You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.10.26 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | কিসিঞ্জারের মস্কো সফর | এবার ম্যানছেরুমিয়ার জ্ঞাতিরাও— | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৬শে অক্টোবর, শনিবার, ১৯৭৪, ৮ই কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

কিসিঞ্জারের মস্কো সফর

মস্কোতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ হেনরী কিসিঞ্জার ও সোভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টি নেতা মিঃ লিওনিদ ব্রেজনেভের মধ্যে আলোচনা বৈঠক শুরু হয়েছে। ডঃ কিসিঞ্জার গত বুধবার মস্কো পৌঁছেছেন।
ডঃ কিসিঞ্জার সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যে সব বিষয়ে আলোচনা করবেন তন্মধ্যে সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য পাবে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা সীমিতকরণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা হ্রাস। এ ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয়ের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
ডঃ কিসিঞ্জার এমন একটি সময়ে মস্কো সফরে এসেছেন যখন মার্কিন-সোভিয়েত উত্তেজনা হ্রাসের বিরুদ্ধে মার্কিন কংগ্রেসে প্রচন্ড সমালোচনা শুরু হয়েছে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ওয়াটারগেট মামলায় জড়িয়ে পড়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পদত্যাগের পর সোভিয়েত-মার্কিন সম্পর্ক এক নতুন মোড় নেয়। এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই সাবেক প্রেসিডেন্ট মিঃ নিক্সন মার্কিন-সোভিয়েত সম্পর্ক উন্নয়নের পটভূমি রচনা করেছেন, এমনকি দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের পথ প্রশস্ত করেছেন। সোভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টি নেতা মিঃ লিওনিদ ব্রেজনেভের যুক্তরাষ্ট্র সফর এবং মিঃ নিক্সনের দু’বার মস্কো সফরই তার প্রমাণ। তাছাড়া সর্বশেষ সফরে মিঃ নিক্সন পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা সীমিতকরণ ও বন্ধের ব্যাপারেও একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন।
নয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিঃ ফোর্ড ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর সোভিয়েত-মার্কিন সম্পর্কের তেমন কোনো বোঝাপড়া হয়নি। সুতরাং ডঃ কিসিঞ্জার মস্কোতে একদিকে যেমন পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কিত বিষয়ে আলোচনা করবেন অন্যদিকে আগামী নভেম্বর মাসে যাতে মিঃ ফোর্ড ও মিঃ ব্রেজনেভের মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারে সে চেষ্টাও চালাবেন।
এ কথা তো আজ দিবালোকের মতোই স্পষ্ট যে, সোভিয়েত-মার্কিন সম্পর্কটা নির্ভর করছে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ বা সীমিতকরণের মধ্যে। সোভিয়েত মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সী কোসিগিনের বক্তব্যে। তিনি সম্প্রতি জাপানের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ‘আশা-ই-শিম্বুনে’র সাথে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন যে, পারমাণবিক সমরাস্ত্রের উৎপাদন হ্রাস করার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পর পরই কেবলমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস স্নেসিঙ্গার বলেছেন, ডঃ কিসিঞ্জার পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার সীমিতকরণ সম্পর্কিত এমন একটি ফর্মূলা বের করতে প্রয়াস পাচ্ছে বা দু’টি দেশের পক্ষেই গ্রহণযোগ্য হবে। এ ব্যাপারে ১০০ বছর মেয়াদী চুক্তিও সম্পাদিত হতে পারে।
ডঃ কিসিঞ্জারের মস্কো সফর, সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রীর উক্তি, মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য—সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে যে, সকলেই পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা হ্রাস ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধের বিষয়ে একমত। সকলেই চাচ্ছেন যে, যুদ্ধের উত্তেজনা হ্রাস পাক, বিশ্ব শান্তির পথ প্রশস্ত হোক। তবুও এ বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়, আর তা হলো শুধু চাইলেই কি সব কিছু পাওয়া যায়? চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে থাকা চাই নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা। মস্কো বৈঠকের ফলাফল কি হবে আমরা জানিনা, তবে ডঃ কিসিঞ্জারের মস্কো সফরের ফলে দু’টি দেশের মধ্যে নতুনভাবে সম্পর্ক উন্নয়নের পথ যে প্রশস্ত হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

এবার ম্যানছেরুমিয়ার জ্ঞাতিরাও—

কিংবদন্তীর মতো ছড়িয়ে পড়া একটি নাম ম্যানছেরুমিয়া। পত্রিকান্তরের প্রতিবেদন সূত্র জানাচ্ছে যে, চট্টগ্রামের সীমান্ত অঞ্চলে কালোবাজারীর নায়ক বলে কথিত সেই ম্যানছেরুমিয়ার গত ২৪শে অক্টোবরে চট্টগ্রাম সদর উত্তর মহকুমা প্রশাসকের আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। আত্মসমর্পণ করার সময় সে আত্মপরিচয় দিয়ে নাকি বলেছে আমি ক্লান্ত আর পালিয়ে কতকাল বেড়াবো।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, চলতি বছরের ২৩শে মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে প্রায় ১ কোটি টাকার চোরাই মাল বোঝাই একখানা স্যাম্পান সহ ৮ ব্যক্তিকে শুল্ক বিভাগীয় গোয়েন্দারা চট্টগ্রামের গভীর সমুদ্রে আটক করে। ঐ চোরাই মালগুলোর মালিক হিসেবে ম্যানছেরুমিয়া ওরফে সিরাজুল ইসলাম মিয়াকে চেনা গেলে সে গা ঢাকা দেয়। এবং দীর্ঘ ৭ মাস পলাতক থাকে। পলাতক থাকাকালে সরকার তার সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। অতঃপর ভোগান্তি এবং পলাতক জীবনের ক্লেশ থেকে মুক্তি পাওয়ার বাসনায় চোরাকারবারীর বিখ্যাত নায়ক নিজের পাপ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।
সান্ত্বনা এই যে, অসাধু ব্যবসায়ী তথা সমাজবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত একটি ব্যক্তি আত্মসমর্পণ করেছে। পাপের ভয়ে কিনা, তা আমরা জানি না, তবে পুলিশের হুলিয়ায় সে যে স্থিতি পাচ্ছিল না কোথাও, তা স্পষ্টই বোঝা যায়। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত এবং পুলিশী তৎপরতার তাড়া ম্যানছেরুমিয়া আর সইতে পারছিল না। তা নইলে চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য থেকে বাস্তবের সংগ্রামমুখর মর্তে ম্যানছেরুমিয়ারা স্বেচ্ছায় নেমে আসবে এমনটি ঘটা প্রায় অসম্ভব।
তাই প্রশ্ন দাঁড়ায় চোরাকারবারীদেরও তাহলে এমন জালে আটকানো যায়, আত্মসমর্পণ ছাড়া যেখান থেকে পালানোর কোনো রন্ধ্র পথ আর থাকে না? এরপরের প্রশ্ন তাহলে ম্যানছেরুমিয়া একা কেন? তার জ্ঞাতিবর্গ যে আছে অসংখ্য। সেই রাঘব বোয়ালগুলোকে ক্লান্ত করা যায় না? যায় না তাদের পেছনে হুলিয়া লেলিয়ে দেয়া বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা? পুলিশী তৎপরতায় তাদের জীবন ও ব্যবসাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়া যায় না?
যদি নাই যায়—তাহলে ম্যানছেরুমিয়ার বেলায় কি করে তা সম্ভব হলো—এ কথা যদি কেউ ভাবে—তাকে দোষ দেয়া যায়না। তাছাড়া ম্যানছেরুমিয়ার আর কয় পয়সার চোরাকারবারী ধরা পড়েছে—মাত্র এক কোটি টাকারই তো? অপরদিকে সারাদেশের সম্পদকে নির্বিচারে যারা আজ সীমান্তের চোরাপথ দিয়ে অন্যত্র পাচার করে দিচ্ছে, তাদের কারবারের সর্বনিম্ন লগ্নিও বোধ হয় এক কোটি টাকা নয়। তারা কি করে নিরাপদে থাকে? প্রতিদিনই প্রায় সংবাদপত্রের পাতায় সংঘবদ্ধ চোরাচালানের তথ্যপূর্ণ যে বিবরণ থাকে সেগুলোর প্রতিও সংশ্লিষ্ট দপ্তর ইচ্ছাকৃতভাবেই থাকেন উদাসীন। অন্ততঃপক্ষে ম্যানছেরুমিয়ার পেছনে যেমন করে কেউ লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল তেমন উদ্যোগ নেয়া হয় না বলেই আমাদের ধারণা।
তাহলে কি আমরা ধরে নেবো যে, চোরাকারবারীদেরও শ্রেণী আছে? এবং কোন শ্রেণীকে ধরতে হবে কোন শ্রেণীকে হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত রাখার শ্লথ চেষ্টা করতে হবে আবার কোন শ্রেণীর পদলেহন করতে হবে—একেও সত্য বলে মেনে নিতে হবে?
আধুনিক বিজ্ঞানের জগতে বৈজ্ঞানিক সত্যেরই মূল্য তর্কাতীতরূপে স্বীকৃত। তাই আমরা কোনো কিছু বিশ্বাস করার আগে তার প্রমাণ চাই। তাই ম্যানছেরুমিয়ার মতো দুর্ধর্ষ ও ধূর্ত সীমান্ত চোরাচালানীকে ক্লান্ত করে ফেলা সম্ভব হলে অন্যান্যদেরও ক্লান্ত করা কেন সম্ভব হয়না আমরা তা বুঝতে চাই। রাতের আঁধারে আজও যেসব ট্রাক ভর্তি চাল আর পাট সহ নানাবিধ দেশজ সম্পদ সীমান্তের ওপারে পাচার হচ্ছে তাদের মূল খুঁজে পাওয়াই বা সম্ভব হচ্ছেনা কেন? তাই যদি দেখি দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত দেশের কোটি কোটি নিরন্ন মুমূর্ষ জনতার মুখের আহার নিয়ে যারা জঘন্যতম কালোবাজারী কারবার আজও চালাচ্ছে তাদেরকে ঢালাও ধরতে গিয়ে আজ আর মুখ চেনাচিনি নয়, বিবেকতাড়িত তৎপরতার সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং জ্ঞাতি কুটুম্ব সহ ম্যানছেরুমিয়ারা ধরা পড়ছে তবেই আমরা আস্থা খুঁজে পাবো—অন্য কোনো সান্ত্বনা বা আপ্তবাক্যে কিছুই এসে যাবে না আমাদের।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন