1971.11.26 | জয় বাংলা পত্রিকা | ২৬ নভেম্বর ১৯৭১
জয় বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র
প্রথম বর্ষ ২৯শে সংখ্যা, মুজিবনগর, শুক্রবার ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮ ২৬শে নভেম্বর, ১৯৭১
আমরা বিজয়ের উৎসব পালন করব
পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত জাতির প্রতি প্রদত্ত বাণীতে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, পবিত্র রমজান মাসেও হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বাংলাদেশের মুসলমান-হিন্দু নির্বিশেষে অসংখ্য নরনারী নিহত হচ্ছে। গত বছর আমরা ১২ ই নভেম্বর এর প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে নিহত ১০ লাখ মানুষের শোকে মুহ্যমান অবস্থায় ঈদ উৎসব পালন করতে পারিনি। এবারও আমরা ইয়াহিয়ার সৈন্যদের বর্বরতায় নিহত ১০ লাখ ভাই বোনের বিয়োগ বেদনা বুকে নিয়ে ঈদের জামাতে শামিল হয়েছি। কিন্তু দুঃখ-কষ্ট যাইহোক এবার ত্যাগের মন্ত্রে আমরা উদ্বুদ্ধ এবং যেকোনো মূল্যে স্বাধীনতা ঘোষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে বদ্ধপরিকর। দেশকে শত্রুমুক্ত করার পর এইমাত্র ঈদুল ফতেহর ঈদ উৎসব পালন করব এবং সেদিন খুব দূরে নয়, এই প্রতিশ্রুতি আমি আপনাদের দিতে পারি।
জাগ্রত বাঙালি
বিখ্যাত মার্কিন সাপ্তাহিক নিউজ উইক এর বিশিষ্ট সাংবাদিক ঢাকা থেকে লিখেছেন যে, সামরিক ও রাজাকার বাহিনীর অত্যাচার বাংলাদেশের মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার না করে প্রতিশোধ স্পৃহাকে দৃঢ় করেছে। গত ১৫ই নভেম্বরের সংখ্যায় তিনি এ কথা লিখেছেন। নিউজউইকের সংবাদদাতা উল্লেখ করেছেন যে, তাকে একজন খুব তথ্য অভিজ্ঞ ও নির্ভরযোগ্য বিদেশি কূটনীতিক বলেছেন, পাক সামরিক বাহিনীর বর্বর নীতি অনুসরণ করে চলেছে। তাদের মনে মুক্তিবাহিনীর ভয় এত প্রবল হয়ে উঠেছে যে, কোনখানে মুক্তিবাহিনীর লোক আছে জানলে বিনা তদন্তে সেখানে গিয়ে জঘন্য অত্যাচার চালাচ্ছে।
৪৮ ঘণ্টাব্যাপী প্রচন্ড যুদ্ধে ৫৭ জন জানোয়ার হত্যা
(রণাঙ্গন প্রতিনিধি)
বাংলাদেশের মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তিযোদ্ধারা ৯ই এবং ১০ই নভেম্বর নোয়াখালী জেলার পরশুরাম থানায় পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে সম্পূর্ণ থাকে দখলমুক্ত করেছে। এই প্রচন্ড যুদ্ধ ৪৮ ঘণ্টা স্থায়ী হয়।
মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণের রণাঙ্গনেই ৫৭ জন হানাদার সৈন্য খতম হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বলিষ্ঠ কব্জির মারে ভীতসন্ত্রস্ত ৮৪ জন পলায়নপর পাকিস্তানি সৈন্যদের মুক্তিযোদ্ধারা পাকড়াও করে এবং দিশেহারা ২১ জন সেনা এবং ২০ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।
হায়না খানসেনাদের এই বধ্যভূমি থেকে আমাদের অপরাজেয় মুক্তিবাহিনী ২২৫ টি স্বয়ংক্রিয় চিনা রাইফেল, ১৯ বাক্স চিনা রাইফেল (৩০৩), ১৮টি হালকা মেশিনগান, ৩৬টি ৩ ইঞ্চি মর্টার, ২৬টি ২ ইঞ্চি মর্টার এবং ১১ বেশ হালকা মেশিনগানের গুলি পেয়েছে।
পরশুরাম থানা দখলের পর যখন মুক্তিবাহিনীর এলাকায় নিজেদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার কাজে ব্যস্ত ছিল তখন চারটি হানাদার জঙ্গিবিমান আমাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। আমাদের অসমসাহসী মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বিমান আক্রমণ প্রতিহত করে।
জনাব সিরাজ নামক এক দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা নিজের জীবন বিপন্ন করে মেশিনগানের সাহায্যে একটি বিমান কে ঘায়েল করে ভূপাতিত করার পর অন্যবিমান গুলি পালিয়ে যায়। এই অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা বিমান ভূপাতিত করতে গিয়ে বীরের মৃত্যুবরণ করেন। তাকে পুরো সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করা হয়েছে মুক্ত জন্মভূমির পবিত্র মাটিতে।
ঢাকা বিচ্ছিন্ন
মৃত পাকিস্তানের জরুরি অবস্থা
বিমান ভূপাতিতঃ ট্যাঙ্ক ধ্বংসঃ এলাকার পর এলাকা মুক্ত
(রণাঙ্গন প্রতিনিধি প্রেরিত)
মুক্তিবাহিনীর সকল জনগণের দুর্বার বেগে এগিয়ে চলেছে। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল লাইন্সের সকল অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে এবং পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। ঢাকা শহর এখন কার্যত বাংলাদেশের দখলীকৃত অন্যান্য জেলা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ঢাকা জেলার মুন্সিগঞ্জ থানা সভাপতি থানার স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন হয়েছে।
সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ মুক্তিবাহিনীর মৃত্যুঞ্জয়ী গেরিলা যোদ্ধারা সমগ্র বাংলাদেশের শত্রু সৈন্যদের উপর্যুপরি প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন।
মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী যোদ্ধা যশোর, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, চাটগাঁ, নোয়াখালী-কুমিল্লা প্রভৃতি রণাঙ্গনে খান সেনাদের ওপর তীব্র থেকে তীব্রতর আঘাত হেনে চলেছে চলেছে।
আমাদের তরুণরা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা রেখে গত ২১শে নভেম্বর যশোর ক্যান্টনমেন্টে রানা দর্শনের উপর সামনা সামনি চালিয়ে আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেন। মুক্তিবাহিনীর অপূর্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ আক্রমণের যশোরে পাকিস্তানি সৈন্যদের পাঁচটি মাঝারি ট্যাংক ধ্বংস হয়। একটি পাকিস্তানি বোমারু বিমান হানাদার পদাতিক বাহিনী কে সাহায্য করতে এগিয়ে গেলে সেই মুহূর্তে গেরিলা যোদ্ধাদের বিমান বিধ্বংসী কামান এর অব্যর্থ গোলায় পাকিস্তানি বোমারু বিমান ভূপাতিত হয়। এর আগে মুক্তিবাহিনী কক্সবাজার ও নোয়াখালীর পরশুরামে ২ টি এছাড়া মেঘনা নদীতে তিনটি হানাদার বিমান ভূপাতিত করেন। জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড চাপে দক্ষিণের খুলনা-যশোর থেকে উত্তরের রংপুর- সিলেটে পাকিস্তানি সৈন্যদের দখলীকৃত ১০টি শক্তিশালী ঘাঁটি সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
মুক্তিবাহিনীর তীব্র অভিযানের চাপে খুলনা রণাঙ্গনের সাতক্ষীরা, কালিগঞ্জ, ভোমরা ও কলারোয়া; রংপুরের জগদ্দল, অমরখানা, হাতীবান্ধা ও রায়গঞ্জ যশোরের, চৌগাছা এবং সিলেটের জকিগঞ্জ ও সাত গ্রাম এলাকা সম্পূর্ণভাবে আমাদের করায়ত্ত হয়েছে।
সিলেটের মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণের মুখে শত্রুরা এখন শহরে অভিমুখে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
এদিকে কুষ্টিয়া জেলার মুক্তি বাহিনীর অভিযানের মুখে বিপর্যস্ত পাকিস্তানী সৈন্যরা আরো পশ্চাদ্ভাগে ছুটে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী কুষ্টিয়া জেলা ও যশোরের সীমান্তবর্তী সহস্রাধিক বর্গমাইল এলাকা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করেছেন।
ঢাকা বেতার এর স্বীকৃতি
দখলীকৃত ঢাকা বেতার থেকে গত ২২শে নভেম্বর রাত ১১/১২ মিনিটের বুলেটিনে এই সংঘর্ষের বিকৃত খবর পরিবেশন করা হয়। ‘এই সংঘর্ষে প্রতিপক্ষ কিঞ্চিত সাফল্য অর্জন করে।’
স্বাধীনতা লাভের দিন নিকটে
-প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জন্মদিন জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে বলেন,”অশ্রু ও রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়ছি, সেই স্বাধীনতা লাভের দিনটি অতি নিকটে।” স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৩শে নভেম্বর রাতে এই ভাষণ প্রচারিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার ধারণা অশেষ অর্থবহ। স্বাধীনতার তাৎপর্য নির্ভর করে যুদ্ধাবস্থায় এর জন্য আমরা কি মূল্য দেই এবং শান্তির সময়ে এর কি ব্যবহার করি তার উপর। তিনি বলেন বাংলাদেশের শহরে ও গ্রামে তরুণের যে যুদ্ধে লিপ্ত, তা বিদেশি দখলদারকে বিতাড়িত করার সংগ্রাম এবং অসাম্য ও সুবিধাভোগের অবসান ঘটানোর সংগ্রাম। তিনি জানান, আমাদের আজকের সংগ্রাম সেদিনের সার্থক হবে যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুত, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব। সমাজের যে ভবিষ্যৎ রূপ আজ বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রত্যক্ষ করেছেন সেখানে সকলের সমানাধিকার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠিত হবে এবং উন্নয়ন ও পরিপূর্ণতার সাধারণ লক্ষ্যে উপনীত হবার প্রয়াস সকলে অংশগ্রহণ করবেন।
প্রধানমন্ত্রী তার বেতার ভাষণে বলেন যে, সামরিক শাসক চক্র আত্মহত্যার যে ব্যবস্থা করে থাকুক না কেন, আর এই উপমহাদেশের জন্য যে ব্যবস্থায় বিশেষ বিশেষ রাষ্ট্রের মনঃপুত হোক না কেন বাঙ্গালা দেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা একটিই-আর তা হলো পূর্ণ স্বাধীনতা। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ তীব্রতার হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন,”ঠিক এই সময়ে এই উপমহাদেশে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ দল পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন কি উদ্দেশ্য সাধন করতে চান? তার দেশের কূটনীতিবিদ ও আইন সভার সদস্যরা অবগত নন এমন কি নতুন তথ্য তিনি জানতে ইচ্ছুক? দশ কোটি বাঙালিকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা এবং প্রায় এক কোটি মানুষকে বাস্তু ত্যাগ বাধ্য করা সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকারকে তার প্রশাসন নিন্দা করেন নি। এখন তথ্য সংগ্রাহক পাঠিয়ে কি ফল তারা লাভ করতে চান, তা জানি না ।”প্রধানমন্ত্রী বলেন, ” তবে এতে আমাদের সংকল্পের কোন ব্যত্যয় হবে না। সেই সংকল্প হলো দেশকে শত্রুমুক্ত করে নিজেদের অভিপ্রেত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।”
কুমিল্লায় ব্যাপক আক্রমণ
মুক্তিবাহিনীর দুর্ধর্ষ বীর যোদ্ধারা পূর্ব রণাঙ্গনের কুমিল্লাতেও সফল অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। কুমিল্লার হাজিগঞ্জ থানা, ফরিদগঞ্জ, রামাহাপুর, সাহাপুর অঞ্চলে দখলদার সৈন্যদের ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ করে পিছু হটিয়ে দিয়েছেন।
মুক্তিবাহিনী এদিকে খুলনা জেলার বসন্তপুর দখল করেছেন এবং সাতক্ষীরার দিকে এগিয়ে চলার অভিযান অব্যাহত রেখেছেন।
রাজশাহীতে তৎপরতা।
রাজশাহী জেলার রাজগঞ্জ এবং রামপুরার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও এখন মুক্তিবাহিনীর দখলে।
২১ জন সৈন্য বন্দি
কুমিল্লার রণাঙ্গনে আখাউড়া রণাঙ্গনের মুকুন্দপুর রেল স্টেশন ও প্রায় ৮ বর্গমাইল এলাকা মুক্তিবাহিনীর পাকিস্তানী সৈন্যের কবল থেকে উদ্ধার করেছেন। এ রণাঙ্গনে ৫ জন পাকিস্তানী সৈন্য ৮ জন রাজাকার ও আটজন পাকিস্তানের রেঞ্জার মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দী হয়।
বাংলাদেশের ২৪ বছরের ইতিহাস
জনাব মান্নান কর্তৃক কার্টুন প্রদর্শনীর উদ্বোধন
(কলকাতা প্রতিনিধি প্রেরিত)
বাংলাদেশের কার্টুন শিল্পী সৈয়দ আব্দুল মতিনের ব্যঙ্গচিত্রের একটি একক প্রদর্শনী কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে শুরু হয়েছে।
জয়বাংলা সাপ্তাহিক-এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি এবং বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পার্লামেন্ট সদস্য জনাব আব্দুল মান্নান প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। প্রদর্শনীতে যোগদানের জন্য জনাব মান্নান, পার্লামেন্ট সদস্য জনাব জিল্লুর রহমান, মিস রাফেয়া আক্তার ডলি মুজিবনগর থেকে কলকাতায় আসেন।
শিল্পী সৈয়দ আব্দুল মতিন বাংলাদেশের ২৪ বছরের সংগ্রামের ইতিহাসে ছবিতে চিত্রিত করেছেন।
উদ্বোধনী ভাষণে জনাব আব্দুল মান্নান বাংলাদেশের এক কোটি শরণার্থী কে ভারতে আশ্রয় দান এবং ভরণপোষণের ব্যবস্থা এবং বাংলাদেশের সরকারের প্রতি ভারতের সরকার ও জনগণের নৈতিক সহায়তা দানের জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
পার্লামেন্ট সদস্য জনাব মান্নান বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস বিবৃতি করে তিনি আমাদের এই জীবন মরণ সংগ্রামে পৃথিবীর প্রতিটি দেশ এবং জনগণের সর্বাত্মক সমর্থন ব্যাখ্যা করেন। কোন দেশের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন যে, পৃথিবীর যে কয়টি দেশ আজ পর্যন্ত আমাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেনি তাদের সহানুভূতিও অচিরেই আমরা পাব বলে আশা রাখি। একদিন না একদিন সে সব দেশ তাদের ভুল বুঝতে পারবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
জনাব মান্নান বক্তৃতা প্রসঙ্গে যেসব দেশ আমাদের নৈতিক ও বৈষয়িক সাহায্য দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তিনি সেসব দেশ এবং দেশের জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
প্রত্যয় দৃঢ় কণ্ঠে জনাব মান্নান ঘোষনা করেন যে, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশের ঘোষিত স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য শেষ হানাদার বাহিনী নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত বীরের মতো লড়েই যাবে। আমরা আমাদের প্রতিটি রক্তবিন্দু জন্য প্রতিশোধ গ্রহণ করবো এবং করছি।
বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উদ্যোক্তা এবং আমাদের মহান রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আশু মুক্তির দাবি জানান। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের মহানায়ক শেখ মুজিবুর ইয়াহিয়ার কারাগার থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব সমগ্র গণতান্ত্রিক বিশ্বের।
তিনি বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত নীতির পুনরুল্লেখ করে বলেন, আমাদের আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ধর্মনিরপেক্ষতা সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা।
জনাব মান্নান আরো বলেন, জল্লাদ ইয়াহিয়া তার পৈশাচিক কাজ কর্ম দ্বারা বিশ্বসভ্যতা, গণতন্ত্র, মানবতা, বিশ্ব শান্তি এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতি বিদ্রুপ করেছে। এই জানোয়ারকে নিবৃত্ত করার দায়িত্ব শুধু বাংলার মানুষের নয়, সারা পৃথিবীর মানুষের।
পার্লামেন্ট সদস্য মিস রাফেয়া আক্তার ডলি তার বক্তৃতায় বলেন, বীরের এ রক্তস্রোত ওমা তারই অশ্রুধারায় প্রত্যক্ষ করে আমাদের আন্দোলনের প্রতি আপাতঃ সহানুভূতিহীন দেশও তাদের মতের পরিবর্তন করবেই।
ভারত সরকার ও জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সদস্যা বলেন, ভারত আমাদের আন্দোলনের প্রতি নৈতিক সাহায্য ও সহযোগিতা না করলে আমরা আন্দোলনের এই পর্যায়ে হয়তো উন্নীত হতাম না।
জনাব গাজীউল হক বক্তৃতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি সঠিক সমর্থন দানের জন্য প্রত্যেকটি দেশের প্রতি আবেদন জানান।
অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র পরিষদের সভাপতি শ্রী সুব্রত মুখার্জি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংরক্ষণের সংগ্রামের প্রতি ভারতীয় জনগণ ও সরকারের একাত্মতার বিষয়ে পুনরায় উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংগ্রামকে বিশ্বের কোন দেশ কি দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করছে তা দেখে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের নীতি প্রণীত হয় নি এবং হবে ও না। ভারত গণতন্ত্রের পূজারী বলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানাচ্ছে এবং জানাবে।
দালাল খতম চলছে চলবে
ঢাকা, ২৩শে নভেম্বর। -সম্প্রতি একজন বিদেশী সাংবাদিক মিস্টার ক্লেয়ার হলিংওয়ার্থ পাকিস্তান সামরিক সরকারের গোপন সূত্র উদ্ধৃত করে বলেছেন, শহর গুলোতে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধাদের তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন দৈনিক কমপক্ষে ২০ জন হানাদার জন্য প্রাণ হারাচ্ছে।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা হানাদার ও তাদের তাবেদার দালালদেরকে যুগপৎ খতম করেছিলেন।
এবিসির (অস্ট্রেলিয়া ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন) এক খবরে মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী বীর যোদ্ধারা গত ১৮ই নভেম্বর দখলীকৃত চাটগাঁ বেতারের সহকারি আঞ্চলিক পরিচালক কে প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করেন। এর আগে ঢাকা বেতারের জনৈক সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার কে প্রকাশ্য দিবালোকে পাকিস্তানি সৈন্যদের করাসহ গানের মধ্যে গ্রীনরোডের পথের উপর হত্যা করা হয়। এই আক্রমণ কালে ওই ইঞ্জিনিয়ার এর পার্শ্ববর্তী অন্য দু’জন কেও গুরুতরভাবে আহত করেন।
গত ১১ই নভেম্বর আমাদের বীর সেনানীরা ২৪ ঘন্টার মধ্যে দখলীকৃত ঢাকা শহরের চারিদিকে ব্যাপকভাবে আক্রমণ চালিয়ে কমপক্ষে ৮ জন বেইমান কুখ্যাত দালালকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধারা আরেকটি সফল আক্রমণ চালান বায়তুল মোকাররমে। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের সংবাদ পরিবেশন করে ঢাকা বেতার কেন্দ্র জানাচ্ছে যে, গেরিলা যোদ্ধারা অতন্ত সন্তর্পনে বায়তুল মোকাররমের সম্পর্কে কতিপয় দালাল এর পার্ক করা মোটর গাড়ির সাথে বোমা লাগিয়ে রাখেন এবং সময়মতো বোমা বিস্ফোরিত হলে উক্ত এলাকায় এক ভয়াবহ দৃশ্যের অবতারণা হয়। এই আক্রমণে ৫ জন নিহত এবং ৩৬ জন গুরুতর আহত হয়। এছাড়া খানসেনা তাবেদারদের কয়েকটি গাড়ি বিনষ্ট হয়।
ঐদিন অপর স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা দুর্বার আক্রমণ চালিয়ে একজন দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদসহ অপর তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে।
একই দিনে গেরিলা যোদ্ধারা একটি কলেজ ও একটি সরকারি বালিকা বিদ্যালয় বোমা আক্রমণ চালিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। এখানে উল্লেখযোগ্য পাকিস্তানের জানোয়ার সৈন্যরা এখানে অবস্থান করছিল।
মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের পরিণতি
উপকথার মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের গল্প সকলেরই জানা। এই মিথ্যাবাদী বালক দিনরাত কেবল চিৎকার করত, বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে। গ্রামবাসীরা ছুটে এসে দেখতো, বাঘ আসেনি। বালকটি তাদের সঙ্গে তামাশা করেছে। ফলে তারা বিরক্ত হয়ে চলে যেত। একদিন সত্যসত্যই যেদিন বাঘ এলো, সেদিন মিথ্যাবাদী রাখাল বালক বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে বলে
অনেক চেঁচালো। কিন্তু কেউ এগিয়ে গেল না রক্ষা করতে।
পাকিস্তানের বর্বর জঙ্গী চক্রের নেতা ইয়াহিয়ার অবস্থাও আজ এই মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের মতো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় থেকেই ইয়াহিয়া এবং তার জয়ঢাক গুলো তার স্বরে চেঁচাচ্ছে, ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করেছে, এবং বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছে ভারতীয় চর ও অনুপ্রবেশকারী। ইয়াহিয়া চক্রের চিৎকারে প্রথম থেকেই অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে ছিলেন। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধিরা এসেছেন ভারত এবং পাকিস্তানে। ফিরে গিয়ে তারা বলেছেন ইয়াহিয়া মিথ্যাবাদী। ভারত কোথাও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায় নি। বরং পাকিস্তানি হানাদারের অত্যাচারে এক কোটির মত শরণার্থী ভারতে পালিয়ে এসে ভারতের অর্থনীতির উপর গুরুতর চাপ সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যারা লড়াই করছে, তারা অস্ত্রবলে হানাদার পাকিস্তানিদের কাছে কিছুই নয় এবং তারা সকলেই বাংলাদেশের মানুষ কেউ ভারতীয় নয়।
কিন্তু ইয়াহিয়ার চিৎকার তাতে থামেনি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের ইয়াহিয়া চক্রের অত্যাচারের যে লোমহর্ষক বিবরণ দিয়েছেন, ব্রিটিশ এমপি এবং মার্কিন সিনেটরগন স্বচক্ষে বাংলাদেশের নিষ্ঠুর বর্বরতা প্রত্যক্ষ করে গেছেন, তারপরেও পিন্ডীর জঙ্গী চক্রের ফ্যাসিস্ট বেহায়া খাঁ চিৎকার করে বলছে, ভারত এবং ভারতীয় চোরেরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে। যদি এ কথা সত্য হয়ে থাকে, তাহলে বেহায়া খাওয়ার সেই পেশাদার ও সুদক্ষ সৈন্যরা কোথায়, যারা কেবল গুলিবর্ষণের জন্য গুলি চালায় না? গত একমাস যাবত ভারত অনুপ্রবেশকারীরা ইয়াহিয়ার রাজত্বে যুদ্ধ চালাচ্ছে আর ইয়াহিয়া ও টীক্কার মত বীরপুঙ্গব জেনারেলরা বসে বসে তা কেবল দেখছেন, এটা কোন পাগলে বিশ্বাস করবে? এই সেদিনও তো ইয়াহিয়া বড় গলায় হুংকার ছেড়েছে ‘বিশ্ব জেনে রাখুক, আমি যুদ্ধ করব। তা ভদ্রলোক যখন এত বড় যোদ্ধা, তখন ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের কচুকাটা করতে পারছেন না কেন?
আসলে মিথ্যাবাদী রাখাল বালক এখন ধরা পড়ে গেছে। বিশ্ববাসী জেনে গেছে, ভারতের হাতে নয়, ইয়াহিয়ার নরপশুরা এখন মার খাচ্ছে বাঙালি মুক্তিবাহিনীর হাতে। মার খেতে তাই ইয়াহিয়াকে মার হজম করতে হচ্ছে আর লজ্জা ঢাকার জন্য চ্যাঁচাতে হচ্ছে, ভারত তা কে মারছে। হায়রে মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের কি করুন শেষ পরিণতি!
চূড়ান্ত আঘাত ও বিজয় লাভের পবিত্র লগ্নে
জয়বাংলা। বাংলাদেশের জয় হোক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘজীবী হোন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্থায়ী ও জয়ী হোক। সকল রণাঙ্গন থেকে বহু প্রত্যাশিত বিজয়ের খবর আসছে। এ সপ্তাহের জয়বাংলা যখন পাঠকের হাতে পৌঁছাবে, তখন আমরা ইনশাল্লাহ দাবি করতে পারব, বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা এক-তৃতীয়াংশের বেশি শত্রুপক্ষের দখলে নেই। সর্বোচ্চ পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যেরা মার খাচ্ছে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রে উজ্জীবিত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ সকল জনগণের দৃপ্তপদে এগিয়ে যাচ্ছে। এই নিবন্ধ লেখার সময় খবর এসেছে যশোর ক্যান্টনমেন্ট শত্রু মুক্ত হওয়ার পথে। সাতক্ষীরা এখন মুক্ত এলাকা। গোটা খুলনা জেলা অতি দ্রুত মুক্ত এলাকা হতে যাচ্ছে। অন্যদিকে ঢাকার অদূরে মধুপুরে মুক্তিবাহিনী আবার শক্তিশালী ঘাঁটি সন্নিবেশ করেছেন। কুমিল্লার পথে মুক্তিবাহিনী এগিয়ে চলেছে। পদ্মা ও মেঘনার বুকে মুজিব নৌবহর সক্রিয়। প্রচন্ড পাল্টা আক্রমণে হানাদারের গানবোট ডুবছে। তাদের হতাহতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আকাশপথেও পাকিস্তানি বিমান আক্রমণ সাফল্যের সঙ্গে প্রতিহত করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই তিনটি হানাদার বিমান ভূপাতিত হয়েছে। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সর্বত্রই এখন মুক্তিবাহিনীর আধিপত্য।
এখন প্রশ্ন উঠবে মাত্র ৮ মাসে মুক্তি বাহিনীর পক্ষে এত বড় সাফল্য অর্জন সম্ভব হলো কি করে? গত মার্চ মাসে এবং বর্তমান নভেম্বর মাসের পরিস্থিতির মধ্যে গুণগত পার্থক্য কি? আমাদের জবাব এই গুণগত পার্থক্য যথেষ্ট। গত মার্চ মাসে বিশ্বাসঘাতক ইয়াহিয়া চক্র সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ও নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। কিন্তু তখনও দেখা গেছে নিরস্ত্র বাঙালির ঐক্যবদ্ধ অসহযোগ আন্দোলনের মুখে ভীতসন্ত্রস্ত হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে অবস্থিত তাদের বড় বড় ক্যান্টনমেন্ট গুলোতে আশ্রয় নিয়েছে এবং আক্রমণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু সর্বাধুনিক মার্কিন ও চীনা অস্ত্রসজ্জিত থাকা সত্বেও তারা নিরস্ত্র অথচ ঐক্যবদ্ধ জনগণের সঙ্গে যুদ্ধে পেরে ওঠেনি। ফলে সর্বাধুনিক বিমান বাহিনী থেকে নির্বিচার বোমাবর্ষণ দ্বারা তারা আপাতঃ সাফল্য লাভ করেছিল। কিন্তু বর্তমানে -অর্থাৎ এই নভেম্বর মাসে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। মুক্তিবাহিনী এখন অসংগঠিত ও নিরস্ত্র নয়। তাদের হাতে রয়েছে শত্রুর কাছ থেকে দখল করে নেয়া এবং বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্র। তাছাড়া মুক্তিবাহিনী এখন সম্পূর্ণ সংগঠিত। তাদের নিজস্ব নৌবহর গঠিত হয়েছে। বিমান আক্রমণ ব্যর্থ করার উপযোগী এবং পাল্টা বিমান আক্রমণ পরিচালনা উপযোগী ব্যবস্থা রয়েছে। সর্বোপরি গোটা বাংলাদেশের মানুষ এখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনীর পশ্চাতে কাতারবদ্ধ। হানাদারের সামনে, পেছনে, ডানে, বামে, উপরে, নিচে সর্বত্র মুক্তিবাহিনী। কোথায় যাবে বাছাধনেরা? অন্যদিকে যুদ্ধ করার মত মনোবল ও তাদের নিঃশেষ হয়ে গেছে। সুতরাং ঢাকা ও চট্টগ্রামের উপর মুক্তিবাহিনীর চাপ আরো প্রবল হয়ে উঠলে আতঙ্কিত হানাদারেরা প্রায় বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করলে আমরা বিস্মিত হব না।
তবু, অতি আশাবাদী না হওয়ার জন্য আমরা সকল মহলকে সতর্ক করে দিতে চাই। স্বাধীনতা অর্জনেই বড় কথা নয় এই স্বাধীনতা সংরক্ষণেই সবচাইতে বড় কাজ। স্বাধীনতার যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য আমাদের যেমন অত্যন্ত বেশি রক্ত মূল্য দিতে হয়েছে, ভবিষ্যতে স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য তার চাইতেও বেশী মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে বহু প্রত্যাশিত বিদ্যালাভের ও শত্রুর উপর চূড়ান্ত আঘাত হানার এই পবিত্র মুহূর্তে আমরা সর্বান্তকরণে খোদার দরবারে প্রার্থনা জানাই, স্বাধীন বাংলার রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দীর্ঘায়ু ও সুস্থ দেহে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য। আমরা শুধু বাংলাদেশকেই শত্রুমুক্ত করবো না, স্বাধীন বাংলার জনক কেও শত্রুর বন্দীশালা থেকে মুক্ত করতে পারব-এ জিরো পয়েন্ট নিয়ে আমাদের বিজয়ের রথ এগিয়ে চলুক পরিপূর্ন সাফল্যের দিকে।
ইতিহাস আমাদের পক্ষে
অধ্যাপক সামাদ
কথায় বলে “যুদ্ধের ভাগ্য যুদ্ধেই নির্ধারিত হয়।” কথাটার মধ্যে সত্য যে নেই তা নয়। নানা ছোটখাটো ঘটনা যুদ্ধের গতি পরিবর্তন করে দিতে পারে। কিন্তু তবু সব যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ভর করে কতগুলি বাস্তব অবস্থার উপর। যুদ্ধে জয় পরাজয় কেবলমাত্র কতগুলো আকস্মিক ঘটনার মালা গাঁথা নয়।
রুশ সাহিত্যিক টলস্টয় মনে করতেন যুদ্ধ ব্যাপারটা নানাভাবেই আকস্মিকতায় ভরা। অভাবিত ঘটনার দ্বারা নির্ধারিত হয় যুদ্ধের গতি প্রকৃতি। তিনি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ওয়ার এন্ড পিস এর মধ্যে দেখাতে চেয়েছেন কিভাবে যুদ্ধ চলে তার আপন ভবিতব্য কে অনুসরণ করে। নেপোলিয়নের অপরাজেয় ফৌজ, মস্কো শহরে ঢুকে লুটপাট আরম্ভ করলো। মস্কো শহরে যে পরিমাণ ময়দা মজুদ ছিল, তাতে নেপোলিয়নের ফৌজরা খেতে পারতো ছয় মাস। কিন্তু লুটপাট করবার হুজুগে সৈন্যদের পায়ের পাড়ায় এই ময়দার একটা বিরাট অংশ মিশে গেল মস্কো শহরের কাদায়। অর্ধেক লুটপাট করার সময় মস্কো শহরে লাগলো আগুন। মস্কো শহরের অধিকাংশ বাড়ি তখন ছিল কাঠের। মস্কো শহর গেলো পুড়ে। মস্কো শহরের দারুণ শীতে খাদ্য ও বাসস্থানের অভাবে নেপোলিয়নের অপরাজেয় ফৌজ হয়ে পড়ল কাহিল। আরম্ভ হলো পরাজয়ের পালা।
এখন যেসব রুশ ঐতিহাসিক তাদের দেশের ইতিহাসের ভাষ্য দেন, তারা অবশ্যই এই দৈব ব্যাখ্যা স্বীকার করেন না। তারা বলেন, মস্কো শহরে আগুন লাগিয়ে ছিল রুলস দেশপ্রেমিকরা। তারা এর পেছনে অনেক প্রমাণ ও দেখাতে চান। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও রুশ নাগরিকদের দেশ প্রেম ছিল নেপোলিয়নের অপরাজেয় বাহিনীর পরাজয়ের কারণ। নেপোলিয়ন ছিলেন বিরাট সেনাপতি। তার বাহিনী ছিল খুবই সুশৃংখল। কিন্তু ইউরোপে তার যুদ্ধ জয়ের পিছনে কেবল তার রণকৌশলতা ছিল না। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জনসাধারণ ভাবতো তাদের নিজের দেশের রাজা চাইতে নেপোলিয়ন অনেক ভালো। নেপোলিয়ন তৈরি আইন-বিধি তাদের মঙ্গল করবে। তাই তারা কার্যত সমর্থন করত নেপোলিয়ন কে। কিন্তু রুশরা এই মনোভাব দেখায়নি নেপোলিয়ন সম্পর্কে। তারা লড়াই করেছিল জার এর পক্ষ নিয়ে। তারা এই যুদ্ধকে গ্রহণ করেছিল রাশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে। রুশ বিপ্লবী নেতা লেনিন নেপোলিয়ন ও জারের মধ্যকার যুদ্ধকে রাশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।
গত মহাযুদ্ধে রণক্ষেত্রে হিটলারের বাহিনীর পরাজয়ের কারণ ও ছিল রাশিয়ার ভৌগোলিক পরিবেশ ও রুশ নাগরিকদের দেশ প্রেম। যুদ্ধের ভাগ্য যুদ্ধই নির্ধারিত হয়, একথা অনেক পরিমাণে সত্য হলেও তাই বলতে হয়, দূর বিদেশে প্রতিকূল পরিবেশে, দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে যুদ্ধে জেতা সহজ নয়। যুদ্ধের ইতিহাসে এ শিক্ষাই বিশেষ ভাবে দিয়ে থাকে।
সেনাপতি ইয়াহিয়া খান যখন বাঙালীদের ওপর পাকবাহিনীকে আক্রমণ চালাতে নির্দেশ দিয়ে ঢাকা পরিত্যাগ করেন, তখন তিনি রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঢাকার দূরত্ব কথা চিন্তা করেননি। ভাবতে পারেনি, এ বাঙ্গালীদের দেশপ্রেমের কথা। তিনি ভেবেছিলেন পাক ফৌজের সামরিক কুশলতা ও শক্তি, কৃষকের জাত বাঙালিকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরাভূত করতে পারবে। সব শেষ হয়ে যাবে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। তারা মনি কথা ভাববার মূলে আর ও একটি কারণ ছিলঃ জুলফিকার আলী ভুট্টো ও আরো অনেক তথাকথিত বামপন্থী তাকে বুঝিয়ে ছিলো, বাঙালি জাতীয়তাবাদ কেবল বাঙালি মধ্যবিত্ত ও কিছু বাঙালি সরকারি কর্মচারীর ব্যাপার। এদের বাস শহরে। শহরগুলিকে দখলে রাখতে পারলেই বিশেষ করে ঢাকা শহরের ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই এই আন্দোলনের সব নেতৃত্ব নষ্ট হয়ে যাবে। থেমে যাবে সব আন্দোলন ও প্রতিরোধ। তাদের এই ব্যাখ্যাটাই ছিল ভুল। কারণ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল সমগ্র বাঙালি জাতির ব্যাপার। যে জাতীয়তা গড়ে উঠেছে ইতিহাসের ধারায়, নির্দিষ্ট ভৌগলিক পরিবেশে, বিশিষ্ট সংস্কৃতি, ভাষা ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে ঘিরে। এটা কোন একটা বিশেষ শ্রেণীর ব্যাপার নয়-এটা গোটা জাতির ব্যাপার। একটা সমগ্র জাতি তাই ঝাঁপিয়ে পড়ল যুদ্ধে। তারা তাদের নেতার কথা অনুসারে এগিয়ে এলো মৃত্যুপণ করে।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস লিখতে গিয়ে ঐতিহাসিকরা বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ও বাঙালির দেশপ্রেমের উপর অধিক গুরুত্ব দেবেন। কারণ, এই দুটি ঘটনাই নিয়ন্ত্রিত করছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ধারাকে।
যুদ্ধ এখনো চলছে। কিন্তু যুদ্ধের গতি কী হবে তা এখন অনুমান করতে আর অসুবিধা নেই কিছু। এ যুদ্ধের ইতিহাস আজ বাঙালির পক্ষে।
বঙ্গবন্ধুর বাণী
“যে জাতি রক্ত দিতে জানে তারা কখনো পরাজয় হয় না। বাঙালি রক্ত দিতে শিখেছে, তারও পরাজয় হতে পারে না। আমি চাই সর্বপ্রকার শোষণ, শাসন, বিচার ও অত্যাচারের অবসান। আর এ রায়ের বিরুদ্ধে আমাদের অবিরাম সংগ্রাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই সংগ্রাম জয়যুক্ত হবেই।”
সমগ্র বাংলাদেশ ব্যাপি মুক্তি বাহিনীর বিজয় অভিযান অব্যাহত
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সমগ্র বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে ব্যাপক ভাবে হানাদার সৈন্য খতম করেন।
ময়মনসিংহে দুর্বার আক্রমণ
গেরিলা যোদ্ধারা ময়মনসিংহ যশোর এলাকায় সরকারি গুদামে আগুন লাগিয়ে দেন। ফলে তখন তাদের ৮ হাজার মণ পাট ভষ্মিভূত হয়।
ময়মনসিংহ রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সৈন্যরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। আরো সৈন্য সরবরাহের জন্য বেতার যোগে ক্যান্টনমেন্টে আবেদন করে শত্রু সৈন্যরা বার্তা পাঠায়। মুক্তিবাহিনী এই বার্তার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হন।
ময়মনসিংহের একটি এলাকাতে গেরিলা যোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণে ৬৮ জন দস্যু সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই সফল আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্যদের চারটি অতিকায় মোটর, গানবোট ও বিপুল সংখ্যক অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিবাহিনী দখল করেন।
নোয়াখালী থেকে জয় বাংলার নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন যে, গত ২৯শে কতবার স্বাধীনতাকামী দুঃসাহসীক যোদ্ধারা ফেনীর বিলোনিয়া তে একটি সাফল্যজনক চোরাগুপ্তা আক্রমণ চালিয়ে ১২ জন হানাদারকে নিশ্চিহ্ন করে দেন। এ আক্রমণে হানাদার সেনাদের একজন পদলেহী রাজাকারকে জীবন্ত ধরে আনেন।
উক্ত দিন গেরিলা যোদ্ধারা ফুলগাজীতে শত্রু ঘাঁটির উপর ত্রিধারা সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে দখলদার সৈন্যদের ৩০ জনকে নিহত করেন। নোয়াপুরী অপর এক আক্রমণে ছয়জন খান সেনাকে নিশ্চিহ্ন এবং একটিবার ধ্বংস করেন।
গত ২রা নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী বীর যোদ্ধারা নোয়াখালী রামগঞ্জ থানার সাহাপুরে এক প্রচণ্ড হামলা চালিয়ে তিনজন শত্রুকে নিহত করেন।
যশোর বিদ্যুৎ সরবরাহ রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন
যশোর জেলার চুড়ামনকাটিতে গত ৩রা নভেম্বর উড়িয়ে দিয়ে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। মুক্তিবাহিনীর সামরিক দপ্তর এর প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, দখলীকৃত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা খান সেনাদের ওপর প্রচণ্ড চাপ অব্যাহত রেখেছেন।
গত ২রা নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী বীর যোদ্ধারা রেললাইন ধ্বংস করে দিয়ে যশোর জেলার চুড়ামনকাটির রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন।
খুলনায় গেরিলা যোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণ
গত ১০ই নভেম্বর খুলনা জেলার বেতগাছী খান সেনাদের সঙ্গে গেরিলা যোদ্ধাদের এক প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। ফলে পাঁচজন প্রতিপক্ষের সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এর আগে ৮ই নভেম্বর হানাদার সৈন্যরা কৈখালী এলাকায় মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটির ওপর আক্রমণের দুঃসাহস দেখালে আমাদের বীর যোদ্ধারা এর ঘাড় ভাঙ্গা জবাব দেন। তাহলে দুইজন শত্রুসৈন্য নিহত এবং বহু সংখ্যক আহত।
গোপালগঞ্জে ৫০ জন শত্রুসেনা নিহত
অন্য এক খবরে প্রকাশ, গত মাসের শেষ সপ্তাহে গোপালগঞ্জ কাশিয়ানী থানাধীন ফোকুরাতে আমাদের দুর্ধর্ষ সৈন্যদের আক্রমণে ৫০ জনের অধিক খানসেনা ও ১৫ জন রাজাকার প্রাণ হারায়। গত ৭ই নভেম্বর শাহপুরায় মুক্তিযোদ্ধারা ৩ জন রাজাকার অস্ত্রশস্ত্রসহ বন্দী করেন।
এই কসাইদের হত্যা করতে হবে
যশোরের শত্রুকবলিত এলাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, গত ৮ই নভেম্বর ভোরে যশোর জেলার বাঘারপাড়া থানার অন্তর্গত চৈত্র বাজারে বহু শরণার্থী রাজাকারদের হাতে হতাহত হয়।
খবরে প্রকাশ, বরিশাল ও ফরিদপুর থেকে প্রায় চার হাজার হিন্দু-মুসলমান পশ্চিমবাংলায় আশ্রয় গ্রহণের উদ্দেশ্যে বনগাঁ সীমান্তের দিকে আসছিল। পথিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় তারা চৈত্র বাড়ি বাজারের স্কুল ময়দানে আশ্রয় নেয়।
৮ই নভেম্বর ভোরের দিকে খাজুরা রাজাকার ক্যাম্প থেকে মুসলিম লীগ গুন্ডা ডক্টর ইব্রাহিম এর নির্দেশে একদল রাজাকার এসে শরণার্থীদের ঘিরে ফেলে। তাদের সাথে যোগ দেয় কটুয়া কান্দির হাবিব, উত্তর চাঁদপুরের দলিল উদ্দিন মোল্লা, সমিন ও দাউদ, হলিহট্টের ইন্তাজ শেখ, তাহের মীর ওরফে মটুক, পদ্মবিলার নুরুল মীর এবং নরসিংহপুরের জয়নাল, সদর ও বন্দর প্রমুখ গুন্ডা।
রাজাকার নামধারী এই গুন্ডার দল চারিদিক ঘিরে শরণার্থীদের জনে জনে তল্লাশি করে, তাদের সমস্ত টাকা-পয়সা ও অলংকারাদি ছিনিয়ে নেয়। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মতে তারা শরণার্থীদের কাছ থেকে নগদ ও অলংকারাদিতে দু লাখ টাকার মতো ছিনিয়ে নেয়।
অতঃপর গুন্ডারা শরণার্থীদের নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু তারা এই বলে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায় যে স্থানীয় মিলিটারি ও রাজাকাররা তাদের সমস্ত বাড়ি ঘর ভষ্মিভূত করে ফেলেছে এবং তাদের সমস্ত জিনিসপত্র ও গরু-বাছুর পর্যন্ত লুট করে নিয়েছে।সুতরাং তারা বাড়ি ফিরে যাবে না। এরপর গুন্ডারা তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। যার ফলে প্রত্যক্ষদর্শীর মতে শতাধিক নিরীহ শরণার্থী প্রাণ হারায়। শেষ পর্যন্ত শরণার্থীরা নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হয়। খবরে আরো প্রকাশ, রাজাকাররা কয়েকটি তরুণ সুদর্শনা শরণার্থী মেয়েকে খাজুরা রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং বর্তমানে তারা সেখানে পূর্বোল্লিখিত ইব্রাহিমের গৃহে আটক রয়েছে।
মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে আরও তিনটি বিদেশি জাহাজ ঘায়েল
সম্প্রতি একটি গ্রীক জাহাজসহ মুক্তিবাহিনীর দুর্জয় সেনাদের আক্রমণে গত ৪ঠা থেকে ২১ই নভেম্বরের মধ্যে আরও তিনটি বিদেশি জাহাজ ঘায়েল হয়েছে। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সরবরাহকারী জাহাজ রয়েছে। মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা এই জাহাজটি গত চৌঠা নভেম্বর একটি মাইনের সাহায্যে বিধ্বস্ত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য সংস্থার কর্মচারীরা এই সংবাদ স্বীকার করেছেন। তারা এ কথাও বলেছেন যে, জাহাজটিতে নাকি জাতিসংঘের পতাকা উড়ছিলো।
মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা অভ্যন্তরের যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং নৌযান ধ্বংস করে দেওয়ার ফলে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে বিদেশ থেকে পাওয়া বিপুল পরিমাণ সরবরাহ দ্রব্যাদি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্বয়ং মার্কিন বৈদেশিক সাহায্য সংস্থার জনপ্রতিনিধি উপরোক্ত তথ্য প্রকাশ করে বলেছেন, বন্দরগুলোতে মাল খালাস করতে না পারার ফলে বহু জাহাজ আটকা পড়ে গেছে এবং পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষকে দৈনিক তিন লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা ডেমারেজ দিতে হচ্ছে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের দুস্থ মানুষের নাম করে বিদেশ থেকে আনা সাহায্য সামগ্রী পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী আত্মসাৎ করে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিরুদ্ধে এবং বাঙ্গালীদের নিধন করার কাজে ব্যবহার করছে।
প্রমাণ স্বরুপ, পাকহানাদার বাহিনীর কাছ থেকে এই ধরনের যে সমস্ত বৈদেশিক ও জাতিসংঘের সাহায্য সামগ্রী আমাদের মুক্তিবাহিনী দখল করেছিল ইতিপূর্বে তার ছবিও পত্র পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছে।
অপর জাহাজটি একটি ব্রিটিশ মালবাহী জাহাজ। জাহাজটি চালনা বন্দরের অদূরে সমুদ্রের বুকে মুক্তিবাহিনীর নৌ যোদ্ধাদের গোলায় ঘায়ে ক্ষতিগ্রস্থ অবস্থায় কলকাতায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। জাহাজটির নাম সিটি অফ সেন্ট এলবানস্। জাহাজটি চালনা বন্দর থেকে বাংলাদেশের পাট বোঝাই করে নিয়ে যেতে এসেছিল। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর নৌসেনাদের আক্রমণে বন্দরে ভিড়তে পাড়া তো দূরের কথা, গোলার ঘায়ে বিক্ষত অবস্থায় পালাতে পথ পায় নি।
জাহাজটির পোর্ট এবং স্টারবোর্ড উভয় দিকেই বিরাট বিরাট গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। জাহাজটি এখন মেরামতের জন্য কলকাতার কয়লা ডাক নোঙর করে আছে।
গত ১০ই নভেম্বরের সকালে কলকাতা কিং জর্জ ডক থেকে জাহাজটি চালনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল। কিন্তু ১১ই নভেম্বর চালনা বন্দরের কয়েক মাইল দূরে সমুদ্রের বুকে থাকতেই মুক্তিবাহিনীর নৌযান কর্তৃক আক্রান্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জাহাজ থেকে এমন অবিরল ধারায় গোলা ও মেশিনগানের গুলি বর্ষিত হতে থাকে যে, কারো পক্ষে বাইরে বেরিয়ে আক্রমণকারীদের লক্ষ্য করাও সম্ভব হয়নি। ক্যাপ্টেন এর আদেশে জাহাজটির মুখ পুনরায় দ্রুত কলকাতার দিকে ঘুরিয়ে নেয়া হয় কিন্তু তার মধ্যে আরো কয়েকটি গোলা ষ্টার বোর্ডের দিকে এসে পড়ে। মুক্তিবাহিনীর জাহাজ এরপর প্রায় ৪৫ মিনিট যাবত্ সিটি অফ সেন্ট এলবানস্ এর পশ্চাদ্ধাবন করে। জাহাজের নাবিকরা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করায় কেউ আহত হয়নি, শুধু একজন নাবিকের দেহের কয়েক জায়গায় সামান্য ছড়ে যায়।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য নৌযুদ্ধে গেরিলা বাহিনীর তৎপরতা শুরু হবার পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের ১৭টি জাহাজ বাংলাদেশ নৌবাহিনী ডুবিয়ে দিয়েছে।
শিল্প ও সংস্কৃতি
পাটনায় বাংলাদেশের উপর আলোকচিত্র প্রদর্শনী
বাংলাদেশ পাক বর্বরতা, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রগতি ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দের আলোকচিত্র এক প্রদর্শনীর পাটনা শহরে সম্প্রতি আয়োজন করা হয়।
পার্টনার জনসাধারণ বিপুল সংখ্যায় এই প্রদর্শনী দেখতে আসেন। প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের মানুষ সম্বন্ধে পাটনার অধিবাসীদের জানবার ও বুঝবার আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় খুব বেশি। বাংলাদেশের প্রতিবেশী বিহার। তার সাথে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক যোগাযোগ বহুদিনের। পাকিস্তান হবার আগে বিহারের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ও ছিল। বিহার থেকে বহু লোক প্রতি বছর আসতো বাংলাদেশে কাজ করতে। বিহারের সাথে বাংলাদেশের সম্বন্ধে ছিল মধুর। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাই বিহার বাসীর মনে জানবার আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। আর এই কথাই প্রমাণিত হলো পাটনাতে বাংলাদেশ আলোকচিত্র প্রদর্শনী থেকে। মুজিবনগর থেকে এই প্রদর্শনীর আয়োজন এর কাজে সাহায্য করতে চান অধ্যাপক সামাদ। পাটনাতে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে অধ্যাপক সামাদ বলেন, শীঘ্রই বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে পাক ফৌজের কবলমুক্ত হবে। অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীনভাবে টিকে থাকবার কোন অসুবিধা নেই। বাংলাদেশের সম্পদকে কাজে লাগিয়ে বাংলার মানুষ সাচ্ছন্দময় জীবন যাপন করতে পারবে। পশ্চিম পাকিস্তানের উপর অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ নির্ভরশীল ছিল না। বরং বাংলাদেশের সম্পদেই গড়ে উঠেছে পশ্চিম পাকিস্তান।’
ঘোলা জলের খেলা
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র মিস্টার ব্রে গত ১৬ই নভেম্বর ওয়াশিংটনে বলেছেন, সীমান্ত উত্তেজনা হ্রাসের জন্য ভারত ও পাকিস্তান যেকোনো ব্যবস্থা গ্রহণের রাজি হলে তাকেই মার্কিন প্রশাসন সমর্থন করবে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রশ্নটি নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ে যাবার প্রশ্নে মার্কিন মনোভাব কি সে বিষয়ে তিনি সরাসরি মন্তব্য করেননি।
মিস্টার ব্রে তার বিবৃতিতে বলেছেন, স্পষ্টতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আশা করছে যে পূর্ববঙ্গ সমস্যা সম্পর্কে মতৈক্য হবে, তবে সে বিষয়েও মার্কিন কর্তৃপক্ষ কোনো সূত্র উপস্থিত করবে না।
তিনি আরো বলেছেন, যেখানে সম্ভব মার্কিনরা গঠনমূলক ভূমিকা নেবে তবে তা প্রকাশ্যে নেবে।
রাতের বেলায় সারা বাংলাদেশে কায়েম হয় মুক্তিবাহিনীর কর্তৃত্ব
ঢাকা থেকে মার্কিন সাপ্তাহিক নিউজ উইক এর বিশেষ প্রতিনিধি সিনিয়র সম্পাদক আর নো দ্য বোরচাগ্ৰাফ বাংলাদেশের অবস্থার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা খুবই নির্ভরযোগ্য ও বিশ্ববাসীর কাছে তা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা বিশেষ ভাবে তুলে ধরবে। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এর উপর এখন মুক্তিবাহিনীর সুদৃঢ় কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়েছে। পাকসেনারা এগিয়ে চলেছে ধ্বংসের পথে। সারা বাংলাদেশে এখন এক লক্ষের উপর গেরিলা সৈন্য খানসেনাদের খতম করার কাজে নিয়োজিত। চরম আঘাত হেনে শত্রুকে ধরাশায়ী করবার সময় আজ সমাগত। সারা বাংলাদেশের মানুষ আজ বলছে, আমরা প্রতিশোধ চাই। ঘরে ঘরে আজ সত্যই দুর্গ গড়ে উঠেছে। অবিচল বাঙালি আজ যুদ্ধ করছে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের সত্তাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য। জয়ের চরম লগ্ন আজ এসে দাঁড়িয়েছে তাদের প্রান্তে। বাঙালি অনুভব করছে বিজয় লক্ষ্মীর হাতছানি।
সাংবাদিক বোরচা লিখেছেনঃ আমিও লন্ডন ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক ক্লার হোলিং ঢাকা থেকে পাঁচ মাইল দূরে মুক্ত অঞ্চলে গিয়েছিলাম। স্বাধীনতা যোদ্ধাদের সদরদপ্তরে আমরা দেখতে পেলাম, যোদ্ধারা প্রকাশ্যেই তাদের আস্তানার চারধারে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র পরিষ্কার করছে। ওদের কোন ভয় নেই পাক ফৌজ এর জন্য। প্রত্যেকে ওরা পরস্পরের সাথে কথা বলছিল সাধারণ কণ্ঠস্বরে। গেরিলা নেতা আব্দুল মান্নান আমাদের বলেন জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা তাই ভয় পাই না । ফৌজ আসছে এই খবর পৌঁছে যা আমাদের কাছে। যথাসময়ে জনসাধারণ আমাদের হুঁশিয়ার করে দেয় পাক ফৌজ এর আগমন সম্পর্কে। আমরা কেউই এখন পাসফৌজের কোন আক্রমণের আশঙ্কা করছি না। মান্নানের বয়স ৪৩ বছর। এক সময় সরকারি চাকুরে ছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি এই মুক্ত এলাকার পনের হাজার লোকের শাসন পরিচালক ও গেরিলা নেতা। মান্নান বলেন, “পাক সামরিক বাহিনীর এখানে আসবার সাহস নেই। আমরা ইচ্ছা করলে যেকোনো জায়গায় যেতে পারি। দিনের আলোতেই যেতে পারি।”
সন্ধ্যায় মান্নানের সাথে ভাত খেতে খেতে আমাদের আরো অনেক কথা হয়। মান্নান বলেন, ক’দিন আগে আমরা এক ট্রাক পাক ফৌজকে খতম করেছি। ১৯ জন সৈন্য ছিল ট্রাকে। আমাদের ডুবুরিরা ক্যাপ্টেন কে এম শাহজাহানের নেতৃত্বে দুটি পাক সামরিক জলযান ডুবিয়ে দিয়েছে। ২৫ বছর বয়সের কমান্ডো নেতা কথার মধ্যে পাক হুচকে বিদ্রুপ করে বলে ওঠেন ‘ওরা কাপুরুষ। ওদের মতো ভীতু সৈনিকের কথা কল্পনা করা যায় না। আমরা যদি নদীর এপার থেকে একটা ফাঁকা আওয়াজ করি তবে ওরা নদীর অপর পাড়ে যেয়ে আশ্রয় নিতে চায়। আর তখনই ওরা গিয়ে পড়ে নদীর অপর পারে আমাদের লুকিয়ে থাকা অন্য গেরিলা দলের হাতে। সব খতম হয় ওরা….. গেরিলারা গর্ব করে” বলেন ক’দিন আগে ওরা ৩১ জন পাক ফৌজ রাজাকারকে জ্যান্ত ধরে ফেলেন এবং পরে তাদের গুলি করে মারেন। শত্রুসৈন্যকে বন্দি করে রাখবার মতো কোন সঙ্গতি নেই আমাদের। তাই গুলি করে মারতে হয় আমাদের যুদ্ধবন্দীদের। তবুও রাখতাম যদি ওরা আমাদের ধৃতদের অমনভাবে গুলি করে হত্যা না করত।”
মান্নান আমাদের বুঝিয়ে বলেন,”গত নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ছিলাম আমরা। কিন্তু ইয়াহিয়া সেই ভোটের বিজয়কে করে পদদলিত। সামরিক বাহিনী আমাদের উপর চালায় অকথ্য অত্যাচার। আমরা এখন মরিয়া হয়ে উঠেছি। শত্রুর অত্যাচার আমাদের করে তুলেছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমরা যুদ্ধ করছি পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন জাতি, একটি নতুন দেশ গড়বার জন্য”। নিউজ উইকেট খ্যাতনামা সাংবাদিক আরো লিখেছেনঃ
“পাকিস্তান সেনাবাহিনী একসময় গোলাবারুদ ও অস্ত্রে গেরিলাদের চাইতে বহুগুন শক্তিশালী ছিল। কিন্তু এখন এই শক্তির ক্ষয় এর পথে। তারা আর এদিক থেকে গেরিলাদের চাইতে উচ্চমান সম্পন্ন নয়। বিশেষ করে পাকিস্তানের ভরসা ছিল, আমেরিকার আজ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাবে। তাই তার অস্ত্র ও গোলাবারুদের ঘাটতি হবে না।কিন্তু আমেরিকার সামরিক সাহায্য বন্ধ করায় পাক রণসজ্জায় দারুন আঘাত লেগেছে।
বাংলাদেশের এখন সব সরকারি কর্মচারী, গ্রামের মোড়ল, সকলে গোপনে সাহায্য করছে মুক্তিবাহিনীকে। কমপক্ষে বাংলাদেশের চারভাগের একভাগ অঞ্চলে এখন পুরোপুরি মুক্তিবাহিনীর প্রশাসন চালু হয়েছে। যাদের বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলের অধিকাংশ জায়গাতেই চলে যায় গেরিলাদের অধিকারে। এখন খেয়াঘাটে ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে কদাচিৎ পাক ফৌজ চোখে পড়ে। শহরগুলোর বাইরে সাধারণতঃ পাক ফৌজরা এখন খুব কমই টহল দিয়ে বেড়ায়।
পাক সামরিক বাহিনীর নানা অত্যাচারের কাহিনী আমি শুনেছি। এটি গ্রামে দশ বছরের একটি মেয়ের উপর বলাৎকার করে ১২ জন পাক সৈন্য। তারপর তাকে হত্যা করে তারা। এক গ্রামে সৈন্যরা গিয়ে দুজন যুবতী মেয়ে দাবি করে। গ্রামবাসী জানায় ফৌজি বড় কর্তা কে। দুজন ফৌজকে ধরে নিয়ে যাওয়ার আদেশ হয়। পরদিন সেনাবাহিনীর লোক এসে পুড়িয়ে দেয় সারা গ্রামটাকেই। ৩৮ জন লোক নিহত হয় এই ফৌজি হামলায়।
যেখানে আমি গিয়েছি মুক্তিবাহিনীর লোক ও সমর্থকরা সর্বত্রই বলছে, শেষে চূড়ান্ত বিজয়ের দিন ঘনিয়ে এসেছে। একটা নদীর খেয়া ঘাটে দেখতে পেলাম একজন পাক-সামরিক কর্মচারী একজন সাধারন লোককে ছড়ি দিয়ে পিটাচ্ছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে মার বন্ধ করেন অফিসারটি। পরে সেই মার খাওয়া লোকটি আমাকে বলেছিলঃ রোজ রোজ এমনি অনেক ঘটনাই ঘটে। কিন্তু প্রতিশোধের দিন আসছে। আজ সেদিনটা ওদের পক্ষে হবে ভয়ঙ্কর।”
(নিউজ উইক, নভেম্বর ২২, ১৯৭১)
মাতম
মনি মুজিবনগরে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের মৃত্যুঞ্জয় মুক্তিবাহিনীর হাতে ইয়াহিয়ার দস্যু বাহিনীর বিপুলসংখ্যক অফিসার নিহত হওয়ার পর সম্প্রতি বারোশ’ নতুন অফিসার রিক্রুট করা হয়েছে।
কিছুদিন আগে কাশ্মীর সীমান্ত পেরিয়ে মুক্তাঞ্চলে আগত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারির জনৈক বাঙালি মেজর বলেন যে, জোয়ান ছাড়াও সৈন্য বাহিনীর বিপুল সংখ্যক অফিসার নিহত হওয়ার পর তড়িঘড়ি করে বারোশো অফিসারকে রিক্রুট করা হয়েছে।
মুক্তাঞ্চলে পালিয়ে আসার আগে এই বাঙালি মেজরকে নিরস্ত্র করে রাওয়ালপিন্ডির সামরিক সদর দপ্তরে কঠোর প্রহরাধীনে কেরানীর কাজ করতে দেওয়া হয়েছিল।
এই মেজর বলেন যে, স্বাভাবিক সময় হলে এই বারোশো যুবকের মধ্যে কমপক্ষে দুই তৃতীয়াংশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের অযোগ্য বলে বিবেচিত হতো।
তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানী মা-বাবারা ইয়াহিয়ার যুদ্ধ উন্মাদনা শিকার হতে সন্তানদের সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করার ব্যাপারে তীব্র অনিচ্ছা প্রকাশ করছে।
মেজর বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে যোগদানের ব্যাপারে এজাতীয় মনোভাব সম্প্রতি গড়ে উঠেছে। কারণ ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ মুক্তিবাহিনীর হাতে বিপুল সংখ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানী জওয়ান ও অফিসারদের নিহত হওয়ার খবর পেয়ে যাচ্ছে। এজাতীয় মৃত্যুর খবর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ যাতে জানতে না পারে সে জন্য কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করা হতো। কিন্তু গোপনীয়তার ধর্ম ভেদ করে বাংলাদেশ থেকে বহু সংবাদ পশ্চিম পাকিস্তানের ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। ফলে সর্বোত্র মাতম হয়ে গেছে।
বাঙালি মেজর বলেন যে, আমাকে সেনাবাহিনীর জেনারেল পর্যন্ত বাংলাদেশে কেউ যে হারাতে হবে সে ব্যাপারে এখন নিশ্চিত হয়ে গেছে। তাই তাদের পিতৃভূমি পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষার জন্যই বর্তমানে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন সেনাবাহিনীতে নতুন বারোশো অফিসার নিয়োগের ফলে একটি ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, মুক্তিবাহিনীর হাতে অথবা তার কাছাকাছি সংখ্যক অফিসার হতাহত হওয়ার নতুন অফিসার রিক্রুট করা হয়েছে।
পাক শাসকদের জ্ঞানোদয় হোক
বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে শ্রী গিরি
ভারতের রাষ্ট্রপতি স্ত্রী ভিভি গীরি বলেন , বাংলাদেশের মানুষ না এর জন্য লড়ছেন। আমি নিশ্চিন্ত, শেষ পর্যন্ত তারা বিজয়ী হবেন।’ শ্রী গিরি গত ১৭ই নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের দুটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করতে গেলে হাজার হাজার শরণার্থী শ্রী গিরি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীক শেখ মুজিবের নামের জয়ধ্বনি দিয়ে তাকে সম্বর্ধনা জানান।
শ্রী গিরি তার ভাষণে বলেন, আমরা চাই পাকিস্তানি শাসক ও বাংলাদেশের মধ্যে একটা রাজনৈতিক মীমাংসা হোক এবং সে মীমাংসা অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে সন্তোষজনক মীমাংসা হতে হবে।’
এই মীমাংসা যে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও নেতাদের সঙ্গে করতে হবে, কোন ক্রীড়ানক দালালের সঙ্গে নয়, পাক সরকারের সেই জবান এখনো হয়নি। তিনি শুধু এই আশায় করতে পারেন যে, পাকিস্তানের শাসকরা ‘তাদের নিজেদের স্বার্থেই’ এটা উপলব্ধি করবেন।
সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর ৬টি দেশ সফরের উল্লেখ করে শ্রী গিরি বলেন, এর ফলে ওইসব দেশের মানুষ ও রাষ্ট্রনায়কেরা বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামের ন্যায্যতা সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, এর ফলে পাকিস্তান বুঝবে যে, বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের পক্ষে এবং বিশ্বজনমত এর চাপ পাকিস্তান সরকারকে বাধ্য করবে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ও জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে।
শ্রী গিরি শরণার্থীদের আগামী কয়েক সপ্তাহে কী ঘটে সে জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার আবেদন জানান।
তিনি ঘোষণা করেন, বিভিন্ন ফ্রন্টে ভারত বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন, তা সত্ত্বেও ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সামরিক অবস্থানকালে তাদের কষ্ট না হওয়ার জন্য ভারত যে কোন স্বার্থ ত্যাগে প্রস্তুত থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘ যে সরকার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না তেমনই এক সরকারের বর্বরোচিত কার্যকলাপের ফলে আপনারা যারা নিজেদের দেশ ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন ‘তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির জানাবার জন্যই তিনি এসেছেন।
হুশিয়ার!
জাতিদ্রোহী মীরজাফর, বাংলার কুলাঙ্গার, পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতি, সামন্তবাদী, ঔপনিবেশিকদের পাচাটাদালাল, খুনি নুরুল আমিন আবার স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। কুকুরের লেজ ১২ বছর চোঙ্গার পুরা থাকলেও তা সোজা হয় না এবং কুকুরকে গৃহীত জানা যায় খাওয়ানো হোক না কেন একটা বিশেষ জিনিস দেখলেই লোভ সামলাতে পারেনা। নুরুল আমিন একথাগুলোর সারবত্তা পুনর্বার প্রমাণ করেছে।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাঙালি জাতির নুরুল আমিনকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করেছিল, তার জাতিদ্রোহীতা মূলক রাজনীতির চির সমাধান রচনা করেছিল। তারপর দীর্ঘ ১৬/১৭ বছর নুরুল আমিন অজ্ঞাত বনবাসে ছিল আর মাঝে মাঝে দু একটি ভালো কথা বলে জনগণের মন জয় করার প্রয়াস পেয়েছিল। কিছু কিছু মানুষ ভেবেছিল মল যখন পলিতে পরিণত হতে পারে তখন নুরুল আমিন এর মধ্যেও পরিবর্তন আসতে পারে। জাতিদ্রোহী নুরুল আমিন তার ফল ও ভোগ করেছে। গত সাধারণ নির্বাচনে বাঙালি জাতির মীরজাফর ও জগৎশেঠদের কবর দিয়ে ও নান্দাইলের জনগণ সরল বিশ্বাসে নুরুল আমিনকে ভোটে পাশ করে দিয়েছে। নুরুল আমিন সেদিন তার ভোটারদের কি বলেছিল দালাল হামিদুল হকের পত্রিকাগুলো খুললে আজো যে কোন লোক তা দেখতে পারবে। নুরুল আমিন সেদিন ভোটারদের কাছে হাতজোড় করে এই আবেদনই জানিয়েছিল এই বৃদ্ধ বয়সে তোমরা আমাকে আর অপমান করো না। আমি মৃত্যুপথযাত্রী। আমাকে আর একটি বার ভোট দাও। আমি তোমাদের সাথে আর বেইমানি করবোনা..।
তারপর পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় অনেক পানি গড়িয়েছে। নুরুল আমিন নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিনন্দন জানিয়েছে। পহেলা মার্চ ইয়াহিয়া ভুট্টো জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করে। প্রতিবাদে ঢাকার ছাত্র জনতা রাজপথে নেমে আসেন। বঙ্গবন্ধু হোটেল পূর্বাণীতে, বহু সাংবাদিক বিক্ষুব্ধ জনসাধারণের সামনে ঘোষণা করলেন, কোন কিছুই বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেওয়া হবে না।’ তবে তিনি জানালেন যে, পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি ঘোষণার পূর্বে তিনি কয়েকজন নেতা নুরুল আমিন, মাওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান ও অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের সঙ্গে আলোচনা করতে চান। তদানুযায়ী তিনি নুরুল আমিনের সঙ্গে আলোচনাও করেছিলেন। ধরে নেয়া যায়, সেদিন বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি বাঙালির পক্ষ থেকে ইয়াহিয়া ভুট্টো চক্রের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন তাতে নুরুল আমিনের ও সায় ছিল। তারপরে নুরুল আমিন প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর চার দফা শর্ত পূরণের দাবি জানিয়েছিল। এমনকি খোদ রাওয়ালপিন্ডিতে খুনি চক্রের নায়ক ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনার পর নুরুল আমিন সাংবাদিকদের কাছে বলেছিল, বাংলাদেশের ক্ষমতা নেওয়ার মতো আজ আর কেউ নেই। বঙ্গবন্ধুকে বন্দি ও আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘোষণার পরেই নুরুল আমিন এ কথাগুলো বলেছিলো। কিন্তু খনি নুরুল আমিন যে তখন ও সুযোগের অপেক্ষায় ছিল তা অনেকেই বুঝতে পারেননি।
সর্বশেষ খবরে প্রকাশ পশ্চিম পাকিস্তানের সাতটি পাঞ্জাব ভিত্তিক রাজনৈতিক দল খুনি নুরুল আমিনকে তাদের দলের পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা নির্বাচন করেছে। তার অর্থ নুরুল আমিন মৃত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে রাজি হয়েছে। এই সাতটি দল হল পিডিপি, পাঞ্জাবি দালাল খানের মুসলিম লীগ, পাঞ্জাবি স্বার্থের জিম্মাদার দৌলতানার মুসলিম লীগ, আইয়ুব খানের দালাল ফজলুল কাদেরের মুসলিম লীগ, মুফতি মাহমুদ এর জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, মারকাজে জমিয়তে উলামা প্রভৃতি।
বাংলার ছাত্র তরুণরা যখন নিজেদের স্বাধীনতার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিচ্ছেন, বাংলার মা বোনেরা যখন খান সেনাদের হাতে ইজ্জত দিচ্ছেন তখন নুরুল আমিন জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে সাব্যস্ত করেছে।
নুরুল আমিনের জাতিদ্রোহী তা এই প্রথম নয়। ১৯৪৬ সালে মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন স্বায়ত্তশাসিত বাংলা গঠনের চেষ্টা করেছিলেন তখন যে কয়টি মীরজাফর তা বানচাল করতে লেগেছিল নুরুল আমিন ছিল তাদের একজন। ১৯৫২ সালে নুরুল আমিন ছাত্র-তরুণদের রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করে রাষ্ট্রভাষা তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে চেয়েছিল। নুরুল আমিনের মুখ্যমন্ত্রীদের আমলে বাংলার সমস্ত জেলখানা ছাত্র তরুণে ভরে গিয়েছিল। নুরুল আমিনের নির্দেশে রাজশাহী জেলে রাজবন্দীদের উপর চলেছিল গুলি। বিশেষ করে মহিলারা রাজবন্দীদের উপর নির্যাতনের যে কায়দা-কৌশল নুরুল আমিন প্রয়োগ করেছিল তার জন্য নুরুল আমিন ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে থাকবে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পূর্ব রাত্রে নুরুল আমিন এগারোশো আওয়ামী লীগ কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছিল। নুরুল আমিন ১৯৫৪ সালে নান্দাইলে বিক্ষুব্ধ জনতার উপর হাতি চালিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীকে নিহত করেছিল। নুরুল আমিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক বিপ্লবী নেতা শামসুল হককে পাগল করেছিল।
নুরুল আমিনের জানা উচিত গদির র এই বিশ্বাসঘাতকতা বাঙালি তরুণেরা বরদাস্ত করবে না। তার ক্ষমা নেই। কুখ্যাত
নিক্সনের বাংলাদেশ নীতি হতবুদ্ধিকর
-সাংবাদিক কেনেডি
গত ১৬ই নভেম্বর বোম্বাইতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নান টাইমস-‘ এর সহযোগী সম্পাদক বলেন যে, বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নিতে তার কাছে হতবুদ্ধিকর। তার ধারণা, প্রেসিডেন্ট নিক্সন সমস্যার প্রতি মনোযোগ দিচ্ছেন না।
সাংবাদিক কেনেডি আরও বলেছেন, মার্কিন জনসাধারণের কোন ধারণাই নেই যে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর স্বাধীনতার সংগ্রামে আত্মোৎসর্গ করেই লড়ছে। আর একথা সত্য যে, আগামী মাসগুলোতে মুক্তিবাহিনী আরো সাফল্য অর্জন করবে কিন্তু তাও মার্কিন জনগণের অজানা।
সম্প্রতি ও সাংবাদিক কেনেডি পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছেন এবং তার ধারণা পূর্ববঙ্গে ফিরে যাবার উপযোগী অবস্থা হলে প্রত্যেক শরণার্থী দেশে ফিরে যাবেন।
ভারত শরণার্থীদের বসতি দেবার ব্যবস্থা করলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে বিস্তর সাহায্য দিতে রাজি বলে যে প্রচার চলছে সে সম্পর্কে সাংবাদিক কেনেডির তিনি মন্তব্য করেন,’কোন দেশের পক্ষেই অন্য দেশ থেকে আসা এক কোটি শরণার্থী কে বসতি দেওয়া সম্ভব নয়।’
পাকিস্তান ডুবন্ত কুকুর
বিখ্যাত মার্কিন সাপ্তাহিক টাইম-এ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের একটি দীর্ঘ বিবরণী প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ভারত-মার্কিন সম্পর্কে এত নিম্নমানের আর কখনো নামেনি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পূর্বপাকিস্তানে সংঘর্ষের যে নীতি অনুসরণ করে চলেছে তাতে তাকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করার দরুনই সম্পর্কের এই অবনতি ঘটেছে। পত্রিকাটিতে বলা হয়েছে গত ২৫শে মার্চ এর পর থেকে ভারতে এক কোটি শরণার্থী আসবার ফলে ভারতের অর্থনীতির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে। পত্রিকাটির মতে শ্রীমতি গান্ধীর সফর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে না পারলেও আমেরিকানদের করেছে। একজন কূটনৈতিকের কথা উদ্ধৃত করে পত্রিকায় বলা হয়েছেঃ “পাকিস্তান একটা ডুবন্ত কুকুর। তার মাথাকে পানির নিচে ঠেসে ধরবার কোনো প্রয়োজন নেই ভারতের।”
টাইম পত্রিকার মতে, ভারত যুদ্ধ এড়াবার সর্বপ্রকার চেষ্টা করছে। ইন্দিরা গান্ধীর বর্তমান সফরের পর সকলে একথা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে ভারত যুদ্ধ বাধাবার পক্ষে নয়। যদি যুদ্ধ বাধে তবে তার জন্য ভারতকে দোষ দেওয়া যাবে না।
চাটগাঁয় ৪ জন খতম
চট্টগ্রাম থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসীক যোদ্ধারা আবার প্রকাশ্য দিবালোকে হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছেন।
গেরিলা যোদ্ধারা প্রকাশ্য দিবালোকে চাটগাঁ বিপণিবিতানের নিকট আক্রমণ চালিয়ে দুই জন পাকিস্তানী সৈন্য ও এক জন অবাঙালি পুলিশ খতম করেন। এই দুঃসাহসিক আক্রমণে এক তরুণ যোদ্ধা বীরের মতো অশেষ শৌর্যবীর্য প্রদর্শন করে শহীদ হন।
বিবিসির এক খবরে প্রকাশ, গত দশই নভেম্বর চাটগাঁ থেকে তথাকথিত উপনির্বাচনের প্রার্থীকে গেরিলা যোদ্ধারা গুলি করে হত্যা করেন।
ভুট্টোর মরাকান্না
গণতন্ত্রের জন্য পুনরায় ভুট্টোর মরাকান্না শুরু হয়েছে। পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোর গণতন্ত্র প্রীতি এবং গণতন্ত্রের জন্য কুম্ভীরাশ্রু নতুন নয়। সুযোগ-সুবিধা অনুসারে নবাব নন্দনটি যেমন নিজেকে ডেনমার্কের যুবরাজ হিসেবে চিহ্নিত করতে ভালোবাসে তেমনি ঝোপ বুঝে গণতন্ত্রের জন্য কিছু মিঠা বুলির কোপ মারার অভ্যাসটাও তার সাবেক স্ট্রাটেজি।
বারংবার ভুল প্রয়োগের ফলে অস্ত্রটি এখন এতই ভোঁতা এবং অকেজো হয়ে পড়েছে যে তার কার্যকারিতা সম্পর্কে স্বয়ং ভুট্টোরও বিশ্বাস কমে এসেছে। করাচির ডন পত্রিকা রাজনীতিবিদদের ক্রিয়া-কলাপ এর একটি নমুনা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।
বায়ান্নর ঘাতক নুরুল আমিন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভুট্টোকে চেক দেওয়ার জন্য একটি জোট গঠন করেছে। সাত পার্টির এই জোটকে দক্ষিণপন্থী জোট বলে বর্ণনা করে ভুট্টো বলেছে যে ওই জোট গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে একটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভুট্টোর উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে ডন জানাচ্ছে যে, ভুট্টো ঔ সাত পার্টির জোটকে একটি কাগজে ফ্রন্ট বলে বর্ণনা করেছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ কর্তৃক নির্বাচনে প্রত্যাখ্যাত অপরাজিত লোকদের সঙ্গে কোন প্রকার সহযোগিতা করতে ভুট্টো সাফ অস্বীকার করেছে।
ভুট্টো এ দাবিও করেছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের হয়ে কথা বলার অধিকার একমাত্র তাঁর দল পিপলস পার্টিরই আছে।
ভুট্টো দখলীকৃত বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন উপনির্বাচনকে একমুখে যেমন উপহাস করেছে, তেমনি সাথে সাথে কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠনে পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে সহযোগিতা করার খায়েশও প্রকাশ করেছে। পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধি বলতে কাদের কথা বলছে জানতে চাইলে বাকসর্বস্ব ভুট্টো ফাঁকা বেলুনের মতোই চুপষে যায়।
বিশ্ব জনমত
পাকিস্তান দিনদিন একঘরে হয়ে পড়ছে
বৃটেনের বিখ্যাত উদারনৈতিক দৈনিক পত্রিকা গার্ডিয়ান এ মন্তব্য করা হয়েছে (৯ই নভেম্বর), যুদ্ধে পাকিস্তানকে একা লড়তে হবে বিশ্বের কোনো শক্তি তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে চাইবে না। আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী এখন দ্রুত পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রবাহিত হচ্ছে। যে মার্কিন সাহায্যের উপর পাকিস্তান এত ভরসা করে বসে ছিল তা এখন বন্ধ হতে গেল। চীন কেবল তাকে বন্ধুত্বের বুলি দিয়ে শান্ত করতে চাচ্ছে। পিকিং এর নেতারা গার্ডিয়ান পত্রিকার মতে ইয়াহিয়া সম্পর্কে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে আরম্ভ করেছে। যা থেকে বোঝা যায় তাদের ইয়াহিয়াকে সর্বতোভাবে সমর্থন জানাবার পক্ষে অসুবিধা আছে। চীনারা এখন ইয়াহিয়াকে সমর্থন জানাতে গিয়ে অস্বস্তি বোধ করতে আরম্ভ করেছে। তারা একজন পুরাদস্ত পাঠান দক্ষিণপন্থী সমরনায়ক এর পক্ষ নিতে দ্বিধা দেখাচ্ছেন। পত্রিকাটির ভারত-পাক যুদ্ধ হলে চীন কোন ক্রমে সেই যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেনা।
পাকিস্তান আরও সমর্থন হারাবে
বৃটেনের বিখ্যাত রক্ষণশীল পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফ এ বলা হয়েছে, যতক্ষণ ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশ সমস্যার একটি যথার্থ রাজনৈতিক সমাধান না চাচ্ছেন, ততক্ষণ তার বন্ধু বাড়তে বাধ্য। ইয়াহিয়ার যথার্থই রাজনৈতিক সমাধান না চাইবার জন্য যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। কাশ্মীর ও পাঞ্জাব সীমান্তে ইয়াহিয়ার পক্ষে যুদ্ধ শুরুর ব্যাপারে প্রলুব্ধ হওয়া অসম্ভব নয়। রাজনৈতিক সমাধানের নীতি গ্রহণ না করলে ইয়াহিয়া ক্রমশ যুদ্ধের পথে ধাবিত হবে। আর বিশ্ব তার এই যুদ্ধ বাদি মনোভাবের জন্য তার উপর আরো বিরূপ হয়ে উঠবে।
ভুট্টোর চীন সফরের লক্ষ্য ব্যর্থ হয়েছে
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় থেকে প্রকাশিত ইংরেজি পত্রিকা জাকার্তা টাইমস-এ বলা হয়েছে যে ভুট্টোর চীন সফরের লক্ষ্য সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। পত্রিকাটির মতে পাকিস্তানকে চীনের সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতি কে ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি সঙ্গে তুলনা করা যায় না। ভারত সোভিয়েত রাশিয়ার কাছ থেকে যে পরিমাণ সাহায্য লাভ করতে সক্ষম হবে, পাকিস্তান চীনের কাছ থেকে সেই পরিমাণ সাহায্য পাবে না। এ থেকে এখন মনে করা যায় ভারত উপমহাদেশে কোন বৃহৎ যুদ্ধ সংঘটিত হবে না।
সিলেটে ৮০ জন রাজাকারের আত্মসমর্পণ
আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন যে সমপ্রতি সিলেটের মৌলভীবাজার রণাঙ্গনে গেরিলা যোদ্ধারা সোনামুড়া, সমান ভাগ, জৈন্তাপুর, গোয়ালবাড়ি ও শ্রীবরদীতে পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে বহু সৈন্যকে হতাহত করেন। রখি চড়ে গেরিলা যোদ্ধারা ৩১ জন দখলদার সৈন্যকে খতম করেন।
সুনামগঞ্জ রণাঙ্গনে গত ১৪ই নভেম্বর স্বাধীনতাকামী তরুণ যোদ্ধারা একটি সেতু মাইনের দ্বারা উড়িয়ে দেন। এসময় বীর দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি একটি অগ্রগামী জিপের ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে একজন ক্যাপ্টেনসহ পাঁচজন হানাদার কে হত্যা করেন। এদিকে সিলেটের কোন এক এলাকায় দখলদার সৈন্যদের চরম বিপর্যয়ের মুখে হতাশাগ্রস্থ ৮০ জনপদে দালাল রাজাকার প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
বাঙালিদের অবদান
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যক্ষ এবং প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী জনাব রশীদ চৌধুরী প্যারিস থেকে এক চিঠি পাঠিয়েছেন।
আমাদের কাছে প্রেরিত এক চিঠিতে তিনি বলেছেনঃ লাখো বাঙ্গালীর রক্তে রঞ্জিত সন্ত্রস্ত বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় আত্মগোপন করে যেসব বাঙালি জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন আমি তাদেরই একজন। গত ছয় মাস আপ্রাণ চেষ্টা করেছি বেরিয়ে আসতে কিন্তু সামরিক সরকার ও দালালদের কড়া পাহারার জন্য তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এখন যেখানে বেয়োনেটের মুখে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় তথাকথিত সরকার পদে পদে ব্যর্থ সেখানে ১৪ ই আগস্ট পালনেরও আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে। সেদিন সরকারি বেতন ও কাগজের মারফত রক্তপিপাসু জেনারেল ইয়াহিয়া খান কয়েকজন বাঙালি কবি, শিল্পী-সাহিত্যিক, স্বর্ণপদক, পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেছে। জেনে মর্মাহত আমার নাম ও সেখানে ছিল। যে মুহূর্তে আমার পুরস্কারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে সে সময় হয়তো জল্লাদদের হাতে বাংলাদেশের কোন গ্রাম দাউ দাউ করে জ্বলছিল, নির্মম অত্যাচারের অসহ্য যন্ত্রণায় বাংলার মা বোনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েছে, তাদের মেশিনগানের গুলিতে বহু বাঙালির জীবন ঝরে পড়েছে।
এখনো যেখানে বাঙালিকে পশুর চেয়েও অধম এর চোখে দেখা হয়, বাংলায় কথা বলা যেখানে অমার্জনীয় অপরাধ, বাংলার সংস্কৃতি, বাঙালির জীবন বিপন্ন আর বাংলাদেশ বিদ্রোহের আগুনে তত্ত্ব সেখানে বাংলার কোন কবি শিল্পী সাহিত্যিককে তথাকথিত সামরিক সরকারের সম্মান এক বিদ্রুপ ছাড়া অন্য কিছু নয়। পশু ইয়াহিয়া প্রদত্ত এ সম্মান আমি ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করলাম।
যদি কোন কবি সাহিত্যিক জীবনে কোনদিন বাংলায় একটি শব্দ লিখে থাকেন, কোন শিল্পীর কণ্ঠস্বর যদি কখনো বাংলার বাতাসে ধ্বনিত হয়ে থাকে, যদি কোন চিত্রশিল্পী সুজলা সুফলা মায়াময় বাংলার ছবি এঁকে থাকেন তবে বাঙালির তাজা রক্তে রাঙানো হাতের যে কোন সম্মান গ্রহণ এর পরিবর্তে তাদের ধ্বংস কামনা সোনার বাংলাকে শোষণমুক্ত করার প্রতিজ্ঞা হাতে অস্ত্র তুলে নেয়াই আজ প্রকৃত শিল্পীর পরিচয় বলে মনে করি। আমি গর্বিত বাঙ্গালী বলে, বাংলায় কথা বলে, জয় বাংলা বলে।
আমেরিকায়
আমেরিকার রাইট স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডঃ এ, কে, এম আমিনুল ইসলাম ওহিও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ভবনে আয়োজিত এক সমাবেশে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা এবং মুক্তি বাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কে বিবরণ দান করেন। তিনি আক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র শিক্ষক সমাবেশে এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ সহায়তা সংস্থার এক বৈঠকে বাংলাদেশ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন।
একটি আজব রহস্য কাহিনী
ভুট্টোর উপর গুলিবর্ষণের নেপথ্যে
(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)
সংবাদ সংস্থার খবরে প্রকাশ, ১১ ই নভেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টোকে লক্ষ্য করে কতিপয় লোক পিস্তল থেকে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়েছে। পিপলস পার্টি নেতা ভুট্টো সাহেব অবশ্য প্রাণে বেঁচে গেছেন এবং আহত ও হননি। ভুট্টা যখন লাহোরে এক দন্ত চিকিৎসালয়ে দাঁতের ব্যথার চিকিৎসার জন্য ঢুকছিলেন তখনই তার উপর ছোড়া হয় গুলি। যারা গুলি ছোড়ে অনুমান করা হচ্ছে তারা জামায়াতে ইসলামীর লোক। সারা পশ্চিম পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর লোকেরা আজ ভুট্টো বিরোধী হয়ে উঠেছে। এই বিরোধের অন্যতম কারণ পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের মধ্যে সিন্ধু নদের পানি বন্টন বিরোধ। ভুট্টো বর্তমানে সিন্ধু প্রদেশের দাবি সমর্থন করছেন। ফলে পাঞ্জাবি ও তাদের অর্থপুষ্ট ইসলাম পছন্দ দলগুলি হয়ে উঠেছে তার বিরোধী। যে ভুট্টো বাঙ্গালীদের বিপক্ষে এনেছিল বিচ্ছিন্নতাবাদীর অভিযোগ, প্রাদেশিকতা অভিযোগ, আজ ভুট্টোর ও তার প্রদেশের বিপক্ষেও উঠতে আরম্ভ করেছে একই ধরনের অভিযোগ। পাঞ্জাব না সিন্ধু এই ভুট্টোর সম্মুখে ভীষণ সমস্যা। পাঞ্জাবীদের ধরে তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তানের মসনদে আসীন হতে। কিন্তু এখন তার সেই স্বপ্নের গুড়ে বালি। কদিন আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিলে নাকি তা দেশবাসীই তাকে মেরে ফেলতে চাইবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ইয়াহিয়ার এককালীন জিগরি দোস্তের প্রাণ, তার সম্মুখে বিপন্ন হতে চলেছে।
ভুট্টো লাহোরে দন্ত চিকিৎসা লয় যাবার আগে যে বক্তৃতা করেন তাতে তিনি অনেকগুলো আশ্চর্য কথা বলেন। তিনি বোঝাতে চান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পাকিস্তানের সামরিক সরকারের সাথে কথা বলতে চান না। দেশে বেসামরিক সরকার অর্থাৎ ভুট্টো সাহেবদের সরকার হলে, ভারত সেই সরকারের সাথে কথা বলতে চাইবে। তাই পাকিস্তানের এখন বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। এককালীন আগুন খাওয়া নেতা ভুট্টো এখন পরোক্ষভাবে বলছেন পাক-ভারত আলোচনার মাধ্যমে শান্তির কথা। আর এর জন্য পাকিস্তানি জঙ্গি রাজের অবসানের কথা। কিন্তু এতে কোনো কাজ হবে না। কারণ বাংলাদেশ সমস্যা পাক-ভারত সমস্যা নয়। ভুট্টো সাহেবের সরকার আমলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে না নিয়ে কোনো সমস্যার সমাধান চলবে না। কিন্তু সামরিক রাজের বিরুদ্ধে সামান্যতম কথা বলাও আজ পাকিস্তানের হয়ে উঠেছে বিশেষ বিপদজনক। আর তাই ভুট্টোর মতো সুবিধাবাদী বড়লোক বামপন্থী নেতা হতে হচ্ছে পিস্তলের গুলির সম্মুখীন। সিন্ধু নদের পানি বিরোধে সামরিক চক্রের পরিবর্তে ভুট্টোর নিজের দলের ক্ষমতাসীন হবার বাসনা সবকিছুই ভুট্টোর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কে করে তুলেছে অনিশ্চিত। বাঙালিরা চেয়েছিল তাদের ন্যায্য অধিকার। চেয়েছিল পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতিষ্ঠিত। ভুট্টোর ক্ষমতার লোভ ও বাঙালি বিদেশ থাকে চক্রান্ত করছে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল সামরিক চক্রের সাথে আজ পাকিস্তানের মিচিয়াভেল্লিটি এখন নিজেই হতে চলেছেন, প্রাণ সংশয় গাড়ি চক্রান্তের শিকার। ভুট্টো আজ তার নিজের জালে নিজেই আটকা পড়ার পথে।
অপরদিকে ভুট্টো চরিত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মহল গুলিবর্ষণের সার্বিক ঘটনাকেই বানোয়াট বলে মনে করছেন। তাদের ধারণা স্ট্যান্ড রাজনীতির ধারক প্লে-বয় ভুট্টো নিজের পার্টির লোক দ্বারা এ জাতীয় একটি ঘটনার পথ দিয়ে তার ক্ষয়িষ্ণু জনপ্রিয়তার পথে বাধা সৃষ্টি করতে চেষ্টিত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিতে গুলি খেয়ে কেউ শাহাদাত বরণ করে আর কেউ নিক্ষিপ্ত পথভ্রষ্ট গুলিতে জনপ্রিয়তার শিখরে আরোহন করে। লাহোরের কোন আদালতের প্রতি একাধিক গুলিবর্ষণ করেছে কিন্তু তার নশ্বর দেহ একটিও গুলী প্রবিষ্ট হয়নি এমন ধারণা করা মুশকিল। ভূট্টো বিরোধী কোন পার্টির (গুলিবর্ষণকারী জামাতের লোক বলে সন্দেহ করা হচ্ছে) লোক যদি ভুট্টোকে হত্যার চক্রান্ত করতো তাহলে ভুট্টো প্রাণে বেঁচে গেলেও অন্ততপক্ষে আহত হতো কিন্তু কোনটাই হয়নি।
ভুট্টোর পিতাজি বলে অভিহিত আইয়ুব খান ও নির্বাচনে বাজিমাত করার জন্য পেশোয়ারের এক জনসভায় তার প্রতি গুলি নিক্ষেপের আয়োজন করেছিল। জনসাধারণকে গুলি নিক্ষেপের ঘটনা বিশ্বাস করানোর জন্য পাকিস্তানের তৎকালীন স্বঘোষিত লৌহমানব আইয়ুব খান মঞ্চের টেবিলের নিচে ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে ঢুকে পড়েছিল।
এই মহলের ধারণা ভুট্টো লাহোরে রাজনৈতিক ঝড়ের সৃষ্টি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছেন। ক্ষমতার জন্য কত রকমের ভোলেই না তুমি নিতে পারো।
লাহোরের এক জনসভায় ভুট্টো আর এক গুল ছেড়েছেন। গুলের কারখানা লাহোরে তিনি বলেছেন যে, পিকিং সফরকালে তিনি চেয়ারম্যান মা ওর সাথে দেখা করেছেন। বিশ্বের আমাকে নির্বোধরাও জান যে, মা ওর সাথে দেখা যেকোনো বিদেশীর সাক্ষাৎকার আন্তর্জাতিক সংবাদ এর মর্যাদা পেয়ে থাকে। কিন্তু ভুট্টো ইয়াহিয়ার ঘাঁটি হিসেবে চিনে গেলেন আর চেয়ারম্যান মায়ের সাথে দেখা করলেন কিন্তু চিনা সংবাদ প্রতিষ্ঠান এনসিএন এ বা পাকিস্তানে ইয়াহিয়া যান্তার প্রচার বাহন এবিপি বা রেডিও পাকিস্তান এমন চাঞ্চল্যকর খবর চেপে গিয়েছেন এমন কথা ভুট্টো লাহোরের লোকদের বোঝাতে চেয়েছেন। জনসাধারণ ভুট্টোর সভায় গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করলে তা প্রশমিত করার জন্য চেয়ারম্যান মাও তাকে সাক্ষ্য দিয়েছেন বলে স্টান্ট সৃষ্টি করে। ভুট্টো বোধ হয় উপলব্ধি করতে পেরেছে লাহোরের সব ধরনের গুলই মারা যায়।
আমাদের লক্ষ্য
(আংশিক)একটা নতুন সমাজ গঠনে সাহায্য করাই তার এই কোরের লক্ষ্য।
সভায় জনাব মোঃ শাহ বাঙালি স্বরচিত গান পরিবেশন করেন। সভাশেষে শরণার্থী শিবিরের মেয়েরা ব্রতচারী গান ও নাচ পরিবেশন করে।
নিউইয়র্ক টাইমস
(আংশিক) মন্তব্য করা হয়।
উক্ত সম্পাদকীয় প্রবন্ধে অভিযোগ করা হয় যে, ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্ত পরিস্থিতি আজ যে এমন সাংঘাতিক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি অনেকখানি দায়ী।
উক্ত প্রবন্ধে আরও বলা হয় যে, সম্প্রতি পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্যের পরিমাণ কমানোর জন্য যে আদেশ দেওয়া হয়েছে সেটা খুবই নামমাত্র ব্যবস্থা। কেননা ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসকদের অন্যান্য দ্রব্য সরবরাহ এবং আদর্শগত সমর্থন জানিয়ে যাবার যে সাংবাদিক নীতি মার্কিন প্রশাসন গ্রহণ করেছে তার ফলে অবস্থার আরো অবনতি হবে।
যশোরে দুঃসাহসিক আক্রমণের ১৭ জন
যশোর , ৯ই নভেম্বর- গত ৫ই ও ৬ই নভেম্বর দুঃসাহসিক গেরিলা যোদ্ধারা যশোর শহর ও শহরতলীতে অন্ততপক্ষে ১৭ জন খান সেনাকে খতম ও আরো কয়েকজনকে গুরুতর রূপে আহত করেছেন।
প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ গত ৫ই নভেম্বরে যশোরে মুক্তি বাহিনীর একজন হানাদার খান সেনাদের ওপর চড়াও হয়ে চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালান। এই দুঃসাহসিক আক্রমণের দশজন শত্রুসৈন্য নিহত হয়। একই দিনে শহরের অপর অংশে গেরিলা যোদ্ধাদের ও ব্যর্থ গুলিতে ৪ জন পাকিস্তানী সৈন্য প্রাণ হারায়।
গত ৬ই নভেম্বর যশোর শহরের কাছে খনন রত একদল দস্যু সৈন্যের উপর গেরিলা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সংঘর্ষে তিনজন খানসেনা নিশ্চিহ্ন হয়। অবশিষ্টরা কোন রকমে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। ঐদিনই মুক্তিযোদ্ধারা একই অঞ্চলে একটি পাটের গুদামে আগুন ধরিয়ে দেন।
বন্ধুহীন পাকিস্তান
বিলাতের বিখ্যাত দৈনিক দি টাইমস পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতা খবর দিয়েছেনঃ চীন পাকিস্তানকে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরামর্শ দিয়েছে এবং ভারতের সাথে যুদ্ধে না জড়াবার জন্য উপদেশ দিয়েছে। চীন আরো বলেছে যে নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন এর সময় এখনো আসেনি।
ভুট্টো সম্প্রতি চীনে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার সাথে চিনা নেতাদের আলোচনার পর কোন যুদ্ধ বিবৃতি প্রচার করা হয়নি। এ থেকেই বোঝা যায় চীন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তাদের মনোভাব পরিবর্তন করেছে। কারণ চীন একসময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে পাকিস্তান বিরোধীদের যুদ্ধ কারীদের কাজ বন্ধ করেছিল। কিন্তু চীন এখন অনুধাবন করতে পেরেছে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি রয়েছে বিরাট গণসমর্থন। সমস্ত বাঙালি আছে এই স্বাধীনতা যুদ্ধের পেছনে।
অন্যদিকে চীন সবে রাষ্ট্রসঙ্ঘে ঢুকেছে। এই অবস্থায় তারা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে সারা বিশ্বে চীনের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে।
বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মতে চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও নানা পরিবর্তন ঘটছে। চরমপন্থীদের হাত থেকে নেতৃত্ব আসছে মধ্যপন্থীদের হাতে। তাই চীনের বৈদেশিক নীতিতেও নমনীয়তা দেখা যাচ্ছে। চীন এশিয়ায় এখন বিশ্ববিপ্লবের নামে নিজেদের কিছুতেই যুদ্ধবাজ বলে প্রমাণ করতে চায় না।
এশিয়াতে চীন ছিল পাকিস্তানের জঙ্গির রাজের একমাত্র সমর্থক। কিন্তু চীনের এই সমর্থন তিরোহিত হবার ফলে পাকিস্তান বিশেষভাবে বন্ধুবিহীন হয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের পত্র-পত্রিকায় এখন কথা বলা হচ্ছে অনেক নরম সুরে।
একদিকে বাংলাদেশের যুদ্ধের পর পরিবর্তন, সর্বত্র মুক্তিবাহিনীর জয়যাত্রা, অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির পটপরিবর্তনে বাংলাদেশের মানুষের বিজয় এখন একান্তভাবেই নিশ্চিত হয়ে উঠেছে।
লাকসামে মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক আক্রমণ
লাকসাম থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, গত ২৫শে অক্টোবর মুক্তি বাহিনীর অসম সাহসী বীর যোদ্ধারা লাকসাম রাস্তার নিকট একটা আক্রমণ চালিয়ে ২১ জন পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকারকে নিশ্চিহ্ন করে দেন। এছাড়া গেরিলা যোদ্ধারা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর তিন টন ওজনের একটি কনভয় ধ্বংস করে দেন। গত ২৬শে অক্টোবর অত্র থানায় গরিবানগা-বানশি সড়কে আর একটি দুঃসাহসিক অভিযানে ১৭ জন বেইমান খান সৈন্য ও ২১ জন অবাঙালি রাজাকার মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রাণ হারায়।
গত ২৭শে অক্টোবর মুক্তি বাহিনীর অসম সাহসী বীর যোদ্ধারা কুমিল্লা লালমাই সরকারের নিকট বিজয়পুরে পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণ প্রতিহত করে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে ২১ জয়ন খানসেনা খতম ও ১৩ জনকে গুরুতররূপে আহত করেন।
গত ৩১শে অক্টোবরের স্বাধীনতাকামীরা হাত খোলাতে শত্রু ঘাঁটিতে মর্টার আক্রমণ চালিয়ে একজন ক্যাপ্টেনসহ ৯৫ জন খান সেনা ও রাজাকারদের খতম করেন।
সকল ফ্রন্টে মুক্তিবাহিনীর দুর্বার অগ্রগতি
ময়মনসিংহ আরো ২৪ জন সেনা খতম
গত ৬ই নভেম্বর জামালপুরের মিলনদহ মাহমুদপুর এলাকায় এক সংঘর্ষের পর মুক্তিবাহিনীর হাতে ১২ জন বেইমান হানাদার সৈন্য প্রাণ হারায় এবং ৪ জন সৈন্য গুরুতর আহত হয়। এই সংঘর্ষের সময় একজন তরুন মুক্তিযোদ্ধা অসম সাহস ও শৌর্য-বীর্যের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন। এর আগে গত ২৭শে অক্টোবর অস্ত্র জেলার মুক্তি বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে আরো ৭ জন দস্যু সৈন্য প্রাণহারায়।
গত ২৪শে অক্টোবর অত্র জেলার ঈশ্বরগঞ্জ থানায় শত্রুর উপর মুক্তিবাহিনী এক সরাসরি আক্রমণ চালিয়ে ৫জন পাকিস্তানি সৈন্যকে নিহত করেন এবং ১০ জনকে গুরুতররূপে আহত করেন।
রংপুরে আট জন রাজাকার আটক
গত ৬ই নভেম্বর রংপুরের করোনাই অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর এক সফল আক্রমণ চালিয়ে পাঁচটি রাইফেলসহ আট জন রাজাকার কে বন্দী করেন।
দিনাজপুরে ব্যাপক তৎপরতা
গত ৭ই নভেম্বর দিনাজপুরের গোসাইগঞ্জ হাটে গেরিলা যোদ্ধাদের হাতে একজন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত এবং তিনজন গুরুতররূপে আহত হন। এ মাসের গোড়ার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা কালিগঞ্জ ভোট এবং হাত বন্ধ্যা ভোটমারীর মধ্যে রেললাইন বিনষ্ট করে হানাদার সৈন্যদের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন।
মেহেরপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্তি বাহিনীর দখলে
মুক্তিবাহিনী তিন দিক থেকে অভিযান চালিয়ে মেহেরপুর শহরসহ আশপাশ এলাকায় অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। এছাড়া কুষ্টিয়া জেলায় ২৫ বর্গমাইল এলাকা এখন মুক্তাঞ্চল।
মুক্তিযোদ্ধারা বামন্দি ঘাঁটিতে তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের খলিসাকুন্ডি পর্যন্ত তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। মেহেরপুরে অবস্থিত পাকিস্তানী সৈন্য দল আটকে পড়েছে এবং মূল ঘাঁটি মিরপুর থেকে তারা এখন সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গান গানই থানার উত্তর-পশ্চিম থেকে মাথাভাঙ্গা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল মুক্তি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া তারা ভৈরব নদীর দক্ষিণ পশ্চিম থেকে দর্শনা মেহেরপুর রোডের উত্তর পর্যন্ত ও দখল করে নিয়েছেন।
ঢাকায় চারজন নিহত
বিবিসির এক খবরে প্রকাশ, ১৪ই নভেম্বর ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে মুক্তিবাহিনীর দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধাদের সাথে সারাদিন ব্যাপী বিক্ষিপ্তভাবে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষের ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে একজন পুলিশ সহ চারজন্ গুলিতে নিহত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা শহরে কয়েকটি সূত্র অবস্থানের উপর বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হানাদার সৈন্যদেরকে বিব্রত করে তোলেন।
চট্টগ্রামে আরো পাঁচজন বুলেটবিদ্ধ
বিবিসি আরো জানাচ্ছেন যে, বাঙালি গেরিলা যোদ্ধাদের আক্রমণের চট্টগ্রামে দুই মুমূর্ষ অবস্থায় আরো ৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
শাহজাদপুরে ব্যাপক তৎপরতা
গত ১০ই নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী বীর যোদ্ধারা চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে খানসেনা ও রাজাকারদের ব্যাপকভাবে ঘায়েল করেন। এছাড়া গেরিলা যোদ্ধারা কাজলদীঘি আক্রমণ চালিয়ে ১২ জন শত্রু সৈন্যকে খতম করেন।
গত ৯ই নভেম্বর রংপুর জেলার বাগেশ্বরী এলাকায় মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে প্রায় ২০ জন পাকিস্তানী সৈন্য খতম হয়।
বিভিন্ন এলাকায় প্রচণ্ড সংঘর্ষ
আমাদের প্রতিনিধি জানাচ্ছেন নোয়াখালীর ফেনি, পরশুরাম, সুধারাম এবং কুমিল্লার এলাকায় প্রচণ্ড সংঘর্ষে হানাদার সৈন্যরা দারুণভাবে মার খাচ্ছে।
কুমিল্লা শহরে মর্টার আক্রমণ
আমাদের রণাঙ্গন প্রতিনিধি জানাচ্ছেন গত ২৬শে অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা কুমিল্লা কোতোয়ালি থানায় দখলদার সৈন্যদের ঘাটির উপর মর্টার আক্রমণ উপর চালিয়ে ৯ জন সৈন্য কে খতম করেন এবং ১০ কে গুরুতর আহত করেন।
গেরিলা যোদ্ধাদের অপর একটি দুঃসাহসিক দল নোয়াখালীর পরশুরামের শত্রু অবস্থানের উপর মর্টার আক্রমণ চালিয়ে ৭ জনতার সৈন্যকে নিশ্চিহ্ন এবং ৯ জনকে গুরুতর আহত করেন। এছাড়া শত্রুর একটি বাংকার ধ্বংস করে দেন।
সালদা নদীতে ৩৯ জন শত্রুসৈন্য খতম
পূর্ব রণাঙ্গন থেকে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি জানাচ্ছেন যে, গত ১২ই নভেম্বর বাংলার দুঃসাহসীক গেরিলা যোদ্ধারা কুমিল্লার লক্ষ্মীপুর, মন্দাভাগ ও কাইয়ুম পুরে শত্রু অবস্থানের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৯ জন হানাদারকে খতম করেন।