বাংলার বাণী
ঢাকা : ৯ই নভেম্বর, শনিবার, ১৯৭৪, ২২শে কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামে সমর্থন
বাংলাদেশ সব সময়েই আরবদের পাশে থাকবে। আরবদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও এ সমর্থন অব্যাহত ও অটুট থাকবে। গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুয়েজ রণাঙ্গনে মিশরীয় তৃতীয় বাহিনীর সামরিক অফিসারদের এক সমাবেশে ভাষণ দানকালে এ বক্তব্য রাখেন। তিনি আরো বলেন, সত্য ও ন্যায়ের সমর্থন, আমাদের অঙ্গীকার সর্বাত্মক ও দ্ব্যর্থহীন। সত্য ও ন্যায়ের এ সংগ্রামে আরবদের চূড়ান্ত বিজয় সুনিশ্চিত।
কায়রো সফররত সুয়েজ রণাঙ্গন পরিদর্শনকালে যে বক্তব্য রেখেছেন এ বক্তব্য শুধু তারই নয়—এটা সাড়ে সাতকোটি বাঙালীর মনের কথা। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে একটা রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ, অত্যাচার, অবিচার এবং নির্যাতন, নিপীড়নের নিগড় ছিন্ন করে বাঙালী স্বাধীনতা সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছে। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ জানে সাম্রাজ্যবাদ আর ঔপনিবেশকতাবাদ কি অভিশাপ বয়ে আনে একটি জাতির জীবনে। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য আজ সাম্রাজ্যবাদী চক্রের লীলাভূমি। ইসরাইলকে ক্রীড়নক খাড়া করে একদিকে প্যালেস্টাইনী জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ব্যর্থ করে দেবার ষড়যন্ত্র যেমন চালানো হচ্ছে অন্যদিকে তেমনি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে মিশর-সিরিয়া সহ অন্যান্য দেশগুলোকে। ইসরাইল আজ মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া। বিশ্ব জনমত আজ ইসরাইলের বিপক্ষে।
বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ জানে আরবদের ন্যায় সঙ্গত সংগ্রাম একদিন না একটি জয়যুক্ত হবেই—কেননা সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রাম কোনোদিনই ব্যর্থ হতে পারে না। এমন কথা ইতিহাস বলেনা। বাংলাদেশের যখন পরাধীন ছিল তখনো বাংলাদেশের মানুষ আরবদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছে। এখনো জানাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও জানাবে।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় ‘আপনাদের সংগ্রামে সাহায্যের মতো বিপুল সম্পদ আমাদের নেই এ কথা সত্য। কিন্তু আমাদের যা আছে এবং আমরা যেভাবে পারি আপনাদের পাশে দাঁড়াবো।’
আর্জেন্টিনায় অবরোধ, বলিভিয়ায় বিদ্রোহ
আর্জেন্টিনায় অবরোধ, বলিভিয়ায় বিদ্রোহ। এ সপ্তাহের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। দু’টো ঘটনাই একেবারে আকস্মিকভাবে ঘটেছে, এমন মনে করার কারণ নেই। দু’টি ঘটনারই নেপথ্য পটভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে আর্জেন্টিনার গোলযোগের কথা কারো অবিদিত নেই। এ কথা সবাই জানেন, জুয়ান পেরনের মৃত্যুর পর আর্জেন্টিার সামগ্রিক অবস্থা এমনই ভেঙে পড়েছে যে, ইসাবেলা পেরনের শাসনামলে আর্জেন্টিনার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দুরবস্থা চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। শ্রমিক অসন্তোষ, রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা, রাহাজানি, ডাকাতি, হানাহানি, মারামারি ইত্যাদি প্রায় নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়। এই অবস্থায় আর্জেন্টিনার ভবিষ্যত কি হবে, সে চিন্তা মনে উদিত হওয়া কিছুমাত্র বিস্ময়ের বিষয় নয়। দেশব্যাপী গেরিলা আক্রমণ অভিযান প্রতিরোধ এবং দেশকে চরম দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রেসিডেন্ট ম্যারিয়া ইসাবেলা পেরন আর্জেন্টিনায় অনির্দিষ্টকালের জন্য জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছেন। গত আঠারো মাস অবধি যে নাগরিক অধিকার বলবৎ ছিল, এই নতুন আইন ও অবরোধ অবস্থা ঘোষণার ফলে তার অবসান ঘটলো। প্রেসিডেন্ট ইসাবেলা পেরনের লোকান্তরিত স্বামী জুয়ান পেরন শ্রমিক আন্দোলন করতেন এবং তিনি ছিলেন একজন সাচ্চা দেশপ্রেমিক। আর্জেন্টিনার জনগণ পেরনবাদের প্রেরণায় ছিলেন উদ্বুদ্ধ। পেরনের অঙ্গুলী হেলনে সমগ্র আর্জেন্টিনা পরিচালিত হতো এবং আর্জেন্টিনাবাসীরা পেরনকে গভীর শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। সুদীর্ঘ ষোল বছরের নির্বাসন জীবন থেকে ফিরে এসে পেরন যখন পুনরায় আর্জেন্টিনার শাসনভার গ্রহণ করেছিরেন, তখনো কিন্তু জনগণ তাঁকে সাদর-স্বাগতম জানিয়েছিল এবং পেরনের নামে দিয়েছিল জয়ধ্বনি। ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার ক’মাস পরই তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। পেরনের মৃত্যুর পর তাঁর পত্নী ইসাবেলা পেরন প্রেসিডেন্ট পদ অলংকৃত করেন গত জুলাই মাসে। কিন্তু ইতিমধ্যে খোদ পেরনপন্থীদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ গোলযোগ চরম আকার ধারণ করে। রক্তাক্ত সংঘর্ষ এবং হানাহানি দেশব্যাপী এক জটিলাবর্তের সৃষ্টি করে। গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে আর্জেন্টিনায় গেরিলা কায়দায় একের পর এক আক্রমণাত্মক অভিযান পরিচালিত হয়। পাল্টা আক্রমণাত্মক অভিযানও হানাহানির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আর্জেন্টিনার রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন এই রকম টালমাটাল হয়ে উঠে, তখন স্কুলগামী বাচ্চাদের জীবনও আর নিরাপদ থাকেনা। এই আতংকিত অবস্থার অবসানের জন্য জারী করা হয় জরুরী অবস্থা।
ওদিকে বলিভিয়ায় সামরিক ও অসামরিক জনগণ প্রেসিডেন্ট হুগো বাঞ্জারের তিন বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং লাপাজ থেকে ৫৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে সান্তাক্রুজের সিটি হল এবং থানা বিদ্রোহীরা দখল করে নেয়। পক্ষান্তরে লাপাজ বেতারের খবরানুযায়ী জানা যায়, সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের একটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়া হয়। জেনারেল বাঞ্জারের সরকার অবশ্য দাবী করে যে, সান্তাক্রুজে একটি রেঞ্জার রেজিমেন্টের অংশ বিশেষ বিদ্রোহ করেছে।
লাপাজে যৌথ সামরিক কমান্ড এ কথাও স্বীকার করে যে, জেনারেল জুগিও প্রাদো মন্টাবো ও জেনারেল আরমান্দো আলভারেন এবং প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কার্লোস ভিলভার্দে বারবেরী এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বলিভীয় সরকারের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহও খুবই স্বাভাবিক। কারণ অতীত ইতিহাস থেকে আমরা এই শিক্ষাই পেয়েছি যে, সামরিক শাসনকর্তাদের মনোভঙ্গি কখনোই জনগণমুখী হয় না। জেনারেল বাঞ্জারের বেলায়ও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি বলেই আজ বলিভিয়ায় একনায়কত্ব বিলোপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠেছে।
কিন্তু আর্জেন্টিনার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠলো কেন? এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে আর্জেন্টিনার অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করা দরকার। আমরা জানি, দক্ষিণ আমেরিকার এই বিশাল দেশটিতে মূল্যবান সম্পদের অভাব নেই। আর্জেন্টিনা এক সোনার দেশ। ত কেন পুরো দেশটির মানুষ সুখী নয়। কেন ইসাবেলা পেরনের মুখাবয়বে হাসির রেখা নেই। আর্জেন্টিনায় আজ যে ডান ও বামপন্থীদের সংঘর্ষ, তা মূলতঃ পরলোকগত প্রেসিডেন্ট পেরনেরই ব্যর্থতার ফলশ্রুতি। পেরন তার শাসনামলে আর্জেন্টিনাবাসীদের ‘চোখের মণি’ ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি নির্ভরযোগ্য প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেননি। তাঁর ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্বে দেশ এবং দশের কোনো মঙ্গল সাধিত হয়নি। পেরনের এই দুর্বলতার সুযোগেই আর্জেন্টিনা আজ বহ্নিমান হয়ে উঠেছে। মাদাম পেরনের পক্ষে এই রোষাগ্নি নির্বাপিত করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদাম পেরন অবশ্য বলেছিলেন, পেরনের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করাই হবে তাঁর লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যই তিনি জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছেন এবং দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, রাষ্ট্রবিরোধীদের কার্যকলাপ বন্ধের জন্য যেন তারা সরকারকে সাহায্য সহযোগিতা অব্যাহত রাখেন। আমরা আশা করি, আর্জেন্টিনাবাসী গোলযোগ সৃষ্টি না করে সরকারকে সহযোগিতা করে আর্জেন্টিনার দুর্যোগ অবসানের জন্য এগিয়ে আসবেন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক