীহ মানুষের যন্ত্রণা চিৎকারে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে যারা নজির স্থাপন করেছেন তারা হলেন বুদ্ধ, গান্ধী, নেহেরু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মানব প্রেমিকতার আশীষে পুষ্ট মহামানবের মিলনক্ষেত্র ভারতবর্ষ আর মহামতি লেনিনের আদর্শে পরিচালিত সোভিয়েত রাশিয়া। বিশ্ব মানব প্রেমিকরা এ দুটি রাষ্ট্রকে জানাচ্ছে প্রীতিসিক্ত সালাম।
ধর্মের দোহাই দিয়েও ভারতীয় জুজুর ভয় দেখিয়ে আর কাজ হবে না –
৪৮ ঘন্টার মধ্যেই মুক্তিকামী বাঙালির প্রতিরোধ শক্তি ভেঙে দেওয়ার আকাশকুসুম চিন্তায় বিভোর হয়ে কুচক্রী পাক জঙ্গিশাহী চোরের মতো রাতের অন্ধকারে রক্তের হোলিখেলায় পৈশাচিক কাণ্ডে লিপ্ত হয়েছিল তা আজ তাদেরকেই অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরেছে। একদিকে বাঙালির প্রতিরোধ শক্তি ও ঘৃণা হ্রাসের বদলে বেড়ে গেছে শতগুণ। আত্মসমর্পণের বদলে বাঙালি এগিয়ে এসেছে শত্রুর উপর চরম আঘাত হানতে, বাংলাদেশের পবিত্র ভূমি থেকে প্রতিটি শত্রুসৈন্য কে নির্মূল করতে। অন্যদিকে বিশ্বজনমতের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গিশাহী আজ গণহত্যার অপরাধে অপরাধী। বিশ্ব জনমতের আদালতে আজ সে আসামীর কাঠগড়ায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ দূত পাঠিয়েও ইয়াহিয়া এর কোন কিনারা করতে পারেনি। কোন দেশেই তাদের বক্তব্য মেনে নিতে রাজি হয়নি। ওদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের ঘরের অবস্থাও ভালো নয়। সেখানে প্রতিটি চিন্তাশীল মানুষের কাছে আজ ধরা পড়ে গেছে ইয়াহিয়া ভুট্টো চক্রের আসল চক্রান্ত।
ঘরে বাইরে জঙ্গিশাহীর যখন এই করুন অবস্থা তখন তারা সেই সনাতনী পন্থায় -যত দোষ নন্দ ঘোষ অর্থাৎ বাংলাদেশে যা হচ্ছে তার সবকিছুরই জন্য ভারতের উপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের অপকর্ম ঢাকার এক ব্যর্থ প্রয়াসে লিপ্ত হয়েছে।
পাকিস্তানে জঙ্গি চক্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত বেতার এবং অন্যান্য প্রচার মাধ্যম থেকে প্রচারণার জন্য প্রবাহিত হচ্ছে তার নির্গলিতার্থ হচ্ছে, বাংলাদেশে যা ঘটেছে, যা ঘটছে তার সবকিছুর জন্য ভারত দায়ী। ভাবখানা যেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীই ইয়াহিয়া খানকে দিয়ে বাংলাদেশের জনমতের রায় বানচাল করে দিয়েছেন এবং ভারতীয় সৈন্য পাঠিয়ে নির্বিচারে লাখো লাখো বাঙালিকে হত্যা করেছেন।
পাকিস্তানে জঙ্গি চক্রের প্রচারণার আরেকটি ধারা হচ্ছে এই যে, পাকিস্তান বিশ্ব মুসলিমের সর্বাধিক শক্তিশালী ঘাঁটি। “মুসলিম বিদ্বেষী” ভারত এ ঘাঁটির অস্তিত্ব সহ্য করতে পারেনা। তাই তারা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়েও সৈন্য পাঠিয়ে ” ইসলামের শক্তিশালী দুর্গ কে” দুর্বল করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের এতে কোনো অবদান নেই। বলাবাহুল্য জঙ্গিশাহীর অনুরূপ প্রচারণার লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্বের মুসলমান রাষ্ট্রগুলোকে ধর্মের নামে ধোকা দেওয়া এবং বিভ্রান্ত করা।
কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষমতালিপ্সু কুচক্রী জঙ্গিসহ যদি মনে করে থাকে যে এসব মিথ্যাচার বেসাতি দিয়ে আসল ব্যাপার ধামা চাপা দেওয়া যাবে অথবা বিশ্বের মুসলমান ও বাংলাদেশের আপামর মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে তাহলে বুঝতে হবে তারা নির্বোধের স্বর্গে বাস করছে। ভারত বিদ্বেষই যে পিন্ডীর পাকিস্তান সরকারের আভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতির একমাত্র ভিত্তি তা আজ বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। কেননা, বিশ্ববাসী অতীতে বহুবার দেখেছে যে, পিঞ্জির একনায়কত্ব বাদী শাসকরা যখন এই অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র ব্যাপারে বেকায়দায় পড়েছে তখনই তারা সবকিছুর জন্য ভারতের উপর দোষ চাপিয়েছে।
অন্তত বাংলাদেশের মানুষকে তো এসব বস্তাপঁচা পুরনো মাল দিয়ে মুহুর্তের জন্যও বিভ্রান্ত করা যাবে না। কেননা, ইসলামের নামে, সংহতির নামে সর্বোপরি ভারত বিদ্বেষের নামে পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদী সরকারগুলো পাকিস্তানের জন্মাবধি যে খেলা খেলে আসছে তা দেখতে দেখতে বাংলাদেশের লোক অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারা ভারতীয় জুজুর ভয় অনেক দেখেছে। তারা এ খেলা দেখেছে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময়। বাঙালির মায়ের ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ঢাকার রাজপথ যখন ছাত্র তরুণ, নারী-পুরুষের পদভারে প্রকম্পিত, তখনো এই কুচক্রীরা তাদের আবিষ্কার করেছিল হিন্দুদের হাত, ভারতের হাত। সেদিন নুরুল আমিন সরকারের প্রেসনোটেই বলা হয়েছিল যে, ভাষা আন্দোলনে বাঙ্গালীদের কোন অবদান নেই সবই করছে ভারত থেকে পায়জামা পড়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী হিন্দু তরুণরা। তারপর তারা এ খেলা দেখেছে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময়ে। সে সময় মুসলিম লীগ ও তার দালাল মুখপাত্র গুলো সমস্বরে চিৎকার করে বাংলার ভোটারদের একথাই বোঝাতে চেয়েছিল যে, যুক্তফ্রন্টের লোকেরা সবাই ভারতের দালাল। ভারতের টাকাতেই চলছে তাদের নির্বাচনী অভিযান আর যারা যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছে তাদের বেশিরভাগই ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী।
আবার যখন মাত্র ১৪ দিন ক্ষমতাসীন থাকার পর ৯২(ক) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করা হয় তখন ভারতের দালালীরই অভিযোগ আনা হয়েছিল যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ,কে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে। বলাবাহুল্য, যে লোকটি পাকিস্তান বেতারের মাধ্যমে শেরে বাংলাকে ভারতের দালাল’ বলে ঘোষণা করেছিল সেই বগুড়ার মোহাম্মদ আলীই আবার নিজেদের কায়েমী স্বার্থে শেরে বাংলাকে “প্রিন্স অফ দি প্যাট্রিয়টস্” বলে অভিহিত করতে দ্বিধা করেননি।
অনুরূপ ভাবে ১৯৫৯ সালের সামরিক আইন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের দেশব্যাপী গণ অভ্যুত্থান প্রতিটি স্তরেই পশ্চিমা কায়েমি স্বার্থবাদীরা বাঙালিদের দেখিয়েছে ভারতীয় জুজুর ভয়, বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে ইসলাম ও ভারতীয় হস্তক্ষেপের নামে।
মোটকথা, পিন্ডি – ইসলামাবাদের গণধিকৃত শাসকগোষ্ঠীর সিংহাসন যখন টলটলায়মান হয়ে উঠেছে তখন তাদের মুখে আমরা শুনেছি ভারতীয় জুজুর ভয়, ভারতীয় হস্তক্ষেপের কথা, সীমান্তে ভারতীয় সৈন্য সমাবেশের আজগুবি খবর অথবা ইসলাম বিপন্ন হওয়ার ধূয়া।
হ্যাঁ, বর্তমান পর্যায়ে ভারত একটা অন্যায় করেছে-শুধু অন্যায় নয়, মহা অন্যায়! সেটা কি? ভারত সরকার, ভারতীয় পার্লামেন্ট, ভারতের সংবাদপত্র ও বেতার বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ইয়াহিয়া ভুট্টো চক্রের সংঘটিত গণহত্যা ও ধ্বংসলীলার কথা। তারা এটা না করলে হয়তো পাকিস্তানের জঙ্গি চক্র সাড়ে সাত কোটি মানুষকে সবার অলক্ষ্যে মেরে ফেলতে পারতো, সারা বাংলাদেশকে বোমা দিয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে পারত। এটা যদি ভারতের অন্যায় হয়ে থাকে, হস্তক্ষেপ হয়ে থাকে তবে বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষই এই অন্যায়কে সমর্থন করবো। এমনকি এটা যদি মহাপাপ ও হয়ে থাকে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ তার ভাগই হতে রাজি।
বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে ও মানবতার স্বার্থে ভারত-বাংলাদেশের জীবন মরনের কোন প্রশ্নেই নির্লিপ্ত থাকতে পারেনা, চোখ-কান বুজে থাকতে পারে না। শুধু নিকটতম প্রতিবেশী নয় ভারতীয় জাতির সাথে বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে একটা আত্মিক সম্পর্ক-নাড়ির সম্পর্ক। একের বিপদে অপরকে এগিয়ে আসতেই হবে। পাকিস্তান তথা পশ্চিম পাকিস্তানের যে কায়েমি স্বার্থ চক্র একটা মানবিক ব্যাপারে সাড়া দেয়ার দায়ে বিশ্বের দরবারে ভারতকে হেয় প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা করছে, তাদের দেশ ও যদি কোনদিন বহিঃশত্রুর দ্বারা অনুরূপভাবে আক্রান্ত হয়, আমাদের বিশ্বাস ভারত সে দিনও একই রকমের সাড়া দিতে পিছপা হবে না। ১৯৫০-এর দশকের শেষদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর যখন কোন অদৃশ্য উত্তরে’র শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল তখন কি পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমি স্বার্থ চক্রের তৎকালীন নায়ক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান সেই শত্রুর মোকাবিলার জন্য ভারতের সাথে জয়েন্ট ডিফেন্স-এর প্রস্তাব দেননি?
তাছাড়া বাংলাদেশের ব্যাপারে অন্য কারণেও ভারত উটপাখি নীতি অনুসরণ করতে পারে না। কেননা, বাংলাদেশের সমস্যার জের ভারতকেও টানতে হয় পিন্ডির জঙ্গিরা যেটাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যাবলে চালাতে চাচ্ছে সেটা ভারতের জন্য এক অভ্যন্তরীণ সমস্যার সৃষ্টি করেছে। জঙ্গী চক্রের সৃষ্ট বিভীষিকা থেকে যে ২৬ লাখ লোক ইতিমধ্যেই সীমান্ত পেরিয়ে ওপার গিয়েছে, তাদের আশ্রয়, ভরণপোষণ বাবদ ভারত সরকারকে ব্যয় করতে হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। জঙ্গী চক্রের সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ সমস্যা ভারতের বিশেষ করে সীমান্তবর্তী রাজ্য গুলোর উপর সৃষ্টি করেছে বিরাট চাপ।
সুতরাং পশ্চিমা জঙ্গী চক্রকে আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই যে ভারত যা করেছে তার জন্য বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। বরং মানবতার স্বার্থে’ ভারত যদি আরো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করত, বিদেশি হায়নাদের বাংলাদেশ থেকে নির্মূল করার জন্য অধিকতর সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করত প্রতিটি বাঙালি তাকে খোশ আমাদেরই জানতো।

রণাঙ্গনেঃ এক সপ্তাহের লড়াইয়ে আরো সহস্রাধিক শত্রুসৈন্য নিহত
দেড় মাস আগে ইয়াহিয়া টিক্কার জল্লাদ বাহিনীর পরিকল্পিত উপায়ে বাংলাদেশের উপর যে ব্যাপক গণহত্যা শুরু করেছিল আজ তা এমন এক পর্যায়ে এসেছে যেখানে তারা প্রত্যহ বাংলা মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড চাপের ফলে ভীতসন্ত্রস্ত ও নাজেহাল হয়ে পড়ছে। প্রতিদিন তরুণ মুক্তিবাহিনীর হাতে পাক ফৌজকে দিতে হয়েছে প্রাণ, দিতে হচ্ছে আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারুদ। দৃঢ় মনোবল সম্পন্ন, অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত, মৃত্যুঞ্জয়ী, আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা সিলেট- কুমিল্লা, চট্টগ্রাম-নোয়াখালী, ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল, দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তরবঙ্গ সেক্টর এর বিভিন্ন রাজ্যের উপর অতর্কিত হামলা অব্যাহত ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এতে গত এক সপ্তাহ অন্ততঃ আরো এক সহস্ত্র পাকসেনা নিহত হয়েছে।
গত ৯ই মে মুক্তিবাহিনী আখাউড়া সাব সেক্টর এবং বিবির বাজার এলাকায় পাক ফৌজে উপর অতর্কিত হামলা চালায়। মুক্তি বাহিনীর আক্রমণের ফলে পাক-হানাদার বাহিনীর তিনশত সৈন্যকে প্রাণ হারাতে হয়েছে।
হানাদার বাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্য বিবির বাজার থেকে সোনামুড়া সীমান্তের দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করলে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের সাথে তাদের অগ্রাভিযান প্রতিহত করে দেয়। পাক ফৌজের এসব সৈন্য ছদ্মবেশের আশ্রয় নেয়। তারা বোখরা পরে মেয়েদের ছদ্দবেশ ধরে অন্যেরা শার্ট ও পাঞ্জাবি পরে বাঙালি সাজে। কিন্তু এদের ছলচাতুরি গ্রামবাসীদের সজাগ দৃষ্টির সামনে ধরা পড়ে যায়। গ্রামবাসীরা তাদের ছল বুঝতে পেরে মুক্তিফৌজকে দ্রুত খবর পৌঁছে দেয়। মুক্তিসেনারা তৎক্ষণাৎ প্রস্তুত হয়ে যায়। এরপর চলে গুলি বিনিময়। মুক্তিফৌজের তীব্র চাপ এর মুখে ছদ্মবেশী পাকসেনারা বহু হতাহত সঙ্গীকে ফেলে পিঠটান দেয়।
একই দিনে মুক্তি বাহিনি রংপুর জেলার দূর্গাপুর থানায় পাকফৌজের উপর আকস্মিক হামলা চালায়। গেরিলা কৌশলের আক্রমণে পাক ফৌজ দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং এলোপাথাড়ি গোলাগুলি ছুড়তে থাকে। কিন্তু তবুও মুক্তিবাহিনীর অবস্থান নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়। মুক্তি বাহিনীর নির্মম হামলায় পাক ফৌজ এর ছয়জন সৈন্য প্রাণ হারায়।
মুক্তিফৌজ মেহেরপুর উপকণ্ঠে ভৈরব নদীর পূর্ব তীরে পাকহানাদার ঘাটির উপরে শেল বর্ষণ করে। অন্যদিকে ভৈরব নদীর পশ্চিম তীরে মেহেরপুরের একটি গুপ্ত স্থান থেকে মুক্তি বাহিনি অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে একজন সুবেদার সহ বেশ কয়েকজন জল্লাদবাহিনীর সৈন্যকে হত্যা করে।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা দক্ষিণ পশ্চিম খন্ডে চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রায় সাত মাস দূরে জয়রামপুর এর কাছে একটি রেল সেতু উড়িয়ে দিয়েছে। ফলে দর্শনা ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে এবং পাকবাহিনীর রসদ সরবরাহের পথ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
গত ১০ই মে মুক্তিবাহিনীর আখাউড়া সেক্টরে পাক ফৌজের উপর আকস্মিক কিভাবে এক বিরাট হামলা চালায়। এই সেক্টরের প্রচন্ড লড়াইয়ে চারশত খানসেনা খতম হয়েছে। এছাড়া পাকফৌজদের কাছ থেকে মুক্তি বাহিনি একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার হস্তগত করেছে।
এদিকে সিলেট জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি তেলিয়াপাড়া এলাকায় প্রবল বৃষ্টিপাতের মধ্যে মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে পাক ফৌজ এর প্রচণ্ড লড়াই বাঁধে। তেলিয়াপাড়া চা বাগানটি পুনর্দখল করার জন্য পাক ফৌজ প্রচুর গোলাবারুদ নিয়ে মুক্তি বাহিনীর উপর আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী এর সমুচিত জবাব দেয়। এই সংঘর্ষে বারো জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয় যাদের মধ্যে দুজন অফিসার ও আছে।
ইয়াহিয়া টিক্কার জল্লাদ বাহিনী কুমিল্লা জেলার তিতাস গ্যাস প্লান্টটি ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ এর শিল্পকারখানাগুলো অচল হয়ে পড়েছে।
মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা চট্টগ্রাম সড়কের শুভপুর সেতুতে অবস্থিত হানাদার বাহিনীর উপর এক আকস্মিক হামলা চালিয়ে তাদেরকে দিশেহারা করে তোলে। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড চাপের মুখে হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। উত্তর-পশ্চিম সেক্টর মুক্তি বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে আরো ষাট জন নিহত হয়। এছাড়া পাক ফৌজের সাতটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং তিনটি বাঙ্কার ধ্বংস করে দেয়া হয়।
মুক্তিবাহিনী গত মঙ্গলবার রংপুর জেলার কোলাঘাট, মোগলহাট এবং ওমরখানায় পাক সেনা ঘাঁটি গুলোর উপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ আক্রমণের মোগলহাটের বহু পাকফৌজ হতাহত হয়।
দিনাজপুরে মুক্তিবাহিনী পার্বতীপুর – সান্তাহার রেল রুটে এবং পাঁচবিবি, জয়পুরহাট শহরে পাক ফৌজের ঘাঁটিগুলোর উপর আক্রমণ চালিয়ে সড়ক রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। জয়পুরহাটে সংঘর্ষে সাতজন পাকহানাদার খতম হয়েছে।
মুক্তিফৌজ কমান্ডোরা কুড়িগ্রামে পার্টির উপর আক্রমণ চালিয়ে পাক ফৌজের হাতে বন্দী বারো জন মুক্তি সেনাকে ছিনিয়ে আনে। এছাড়া ধরশা ও কুড়িগ্রাম এর মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু কমান্ডোরা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়।
গত ১২ই মে মুক্তিবাহিনী কসবা অঞ্চলে পাক ফৌজ এর উপর হামলা চালান। মুক্তিবাহিনী এখানে দুমুখি এমন আক্রমণ চালানো যে পাকফৌজ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও পাকফৌজের মধ্যে এই ভয়াবহ আক্রমণে ১২৭ জন নিহত হয়। এদের মধ্যে একজন মেজর ও ছিল।

অমানিশার অবসানে পূর্ব দিগন্তে ঊষার আলো দেখতে পাচ্ছি
জাতির উদ্দেশ্যে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের বেতার ভাষণ
মুক্তি সংগ্রামের অন্ধকার অধ্যায় কাটিয়ে আমরা সুপ্রভাত এর দিকে এগিয়ে চলেছি। ইতিমধ্যে আমি পূর্ব দিগন্তে ঊষার আলো দেখতে পাচ্ছি।
গত ১৮ই মে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরোক্ত ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন সেদিন বেশি দূরে নয় যখন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বহু বিদেশী রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করবে।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার ভাষণে মুক্তিফৌজের ভূমিকার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং বলেন মুক্তিফৌজের কঠোর প্রতিরোধ ও তীব্র পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তান বাহিনী হিমশিম খাচ্ছে এবং তাদের মনোবল একেবারে শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের সরাসরি মুক্তিপাগল মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন বাংলাদেশের মানুষ ইতিমধ্যে অভাবিতপূর্ব ত্যাগ স্বীকার করেছে।লক্ষ লক্ষ লোক ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর গুলিতে প্রাণ দিয়েছে, কোটি লোক গৃহহারা হয়ে পথের ভিখারী বনেছে। লাখো লাখো মাতা তাদের সন্তান হারিয়েছে, তাদের অশ্রুতে বাংলার আকাশ-বাতাস আজ সিক্ত। শহীদদের রক্তে বাংলাদেশের পথে প্রান্তর আজ নদী। তবু তারা আজও সংগ্রামী মনোবল হারাননি। আজ তাদের আত্মত্যাগের প্রতিদানে তিনিও শুধু অশ্রু দিতে পারেন।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি দৃঢ়তার সাথে বলেন যে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির বৃথা যেতে পারে না। এবং তা বৃথা যেতে দেওয়া হবে না। তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন যে বাঙালির অশ্রু একদিন তাদের মুখে হাসি ফোটাবে।
বাংলাদেশ কেন স্বাধীনতা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে তার কারণ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ইয়াহিয়া ও তার উপদেষ্টাদের সাথে আলাপ আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীরা ২৫শে মার্চ সামরিক আইন প্রত্যাহার করে গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছ থেকে একটা ঘটনা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু সে ঘোষণা কোন সময় আর আসলো না। কার বাদলে ইয়াহিয়ার বর্বর সেনাবাহিনীর ঝাঁপিয়ে পরলো নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের উপর।
তথাকথিত দুই শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের উপর দোষ চাপানোর প্রয়াস চলছে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ওটাকে একটা মিথ্যার বেসাতি বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ইয়াহিয়ার উপদেষ্টারা তাদের খসড়া প্রস্তাব করেছিলেন। তাতে স্পষ্ট ভাবে লেখা ছিল যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্য পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হয়ে দুটো শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবেন। তারপর যৌথ অধিবেশনে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হবে। ভুট্টোকে খুশি করার জন্য ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এব্যাপারে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর অপচেষ্টার তীব্র নিন্দা করেন।
সশস্ত্র আওয়ামী লীগ কর্মী এবং দুষ্কৃতিকারীদের উপরেই শুধু সামরিক বাহিনী আক্রমণ চালিয়েছে বলে সামরিক জান্তার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে তার জবাবে সৈয়দ নজরুল জিজ্ঞেস করেনঃ তাহলে ইপিআর ও পুলিশের সদর দপ্তর এর উপর আক্রমণ চালানো হলো কেন? তারাতো আওয়ামী লীগ কর্মী বা দুষ্কৃতিকারীর কোনটাই ছিলেন না।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বৃহত্তম গণহত্যার ঘটনা দেখেও বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রপতি আজ যে নীরবতা অবলম্বন করেছেন তার জন্য সৈয়দ নজরুল ইসলাম গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন। তাদের উদ্দেশ্যে তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ লাখো লাখো নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে বিনা কারণে হত্যা করা কি ইসলাম অনুমোদন করে? মসজিদ, মন্দির বা গির্জা ধ্বংস করার কি কোনো বিধান ইসলামে আছে?
বাংলাদেশের মানুষকে আশ্বাস দিয়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলেন, নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ জনগণকে যেসব ওয়াদা দিয়েছিল তার প্রতিটি তারা পালন করবে। তিনি জানান যে তার সরকার ভূমিহীনকে ভূমিদান, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, বড় বড় শিল্প জাতীয়করণ করে দেশকে সমাজতন্ত্রের পথে নিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
যে সমস্ত বিশ্বাসঘাতক পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর সাথে সহযোগিতা করছে, তাদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাদেরকে অবিলম্বে বাংলার স্বার্থবিরোধী ও মুক্তি সংগ্রাম বিরোধী ঘৃণ্য কাজ কারবার থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতেই তাদেরকে এসবের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। তখন তাদের প্রতি কোনরূপ কৃপা প্রদর্শন করা হবে না।
উপসংহারে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন যে নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে স্তব্ধ করা যাবে না। বাঙালিরা তাদের দেশকে শত্রুমুক্ত করবেই করবে।
তিনি বাংলাদেশের জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও মতাদর্শ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে আজ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লক্ষ্য অর্জনে- মুক্তি অর্জনে সহায়তা করার আবেদন জানান। কেননা, জয় আমাদের সুনিশ্চিত। কোনো শক্তিই তা ঠেকাতে পারবে না।
বিদেশি সাংবাদিকের জিজ্ঞাসা
পশ্চিম পাকিস্তানী জল্লাদ বাংলাদেশের কত লাখ লোক খুন করেছে?
গত ২৫শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র নাগরিকদের সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করার জন্য ইয়াহিয়া টিক্কা এবং তাদের বাহিনী যে ঘৃণ্য পথ গ্রহণ করে তার কুকীর্তি বিশ্ববাসীকে ঢাকা দেয়ার জন্য ঢাকায় অবস্থানরত ৩৫ জন বিদেশি সাংবাদিক কে ২৬ শে মার্চ জোর করে ধরে তাদের ফিল্ম ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে বিমানে করে পশ্চিম পাকিস্তানের ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকে সংবাদপত্র বেতার টেলিভিশন এর উপর কঠোর সামরিক সেন্সরশিপ আরোপ করে পাকহানাদার বাহিনী সারা বাংলাদেশে এক লোমহর্ষক গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণ অভিযান চালিয়ে যায়। পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ বাংলাদেশের সত্যিকারের ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। তবুও লৌহ যবনিকা অন্তরালে এবং পাক ফৌজের কঠোর দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে যেসব সাংবাদিক প্রাণ ভয়কে তুচ্ছ করে সীমান্ত ডিঙিয়ে যে টুকরো টুকরো খবর সংগ্রহ করলেন তা দিয়ে বিশ্ববাসীর জোড়া করলেন বাংলাদেশের একটি বীভৎস চিত্র।
আর তখন সমগ্র বিশ্ব আজকের বিক্ষোভ ও বিধ্বস্ত বাংলার চিত্র দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। বিশ্ব জনমত মূল তথ্য জানবার জন্য চাপ শুরু করে দিলেন। গুটি কতক স্থান ঠিকঠাক করে ইয়াহিয়া খান বাধ্য হয়ে ছয় জন বিদেশি সাংবাদিক, যারা এর আগে কোনদিন বাংলাদেশে আসেনি তাদের আমন্ত্রণ করলেন। এসব নতুন সাংবাদিকের সফরে আনায় ইয়াহিয়া খানের একটি লাভ হলো- এরা রেসকোর্স ময়দানের ঢাকার জনসংখ্যা দেখে নি, দেখেনি সদরঘাটের বাস, নবাবপুরের রাস্তায় ভিড় আর দেখেনি ঢাকার পথে সাইকেল, রিক্সা, মোটর গাড়ির প্রচন্ড ভিড়।
সে যাহোক সামরিক গাড়িতে সামরিক নিয়ন্ত্রণে এসব সাংবাদিককে ছয় দিনের জন্য বাংলাদেশ সফরের অনুমতি দেওয়া হল। এই সফরের আগে ইয়াহিয়া সাহেব বায়না ধরলেন যে সব সাংবাদিক ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন তাদের এই সফরে আসতে দেয়া হবে না। কারণ তাদেরকে এই নিয়ন্ত্রিত শহরে আসে দিলে আদিম পৈশাচিকতার মূল তথ্য কে ফাঁকি দেয়া যাবে না। তবু এই নিয়ন্ত্রিত সফরে ব্যবস্থা করে ও বাংলাদেশ নবাগত সাংবাদিকের চোখকে যথার্থভাবে ফাঁকি দিতে পারলেন না বেইমান ইয়াহিয়া টিক্কা চক্র।
অ্যাসোসিয়েট প্রেসের প্রতিনিধি সাংবাদিক মর্ট রোসেন ব্লুম বলেন যে, সামরিক কর্তৃপক্ষ এই সফরের নিয়ন্ত্রিত পথে বিভিন্ন স্থানে ভাড়া করা লোক দাঁড় করে রাখে। পথ ঘাট মেরামত করে মূল তথ্য কে ঢাকতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার মধ্যে থেকেও বাংলাদেশের এক ভয়ঙ্কর বীভৎস চিত্র ফুটে উঠেছে। তার সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে একটা মাত্র দৃষ্টান্তের মধ্যে তিনি সারা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর পৈশাচিক নরহত্যার একটি খন্ডাংশ তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন গলিত লাশের মাংসে শকুনি গৃধিণীদের পেট এত পূর্ণ হয়েছে যে পদ্মার তীর ধরে উঠে যেতেও তাদের কষ্ট হচ্ছে। তার মতে মাত্র পাঁচ সপ্তাহের হানাদার বাহিনীর হত্যালীলার বাংলাদেশের পাঁচ লাখ লোকের লাশ শকুনিরা মেজবানের জন্য পেয়ে গেছে।
রোজেন ব্লুম লিখেছেন, বাংলাদেশে পাকফৌজ কত লাখ লোককে হত্যা করেছে তা কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু নির্ভরযোগ্য ও নিরপেক্ষ হিসাবের ভিতরে সংখ্যা কমপক্ষে দশ লাখ হবে বলে তার ধারণা।
কিন্তু আমাদের কাছে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সূত্রে যে সমস্ত হিসাব এসেছে তার থেকে বলা যায় যে এযাবত অন্তত ৩০-৫০ লক্ষ লোককে তারা হত্যা করেছে।
দেউলিয়া সরকারের পাশে চীন
গণচীন পাকিস্তানের আর্থিক সংকট মোচনের জন্য ইয়াহিয়ার সরকারকে এক শত কোটি টাকা সুদবিহীন ঋণদানের সিদ্ধান্ত করেছে।
বাংলাদেশে ফৌজি বিভীষিকার ধারাবাহিক বিবরণ
একটি যুদ্ধঃ বহু ইতিহাস
ফৌজী বিভীষিকার অনেক লোমহর্ষক কাহিনী বইপত্র পড়েছি, ছায়াছবিতে দেখেছি। মনে পড়ে “ডায়েরি অফ অ্যানা ফ্রাঙ্ক” এর কথা। হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী কিভাবে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিল তার কিছু নমুনা বইটিতে বর্ণনা করেছে তের বছরের কিশোরী অ্যানা ফ্রাঙ্ক। কোনোদিন ভাবি নি নিজেরাও শিকার হবে এমন এক ফৌজি বিভীষিকার।
২৯শে এপ্রিল যখন মুক্ত এলাকা তখন মনে হলো পাখির গান, গাছে গাছে সবুজ পাতার কাঁপন, মেঘের আনাগোনা, হাওয়ার পরশ, সবকিছুই যেন নতুন করে অনুভব করছি। বহু হেঁটেছি, বড্ড ক্লান্ত। বসেছি এক পুকুর পাড়ে। ঘাটে কলসিতে জল ভরছে মেয়েরা, ছেলেরা ঝাঁপাঝাঁপি করছে পুকুরে।‌ কত নিশ্চিন্ত মনে বসে আছে মাছরাঙ্গা চুপ করে গাছের ডালে।
বসে বসে ভাবছিলাম ঢাকার কথা। ওখানে ছিলাম আমি ২৫ শে মার্চ থেকে ২৫শে এপ্রিল পর্যন্ত। সেসব দিনের কথা ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। পঁচিশে এপ্রিল রাত ১২ টায় শুরু হয় ইয়াহিয়ার বর্বর সেনাবাহিনীর পৈশাচিক আক্রমণ। পৃথিবীর ইতিহাস ঘাটলে এমন কোন নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। যে নিজের দেশের সেনাবাহিনীর দেশের নিরীহ নিরস্ত্র জনগণের উপর এমন হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, এমনভাবে নির্বিচারে খুন করেছে নিজেরই দেশের মানুষকে।
সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, ২৫ শে মার্চ। ঢাকা তখন সরগরম, ইয়াহিয়া ভুট্টো সবাই ঢাকায়। আলাপ-আলোচনা চলছে শেখ সাহেব আর ইয়াহিয়ার মধ্যে এবং বাঙ্গালীদের দুই দুশমন ইয়াহিয়া ভুট্টোর মধ্যে। বাঙ্গালীদের এই দুই চরণ শত্রুর পাকা অভিনয় করে রেখেছিল আমাদের কাগজের রিপোর্টার হিসেবে আমাদের ছোটাছুটির অন্ত তখন নেই। একবার শেখ সাহেবের বাসা, একবার প্রেসিডেন্ট ভবন, কোন সময় ছুটছি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। বিকেলের শেখ সাহেবের বাসায় আমার ডিউটি ছিল, অপেক্ষায় ছিলাম আমরা সবাই। দেশি-বিদেশি প্রচুর সাংবাদিকের ভিড়, আর বাইরে অপেক্ষমাণ বিরাট জনতা। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, অসহযোগ আন্দোলন বিশেষ করে ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনা শুরু হওয়ার পর থেকে শেখ সাহেবের বাসায় রিপোর্টার আর জনতার ভিড় লেগেই ছিল।
আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি। যদি বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোন তথ্য পেশ করেন তা টুকে নেবার জন্য। তখন প্রায় রাত সাতটা। আমাদের কাগজের অন্য এক রিপোর্টার আমাকে বললেন, তুমি অফিসে গিয়ে হাতের কাজ সেরে নাও, আমি একটু পরে আসছি। রাত সাড়ে আটটা, অফিসে বসে কাজ করছি, সহকর্মী ফিরে এসেছেন, নতুন কোন কিছু জানা যায়নি। আলোচনায় অগ্রগতি হচ্ছে, অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শেখ সাহেব।
রাত সাড়ে নয়টায় টেলিফোন এল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে। ভুট্টো দশটার প্লেনে চলে যাচ্ছে, আপনারা ইচ্ছে করলে আসতে পারেন, ছুটলাম ইন্টারকন্টিনেন্টালে, গিয়ে দেখি খাকি পোশাক ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সংখ্যা বেড়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর অসংখ্য খাকি পোশাকধারী লোক ও মেশিনগান রাইফেল এর মধ্য দিয়ে বীরদর্পে চলে গেলেন ভুট্টো সাহেব বিমানবন্দরে। রাস্তায় গিয়ে দেখি তুমুল কান্ড শুরু হয়ে গেছে। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করছে লোকজন। সারা শহরময় একটা চাপা গোঙানির বাংলাদেশ স্বাধীন কর বীর বাঙালি অস্ত্র ধর ইত্যাদি স্লোগান রাজধানীর আকাশ-বাতাস হয়ে উঠেছে মুখরিত। একটা লোক আমাকে বলল, “তারাতাড়ি” বাসায় চলে যান, এখনই মিলিটারির সাথে যুদ্ধ শুরু হবে, আপনারা পারবেন না যুদ্ধ করতে। শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।”
অফিসে যখন এসেছি সে সময় রাত প্রায় এগারোটা বাজে। দেখি আমাদের অফিসের সামনে তৈরি হচ্ছে ব্যারিকেড। কয়েক হাজার লোক জমা হয়েছে। রাস্তা থেকে গাছ কেটে ব্যারিকেড তৈরি করছে তারা। ইট আর গাছ দিয়ে ব্যারিকেড তৈরির কাজ শেষ করে নানা স্লোগান দিচ্ছিল লোকজন। স্লোগান তখন সারা শহরেই চলছে। মনে হয় হাজার হাজার লোক নেমে এসেছে রাস্তায়। আমরা সবাই দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, রাত প্রায় বারোটা বাজে তখন। তখন আমাদের অফিসের পূর্ব দিক থেকে একে একে চারটি মিলিটারি ট্রাক এসে দাঁড়াল অফিসের সামনে। রাস্তায় ব্যারিকেড সামনে এগুনোর উপায় নেই। তাড়াতাড়ি সবাই ঢুকে পড়লাম ভেতরে। কয়েক হাজার লোক ও নিমিষের মধ্যে কোথায় লুকিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর জানালা দিয়ে সন্তর্পনে তাকিয়ে দেখি জনতা আবার জোট বেঁধেছে। স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছে। শুরু হলো এই নাম-না-জানা অসীম সাহসী বীরদের উপর নির্বিচারে মেশিনগানের গুলি, ছুটে পালিয়ে গেল সবাই। অন্ধকারে দেখতে পেলাম না কয়জন নিহত হলো। রাস্তায় কোনো আলো নেই, তাই কিছু দেখার উপায় নেই।
কি ঘটছে বা কি শুরু হলো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। রাত বারোটার দিকে টেলিফোন অচল হয়ে গেল। এরপর শুরু হল একটানা দুঃস্বপ্নের ইতিহাস। রীতিমতো যেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। পিশাচরা আক্রমণ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষকদের কোয়ার্টার, ইকবাল হল, জগন্নাথ হল, রাজার বাগ পুলিশ সদরদপ্তর, শহরের বিভিন্ন বস্তি এলাকা। আরো নানা জায়গায় সারারাত ধরে একটানা চলল রাইফেল, মেশিনগান, মর্টার, বোমার আওয়াজ আর যেদিকে তাকাই সেদিকেই আগুন মনে হলে সারা শহরে আগুন জ্বলছে। (চলবে)
খুনি মওদুদ কি বলছে
১৯৫৩ সালে লাহোরে মজহাবী খুনির তালিকায় শীর্ষ স্থান অধিকার দাঙ্গা বাঁধিয়ে ১০ সহস্র কাদিয়ানীকে হত্যা করে যে মাওলানা মওদুদী বিশ্বে করেছেন সেই মলানা মৌদুদি বাংলাদেশ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জল্লাদদের কার্যকলাপে এক ইসলামী যুক্তি আবিষ্কার করেছেন। বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী জল্লাদরা যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে তার সমর্থনে বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে লিখিত এক পত্রে মাওলানা মওদুদী বলেছেন যে বাঙালি মুসলমান ও হিন্দুদের তেমন কোন তফাৎ নেই , এবং বাঙালি মুসলমানদের হিন্দুতে ধর্মান্তর রোধ করার জন্যই পাকিস্তান সেনাবাহিনী কয়েক লাখ বাঙালি মুসলমানকে হত্যা করেছে। বাঙালি মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করে পশ্চিমা সৈন্যরা সওয়াবের কাজ করছে বলে মওদুদী প্রকারান্তরে মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের বুঝাতে চেয়েছেন। মাওলানা মওদুদী তার পত্রে ইসলামের স্বার্থে পাক সেনাবাহিনীর বাঙালি হত্যার যে কর্মসূচি নিয়েছে তার পথে কোনো বাধা সৃষ্টি না করার জন্য রাষ্ট্রপ্রধানদের অনুরোধ করেছেন।
পশ্চিম পাকিস্তানের কুখ্যাত ২২ পরিবারের বেতনভোগী দালাল মওদুদী কি কারণে বাংলাদেশের বর্তমান গণহত্যার প্রশ্নের ধর্মের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন বা কি কারনে বাঙালি মুসলমানদের ধর্মের দিক থেকে হিন্দু বানিয়ে ছেড়েছেন তা আমাদের জানা নেই। বাংলাদেশ ওয়াজ হিন্দু মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পশ্চিমা শোষক ও জল্লাদদের বিরুদ্ধে লড়ছেন বলেই কি মওদুদী এমনটা চটে গেছেন। অথবা গত নির্বাচনে বাংলাদেশের হিন্দু মুসলমান মওদুদীর লেবাস সর্বস্ব জামাতকে ভোট দেয়নি বলেই তিনি এমনভাবে ক্ষেপেছেন। কিন্তু প্রশ্ন জামাতকে ভোট না দিলে যদি মুসলমানদের ধর্ম নষ্ট হয়ে যায় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানরাও তো কাফের হয়ে গেছে। কেননা বাংলাদেশের মানুষের মতো তারাও তো গত নির্বাচনে মওদুদীর জামাতকে ভোট দেয়নি।
তাছাড়া হিন্দু-মুসলমান একসাথে বসবাস করলে যদি মুসলমানের ধর্ম নষ্ট হয় তাহলে মওদুদীর নিজেও তো একজন বিধর্মী। কেননা, মওদুদীর বাপ-দাদারা পূর্ব পাঞ্জাবে হিন্দু ও শিখ দের সাথে বসবাস করতেন। সে ক্ষেত্রে যদি তাদের ধর্ম নষ্ট হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে বিধর্মীর পুত্র মওদুদী ও তো একজন বিধর্মী। কই আমরা তো কোনদিন শুনিনি যে মওদুদী পাকিস্তানের আগমনের পর নতুন করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন।