বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২রা জুলাই, মঙ্গলবার, ১৭ই আষাঢ়, ১৩৮১
পরলোকে জহুর আলম চৌধুরী
স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রসেনানী দেশমাতৃকার সূর্যসন্তান বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও সমাজ কল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী জনাব জহুর আহমেদ চৌধুরী গতকাল সকাল ৬:৪৫ মিনিটে তিনি ৫৮ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। (ইন্নালিল্লাহি… রাজিউন)।
বাংলাদেশের জহুর আহমদ চৌধুরী একটি নাম। একটি ইতিহাস। পাকিস্তানি শাসন আমলের প্রথম পর্যায়ে যে কজন মুষ্টিমেয় কর্মী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে থেকে একান্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দেশমাতৃকার শৃংখল মোচনের জন্য সংগ্রাম করেছেন জনাব জহুর আহমেদ তাদের একজন।
১৯১৬ সালে চাঁদগাও জেলার কাট্টলীতে জন্মগ্রহণ করেন। জনাব চৌধুরী ১৯৪৩ সালে তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগদান করেন। রাজনীতিতে তাঁর আগমন হয় শ্রমিক নেতা হিসেবে। চাটগাও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন এদেশের শ্রমিক আন্দোলনের জনক।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে তিনি সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে সাবেক রাজসিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। সত্তর সালের সাধারণ নির্বাচনেও তিনি জয়লাভ করেন।
১৯৫২ সালে তিনি চাটগাঁও মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় সৈনিক এবং সে সময় তিনি কারাগার বরণ করেন। জনাব চৌধুরী জীবনের বিভিন্ন সময়ে সর্বমোট দীর্ঘ আট বছর কারান্তরালে অতিবাহিত করেছেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের সময় সিলেট জেলে অবস্থানকালে তিনি নিপীড়ন ও নির্যাতনের ফলে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তারই ফলশ্রুতিতে তিনি শ্রমশক্তি হারিয়ে ফেলেন।
জনাব চৌধুরীর উপর সবচেয়ে নিপীড়ন নির্যাতনের স্টিমরোলার নেমে আসে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়। বাংলাদেশ শেখ মুজিবুর রহমানের একজন একনিষ্ঠ পার্শ্বচর হিসেবে তার উপর কঠিন দায়িত্ব বর্তায়। সে দায়িত্ব তিনি হাসিমুখে পালন করেন। চাটগাতে পাকিস্তানি পশু বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংগ্রামের সময় তার নয়নের মনি জ্যেষ্ঠ সন্তান শহীদ হন। অথচ পরবর্তী সময়ে তিনি একথা কাউকে বলেনি। প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে বলতেন যে, দেশের ৩০ লক্ষ সন্তানের সঙ্গে তার সন্তানও দেশকে শৃংখল মুক্ত করার জন্য শহীদ হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিনি পূর্বাঞ্চলের প্রধান বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে। পার্থিব ধন সম্পদের প্রতি তার লোভ কোন দিন ছিল না। তিনি ইচ্ছা করলে প্রচুর ধন সম্পদের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। দেশমাতৃকার একজন আদর্শবাদী দেশপ্রেমিক’ সন্তানের পক্ষে তা করা উচিত নয় বলেই তিনি অন্যায় ও অসঙ্গত পথে পা বাড়াননি।
দেশ স্বাধীন হবার পর পাকিস্তানি নরপশুদের নজিরবিহীন শাসন, শোষণ, অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতনের ফলে বিধ্বস্ত বাংলার সাধারন মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। স্বাস্থ্য দপ্তর, শ্রম ও সমাজ কল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে মৃত্যুর পূর্বে শ্রমনীতি রচনার সবরকম কাজেই তিনি সমাপ্ত করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ মৃত্যু এসে তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার পক্ষে সম্ভব হলো না শ্রমনীতিকে দেশবাসীর সম্মুখে উপস্থিত করে যাওয়া।
মানুষ ও মানবতার কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী পৃথিবীতে এসেছিলেন শূন্য হাতে আবার বিদায়ও নিলেন শূন্য হাতে। কিন্তু পেছনে রেখে গেলেন তার গুনমুগ্ধ বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষকে। যারা তার জন্য এক ফোটা চোখের জল ফেলবে আর তারই কথা ভেবে অনুপ্রাণিত হবে দেশমাতৃকার সেবার জন্য।
জনাব চৌধুরীর মৃত্যুতে তাঁর পরিবারবর্গকে সান্তনা জানাবার ভাষা আমাদের নেই। তবে এটুকুই আমরা বলবো যে, তাঁর আত্মার শান্তি লাভ করুক। তার নামের পরশে ও প্রেরণায় সঞ্জীবিত হোক, উৎসাহিত উদ্দীপ্ত বাংলাদেশের দেশ প্রেমিক নাগরিকরা।
ঢাকা—কাবুল বাণিজ্য চুক্তি
বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের বন্ধুত্ব আরও ঘনিষ্ঠ হল। গত রোববার ৩০ শে জুন এই দুটি দেশ একবছর মেয়াদী একটি সাধারণ বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তি অনুযায়ী দু’দেশের সরকার চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তালিকার নিয়ম বিধি অনুযায়ী পারস্পরিক আমদানী রপ্তানীর সুবিধে দেবে। এই বাণিজ্য চুক্তি কার্যকরী করার জন্য উভয় দেশের সরকার এটি পণ্য বিনিময় চুক্তি ও সম্পাদন করবেন। এবং দুটি দেশের মধ্যে পণ্য বিনিময়ের মূল্য পরিশোধ করা হবে সংশ্লিষ্ট দেশ দুটির নিজ নিজ বৈদেশিক মুদ্রা বিধি অনুযায়ী বিনিময়যোগ্য মুদ্রায়।
বাংলাদেশ-আফগানিস্তান বাণিজ্য চুক্তির ফলে দুটি দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত এবং সম্ভাবনাময় হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী দুটি দেশ পরস্পর বাণিজ্য মেলা, প্রদর্শনী এবং ব্যবসা বাণিজ্য প্রতিনিধি দলের সফরের সুবিধাদি দিতে সম্মত হয়েছে । এক বছর মেয়াদী এই চুক্তি একপক্ষ লিখিতভাবে বাতিল না করলে স্বাভাবিকভাবেই এই চুক্তি আরও এক বছরের জন্য সম্প্রসারিত হবে।
বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন ছাড়াও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সফররত আফগানিস্তানের ডেপুটি পররাষ্ট্রমীর মধ্যে এক দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয়। আলোচনায় তারা দু‘দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় নিয়ে পারস্পরিক মত বিনিময়ও করেন। আলোচনা শেষে উভয়পক্ষই তাদের ভবিষ্যত সুন্দর সম্পর্কের আশ্বাস প্রকাশ করেন।
একথা অনস্বীকার্য যে, সংগ্রামী বাঙ্গালী জাতিকে আফগানবাসী স্বীকৃতির মাধ্যমে তাদের শ্রদ্ধা ও সংগ্রামী অভিবাদন জ্ঞাপন করেছেন। বিশ্ব রাজনীতি দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান দুটি দেশই জোটনিরপেক্ষ। এবং আঞ্চলিক স্থায়ী শান্তি, নিরাপত্তা ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনেও দুটি দেশ সমান আগ্রহী। আর এই সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সহ-অবস্বনে সম্ভব হয় বলেও দু’টি দেশ মনে করে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃত। অভাব অভিযোগ এবং অভ্যন্তরীণ নানা অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও দু’টি দেশ গঠনমূলক কাজে আজ আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করে। সেদিক থেকে ধনীদেশ সহ উন্নয়নশীল দেশ এবং বিশেষ করে নীতিগত স্বার্থে মিল আছে এমন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক আবদ্ধ হওয়া বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান উভয় দেশের জন্যই অপরিহার্য। এই দুটি দেশের বাণিজ্য চুক্তি তাই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনের প্রতিশ্রুতি দেবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
বর্তমান বিশ্বে ভৌগোলিক অবস্থানে প্রতিবেশী নাহলেও নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের মাধ্যমে পড়শীর ভূমিকা পালন করা যায়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বিশ্বমানবতা ন্যায্য মানবাধিকার এবং সংগ্রামী জাতির প্রতি শ্রদ্ধা বোধেও বাংলাদেশ-আফগানিস্তান একসুরী। এতএব লিখিত ঐক্যবোধ ও সৌহার্দপূর্ণ মনোভাবের পটভূমিতে দাড়িয়ে সম্প্রতি যে বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে আমরা তার সুদূর প্রসারী সম্ভাবনা ও কার্যকারিতা দেখবার আশা রাখি। উভয়দেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হোক। সম্প্রসারিত হোক অর্থনৈতিক সহযোগিতার বহুমুখী আশ্বাস।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক