আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু
ভাষণের অডিও এবং সম্পূর্ন ভাষণ টাইপ করে যুক্ত করা হল। সেই সাথে আজ বঙ্গবন্ধুর আরও একটি ভাষণ আমরা সঠিকভাবে টাইপ করে অনলাইনে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিলাম। আমরা লক্ষ্য করি নানান প্রকাশনায় ও অনলাইনে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রকৃত শব্দকে বিকৃত ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন ও বাতিল করে ছাপানো ও প্রকাশ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেশের জনগণের সম্পদ। এখানে নানান রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস বর্নিত রয়েছে। রয়েছে বাঙালীর ভবিষ্যতের চলার নির্দেশনা। তাই এগুলোর সঠিক প্রকাশ জরুরী। একারণে প্রকৃত ভাষণ সংরক্ষণের এখনই সময়। সংগ্রামের নোটবুক বৃহৎ উদ্যোগে এনিয়ে কাজ করছে। প্রায় তিনশত প্লাস ভাষণ সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগ্রহের সময় আমরা ভাষণের পরিবেশ ও ইমোশনকেও তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ধীরে ধীরে সকল সংগ্রহ সবার কাছে পৌঁছে দেবো। আপনাদের সহায়তা কাম্য।
১৮ই জানুয়ারী ১৯৭৪
ঢাকা
সহকর্মী ভাই ও বোনেরা, বিদেশ থেকে আগত অত্তিথিবৃন্দ এবং আওয়ামী লীগের কর্মী ভাইয়েরা,
আপনারা আমার আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন। স্বাধীনতা সংগ্রামের পর এবারই নির্বাচিত কাউন্সিল সদস্য হিসেবে প্রথম আপনারা সম্মেলনে যোগদান করেছেন। কর্মী ভাইয়েরা, আওয়ামী লীগের ইতিহাস আপনারা জানেন। হাসি-কান্নার ইতিহাস, রক্তের ইতিহাস, অত্যাচারের ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস, জয়ের ইতিহাস। আপনাদের সঙ্গে বাংলার মাঠ-প্রান্তরে, গ্রামে গ্রামে আমি কাজ করেছি। এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম থেকে প্রথমে আমি যোগদান করি যুগ্ম সম্পাদক হিসাবে। তিপ্পান্ন সাল থেকে পঁয়ষট্টি সাল পর্যন্ত কাজ করি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এবং ছেষট্টি সাল থেকে এ পর্যন্ত সভাপতি হিসেবে। গঠনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী হলে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি, সম্পাদক কিংবা কর্মকর্তা হওয়া যায় না। তবুও গতবার আপনারা আমাকে কিছুদিনের জন্য দায়িত্বভার দিয়েছিলেন আপনাদের সভাপতি হিসেবে কাজ করার জন্য। আজ আপনাদের নতুন করে প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তুলতে হবে।
আপনারা জানেন, কিভাবে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। আমরা বাংলাদেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিলাম। দুইশ’ বছর ইংরেজ এ দেশকে শাসন করে। দুইশ’ বছর পরে ১৯৪৭ সালে ফাঁকির স্বাধীনতা আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। আমরা বাংলাদেশের জনগন সংখ্যাগুরু ছিলাম। কিন্তু বাংলার মানুষকে শোষনের পর শোষন করার জন্য সামরিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত পাকিস্তানের সংখ্যালঘু শাসকগোষ্ঠী ১৯৪৭ সালে নতুন করে বাংলাকে পরাধীন করে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের কলোনীতে পরিনত হয়। বাংলাদেশের মানুষকে শোষ্ণ করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী গড়ে তোলে তাদের দেশকে। কিন্তু বাংলার মানুষ চুপ করে থাকে না।
এ সব শাসন, শোষণ ও সংগ্রামের অনেক ইতিহাস আপনাদের জানা আছে। কারন, অনেক আন্দোলনের মধ্য থেকে আপনাদের জন্ম। অনেক রক্ত দিয়ে আপনাদের সংগ্রাম করতে হয়েছে। আপনাদের বারবার মোকাবেলা করতে হয়েছে শোষক শ্রেণীকে। মোকাবেলা করতে হয়েছে একদল মীরজাফরকে। বাংলাদেশের একদল শোষক যদি হাতে হাত না মেলাতোম তাহলে পঁচিশ বছর পাকিস্তানিরা বাংলাকে শোষণ করতে পারতো না। যতবার আমরা সংগ্রামে এগিয়ে গিয়েছি ততবারই এই বাংলার মাটিতে একদল লোক সেই শোষকদের হাতিয়ার হিসেবে আমাদের উপর চড়াও হয়েছে। বার বার আমরা এদের মোকাবেলা করেছি। বারবার আমরা মার খেয়েছি। অবশেষে আমরাও চরম আঘাত হেনেছি, যে আঘাতে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। সহকর্মী ভাইয়েরা ও বোনেরা, ১৯৪৭ সালের পূর্বে আমরা যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করেছিলাম তখন আমাদের স্বপ্ন ছিল আমরা স্বাধীন হবো। কিন্তু সাতচল্লিশ সালেই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমরা নতুন করে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছি।। এর মধ্য থেকেই আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। জনগন তখন বুঝতে পারে নাই শোষক গোষ্ঠীর নায়করা এখানে শক্তিশালী সরকার গঠন করে। তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ব্যবহার করে। এই অবস্থায়ও আমরা কিছুসংখ্যক দেশপ্রেমিক তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার চেষ্টা করি।
আমার মনে আছে ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে প্রথম আমরা ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ লীগ নামে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি। উদ্দেশ্য শোষকগোষ্ঠীর মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু আমরা এগুতে পারলাম না। অনেক সময় থিওরি ও প্রাকটিসে গন্ডগোল হয়ে যায়। থিওরি খুব ভাল। কাগজে-কলমে লেখা থিওরি অনেক মুল্যবান। পড়ে শান্তি পাওয়া যায়। কিন্তু প্রাক্টিক্যাল কাজের সঙ্গে মিল না থাকলে থিওরি কাগজে-কলমে পড়ে থাকে, কাজে পরিণত হয় না।
তখনকার দিনে একদল লোক এ ধরনের থিওরি অনুসারী ছিলো। এ সময় ভারতবর্ষে কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন রণদিভে। তিনি পি সি যোশীকে তাড়িয়ে দিয়ে কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন। তিনি বললেন, এখনই অস্ত্রের সাহায্যে মোকাবেলা করা দরকার। পন্ডিত জওয়াহেরলাল নেহেরু সরকারকে উৎখাত করতে হবে। তারা এদিক-ওদিক আঘাত হানলেন। আমাদের এখানেও কিছুসংখ্যক কর্মী বুঝতে না পেরে সেই পন্থা অবলম্বন করতে গেলেন। আমাদের সঙ্গে তাদের মতের অমিল হলো। আমরা বললাম, দেশের মানুষকে না গড়ে তুলে দেশের মানুষকে মোবিলাইজ না করে এবং পরিষ্কার আদর্শ না নিয়ে চলা যায় না। তারা বুঝতে পারলেন না। ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ লীগ ভেঙ্গে গেলো।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন শোষণ করতে চায় তখন তারা আঘাত করে শিক্ষা ও সংস্কৃতির উপর, ভাষার উপর। তাকে ধ্বংস করতে না পারলে শোষণ করা সহজ হয়ে উঠে না। তাই ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার উপর আঘাত হানলো। সংখ্যাগুরু লোকের ভাষার উপর আঘাত করে আমাদের উপর ঊর্দু ভাষা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করা হলো। তখন একমাত্র রাজনৈ্তিক প্রতিষ্ঠান ছিলো মুস্লিম লীগ। জিন্নাহ্ সাহেব তখনও বেঁচে আছেন এবং তাঁর দলের লোকেরাই বাংলাদেশে শাসন চালিয়েছিল। তাদের শক্তি ছিল, সামর্থ্য ছিল, অর্থ ছিল। বিদেশী শক্তিও তাদের পিছনে ছল। আমরা ভাষার উপর এ আঘাত সহ্য করতে পারলাম না। তারি ফলশ্রুতিতে আটচল্লিশ সালের ৪ঠা জানুয়ারী ছাত্রলীগের জন্ম হয়। ১১ই মার্চ তারিখে ছাত্রলীগের নেতৃ্ত্বে আমরা আন্দোলন শুরু করি। ঐ তারিখেই অন্যান্য কয়েকটি সাংস্কৃতিক প্রাতিষ্ঠানের সঙ্গে একযোগে আমরা শোষকগোষ্ঠীর আঘাতের মোকাবেলা করি।
আজ মনে পড়ে আমার বন্ধু ও সহকর্মী শামসুল হকের কথা। যার সঙ্গে অনেকদিন কাজ করেছি। তিনি আর ইহজগতে নাই। তিনি আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর কথা যদি আগ আমি স্মরণ না করি অন্যায় হবে। মরহুম শামসুল হক আর আমি একসঙ্গে গ্রেফতার হই। তারপরেই আমাদের আন্দোলন শুরু হয়। আমরা বুঝতে পারলাম রাজনৈ্তিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন আছে। তা না হলে আন্দোলন করা যাবে না। তাই আমরা প্রাতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। আমাদের সহকর্মীদের মোবিলাইজ করতে শুরু করলাম।
অনেকে ইতিহাস ভুল করে থাকেন। ১৯৫২ সালের আন্দোলনের তথা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস আপনাদের জানা দরকার। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বন্দী অবস্থায় চিকিৎসাধীন। সেখানেই আমরা স্থির করি যে, রাষ্ট্রভাষার উপর ও আমার দেশের উপর যে আঘাত হয়েছে ২১শে ফেব্রুয়ারী তারিখে তার মোকাবেলা করতে হবে। সেখানেই গোপন বৈঠকে সব স্থির হয়। এ কথা আজ বলতে পারি; কারণ আজ পুলিশ কর্মচারীর চাকুরী যাবে না। সরকারী কর্মচারীর চাকুরী যাবে না। কথা হয়, ১৬ই ফেব্রুয়ারী আমি জেলের মধ্যে অনশন ধর্মঘট করব, আর ২১শে তারিখে আন্দোলন শুরু হবে। জেলে দেখা হয় বরিশালের মহিউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে। তাঁকে বললাম, আমরা এই প্রোগ্রাম নিয়েছি। তিনি বললেন, আমিও অনশন ধর্মঘট করবো। ১৬ই ফেব্রুয়ারী তারিখে আমরা অনশন ধর্মঘট করলাম। এর দরুন আমাদের ট্রান্সফার করা হলো ফরিদপুর জেলে। সূচনা হয় ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের।
তারা চরম আঘাত করলো ভাষার উপর, কৃষ্টির উপর। চরম আঘাত হানলো আমাদের উপর। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের জন্মের পর থেকেই গ্রেফতার অভিযান শুরু হয়। আওয়ামী লীগের কন্ঠ রোধ করে দেয়া হলো। আওয়ামী লীগের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা হলো। আওয়ামী লীগের কর্মীদের পালিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। এভাবেই আমাদের দিন কাটতে থাকে। এ অবস্থায় আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাই। একদিনে সংগ্রাম হয় না। একদিনে দেশ জয় হয় না। একদিনে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এজন্য চাই নীতি ও আদর্শকে সামনে রেখে নিঃস্বার্থভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া।
সহকর্মী ভাইয়েরা, আজ এমন কথা কেনো বলছি? এ জন্যে বলছি যে, এতকাল পর্যন্ত আপনাদের প্রাতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি কাজ চালিয়েছি। আজ আমার বিদায় নেবার পালা।। আজ আমি আপনাদের প্রেসিডেন্ট থাকতে পারি না। আজ আপনাদের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হবে। কারণ আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। এটাই আমার সভাপতির শেষ ভাষণ। এই জন্যই আপনাদের কাছে আমার কিছু বলা দরকার। এ জন্যই আজ সংক্ষেপে আওয়ামী লীগের কিছু ইতিহাস বলছি। এই প্রতিষ্ঠানের কথা চিন্তা করলেই বক্তৃতা আমি দেবার পারি না। কত চেহারা ভেসে উঠে আমার সামনে। কত ত্যাগী কর্মী কারাবরণ করেছে। কত ভাই, কত সহকর্মী শহীদ হয়েছে।এদের সঙ্গে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমি কঠোর পরিশ্রম করেছি। কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে দিন কাটিয়েছি। কত দিন আন্দোলন করতে গিয়ে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি। তাদের কথা আমি স্মরণ না করলে অন্যায় করা হবে। কারণ আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু তারা আমাদের মধ্যে নাই।
১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর চরম আঘাত আসে আওয়ামী লীগের উপর। শোষকগোষ্ঠী আমাদের ভাষা ও কৃষ্টির উপর হামলা চালায়।অত্যাচার চালায় বাংলার মানুষের উপর। কিন্তু আমরাও বসে থাকি নাই। বাংলার জনগন, বাংলার ছাত্র সমাজ, বাংলার যুব সমাজ, বাংলার প্রাগতিশীল কর্মীরা এই হামলার মোকাবেলা করতে থাকে বারবার। কিন্তু অপরপক্ষ ছিল বড় শক্তিশালী। তাদের হাতে ছিল অস্ত্র, মেশিনগান। তাদের কাছে ছিল অর্থ, ছিল ধোঁকাবাজি। তারা বিশেষ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত ধর্মের নাম। আমার বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু। তাই ধর্মের নামে ধোঁকা দেয়া যত সহজ অন্য কিছুতে ততটা সহজ নয়। তাই ধর্মকে তারা ব্যবহার করলো বাংলার মানুষকে শোষণ করার অস্ত্র হিসেবে।
১৯৫২ সালের আন্দোলনের পরে শোষকগোষ্ঠী দেখলো যে, বাংলা ভাষাকে এভাবে দাবানো যাবে না। তাই তারা ছলে বলে কৌশলে আমাদের ভাষা, কৃষ্টি ও সভ্যাতাকে এবং আমাদের আন্দোলনকে বানচালের চেষ্টা করতে আরম্ভ করে।
ভাই ও বোনেরা, ১৯৫৪ সালের ইতিহাস আপনারা জানেন। আমরা বায়ান্ন সালে জেল থেকে বের হয়ে আসি। তিপ্পান্ন সালেও আমাদের অনেক কর্মী গ্রেফতার হয়। ১৯৫৪ সালে একটা নির্বাচন দেয়া হল। আওয়ামী লীগের নেতৃ্ত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। বাংলাদেশে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সেই যুক্তফ্রন্ট। বাংলার মানুষ একতাবদ্ধ হয়। শেরে বাংলা ফজলুল হক তখন চীফ মিনিষ্টাভ হন। কিন্তু পাকিস্তানের শোষকগোষ্ঠী আঁতকে উঠে। তারা বাংলার মানুষকে একতাবদ্ধ হতে দেবে না। তাই আবার তারা আঘাত হানার চেষ্টা করে।
যেদিন আমি মন্ত্রী হিসেবে শেরে বাংলার কেবিনেটে শপথ নিয়েছি সেদিনের কথা আমার মনে আছে। ঠিক সেই সময় এক ঘন্টার মধ্যে আদমজীতে এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করা হল। তারা ষড়যন্ত্র করলো এই সরকারকে উৎখাত করতে হবে। তাই সৃষ্টি করলো তাদের দালালদের দিয়ে এই দাঙ্গা। মানুষের জন্য তাদের কোন দরদ ছিল না। মানুষকে তারা ভালবাসতো না। ক্ষমতাকেই তারা বড় করে দেখতো। তাই চুয়ান্ন সালে তারা দাঙ্গা বাধালো আদমজীর পাট কলে। আমার মনে আছে, পাঁচ শ’রও বেশী লোক সেখানে মারা যায়। শপথ নিয়েই সেখানে আমরা দৌড়ে যাই। উপস্থিত হই। মোকাবিলা করি। মানুষকে বুঝাবার চেষ্টা করি।
১৯৫১ সালেও তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে বাংলার মাটিতে। এতে এদেশের অনেক নিরীহ লোক জীবন দেয়। এই দাঙ্গা তারা সৃষ্টি করে বাঙালি জাতিকে বিভক্ত করার জন্য কারণ, বাংলাদেশে যদি বিভেদ সৃষ্টী করা না যায় তাহলে তারা শাসন ও শোষণ চালাতে পারবে না। এমনি করে তারা চালায় তাদের ষড়যন্ত্র। আমার মনে আছে তদানীন্তন প্রাদেশিক পরিষদের ৫০ জনের মত সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। আমাদের কয়েক হাজার কর্মী গ্রেফতার হয়। বাংলার মানুষের উপর অত্যাচারের ষ্টীম রোলার চলে। কিন্তু আমরা নিরুৎসাহ হই নাই। আমরা আরো সংঘবদ্ধভাবে সংগ্রাম আরম্ভ করার চেষ্টা করি। আমরা ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। আওয়ামী লীগের পরিষ্কার আদর্শ আমাদের সামনে ছিল। আওয়ামী লীগের ম্যানিফেষ্টো ছিল। তাদের কর্মী ছিল, তাদের প্রতিষ্ঠান ছিল।
সহকর্মী ভাইয়েরা, আমাদের রাষ্ট্রের চারটি আদর্শ আছে। রাজনৈ্তিক প্রতিষ্ঠানগুলিরও তেমন চারটা স্তম্ভ থাকা প্রয়োজন। এই চারটি স্তম্ভ ছাড়া কোন রাজনৈ্তিক প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। আমি গর্বিত যে পঁচিশ বছরে আওয়ামী লীগ সেই স্তম্ভগুলি প্রতিষ্ঠিত করেছে। পঁচিশ বছরের আওয়ামী লীগ কর্মীদের জন্য আমি গর্বিত। বারবার জনগনের সাহায্য ও সমর্থনের জন্য। আমি কৃতজ্ঞতা প্রাকাশ করছি। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রথম প্রয়োজন সঠিক নেতৃ্ত্বের। সঠিক নেতৃ্ত্ব ছাড়া রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিয়েছে। নেতারা চেষ্টা করেছেন সঠিক নেতৃ্ত্ব দেওয়ার জন্য। নেতৃ্ত্বের সঙ্গে প্রয়োজন আদর্শের। যাকে অপর কথায় বলা যায় ম্যানিফেষ্টো। প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য কি আদর্শ কি এটা থাকতেই হবে। নেতৃ্ত্ব ও আদর্শের পরে প্রয়োজন নিঃস্বার্থ কর্মীর। নিঃস্বার্থ কর্মী ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠান বড় হতে পারে না, কোন সংগ্রাম সাফল্যমন্ডিত হতে পারে না। এর পর প্রয়োজন সংঠনের। সংগঠন ছাড়াও কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কাজ সফল হতে পারে না।
সেই জন্য বলছিলাম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের চারটি জিনিষের প্রয়োজন এবং তা হচ্ছে নেতৃ্ত্ব, ম্যানিফেষ্টো বা আদর্শ নিঃস্বার্থ কর্মী এবং সংগঠন। আমি আনন্দের সাথে বলতে পারি যে আওয়ামী লীগের ১৯৪৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত নেতৃ্ত্ব ছিল, আদর্শ ছিল, নিঃস্বার্থ কর্মী ছিল এবং সংগঠন ছিল। এই ভিত্তির উপরই সংগ্রামে এগিয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগ ইতিহাস সৃষ্টি করতে পেরেছে।
১৯৫৪ সালের পর অনেক ইতিহাস। আমরা ধাপে ধাপে এগিয়ে যাই। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। তারপর পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন শুরু হয়। বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চলে। কিন্তু শোষকগোষ্ঠী দেখলো যে, এভাবে চলতে দেয়া যায় না। তাই ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারী করে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন।
বাংলাদেশ আরও বিপদের মধ্যে গিয়ে পড়ে, কারণ সামরিক বাহিনীর শতকরা ৯৫ জন ছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের। তারা বাংলাদেশেরও সরকার দখল করল। মার্শাল ল’ জারী করার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে শোষণ করা। আমরা গ্রেফতার হলাম। সহকর্মীরা গ্রেফতার হলো। আওয়ামী লীগ পার্টি ব্যাণ্ড হলো। কিন্তু তারা চুপ করে বসে রইলো না। ব্যাণ্ড হয়ে গেলেও আওয়ামী লীগের কাজ চললো।
আমরা সংখ্যাগুরু। তারা সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও বন্দুকের জোরে বাংলার মানুষের উপর মিলিটারী শাসন আরম্ভ করলো। দু’শ’ বছরে ইংরেজ যা করে নাই। পঁচিশ বছরে পাকিস্তানিরা বাংলার মাটিতে তাই করলো। সম্পদ অর্থ যা কিছু সেখানে জড়ো করলো। সেখানে রাজধানী, সেখানে সামরিক বাহিনীর হেডকোয়ার্টার, ইনভেষ্টমেন্টের হেডকোয়ার্টার, এসেম্বলী সব কিছু প্রতিষ্ঠিত হলো।
পনের শ’মাইল দূরের দুটি অংশ নিয়ে কোন সময় কোন একটি রাষ্ট্র হয়েছে বলে আমার জানা নাই। কিন্তু আমরা ধর্মভীরু মানুষ তাই পাকিস্তানিরা ধর্মের নামে এক রাষ্ট্রের দোহাই দিতে আরম্ভ করলো। আমরা যারা ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করেছিলাম তারা সংগ্রাম করেছি। যারা বুঝতে চেষ্টা করে নাই তারা তাদের দালালী করেছে।
১৯৬২ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেব গ্রেফতার হন। ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। আওয়ামী লীগ পার্টি তখন ব্যান্ড। অন্যান্য পার্টিও ব্যান্ড ছিল। আমরা জেল থেকে চেষ্টা করলাম কি করে প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখা যায় এবং সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া যায়। আমরা আওয়ামী লীগকে বাঁচিয়ে রাখলাম। আওয়ামী লীগ কর্মীরা যে যেখানে ছিল বিপদের সম্মুখীন হয়েও নীতি পরিবর্তন না করে, আদর্শ পরিবর্তন না করে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে।
আমরা চিন্তা করে দেখলাম এদের সংগে আর আমাদের চলবে না। যেখানে আদর্শের মিল নাই, যেখানে মতের মিল নাই, যেখানে ভাষার মিল নাই, যেখানে চিন্তার মিল নাই সেখানে এক রাষ্ট্র চলতে পারে না। আজ কোথায় পাকিস্তান, কোথায় বাংলাদেশ। পনের শ’মাইলের ব্যবধানে তার সংগে আমাদের কোন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নাই। এক রাষ্ট্র করা হয়েছিলো বাংলাদেশকে শোষণ করবার জন্য, কলোনী করার জন্য। তারা সাড়ে সাত কোটি লোকের বাংলাদেশকে তাদের শিল্পপন্যের বাজারে পরিণত করে। তাদের কল-কারখানার শিল্প দ্রব্য বাংলাদেশে বিক্রয় করে এখানকার অর্থ-সম্পদ লুটে নেয়। আমাদের কিছু কিছু লোক ছিল তারা মন্ত্রী হলেও খুশী হতেন, পার্লামেন্টের সদস্য হলে হতেন, সামান্য ব্যবসায়ী হলে খুশী হতেন। কিন্তু সাড়ে সাত কোটি মানুষের কথা তারা চিন্তা করতেন না।
১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেব এন্তেকাল করলেন। আওয়ামী লীগকে আমরা রিভাইব করলাম। আবার আমরা আওয়ামী লীগকে অর্গানাইজ করার উদ্যোগী হলাম। এই সময় কিছু কিছু লোক আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে চলে গেল। ভালই হলো। আবর্জনা যতই যায় ততই মঙ্গল। কয়েকবারই এরকম হয়েছে। কিন্তু তাতে প্রতিষ্ঠানের কোন ক্ষতি হয় না। যাদের আদর্শ নাই, যাদের নীতি নাই যারা দুর্নীতিবাজ, যারা দেশকে ভালবাসে না তারা যদি প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে যায়, তাতে প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয় না। প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হয়। তাই ভবিষ্যতেও এ ধরণের লোকদের প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দিয়ে আওয়ামী লীগকে আপনাদের আরো শক্তিশালী করতে হতে পারে।
ভাইয়েরা ও বোনেরা, আমরা আমাদের সহকর্মীদের নিয়ে সুনির্দিষ্ট পথে যাওয়ার স্থির সিদ্ধান্ত নিলাম। তারপর অনেক ভাঙ্গা-গড়া হলো। ১৯৬৬ সালে আমার দেশবাসী জানতে চায় পরিষ্কার রাস্তা কোথায়? বাঙালি চায় কি? তাদের সামনে কি আছে? তখন ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুল নামে একটা পদার্থ ছিল। ফান্ডামেন্টাল রাইটস ছিল না, আয়ুবী শাসন চলছিল তখন বাংলার মাটিতে। অত্যাচারের স্টিম রোলার চলছিল বাংলার মাটিতে আমাদের চোখের সামনে। আমি আমার সহকর্মীদের নিয়ে বসলাম। পরিষ্কার পন্থা দিতে হবে। বাংলার মানুষকে আর আমরা এভাবে শোষিত হতে দিতে পারি না। মানুষের একদিন মরতে হয়। আমরা বহু অত্যাচার সহ্য করেছি দরকার হলে আরো অত্যাচার সহ্য করবো। কিন্তু পরিষ্কার রাস্তা দেখাতে হবে। ওদের সঙ্গে আমরা থাকতে পারি না। আমার বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হবে। বাংলার মানুষকে রক্ষা করতে হবে। বাংলার অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলতে হবে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তন করতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে থেকে বাংলার মানুষ তা কোন দিন করতে পারবে না। এর উপায় কি?
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলতে চাই, যারা মনে করেন রাতের অন্ধকারে গুলী করে কিংবা একটা রেল লাইন তুলে দিয়ে টেরোরিজম করে বিপ্লব হয়, তারা কোথায় আছেন, তারা জানেন না। এই পন্থা বহু পুরানো পন্থা। এই পন্থা দুনিয়ায় কোন দিন কোন কাজে লাগে নাই। এ পন্থা দিয়ে দেশের মানুষের কোন মঙ্গল করা যায় না। একটা রাস্তা ভেঙ্গে দিয়েও একজন লোককে অন্ধকারে হত্যা করে শুধু শুধু মানুষকে কষ্ট দেয়া হয়। এই টেরোরিজম দিয়ে দেশের বিপ্লব হয় না, হয় নাই, হতে পারে না। জনগণকে ঝাড়া, জনগণকে সংঘবদ্ধ না করে, জনগণকে আন্দোলনমুখী না করে এবং পরিষ্কার আদর্শ সামনে না রেখে কোন রকম গণ-আন্দোলন হতে পারে না। এবং সেখানে কোন বিপ্লব হতে পারে না। দুঃখের বিষয়, অনেকে এখনও টেরোরিজম-এ বিশ^াস করেন। যাই হোক, ভবিষ্যতে তাদের ভুল ভাঙ্গবে। সময় থাকতে না ভাঙ্গলে তাদের ক্ষতি বেশী হবে। জনগণের ক্ষতিতো হবেই, কিন্তু তাদেরও ক্ষতি হবে।
পরিষ্কার রাস্তা হিসেবে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দেওয়া হলো। আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষা ব্যবহার করবেন বলে হুমকি দিলেন। আইয়ুব খান বোকা ছিলেন না। আইয়ুব খান বুঝতে পারলেন, ৬ দখা আওয়ামী লীগ কেন দিয়েছে? এর পিছনে উদ্দেশ্য কি? পাকিস্তানিরা বুঝতে পেরেছে, এর উদ্দেশ্য কি? এবং আমরা জানতাম আমাদের উদ্দেশ্য কি ও কোথায় আমরা যাবার চাই। কি আমরা বোঝাতে চাই।
৬-দফা বাংলার মানুষের মুক্তি সনদ। আমরা মুক্তি সনদ কেন দিলাম, আইয়ুব খান বুঝতে পারলেন। তাই তিনি আগরতালা ষড়যন্ত্র মামলা করলেন আমাদের বিরুদ্ধেÑÑ সামরিক বাহিনীর কিছু বাঙালি ছেলে, বাঙালি সরকারী কর্মচারী ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তারা আমাদের কারাগারে বন্দী করলেন। আওয়ামী লীগকে ব্যা- করলেন না, কিন্তু তারা বন্দী করলেন অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকে আওয়ামী লীগ ভাঙ্গার জন্য পাকিস্তান থেকে কিছু নেতা এসে তখন চেষ্টা করলেন। ভাঙ্গলেন কিছুটা, কিছু কিছু আওয়ামী লীগ নেতা বুঝতে না পেরে যোগদান করলেন তাদের সাথে। আমি তখন কারাগারে বন্দী। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন, মনসুর আলী, শামসুল হক, জালাল, জহুর ও চিটাগাং-এর আজিজ সহ আমাদের বহু সহকর্মীও বন্দী হয়। যারা বাইরে রইলো, তারা ৬-দফাকে আঁকড়ে ধরলো। তারা মোকাবেলা করলো, নেতৃত্ব দিলো। নজরুল ছিলেন অ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট, এই অবস্থায়ই তারা শুরু করলো। শাসকরা পারলো না আওয়ামী লীগকে দাবাতে।
বাংলার ছাত্র-জনতা রুখে দাঁড়ালো এর বিরুদ্ধে। গণ-আন্দোলন শুরু হলো। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো। ছাত্র লীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও অন্যান্য সব প্রগতিশীল ছাত্র প্রতিষ্ঠান ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করলো। তারা আওয়ামী লীগকে সক্রিয় সমর্থন দিলো এবং তাদের সঙ্গে যোগদান করলো। আইয়ুব খানের আসন নড়ে উঠলো। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা উইথড্র হয়ে গেলো। আমরা খালাস পেলাম।
আবার একটা ফন্দি করা হলো। রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স। রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সের উদ্দেশ্য ছিল একটা কনস্টিটিউশন প্রবলেম সলভ করা। আমি আমার সহকর্মী ছাড়াও কয়েকজন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে গেলাম আমার সঙ্গে। কারণ আমাদের বুঝতে হবে, এটা রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স না ধোঁকা। আসলে এটা ছিল বাংলাকে শোষণ করার আরেকটা ষড়যন্ত্র তাই আপনাদের পক্ষ থেকে আমি তা রিজেক্ট করলাম। বলে দিলাম, সংগ্রাম করে বাংলার মানুষ তাদের দাবী আদায় করবে। রাউন্ড টেবিলে বসে নয়।
আইয়ুব খান বিদায় নিলেন। ইয়াহিয়া খানকে বসিয়ে দেয়া হলো। প্রেসিডেন্ট হয়ে বসে পড়লেন আর এক জেনারেল সাহেব। তিনি বললেন, নির্বাচন দিবেন। নির্বাচন দেওয়া হলো। আমাদের অনেকে বুঝতে পারলেন না। তারা বড় বড় বক্তৃতা করলেন, প্রশ্ন করলেন কেন আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি? বাংলার মানুষ যে একতাবদ্ধ, এক; বাংলার মানুষ যে বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ যে মুক্তি চায় তার জন্য আমাদের নির্বাচনে যাওয়া প্রয়োজন। তারা একথা বুঝতে পারেন নাই। বুঝতে পারেন নাই, শেখ মুজিব আর আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য কি?
আমরা নির্বাচনে গেলাম। আমরা ১৬৯টি সিটের মধ্যে ১৬৭টি সিট ক্যাপচার করলাম। দুনিয়া দেখলো, বাংলার মানুষ একতাবদ্ধ। এই প্রথম একতাবদ্ধ। বাংলার মানুষের মধ্যে কনফিডেন্স ফিরে আসলো। ইয়াহিয়া খান আঁতকে উঠলেন। শোষকগোষ্ঠী আঁতকে উঠলো। তারা আঘাত করার জন্য প্রস্তুত হলো। আমরা জনগণকে আন্দোলনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলাম। আমরা শপথ গ্রহণ করলাম যে, নীতির সঙ্গে কোন আপোষ নাই। জনগণ যে ম্যাণ্ডেট দিয়েছে তা থেকে আমরা সরতে পারি না।
তারপরের ইতিহাস চরম ইতিহাস। ধাপে ধাপে বাংলার মানুষকে এগিয়ে নিতে হয়েছে ধাপে ধাপে বাংলার মানুষকে আন্দোলন করতে হয়েছে। অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে অনেকে বক্তৃতা করে, বড় বড় তেজি বক্তৃতাঃ কিন্তু তারা জানে না ১৯৪৭-৪৮ সাল কি ছিলো। ১৯৫০, ’৫২, ’৫৪ সাল কি ছিল। ওরা জানে না ১৯৫৭-৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৫-৬৬, ১৯৬৮-৬৯ ও ’৭০ সাল কি ছিলো। ওদের কারো কারো সে দিন জন্ম হয় নাই। অনেকে আন্দোলন দেখে নাই। আন্দোলন কাকে বলে জানে না। কোন দিন জীবনে জেলের দরজা দেখে নাই। অবিচারের সামনে পড়ে নাই। আন্দোলন গাছের ফল নয়। আন্দোলন মুখ দিয়ে বললেই করা যায় না। আন্দোলনের জন্য জনমত সৃষ্টি করতে হয়। আন্দোলনের জন্য আদশ্য থাকতে হয়। আন্দোলনের জন্য নিঃস্বার্থ কর্মী থাকতে হয়। ত্যাগী মানুষ থাকা দরকার। আর সর্বোপরি জনগণের সংঘবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ সমর্থন থাকা দরকার।
তারা ভুলে যায, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগের ইতিহাস ভুলে যায়, কি ভাবে ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এককভাবে এদেশে নন-কোঅপারেশন মুভমেন্ট করে। ছাত্র-জনা, ধর্ম শ্রেণী ও পেশা নির্বিশেষে তাতে যোগদান করেছিলো। দেশের মানুষ সংঘবদ্ধ ছিলো, শোষকগোষ্ঠী আঁতকে উঠেছিলো। শোষকরা জানতো এবং আমরাও জানতাম যে, আওয়ামী লীগ তাদের দাবী থেকে এক চুলও নড়বে না। কারণ আওয়ামী লীগ কোন দিন ওয়াদা ভংগ করে নাই। তারা ওয়াদা ভংগ করতে পারে না। বাংলার মানুষ যা বলেছে তাই হবে। এর পিছনে সরার ক্ষমতা আমাদের নাই। তাই আমি সেদিন বলেছিলাম ৬-দফা জনগণের সম্পদ আওয়ামী লীগের আর শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পদ নয়। ওটার সংগে আপোষ হয় না। অনেকে গোপনে আপোষের প্রপাগাণ্ডা করতেন। কিন্তু আমরা জানতাম যে ইয়াহিয়া খান সৈন্য সমাবেশ করছেন।
আজ সকলের জানা দরকার আমরাও বসে ছিলাম না। আমরা যদি বসে থাকতাম একই সময় একই মুহুর্তে বাংলাদেশের ৫৮টা মহকুমায় সশস্ত্র বিপ্লব শুরু হতো না। রেসিসট্যান্ট মুভমেন্ট শুরু হতো না। শুরু হয়েছিলো এজন্য যে, তখন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিচ্ছিলো।
২৫শে মার্চ তারিখে আমি যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম, আমি যখন বাংলার মানুষকে ডাক দিলাম তখন আমি গ্রেফতার হয়ে গেলাম। কিন্তু আমার সহকর্মীরা আমার অনুপস্থিতিতেও সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সংগ্রাম উপরের থেকে পড়ে নাই। নজরুল তখন অ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট হয়েছিলো। প্রেসিডেন্ট আমাকে করে। তাজউদ্দিন প্রাইম মিনিস্টার হয়েছিলো। তারা দেশের এই সংগ্রাম চালায়। অবশ্য আমাদের সহযোগী দু-একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আমাদের সমর্থন দিয়েছিলো। কম্যুনিষ্ট পার্টি দিয়েছিলো। আমাদের মোজাফ্ফর ন্যাপও দিয়েছিলো। কিন্তু সেদিন প্রতিষ্ঠান ছিলো কার? নেতৃত্ব ছিলো কার? আজ যারা বড় বড় কথা বলে, কোথায় ছিলো তারা? কোথা থেকে তারা এসেছে? কে তাদের কথা শুনতো?
আজকে তারা সংগ্রাম করে গভর্ণমেন্ট গঠন করতে চায়। ২৫শে মার্চ তারিখে কার উপরে আক্রমণ শুরু হয়? আক্রমণ শুরু হয় আওয়ামী লীগের উপরে, আওয়ামী লীগের কর্মীদের উপরে, বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপরে, রাজারবাগের আমার পুলিশের উপরে, আমার সামরিক বাহিনীর বাঙালি ছেলেদের উপরে, আর আমার বিডিআর-এর উপরে।
এরপর রেসিসট্যান্স মুভমেন্ট আরম্ভ হয়। এরোপ্লেন, জাহাজ না থাকলে তারা কিছুই করতে পারতো না। আমাদের অস্ত্র ছিলো না। সামান্য যা জোগাড় করতে পেরেছিলাম সেগুলো সমস্ত জায়গার বাংলাদেশের মহকুমায় মহকুমায় পাঠানো হয়েছিলো। প্রত্যেক মহকুমায় মহকুমায় আমাদের কমাণ্ডার ঠিক করা ছিলো। প্রত্যেক জিলায় জিলায় আমাদের কমাণ্ডার ঠিক করা ছিলো। স্বাধীনতা আন্দোলন একদিনে হয় নাই। স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয়েছে ২৫ বছর আগে থেকে। আওয়ামী লীগের জন্ম, সংগ্রামের জন্ম। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানের আজ যদি মৃত্যু হয় তবে আমি দেখতে চাই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই যেনো মৃত্যু হয়।
কর্মী ভাইয়েরা আজ তোমাদের সামনে আমার অনেক কথা বলার আছে। কত হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোক শহীদ হয়েছে বাংলার স্বাধীনতার জন্য। লক্ষ লক্ষ মা-বোনের আর্তনাদ আজও মোছে নাই, আজও থামে নাই। আজও তাদের চোখের পানি যায় নাই। সেই সংগ্রামে আওয়ামী লীগের এমন কোন কর্মী নাই যার বাড়ী ঘর জ্বালাইয়া দেওয়া হয় নাই। গ্রামে গ্রামে আওয়ামী লীগারদের বাড়ী কোনটা, আওয়ামী লীগের কর্মীর বাড়ী কোনটা, আওয়ামী লীগের বাপ-মা কে সেইগুলো বেছে বেছে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ কর্মীকে ধরতে পারলে এক মুহুর্তও দেরী করে নাই, গুলী করে হত্যা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ যুবক, লক্ষ লক্ষ কৃষক, লক্ষ লক্ষ শ্রমিক রক্ত দিয়েছে। আর কারো কথায় নয় শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকেই তারা জীবন দিয়েছে। স্বাধীনতার ইতিহাস কোনদিন মিথ্যা করতে নাই। আমার সহকর্মীরা যারা এখানে ছিলো তারা সকলে জানতো যে ২৫ তারিখ রাত্রে কি ঘটবে। তাদের বলেছিলাম, আমি মরি আর বাঁচি সংগ্রাম চালিয়ে যেয়ো। বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে। ৭ই মার্চ কি স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলা বাকী ছিলো। প্রকৃতপক্ষে ৭ই মার্চই স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিলো। সেদিন পরিষ্কার বলা হয়েছিলো , এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রামÑÑÑ এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। সহকর্মী ভাইয়েরা, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আপনারা জানেন, আমি আর বলতে চাই না। ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কি করেছে আপনারা জানেন। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, রাস্তা-ঘাটের অবস্থা, পোর্টের অবস্থা সবই আপনারা জানেন।
১০ই জানুয়ারি তারিখে আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম, আজ আমি বেঁচে আছি, অথচ আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিলো। এ দুবছর লাইফের এক্সটেনশন হলো। ৫৭ বছর চাকুরী হয়ে গেলে সরকারি চাকুরি যেমন এক্সটেনশন হয় তেমনি আমার লাইফেরও এক্সটেনশন হয়েছে। কিন্তু কয় বছর এক্সটেনশন হয়েছে তা আমার জানা নাই। কারণ ওটা খোদার হাতে। তবে দুই বছর পার হয়েছে বলতে পারি। আমার সহকর্মীদের বলা হয়েছিলো তাই। ধরা পড়লে আর এক্সটেনশন হতো না সঙ্গে সঙ্গে শেষ।
তাই আজকে ভেবে দেখুন যে আদর্শের জন্য স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছেন সে আদর্শ কি? কেন স্বাধীনতা সংগ্রাম করলাম? কেন লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন দিল? আজ সত্যই আমরা স্বাধীন। আজ আমার পতাকা ওড়ে, আজ আমার জাতীয় সংগীত বাজে। দুনিয়ার ১১৬টি দেশ আমাদের রিকগনিশন দিয়েছে। আজ আমার কৃষ্টি ও ভাষার উপর কেউ আঘাত করতে পারবে না। আজ বাংলার মাটি আমার, আমি বাংলার মাটির। আজ বিদেশী শোষকরা আমার দেশকে শোষণ করতে পারবে না। আজ সাম্রাজ্যবাদের দালাল বাংলার মাটিতে স্থান পাবে না। আজ আমরা বাংলার মানুষকে শোষণ করতে দিব না। আজ বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র্র্র এটা একদিক। আর একদিক রয়েছে, সহকর্মী ভাইরা মনে রেখ, কোন দিন আমি আমার কথা না বুঝে বলি না। আমি জেনেশুনেই বলেছিলাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। কিন্তু মানুষ মুক্তি পাবে সেই দিন যেইদিন অর্থনৈতিক মুক্তি দেবা বাংলার মানুষকে। তোমরা এক যুদ্ধে জয় লাভ করেছো, দ্বিতীয় যুদ্ধ শুরু করেছো। আওয়ামী লীগের সহকর্মীরা এইখানেই তোমাদের পরীক্ষা অগ্নি পরীক্ষা।
আজ আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে ভারতবর্ষের কথা স্মরণ করি। পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী পাঁচ ডিভিশন সৈন্য নিয়ে বাংলার মাটিতে থাকতে পারে নাই। এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো। আমার সহকর্মীরা আশ্রয় নিয়েছিলো। ভারতের জনগণ এবং শ্রীমতি গান্ধী ও তাঁর সরকার বাংলার মানুষকে যদি সেই দিন আশ্রয় না দিত, যদি সান্ত¡না দিত– বাংলার মানুষের দাঁড়াবার জায়গা থাকতো না। পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর লোকের আমার দেশের মানুষকে শেষ করে দিত। তাই আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে তাদের স্মরণ করি।
কিন্তু তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করার ষড়যন্ত্র চলছে। আমি পরিষ্কার বলতে চাই, এ বন্ধুত্ব এমনি আসে নাই। দুর্দিনে যে লোক আমার পাশে দাঁড়ায় সেই হলো আমার সত্যিকারের বন্ধু। তাই ভারতবর্ষ আমার বন্ধু, আমরা স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ, ভারত স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। তার ব্যাপারে আমি হস্তক্ষেপ করবো না। আমার ব্যাপারে তারা হস্তক্ষেপ করবে না। পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানের ভিত্তিতে আমি বাস করতে চাই। আজ আমি স্মরণ করি আমার সহকর্মী ভাইদের কথা, আমার বাংলার জনগণের কথা– যে জনগণ রক্ত দিয়ে গেছে। স্মরণ করি আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের কথা– যারা রক্ত দিয়েছে, যারা মরে শহীদ হয়েছে, যারা আজ পঙ্গু হয়ে আছে। আমি স্মরণ করি সেই মা-বোনদের কথা– যাদের উপর অত্যাচার হয়েছে, সেই সংগে আমি নিশ্চয়ই স্মরণ করি ভারতের সেই সমস্ত সেনাবাহিনীর জোয়ানদের কথা, ১৪ হাজার জোয়ান, যারা বাংলার মাটিতে রক্ত দিয়ে বাংলার মানুষকে বাঁচিয়েছিল।
রাষ্ট্র চালানো ছেলে খেলা নয়। রাষ্ট্র চালানো এতো সোজা নয়। আওয়ামী লীগ কর্মী ভাইয়েরা, আমি আগেই বলেছি আজ স্বাধীনতা সংগ্রাম করে আমরা স্বাধীন হয়েছি, এখন আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে। যে জনগণ সংঘবদ্ধভাবে আপনাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলো সেই জনগণ কিন্তু আজও আছে। যদি আজ জনগণ আপনাদের অশ্রদ্ধা করে, জনগণ যদি আপনাদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে সেই জন্য বাংলার জনগণ দায়ী হবে না– দায়ী হবেন আপনারা, দায়ী হব আমরা। আপনারা জানতেন না কোন দিন আপনারা ক্ষমতায় আসবেন। আওয়ামী লাগ সহকর্মীরা, আপনারা জানতেন না এত সহজে কোনদিন আপনারা যুদ্ধে জয়লাভ করবেন। এত তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা পাবেন। আপনারা আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা এনেছি। এ স্বাধীনতাকে আমারদের রক্ষা করতে হবে।
কিন্তু স্বাধীনতা পেলেও বিদেশী দালালরা আজ চুপ করে বসে নাই। এ স্বাধীনতাকে তারা আজ সহজে গ্রহণ করতে পারে নাই। সেই জন্যই তারা ছলে বলে কৌশলে কাজ করছে। সম্মুখ সমরে না যেয়ে পিছনের রাস্তা অবলম্বন করেছে। পিছনের পথ দিয়ে ছলে বলে কৌশলে দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে। মাত্র দু’ বছর আগে আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি তাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে।
আমি বিশ্বাস রাখি, আওয়ামী লীগ কর্মীদের জীবন থাকতে এ স্বাধীনতা কেউ নস্যাৎ করতে পারবে না। সহকর্মী ভাইয়েরা আজ আপনাদের সামনে যথেষ্ট কাজ রয়েছে। স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনি কষ্টকর। আজ আমাদের নীতি পরিষ্কার। আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে চারটা স্তম্ভ রয়েছে। এটার মধ্যে কোন কিন্তু নেই। এটা পরিষ্কারভাবে শাসনতন্ত্রে দেওয়া হয়েছে। আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমরা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করি। আওয়ামী লীগ পার্টি বিশ্বাস করে আওয়ামী, সংগ্রাম করেছে, তাই আওয়ামী লীগের ম্যানিফেষ্টোতে যে নীতি ছিল তা আজ রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত হয়েছে। এটা রক্ষা করার দায়িত্ব আওয়ামী লীগ কর্মীদের সব চেয়ে বেশী। যে বিশ্বাস করবে না, তার জন্য রাস্তা খোলা আছে। আমাদের নীতি পছন্দ না হয়ে চলে যেতে পারেন। থাকলে নীতি বিশ্বাস করে থাকতে হবে। মানুষ মরতে পারে নীতি আদর্শ মরে না কোনদিন। স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়লাভের পরে আপনারা শাসনতন্ত্র দিয়েছেন। আপনার নির্বাচন দিয়েছেন। বাংলার মানুষ শতকরা ৯৭টি সিট আপনাদের দিয়েছে। এদেশ শাসন করার অধিকার আপনাদের আছে।
কিন্তু দেশ শাসন করতে হলে নিঃস্বার্থ কর্মীর প্রয়োজন। হাওয়া কথায় চলে না। সেদিন ছাত্ররা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলো। তাদের বলেছিলাম, আত্মসমালোচনা কর। মনে রেখ আত্মসমালোচনা করতে না পারলে নিজকে চিনতে পারবা না। তারপর আত্মসংযম কর, আর আত্মশুদ্ধি কর। তাহলেই দেশের মঙ্গল করতে পারবা।
আওয়ামী লীগ কর্মী ভাইয়েরা, কোনদিন তোমরা আমার কথা ফেলো নাই জীবনে। আমি কোনদিন কন্টেষ্ট করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বা প্রেসিডেন্ট হই নাই। জীবনভরই তোমরা আমাকে সর্বসম্মতিক্রমে নেতৃত্ব দিয়েছো। তোমরা আমার কথায় রক্ত দিয়েছো, আজ শেষ দিনÑÑ কেন না আমি সভাপতি পদ ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছিÑÑ তোমরা আমার কথা মনে রেখ। আমার কথা ভুলো না। কোন দিন স্বার্থে অন্ধ হয়ে তোমাদের ডাক দেই নাই। কোন দিন কোন লোভের বশবর্তী হয়ে কোন শয়তানের কাছে মাথা নত করি নাই। কোন দিন ফাঁসির কাষ্ঠে বসেও বাংলার মানুষের সঙ্গে বেঈমানী করি নাই। আমি বিশ^াস করি তোমরা আমার কথা শুনবা, তোমরা আত্মসমালোচনা কর, আত্মসংযম কর। তোমরা আত্মশুদ্ধি কর। দুই চারটা-পাঁচটা লোক অন্যায় করে, যার জন্য এতো বড় প্রতিষ্ঠান যে প্রতিষ্ঠান ইতিহাস সৃষ্টি করেছে যে প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতা এনেছে, যে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ লক্ষ কর্মী জীবন দিয়েছে যে প্রতিষ্ঠান ২৫ বছর পর্যন্ত ঐতিহাসিক সংগ্রাম করেছে তার বদনাম হতে দেওয়া চলে না।
আজ বাংলার নিভৃত কোণে আমার এক কর্মী পড়ে আছে যার জামা নাই, কাপড় নাই। তারা আমার কাছে আসে না। আপনাদের অনেকেই এখানে আছেন। কিন্তু আমি যদি চর কুকরী-মুকরী যাই আমার ঐ ধরণের কর্মীকে আজও দেখি। আমি যদি কক্সবাজার যাই, আমার গ্রামের একটা কর্মীকে দেখি। এদরে সঙ্গে আমার রক্তের সম্বন্ধ। আজও আমি দেখি তার পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি। আজও দেখি, সেই ছেঁড়া পায়জামা, ছেঁড়া সার্ট, পায়ে জুতা নাই। বাংলাদেশে আমার এ ধরণের লক্ষ লক্ষ কর্মী পড়ে আছে।
কিন্তু কিছু কিছু লোক যখন মধু-মক্ষিকার গন্ধ পায় তখন তারা এসে আওয়ামী লীগে ভীড় জমায়। আওয়ামী লীগের নামের লুটতরাজ করে। পারমিট নিয়ে ব্যবসা করার চেষ্টা করে। আওয়ামী লীগ কর্মীরা, আওয়ামী লীগ থেকে তাদের উৎখাত করে দিতে হবে। আওয়ামী লীগে থাকার তাদের অধিকার নাই। তাই বলছি, আত্মসমালোচনার প্রয়োজন আছে, আজ আত্মসংযমের প্রয়োজন আছে, আজ আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন আছে। তোমরা, আওয়ামী লীগের কাউন্সিলাররা আজ যারা এখানে বসেছ তারা মনে মনে চিন্তা কর। বুকে হাত দিয়ে খোদার উপর নির্ভর কইরা বল যে, আমরা মানুষকে ভালবাসি। আমরা বাংলার মানুষকে ভালবাসি। আমরা ২৫ বছর সংগ্রাম করেছি। আমরা ইতহিাস সৃষ্টি করেছি। আমরা ইতিহাস রাখবো। আমরা নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবো। আমরা দেশকে মুক্ত করবো। তাহলেই আওয়ামী লীগের ইতিহাস থাকবে। তাহলে মরেও আমি শান্তি পাব। তা না হলে আমার বড় দুঃখ, বড় কষ্ট।
সহকর্মী ভাইয়েরা, বোনেরা, নীতি ছাড়া, আদর্শ ছাড়া এবং যে কথা আমি বলেছিলাম আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি ছাড়া তা হয় না। ন্যায়-নীতি ও আদর্শ সামনে রাখতে হবে। সে আদর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হবে। ভুলে যেয়ো না। স্বাধীনতা পেয়েছো এক রকমের শত্রুর সাথে ফাইট করে। তখন আমরা জানতাম আমাদের এক নম্বর শত্রু পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও শোষকগোষ্ঠী। কিন্তু এখন শত্রুকে চেনা বড় কষ্টকর। আমি একদিন গল্প করতে গিয়ে বলেছিলাম, জীবনে আমি তিনটা জিনিসকে ভয় পাই। আর কাউকে আমি ভয় পাই না। একটা হলো কুমীর। নদীতে থাকে। পানির মধ্যে গোসল করতে গেলে পা ধরে টান দিয়ে নিয়ে যায়। তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারি না। দ্বিতীয়টা সাপ, ফুস করে মেরে দিলে যুদ্ধ করতে পারি না। আর তৃতীয়টা মোনাফেক, তার সঙ্গেও সামনাসামনি যুদ্ধ করা যায় না। কুমীর সাপ আর মোনাফেক। তোমরা আগে যুদ্ধ করেছো। কিন্তু এখন বাংলার মাটিতে এদের সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধ করার উপায় নাই।
তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে মোনাফেক, তোমাদের সাথে যুদ্ধ করছে কেউটে সাপ আর পানির তলে কুমীর। এরা রাতের অন্ধকারে গুলী করে মারে, আর বলে রাজনীতি করে রাত্রে একজন লোক শুয়ো আছে তাকে জানালা দিয়ে গুলী করে মারল। বলে আমি বিপ্লবী তুমি বিপ্লবী, না দাগী চোর? যে কোন সময় যে কোন মানুষকে গুলী করে মারা যায়। এটা কি বিপ্লব? তোমরা রাত্রে গুলী করে মারো, আমরা প্রস্তাব পাস করি। আর আমি যদি লোকদের বলে দি যে, তোমরাও রাত্রে গুলী করে মারো, তখন কি হবে? এদের কোন নীতি নাই, এদের কোন আদর্শ নাই, এদের কিছুই নাই। এরা বড় বড় কথা বলে। আসলে চোর-ডাকাতের ন্যায় হাট-বাজারে ডাকাতি করে জিন্দাবাদ দিয়ে চলে যায়। সব ডাকাত, সব চোর। হাট-বাজার, চিনির দোকান, মুরগীর দোকানে, সব্জির দোকানে ডাকাতি করে বিপ্লব হয় না। ঐ রণদিভের থিওরী ইট মারো, সেপাইর আস্তানায় ইট মারো, ওয়ালে একটা পাথর মারো। এতে বিপ্লব হয়না।
সেই জন্যই আমি বলতে চাই যে, তাকে বিপ্লব বলে না, তাকে বলে পার্ভার্সান, বিপ্লবের বিকৃতি। এই যত বিপ্লবীরা সমাজতান্ত্রিক দেশের প্রতিনিধিরা আমার পাশে বসে আছেন, বহু বিপ্লব করছেন, এরা। ফাউন্ডার্স অব দি বিপ্লব (বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা)। সেটা এদের কাছে থেকে জেনে নাও। জনগণকে ছাড়া গণবিপ্লব ছাড়া বিপ্লব হয় না। রাতের অন্ধকারে গুলী মাইরা কোন দিন বিপ্লব হয় নাই। পড় সোভিয়েট রাশিয়ার বিপ্লবের ইতিহাস, পড় অন্যান্য দেশের বিপ্লবের ইতিহাস। পড় আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। দেখ সেখানে কি হয়েছে। দেখ আমাদের এই সাব-কন্টিনেন্টে কি হয়েছে। পড়, জান, শেখ, বোঝ। তারপরে বিপ্লবের কথা বল। বিপ্লব রাতের অন্ধকারে গুলী কইরা, টেরোরিজম কইরা হয় না। আবার এখন একটা সুবিধা হয়েছেম রাত্রের অন্ধকারে গুলী করে মাইরা বলে, আমরা মাওবাদী। কিন্তু আমি জানি, তোমরা চোর আর গুন্ডা ছাড়া কিছু না।
ভাই আপনাদের কাছে আমি বলতেছিলাম যে, আপনাদের চারটা আদর্শ- যেটা রাষ্ট্রীয় আদর্শ এবং আওয়ামী লীগের আদর্শ, সেটা প্রতিষ্ঠিত রাখতে হবে। একদল লোক গণতান্ত্রিক পন্থাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে। আমরা গণতন্ত্র বিশ^াস করি। আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়েছি। পাঁচ বৎসর পর নির্বাচন কর। যদি নির্বাচনে তোমরা কেউ আসতে পার, যে কোন দল মেহেরবানী করে চলে আস। আওয়ামী লীগ গদি ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু তোমরা জান, যে যতই বক্তৃতা কর, আর মানুষ যতই বক্তৃতা শুনুক না কেন ভোট দেখার সময় তোমাদের অবস্থা যা আছে– আগেও যা হয়েছে পরেও তাই হবে। সে জন্যই তোমরা জনগণের উপর আস্থা রাখ না। একদিকে গণতান্ত্রিক অধিকারকে ব্যবহার করব আর অন্যদিকে রাতের অন্ধকারে আওয়ামী লীগ কর্মীকে মারবো, প্রগতিশীল কর্মীকে মারবো, আর বলবো অস্ত্র নিয়ে মোকারেলা করবো, বলবো অস্ত্র নিয়ে বিপ্লব করবো। কোন স্বাধীন দেশ কোন গণতান্ত্রিক দেশে এটা এলাউ করা যায় না। বহু সহ্য করা হয়েছে। দুই বৎসর সহ্য করা হয়েছে। বলা হয়, বঙ্গবন্ধু কঠোর হও। বঙ্গবন্ধু কঠোর কি-না আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী নসরুল্লাহ খান, লিয়াকত আলী খান সবাই জানেন।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু চেয়েছিল কি? বাংলার মানুষ তাকে জাতির পিতা করেছে। বাংলার মানুষ তাকে প্রধানমন্ত্রী করেছে। বাংলার মানুষকে আমি বুঝবার চেষ্টা করেছি। তাদের বলতে চেষ্টা করেছি, তোমরা কাজ কর। তোমরা গণতন্ত্রের পথ অবলম্বন কর। দুটো খেলার অধিকার তোমাদের নাই। গণতান্ত্রিক অধিকারও তোমরা ব্যবহার করবা আর বিপ্লবের কথা বলে রাতের অন্ধকারে গুলী মারবা, অস্ত্র ফেরত দেবা না, সে অধিকার তোমাদের নাইম সে অধিকার তোমাদের দেওয়া হবে না। এটা মনে রাখা দরকার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাওয়া হয়েছে। জনগণ দেখতে চাও জনগণ দেখবা। কয়েক হাজার লোক মিটিং-এ যোগদান করলেই মনে করো না যে হয়েছে। এখনও আওয়ামী লীগ ডাক দিলে রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ লোক এসে হাজির হবে।
মনে করো না যেন বড় একটা কিছু হয়ে গেছে। সাবধান হয়ে যাও। একদল বলে অমুক তারিখ থেকে সশস্ত্র বিপ্লব শুরু কর। তারপরেও আমি কিছু বলি না। তবুও তারা বলে কি যে, আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে হাত দেয়া হয়েছে। কিন্তু তোমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার নাই, থাকতে পারে না। নইলে আওয়ামী লীগ কর্মীরা অন্ধকারে মরে? আওয়ামী লীগ কর্মী এবং প্রগতিশীল কর্মী যারা স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে আমি তাদের কাছে অস্ত্র চেয়েছিলাম। তারা অস্ত্র জমা দিয়েছে। কিন্তু তোমরা গোপনে কিছু কিছু অস্ত্র রেখে দিয়েছো এবং সেগুলি গোপনে ব্যবহার করছো। আজ যদি আওয়ামী লীগ কর্মী বা প্রগতিশীল কর্মীর কাছে একদিন অস্ত্র দিয়ে দেয়া হয় তাহলে একজনের অস্তিত্বও বাংলাদেশে থাকবে না। আমাকে বাধ্য করো না। দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করো না, যাও গণতন্ত্রের অধিকার আছে বক্তৃতা কর। বাই-ইলেকশন হবে, ইলেকশনে নামো। ইউনিয়ন কাউন্সিল ইলেকশনে জিততে পারে না রাত্রিবেলা এসে চেয়ারম্যানকে গুলী করে মারে। কয কি করলাম বিপ্লব করলাম। কি বিপ্লব– চেয়ারম্যান মারছে। বাবা এতো শুনি নাই। আমার মনে হয় এখানে যত দেশের লোকেরা আছেন, যদি শোনেন সবাই হাসবেন। কারণ তাহলে বিপ্লবের ইতিহাস বদলিয়ে লিখেতে হবে।
আজ সেইজন্য আওয়ামী লীগ কর্মীদের কাছে আমার কথা যে, তোমাদের কর্তব্য রয়েছে। স্বাধীনতা এনেছো। এবার খোদাকে হাজের নাজের রেখে এই প্রতিজ্ঞা করে যেতে হবে যে, বাংলার মানুষকে সুখী করতে হবে আমার। বাংলার দুঃখী মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। দুর্নীতি উৎখাত করতে হবে। শোষণহীন সমাজ করতে হবে। যে রাষ্ট্রীয় চার আদর্শ আছে তাকে পরিপূর্ণ করতে হবে, এর আগে নয়।
তোমাদের সেজন্য কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন। তোমাদের আরও ত্যাগের প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করে তারা জীবনভর করে। তোমরা ত্যাগ করেছো, আরও করবা। আর যারা মজা মারে তারা এমনিও মারে অমনিও মারে। সেজন্য তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ আছে, কর্মীরা তোমাদের কাছে আমার দাবী আছে। তোমরা জীবনে আমার চোখের সামনে কোনদিন কথা বল নাই। যা বলেছি তোমর তাই করেছো। তোমরা হাসতে হাসতে মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়েছো।তোমরা পারবা না আমার কথা শুনতে? দুর্নীতি আমরা দেখব না, দুর্নীতি আমরা করব না, দুর্নীতি এ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবো। তোমরা পারবা না এ দেশের মানুষকে ভালবাসতে? আমর দেশ গড়ার কাজে আত্ননিয়োগ করবো। এ দেশের মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে চায়, আমরা শান্তি দেবো। পারবা না তোমরা এ কাজ করতে! বল আমার কাছে। না পার আমাকে বিদায় দিয়ে দাও। আমি কিছু চাই না তোমাদের কাছ থেকে।
সহকর্মী ভাইয়েরা, আমি বলে দিচ্ছি, আমি সেন্টিমেন্টালী বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে এ্যাটাচড্। কথাটা তোমাদের পরিষ্কার বলে দেবার চাই। তোমরা সকলে জান যে, প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য আমি রাজনীতি করি নাই। তোমরা জানতা, ইচ্ছা করলে আমি বহু আগে প্রধানমন্ত্রী হতে পারতাম। এ প্রধানমন্ত্রিত্ব আমার কাছে কাঁটা বলে মনে হয়। আমি যদি বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে না পারি, আমি যদি দেখি বাংলার মানুষ দুঃখী, আর যদি দেখি বাংলার মানুষ পেট ভরে খায় নাই, তা হলে আমি শান্তিতে মরতে পারবো না— পারবো না, পারবো না। আমার জীবন বৃথা হয়ে যাবে। আমার যৌবন কারাগারের অন্তরালে কাটিয়ে দিয়েছি এ দেশের মানুষের জন্য। আমি ওদের কাছে থাকতে চাই, ওদের কাছে থাকতে চাই, ওদের সঙ্গে সঙ্গে মরতে চাই, এর বেশী আমি আর কিছু চাই না।
তাই তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ, তোমরা শুধু পার আমার অনুরোধ রাখতে, কারণ তোমরা আমার দুর্দিনের কর্মী। ১৯৪৯ সাল থেকে তোমরা এ পর্যন্ত আপদ, বিপদ, মুসিবত, অত্যাচার, অবিচার, জুলুম, গুলী সব অগ্রাহ্য করে আমার পাশে দাঁড়িয়েছো বাংলার মানুষকে স্বাধীন করার জন্য। স্বাধীন তোমরা করেছো। এবার বাংলার মানুষকে মুক্তি দিতে হবে। দিতে হবে অর্থনৈতিক মুক্তি, সমাজতান্ত্রিক সমাজ। সমাজতন্ত্র ছাড়া রাস্তা নাই। শোষণহীন সমাজ গাছ থেকে পড়ে না। শোষণহীন সমাজ বা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক গড়তে হলে আমার কর্মী ভাইদের সমাজতন্ত্রের কর্মী হতে হবে। ক্যাডার তৈরী করতে হবে ট্রেনিং দিতে হবে। না হলে পারব না কিছু করতে।
তোমাদের নিঃস্বার্থ কর্মী হয়ে ট্রেনিং নিতে হবে। সমাজতন্ত্রে আমরা গণতন্ত্রের মাধ্যমে যাবার চাই। এবং আমরা দুনিয়াকে দেখাতে চাই যে, গণতান্ত্রিক পন্থায় নতুন সিস্টেমে আমরা শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলবো।
আমরা বাঙালী। আমরা জাতীয়তাবাতে বিশ্বাস করি। আমি যদি ভুলে যাই আমি বাঙালী, সেদিন আমি শেষ হয়ে যাবো। আমি বাঙালী বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ, বাংলার মাটি আমার প্রাণের মাটি, বাংলার মাটিতে আমি মরবো। বাংলার কৃষ্টি বাংলার সভ্যতা আমার কৃষ্টি ও সভ্যতা। এই বাঙালী জাতীয়তাবাদ তোমাদের মনে রাখতে হবে।
আর একটা জিনিস। রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালবাসে সে কোনদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। আপনারা যাঁরা এখানে মুসলমান আছেন, তাঁরা জানেন যে, খোদা যিনি আছেন তিনি রাব্বুল আলামীন– রাব্বুল মুসলেমীন ন। হিন্দু হোক, খৃস্টান হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক সমস্ত মানুষ তার কাছে সমান। সেই জন্যই এক মুখে সোস্যালিজম ও প্রগতির কথা এবং আর এক মুখে সাম্প্রদায়িকতা চলতে পারে না। সমাজতন্ত্র প্রগতি আর সাম্প্রদায়িকতা পাশাপাশি চলতে পারে না। একটা হচ্ছে পূর্ব আর একটা হচ্ছে পশ্চিম। যারা এই বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা করতে চায় তাদের সম্পর্কে সাবধান হয়ে যেও। আওয়ামী লীগের কর্মীরা, তোমরা কোনদিন সাম্প্রদায়িকতাকে পছন্দ করো নাই। তোমরা জীবনভর তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছো। তোমাদের জীবন থাকতে যেন বাংলার মাটিতে আর কেউ সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করতে না পারে। তোমাদের মনে রাখা দরকার, সেজন্য আমাদের রাস্তা ক্লিয়ার। আমাদের জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে কোন কিন্তু নাই। সে সমাজতন্ত্র হলো আমার অর্থনীতি। একে গড়তে হলে কর্মীদের সমাজতান্ত্রিক কর্মী হতে হবে, ক্যাডার হতে হবে, ট্রেনিং নিতে হবে। তা’হলেই আমরা সফল হবো।
অবশ্য অনেক লোক আছে যারা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে গ্রহণ করতে পারে নাই। তারা পিছন থেকে কিছু ঢেলা মারার চেষ্টা করছে। যারা প্রগতির নামে সাম্প্রদায়িকতা করছে তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। গ্রামে গ্রামে দেশের মানুষকে সংঘবদ্ধ করে বোঝাতে হবে, একেই বলে সমাজতন্ত্র। একেই বলে শোষণহীন সমাজ। একেই বলে সুষম বন্টন। তা’হলে বাংলার মানুষ তোমাদের পিছনে থাকবে।
সহকর্মী ভাই ও বোনেরা, আওয়ামী লীগ পার্টি দীর্ঘদিন ধরে যে বৈদেশিক নীতি দিয়েছে, আমার মনে হয় আপনাদের এই সরকার সেই নীতি পুরাপুরি পালন কতে চেষ্টা করেছে। ভারতবর্ষ, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুগোশ্লাভিয়া ও অন্যান্য যেসব দেশ স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের সাহায্য করেছেন আজ তাঁদের কথা স্মরণ করি। এ ছাড়াও ঐ সমস্ত দেশের কথা স্মরণ করি, যারা বিপ্লবের পরেও আমাদের ভেঙ্গেপড়া অর্থনীতি পুনর্গঠনে সাহায্য করেছেন। আমাদের সাহায্য করেছেন ভারত, সোভিয়েত রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ক্যানাডা, গ্রেটবৃটেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানী, জিডিআর, ফ্রান্স, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কান্ট্রি এবং আরো বিভিন্ন দেশ। সাহায্য করেছেন সমস্ত সোস্যালিস্ট কান্ট্রি। তাদের সঙ্গে আমাদের রিলেশন ভাল হয়েছে।
আমরা আজ গর্বিত যে, মধ্যপ্রাচ্যে আমরা আরব ভাইদের এবং প্যালেস্টাইনবাসীদের পাশে রয়েছি। ইসরাইলীরা তাদের ন্যায্য অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে। ইসরাইলীরা জাতিসংঘের প্রস্তাব মানে নাই। তারা দখল করে বসে আছে আরবদের জমি। আরব ভাইদের এ কথা বলে দেবার চাই এবং তারা প্রমাণ পেয়েছে যে, বাংলার মানুষ তাদের পিছনে রয়েছে। আরব ভাইদের ন্যায্য দাবীর পক্ষে রয়েছে। আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে তাদের সাহায্য করবো।
যেসব দেশ আমাদের সাহায্য দিয়েছে আমি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাই। শান্তিপূর্ণ দেশ সহঅবস্থানে বিশ্বাস করে আমি বিশ্বাস করি নন-অ্যালাইন্ড, ইন্ডিপেন্ডেট ফরেন পলিসি। আমরা কারুর পকেটে যাবার চাই না। আমরা সকলের বন্ধুত্ব কামনা করি। কিন্তু আমাকে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় একটা দেশ পাকিস্তান শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানে বিশ্বাসী নয়।
যে চীন নিজেকে মহান দেশ বলে এবং দুঃখী মানুষের বন্ধু বলে গর্ব করে সে চীন সম্পর্কে আমার একটা কথা বলার আছে। চীনের সঙ্গে আমরা বন্ধুত্ব কামনা করি। কিন্তু আত্মসম্মান বিক্রি করে আমরা কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই না। আমরা এমন কিছু করি নাই যেজন্য চীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে ভেটো দিতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় চীন বাংলার বিরুদ্ধে ভেটো দিয়েছে। আমরা সেজন্য দুঃখিত। তবু চীন অনেক বড় দশে, আমরা তাদের বন্ধুত্ব কামনা করি। কিন্তু চীন একটা সাম্রাজ্যবাদী ও ক্যাপিটালিস্ট দেশ পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে। আর বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ যারা রক্ত দিয়ে বিপ্লব করে দেশকে স্বাধীন করেছে তারা যাতে জাতিসংঘে স্থান না পায়, সেজন্য চীন জাতিসংঘে ভেটো দিলো বাংলার বিরুদ্ধে।
ইতিহাস বড় তাৎপর্যপূর্ণ। যখন চীনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে ভেটো দেয়া হতো তখন এই বাংলার মানুষই বিক্ষোভ করতো। আমি নিজে ঐ ভেটোর বিরুদ্ধে বহুবার কথা বলেছি, যে ভেটোর জন্য চীন ২৫ বৎসর জাতিসংঘে যেতে পারে নাই। দুঃখের বিষয় সেই চীন আজ ভেটো “পাওয়ার” হয়ে প্রথম ভেটো দিলো আমার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তবুও আমি কামনা করি তাদের বন্ধুত্ব। অনেক বড় দেশ। দুশমনি করতে চাই না। বন্ধুত্ব কামনা করি। কারণ আমি সকলের বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু জানি না, আমার এই কামনায়, আমরা এই প্রার্থনায় তাঁরা সাড়া দেবেন কি-না। যদি না দেন কিছু আসে যায় না। ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা এত ছোট দেশ নই। বাংলাদেশ এতটুকু নয়। পপুলেশনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ দুনিয়ার অষ্টম বৃহত্তম রাষ্ট্র।
আজ আমাদের দেশের আর্থিক অবস্থা বড়ই খারাপ। অর্থনৈতিক অবস্থা বেশী ভাল নয়। কেন? ২৫ বছর শোষণ করে সব নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিনা পয়সায়, বিনা বৈদেশিক মুদ্রায় সরকার চালাতে হচ্ছে। সাড়ে সাত কোটি লোকের দেশ। সবকিছু বিধ্বস্ত। একে গড়া এত সোজা নয়। তাছাড়া দুনিয়াতে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের মতো যারা উন্নয়নশীল দেশ, যারা দেশকে গড়ে তুলতে চায়, তারা মহাবিপদের সম্মুখীন।
আমাদের কষ্ট হবে। তবুও একটা কথা মনে রাখা দরকার, যে সাহায্য আমি চাই, আওয়ামী লীগ যে সাহায্য চায় তা আত্মসন্মান বিক্রি করে নয়। আওয়ামী লীগ সরকার সেই সাহায্য গ্রহণ করতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষ গ্রহণ করতে পারে না। আমাদের কেউ যদি কিনতে চান ভুল হবে। কেউ যদি সাহায্যের নামে আমাদের দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় তবে ভুল হবে। আমরা শোষিত মানুষ। বহু ত্যাগ করেছি। বহু রক্ত দিয়েছি। দরকার হয় আরও দেবো। কিন্তু আত্মসন্মান বিক্রি করে আমরা কারো কাছে সাহায্য চাই না। যারা বন্ধু হিসেবে সাহায্য করতে চান তারা আমার ভাই। আসুন, আমরা সাহায্য নিশ্চয়ই গ্রহণ করবো। কারণ দেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। আমার দেশকে গড়তে হবে।
আজ সত্য কথা বলতে কি আমাদের একটা কথা মনে রাখা দরকার। আওয়ামী লীগ কর্মীরা, কোথায় যেন গোড়ায় একটু গলদ রয়ে গেছে। মানুষ এতো অর্থের জন্য পাগল হয়েছে কেন? শুধু টাকা কামাই করবে কি করে, এই চেষ্টা। একদিন হাসতে হাসতে বললাম যে, বাংলার কৃষক, বাংলার দুঃখী মানুষ এরা কিন্তু অসৎ নয়। ব্ল্যাকমার্কেটিং করে কারা? রাগ করবেন না। আপনারা শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, চিন্তাশীল, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় আছেন, আপনারা রাগ করবেন না। ব্ল্যাকমার্কেটিং কারা করে? যাদের পেটের মধ্যে দুই কলম বিদ্যা হয়েছে তারাই ব্ল্যাকমার্কেটিং করে। স্মাগলিং কারা করে? যারা বেশী লেখা-পড়া করছে তারা বেশী করে। হাইজ্যাকিং কারা করে? যারা বেশী লেখা-পড়া শিখছে তারাই করে। ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলিং তারাই করে। বিদেশে টাকা রাখে তারাই। আমরা যারা শিক্ষিত, আমরা যারা বুদ্ধিমান ঔষধের মধ্যে ভেজাল দিয়ে বিষাক্ত করে মানুষকে খাওয়াই তারাই। নিশ্চয়ই গ্রামের লোক এসব পারে না। নিশ্চয় আমার কৃষক ভাইরা পারে না। নিশ্চয় আমার শ্রমিক ভাইরা পারে না। পেটের মধ্যে যাদের বুদ্ধি বেশী আছে তারাই ব্ল্যাক-মার্কেটিয়ার। আর বিদেশী এজেন্ট কারা হয়। নিশ্চয়ই আমার কৃষক নয়, নিশ্চয়ই আমার শ্রমিক নয়। আমরা যারা লেখা-পড়া শিখি, গাড়ীতে চড়ি, বিদেশে যাবার পারি, বিদেশীদের সাথে মিশতে পারি, ভাল স্যুট পরতে পারি তারাই বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে বিদেশের এজেন্ট হই।
মহাবিপদের মধ্যে আছি আমরা। আপনারা যাঁরা বুদ্ধিজীবি, শিক্ষিত, যাঁরা দেশকে নেতৃত্ব দেন তাদের কর্তব্য হবে আত্মসমালোচনা করা। আর আওয়ামী লীগের সহকর্মী ভাইয়েরা, তোমরা ব্ল্যাক-মার্কেটিয়ারদের পিছনে লাগো। হোর্ডারদের পিছনে লাগো। ঘুষখোরদের পেছনে লাগো। তোমরা আমার কথায় আগেও লেগেছো, এখনো লাগো। শুধু আইন দিয়ে, শুধু শক্তি দিয়ে দুর্নীতি দমন করা যায় না। এজন্য এমনভাবে জনমত সৃষ্টি করতে হবে, যেমনভাবে ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত জনমত সৃষ্টি করে আমরা আন্দোলন করেছিলাম। যেমনভাবে ২৫শে মার্চ থেকে ন’মাস পর্যন্ত জনমত সৃষ্টি করে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিলাম। তেমনি বাংলার মাটিতে জনমত সৃষ্টি করতে হবে – দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর ও শোষকদের বিরুদ্ধে। আমি বিশ্বাস করি তা’হলে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি উঠে যাবে।
গণঐক্য জোট করেছেন আপনারা। আওয়ামী লীগের সংগে কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ আছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সাথে কর্মী আছে পাঁচটি গ্রুপের – আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ। আমি মাঝে মাঝে খবর পাই ভুল বোঝাবুঝি হয়। কোন ভুল বোঝাবুঝি হতে পারবে না। সবার সাথে আলোচনা করে নিয়ে আপনাদের পাঁচ গ্রুপকে এক সাথে কাজ করতে হবে। আপনারা কাজ করছেন দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য। সেইজন্য সংঘবদ্ধভাবে বসে আলোচনা করে আপনাদের কাজ করতে হবে। কারণ, আদর্শ আপনাদের এক। নেতৃত্ব আপনাদের এক। কর্মী আপনারা এক। সম্মুখে রাস্তা আপনাদের এক। গভর্নমেন্ট আপনাদের এক।
ভাইয়েরা আমার, পরিশ্রম না করলে, কঠোর পরিশ্রম না করলে সাড়ে সাত কোটি লোকের ৫৪ হাজার বর্গমাইল এলাকার এই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করা যাবে না। ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত থাকে না। বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে এনে দেশকে গড়া যাবে না। দেশের মধ্যেই পয়দা করতে হবে। শ্রমিক ভাইদের কাছে আমার অনুরোধ, তোমাদের বার বার বলেছি এখনো বলছি, প্রোডাকশন বাড়াও। সমাজতন্ত্রের অর্থ এই যে, প্রোডাকশন বাড়াও, ভোগ কর।
একবার এক মিটিংয়ে বলেছিলাম, গাইটা খেয়ো না, দুধ খাওয়া তোমরা কিছু লোক যা আরম্ভ করেছো, দুধও খাবার চাও, গাইও খাবার চাও। সেজন্যই বলছি প্রোডাকশন কর। আমি শ্রমিক ভাইদের সবাইকে দোষ দেই না। অনেক শ্রমিক প্রতিষ্ঠান আছে যারা ভাল প্রোডাকশন করছে, ভাল কাজ করছে, কৃষক ভাইরাও এগিয়ে এসেছে। তাদের অর্গানাইজ করতে হবে। এমন কি এ কথা ছাত্র ভাইদেরও বলি। দেখুন, বগুড়ায় গিয়ে কলেজের ছাত্ররা নিজেরা মাঠ চাষ করে নিজের খরচ নিজেরাই কামাই করে লেখাপড়া আরম্ভ করে দিয়েছে। আপনারাও শুরু করেন। বাপ-মা’র উপর ট্যাক্স কম করেন। আজকে জিনিসের দাম দিন দিন বাড়ছে। বিদেশ থেকে আনতে হয়। দেশে ইনফ্লেশন হচ্ছে। মানুষের দুঃখ হবে। সেজন্য আজ আপনাদের এদিকে নজর দিতে হবে। আমি আপনাদের কাছে আজ আর বেশীক্ষণ বক্তৃতা করছি না। ইতিহাস বলে দেওয়ার দরকার ছিলো বলেই এত কথা বলেছি।
আমি তোমাদের পরিষ্কার বলতে চাই, আমি আওয়ামী লীদের সভাপতি থাকতে পারবো না, তোমাদের নতুন সভাপতি করতে হবে কারণ সময় আমি দেবার পারি না। দ্বিতীয়তঃ আওয়ামী লীগের কার্যপ্রণালীর মধ্যে যেটা আমি নিজে পাস করিয়েছিলাম তাতে পরিষ্কার বলা ছিল যে, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা গভর্নর হলে কেউই আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারী বা কর্মকর্তা হতে পারবে না। এটাকে আমি পরিবর্তন করতে চাই না। আমি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করি যে, তোমরা আমার কথা রাখবা এবং আমার কথা শোনবা। আমি সব ঠিক করে দেব, তোমরা চিন্তা কর না – গোছায়ে গোছায়ে ঠিক করে দেবো। সারা জীবন আমার কথা শুনেছো এবারও শুনতে হবে।
আমি আগেই বলেছি যে, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের যা প্রয়োজন আওয়ামী লীগের সে চারটি জিনিস – নেতৃত্ব, আদর্শ, সংগঠন ও নিঃস্বার্থ কর্মী রয়েছে। আমরা আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়লাভ করেছি। আজ যে নতুন সংগ্রাম শুরু হয়েছে – দেশ গড়ার সংগ্রাম, দুঃখী মানুষকে বাঁচাবার সংগ্রাম – এই সংগ্রামেও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বাস করি, যদি আওয়ামী লীগ কর্মীরা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে তাহলে নিশ্চয়ই আমরা কামিয়াব হবো। কেউ আমাদেরকে ঠেকাতে পারবে না। বিশৃঙ্খলাকারীরা কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তাই আজকে তোমাদের কাছে আমার আবেদন রইলো – গ্রামে গ্রামে কাজ করো। দুঃখের দিনে মানুষের পাশে দাঁড়াও। তোমরা আমার কথা শুনেছো, এখনো আমার কথা শোন। তোমাদের যা বলি সেভাবে কাজ করো। আমি যেখানেই থাকি তোমাদের সাথেই থাকবো, তোমাদের পাশেই থাকবো। তোমাদের বাদ দিয়ে একদিনও আমি বাঁচতে পারি না। কিন্তু সভাপতি আমি থাকতে পারবো না।
আমি আমার পক্ষ থেকে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এবং বাংলাদেশের জনগনের পক্ষ থেকে যাঁরা বিদেশ থেকে এখানে এসেছেন সেই যুগোশ্লাভিয়া, পোল্যান্ড, সোভিয়েট ইউনিয়ন, জাপান, বুলগেরিয়া, পূর্ব জার্মানী, ভারত, রুমানিয়া, ইরাক, মালয়েশিয়া, হাঙ্গেরী ও দক্ষিণ ইয়ামেনের প্রতিনিধিদের ধন্যবাদ দিচ্ছি। যাঁরা আসতে পারেননি বলে আমাদের জানিয়েছেন এবং যাঁরা এখানে কূটনৈতিক প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত রয়েছেন তাঁদের সকলকেও আমি আন্তরিক ধন্যবাদ দিচ্ছি। আমি আপনাদের অনেক সময় নষ্ট করেছি এই জন্য যে, আজ প্রয়োজন ছিলো আওয়ামী লীগের কিছু ইতিহাস বলার, প্রয়োজন ছিলো আপনাদের কিছু পথ দেখানোর। শুধু একটা কথা বলে যাই – শেষ কথা আমার, যে কথা আমি বার বার বলেছি – সোনার বাংলা গড়তে হবে। এটা বাংলার জনগনের কাছে আওয়ামী লীগের প্রতিজ্ঞা। আমার আওয়ামী লীগের কর্মীরা, যখন বাংলার মানুষকে বলি তোমরা সোনার মানুষ হও তখন তোমাদেরই প্রথম সোনার মানুষ হতে হবে। তাহলেই সোনার বাংলা গড়তে পারবা। আর যারা দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সংগ্রাম করেছো, তারা বাংলার দুঃখী মানুষের কাছে থেকে সরে যেয়ো না।
জয় বাংলা। জয় আওয়ামী লীগ।
Reference:
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সমগ্র
সম্পাদনা – ফারজানা ইয়াসমিন, ড রাজিবুল বারী