You dont have javascript enabled! Please enable it! 1941 | মুসলিম ছাত্রদের মেরুকরণ | সরদার ফজলুল করিমের স্মৃতি থেকে - সংগ্রামের নোটবুক

মুসলিম ছাত্রদের মেরুকরণ

গঙ্গাধর অধিকারী জি অধিকারী এ সময়ে একটি পুস্তিকা লেখেন : পাকিস্তান এন্ড দি কোশ্চেন অব সেলফ ডিটারমিনিশেন অব দি মাইনরিটিস’। অর্থাৎ মুসলমানেরাই একমাত্র মাইনরিটি নয়, আরাে মাইনরিটি আছে ভারতে। ভারতবর্ষে একটা পাকিস্তান নয়, দৃশটা পাকিস্তান দরকার। পাকিস্তানপন্থীরা তখন আবুল কালাম আজাদ, হুমায়ুন কবির প্রমুখ জাতীয়তাবাদীদের গালাগালি করছে মুসলিম কমিউনিটির বিদ্রোহী হিসেবে। হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক্সটারনাল পরীক্ষক হিসেবে আসতেন, দর্শনের অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্যের বাসায় থাকতেন। সেখান থেকে তিনি পরীক্ষা নিতেন।
মুসলিম লীগের আবুল হাশেম সাহেব এসেছিলেন একটি জাতীয়তাবাদী পরিবার থেকে। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের একটা বিশেষ ব্যাখ্যা দিতে শুরু করলেন। তার ব্যাখ্যাটা কিছু পরিমাণে সােসালিস্ট। সুতরাং মুসলিম লীগের মধ্যে দুটি উপবিভাগ দাঁড়িয়ে গেল। একটি দল ডানপন্থী আর একটি দল প্রগতিবাদী। মুসলিমদের মধ্যে যারা প্রগতিবাদী, কমিউনিস্ট পার্টি তাঁদের পক্ষ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিল। পার্টি থেকে সদস্যদের কাছে গােপন নির্দেশ আসত, ‘অমুক প্রগতিবাদী, তুমি ওর কাছাকাছি থেকো।,যদি কোনাে ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে তবে তাকে আমাদের কাছে নিয়ে এসাে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রদের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির বেশ কিছু যােগাযােগ হয় । হিসাম উদ্দীন আহমদ যিনি পরবর্তীকালে বগুড়া কলেজের প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন, এখন তাে তার আমার চেয়ে বেশি বয়স হয়ে গেছে, ওঁরও এ ধরনের স্মৃতি থাকবে । রবি গুহেরও আছে এসব স্মৃতি। রবি গুহ তার লেখায় নাজমুল করিমের খুব প্রশংসা করেছেন। রবি গুহের সপ্রশংস সব চিঠি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত নাজমুল করিম স্মারক গ্রন্থে পাওয়া যাবে। এ সব সূত্র একটির সাথে অন্যটি জোড়া দিলে আপনারা একটি ডেভেলপমেন্ট পাবেন তৎকালীন সমাজ ও রাজনীতির । তখন আপনারা দেখবেন, মুসলিম লীগ পূর্ববঙ্গের মুসলিম সম্প্রদায়ের একমাত্র মুসলিম দল হিসেবে ডেভেলপ করেনি। আবুল হাশেমও খাটি মুসলিম লীগার ছিলেন না। ছাত্র ফেডারেশন ছিল কমিউনিস্ট মনােভাবাপন্ন।
ঢাকা কলেজ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থানগত দূরত্ব বেশি ছিল । তেমন আলাদাও ছিল না এ দুটি প্রতিষ্ঠান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে আমাদের পরিচয় ছিল। যাতায়াতটাও ছিল। একই রাস্তা তাে। আমার বন্ধুবান্ধব, যেমন নাজমুল করিমের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। নাজমুল করিমের এক বন্ধু রবি গুহ। রবি গুহ, নাজমুল করিম আর আমি খুবই মার্কড ছিলাম। মুসলিম লীগ যখন থেকে সংগঠিত হতে শুরু করল তখন থেকেই আমরা তিনজন হয়ে দাঁড়ালাম তাদের
৩৩
অর্থাৎ পাকিস্তানি পক্ষের আক্রমণের লক্ষ্য। মুসলিম লীগের মধ্যে খুব গোঁড়া যাঁরা যেমন, শাহ আজিজুর রহমান কিংবা সালেক বলে একজন ছিল, ‘দে মেইড আস দেয়ার টার্গেট অব এ্যাটাক। আমাদের তারা বলত ‘হকপন্থী” অর্থাৎ আমরা শেরেবাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হকের সমর্থক।
এ সময়ে একটি ঘটনা ঘটেছিল। যে সময়ের কথা বলছি তখন ফজলুল হক সাহেব মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর সাথে মিলিত হয়ে একটা সরকার গঠন করেছেন। এই সরকারের পেছনে ঢাকার নবাব বাড়ির সমর্থন ছিল। নবাব সলিমুল্লাহ এবং ঢাকার সরদাররা ছিল শ্যামা-হক সরকারের সমর্থক। ফজলুল হক সাহেব একবার ঠিক করলেন যে তিনি ঢাকায় আসবেন। এটা শুনে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট হােস্টেল, ফজলুল হক হল, সলিমুল্লাহ হল : ইত্যাদিতে যেসব মুসলিম লীগের ছেলেরা থাকত তারা ঠিক করল হক সাহেবকে তারা বিরূপ সংবর্ধনা দেবে। ফুলবাড়িয়া স্টেশনে ওরা ঐভাবে অরগানাইজড হল। আর এদিকে নবাব হাবিবুল্লাহ এবং তাঁর অনুগামীরাও অর্থাৎ ঢাকা সিটির যত সরদার, যত স্থানীয় লােক ছিল সবাই একজোট হল। আমরা যারা নিরীহ, মানে আমি সরদার ফজলুল করিম, মােহাম্মদ কাসেম যে এখন তেজগাঁও কলেজের অধ্যাপক, নাজমুল করিমের ছােটভাই লুৎফুল করিম অর্থাৎ আমরা প্রগতিবাদীরা এই দ্বিতীয় গ্রুপটির সঙ্গে থাকব বলে স্থির করলাম।
আমি আমার গ্রুপের মুখপাত্রের মতাে ছিলাম, একটু লিডারগিরি করতাম। লিডারশিপ অবশ্য শুরু হয় আরাে অনেক আগে থেকে। একবার আমার গ্রুপের সব ছেলে মিলে সারারাত মুকুল সিনেমায় গিয়ে সিনেমা দেখেছি, ভালাে ভালাে সব সিনেমা—মুক্তি, দেশের মাটি ইত্যাদি। হােস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট এর জন্যে আমাদের শাস্তি দিয়েছেন। ছেলেদের যখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে তােমাদের বলেছে যে তােমাদের পারমিশন আছে সিনেমা দেখার? ছেলেরা তখন উত্তর দিয়েছে, সরদার বলেছে। আমাকেই সরদার বানিয়েছে তারা। এই সরদারিটা আমি ভালােই এনজয় করেছি। সাময়িক পত্রিকা, হাতে লেখা ম্যাগাজিন এসব বের করেছি। আমাদের গ্রুপটা ছিল জাতীয়তাবাদী এবং হকপন্থী। একবার আমাদের গ্রুপের কিছু ছেলেকে সুপারিনটেনডেন্ট হল থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। তখন হক সাহেবের মন্ত্রীসভা ক্ষমতায়। আমরা হক সাহেবের কাছে পিটিশান পাঠিয়ে দিলাম এই মর্মে যে, আমরা হক-পন্থী বলে অর্থাৎ আমরা আপনাকে সাপাের্ট করি বলে আমাদের এমন শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এ রকম সব ব্যাপার-স্যাপার ছিল তখন।
৩৪
একদিন আমরা যখন ইন্টারমিডিয়েট কলেজের হােস্টেলে বসে কথা বলছি তখন মুসলিম লীগের গ্রুপটা এসে আমাদের বলল, “অমুক তারিখে আমরা ফুলবাড়িয়া স্টেশনে ফজলুল হক সাহেবের বিরুদ্ধে ডেমনেস্ট্রেশন দিতে যাবাে। তােমরা সেদিন আমাদের সঙ্গে থাকবে। আমি আমাদের গ্রুপের মুখপাত্র হিসেবে তাদের বললাম, আমরা যাব কি যাব না, তার সিদ্ধান্ত আমরা নেবাে। তােমাদের মতামত আমরা শুনলাম, ঠিক আছে। এটা শুনে ওরা খুব ক্ষেপে গেল আমাদের উপর।
হক সাহেব আসেননি সেবার, নবাব হাবিবুল্লাহ এসেছিলেন কলকাতা থেকে। একটা মারামারি হয়েছিল সেদিন দুই পক্ষের মধ্যে ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের ওয়েটিং রুমের সামনে, যেখানে এসে রেলগাড়ির কম্পার্টমেন্টগুলাে দাঁড়াত সেখানে। ফজলুল হক হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট হােস্টেলের মুসলিম লীগপন্থী ছেলেরা সবাই ফুলবাড়িয়া স্টেশনে লুকিয়ে ছিল এই ভেবে যে হক সাহেব বা নবাব হাবিবুল্লাহ যেই ট্রেনে করে এসে প্ল্যাটফর্মে নামবে অমনি তারা তাদের উপর হামলা করবে। কিন্তু মুসলিম লীগারদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়নি সেদিন। নবাববাড়ির পক্ষের লােকেরা অর্থাৎ সব সরদার আর স্থানীয় লােকেরা মিলে বেদম পিটালাে মুসলিম লীগপন্থীদের। পিটুনি খেয়ে ওরা নিজ নিজ হলে ফিরে গিয়ে ওরা আবার সেখানে যাদের যাদের হকপন্থী বলে মনে করত তাদের উপর হামলা করল। নাজমুল করিমের বিছানাপত্র সব উপর থেকে নিচে ফেলে দিল, ডাইনিং হলে আমার খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিল। যদি আমি ডাইনিং-এ খেতে আসি তবে আমাকে চোখা বাঁশ দিয়ে খুঁচিয়ে মারবেটারবে বলে হুমকি দিল। আমার কলেজে যাওয়াও বােধ হয় বন্ধ করে দেয় তারা। আমার তখন ফাইনাল পরীক্ষা। আমি হােস্টেল ছেড়ে আমার বড় ভাইয়ের কাছে চলে গেলাম।
আমার বড় ভাই মঞ্জে আলী তখন ঝালকাঠির কাছে নলছিটির সাবরেজিস্ট্রার। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক মনােভাবের ছিলেন। হুমায়ুন কবীরের প্রশংসা তিনি কখনাে করেননি। তিনি বরং জিন্না সাহেবের প্রশংসা করতেন। তবুও বড় ভাই যখন ঢাকায় আসতেন তখন তিনি এটা দেখে মােহিত হতেন যে, ছেলেপিলেরা তার ভাইয়ের বেশ প্রশংসা করে। ওরা বলত, “ও! আপনি সরদারের ভাই!’ বলে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করত। এটা তার খুব ভালাে লাগত। কিন্তু ইতােমধ্যে ঢাকার ঘটনাটা তার কানে গেছে এবং আমার সম্পর্কে তিনি বিরূপ মনােভাব পােষণ করা শুরু করেছেন। আমাকে দেখে বড় ভাই একটু এ্যাগ্রেসিভ টোনে বললেন, তুমি দুই কলম ইংরেজি শিইখ্যা খুব মাতব্বর অইয়া গেছাে, হুমায়ুন কবিরের দলে যােগ দিছাে!
৩৫
হুমায়ুন কবির তখন বিখ্যাত। বিখ্যাত ছাত্র ছিলেন তিনি, হিন্দু মেয়ে বিয়ে করেছেন, শ্রমিক আন্দোলনের হুমায়ুন কবিরের বিরােধী পক্ষ ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জ্যোতি বসু।
১৯৪১-৪২ সালে মুসলিম লীগ ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে। পাকিস্তান আন্দোলন দানা বাঁধছে। ১৯৪০ সালে পাকিস্তান প্রস্তাব পাশ হবার সঙ্গে সঙ্গেই যে মুসলিম লীগ খুব জোরদার হয়ে গেল এমন নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. মজহারুল হক আর ফজলুর রহমান—এই দুজনে ‘পাকিস্তান নামে একটি বাংলা পত্রিকা বের করতেন এ সময়। ফজলুর রহমান সাহেবের সাথে আমি ৫৫/৫৬ সালে পাকিস্তান কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমব্লির সদস্য ছিলাম। সেটা অবশ্য আরাে পরের কথা। যেখানে কংগ্রেসের স্লোগান ছিল ‘কুইট ইন্ডিয়া’, সেখানে মুসলিম লীগ ধ্বনি তুলল “ডিভাইড এ্যন্ড কুইট” । ১৯৪২-এ কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলন জঙ্গি রূপ নিল। ব্রিটিশ সরকার সবাইকে গ্রেপ্তার করে ফেলল। মােহন দাস করমচাঁদ গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইত্যাদি সব বড় বড় কংগ্রেস নেতাকে হায়দ্রাবাদের একটা প্রাসাদে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখল। এদিকে বঙ্গদেশে মেদিনীপুর, তমলুক ইত্যাদি জায়গায় স্বাধীন সরকার পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে অনেক জায়গায়। জনগণ টেলিগ্রাফের খুঁটি ইত্যাদি উপড়ে ফেলছে। মহিলা নেতা মাতঙ্গিনী হাজরার কথা পাবেন আপনারা ইতিহাসে। আন্দোলন সাংঘাতিক জঙ্গি হয়ে উঠেছে। উত্তাল চল্লিশ’ বলে একটা বইয়ে এসব আন্দোলনের কথা লেখা আছে।

Reference:
আত্ম কথা আমি সরদার বলছি – সরদার ফজলুল করিম, pp 32-36