You dont have javascript enabled! Please enable it! 1980.04.18 | স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসীদের চেতনা | আবু সাঈদ চৌধুরী | সাপ্তাহিক বিচিত্রা - সংগ্রামের নোটবুক

স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসীদের চেতনা

আবু সাঈদ চৌধুরী | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৮ এপ্রিল ১৯৮০

বিগত ৪ ঠা এপ্রিলের সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত “মুক্তিযুদ্ধঃ প্রবাসীদের চেতনা ” শিরোনামের নিবন্ধটির প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। লেখক তার আলোচনায় বিভিন্ন স্থানে আমার প্রসংগ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ নিবন্ধে কতিপয় বিষয় তুলে ধরা হয়েছে যা তথ্য নির্ভর নয়। লেখক যখন এ সম্পর্কে কারো কারো সঙ্গে আলোচনা করেছেন, সে ক্ষেত্রে আমার সাথে যোগাযোগ করলে আমার বক্তব্য জানতে পারতেন। আমি সাধারণত এসব ব্যাপারে নিরব থাকি৷ কারণ আমি জানি সত্যকে যতই কুয়াশাচ্ছন্ন করার প্রচেষ্টা করা হোক না কেন, সূর্যালোকের মতই তা এক সময় স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এতদ সত্ত্বেও আমি এবারে ব্যতিক্রম করছি এই ভেবে যে, বিচিত্রার মতো একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকা কোন কোন পাঠকদের মনে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করতে পারে।

আজ আমি বাইরের জীবন থেকে একান্তে অবসর গ্রহণ করেছি। একজন আইনবিদ হিসেবে কোন কোন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত আছি মাত্র। তথাপি মাঝে মাঝে আমার সম্মন্ধে অসত্য গুজব ও কাল্পনিক কথা রটানো হয়। সাময়িকভাবে ব্যথিত হলেও সাধারণত এ সবের প্রতিবাদ করি না। আমি মনে করি সত্য নিরূপণের দায়িত্ব দেশের। দেশের মানুষকে দীর্ঘদিন সত্যবিমুখ করে রাখা সম্ভব হবে না।

এবার আমার মূল বক্তব্যের সূত্রপাত করা যাক। উল্লেখিত প্রবন্ধে আমার সম্মন্ধে বলা হয়েছে, “দীর্ঘ এক মাস এক সপ্তাহ পর তিনি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে যোগ দিতে রাজী হন।” বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে যোগদানের জন্য আমাকে কেউ রাজী করাননি। সে প্রশ্ন ওঠে না। সত্য প্রকাশের খাতিরেই তখনকার দিনগুলো সম্পর্কে আমাকে স্মৃতি চারণ করতে হচ্ছে।

১৯৭০ সনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসাবে আমি মানবাধিকার কমিশনের সদস্য হিসেবে তিন বছরের জন্য নিযুক্ত হই৷ ১৯৭১ সনের ১৭ ই ফেব্রুয়ারী মানবাধিকার কমিশনের সদস্য হিসেবে উক্ত সভায় যোগদানের জন্য জেনেভার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করি। ২৬ শে মার্চ অপরাহ্নে আমি জেনেভা ত্যাগ করে লন্ডনে আসি। লন্ডনে পৌছার সাথে সাথেই বিবিসি প্রদত্ত খবরে জানতে পারি যে ঢাকায় খুব বড় রকমের গোলমাল হয়েছে। আমি তখন ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর জানার জন্য খুবই উৎকন্ঠিত হয়ে পড়ি। তাই ১৯৭১ সনের ২৭ মার্চ অর্থাৎ পরের দিনই আমি বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান মিঃ ইয়ান সাদারল্যান্ডের সাথে এগারোটার সময় দেখা করি। (বর্তমানে তিনি বৃটিশ সরকারের গ্রীসে রাষ্ট্রদূত।) সেদিনটা ছিল শনিবার। তিনি আমার পূর্ব পরিচিত৷ তাই বিশেষ অনুরোধে সেদিন তিনি অফিসে আসেন।

মিঃ সাদারল্যান্ডের কাছ থেকে যখন ঢাকার জনসাধারণের এবং আমার প্রাণ প্রিয় ছাত্র ছাত্রীদের ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দের হত্যার কথা জানতে পারি, তখন অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ি। সেই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ছবি। আমি তাদের বলেছি, ” তোমাদের ছেলেমেয়ের মত ভালবাসি। পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করলে তোমাদের সাথে শত্রুতা করা হবে। সে আমি কখনো পারবো না। বাড়ি যাও, আমার এখানে সময় নষ্ট করেছো। সে জন্যে বাড়ি গিয়ে দু ঘন্টা বেশী পড়বে। ” সেদিন তারা আমার কথা শুনেছে। আমার কথা মেনে নিয়ে তারা চলে গিয়েছে। আমার সেই প্রাণপ্রিয় ছাত্র ছাত্রীদের হত্যার সংবাদে আমার মনে হল আমার জীবনের পরীক্ষার দিন উপস্থিত। যারা আমার ছেলেমেয়েদের হত্যা করেছে, তাদের সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না। সেই মুহূর্তে আমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা জন্মালো যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে কিছুতেই আর এক হয়ে থাকা সম্ভব হবে না। সমস্যা সমাধানের সকল আশাবাদ ধূলিস্মাৎ হয়ে গেল। পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন হতেই হবে। এবং সে কথা আমি মিঃ সাদারল্যান্ডকে বললাম। তাকে আরো বললাম, “আজ থেকে পাকিস্তান সরকারের সাথে আমি সকল সম্পর্ক ছিন্ন করলাম। আমি দেশ থেকে দেশান্তরে যাব এবং এই নৃশংসতার কাহিনী বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরবো।”

আমি সেদিনই পত্রিকায় একটি বিবৃতি দিয়ে বলি এবং যুক্তরাজ্যের তদানীন্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম এবং ব্রিটিশ ওভারসীজ মিনিস্টার রিচার্ড উডের সাথে দেখা করে ঢাকার রক্তপাত বন্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার জন্য চেষ্টা করতে বলতে চাই। মিঃ সাদারল্যান্ডের কাছেই জানতে পারি যে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মিঃ সাদারল্যান্ডকে উপরোক্ত মন্ত্রীদ্বয়ের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ জানাই। এদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পূর্বে সংবাদপত্রে বিবৃতি না দেয়ার জন্য মিঃ সাদারল্যান্ড আমাকে অনুরোধ জানান। কেননা সেটা সাক্ষাৎকারের জন্য কূটনৈতিক অসুবিধার সৃষ্টি করতে পারে। তবে তিনি বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্কটল্যান্ডের ছুটি থেকে যেদিন ফিরবেন সেদিনই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা আগেই টেলিফোন যোগে করে রাখবেন। করেও ছিলেন তাই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী লন্ডন ফেরার দিনই আমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। এবং সেদিনই বিবিসি পাকিস্তানের সঙ্গে আমার সম্পর্কচ্ছেদের কথা ঘোষণা করি। যতদূর মনে পড়ে তারিখটা ছিল ১০ এপ্রিল। তখন পর্যন্ত লন্ডনে মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠার সংবাদ পৌছায় নাই। পরবর্তী পর্যায়ে আমি রিচার্ড উডের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করি। দুটি সাক্ষাৎকারের সময়েই মিঃ সাদারল্যান্ড উপস্থিত ছিলেন। দুজনেই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত বন্ধ ও বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার্থে সর্বতোভাবে চেষ্টার আশ্বাস দেন।

মিঃ সাদারল্যান্ডের সাথে দেখা হওয়ার দু তিনদিনের মধ্যে আমি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে দেখা করি। তার কথা মত কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটি এ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল স্যার হিউ স্প্রিঙ্গারের সঙ্গে দেখা করি এবং তিনি আমার কথা শুনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নিকট রক্তপাত বন্ধ করার জন্য টেলিগ্রাম পাঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক হত্যার জন্য গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করে। আমি কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেল মিঃ আরনল্ড স্মিথের সঙ্গেও দেখা করি এবং তাকেও সব কথা জানিয়ে একই অনুরোধ করি। জেনেভাস্থ ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টের সেক্রেটারি জেনারেল মিঃ ম্যাকডো ম্যাটকে এবং ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির সেক্রেটারি জেনারেলের সঙ্গে ফোনে কথা বলি৷ তারা উভয়েই তীব্র ভাষায় ঢাকায় অনুষ্ঠিত হত্যাযজ্ঞের নিন্দা করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নিকট টেলিগ্রাম করেন। আমি ৬ এপ্রিল ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর লর্ড জেমসের সঙ্গে দেখা করি। এই উপলক্ষে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫-২০ জন অধ্যাপককে মধ্যাহ্ন ভোজে আমন্ত্রণ জানান। আমি তাদের কাছেও পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের কারণ ব্যাখ্যা করি। লর্ড জেমস ১৯৭০ সনে ঢাকায় এসেছিলেন এবং আমার আতিথ্য গ্রহন করেছিলেন। তিনি বললেন যে, তার ধারণা ছয় মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হবে।

ইতিমধ্যে আমি প্রায় প্রত্যেক দিন সন্ধায় বাঙালী দের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হতে থাকি। আমি বুঝতে পারলাম যে তারা সকলেই সর্বান্তকরণে স্বাধীনতা আন্দোলন সমর্থন করেন কিন্তু ঐক্যবদ্ধ ভাবে কোন সংগঠন গড়ে উঠছিল না। সকলেই চাচ্ছিলেন যে আমি তাদের দলে যোগ দেই৷ অন্যান্যদের সঙ্গে আমিও তাদের বোঝাতে চেষ্টা করি যে সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল মিলে একটা কেন্দ্রীয় সংগঠন গড়ে না তুললে স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যাহত হবে এবং এরূপ কেন্দ্রীয় সংগঠন গড়ে না ওঠা পর্যন্ত আমি কোন দলে যোগ না দিয়েই স্বাধীনতার জন্য কাজ করে যাব।

বিবিসি আমার স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদানের কথা প্রচার করে। এর পর এপ্রিলের মাঝামাঝি জনাব আবদুল মান্নান (প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রী) এবং ব্যারিস্টার জনাব আমিরুল ইসলাম (প্রাক্তন খাদ্য মন্ত্রী) কলকাতা থেকে একই সঙ্গে আমাকে টেলিফোন করেন এবং জানান যে, তাদের প্রস্তাবানুসারে মুজিবনগর সরকার আমাকে বহির্বিশ্বে তাদের বিশেষ প্রতিনিধি নিয়োগ করতে চাচ্ছেন। আমি তৎক্ষনাৎ সম্মতি দেই। মুজিবনগর গবর্নমেন্টের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষরিত নিয়োগপত্র সিলেটের জনাব রকীবের হাতে পাঠান। ২৪ এপ্রিল কভেন্ট্রিতে বৃটেনে বসবাসকারী বাঙালীদের সভায় রকীব পত্রটি পড়ে শোনান।

এই সভায়ই আন্দোলন পরিচালনার জন্য একটি কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হয় এবং প্রস্তাবে আমার সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়৷

উপরোক্ত ঘটনা প্রবাহ লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে যে, আমি ২৭ মার্চেই পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। একমাস, এক সপ্তাহ দেরী করার কথা একেবারেই ভিত্তিহীন।

লন্ডনে বাংলাদেশ মিশন জুন মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে উক্ত প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে৷ এটাও ভুল। ১ লা আগস্ট ট্র্যাফালগার স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত বৃহৎ জনসভায় মুজিবনগর সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের কথা ঘোষণা করি এবং তারপর পেম্ব্রিজ গার্ডেনে এই দূতাবাস স্থাপন করা হয়। স্টিয়ারিং কমিটির অফিস স্থাপন করা হয়েছিল ২৪ শে এপ্রিলের অব্যবহিতের পরেই ১১ নং গোরিও স্ট্রীটে, আমি আগেই সরকারী প্রতিনিধি ছিলাম বিধায় আমাকে মিশনেরও প্রধান করা হয়। আমকে জনাব মান্নান এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম বলেছিলেন যে, তাদের প্রস্তাবেই আমাকে নিয়োগ করা হয়। উক্ত নিবন্ধে মিঃ সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের কথা এ ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়েছে। মিঃ রায়ের সাথে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে আমার একবারও যোগাযোগ হয় নি।

উক্ত নিবন্ধে “বাংলাদেশ ফান্ডের” কথা বলতে গিয়ে বলা হয়েছে ফান্ড সরাসরি খরচের একটি খাতে দেখিয়েছে যে শেখ মুজিবুর রহমানের মামলা বাবদ ৩ হাজার ২০০ পাউন্ড ৫০ পেনী। কিন্তু ১৯৬৮ সালের আগরতলা মামলার খরচ ‘৭১ সালের ফান্ডে কেন দেখানো হলো সে বিষয়ে বিচারপতি চৌধুরী এবং অন্য দুই জন ট্রাস্টিই কোন সদুত্তর দিতে পারেন নাই। ” বিচিত্রার কেউ তো আমাকে জিজ্ঞেস করেন নাই। ১৯৭১ সনে পশ্চিম পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে বিচার হয়েছিল সে কথাটাও লেখক ভুলে গিয়েছেন অথবা জানেন না। যে বিচারে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থনের জন্য বার্নাড শেরিডান এ্যান্ড কোম্পানীর একজর সলিসিটর সহ বিখ্যাত আইনবিদ এবং আয়ারল্যান্ডের প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিঃ শোন ম্যাক ব্রাইডকে ইসলামাবাদে পাঠানো হয়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ যোগ্য যে, মিঃ ম্যাকরাইড বিশ্ব শান্তির প্রচেষ্টার জন্য সম্প্রতি নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। তাছাড়া কারাগারে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার জন্য মিঃ জেরাল্ড ড্রেপার কিউ সি ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রস কমিটির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে দরখাস্ত পেশ করেন। আমিও তার সঙ্গে উক্ত কমিটির নিকট জেনেভায় যাই৷ উক্ত টাকা এসব ব্যাপারে সলিসিটরের মারফৎ আইনবিদদের ফিস ইত্যাদি বাবদ খরচ হয়েছে৷ শ্যোন ম্যাকব্রাউন পাকিস্তান থেকে লন্ডনে ফিরে যেয়ে তাকে বিচারে উপস্থিত হতে না দেয়ার যে বিবৃতি দেন, তাতে বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণিত হয় যে, ১৯৭১ সনে পশ্চিম পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর বিচার একটি প্রহসন ছিল মাত্র। এই বিচার প্রহসনের প্রতিবাদে হাইড পার্কে একটি বিরাট জনসভার আয়োজন করা হয়।

উক্ত নিবন্ধে আরো আছে যে “বাংলাদেশ ফান্ডে প্রাপ্ত অর্থের পুরো প্রাপ্তি হিসাব দেখাননি। এরকম নির্দিষ্ট অনেক অভিযোগ আছে। এবং অভিযোগ করেছেন যে, তাদের রসিদ বইসহ অর্থ জমা দেওয়া সত্ত্বেও অর্থ দাতাদের তালিকায় তাদের নাম নাই। “

এ অভিযোগ একেবারে অমূলক এবং ভিত্তিহীন। বাংলাদেশ ফান্ডে জমা দেওয়া প্রতিটি পেনীর হিসাব দেওয়া হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের অডিট রিপোর্ট এবং হিসাব বাংলাদেশ প্রেসে ছাপানো হয়৷ সেগুলো বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় এবং ইংল্যান্ডে সমস্ত কমিটি গুলোকে পাঠানো হয়েছে। সে রিপোর্টে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন কমিটির নিকট প্রায় এক লক্ষ পাউন্ড অনাদায়ী ছিল। সেসব কমিটিকে টাকা ব্যাংক এ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার জন্য তাগিদ দেওয়া চলতে থাকে। আমার নিজের তখন বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না বলে বাংলাদেশের লন্ডনস্থ প্রথম রাষ্ট্রদূত সৈয়দ আবদুস সুলতান সাহেবকে এ কাজের ভার দেওয়া হয়৷ তিনি এবং উক্ত মিশনের ফাইন্যান্স ডিরেক্টর জনাব মতিন অনেক চেষ্টা করে ১৯৭২ সনের ৩০ সেপ্টেম্বরের আগে প্রায় এক লক্ষ পাউন্ড এবং রসিদবই ফেরত নেন। প্রাপ্ত রসিদ বই ও টাকার প্রাপ্তি স্বীকার করা হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, এই হিসাবের সিনপসিস ১৯৭২ সনের ৩০ সেপ্টেম্বরের অব্যবহিত পরেই ঢাকার দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত হয়েছিল।

২৫ মার্চের দিবাগত রাত্রের খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বৃটেনস্থ প্রবাসী বাঙালীরা সর্বত্র কমিটি গঠন করেন, চাঁদা তুলতে থাকেন, সভা অনুষ্ঠান করেন এবং মিছিল বার করতে থাকেন এবং জোর প্রতিবাদের ধ্বনি তোলেন৷ কোন কেন্দ্রীয় কমিটি না থাকায় তারা স্ব স্ব এলাকায় নিজেদের সদস্যদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করতে থাকেন। মুজিবনগর গবর্নমেন্ট গঠিত হওয়ার পর স্বাধীনতার আন্দোলনকে অধিকতর জোরদার করার জন্য একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের প্রয়োজন আরো বিশেষ করে অনুভূত হয়। অনেক চেষ্টার পর – আগেই বলেছি ২৪ এপ্রিল কভেন্টির মিটিং এ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। এর কিছুদিন পর এই সব বিভিন্ন কমিটির টাকা একটি ফান্ডে জমা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা হয়। তখন সকল অঞ্চলের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে “বাংলাদেশ ফান্ড” নামে একটি কেন্দ্রীয় ফান্ড সৃষ্টি করা হয়। কোন ব্যাংকই একাউন্ট খুলতে রাজী হয় না – কেননা তাদের মতে, বাংলাদেশ বলে স্বীকৃত কোন দেশ নেই৷ অনেক কষ্টে একটি মার্চেন্ট ব্যাংক হ্যামরুজ ব্যাংকে একাউন্ট খোলা হয়। শোনা যায়, এতেও পাকিস্তান দূতাবাস প্রতিবাদ করে৷ কিছুদিন পর হ্যামব্রুজ ব্যাংক হঠাৎ একাউন্ট তুলে নিতে বলে এবং মাত্র ২/১ দিনের সময় দেয়৷ আমরা খুবই বিপদে পড়ি। এবারে কয়েকজন প্রতিপত্তিশালী ইংরেজের সহায়তায় ন্যাশনাল ওয়েস্টমিনস্টার ব্যাংককে রাজী করানো হয়। এভাবে এক গুরুতর সমস্যার সমাধান হয় ও হ্যামব্রুজ ব্যাংকের টাকা ন্যাশনাল ওয়েস্ট মিনস্টার ব্যাংকে পাঠানো হয় এবং নতুন একাউন্টের নম্বর ইত্যাদি আবার নতুন করে বাঙালীদের জানানো হয়। সমস্ত কমিটিকে অনুরোধ করা হয় তাদের আদায়কৃত টাকা ঐ একাউন্টে জমা দিতে আর ভবিষ্যতে যা আদায় করা হবে তাও ঐ একাউন্টে জমা দিতে। তারা পূর্বেই নিজেদের রসিদ বইয়ে টাকা আদায় করছিলেন এবং পরেও নিজেদের খরচ চালানোর জন্য টাকা নিজেদের রসিদ বই মারফৎ তুলতে থাকেন৷ অবশ্যি যে টাকা তারা বাংলাদেশ ফান্ডের রসিদ বইয়ে তোলেন তা ফান্ডে জমা দেন৷ যারা রসিদ বই ফেরত দেননি তাদের তালিকা অডিট রিপোর্টে দেওয়া আছে। কথা হয়েছিল, বাংলাদেশ ফান্ডের রসিদ বই ছাড়া আর কোন রসিদ বইয়ে টাকা তোলা বন্ধ করতে হবে এবং খরচের টাকা বাংলাদেশ ফান্ড থেকে নেবেন। কিন্তু বাস্তব অসুবিধার কথা উল্লেখ করে প্রায় সব কমিটিই নিজেদের কাজ পরিচালনার জন্য নিজেদের রসিদ বইয়ে টাকা তোলেন। এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্যের জন্য বাংলাদেশ ফান্ডের বইয়ে টাকা তোলেন।

এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, এটা ছিল একটা যুদ্ধকালীন সময়। প্রায় সকল প্রবাসী বাঙালীই স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন – সমর্থন করেছেন কিন্তু কেউ সমর্থন করতে বাধ্য ছিলেন না। বিশেষ করে পাকিস্তান দূতাবাস আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য অনবরত চেষ্টা করছিল কিন্তু সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। সেই অবস্থায় আমরা যতখানি ঐক্য রক্ষা করতে পেরেছি তাতেই আশ্চর্য হতে হয়। এ নিবন্ধে অভিযোগ করা হয়েছে আমাদের কমান্ড শক্ত ছিল না। এর চেয়ে বেশী শক্ত কি করে হতে পারত আমি জানি না। একটি কমিটি চাঁদা তুলে সরাসরি মুজিবনগরে পাঠিয়েছিলেন। যা হোক – ২৪ এপ্রিল কভেন্ট্রিতে গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটিকে যে আমরা নয় মাস রক্ষা করতে পেরেছিলাম, সেটাই যথেষ্ট। প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় আঞ্চলিক সমিতি গুলি সভা ইত্যাদি করতেন। এসব খরচ চালানোর জন্য বিভিন্ন আঞ্চলিক সমিতিগুলি তাদের প্রয়োজনেই টাকা তুলতে থাকেন। তারা স্টিয়ারিং কমিটির সহযোগিতা করতেন কিন্তু যাকে বলে স্বায়ত্তশাসন সেটা তাদের ছিল।

স্বাধীনতার পর মিঃ স্টোন হাউস বৃটিশ – বাংলাদেশ ট্রাস্ট নামে একটি ব্যাংক করেন। এই ব্যাংক এবং অন্যান্য কোম্পানীর ব্যাপারে তাকে অভিযুক্ত করা হয় এবং বিচারে তার শাস্তি হয়। তিনি কিংবা আর কেউই বাংলাদেশ ফান্ডের জমা দেওয়া টাকা আত্মসাৎ করেন নাই৷ এই প্রসঙ্গে আরো উল্লেখযোগ্য যে, কখনোই ট্রাস্টি নিজেদের হাতে টাকা লেনদেন করেন নাই। কয়েকজন বাঙালীর অনুরোধে মিঃ জনসন নামে এক জন পার্লামেন্ট সদস্য তদানীন্তন সলিসিটর জেনারেল রাইট অনারেবল পিটার আর্চার এম, পি- এর কাছে “বাংলাদেশ ফান্ড” সম্বন্ধে জানতে চান৷ সলিসিটর জেনারেল বৃটিশ মন্ত্রীসভা ও পার্লামেন্টের সদস্য এবং তিনি ফৌজদারী মামলার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। তিনি ১৯৭৭ সনের নভেম্বরে লেখা একটা চিঠিতে মিঃ জনসনকে যে উত্তর দেন তা নিম্নে দেওয়া গেলঃ

‘Further to our conversation on the subject of the Bangladesh Fynd; you may wish to know that the police have concluded a long and searching enquiry into the affairs of the Fund; but in the view of the Director of Public Prosecutions, no evidence has emerged which would justify a prosecution against anyone.
I have studied the position carefully, and agree with the D. P. P ‘

এছাড়া বৃটিশ গবর্নমেন্টের ডিপার্টমেন্ট অব ট্রেড মাইকেল সেরারড কিউ সি এবং ইয়ান হে ডিভিশন এফ সি এ দ্বারা একটি ইন্সপেক্টিং টিম গঠন করেন। এই টিম মিঃ স্টোন হাউস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বৃটিশ বাংলাদেশ ট্রাস্ট লিমিটেড ইত্যাদির হিসাব পরীক্ষা করেন। তারাও তাদের রিপোর্টে বাংলাদেশ ফান্ড সম্পর্কে মন্তব্য করেনঃ

“The Bangladesh Fund
22. Mr. Stonehouse was one of three trustees of the Bangladesh Fund – sometimes known as the Bangladesh Relief Fund. We were aware of rumours in the press that he might have misappropriated or made use of the funds of that charity. Although not strictly within our any evidence of improper dealing with the funds of that charity or the possible mixing of such fund by Mr. Stonehouse but our work did not reveal any hint of wrong doing in this connection. We have seen withnesses hotile to Mr. Stonehouse : not one of them has suggested that interfered in any way with charity monies. It is only fair to Mr. Stonehouse to say that, So far as our investigations can show, such rumours are without foundation.

আমার মনে হয় দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামের সাদৃশ্যের জন্য কারো কারো মনে কনফিউশন সৃষ্টি হয়েছে। ” বাংলাদেশ ফান্ড” সৃষ্টি হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় অর্থাৎ ১৯৭১ সনে। চাটার্ড এ্যাকাউন্টেন্ট, ১৯৭২ সনের ৩০ সেপ্টেম্বর এর অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করেন। অন্য পক্ষে স্বাধীনতা অর্জনের বেশ কিছু দিন পরে মিঃ স্টোন হাউস বৃটিশ বাংলাদেশ ট্রাস্ট ব্যাংক স্থাপন করেন। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার বা আমার কোন প্রকার সম্পর্ক ছিল না।

পরিশেষে আমার প্রিয় দেশবাসীর কাছে আমার একটি আবেদন আছে। যারা সত্য পরিবেশন করতে চান, তারা আমার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশ করার আগে আমার কি বলার আছে সে সুযোগ দেবেন। আর যদি তা না করা হয়, কারো জন্যই সর্বদা প্রতিবাদ করা সম্ভব নয় বা শোভনীয় নয়। তাই গত চার বছর পরে আমি কয়েকটি মাত্র কথা বললাম।