You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.11.08 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | রিপাবলিকানের ভরাডুবি | বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষুদ্রায়তন প্রকল্প | যে সব স্কুলে ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছিল | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৮ই নভেম্বর, শুক্রবার, ১৯৭৪, ২১শে কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

রিপাবলিকানের ভরাডুবি

মার্কিন সিনেট, প্রতিনিধি পরিষদ এবং রাজ্য গভর্ণর নির্বাচনে রিপাবলিকান দল ডেমোক্র্যাটদের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেছে। নির্বাচনের সর্বশেষ প্রাপ্ত হিসেবে দেখা গেছে, প্রতিনিধি পরিষদে যে কোনো দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য দু’শো আঠারোটি আসন প্রয়োজন পড়লেও ডেমোক্র্যাট দল পেয়েছে দু’শো একানব্বুইটি আসন। পয়ত্রিশটি রাজ্য গভর্ণর পদের নির্বাচনে রিপাবলিকান পেয়েছে মাত্র দশটি। পঁচিশটি পেয়েছে ডেমোক্র্যাট দল। সিনেটের চৌত্রিশটি আসনের মধ্যে সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, ভোট গণনার কাজ চলা অবস্থায় ডেমোক্র্যাট মোট পঁয়ত্রিশটির মধ্যে দশটি আসন লাভ করেছে এবং ফলাফল ডেমোক্র্যাটদের অনুকূলেই যাবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ শরৎকালীন নির্বাচনে রিপাবলিকান দল যে ভরাডুবির সম্মুখীন সে কথা নির্বাচনের আগেই অনেকে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তবে কোন্ কোন্ কারণগুলো রিপাবলিকানের পক্ষে বিপর্যয় ডেকে এনেছে তা খানিকটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকট থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও অব্যাহতি পায়নি। স্বভাবতঃই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বিচলিত মার্কিন জনগণ শাসনদলকেই দায়ী করবে এবং তার প্রভাব বর্তমান নির্বাচনের উপর পড়তে বাধ্য। এক্ষেত্রে হয়েছেও তাই। তবে সবচাইতে বেশী প্রভাব বিস্তার করেছে নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেংকারী এবং ফোর্ড কর্তৃক নিক্সনকে ক্ষমা ঘোষণা।
রিচার্ড নিক্সন অন্যায় করেছিলেন, এ অবিসংবাদিত সত্য মার্কিন জনগণের মনে বদ্ধমূল হয়ে গেছে এ কথাটা কেন জানিনা রিপাবলিকান দল প্রথমাবধি বুঝতে পারেনি এবং পারেনি বলে নিক্সনকে রক্ষা করার জন্য দলের পক্ষ থেকে যত প্রচেষ্টা চালান হয়েছে—নিক্সনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ মার্কিন জনগণের সমর্থন ও সহানুভূতিও ততখানি হারিয়েছে রিপাবলিকান দল। গণতান্ত্রিক ইতিহাসের শাশ্বত নিয়মের পথ ধরে প্রশাসনিক সর্বময় কর্মকর্তার দুষ্কর্ম ও অযোগ্যতার খেসারত দিতে হয়েছে রিপাবলিকান দলকে। সুতরাং রিপাবলিকান দলের এ পরাজয় আকস্মিক নয় এবং মার্কিন জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের নতুন করে পরিচয় দিলেন সাম্প্রতিক নির্বাচনে।
এরপর হল ফোর্ড কর্তৃক নিক্সনকে ক্ষমা প্রদর্শন। নিক্সন পদত্যাগ করে দলের অশেষ উপকার করেছিলেন। কারণ যত অন্যায়ই নিক্সন করুন না কেন তার পদত্যাগের ফলে বিশেষ করে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন উচ্চ প্রশাসনিক কর্মকর্তার এই ধরনের ক্ষমতা ত্যাগে মার্কিন জনগণের যতখানি মানসিকতার পরিবর্তন ঘটার কথা ছিল, তড়িঘড়ি করে ফোর্ড কর্তৃক নিক্সনের প্রতি ক্ষমতা প্রদর্শনে ফোর্ড নিজের অজ্ঞাতেই রিপাবলিকান দলকে অধিকতর জনপ্রিয়তা শূন্য করে ফেলেছেন। সুতরাং ওয়াটারগেট কেলেংকারীর নায়কের অন্তর্ধান ঘটলেও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন মার্কিন জনগণের আস্থা পুনরায় অর্জন করা সম্ভব হয়নি রিপাবলিকান দলের পক্ষে।
সবকিছু মিলিয়ে সাম্প্রতিক মার্কিন কংগ্রেস এবং গভর্ণর নির্বাচনকে আমরা মার্কিন জনমতের সঠিক প্রতিফলন বলে অভিহিত করি। কারণ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে শুরু করে নিক্সন যা কিছু দোষ ক্রুটি করেছেন, দলীয় পদ্ধতির সরকার বিধায় প্রশাসনিক কর্মকর্তার অপকর্মের সমস্ত দায়-দায়িত্ব যেয়ে পড়ে দলের উপর। রিপাবলিকান দল হিসেবে নিক্সনকে দোষ মুক্ত রাখতে চেয়েছে বলে জনগণের আস্থা তাকে হারাতে হয়েছে এবং সে অনাস্থার চূড়ান্ত প্রতিফলন হলো সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল। গণতান্ত্রিক অধিকার যেখানে পুরোপুরি স্বীকৃত, সেখানকার জনগণ তাদের সে মূল্যবোধের বাস্তব প্রয়োগ ঘটাবে তাতে আর বিচিত্র কি?

বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষুদ্রায়তন প্রকল্প

বন্যা বাংলাদেশের একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রায় প্রতি বছরই বন্যা আসে। বন্যার করাল গ্রাস ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষের সমুদয় সহায় সম্পদ। বন্যাক্রান্ত হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ী ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করে। বন্যা শুধু মানুষের জীবনে দুর্ভোগই বাড়ায় না, বন্যা দেশের অর্থনীতিকেও পঙ্গু করে দিয়ে যায়। সর্বগ্রাসী বন্যার ছোবল মুক্ত হওয়ার জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়া একান্ত আবশ্যক। কিন্তু বন্যানিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করে বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধান একেবারে সহজসাধ্য কাজ নয়। এ জন্য দরকার বিপুল পরিমাণ অর্থের। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার নানা প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছেন। এ দেশের বুক থেকে বন্যার অভিশাপ চিরতরে রোধ করার জন্য যে সব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, তা মুখের কথায় রাতারাতি কার্যকর করা সম্ভব নয়। সে জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষুদ্রায়তন প্রকল্পগুলোও যদি বাস্তবায়িত করা যায়, তাহলে অন্ততঃ বন্যা সমস্যার শতাংশের একাংশ লাঘব হতে পারে।
বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য দশটি ক্ষুদ্রায়তন প্রকল্পে নেদারল্যান্ড সত্তর লক্ষ ডাচ গিলডারের আর্থিক এবং কারিগরি সাহায্য দিতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর মূল্য দুই কোটি দশ লক্ষ টাকা। সম্প্রতি ডাচ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞদের একটি দল বাংলাদেশ সফর করেন। বিশেষজ্ঞ দলটি বাংলাদেশের বন্যা সমস্যা সমাধানকল্পে সরেজমিনে তদন্ত করেন এবং বাংলাদেশ জল উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা করেন। অতঃপর সফররত প্রতিনিধি দলটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানান যে, ডাচ সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণের দশটি ক্ষুদ্রায়তন প্রকল্পে সাহায্য হিসেবে দুই কোটি দশ লক্ষ টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জানা গেছে, ন’টি জেলার বন্যা প্রতিরোধ এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণের দশটি প্রকল্পে নেদারল্যান্ডের এই অর্থ ব্যয়িত হবে। প্রকল্পগুলো সমাপ্ত হবে আগামী মৌসুমে।
নেদারল্যান্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিদলে তিনজন সদস্য ছিলেন। তাঁরা সবগুলো প্রকল্প সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করেন এবং রাজশাহী, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, পটুয়াখালী, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, খুলনা ও বরিশাল জেলার জন্য একটি করে, ফরিদপুর জেলার জন্য দু’টি করে প্রকল্প নির্বাচন করেন। বন্যানিয়ন্ত্রণের এই ক্ষুদ্রায়তন প্রকল্প যদি নেদারল্যান্ডের অর্থ এবং কারিগরি সহায়তায় বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বন্যা নিয়ন্ত্রণের কাজ অনেকটা এগিয়ে যাবে বলেই আমরা মনে করি। তাছাড়া, এই প্রকল্পগুলো চালু হলে স্থানীয় কর্মীরাও কাজের সংস্থান করতে পারবে। বাংলাদেশে পুরোপুরি বন্যা প্রতিরোধ একটি দীর্ঘ কর্মসূচী। এই ব্যাপক কর্মসূচীর অংশ হিসেবে ক্ষুদ্রায়তন প্রকল্পগুলোর ভূমিকাও একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবার মতোন নয়। ভয়াবহ বন্যার কবল থেকে জনপদ ও জনসাধারণের মুক্তি লাঘবটা পর্যন্ত এদেশের জনজীবনে, অর্থনীতিতে উন্নয়নের কোনো আশাই নেই। তাই পুরোপুরি না হলেও, আংশিক সমাধান আমাদের জন্য স্বস্তির কারণ। আমরা আশা করি, নেদারল্যান্ডের আর্থিক এবং কারিগরি সাহায্যকে আমরা যথার্থভাবে কাজে লাগাতে পারবো। আগামী মৌসুমে কথা মতো প্রকল্পগুলো কার্যকরী হলে নির্দিষ্ট জেলায় বন্যা প্রতিরোধ সম্ভব হবে এবং স্বাভাবিক কারণেই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। ভালোয় ভালোয়, তাই যেন বন্যা নিয়ন্ত্রণের এই দশটি ক্ষুদ্রায়তন প্রকল্পের বাস্তবায়ন ঘটে। আমরা যেন নেদার‌ল্যান্ডের সাহায্যে উপকৃত হই সেদিকে তীক্ষ্ম নজর রাখা দরকার। ক্ষুদ্রায়তন প্রকল্পগুলোকে নিছক তুচ্ছাতিতুচ্ছ মনে করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য যেখানে কোটি কোটি টাকার দরকার, সেখানে যদি আংশিকভাবেও সেই সর্বনাশা সমস্যার সমাধান হয়, তাহলে মন্দ কি। এই মুহূর্তে বন্যা নিয়্ন্ত্রণের ক্ষুদ্রায়তন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজটি একেবারে হেলাফেলা করার মতো নয়।

যে সব স্কুলে ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছিল

রমজান, ঈদ এবং দুর্গোৎসব তিনটি উপলক্ষ মিলিয়ে প্রায় দেড়মাস বন্ধ থাকার পর দেশের স্কুল-কলেজগুলো খুলেছে। সামনে বাৎসরিক পরীক্ষা। স্বাভাবিকভাবে পড়াশোনার রূপ বেড়েছে, ছাত্র-ছাত্রীরাও স্কুল-কলেজগুলোতে এখন নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছে। দেশের সব শিক্ষাঙ্গন এখন বিদ্যার্থীদের কলগুঞ্জনে মুখর অথচ স্কুলে এসে তাদের পড়তে হচ্ছে নানা সমস্যায়। প্রথম সমস্যাটা বন্যাউদ্ভূত। ব্যাপক বন্যায় দেশের বিপুল সংখ্যক নর-নারী যখন আশ্রয় হারা, মাথা গুঁজবার ঠাঁই নেই, খুটে খাবার দানা নেই, তখন সরকার সম্পূর্ণ মানবিক কারণে স্কুল বাড়ীগুলোতে আশ্রয় শিবির খুলেছিলেন। বন্যা নেমে যাবার পর যখন আশ্রয় শিবিরগুলো বন্ধ করে দেয়া হলো, তখন দেখা গেল অধিকাংশ স্কুলেই ছেলেদের বসার বেঞ্চ নেই, কতক ভেঙে গেছে, কতক উধাও হয়ে গেছে। চেয়ার-টেবিল আর ব্ল্যাক বোর্ডের অবস্থাও তাই। আশ্রয় শিবিরের ত্রাণ কর্মীরা তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে স্কুল বাড়ীগুলো ব্যবহার করলেন কিন্তু এর ভবিষ্যত প্রয়োজনের কথা একটুও খেয়াল রাখলেন না। স্কুলের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশকে এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাঠ্যাভ্যাস করতে হচ্ছে এবং শিক্ষকগণও বসার চেয়ার না পেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ সারছেন। বলাবাহুল্য, এই পরিস্থিতিটা বিদ্যাদান এবং গ্রহণ কোনটার পক্ষে অনুকূল নয়।
দুই নম্বর সমস্যাটা বন্যা উদ্ভূত নয়। দেশের বেশীরভাগ খবরের কাগজে সমস্যাটা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, দেশের অভিভাবকরাও অনেকবার চিঠিপত্র কলামে অনুযোগ করেছেন। আমরাও লিখে লিখে হদ্দ হয়ে গেছি কিন্তু সমস্যাটার ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভাঙানো কিছুতেই সম্ভব হয়নি। দেশের একশ্রেণীর হঠাৎ গজিয়ে উঠা ধনীর দুলালরা (ইদানীং যাদেরকে রোমিও বলে অভিহিত করা হয়) স্কুল-কলেজ প্রভৃতির আশেপাশে নিত্য ঘোরা-ফেরা করে। শিষ দেয়, সস্তা ফিল্মী গানের সুর ভাজে, কখনো কখনো মেয়েদের নাম ধরে অশ্লীল কথার টুকরো ছুঁড়ে মারে। এই রোমিও নামে আখ্যায়িত হঠাৎ অবতার নন্দনদের উৎপাত দিন দিন এতই বেড়ে যাচ্ছে যে, অনেক অভিভাবককেই আজ ভাবতে বাধ্য হতে হচ্ছে যে, মেয়েটিকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেবে কি না।
আমরা অবশ্যই জানি, সম্পাদকীয় স্তম্ভে একটা নিবন্ধ লিখে দিলেই সমস্যাটা শেষ হয়ে যাবে না কিন্তু এ কথা ঠিক যে, দেশের সরকার ও সরকারের বাইরে যে সব নেতৃস্থানীয় সমাজকর্মী রয়েছেন, সময়ে ‍উদ্যোগ নিলে সমাজ থেকে এই দুষ্টক্ষতটা তাঁরা অবশ্যই দূর করতে পারেন। সন্দেহ নেই। অবস্থাটা খুবই ভয়াবহ এবং ভয়াবহ বলেই এ সম্পর্কে আমাদের গড়িমসি করার কোনো সুযোগ নেই। যা করবার অচিরেই করা দরকার।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন