You dont have javascript enabled! Please enable it!

জয় বাংলা ১১ মে ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা

মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

জয় বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র
মুজিবনগরঃ প্রথম বর্ষঃ প্রথম সংখ্যা ২৭ শে বৈশাখ ১৩৭৮, ১১ই মে ১৯৭১

বাংলাদেশের মুক্তিপাগল মানুষ আজ ইয়াহিয়া ও তার জঙ্গী চক্রের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ করে রুখে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পাক-ফৌজের বিরুদ্ধে চলছে মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড লড়াই। অস্র বলে বলিয়ান খানসেনাদের নায়ক টিক্কা খান ভেবেছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভেঙ্গে দেয়া যাবে বাঙালির প্রতিরোধ, তাদের পরিণত করা যাবে গোলামের জাতে। কিন্তু তাদের সে আশা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিদিন বাড়ছে মুক্তিবাহিনীর শক্তি। বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন যোগ দিচ্ছে মুক্তিবাহিনীতে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী নিচ্ছে খানসেনাদের খতম করার চূড়ান্ত প্রস্তুতি। শত্রুর কামান চিরতরে স্তব্ধ না করা পর্যন্ত থামবে না এ যুদ্ধ। কিন্তু এ ছাড়া কি অন্য কোন পথ খোলা ছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ও তাদের নেতাদের জন্য?
এ প্রশ্নের জবাব দিতে গেলে পাকিস্তানের জন্ম লগ্ন থেকেই নানা বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে হয়। গণতন্ত্রের পথেই হয়েছিল পাকিস্তানের জন্ম, এবং তা অর্জনের উদ্দেশ্যে ছিল আপামর দেশবাসীর সার্বিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি। কিন্তু বাঙালি জাতি কি কোনদিন পেয়েছে মুক্তির স্বাদ? বারবার বাঙালির রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের উপর হানা হলো একটানা হামলা।
গোড়াতেই চলল বাঙালির মাতৃভাষার উপর আক্রমণ -যদিও পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার মধ্যে বেশিরভাগ ছিল বাঙালি। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রাণ দিতে হলো আমাদের। সন্তানদের কিশোর-তরুণ এর তাজা রক্তে লাল করতে হল ঢাকার রাজপথ। অনেক খুন, অনেক রক্ত ও অনেক সংগ্রাম এর বিনিময় বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পেল কোনদিন তার ন্যায্য মর্যাদা পেল না।
বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ওদের কত ঘৃণা-বিদ্বেষ বাংলাদেশব্যাপী শহীদ স্মরণে গড়ে ওঠা শহীদ মিনার গুলো কামান দাগিয়ে ধ্বংস করা থেকেই পাওয়া যায় তার প্রমান।
শুধু ভাষায় নয় বাংলার সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা চালালো হামলা। আমাদের সংস্কৃতিকে গলা টিপে মারার প্রয়াস চলল সুপরিকল্পিত ভাবে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও চলল একটানা শোষণ-বঞ্চনা। বাংলাদেশের শোষণ করে গড়ে তোলা হলো পশ্চিম পাকিস্তান। ফলে একদিকে সোনার বাংলা পরিণত হলেও শ্মশানে অন্যদিকে মরুময় পশ্চিম পাকিস্তান হয়ে উঠল শস্য শ্যামলা। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি বাকরি সশস্ত্র বাহিনীর কোথাও হলো না বাঙ্গালীদের স্থান। আজাদীর ২৪ বছর পরও সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙ্গালীদের সংখ্যা শতকরা দশ জন ও ছিল না। বিদেশি সাহায্য ঋণ প্রবৃদ্ধি ক্ষেত্রেও পেলো না বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা। সাড়ে ১২ কোটি পাকিস্তানের নামে এসব বিদেশি সাহায্য ঋণ ও মঞ্জুরি এনে তা ভোগ করলো দেশের একটি অংশের মানুষ। বাংলাদেশের পাট বেচা টাকা থেকে আয় হতো পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার শতকরা ষাট ভাগ। কিন্তু কোনদিন বাঙালি এর অর্ধেক ও নিজের ব্যবহারের জন্য পায়নি। বাংলাদেশের উদ্ধৃত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে পূরণ করা হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের ঘাটতি। কেনা হয়েছে দেশের সেই অঞ্চলের জন্য কলকারখানা ও শিল্পের যন্ত্রপাতি, আর আনা হয়েছে সামরিক অস্ত্র শস্ত্র। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বাঙালির অর্থে কেনা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আজ নির্বিচারে খুন করা হচ্ছে বাঙ্গালীদের।
আওয়ামী লীগ যখনই এসব অন্যায়, অবিচার ও শোষণ বঞ্চনার প্রতিকার দাবি করেছে তখনই তাদেরকে আখ্যায়িত করা হয়েছে ভারতের দালাল রূপে, ইসলাম ও সংহতির দুশমন রূপে। তবু নির্ভেজাল গণতন্ত্রে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জাতীয় সমস্যাবলীর সমাধান করতে, কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যকার তথা দেশের দুই অংশের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ধারণ করতে। ভাই ভাই হিসেবে এক সাথে বাস করতে। কিন্তু বেঈমানী ইয়াহিয়া ও তার সামরিক চক্র রুদ্ধ করে দেয় গণতন্ত্রের পথ। গণতন্ত্রের সব পথ বন্ধ হয়ে যাবার পরেই শুরু হয়েছে আজ এই যুদ্ধ। এই যুদ্ধের জন্য বাঙালিরা দায়ী নয় এই যুদ্ধ ইয়াহিয়া তার জঙ্গী চক্রের চক্রান্তেরই ফলশ্রুতি।
বাংলাদেশের মানুষ সবসময়ই শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমস্যার সমাধান চেয়েছে। তাই যখনই দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমস্যা সমাধানের সামান্যতম সুযোগ এসেছে তাকে তারা গ্রহণ করেছে সযত্নে। ১৯৫৪ সালে বাংলাদেশের মানুষ গণতান্ত্রিক উপায়ে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তব রূপ দানের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। যুক্তফ্রন্ট বাংলাদেশ বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করে। পরাজিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের দালাল নুরুল আমিন ও তার মুসলিম লীগ দল। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট সরকার কে ৯২ক ধারা প্রয়োগ করে ১৪ দিনের বেশি মন্ত্রিত্ব করতে দেয়া হয় না। এরপরে চলে নানা চক্রান্ত। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ডাকাতির মামলাসহ অনেকগুলি মামলা। কথা ছিল ১৯৫৯ সালে সারা পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন হবে। আওয়ামী লীগ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে সেদিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগ না দিয়ে ও ফিরোজ খান নুন মন্ত্রিসভা কে সমর্থন করেছিল। কারণ সেদিন বাঙালিরা ভেবেছিলো এই নির্বাচনের মাধ্যমে তারা তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণের কথা। পশ্চিমা স্বার্থ যখন বুঝতে পারলো যে নির্বাচন হলেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হবে তথা বাঙ্গালীদের হাতে কেন্দ্রের ক্ষমতা চলে যাবে তখন আইয়ুব খান করলেন ক্ষমতা দখল। পাকিস্তানের চালু হলো সামরিক রাজ। সামরিক রাজ মানেই পাঞ্জাবি রাজ। বাংলা দেশের গণতন্ত্রকামী সব নেতাদের জেলে পাঠানো হলো। আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকে করতে হলে বছরের পর বছর কারাবরণ। তাদের অপরাধ ছিল তারা পাকিস্তানের চাচ্ছিলেন সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। আর যাচ্ছিলেন বাঙ্গালীদের ন্যায্য অধিকার। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন তাঁর বিখ্যাত ছয় দফা কর্মসূচি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে দানা বাঁধতে থাকে গণ-আন্দোলন। ঢাকার রাস্তায় নিরস্ত্র মিছিলের উপর চলে গুলি। অবশেষে শেখ সাহেব কে গ্রেফতার করা হয় ও কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজানো হয়। এই মামলা চলাকালীন সারাদেশে সৃষ্টি হয় বিরাট গণঅভ্যুত্থান আইয়ুব শাহীর বাধ্য হয় তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিতে।
আইয়ুবের জায়গায় আসেন ইয়াহিয়া খান তার নির্বাচন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বুলি নিয়ে। ইয়াহিয়া নির্বাচন দেন জনসাধারণের চাপে পড়ে। কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল জয় দেখে শঙ্কিত হয়ে ওঠেন ইয়াহিয়া, সামরিক চক্র, পশ্চিম পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র ও কায়েমী স্বার্থবাদীর দল। নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হয় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের শতকরা ৭৯টি পপুলার ভোট পেয়ে ৩১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি দখল করে। আওয়ামীলীগ নিজেকে প্রমাণ করে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলরূপে এবং বাংলাদেশে একমাত্র মুখপাত্ররূপে। গণতন্ত্রের সর্বজনীন নিয়ম নীতি অনুসারে আওয়ামী লীগের ছিল মন্ত্রিসভা গঠন করার, গণতন্ত্র প্রণয়ন করার অধিকার। কিন্তু সে পথে না গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী, সামরিক চক্র, আমলাতন্ত্র ও কায়েমী স্বার্থবাদী দল নতুন করে চক্রান্ত শুরু করে বাংলার বিরুদ্ধে। অনেক টালবাহানার পর ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হয়। আওয়ামী লীগ এগিয়ে চললো তার শাসনতান্ত্রিক বিল নিয়ে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতিদের দালাল ভুট্টো সামরিক বাহিনীর ইঙ্গিতে দাবি তুললেন জাতীয় পরিষদের বাইরে শাসনতান্ত্রিক সমস্যার সমাধান করতে হবে। এটাকে ছুতা হিসেবে ব্যবহার করে ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন অনির্দিষ্টকালের জন্য। সারা বাংলাদেশে ফেটে পরলো গণবিক্ষোভে। সামরিক চক্র চাইলো গুলি ছুড়ে এই বিক্ষোভ দমন করতে। কিন্তু পারল না। শত শত শহীদের রক্তে রাঙ্গা হলো বাংলার রাজপথ। শেখ সাহেব ঘোষণা করলেন তার অসহযোগ আন্দোলনের কথা‌। সারা বাংলাদেশ সাড়া দিল তাতে। ইয়াহিয়া সরকার প্রমাদ গুনলেন। ইয়াহিয়া এলেন ঢাকায়। আলাপ-আলোচনা আরম্ভ করলেন শেখ সাহেবের সাথে। কিন্তু এই আলোচনা ছিল আসলে এক বিরাট ষড়যন্ত্রের অংশ মাত্র।
আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল কেবল সময় নেওয়া। আলোচনার অসিলায় সেনা বাহিনীকে প্রস্তুত করা। ইয়াহিয়া যখন ঢাকায় আলোচনায় বসেন তখন বাংলাদেশের যা সৈন্য ছিল তাকেই যথেষ্ট ভাবতে পারেনি ইয়াহিয়া চক্র। আর বিপুল রণ সম্ভার আনা হতে থাকে এই সময়। আনা হলো কমপক্ষে আরো ২০ হাজার সৈন্য। বাঙালিরা যা সামান্য কিছু সংখ্যক সেনাবাহিনীতে ছিল তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হতে থাকলো অস্ত্রপাতি। ইপিআর কে নিরস্ত করার চেষ্টা চলল। এমনকি পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকেও অস্ত্র শস্ত্র সব নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হলো।
যাতে লোকের সন্দেহ না হয় তাই ইয়াহিয়া বলতে থাকে বিভিন্ন মনভোলানো কথা। কিন্তু আলোচনা শেষ হবার আগেই ২৫শে মার্চ মধ্যরাত্রিতে ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ঢাকায় নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙ্গালীদের উপর। সারাদেশে আরম্ভ হয়ে যায় ফৌজি বিভীষিকা। পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন ভয়াবহ জঘন্য বেঈমানীর নজির আর নেই। হিটলারের নিষ্ঠুরতাও হার মেনেছে এদের কাছে।
আওয়ামী লীগ ৬ দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে জয়ী হয়। ছয় দফার গোড়ার কথা ছিলঃ পাকিস্তানকে হতে হবে একটি গণতান্ত্রিক ফেডারেল প্রজাতন্ত্র। প্রজাতন্ত্রের কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে পররাষ্ট্র (বৈদেশিক বাণিজ্য বাদে) ও দেশ রক্ষার ভার। অন্যান্য সমস্ত ক্ষমতা থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে। ছয় দফার মধ্যে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার কোন পরিকল্পনা ছিল না। ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে আলোচনায় এর সবকিছুই বাহ্যত স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু পরে দেখা গেল এই সবে ছিল ভাওতা। তার আসল লক্ষ্য ছিল সময় নেওয়া। আলোচনার নামে আক্রমণের প্রস্তুতি চালানো।
ইয়াহিয়া ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতা, সেনাবাহিনীর নরঘাতী আক্রমণ বাঙালিকে বাধ্য করেছে অস্ত্র ধারণ করতে। স্বাধীন সরকার গঠন করতে। বাঙালি আর কোনো ষড়যন্ত্র পতিত হতে চায় না। ওদের সাথে একসাথে বসবাস করা যাবে না -এটা প্রতিটি বাঙালি আজ বুঝতে পেরেছে। অস্ত্রের ভাষার জবাব বাঙালি আজ দিতে প্রস্তুত অস্ত্রের ভাষায়। বাংলাদেশের লোকগীতি ভাই-বোন এগিয়ে আসো, অস্ত্র ধর বাংলার মাটি থেকে শোষক, অত্যাচারী, নিপীড়ক ও স্বৈরাচারী খানসেনাদের খতম করতে। খুনের উত্তর খুন। রক্ত দিয়েই আমরা রক্তের বদলা নেব। বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নিয়েছে এক নতুন পতাকা। বাংলাদেশের সবুজ প্রান্তরে পড়ছে লাল রক্তের দাগ। এ রক্তের কেন আমরা ভুলব না। বাঙালির রক্ত বৃথা যেতে দেব না। পবিত্র এ রক্ত আমাদেরকে যুগ যুগ ধরে দেবে অনুপ্রেরণা। আবার বলি এ যুদ্ধ আমরা চাইনি। বাধ্য হয়ে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা করেছি। নিজেদের সরকার গঠন করেছি। আর পশ্চিম পাকিস্তানের জল্লাদদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছি। কারণ তারা আমাদের সামনে আর কোন পথ খোলা রাখে নি। জয় বাংলা।
জয় বাংলার প্রতি শুভেচ্ছা বাণীঃ-
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর বাংলাদেশের জনসাধারণের কাছে আমাদের বাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্য বলিষ্ঠ শক্তিশালী পত্রিকার অভাব বিশেষভাবে অনুভব করছিলাম। শুনে সুখী হলাম যে আওয়ামী লীগের মুখপত্র হিসেবে ‘জয়বাংলা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আশাকরি পত্রিকাটির বাংলাদেশের ঘরে ঘরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের বাণী পৌঁছে দিয়ে দেশের জনসাধারণের সংগ্রামী চেতনা ও মনোবল রেখে আমাদের সংগ্রামকে পূর্ণ পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাসী। তাই আমি আশা করি জয়বাংলা সর্বদা আমার সরকারের সঠিক ও নিরপেক্ষ সমালোচনা করে তাকে ঠিক পথে পরিচালিত করতে সাহায্য করবে।
আমাদের যে সাংবাদিক বন্ধুরা এই পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছেন আমরাও আমার সরকারের তরফ থেকে তাদের আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘হিসেবে জয়বাংলা’-র আত্মপ্রকাশকে আমি জানাই আমার আন্তরিক অভিনন্দন। জাতি আজ এক মহা সংকটে নিপতিত একটি বিরাট সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত। আমি আশা করি জয় বাংলা বাংলার ঘরে ঘরে আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনবাংলা সরকারের বানী পৌঁছে দেবে এবং আমাদের সংগ্রাম এর চূড়ান্ত সাফল্যের ব্যাপারে আমাদের পথ দেখাবে। আওয়ামীলীগের মুখপত্র হলেও জয়বাংলা ত্রুটি-বিচ্যুতি নির্দেশের ব্যাপারে আমাদের কাকেও ছাড়বে না এ বিশ্বাস আমার আছে।
তাজউদ্দিন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ সরকার
ইয়াহিয়া টিক্কা খানের জঙ্গী চক্রের হাতে ঢাকার সংবাদপত্র গুলো পড়ে যাওয়ার পর আমরা প্রচারণার ক্ষেত্রে বিশেষ অসুবিধায় পড়ে ছিলাম। কিন্তু নানাবিধ অসুবিধার দরুন আমাদের পক্ষে এতদিন কিছু করে ওঠা সম্ভব হয়নি। অথচ নিজস্ব সংবাদপত্র ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ তো দূরের কথা কোন নিয়ম তান্ত্রিক সংগ্রামও সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হিসেবে সাপ্তাহিক ‘জয়বাংলা’র আত্মপ্রকাশকে অভিনন্দিত করছি। আশা করি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগের কর্মীরা পত্রিকাটি বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন।
মিজানুর রহমান চৌধুরী
ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
পাঁচ সপ্তাহের যুদ্ধে দশ সহস্ত্র পাকসেনা নিহত
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী দখলদার পাক-ফৌজের উপর ক্রমাগত প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন। তাদের চাপের তীব্রতার ফলে প্রতিদিন নতুন নতুন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল পুনর্দখল হচ্ছে। ইতিমধ্যে রামগড়, টাঙ্গাইল, ছাগলনাইয়া প্রভৃতি কতকগুলি অঞ্চল থেকে পাক-সৈন্যকে বিতারিত করা হয়েছে এবং অন্যান্য সেক্টরে দখলদার সৈন্যের বিরুদ্ধে প্রচন্ড লড়াই চলছে। মুক্তিফৌজ এর এক হিসাবে প্রকাশ এ পর্যন্ত তাদের হাতে দশ হাজার পশ্চিম পাকিস্তানে ভারতীয় সৈন্য নিহত এবং বিশ হাজার আহত হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েক শত পদস্থ সামরিক অফিসার ও রয়েছে।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, মুজাহিদ, আনসার এবং ছাত্র-তরুণদের দ্বারা গঠিত এই মুক্তি ফৌজের সাফল্য ইতিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ রামগড় দখলে এসেছে। মুক্তি সংগ্রামীদের পক্ষে এটা একটা বড় রকমের জয়। শহরটি মুক্তিফৌজের দখলে আসার আগে পাক বাহিনীর সঙ্গে কয়েক দফা বড় রকমের সংঘর্ষ হয়। পাক ফৌজের বহু সৈন্য এইসব আক্রমণে নিহত হয়।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে নোয়াখালী জেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সংযোগ-কেন্দ্র ছাগলনাইয়াতে তিনদিন ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রচণ্ড সংগ্রামের পর মুক্তিফৌজ এ জায়গাটি দখল করে নেন। এই যুদ্ধে অন্তত ২১ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে। মুক্তিফৌজ মেশিনগান, রাইফেল রকেট নিক্ষেপক প্রভৃতি প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাগুলি পলায়মান পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে দখল করেছেন। এছাড়া এই জেলার ফেনাঘাটা সেতুর কাছে মুক্তি ফৌজের কমান্ডো বাহিনীর আক্রমণে আরো পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়েছে।
বেনাপোল সীমান্তের ঝিকরগাছায় কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। মুক্তিফৌজ মুক্তিফৌজের সঙ্গে পাক-ফৌজের এখানে শত্রু সৈন্যকে গেরিলা কায়দায় তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে।পাক-ফৌজ বেকায়দায় পড়ে বেপরোয়াভাবে মেশিনগান ও দূরপাল্লার কামান ছুড়তে থাকে। মুক্তি ফৌজের প্রচন্ড আক্রমণের সামনে বহু পাকসেনা নিহত হয় এবং রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে পলায়নের চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তিফৌজের সতর্ক দৃষ্টির ফলে কয়েক জন পাকসেনা গ্রেফতার হয়। পাকফৌজ পিছু হটার সময় পথিপার্শ্বের ঘর-বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ ও মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। তাদের বর্বরোচিত হামলায় নারী, শিশু, বৃদ্ধ, এমন কি ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা ও রেহাই পায়নি।
কুমিল্লার কসবা অঞ্চলে মুক্তিফৌজ পশ্চিম পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর উপর দুই দিক থেকে সাড়াশী আক্রমণ চালায়। মুক্তি ফৌজের অল্প সংখ্যক সদস্যের এই হামলায় পাক-ফৌজ দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা বিমান হামলার সাহায্য নিয়েও এঁটে উঠতে পারেনি। এই আক্রমণে পাক-ফৌজের বহু সেনা মুক্তি ফৌজের হাতে হতাহত হয়। অবশিষ্ট সৈন্য পলায়ন করে।
মুক্তিফৌজ বাংলাদেশের উত্তর, দক্ষিণে ও পূর্বাঞ্চলে শত্রুবাহিনীর গতিরোধ করে এবং তাদের টাঙ্গাইলের জেলা সদর দপ্তর থেকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য করে।
প্রাপ্ত অপর এক খবরে প্রকাশ, ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা মুক্তিফৌজ পাকসেনাদের সঙ্গে কয়েকটি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। তাছাড়া মুক্তিফৌজ কুমিল্লা অঞ্চলের মিয়াবাজার ও বিবি বাজারে প্রচন্ডভাবে শত্রুদের পর্যুদস্ত করে।
কুমিল্লা জেলায় শাহবাজপুরের গুরুত্বপূর্ণ পুলটি পুনর্দখলের চেষ্টা করলে মুক্তিফৌজ পাকবাহিনীকে সাফল্যের সঙ্গে হটিয়ে দেয়। ৯০ নম্বর সড়কের ওপর শাহবাজপুর পুলটি অবস্থিত এবং এই সড়ক চট্টগ্রাম ও ফেনীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মুক্তিফৌজ ফুলবাড়ী দিনাজপুর এর মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী সড়ক বিধ্বস্ত করে দিয়েছে।
রংপুর অঞ্চলে মুক্তিফৌজ মোগলহাট ও অমরখানে গেরিলা পদ্ধতিতে পাকবাহিনীর উপর আঘাত হানে। মুক্তিফৌজ এই অঞ্চলে বহু পাক সেনাকে হতাহত করেছে।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিটগুলো অমরখানা ও পাঁচ ঘরের মধ্যে জগদ্দল থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের তাড়িয়ে দিয়ে জগদ্দল দখল করে নিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা জগদ্দল ও পাঁচ ঘরের সংযোগরক্ষক একটি সেতু উড়িয়ে দিয়েছেন। তারা তেতুলিয়া ও ঢাকার মধ্যে সড়ক সংযোগ ও বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন।
রংপুরের পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে যারা নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে মসজিদের ইমাম ও আছেন।
পূর্বাঞ্চল সেক্টরে মুক্তিফৌজের চাপ অব্যাহত রয়েছে। এখানে পাকফৌজের একশত সৈন্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আখাউড়ায় আরো ৫০ সৈন্য নিহত হয়েছে।
বেনাপোলে ওপরে খবরে প্রকাশ মুক্তিফৌজের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাহিনীর বেনাপোল সেক্টরে প্রচণ্ড চাপ অব্যাহত রাখেন। এই আক্রমণের মুক্তিফৌজ মর্টার, মেশিনগান ও রাইফেল ব্যবহার করেন। ফ্রন্টে পাক-ফৌজের ঘাঁটি ধ্বংস করে দেওয়া হয় এবং ২৫ জন দখলদার সৈন্যকে হত্যা করা হয়।
বিদেশি সাংবাদিকের দৃষ্টিতে ঢাকা নগরী-
২৫শে মার্চ মাসে ফল রাত্রিতে ঢাকা নগরী থেকে যেসব বিদেশি সাংবাদিক কে বের করে দেওয়া হয় তাদের মধ্যে আমেরিকার বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা টাইম এর সংবাদদাতা ডান কগিনও ছিলেন। ঢাকার নারকীয় হত্যাকাণ্ডের কোনো খবর যাতে বাইরে বিশ্বের মানুষ না জানতে পারে, এ কথা ভেবেই জঙ্গিশাহী ঢাকায় থাকতে দেননি কোন বিদেশী সাংবাদিক কে। সর্বপ্রকার খবরের উপর পাকিস্তান সরকার চেয়েছিলে নিষেধাজ্ঞার কালো পর্দা টানিয়ে দিতে। সারা পৃথিবীর মানুষকে বোকা বানাতে। তাদের নাদির শাহের কুকীর্তি ঢেকে রাখতে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। একাধিক সাংবাদিক মৃত্যু ভয় কে তুচ্ছ করে পরে সীমানা পেরিয়ে ঢুকে পড়েন বাংলাদেশের মধ্যে; সংগ্রহ করে আনেন এবং এখনও আনছেন নানা খবর। আর এইসব খবর সৃষ্টি করছে বিশ্বজনমত। ধিক্কার উচ্চারিত হচ্ছে ইয়াহিয়া সরকার ও তার জঙ্গী চক্রের বিরুদ্ধে। টাইম পত্রিকার সাংবাদিক ডান কাগিন পশ্চিমবাংলা থেকে হুন্ডায় চড়ে প্রবেশ করেন বাংলাদেশে। তারপর বাসে, ট্রাকে, সাইকেলে চেপে পৌঁছান ঢাকা শহরে। সেখান থেকে আবার খবর সংগ্রহ করে ফিরে আসেন ভারতে। তিনিই প্রথম মার্কিন সাংবাদিক যিনি ঢাকায় গিয়ে নিজের চোখে দেখে বাইরের বিশ্বে ইয়াহিয়া সাহেব কুকীর্তির কথা বিশ্ব সমক্ষে তুলে ধরেছেন।
কগিন লিখেছেনঃ
ঢাকা এখনও মৃত নগরী। সামরিক আক্রমণের একমাস পরেও সরকারি দপ্তর অফিস-আদালত কিছুই চালু করা সম্ভব হয়নি। কত লোক মারা গিয়েছে তার হিসাব এখনও দেওয়া চলে না। হাজার হাজার লোক নিহত হয়েছে সামরিক আক্রমণে। ঢাকা শহরের অর্ধেক কি তার বেশি লোক পালিয়ে গেছে শহর ছেড়ে। শহরে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে দারুণভাবে। শহরের ১৮টি বাজারের মধ্যে ১৪টি পুড়িয়ে দিয়েছে পাক সামরিক বাহিনী। যেসব পথে একসময় মানুষের ভিড়ে পথ চলা দায় হতো, সেসব পথ আজ প্রায় জনশূন্য। বিজন পথে, পথ চলতে ভয় করে।
শহরের বাড়িগুলির মাথায় মাথায় উঠছে পাকিস্তানের পতাকা। অনেক স্থানেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না এমনকি ইয়াহিয়া সাহেবের বড় বড় ছবি। কিন্তু এসব এই বাহ্যিক। প্রতিটি বাঙালির মনেই জ্বলছে আগুন। তারা মনে করছেন, যুদ্ধে তাদের হার হয়নি। তারা আপাতত পিছিয়ে গিয়েছেন মাত্র। একজন বাঙালি আমার কথার উত্তরে বলল “আমরা ভুলে যাব না কখনো এই স্মৃতি। আমরা কখনো ক্ষমা করব না ওদের।”
আমি সাংবাদিক এ কথা জানতে পেরে শহরের অনেকে আমাকে নিয়ে চলল দেখাতে সেই সমস্ত স্থানগুলি, যেখানে মাটিতে খাত খুড়ে দেওয়া হয়েছে বহু লোকের কবর। আমি জানতে পারলাম ধর্মপ্রাণ মানুষ ও রেহাই পায়নি হত্যাযজ্ঞ থেকে। মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়ে বের হওয়ার সময় গুলি করে মারা হয়েছে বৃদ্ধকে। সেনাবাহিনীতে বোঝানো হয়েছে বাঙালি মুসলমানকে গুলি করে হত্যা করার মধ্যে কোন অপরাধ নেই বরং সওয়াব হবে। কারণ বাঙালি মুসলমানদের আসলে ছদ্দবেশী হিন্দু। শুধু এই নয় ঢাকায় একাধিক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ৫০০ ছাত্র কে মেরে ফেলা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পুরান ঢাকার। সেখানে ঘটেছে সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ ও জঘন্য হত্যাকান্ড। পুরান ঢাকার একাধিক অংশ বাড়িতে পেট্রোল ঢেলে তার উপর গোলা ছুড়ে ধরিয়ে দেওয়া হয় আগুন। মানুষ যখন বাইরে পালাতে চায়, তখনই তাদের উপর মেশিনগান থেকে ছোড়া হয় গুলি।
কিন্তু তথাপি মানুষের মনোবল ভেঙে যায় নি। যেখানেই আমি গিয়েছি সর্বত্র লক্ষ্য করেছি মানুষের অবাক করা মনোবল। তাদের সকলেরই এক প্রতিজ্ঞা কিভাবে পাক বাহিনীকে উৎখাত করে দেশকে চিরতরে মুক্ত করা যাবে।
কগিন মন্তব্য করেছেনঃ বর্ষাকাল আসছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে ভয়ঙ্কর সংকট। ইসলামাবাদকে হয়তো বুঝতে হবে, কেবল গায়ের জোরে একতা রক্ষা করা যায় না এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্না ঠিক তেমনি পাকিস্তানের কথা কখনো চিন্তা করেননি।
(টাইম, ৩রা মে,১৯৭১)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র
“যেহেতু ১৯৭০ সনের ৭ই ডিসেম্বর হাতে ১৯৭১ সনের ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হইয়াছিল
এবং
“যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করিয়াছিলেন
এবং
“যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন
এবং
“যেহেতু আহূত এ পরিষদ স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন এবং যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সহিত পারস্পরিক আলোচনাকালে পাকিস্তান কতৃপক্ষ ন্যায় নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে
এবং
সেহেতু উল্লেখিত বিশ্বাসঘাতকতা মূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখন্ডতা ও মর্যাদা রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান
এবং
“যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর নিশংস যুদ্ধ পরিচালনা করিয়াছে এবং এখনও বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাইতেছে এবং যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্যা ও নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনা দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের একত্রিত হওয়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিয়া জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছে।
এবং
“যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায় পরিষদ গঠন করিয়া পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামরিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য-সেহেতু আমরা বাংলাদেশকে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি এবং উহা দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করিতেছি।
“এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন।
রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক পদেও অধিষ্ঠিত থাকিবেন। রাষ্ট্রপ্রধানই সব সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী।
রাষ্ট্রপ্রধানের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগের ক্ষমতা থাকবে তাহার কর ধার্য ও অর্থ ব্যয়ের ক্ষমতা থাকবে তাহার গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান ও উহার অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা ক্ষমতা থাকিবে। উহা দ্বারা বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষমতার ও তিনি অধিকারী হইবেন।
বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, কোনো কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করিতে না পারেন অথবা তার কর্তব্য ও প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব উপরাষ্ট্রপ্রধান পালন করিবেন।
আমরা আরো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসেবে (অস্পষ্ট) জাতিসংঘের সনদ মোতাবেক আমাদের যে দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তাইয়াছে উহা যথাযথভাবে আমরা পালন করিব।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সনের ২৩শে মার্চ হইতে কার্যকরী বলিয়া গণ্য হইবে।
আমরা আরো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্য আমরা অধ্যাপক ইউসুফ আলী কে যৌথভাবে রাষ্ট্রপ্রধান ও উপরাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য দায়িত্ব অর্পণ এবং নিযুক্ত করিলাম।”
স্বাক্ষর –
এম, ইউসুফ আলী
বাংলাদেশ গণপরিষদের প্রথম
জাতির আজিকার এই সংকট সময়ে আপনার আমার দায়িত্ব -তাজউদ্দিন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
স্বাধীন বাংলাদেশ আর তার সাড়ে সাত কোটি সন্তান আজ চূড়ান্ত সংগ্রামে নিয়োজিত। এ সংগ্রামের সফলতার উপর নির্ভর করছে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির -আপনার, আমার সন্তানদের ভবিষ্যত। আমাদের এই সংগ্রামে জয়লাভ করতে হবে এবং আমরা যে জয়লাভ করবো তা অবধারিত।
মনে রাখবেন আমরা এই যুদ্ধ চাইনি। বাংলার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ছিলেন গণতান্ত্রিক উপায়ে বিরোধের মীমাংসা করতে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতি, শোষকশ্রেণী ও রক্তপিপাসু পশুশক্তির মুখপাত্র ইয়াহিয়া হামিদ টিক্কা খান সে পথে পা না বাড়িয়ে বাঙালির পাট বেঁচা টাকায় গড়ে তোলা সেনাবাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমাদের উপর সর্বশক্তি নিয়ে। তারা নির্বিচারে খুন করছে আমাদের সন্তানদের, মা-বাবাদের, ইজ্জত নষ্ট করছে মা-বোনদের আর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে শহরের পর শহর, গ্রামের পর গ্রাম। তাই আমরা আজ পাল্টা হামলায় নিয়োজিত হয়েছি। গঠন করা হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার। এ সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে শত্রু কবল হতে মুক্ত করা। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ধর্ম, মত, শ্রেণী বা দল নেই। বাংলার মাটি পানি ও আলো বাতাসে লালিত-পালিত প্রতিটি মানুষের একমাত্র পরিচয় আমরা বাঙালি। আমাদের শত্রুপক্ষ আমাদের সেই ভাবেই গ্রহণ করেছে। তাই তারা যখন কোথাও গুলি চালায়, শহর পোড়ায় বা গ্রাম ধ্বংস করে তখন তারা আমাদের ধর্ম দেখেনা, মতাদর্শ দেখেনা -বাঙালি হিসেবেই আমাদেরকে মারে।
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার সকল রকমের অত্যাচার, অবিচার, অন্যায় ও শোষণের অবসান ঘটিয়ে সুখী-সমৃদ্ধ, সুন্দর সমাজতান্ত্রিক ও শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
তাই জাতির এই মহাসংকট মুহূর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনাদের প্রতি আমার আবেদনঃ
(১) কোন বাঙালি কর্মচারীর শত্রুপক্ষের সাথে সহযোগিতা করবেন না। ছোট-বড় প্রতিটি কর্মচারী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ মোতাবেক কাজ করবেন। শত্রু কবলিত এলাকায় তারা জনপ্রতিনিধিদের এবং অবস্থা বিশেষে নিজেদের বিচার বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করবেন।
(২) সরকারি, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের যে সমস্ত কর্মচারী অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তারা স্ব স্ব পদে বহাল থাকবেন, এবং নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিফৌজ কে সাহায্য করবেন।
(৩) সকল সামরিক, আধা-সামরিক লোক কর্মরত অবসরপ্রাপ্ত অবিলম্বে নিকটতম মুক্তিসেনা শিবিরে যোগ দিবেন। কোন অবস্থাতে শত্রুর হাতে পড়বেন না, শত্রুর সাথে সহযোগিতা করবেন না।
(৪) স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ছাড়া অন্য কারো বাংলাদেশ থেকে খাজনা-ট্যাক্স, শুল্ক আদায়ের অধিকার নেই। মনে রাখবেন আপনার কাছ থেকে শত্রুপক্ষের এভাবে সংগৃহীত প্রতিটি পয়সা আপনাকে ও আপনার সন্তানদের হত্যা করার কাজে ব্যবহৃত করা হবে। তাই যে কেউ শত্রুপক্ষকে খাজনা-ট্যাক্স দেবে অথবা এ ব্যাপারে তাদেরকে সাহায্য করবে, বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিফৌজ তাদেরকে জাতীয় দুশমন বলে চিহ্নিত করবে এবং তাদের দেশদ্রোহের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
(৫) যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ করে নৌচলাচল সংস্থার কর্মচারীরাও কোন অবস্থাতেই শত্রুর সাথে সহযোগিতা করবেন না। সুযোগ পাওয়া মাত্রই তারা যানবাহনাদি নিয়ে শত্রু কবলিত এলাকার বাইরে চলে যাবেন।
(৬) নিজ নিজ এলাকার খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। আর এ চাহিদা মেটানোর জন্য খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে। মনে রাখবেন বর্তমান অবস্থায় বিদেশি খাদ্যদ্রব্য ও জিনিসপত্রের উপর নির্ভর করলে তা আমাদের জন্য আত্মহত্যার শামিল হবে। নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে এবং দেশজ দ্রব্যাদির উপর নির্ভর করতে হবে। স্থানীয় কুটির শিল্প বিশেষ করে তাঁত শিল্পের উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।
(৭) কালোবাজারি, মুনাফাকারী, মওজুদদারী, চুরি-ডাকাতি বন্ধ করতে হবে। এদের প্রতি কঠোর নজর রাখতে হবে। জাতীয় এই সংকট সময়ে এরা আমাদের এক নম্বর দুশমন। প্রয়োজনবোধে এদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
(৮) আরেক শ্রেণীর সমাজ বিরোধী ও দুষ্কৃতিকারী সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। এদের কার্যকলাপ দেশদ্রোহী মূলক। এদেরকে চিনে রাখতে হবে। কেননা এরাই হলো আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। এরা ধর্মের দোহাই দিয়ে অখণ্ডতার বুলি নিয়ে সরলপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এদের আসল পরিচয় এরা পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতি ও শোষণদের স্থানীয় দালাল। ধর্মের লেবাস পড়ে পীর, মুর্শিদ, আলেম, মৌলবী হিসেবে জনগণের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে। একবার এদের খপ্পরে পড়লে আর নিস্তার নেই। এ ধরনের লোক সম্পর্কে সাবধান থাকতে হবে। তাদেরকে দেশদ্রোহিতা ও বেঈমানির পথ ছেড়ে দেবার জন্য বলতে হবে। তাতেও যদি তাদের শুভবুদ্ধির উদয় না হয় তবে তাদের বিষদাঁত ভেঙে দিতে হবে, অথবা তাদেরকে ধরে এনে মুক্তিফৌজের হাতে অর্পণ করতে হবে। কর্তৃপক্ষ দেশদ্রোহের অভিযোগে এদের বিচার করবেন এবং এদের শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। বলাবাহুল্য দুনিয়ার সর্বত্র দেশদ্রোহের একমাত্র শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড।
(৯) গ্রামে গ্রামে রক্ষী বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। মুক্তিবাহিনীর নিকটতম শিক্ষাশিবিরে রক্ষীবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবকদের পাঠাতে হবে। গ্রামের শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও এরা প্রয়োজন বোধে মুক্তিবাহিনীর সাথে প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করবে। আমাদের কোন স্বেচ্ছাসেবক বা কর্মী যাতে কোনো অবস্থাতেই শত্রুর হাতে না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
(১০) শত্রুপক্ষের গতিবিধির সমস্ত খবরা খবর অবিলম্বে মুক্তি বাহিনীর কেন্দ্রে জানাতে হবে।
(১১) স্থানীয় বাংলা মুক্তিবাহিনীর যাতায়াত ও যুদ্ধের জন্য চাওয়ামাত্র সমস্ত যানবাহন (সরকারি বা বেসরকারি) মুক্তিবাহিনীর হাতে ন্যস্ত করতে হবে।
(১২) বাংলা মুক্তিবাহিনীর অথবা বাংলাদেশ সরকার ছাড়া অন্য কারো কাছে পেট্রোল, ডিজেল, মবিল, ইত্যাদি বিক্রি করা চলবে না।
(১৩) কোন ব্যক্তি পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অথবা তাদের এজেন্টদের কোন প্রকারের সুযোগ-সুবিধা, সংবাদ সরবরাহ অথবা পথ-নির্দেশ করবেন না। যে করবে তাকে আমাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে এবং প্রয়োজনবোধে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
(১৪) কোন প্রকার মিথ্যা গুজবে কান দেবেন না বা চূড়ান্ত সাফল্য সম্পর্কে নিরাশ হবেন না। মনে রাখবেন যুদ্ধে অগ্ৰাভিযান ও পশ্চাদপসরণ দুইটাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কোন স্থান থেকে মুক্তিবাহিনী সরে গেছে দেখলেই মনে করবেন না যে আমরা সংগ্রামে বিরতি দিয়েছি।
(১৫) বাংলাদেশের সকল সুস্থ ও সবল ব্যক্তিকে নিজ নিজ আগ্নেয়াস্ত্রসহ নিকটে সমাবেশে শিবিরের রিপোর্ট করতে হবে এ নির্দেশনার মুজাহিদ ও প্রাক্তন সৈনিক দের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
(১৬) শত্রুবাহিনীর ধরা পড়া সমস্ত সৈন্যকে মুক্তিবাহিনীর কাছে সোপর্দ করতে হবে। কেননা জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের কাছ থেকে অনেক মূল্যবান তথ্য সংগৃহীত হতে পারে।
(১৭) বর্বর ও খুনি পশ্চিমা সেনাবাহিনীর সকল প্রকার যোগাযোগ ও সরবরাহ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিথ না হতে পারে তার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
(১৮) তথাকথিত পাকিস্তান বেতারের মিথ্যা প্রচারের আদৌ বিশ্বাস করবেন না। এদের প্রচার-অভিযানের একমাত্র উদ্দেশ্যই হলো আমাদের সাফল্য সম্পর্কে বাঙালির মনে সংশয়, সন্দেহ, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা এবং হতাশা আনয়ন করা।
উপসংহারে বাংলার মানুষের প্রতি আমার আবেদন, আপনারা নিজের উপর বিশ্বাস হারাবেন না। আমাদের চূড়ান্ত বিজয় সম্পর্কে মনে এতোটুকু সন্দেহ পোষণ করবেন না। কেননা, আমাদের এ সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম, এ সংগ্রাম সত্যের সংগ্রাম,এ সংগ্রাম আজাদীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রাম। এটা আমার কথা নয়। একথা বলেছেন আপনার আমার তথা সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভুলে যান আজ আপনার ধর্ম, বর্ণ, পেশা কি? আমরা সবাই বাঙ্গালী। আমি আগেই বলেছি শত্রু আজ আপনার আমার ধর্ম বিচার করছে না। শুধু বাঙালি হওয়ার অপরাধে আজ আপনাকে আমাকে মারছে, আপনার-আমার বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। শত্রু মসজিদে, মন্দিরে, গীর্জায় আশ্রয়গ্রহণকারী ও প্রার্থনারত নিরীহ মানুষকে হত্যা করতেও ছাড়ছেনা। তাই আজ আপনার আমার একমাত্র কর্তব্য, নিজেদের যথাসর্বস্ব এমনকি প্রাণ দিয়েও বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনীর সাথে সহযোগিতা করা আর শত্রুকে ঘায়েল করা। আমাদের ঐক্য বজায় থাকলে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কেন দুনিয়ার কোন শক্তি আমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে পারবে না।
‘জয় বাংলা’।
বিশ্ব জনমতঃ এ কৃত্রিম রাষ্ট্রের অবাস্তবতা উপলব্ধির জন্য আর কত রক্তের প্রয়োজন হবে
বৃটেনের বিখ্যাত বামপন্থী পত্রিকা নিউ ষ্টেটসম্যান-এ বলা হয়েছেঃ
যদি রক্ত একটি জাতির স্বাধীনতার মূল্য হয় তবে বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই তা দিয়েছে বরং বেশি পরিমাণে দিয়েছে। বাংলাদেশের আজ যা চলেছে তা হচ্ছে নির্বিচার গণহত্যা যার নজির আধুনিক ইতিহাসে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ আজ যা ঘটছে তার মূলে আছে পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস, তার কৃত্রিম ভৌগলিকতা। আর কত রক্তের প্রয়োজন হবে এই কৃত্রিম রাষ্ট্রটির অবাস্তবতা উপলব্ধির জন্য।
* * *
ব্রিটিশ পত্রিকা সানডে টাইমস-এ লেখা হয়েছেঃ পাকিস্তানের জঙ্গিশাহীর অত্যাচার ও নরহত্যা হিটলারের বর্বরতাকে ম্লান করে দিয়েছে।
* * *
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে শ্রমিক দলীয় সদস্য মিঃ ব্রুস ডগলাসম্যান সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেন। তিনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোন অঞ্চলে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সাথেও সাক্ষাৎ করেন। তিনি কলকাতায় এক বিবৃতিতে বলেছেনঃ পাকিস্তানি বাহিনী যত শক্তিশালী ও যত আধুনিক মারণাস্ত্রেই সজ্জিত হোক না কেন , তাদের পরাজয় অবধারিত। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ দখল করে রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। কারণ বাংলাদেশের সমস্ত জনসাধারণ তাদের বিরোধী। বাংলাদেশের যুবকেরা দলে দলে যোগ দিচ্ছে মুক্তিফৌজে।
মিস্টার ডগলাসম্যান বলেনঃ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকামী সকল দেশের মানুষের সহযোগিতা করা উচিত। তিনি আরো বলেন ভারতের সাহায্যপুষ্ট হয়ে মুক্তিফৌজ লড়াই করছে একথা সত্যি নয়। তারা স্বল্প অস্ত্র নিয়ে দেশপ্রেম সম্বল করে বীরবিক্রমে লড়াই করছে। তিনি নিজে অনেক মুক্তিফৌজের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন।
* * *
নিউজিল্যান্ড পার্লামেন্টের একজন সদস্য ও সম্প্রতি বাংলাদেশের সীমান্ত পরিদর্শন করার পর নিম্নোক্ত বিবৃতি দিয়েছেনঃ
পাক সেনা বাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাদের হাতে নারী এবং শিশু ও রেহাই পায়নি। এ এক ভয়াবহ বর্বরতা।
তিনি বলেছেন, তিনি দেশে যেয়ে তার দেশের পার্লামেন্টে তার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করবেন এবং এই বর্বরতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলবেন।
* * *
আমেরিকার প্রভাবশালী সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস এ মন্তব্য করা হয়েছেঃ যুক্তরাষ্ট্র সরকার যেভাবে অন্ধের মত পাকিস্তানের জঙ্গি সরকারকে সমর্থন করে চলেছে, তার ফলে পাক-ভারত উপমহাদেশে মার্কিন স্বার্থ বিপন্ন হতে পারে। উক্ত সংবাদপত্রটি এক সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলেছেন- পাকিস্তানে জঙ্গি সরকার গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচিত পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবর্গ বাংলার লক্ষ লক্ষ অধিবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করবার যে নীতি চালিয়ে যাচ্ছে, তাকে পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার বলে নিষ্ক্রিয় থেকে আমেরিকা বিপজ্জনকভাবে অদূরদর্শিতার ভিত্তি। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এই গুরুদায়িত্ব পড়েছে এই গণহত্যা বন্ধ করবার ও এই অঞ্চলের উত্তেজনা প্রশমন করবার ।
* * *
বিখ্যাত ফরাসি পত্রিকা দ্য লা ম’দ-এ এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের সংগ্রাম ক্রমশ সুসংহত হচ্ছে। বাঙ্গালীদের উপর যে অমানুষিক অত্যাচার চালানো হয়েছে, তারপর আর একথা বিশ্বাস করা যায় না যে, তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে কোন প্রকার সংশ্রব রাখতে চাইবে। বরং তারা ক্রমশঃ মরণপণ সংগ্রামে রত হবে এইটাই স্বাভাবিক। বাঙালিরা ক্রমশঃ আরো বেশি সংখ্যায় সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বে। প্রবন্ধটিতে আরো বলা হয়েছে যে বাঙ্গালী, যুদ্ধে খুবই নৈপূণ্য দেখিয়ে। তাদের সংগ্রামী মনোবল খুবই উচ্চ মানের। আওয়ামী লীগ নেতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু কোন প্রকার প্রস্তুতি ছাড়া যুদ্ধে বাঙালিরা অসাধারণ সাহস ও উন্নত রণকৌশল দেখাতে সক্ষম হয়েছেন।
* * *
ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ান এ মন্তব্য করা হয়েছে জনগণের ভোটের রায় কে অস্বীকার করার ফলেই পাকিস্তানের বর্তমান যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে। সেনাবাহিনী শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার জন্য বাংলাদেশকে চরম পন্থা বেছে নিতে হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধ চায়নি। যুদ্ধ তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
হুশিয়ার!
ইয়াহিয়া -টিক্কা হুশিয়ার
সারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ মুক্তিসংগ্রামের জয় পতাকা হাতে নিয়ে যুদ্ধ করছেন পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত -উত্তরে সিলেট সীমান্ত থেকে শুরু করে দক্ষিণের টেকনাফ পর্যন্ত বাংলায় সাধারণ মানুষ- কৃষক- শ্রমিক ছাত্র-জনতা মরণপণ করে রুখে দাঁড়িয়েছেন নরখাদক দস্যু সৈন্যদের মোকাবিলা করতে। আজকের এই যুদ্ধ বাঙালির মুক্তির যুদ্ধ। এ যুদ্ধ বাংলার গণযুদ্ধ। পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও ভাড়াটে লম্পট বাহিনী গণমানুষের জীবন-সংগ্রামের ঢেউকে প্রতিহত করতে পারেনি। বাংলার মাটিতেও পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদাররা মুক্তিফৌজের সম্মিলিত প্রচেষ্টার সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ই। এই কথা সুনিশ্চিতভাবে জেনে আমাদের গণযোদ্ধা আজ বাংলার গ্রামে গ্রামে ও শহরে বন্দরে মরণপণ করে নেমেছেন স্বাধীনতার যুদ্ধে।
বাংলার মানুষের কাছে জল্লাদ ইয়াহিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা ক্ষমার অপেক্ষা রাখে না। ঢাকায় মিথ্যা স্তোকবাক্যের বৈঠক বসে সবার অগোচরে বাঙালির বুকে ছুরি বসাবার ষড়যন্ত্র ইয়াহিয়া অনেক আগে থেকেই নিয়েছিল। সেই জন্যেই সে ‘বুচার বেলুচিস্তান’ টিক্কা খানকে বাংলাদেশ পাঠিয়েছিল নৃশংস আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেবার জন্য।
২৫শে মার্চ তারিখে প্রকাশ্য বৈঠক চলার থাকতে থাকতেই দস্যু ইয়াহিয়া তার ভিন্ন অনুচর টীক্কা খাঁকে আক্রমণ শুরু করার আদেশ দিয়ে কাউকে না জানিয়ে ঢাকা ত্যাগ করে চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। রাতের অন্ধকারে টিক্কা তার মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঢাকায় নিরস্ত্র জনতার উপর। প্রথম ৩৬ ঘণ্টার মধ্যেই একমাত্র ঢাকা ও শহরতলীর টিক্কার দস্যুরা ৫০ হাজার নারী-পুরুষ শিশুকে হত্যা করে নিশংস ভাবে। দুনিয়ার ইতিহাসে খুঁজে দেখুন এমন বিশ্বাসঘাতকতার নজির আর কোথাও নেই। থার্ড রাইখ এর নাৎসী নরপশুদের হত্যালীলাকেও বাংলার উপর এই দুর্বিনীত অত্যাচারের কাহিনী ম্লান করে দিয়েছে।
ইয়াহিয়া টিক্কা ভূট্টো প্রভৃতি জল্লাদজোট ঠিক করেছিল তারা বাঙালি জাতীয় অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দেবে। দেশের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সংগ্রামী কৃষক, শ্রমিক, জনতা কে মেরে ফেলে সারা বাংলাদেশকে মৃত্যু, দুর্ভিক্ষ আর মহামারীর ছায়ায় ঢেকে দেবে। আর সেই গোরস্থানের উপর রাজত্ব করবে পশ্চিম পাকিস্তানের দুর্বৃত্ত সরকার।
কিন্তু স্বাধীনতার ঐতিহ্যবাহী বাংলার জাগ্রত জনতা ইয়াহিয়া ও তার কুত্তাদের এই জঘন্য ষড়যন্ত্রকে সম্পূর্ণ বানচাল করে দিয়েছে। ঈশা খাঁ-তীতুমীর- সূর্যসেনের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি আজ গণসংগ্রামের মুখে এগিয়ে গেছেন দেশকে দুর্বৃত্তদের থেকে মুক্ত করার জন্য।
ঢাকায় সংগ্রামী শ্রমিক এর মুখে শুনেছিলাম এক বজ্র শপথের কথা।
“টিক্কার ফাসি হবে।”
সাধারণ শ্রমিক এর মুখে সারা বাংলাদেশের যুদ্ধরত মানুষের রক্ত শপথ যেন প্রতিধ্বনিত হলো। আজ যারা বাংলাদেশের উপর অত্যাচার, লুণ্ঠন আর হত্যার ধ্বংসলীলা চাপিয়ে দিয়েছে সেইসব হত্যাকারীদের -ইয়াহিয়া জোটের নরপশুদের -হাজির করা হবে বাংলাদেশের গণআদালতে তাদের যুদ্ধাপরাধের জন্য শাস্তি গ্রহণ করতে।
বাংলার মাটিতে সোনা ফলে। কিন্তু আজ সেই মাটি বাঙালির রক্তে সিক্ত। এই মাটি-সেই শ্যামল ধানের ক্ষেত, পলির প্রান্তর থেকেই জন্ম নিয়েছে লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধারা। মেঘনা, যমুনা, পদ্মার, কৃষক, মাঝি, কামার, কুমোর, জোলা, ক্ষেতমজুর হাতে তুলে নিয়েছে মারণাস্ত্র। এদের বুকে জ্বলে উঠেছে স্বাধীনতার অনির্বাণ আগুন। আমার সখিনা মা, আমিনা বোনের ইজ্জত যারা কেড়েছে তাদের ক্ষমা নেই। আর ক্ষমা নেই আমার ভাইয়ের ঘরে যে দস্যু আগুন দিয়েছে, যে তার ক্ষেত পুড়িয়েছে, তার শিশুকে হত্যা করেছে, তার।
সারা বাংলাদেশে আজ শুধু এক আওয়াজ। ক্ষেত -প্রান্তর- হাট,মাঠ ছাপিয়ে আজ মহা বজ্রধ্বনির মত বীর জনতার কন্ঠে একই আওয়াজ” হুশিয়ার! হুশিয়ার! ইয়াহিয়া টিক্কা হুশিয়ার! বাংলাদেশের স্বাধীনতা তোমরা রুখতে পারবে না। জয় স্বাধীন বাংলা।
বিশ্বের মানচিত্র থেকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্ব মুছে ফেলা শক্তি কারো নেই
-সৈয়দ নজরুল ইসলাম
১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা হারিয়েছিল আর ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল সেই প্রাচীন আরেক আম্রকাননে জন্ম নিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার একটি গ্রামের নতুন নামকরণ হয় মুজিবনগর। এই মুজিবনগরই হলো বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী।
সেদিন বেলা ১১টা ১০ মিনিটঃ মঞ্চের পশ্চিম দিক থেকে এলেন নেতারা। সমবেত জনতা জয়ধ্বনী দিলেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথম সশস্ত্র বাহিনীর অভিবাদন এবং পরে নেতারা মঞ্চে এসে চেয়ারে বসলেন। প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি। তারপর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন। তারপর মন্ত্রী খন্দকার মুশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, জনাব কামরুজ্জামান এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী স্বেচ্ছাসেবকরা পুষ্পবৃষ্টি করে তাদের অভিবাদন জানালেন।
সাড়ে সাত কোটি বাঙালির যে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ জন্ম নিল তার নাম হলো স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। তখন সারা আকাশে ছিল থোকা থোকা মেঘ । চারটি ছেলে প্রাণ ঢেলে “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি” গানটা গাইলো। এর আগে পবিত্র কোরআন শরীফ থেকে তেলাওয়াত করা হলো।
তারপর উঠে দাঁড়ালেন স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। পায়জামা পাঞ্জাবী পড়নে। শুরুতেই তিনি বললেনঃ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেছে এবং তার পরামর্শক্রমে আরও তিনজনকে মন্ত্রীরূপে নিয়োগ করেছে। একে একে তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী এবং তার তিন সহকর্মীর সঙ্গে। তারপর ঘোষণা করলেন প্রধান সেনাপতি পদে কর্নেল ওসমানী নিয়োগ। আর বললেন সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ পদে নিয়োগ করা হয়েছে কর্নেল আব্দুর রবকে।
তিনি সাড়ে সাত কোটি বাঙালি মন মানসের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর এর কথা বারবার বললেন। তার প্রতিভা, ব্যক্তিত্ব, আত্ম ও স্বার্থ ত্যাগ এবং বিরাট রাজনৈতিক জীবনের বর্ণনা দিলেন। তিনি বলেন, আজ একটি নতুন জাতির জন্ম নিল। বিগত বছর যাবত বাংলার মানুষ, তার নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব নেতাদের নিয়ে এগোতে চেয়েছেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থ কখনোই তা হতে দিলো না। ওরা আমাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগোতে চেয়েছিলাম, ওরা দিল না। ওরা আমাদের উপর বর্বর আক্রমন চালালো। তাই আজ আমরা লড়াইয়ে নেমেছি। এ লড়াইয়ে আমাদের জয় অনিবার্য। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার কে বিতারিত করবোই। আজ না জিতি কাল জিতবো। কাল না জিতি পরশু জিতবোই।
তিনি বলেন, আমরা বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাই। পরস্পরের ভাই হিসেবে বসবাস করতে চাই। মানবতার, গণতন্ত্রের এবং স্বাধীনতার জয় চাই।
আপনারা জানেন, পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ এবং শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গত ২৩ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু সবকিছু পরিত্যাগ করে আন্দোলন করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার। আমি জোর দিয়ে বলছি তিনি আমাদের মধ্যে আছেন। যাদের সংকটের সময় আমরা তার নেতৃত্ব পেয়েছি। তাই বলছি পৃথিবীর মানচিত্র আজ নতুন রাষ্ট্রের জন্মলগ্নের সূচনা হলো তা চিরদিন থাকবে পৃথিবীর কোন শক্তি তা মুছে দিতে পারবে না।
আপনারা জেনে রাখুন গত ২৩ বছর ধরে বাংলার সংগ্রামকে পদে পদে আঘাত করেছে পশ্চিমের স্বার্থবাদী শিল্পপতি, পুঁজিবাদী ও সামরিক কুচক্রীরা।
আমরা চেয়েছিলাম শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের অধিকার আদায় করতে। লজ্জার কথা, দুঃখের কথা ঐ পশ্চিমারা শেরেবাংলা কে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কে কারাগারে পাঠিয়ে ছিল তাই ওদের সঙ্গে আপোষ নেই। নেই ক্ষমা।
আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণ নন্দিত ক্ষণজন্মা পুরুষ নির্যাতিত মানুষের মূর্তপ্রতীক শেখ মুজিবুর বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের (অসমাপ্ত)
মীরজাফরদের খতম কর
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তি ফৌজের কেন্দ্রে কেন্দ্রে খবর আসছে মে, বিভিন্ন স্থানে একশ্রেণীর মির্জাফর বাংলাদেশ ও বাঙালির স্বার্থের বিরোধিতা করছে। তারা ইয়াহিয়া খানের লেলিয়ে দেওয়া পাঞ্জাবি কুকুরগুলোকে মুক্তিফৌজের অবস্থান জানিয়ে দিচ্ছে, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মীদের নাম ঠিকানা বলে দিচ্ছে, অথবা ক্ষেত্রবিশেষে পশ্চিমা সমাজের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে। তারা নানারকম মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে শত্রুকবলিত এলাকার মানুষের মনোবল ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করছে। গুন্ডা, দুষ্কৃতিকারী লেলিয়ে দিয়ে লুটতরাজ করাচ্ছে অথবা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়িয়ে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির প্রয়াস পাচ্ছে। এদে কোন কোন নেতা বেতার বক্তৃতা, সংবাদপত্রে বিবৃতি ও তথাকথিত জনসভা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধাচরণ করছে।
এসব মীরজাফরকে মুক্তিবাহিনীর শেষবারের মতো হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে। এরা যদি এই মুহূর্ত থেকে নিজেদেরকে অপকর্ম বন্ধ না করে তাহলে মুক্তিফৌজ তাদেরকে কুকুরের মত হত্যা করবে। বাংলাদেশ মুক্তিফৌজ কর্মীদের প্রতি আমাদের নির্দেশ এদের খতম করো।
এম, এল এ- এম,পি এদের প্রতি –
আওয়ামী লীগ দলীয় এম এল এ ও এম পি এদের প্রতি দলের হাইকমান্ডের নির্দেশ, তারা যেন নিজ নিজ এলাকায় থেকে মুক্তি সংগ্রাম কে এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেন। নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় অবস্থান করা একেবারেই অসম্ভব বিবেচিত হলে তারা নিকটবর্তী মুক্তিসেনা শিবিরে চলে যাবেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ও থাকা-খাওয়ার কাজ তদারক করবেন। প্রাণের ভয়ে বা অন্যবিধ কারণে যারা বাংলাদেশের সীমান্তের বাইরে চলে গেছেন তারা অবিলম্বে এ নির্দেশ মোতাবেক কাজ করবেন।
শরণার্থীদের উদ্দেশে-
বাংলাদেশ থেকে যে সমস্ত কিশোর যুবক এবং মধ্যবয়সী লোক সপরিবারে একাকী সীমান্তের ওপারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের প্রতি আমাদের অনুরোধ আপনারা অবিলম্বে বিভিন্ন বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করুন এবং সামরিক ট্রেনিংয়ের জন্য নাম তালিকাভুক্ত করুন।
বাংলাদেশ থেকে যারা প্রাণের বাঁচার জন্য সীমান্তের ওপারে আশ্রয় শিবিরে আছেন তাদের সবসময় স্মরণ রাখতে হবে যে এটা স্থায়ী ব্যবস্থা মাত্র। স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য তারা ভারতে যাননি। তাদের চেষ্টা হবে সামরিক ট্রেনিং গ্রহণ করে মুক্তিফৌজের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া এবং নিজেদের মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়া। ভারতে যারা শরণার্থীদের সাহায্য করছেন তাদের উপর বোঝা হয়ে বসবার চেষ্টা করলে তা নানা কারনে আমাদের জন্য আত্মহত্যার শামিল হবে। তাই রিলিফের খাদ্য গ্রহণ করেই নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকা কোনক্রমেই উচিত হবে না। শরণার্থীদের ভিড়ের মধ্যে পঞ্চম বাহিনীর অনেক লোকও ঢুকে পড়ছে। নিজ নিজ এলাকার মানচিত্র সংগ্রহ করে নিজ হাতে এঁকে তা মুক্তিফৌজকে দিতে হবে এবং শত্রু বাহিনীর অবস্থান, সেখানে গমনের নির্ভুল রাস্তাঘাট ও নির্ভুল পরিচয় দিয়ে সাহায্য করতে হবে।
প্রসঙ্গতঃ বলা দরকার যে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিফৌজের ট্রেনিং শিবির চালু হয়েছে এবং সেগুলোতে হাজার হাজার তরুণ ট্রেনিং নিচ্ছে।
একটি যুদ্ধঃ বহু ইতিহাস
কুষ্টিয়ার পতন ঘটেছে বাঙালি জওয়ানদের হাতে। সেখানে যে দুই কোম্পানি পশ্চিমা সৈন্য ছিল তাদের অনেকেই প্রাণ দিয়েছে বুলেটের আঘাতে। অন্যরা রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছে যশোর ক্যান্টনমেন্ট এর দিকে। কিন্তু পথিমধ্যে পথে-প্রান্তরে তাদেরকে প্রাণ দিতে হয়েছে শিয়াল, কুকুরের মত মুজাহিদ, আনসার ও স্বেচ্ছাসেবীদের হাতে। অনেক জায়গায় জনগণ দা, কুড়াল, লাঠি দিয়ে খতম করেছে তাদের জাত শত্রুদের।
কুষ্টিয়ার পতনের সংবাদ পাগল করে তুলল টিক্কা খানকে। মাঝে মাঝে ওয়ারলেসের নির্দেশ গেল যশোর ক্যান্টনমেন্টে ব্রিগেডিয়ার দূররানির কাছে অবিলম্বে কুষ্টিয়া পুনর্দখলের জন্য। ডেকে পাঠালেন কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল তোফায়েলকে। হুকুম করলেন, এক্ষুনি রওয়ানা হয়ে যাও কুষ্টিয়ার দিকে। কর্নেল তোফায়েল প্রথমে ইতস্তত করছিলেন। কেননা দীর্ঘ প্রায় এক মাসের অনাহারে-অর্ধাহারে অনিদ্রায় যশোর ক্যান্টনমেন্ট এর সৈন্যদের মনোবল একেবারে ভেঙে পড়েছিল। তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানে ভারতীয় সৈন্যরা ততদিনে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য্য বীর্যের প্রমাণ তো কিছুটা উপলব্ধি করতে পেরেছিল। কিন্তু কর্নেল তোফায়েলের কোন যুক্তি ধোপে টিকল না। তাকে অবনত মস্তকে মেনে নিতে হলো ব্রিগেডিয়ার এর হুকুম -এক্ষুনি রওয়ানা হয়।
সেদিন ছিল পয়লা এপ্রিল। সাজ সাজ রব পড়ে গেল সারা ক্যান্টনমেন্টে। ট্যাংক, সাঁজোয়া গাড়ি ও ট্রাকসমেত চার গাড়িতে কামান, মেশিনগান, রকেট, লঞ্চার, লাইট মেশিনগান, ব্রেন গান প্রভৃতি আধুনিক মারণাস্ত্র সজ্জিত দেড় সহস্রাধিক পশ্চিমা সৈন্য রওয়ানা হল কুষ্টিয়ার পথে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে তারা অনবরত পথের দু’ধারে সামনে গুলি চালিয়ে এগোতে থাকলো। এভাবে তারা পার হয়ে গেল মেহেরুল্লাহ নগর, বারোবাজার, পিরোজপুর, কালিগঞ্জ। কোন কোন বাধা পেল না। তবে আসার পথে তারা যে কামান দাগিয়েছে, রকের ছুড়েছে, মর্টারের গোলা বর্ষণ করেছে তাতে নিহত হয়েছে শত শত নিরস্ত্র নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা। জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কৃষক, মজুর, কামার, কুমরের শত শত বাড়ি। বারোবাজারের মসজিদ খানাও রেহাই পায়নি এই বর্বর পশ্চিমা নব্য উপনিবেশবাদী সৈন্যদের হাত থেকে।
ইত্যবসরে বিভিন্ন পথে বাঙালি তরুণরা ঝিনাইদহ কন্ট্রোলরুমে শত্রু বাহিনীর অগ্ৰাভিযানের খবর পৌঁছিয়ে দেয়। সেখানে তখন খুব বেশি মুক্তিফৌজ ছিলনা‌। ছিল মাত্র জন পঞ্চাশেক। তাদের মধ্যে জন পঁচিশেঅকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পথিমধ্যে শত্রুবাহিনীর গতিরোধ করতে। সাথে গেল কিছু সংখ্যক মুজাহিদ ও আনসার। অবশ্য (অস্পষ্ট) থেকেই বিশেখালিতে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে রাস্তা পাহারা দিচ্ছিল কিছুসংখ্যক আনসার মুজাহিদ।
দুখানা খোলা ট্রাকে রওনা দেয় ঝিনাইদহ থেকে ২৫ জন ইপিআর আনসার মুজাহিদদের সাথে নিয়ে। বিশেখালী গিয়েই তারা দেখতে পেলো আনসার মুজাহিদরা পুলের দুধার থেকে পজিশন নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে। তবে তাদের অস্ত্র বলতে একমাত্র রাইফেল। তারা আরো শুনতে পেল শত্রুবাহিনী আর মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যেই এসে পড়বে। সুতরাং ইচ্ছা থাকলেও কালীগঞ্জের কাছে গিয়ে শত্রু কে বাধা দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হলো না। সুতরাং মুহূর্তমাত্র কালক্ষেপণ না করে ইপিআর দল পজিশন নিয়ে নেয়। আর অসীম সাহসের সাথে অপেক্ষা করতে থাকে শত্রুর মোকাবেলার জন্য।
ইত্যবসরে বিশেখালী থেকে মাইল দুয়েক দুরে একটি ঘটনা ঘটে গেল। আইয়ুব আমলের কালিগঞ্জ এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন নূর আলী মিয়া। আইয়ুবের দালালি আর বাঙালি ও বাংলার স্বার্থের বিরুদ্ধে মীরজাফর এর বিনিময়ে তিনি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছিলেন। গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অধ্যাপক ইকবালের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে অবশ্য তিনি জামানত হারিয়েছিলেন। নুর আলী মিয়া সেদিন কালীগঞ্জ থেকে জিপে চড়ে মাছ মারতে গিয়েছিলেন বিশেখালীর নিকটে একটা দিঘিতে। এই দীঘিটাও তিনি আইয়ুব সরকারের কাছ থেকে এনাম হিসেবে পেয়েছিলেন। তিনি তখন মাছ মেরে ফিরছিলেন বাড়ির দিকে। যাবার সময় দেখে গেলেন ইপিআর সহ মুক্তিফৌজের অবস্থান ও প্রস্তুতি। কিছুদূর গিয়ে তার চোখে পরলো পাঞ্জাবি সৈন্যের বিরাট কলাম। তথাকথিত ইসলাম ও সংহতির মোহগ্রস্থ ও বাঙালির দুশমন নুর আলীর বুক কেঁপে উঠল। তিনি রাস্তার ধারে জীপ থামালেন। তার এক হাতে ছিল একটা দোনলা বন্দুক। অপর হাতখানা উপরে তুলে সৈন্যদলকে থেমে তার কথা শোনার সংকেত দিলেন। উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে মুক্তিফৌজের অবস্থান সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া। কিন্তু বেঈমান মীরজাফরদের ভাগ্যে চিরকাল যা ঘটে নুর আলীর ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। তার উত্তোলিত হাতখানা দেখামাত্র পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের একজন তাঁর হাতখানা লক্ষ্য করে লাইট মেশিনগানের গুলি ছুড়লো। মুহূর্তের মধ্যে গুলি তাঁর হাতখানা চুরমার করে বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেল। জাতির দুশমন নুর আলী পেল তার উপযুক্ত পুরস্কার। নুর আলীর জন্যদিন কালীগঞ্জে কোন বাঙালি সন্তানকে কাঁদতে দেখিনি বা এতোটুকু দুঃখ করতে দেখিনি। তবে নুর আলী বোধহয় মৃত্যুর মুহূর্তে তার জীবনের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করে গেছেন। তাকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্ব মুহুর্তে অস্ফুট স্বরে বলতে শোনা গেছেঃ ‘তোমাদের জন্য জীবনে এত কিছু করলাম….।’
যাক, দেখতে দেখতে পশ্চিমা সৈন্যের কলামটি দৃষ্টিসীমায় এসে গেল। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও আলমখালির যুদ্ধে নজিরবিহীন সাফল্যে উদ্দীপ্ত মুক্তিফৌজের দেরী সইতে ছিলনা। বুকে অসীম বল ও অন্তরে দেশপ্রেমের প্রদীপ শিখা নিয়ে দেখামাত্র মুক্তিফৌজ তাদের গোপন অবস্থান থেকে বর্ষণ শুরু করল গুলির অনল। তাদের লাইট মেশিনগানদ্বয়, উদগীর করতে থাকলো গোলা বৃষ্টি। অসতর্ক পাঞ্জাবি সারাদেশে হয়ে পড়ল। কামান, মর্টার, মেশিন গানগুলো চালুর আগেই লুটিয়ে পড়ল তাদের বহু সৈন্য। অনেকে হাতের কামান ও মেশিনগানের ট্রিগার টিপল সুযোগটিও পেল না। হতভম্ব, দিশেহারা সৈন্যরা তখন গাড়ি থেকে নিচে নামার চেষ্টা করল। কিন্তু আর যায় কোথায়। চারিদিক থেকে তাদের উপর এসে পড়তে লাগল অগণিত বুলেট। প্রতিটি বুলেট সেদিন কার্যকরী হয়েছিল। প্রতিটি বুলেট সেদিন ভেঙে দিয়েছিল পশ্চিমা পুঁজিপতিদের ভারবাহী পাঞ্জাবি সৈন্যদের পাঁজর। ২০ থেকে ২৫ মিনিট স্থায়ী এই যুদ্ধে নিহত হলেও প্রায় তিনশত শত্রু সৈন্য। ট্যাংক, সাঁজোয়া গাড়ি ও বহু ট্রাক পশ্চাদপসরণ করতে শুরু করল শত্রুবাহিনী। তাদের পশ্চাদপসরণ এর ভাব লক্ষ্য করে মাত্র জনতিনেক মুজাহিদ সাথে নিয়ে গ্রামের দিকে ছুটতে লাগলো একজন ইপি আর। তার হাতে একটা লাইট মেশিনগান। তিনি গ্রামের ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে পাশ কাটিয়ে বিশেখালী থেকে অর্ধ মাইল দূরে গিয়ে একটা ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে ঢুকে পড়লেন। চারিদিক থেকে ঘরটা জঙ্গলে আচ্ছন্ন। তিনি সেখানে মেশিন গানটা বসিয়ে চুপ করে বসে থাকলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শত্রুসৈন্য এসে পড়ল তার দৃষ্টিতে। তিন মিনিট অপেক্ষা করলেন। ততক্ষণে কলামের অর্ধেকটা তাকে অতিক্রম করে গেছে, অর্ধেকটা পেছনে রয়েছে। অকস্মাত্ গর্জে উঠল তার মেশিনগান শ্রাবণের ধারার মতো তিনি বর্ষণ করে চললেন মেশিনগানের গোলা। এবারও শত্রু কিছু বুঝে উঠতে পারল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল তার তিন বাক্স গোলা। তারপর শত্রুর চোখে ধুলো দিয়ে সঙ্গীদের নিয়ে তিনি ছিটকে পড়লেন পেছনে গ্রামের দিকে। পরে গণনায় সেখানে গোটা পঞ্চাশেক মৃতদেহ পড়ে আছে।
এ যুদ্ধে আমাদের পক্ষে নিহত হয়েছেন মাত্র দুইজন ইপিআর। তাছাড়া প্রাণ দিয়েছেন কয়েক জন স্বেচ্ছাসেবী। তাদের মধ্যে ছিলেন স্থানীয় জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব ইকবাল এর পুত্র। সে ছিল কলেজের ছাত্র। তার মৃত্যুতে জনাব ইকবাল এতোটুকু আফসোস নেই। কেননা, মৃত্যুর আগে সে অন্যূন জন পঁচিশেককে নিহত করে গেছে।
জনাব ইকবালের আফসোস হচ্ছে তার অপর পুত্রের জন্য। এ পুত্র মোবারকগঞ্জ সুগার মিলে কাজ করত। বিশেখালিতে বেদম মার খেয়ে ফেরার পথে শত্রু পথিমধ্যে সবকিছু ধ্বংস করে গেছে। মোবারকগঞ্জ সুগার মিল টি ও তাদের বর্বরতা থেকে রেহাই পায়নি। মিলটির উপরে তারা গিয়েছে অসংখ্য কামান ও মেশিনগানের গোলা। তাতে প্রাণ দিয়েছে বহু নিরস্ত্র মানুষ। ইকবাল সাহেবের পুত্র হলো এদের একজন। ইকবাল সাহেবের দুঃখ তার ছেলে একজন দুশমনকেও না মেরে মারা গেল।
এ যুদ্ধ আপনার আমার সকলের
রক্তের অক্ষরে লেখা হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। যেমন লেখা হয়েছে আরো অনেক দেশের। অন্যান্য দেশের মানুষের দেশ প্রেমের কাছে হার মেনেছে বিদেশি হানাদারেরা। আমাদের কাছেও মানবে। ঘাতকের ক্ষমা নেই। শত্রুকে নির্মূল না করে ক্ষান্ত হব না আমরা।
আমরা এ যুদ্ধ চাইনি। কিন্তু যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমাদের উপর জঙ্গিশাহীর সেনাবাহিনী। হাতে তার সর্বাধুনিক মারণাস্ত্র। সমস্ত শক্তি নিয়ে সে আক্রমণ করেছে। কিন্তু লক্ষ্য সিদ্ধ হয়নি। শত্রু আমাদের পরাভূত করতে পারেনি। হিটলারী কায়দায় হঠাৎ আক্রমণ করে আমাদের নিষ্ক্রিয় করে দিতে চেয়েছিল। মৃত্যুর বিভীষিকা দেখিয়ে চেয়েছিল আমাদের স্তব্ধ করে দিতে। কিন্তু তা সে পারেনি। বাংলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত আজ রুখে দাঁড়িয়েছে প্রতিরোধ প্রতিজ্ঞা নিয়ে। জেগে উঠেছে বীর জনতা তার বিপুল উদ্দীপনার নিয়ে।
প্রথমে আমাদের দাবি ছিল স্বায়ত্তশাসনের। কিন্তু ইয়াহিয়া আর তার জঙ্গী চক্রের বিশ্বাসঘাতকতা খুলে দেয় আমাদের দৃষ্টি। জন্ম নিয়েছে আজ গণপ্রজাতন্ত্র স্বাধীন বাংলাদেশ। আর এই সরকার ও জনতার সহযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতি অঞ্চল গড়ে উঠছে মুক্তিফৌজ। তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছে শত্রু নিধনের। আমাদের এই যুদ্ধ একটি জাতির বাঁচা-মরার যুদ্ধ। আসুন আপনিও শরিক হন এই যুদ্ধে। শত্রুকে ধ্বংস করে রক্ষা করুন আপনার দেশের হাজার হাজার মানুষকে। আমাদের শত্রু নির্মম। আর নির্মম হাতেই রচনা করতে হবে তার কবর।
আমাদের রণনীতিঃ
আমরা যে রণনীতি গ্রহণ করেছে তার মূল লক্ষ্য হলো যত কম ক্ষতি স্বীকার করে যত অধিক সংখ্যক শত্রুসৈন্য হত্যা করা যায়। আমাদের লক্ষ্য হল শত্রুসৈন্য আক্রমণের উপর আক্রমণ করে তাকে সদা ব্যস্ত রাখা। তাকে ক্লান্ত করে তোলা। তার মনোবল নষ্ট করে দেওয়া। তারপর একসময় মনোবল হীন ক্লান্ত শত্রুকে আক্রমণ করে সমূলে উৎখাত করা। পাকিস্তান সরকার অস্ত্রপাতি তৈরি করে না। গোলাবারুদের জন্য বিশেষভাবে অন্যদেশ নির্ভর। তার অর্থনীতি গত দেখা দিয়েছে তীব্র সংকট। তাই দীর্ঘ প্রলম্বিত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে গিয়ে তার কৌশল ব্যর্থ হতে বাধ্য।
আমাদের কাছে এই যুদ্ধ হলো গণ যুদ্ধ বা জনগণের যুদ্ধ। আমরা ভাড়াটে পেশাদার সৈনিক নই। অস্ত্র বল আমাদের কম, কিন্তু আমাদের মনে আছে প্রবল দেশ প্রেম। শুধু অস্ত্র দিয়ে যে যুদ্ধ হয় তার থেকে আমাদের যুদ্ধের চেহারা আলাদা। গণসমর্থন আমাদের যুদ্ধের মূল ভিত্তি। সমস্ত বাঙালি আজ জাতীয় চেতনায় উদ্ভুদ্ধ। এ যুদ্ধ মুষ্টিমেয় পেশাদার সৈনিকের বিরুদ্ধে একটা সমগ্র জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধ। এ যুদ্ধের কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল নেই। আমাদের লড়াই কোনো নির্দিষ্ট যুদ্ধক্ষেত্রের লড়াই নয়। যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে সুযোগ পেলেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়বো শত্রুসেনার উপর। আমরা তাদের হত্যা করব। আমরা তাদের সরবরাহ ব্যবস্থা কে বানচাল করব। বিদেশী বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে যে পাকিস্তানি সৈন্য আছে তা একটা যুদ্ধ জয়ের জন্য যথেষ্ট নয়।
রক্তচোষা!
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় যে, মুক্তিফৌজের হামলায় যে হাজার হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আহত হয়েছে তাদেরকে বাঁচানোর জন্য জঙ্গিশাহী এক বীভৎস পন্থা অবলম্বন করেছে। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কিশোর এবং যুবকদের কে ধরে নিয়ে তাদের শরীর থেকে রক্ত বের করে নিচ্ছে এবং রক্ত হীন অসার দেহ রাস্তায় ফেলে দিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। রক্তচোষা আর কাকে বলে!

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!