You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.11.07 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | মহান অক্টোবর বিপ্লব | ভিক্ষুকরাও স্বাবলম্বী হতে পারে | আদর্শ হোক যাত্রাপথের দিশারী | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৭ই নভেম্বর, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৪, ২০শে কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

মহান অক্টোবর বিপ্লব

উনিশ শ’ সতেরো সাল। সাতই নভেম্বর। এই দিনটিতে সোভিয়েত রাশিয়ার মাটিতে নিপীড়িত, নির্যাতিত ও শোষিত মানুষের মহান নেতা লেলিনের নেতৃত্বে বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠেছিল। যে বিপ্লবের আগুনে পুড়ে ছাড়খার হয়ে গিয়েছিল শোষক, শাসক আর সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়ানকরা।
আজ থেকে সাতান্ন বছর আগে অনুষ্ঠিত মহান অক্টোবর বিপ্লব যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল তারই ফলশ্রুতিতে জন্ম নিয়েছে রাশিয়া, চীন সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ। যে সমাজে নেই কোনো শাসন, শোষণ ও বঞ্চনার নিদর্শন।
অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে সেদিন যে নবজাত রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল তাকে অঙ্কুরেই টুঁটি টিপে হত্যা করার সাম্রাজ্যবাদী ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ও হীন প্রচেষ্টাও কম হয়নি। কিন্তু সকল প্রতিবন্ধকতা ও বাঁধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে মহান নেতা লেনিন নবজাত রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির দিকে। সেদিন যদি নবজাত রাষ্ট্রটির জন্ম না হতো তাহলে আজকের দিনে বিশ্বের চেহারাটা কি হতো বলা কঠিন। চল্লিশ দশকে ফ্যাসিস্ট হিটলার চেয়েছিল রাশিয়ার নাম-নিশানা মুছে ফেলতে কিন্তু পারেনি। পরিণামে তাকেই নিশ্চিহ্ন হতে হয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মহান অক্টোবর বিপ্লবের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সকল শাসন শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জয়যুক্ত হয়েছে।
সাতই নভেম্বর যে বিপ্লবী মশাল জ্বলে উঠেছিল তারই আগুন আজ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের সর্বত্র। মহান অক্টোবর বিপ্লবকে আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি এ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, ভিয়েতনাম, মধ্যপ্রাচ্য তথা দুনিয়ার সকল মুক্তিকামী মানুষের পাশে। যেখানে নিপীড়ন, নির্যাতন, অত্যাচার, অবিচার ও শাসন-শোষণ সেখানেই অফুরন্ত প্রেরণা উৎসাহ-উদ্দীপনা জোগাচ্ছে মহান অক্টোবর বিপ্লব। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে শোষিত ও নিপীড়িত জনতার সংগ্রাম কখনো ব্যর্থ হয়না—হতে পারেনা।
অক্টোবর বিপ্লব একদিকে যেমন আমাদের বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তেমনি আবার শোষণহীন সমাজ গঠনে ত্যাগ, তিতিক্ষা ও সংগ্রামের পথে চালিত করে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে একটা রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। এক নদী রক্ত পেরিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুবার সময় মহান অক্টোবর বিপ্লব আমাদের পথ দেখিয়েছে। আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সোভিয়েত সরকার ও জনগণ। অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়েছে আমাদের বিপ্লবকে। বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের সমর্থন, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সাহায্য ও সহযোগিতার বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে যদি না অক্টোবর বিপ্লবের পরবর্তী অবস্থায় রাশিয়ার জনগণ যে নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেম নিয়ে দেশ পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন সেই শিক্ষাকে মনে-প্রাণে আমরা গ্রহণ না করি। বাংলাদেশ শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমে বদ্ধপরিকর। শোষণহীন সমাজ গঠনে অক্টোবর বিপ্লবের শিক্ষা আমাদের সকল প্রেরণার উৎস হোক। এ কামনাই আমরা করছি।

ভিক্ষুকরাও স্বাবলম্বী হতে পারে

দুয়ারে দুয়ারে যারা নিয়ত হাত পেতে করুণা ও ভিক্ষা করে এবং ভিক্ষাই যাদের জীবন-জীবিকা আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছা থাকলে সেই ভিক্ষুকরাও একদিন স্বাবলম্বী হতে পারে। ভিক্ষা যাদের পেশা তারা সাধারণতঃ সাধারণ মানুষের করুণা এবং দয়ার উপরই নির্ভরশীল। উপার্জনক্ষম মানুষ কখনো ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে পথে নামে না। জীবিকা নির্বাহের সমুদয় পথ যখন রুদ্ধ হয়ে যায়, তখন অন্য কোনো উপায়ান্তর না দেখে মানুষ ভিক্ষাবৃত্তিকেই জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়। এই সব ভিক্ষুককে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য আমাদের দেশে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। তাই দেখি আমাদের চারপাশে সব সময়ই ভিক্ষুকের ভীড় লেগে রয়েছে। ভিক্ষুকদের প্রতি আমরা কখনো সদয় হই, আবার কখনো বা দুর দুর করে তাড়িয়ে দিই। এই সব অপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করেও মানুষ ভিক্ষা করে। কারণ ভিক্ষার পাত্র হাতে না নিলে তাদের মুখে দু’মুঠো অন্ন জুটবে না। অনাহারে হবে তাদের জীবনের করুণ পরিসমাপ্তি। সমাজপতিরা প্রায়শই বলে থাকেন, সমাজের বুক থেকে ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূল করতে হবে। কিন্তু সরকার যদি ব্যাপকভাবে এ ব্যাপারে কোনো রকম কর্মসূচী গ্রহণ না করেন, তাহলে সমাজদেহ থেকে ভিক্ষাবৃত্তি উচ্ছেদ করা একেবারে সহজ সাধ্য নয়। অন্ততঃ অনুন্নত দেশগুলোতে যেন ভিক্ষাবৃত্তি একটি অবধারিত সত্য হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আসছে। এই সব সত্ত্বেও আজমীরের ভিক্ষুকরা এক অভিনব এবং দৃষ্টান্তমূলক কর্মের পরিচয় দিয়েছে। এক খবরে প্রকাশ, সেখানকার ভিক্ষুকরা প্রথমে একটি সমবায় সমিতি গড়ে তোলে এবং দু’বছর আগে তারা একটি বিস্কুট কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। সবচেয়ে উল্লেখ্য ব্যাপার হচ্ছে এই যে, সমবায় সমিতির সদস্য ভিক্ষুকরাই এই কারখানায় কাজ করে এবং এরাই কারখানাটি পরিচালনা করে থাকে। ৬৫ জন ভিক্ষুক কারখানায় কাজ করছে। এরা কাজের মান অনুযায়ী ৪০ থেকে ১৫৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক মাইনে পাচ্ছে। এছাড়া, অতিরিক্ত সুযোগ হিসেবে এরা দিনে পাঁচবার চা এবং বিড়ি পাচ্ছে। এ খরচ কারখানার। দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা ভিক্ষুকদের এই বিস্কুট কারখানাটি চালু থাকে। প্রতিদিন উৎপন্ন হয় সাইত্রিশ মণ বিস্কুট। গত দু’বছরে কারখানাটি ৭২ হাজার টাকা আয় করেছে। সম্প্রতি বিস্কুট কারখানাটিতে রুটি তৈরীর কাজও শুরু হয়েছে। এ থেকে অনুমিত হয় যে, নিকট-ভবিষ্যতে এই কারখানার আয়ের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়বে। ভিক্ষুকরা যে পরমুখাপেক্ষী হয়ে চিরজীবন থাকতে চায় না, ভিক্ষুকরাও যে ইচ্ছে করলে স্বাবলম্বী হতে পারে আজমীরের ভিক্ষুকরা সেই দৃষ্টান্ত উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরেছে। ভিক্ষুকদের এই কর্মপ্রচেষ্টা অভিনন্দনযোগ্য। সমাজের গলগ্রহ হয়ে থাকার চেয়ে গা-গতর খাটিয়ে জীবিকা নির্বাহ অনেক সুখের, অনেক শান্তির। সব দেশের সব ভিক্ষুকরা এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করলে মন্দ হয় না। বরং তা সর্বমহলের সাধুবাদ কুড়োবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

আদর্শ হোক যাত্রাপথের দিশারী

কৃষক নেতা বরোদা চক্রবর্তী মারা গেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশ থেকে একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক খসে গেল।
গত ৪ঠা নভেম্বর সোমবার রাত ১২টায় কলকাতার একটি নার্সিংহোমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন আজীবনের ত্যাগী রাজনীতিক বরোদা ভূষণ চক্রবর্তী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। তিনি বিধবা স্ত্রী, ছয় পুত্র আর দু’টি কন্যা রেখে গেছেন। বলা যায় পরিণত বয়সেই তার মৃত্যু ঘটেছে। বাংলাদেশের শোষিত নিপীড়িত কৃষক সমাজের জন্য তাঁর যেটুকু করার তা করতে জীবদ্দশায় তিনি একটুও কার্পণ্য করেননি। তবু তাঁর এই মৃত্যু আপামর কৃষক সমাজের জন্য নিঃসন্দেহে একটি মর্মন্তুদ ঘটনা। দিনাজপুরের বরোদা ভূষণ চক্রবর্তী সুদীর্ঘ ষাট বছর যাবত রাজনীতি তথা কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন ত্রৈলক্য মহারাজ, মাস্টার দা সূর্য সেন ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সহ আরো অনেকে। বর্তমান বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে সরকারী দলে কি বিরোধী দলে এমন ঐতিহ্যবান রাজনীতিক খুব কম আছেন যারা তাঁর সাথে এক সঙ্গে কারাবাস করেননি। উপনিবেশবাদী বৃটিশ শাসকদের কারাগার থেকে তাঁর কারাজীবন আরম্ভ হয়েছিল এবং দেশ মুক্ত হবার কিছুদিন আগে পর্যন্তও তিনি কারাযন্ত্রণা ভোগ করেছেন। পর্যায়ক্রমে জীবনের ষাট বছরের মধ্যে সুদীর্ঘ তিরিশটি বছর কারাযাপন করতে হয়েছে বরোদা চক্রবর্তীকে। সর্বশেষ ইয়াহিয়া খাঁর হার্মাদ বাহিনী তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে ১৪ বছরের কারাদন্ড দিয়েছিল।
কলকাতার নার্সিং হোমে আজীবন সংগ্রামী এই কৃষক নেতা যখন মারা গেলেন, আমরা দূর থেকে খবরটা শুনলাম। বাংলাদেশের প্রতিটি মেহনতি মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী আজ শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে তাদের অনন্য সাধারণ ত্যাগী নেতা, বন্ধু ও সহযোগীকে শ্রদ্ধা জানাবে। দেশ মাতৃকার সেবায় যে আদর্শ তিনি বহন করেছিলেন আমৃত্যু, আজীবন—সেই আদর্শকে প্রতিটা বাঙালী সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করবে। তাঁর মহাপ্রয়াণ উপলক্ষে তার রেখে যাওয়া আদর্শই হবে আমাদের যাত্রাপথের দিশারী।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন