You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৫শে মার্চ, সোমবার, ১৯৭৪, ১১ই চৈত্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

দ্রব্যমূল্যের অক্টোপাস ও বাংলার মানুষ

সারা পৃথিবীতেই দ্রব্যমূল্যের দাউ দাউ আগুনে মানুষ আজ অতিষ্ঠ, প্রাণান্ত। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে, একটু পাশাপাশি রেখে বিচার করলেই স্পষ্ট বোঝা যাবে যে, পৃথিবীর আর যে কোনো দেশে দ্রব্যমূল্যের স্বরূপ আর যাই কিছু হোক না কেন, বাংলাদেশে কিন্তু একে একটা নির্মম পরিহাস, নিছক শ্লোগান বা নিষ্ঠুর প্রহসন ছাড়া আর কোনোভাবেই চিহ্নিত করা যায় না।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সাধারণতঃ প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক বা ব্যবসায়িক নীতি বা ধারা সাপেক্ষেই হয়ে থাকে। যেমন, উৎপাদন প্রয়োজনীয় পরিমাণ হলে বা উৎপাদনে খরচ কম হলে, দ্রব্যমূল্য কমে। আবার উৎপাদন ও চাহিদা বরাবর হলেও দ্রব্যমূল্যও স্বাভাবিক থাকে। শুধু তাই নয়, কোনো বিশেষ কারণে কোনো দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে এবং তা’ জনতার ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে জনতার দাবীর চাপে ব্যবসায়ী মহল ‘ন্যূনতম লভ্যাংশ’ এর নীতিতে দ্রব্যমূল্যকে আবার স্বাভাবিক করে তোলেন। আর এজন্য ব্যবসায়ীদের উপরও সরকারের নির্দিষ্ট, কঠোর ও কার্যকরী ব্যবস্থা থাকে। সরকার জনতার প্রকৃত ক্রয় ক্ষমতার দিকে সহৃদয় দৃষ্টি রেখেই বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করেন এবং জনতাও যাতে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঠিক সেই নির্দিষ্ট মূল্যেই দ্রব্যাদি কিনতে পারে তজ্জন্যেও নানাবিধ ব্যবস্থা করেন। কিন্তু এসব দিক থেকে বাংলাদেশ মাশাহ্ আল্লাহ্ একেবারেই হাতখালি মোস্তান। এখানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি কোনো প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক বা ব্যবসায়িক নীতিসাপেক্ষ হয়না।
আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের কাছে ‘ন্যূনতম লভ্যাংশ’ একটি অচিন্তনীয় ব্যাপার। তাদের মানসিকতা ও মোদ্দা কথা হচ্ছে গাইও খেতে হবে দুধও খেতে হবে। তাতে আল্লায় যাই করুক। আর জনতার ক্রয় ক্ষমতা? সে আবার কোন্ আব্দারী কথা? কই যতই দাম বাড়াচ্ছি ততই তো খদ্দেরের সংখ্যা বাড়ছে। তবে আর জনতার ক্রয় ক্ষমতা কি জিনিস? সত্যিই আপন আপন গন্ডির সুখ প্রাচুর্যে অন্ধ ব্যবসায়ীরা জানতেও পারেনা এতো মানুষ কোত্থেকে কী জ্বালা নিয়ে হন্যে হয়ে এসেছে, কিম্বা, কতদিনই বা তারা এভাবে চলতে পারবে। তার সঙ্গে আরো জ্বালা এসে জুটেছে কর্তৃপক্ষের ব্যবসায়ীদের উপর সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাবার ফলে। সারাদেশে সমস্যা-মুহ্যমান মানুষের গগনবিদারী বুকফাটা চীৎকার : ‘বাঁচাও, বাঁচাও, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমাও। দ্রব্যমূল্যের অক্টোপাস থেকে গণমানুষকে বাঁচাও।’ কিন্তু কে কার কথা শোনে? প্রতিনিয়তই দ্রব্যমূল্য আকাশে ছুটে চলেছে মঙ্গল গ্রহকেও ছাড়াবার বাসনায়।
এভাবে কখনো কোনো জাতি ইতিহাসে টিকে থাকতে পারেনি। আমাদেরও দারুণ নাজুক সময়। অচিরেই এর বিহিত না হলে কারোই বাঁচার সম্ভাবনা নাই। তবে, বিভিন্ন জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে স্বাভাবিক করে মানুষকে বাঁচাতে হলে সকলকেই যৌথভাবে এগুতে হবে—এ কাজ কারো একার নয়। এককভাবে কোনোদিনও সম্ভব নয়।
প্রথমেই সরকারকে চেষ্টা করতে হবে দেশের সমস্ত জিনিসকে অর্থনীতির নিয়মানুসারে একান্ত অপরিহার্য, আরামে অপরিহার্য ও বিলাসে অপরিহার্য হিসেবে তিনটে পৃথক পৃথক শ্রেণীতে তালিকাভুক্ত করে প্রত্যেকটির মূল্য বেঁধে দেয়া। প্রত্যেকটি জিনিসের সরকারী মূল্য বেঁধে দেয়া হয়নি বলে জনসাধারণ আজ বিভ্রান্ত ও অসাধুর দৌরাত্ম্যই প্রধান।
দ্বিতীয়তঃ, সরকার নির্ধারিত মূল্যে জনসাধারণ যাতে প্রত্যেকটি জিনিস পেতে পারে এজন্যে সরকারের কঠোর আইন ও দৃষ্টি রাখতে হবে, ব্যবসায়ীদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
তৃতীয়তঃ প্রত্যেক মহল্লা ভিত্তিতে জনসাধারণের উদ্যোগে ‘ন্যায্যমূল্য বাস্তবায়ন দল’ গঠন করে স্থানীয়ভাবে নিয়মিত অসাধু ব্যবসায়ীদের উপর নজর রাখতে হবে। তবে এমন দলকে প্রথমেই সরকারের অনুমোদন নিয়ে পরে বাস্তবায়ন অভিযানে নামতে হবে। জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে এসব কাজ সমাধা করা যেতে পারে।
চতুর্থতঃ, দেশে উৎপাদিত সমস্ত জিনিসের মূল উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে গুদাম-বাজার সহ সরবরাহ, বন্টন, পরিবহন সর্বস্তরেই সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ দেশপ্রেমিক কর্মীর মাধ্যমে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এবং কোনো ভুয়া বা অসাধু লোক বা টাউট ফড়িয়া যাতে কোনো রকমের মধ্যস্বত্ব ভোগের সুযোগ না পায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
পঞ্চমতঃ, উৎপাদকের যে কোনো অভাব বা অসুবিধা দূর করার জন্যে পর্যাপ্ত সরকারী ক্ষিপ্রতা, তৎপরতা ও ব্যবস্থা থাকতে হবে। এমনকি, যে কোনো বেসরকারী উৎপাদকের অসুবিধাও সরকারকে সহৃদয় দৃষ্টিতে নিতে হবে। পরিবহন, কাঁচামাল, খুচরা যন্ত্রাংশ, জ্বালানী, প্রশিক্ষিত কর্মী ইত্যাদি নামে বহুল কথিত যেসব সমস্যা আছে, তা’ দূর করতে হবে।
ষষ্ঠতঃ, টিসিবি, ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থা, ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থা সহ বিভিন্ন সরবরাহ প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য ও সৎ কর্মী দিয়ে সাজাতে হবে। ভুয়া লাইসেন্স, পারমিট, এজেন্সী, ডিলারশীপ প্রভৃতি উৎখাত করতে হবে।
সপ্তমতঃ, পাইকারী ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীর মাধ্যমে একটি কার্যকরী বাঁধ সৃষ্টি করতে হবে এবং উভয়ের গতিবিধি লক্ষ্য করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তা, না হলে শুধুমাত্র পাইকারকে ধরে দাম কমানো যাবেনা, কারণ লাটের সব মালই ফুটপাতে বা হকারীতেই কালোবাজারে খুচরা বিক্রির মাধ্যমে বিক্রিত হচ্ছে। সুতরাং দ্রব্যমূল্য কমানোর অভিযান ফুটপাতেও চালাতে হবে। তা না হলে অভিযান সফল হবেনা।
অষ্টমতঃ, প্রভাবশালী মহলের সুপারিশ, পরিচাপ বা রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধেরও কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে।
আর এইভাবে একটা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আরো অনেক অনেক সমস্যার উদ্ভব হবে, তাদেরও সমাধানের ব্যবস্থা নিতে হবে। মোট কথা দ্রব্যমূল্য কমাতে ব্যাপক সরকারী পরিকল্পনা নিতে হবে এবং এটা সত্যিই যাতে কমে এসে মানুষের সাধ্যমতো হতে পারে সেজন্য জনসাধারণকেও যেমন বিশিষ্ট ভূমিকা নিতে হবে তেমনি ব্যবসায়ে নিয়োজিত সমস্ত সংশ্লিষ্টকেও এক পা উঁচু করে উদগ্রীব থাকতে হবে। তা না হলে ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করবেনা।

পর্যটন শিল্পের সাংস্কৃতিক মূল্য

পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে শুধু অর্থ আয়ের পথই সুগম হয় না, পর্যটন শিল্পের সাংস্কৃতিক মূল্যও অপরিসীম। প্রাকৃতি রূপবৈচিত্রের দিক থেকে বাংলাদেশের শ্যামল শোভা যে কোনো বিদেশীকেই বিমোহিত করে দিতে পারে। রূপসী বাংলার নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলী দেখে বিদেশী পর্যটকরা তৃপ্ত হবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা কি আমাদের স্বদেশের ছবি বিদেশীদের কাছে সম্যকভাবে তুলে ধরতে পেরেছি? বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হওয়া সত্ত্বেও বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো কোনো সুচারু বন্দোবস্ত এতোদিনে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। বাণিজ্য ও বৈদেশিক বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ পর্যটক শিল্প বিকাশের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পর্যটন শিল্প উন্নয়নের জন্যে সরকারের পক্ষ থেকে ২০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। পর্যটকদের আবাসিক এবং যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি সাধন এবং দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রচারাভিযান চালানোর পরিকল্পনাও প্রণীত হয়েছে। এই পরিকল্পনা যথার্থভাবে বাস্তবায়িত করা হলে বাংলাদেশকে বিদেশী পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা সম্ভ হবে ঠিকই, তবে ইতিমধ্যে ঐতিহাসিক মূল্য আছে এ রকম কয়েকটি স্থানকে পর্যটন উপযোগী করে তোলার জন্য বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করা একান্ত দরকার। বাণিজ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প উন্নয়নের জন্য আসটার সহযোগিতা কামনা করে বলেছেন, আসটার আঞ্চলিক শতভাগ অর্থে চতুর্থ সম্মেলন এ অঞ্চলের যাবতীয় প্রকৃত সমস্যা ও সংকট নিরসনের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার ব্যাপারে সার্বিক ভূমিকা গ্রহণ করবে। মন্ত্রী মহোদয় আরো বলেছেন যে, পর্যটনকে কেবলমাত্র শিল্প হিসেবে নয়, সাংস্কৃতিক ও সৌহার্দ বিনিময়ের অন্যতম মাধ্যম হিসেবেও গুরুত্ব দেয়া দরকার।
এ কথা সত্য যে, পর্যটন আজকের বিশ্বে একটি অন্যতম শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো বাংলাদেশের প্রাকৃতিক শোভা যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তবুও কেবল সরকারী উদ্যোগেই পর্যটন শিল্পের সার্বিক বিকাশ সাধিত হতে পারেনা, পর্যটন শিল্পকে সমৃদ্ধ করার জন্যে বেসরকারী উদ্যোগ যেমন অব্যাহত থাকা প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন দেশের নাগরিকদের অতিথিপরায়ণ হওয়া। কেবলমাত্র প্রাকৃতিক শোভাই পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্যে যথেষ্ট নয়, পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য ঐতিহাসিক স্থান ও নিদর্শনের রক্ষণাবেক্ষণের উপরও নজর দেয়া দরকার। তা’ছাড়া পর্যকটরা যদি আবাস এবং যাতায়াতের ব্যাপারে নানারকম প্রতিবন্ধকতায় সম্মুখীন হন তা হলে এ শিল্পের প্রসার ঘটতে পারে না। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো সম্পদ বাংলাদেশে রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে দিন দিন শ্যামল বাংলার গুরুত্ব বাড়বে। পর্যটকরা বাংলাদেশ ভ্রমণে আরো উৎসাহিত হবেন। কিন্তু এ উৎসাহে যেন ভাটা না পড়ে সেজন্যে পর্যটন কেন্দ্রগুলোকেও উপযুক্তভাবে পরিচর্যা করতে হবে। কারণ, পর্যটনের মাধ্যমে শুধু অর্থোপায় হয় না, পর্যটনের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি গড়ে উঠে এবং সবচেয়ে বড় কথা পর্যটকদের কাছে বাঙালী সংস্কৃতির পরিচয় অত্যন্ত সহজ উপায়ে তুলে ধরা সম্ভব হয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!