‘৬৯-এর ১৫ই ফেব্রুয়ারি ভােরবেলা
ফজরের আযান শােনা যাচ্ছে। ‘৬৯-এর ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ । তেমন করে আলাে ফোটেনি, চারদিকে হালকা আলাের কমলা রঙের আভা ছড়াচ্ছে। পাখিরা জেগে ওঠে আরাে আগে তাদের কিচিরমিচির ডাক ভেসে আসছে । জহুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফজলুল হকের পেটে ব্যথা হচ্ছে। তার ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়ােজন। জহুরকে সে ডাকল, জহুর আগে থেকেই জেগে ছিল। গত রাতে তার ভালাে ঘুম হয়নি। কেমন আচ্ছন্নের মতাে রাতটা কেটে গেছে । চাপা একটা ক্রোধ তার বুকের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে । অনেক দিন ধরে তারা এই থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ব্যারাকে বন্দি অবস্থায় আছে । জহুর আর ফজলুল হক অনেক দিনের বন্ধু । পাকিস্তানের করাচির কোরাঙ্গি ক্রিকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে একসঙ্গে কাজ করেছেন। সেই সময় থেকে তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব। ভাবনা-চিন্তা ও পথচলায় এই দুই বন্ধু ছিল একই মতাদর্শের মানুষ ।
ফজলুল হক বললেন- ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যদের গতিবিধি দেখে কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছে ।
জহুর বললেন- চলাে আমিও তােমার সঙ্গে যাব । রুমে ছিলেন স্টুয়ার্ড মুজিব, উনিও উঠে দাঁড়ালেন। চলাে, আমরা একসঙ্গে যাই। গত রাতের ঘটনাটায় ওরা ক্ষেপে আছে, তবুও আমাদের হয়তাে কিছু করবে না। জহুরের মনে ভেসে উঠল গত রাতের পাকিস্তানি সেনাদের দুর্ব্যবহার । ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় যে সকল রাজবন্দি ছিল, তাদের জন্য পাকিস্তানিরা মানসম্পন্ন খাওয়াদাওয়া দিত না । বাঙালিরা ভাত খেতে পছন্দ করে জেনেও তারা অভিযুক্তদের নিম্নমানের মােটা চালের ভাত দিত, এমনকি সেই ভাতের সঙ্গে কাঁকর মেশানাে থাকত । অভিযুক্তরা প্রায়ই সম্পূর্ণ ভাত খেতে পারতেন না। থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টে যে ব্যারাকে আগরতলা মামলার অভিযুক্তরা বন্দি অবস্থায় ছিলেন, সেটি ষাট দশকে নির্মিত একটি একতলা দালান, কোথাও কোথাও টিনের ছাদ, তার পাশেই ছিল কাঁটাতারের বেড়া। সেখানে মাঝে মাঝেই কিছু গরিব ছােট ছােট অভুক্ত শিশু সামান্য খাবারের আশায় আসত । মূলত তারা অভিযুক্তদের অবশিষ্ট খাবারগুলাে সংগ্রহ করতে আসত। গত রাতে জহুর চুপচাপ বসে ছিলেন। অন্য অভিযুক্তরা তাদের অবশিষ্ট খাবার অসহায় শিশুদের মাঝে বিতরণ
১৯
করে দিচ্ছিলেন। এভাবে প্রায়ই অভিযুক্তরা তাদের খাবার থেকে একটা অংশ কাঁটাতারের বেড়ার অপর প্রান্তে অপেক্ষারত ছােট বাচ্চাদের দিয়ে দিতেন। পাকিস্তানি সেনারা প্রায় প্রতিদিনই এই ছােট বাচ্চাদের গালাগাল আর মারধর করে তাড়িয়ে দিত। গত রাতেও অভিযুক্তরা একইভাবে খাবার বিলিয়ে দিচ্ছিলেন।
পাকিস্তানি সৈনিক মঞ্জুর শাহ আবারাে গালাগাল শুরু করে। একপর্যায়ে অভিযুক্তরা প্রতিবাদ করে বলেন- আমরা তাে আমাদের খাবার থেকে খাবার বাঁচিয়ে ওদের দিচ্ছি! মঞ্জুর শাহ ক্ষিপ্ত হয়ে বাচ্চাদের লাথি মারা শুরু করে। জহুর চুপচাপ বসে পুরাে ঘটনাটা দেখছিলেন। মঞ্জুর শাহর দুর্ব্যবহার দেখতে দেখতে হঠাৎ তার বুকের ভেতর এক তীব্র প্রতিবাদের ঝড় উঠল। জহুর মুহূর্তের মধ্যে উঠে দাঁড়ান এবং অতর্কিতে মঞ্জুর শাহর ওপর ঝাঁপ দিয়ে তার রাইফেলটা কেড়ে নেন । মঞ্জুর শাহ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। জহুর বলে ওঠে- তােমরা কী ভেবেছাে? তােমাদের এই দুর্ব্যবহার দেখে দেখে আমরা অসহ্য হয়ে পড়েছি, তােমাদের হাতে অস্ত্র আছে তাই এত ক্ষমতা দেখাচ্ছাে । চাইলে আমরা খালি হাতে এই ক্যান্টনমেন্ট দখল করতে পারি। এই কথা বলার পর, জহুর সবলে রাইফেলটি মঞ্জুর শাহর দিকে ছুড়ে দেন। মঞ্জুর শাহর চেহারা দেখে অন্য অভিযুক্তরা বুঝতে পারেন- অস্ত্রধারী এই উদ্ধত পাকিস্তানি সেনাটি তার যােগ্য অপমানটি পেয়েছে। মঞ্জুর শাহ হতবাক হয়ে পড়ল, সে ভাবতেও পারেনি, একজন নিরস্ত্র বাঙালি অভিযুক্ত এইভাবে প্রতিবাদ করতে পারে! আবার এইভাবে রাইফেলটা ছুড়ে দিতে পারে! জহুর দীর্ঘদিন পাকিস্তানের কোরাঙ্গি ক্রিকে অস্ত্র প্রশিক্ষক ছিলেন। অভিজ্ঞ অস্ত্র প্রশিক্ষক হিসেবে তাঁর যথেষ্ট সুনাম ছিল। কিন্তু তার মাঝে এই শিক্ষাও ছিল যে, তিনি জানতেন শত্রুর সঙ্গে সামনা-সামনি অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে নামতে হয় । কারাগারের কক্ষগুলাে বাইরে থেকে তালা লাগানাে থাকত। ভেতর থেকে নাড়া দিয়ে শব্দ করায় সেন্ট্রি এসে জিজ্ঞেস করে, “তােম লােক কেয়্যা চ্যাতা? তারা ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বললেন । সেন্ট্রি বলল, একটু অপেক্ষা করতে হবে ওপর থেকে পারমিশন আনতে হবে । তারপর নিয়ে যাওয়া যাবে। কিছুক্ষণ পর সেন্ট্রি এসে গেট খুলে কড়া গলায় তিনজনকে লাইন করে দাঁড়াতে বলল। কারাগারের কক্ষগুলাের সামনে ছিল প্রশস্ত বারান্দা। সেখান থেকে হেঁটে গিয়ে শেষ মাথায় ছিল ওয়াশরুম। ভােরের আভা সবে মাত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে- জহুর সবার আগে হাঁটছে, মাঝখানে ফজলুল হক, শেষে স্টুয়ার্ড মুজিব । ওয়াশরুমের কাছাকাছি পৌছে হঠাৎ তারা দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাঁরা এক অশনিসংকেত বুঝতে পারলেন ।দ্রুত বুটের শব্দে কেউ এগিয়ে আসছে। জহুর
২০
বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। তিনি যেমন ছিলেন, তেমনি সােজা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। গত রাতের সেই উদ্ধত পাকিস্তানি সৈনিক মঞ্জুর শাহ রাইফেল তাক করে তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। চোখে-মুখে রক্তের পিপাসা, আক্রোশের ছাপ। উর্দুতে গালি দিয়ে বলল- কাল তাের সাহস দেখেছি, কিন্তু আজ আমি তােদের মেরে ফেলব। জহুর একটুও বিচলিত হলেন না। সরাসরি তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। মঞ্জুর শাহ মুহূর্তের মধ্যে গুলি চালাল, গুলি এসে সােজাসুজি জহুরের পেটে লাগল । আচমকা গুলির আঘাতে দীর্ঘদেহি মানুষটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আরও একটি গুলির শব্দ, জহুর সাহসী যােদ্ধা- তার শরীর সবল ও শক্তিশালী, কিন্তু আচমকা গুলির আঘাতে গভীর আচ্ছন্নতার। ভেতরেই সে দেখতে পেল তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফজলুল হকের দেহটিও মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। জহুর বুঝতে পারল না স্টুয়ার্ড মুজিবের কী হয়েছে । সেও নিশ্ৰুপ শুয়ে আছে। জহুর ধীরে ধীরে ফজলুল হককে ডাকল- বলল, ফজলু শক্ত হও, গত রাতের সেই বর্বর পাকসেনারা আমাদেরকে মেরে ফেলতে চাচ্ছে, আমাদেরকে উঠতে হবে, বাঁচতে হবে। ওদের বর্বরতা যে কতখানি নির্মম হতে পারে, তারই দৃশ্য এইবার ফুটে ওঠল । পাকসেনারা ছুটে এসে হাসতে হাসতে বলল- দ্যাখাে, ইয়ে আদমি আভি তাক জিন্দা হ্যায়। রাইফেল খাড়া করে- জহুরের গুলিবিদ্ধ পেটের ওপর উঠে দাঁড়াল । রাইফেলের মাথার বেয়নেট দিয়ে সরাসরি পেটের মধ্যে আঘাত শুরু করল । বেয়নেটের আঘাতে জহুরের পেটের সমস্ত তন্ত্রী ছিড়ে যাচ্ছে। তবুও বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যটি ক্ষান্ত হচ্ছে না। তাকে জুতা দিয়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে। বুটের আঘাতে জহুরের কলার বােন ভেঙে গেল । জহুর বুঝে উঠতে পারছে না একজন নিরস্ত্র মানুষকে একজন অস্ত্রধারী মানুষ কীভাবে এই রকম নৃশংস আক্রমণ করতে পারে । আজন্ম এই শিক্ষা সে পেয়েছে একজন প্রকৃত যােদ্ধা নিরস্ত্র মানুষকে আক্রমণ করতে পারে না। এই রকম অবস্থায়ও সে খেয়াল করল ফজলুল হককেও ওরা বুট দিয়ে লাথি মারছে। এরা সৈনিক না, এরা একই দেশের মানুষ না, এদের সঙ্গে আমি একই সঙ্গে পাকিস্তানে কাজ করেছি, তবুও এরা আমাদের ভাই না, এরা রক্তপিপাসু, পিশাচ! পাকিস্তানি বর্বর মঞ্জুর শাহর বেয়নেটের আঘাতে জহুরুল ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। গুলির শব্দে আচমকা ঘুম ভেঙে গেছে থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কারাগার কক্ষে বন্দি বাকি অভিযুক্তদের । সকলেই উদ্বিগ্ন হয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে, কোথায় গুলি চলছে । কারাগার কক্ষে নিচের দিকে জানালা ছিল না। তাই সরাসরি তারা দেখতে পারছিল না। দেয়ালের ওপরের দিকে লােহার গ্রিল ও কাচের শার্সি ছিল । অভিযুক্তরা চেয়ার টেনে এনে তার ওপর দাড়িয়ে ওপরের জানালা দিয়ে কষ্ট করে দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অভিযুক্তরা অচিরেই বুঝতে পারল তাদের কোনাে ঘনিষ্ঠ সহযােদ্ধার ওপর বর্বর পাকসেনারা গুলি চালিয়েছে। অথচ তারা কিছুই করতে পারছে না। বাইরে থেকে সবগুলাে কক্ষ তালাবদ্ধ। বাইরে পাকিস্তানি সেনারা জোরেশােরে টহল দিচ্ছে। কিন্তু বাঙালিরা থেমে থাকতে পারছিল না। তারা ঘরের ভেতর থেকে মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে, চিৎকার করে প্রতিবাদ শুরু করে দিল । তাদের প্রতিবাদে চিৎকারে সমস্ত পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠল ।
২১
জহুরের কখন জ্ঞান হারিয়েছিল আবার কখন জ্ঞান এলাে, সে কিছুই ঠিকমতাে মনে করতে পারছে না। হঠাৎ সে বুঝতে পারল- একটা অ্যাম্বুলেন্সে তাকে আর ফজলুল হককে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
জহুর বন্ধকে জিজ্ঞেস করল- তােমার কেমন লাগছে? সাহস রাখাে, আমরা বেঁচে যাব ।
ফজলুল হক জহুরকে বলল- তােমার জখম অনেক বেশি, তােমার কেমন লাগছে । আমাদের ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! কী করবে বুঝতে পারছি না!
ডা. কর্নেল এম. এ. আলী
ঘড়িতে ভাের সাড়ে ছয়টা, ডা. কর্নেল এম. এ. আলী প্রতিদিনের মতাে খুব ভােরে উঠেছেন, গােসল সেরেছেন । সকালের নাস্তা তখনও করেননি। স্ত্রী মারিয়ম নাস্তা তৈরি করছেন। হঠাৎ ঝন ঝন শব্দে টেলিফোন বেজে উঠল। সিএমএইচ থেকে ফোন- খুব জরুরি অবস্থা! এখনই তাকে হাসপাতালে যেতে হবে। সকালের নাস্তা খাওয়ার সময় হলাে না। তিনি দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছলেন। সেই ষাটের দশকের শুরুতে, পাকিস্তান থেকে এসে ঢাকার সিএমএইচে সার্জন হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বিলাতে ছিলেন অনেক দিন, ডাক্তারি পড়েছেন। আর সেখানেই পরিচয় ‘মারিয়ম’-এর সঙ্গে। পরে মারিয়মকে বিয়ে করেছেন । আজও এই ব্রিটিশ নারী, বাঙালি রমণীর মতাে ঘর-সংসারের দায়িত্ব নিয়ে আছেন আমাদের বাংলাদেশে।
২২
কর্নেল আলী সিএমএইচ হাসপাতালে পৌছেই বুঝতে পারলেন, পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ। সহকারী ‘খাওসা’ দ্রুত এসে তাকে জানাল, দুইজন মানুষকে পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্মমভাবে আহত করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে । রক্তে ভেসে যাচ্ছে- কোনােভাবে রক্ত থামানাে যাচ্ছে না, এরা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় ছিল। আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত। কর্নেল আলী খাওসাকে রােগীদের কাছে থাকার নির্দেশ দিয়ে দ্রুত পাকিস্তানি অফিসারদের কাছে ছুটে যান। পাকিস্তানি অফিসারদের মধ্যে তখন তুমুল বাগ্বিতণ্ডা চলছে। কেউ কেউ বলছেন- এদের পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হােক। কেউ কেউ বলছেন- আধমরা লােক দুটোকে এখানেই চিকিৎসা করানাে হােক। তা না হলে বাইরে আন্দোলন তীব্র হবে। আবার কেউ কেউ হাসতে হাসতে বলে ওঠল- এগুলােকে ফেলে রাখাে। এমনিতেই আধমরা, আর কিছুক্ষণ পর মরে যাবে, ল্যাটা চুকবে । মেজর নাসের ডা. আলীকে নির্দেশ দিলেন আহত রােগীদের চিকিৎসার জন্য । ডা. আলী আহতদের কাছে গিয়ে এক অভূতপূর্ব ঘটনার সম্মুখীন হলেন। রক্তে ভেসে যাচ্ছে দু’জনের শরীর । অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে ধমনিতে রক্তের সঞ্চালন অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে আসছে। সমস্ত চেহারা রক্তশূন্যতায় বিবর্ণ, চোখের উজ্জ্বলতা লীন, শরীরের শেষ রক্তবিন্দু নিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। ডা. আলী প্রথমে জহুরের কাছে গেলেন। জহুর তাঁকে ক্ষীণকণ্ঠে বললেন- “আমার বন্ধুর অবস্থা খারাপ, আপনি তাকে আগে দেখেন। ডা. কর্নেল আলী অবাক হয়ে, অপর পাশে শুয়ে থাকা ফজলুল হকের কাছে গেলেন। ফজলুল হক ডা. আলীকে বললেন- “আমার চেয়ে জহুরের আঘাত অনেক বেশি, ওকে ওরা রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে অনেক আঘাত করেছে, আপনি ওকে আগে দেখেন। ৯৮ বছর বয়সে ডা. কর্নেল আলী আমাকে বলেছিলেন- আজ আমি মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছি। সে সময় ওদের দুই বন্ধুর মধ্যে যে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালােবাসা লক্ষ করেছি। আমি কোনাে দিন তা ভুলতে পারিনি। আমি হত-বিহ্বল হয়ে পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের কাছে আবার ছুটে গেলাম চিকিৎসার সুব্যবস্থার জন্য।
আমি তখন পাকিস্তানি সৈন্যদের অনুরােধ করে বললাম, এ রকম রােগীর অপারেশনে দেরি করা যাবে না। ঢাকা মেডিকেল কলেজে অনেক ভালাে ভালাে সার্জন আছে। এক-দু’জন সার্জন নিয়ে আসুন, দু’জনকে দ্রুত অপারেশন করাতে হবে । আমার পক্ষে একা দু’জনকে একসঙ্গে অপারেশন করা সম্ভব না। এ ছাড়া আনুষঙ্গিক প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থার জন্য অনুরােধ করি ।
২৩
আরাে অনুরােধ করলাম, জহুরের রক্তের গ্রুপ ‘ও-নেগেটিভ’- এ ধরনের রক্ত পাওয়া দুষ্কর। জহুরের রক্তের জন্য প্রয়ােজনে পত্রিকা, গণমাধ্যমে উন্মুক্ত বিজ্ঞাপন দেওয়া প্রয়ােজন, নতুবা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে রােগী বিপজ্জনক অবস্থায় চলে যেতে পারে। তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কোনােমতেই বাইরে থেকে চিকিৎসক, সার্জন ও কোনাে রকম সাহায্য নিতে রাজি হলেন না। তারা মূলত এবিষয়টি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যাতে অভিযুক্তদের ওপর গুলি হওয়ার খবরটা প্রকাশ না পায় সে জন্য গােপনীয়তার আশ্রয় নিয়েছিল। তারা অনেকটা হুকুমের মতাে ডা. আলীকে বললেন- আমাদের এক কথা, আপনি যা পারেন তা-ই করেন। এমনকি তারা জহুরের জন্য রক্ত সংগ্রহের আহ্বান জানিয়ে বিজ্ঞাপনও দিলেন না। এদিকে বিহ্বল এক বাঙালি তরুণী নার্স খাওসা মাটিতে পড়ে থাকা গুলিবিদ্ধ দু’জনকে কোনােমতে দুটি বেডে শুইয়েছেন। সে একা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। এই হাসপাতালের সে চিফ মেট্রন । শ্যাম বর্ণের ২২ বছরের মেয়েটি মাথায় কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, মিষ্টি চেহারা, তার অমায়িক স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহারের জন্য ডা. আলী ও তার স্ত্রীর অনেক স্নেহের একজন। হাসপাতালে তার দিনের বেশির ভাগ সময় কেটে যায়। অনেক জটিল রােগী দেখেছেন, তাদের কেউ ভালাে হয়েছে, কেউ বা ইহলােক ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু সেদিনের মতাে পরিস্থিতিতে কোনাে দিন পড়তে হয়নি। ইতােমধ্যে সে খবরের কাগজে পড়েছে আগরতলা মামলার কথা, ক্যান্টনমেন্টে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরও অনেককে বন্দি করে রাখা হয়েছে। ওখান থেকেই দুজনকে পাকিস্তানিরা গুরুতর জখম করে নিয়ে এসেছে। সে বিচলিত হয়ে পড়ল, কীভাবে এদের বাঁচাবে, দুজনের শরীর থেকে এত রক্ত বের হচ্ছে, স্টোর থেকে অনেক তুলা এনে চাপ দিয়ে ক্ষত স্থানগুলাে চেপে ধরার চেষ্টা করছে, তবুও রক্তে ভিজে যাচ্ছে। এরপর দৌড়ে গিয়ে দু-তিনটি চাদর নিয়ে এসে চাদর দিয়ে তাদেরকে জড়িয়ে ধরে, রক্তের ধারা থামানাের জন্য। তবুও রক্তক্ষরণ হয়েই যাচ্ছে। এদিকে পাকিস্তানিদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডার পর ডা. আলী ক্লান্ত মন নিয়ে আবার রােগীদের কাছে ফেরত এলেন। ডা. আলী এসে খাওসাকে বললেন- অপারেশন করতে হবে, রােগীদের অপারেশনের ব্যবস্থা নাও। ডা. আলী আবার রােগীদের পরীক্ষা করলেন। ফজলুল হকের ক্ষত বুকে । গুলি তার বুকে লেগেছে। গুলি বুকের পাঁজরের হাড় বিদীর্ণ করে শরীরের ভেতর প্রবেশ করেছে। তার অবস্থা অপেক্ষাকৃত আশঙ্কামুক্ত। কিন্তু জহুরের অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন । তার পেটে গুলি লেগেছে। একই সঙ্গে বেয়নেটের নির্মম আঘাতে সমস্ত নাড়িভুড়ি ছিড়ে গেছে। বিশেষ করে অগ্ন্যাশয় খণ্ডিত হয়ে গেছে। অগ্ন্যাশয় খণ্ডিত হয়ে পড়ায়, অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত জায়লরিক অ্যাসিড পেটের সকল তন্ত্রিকে জখম করে ফেলেছে। এই ঘটনার অনেক বছর পরে, আমি যখন ‘আগরতলা মামলার অনুচ্চারিত ইতিহাস ও শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক’ বইটির তথ্য সংগ্রহের জন্য কর্নেল আলীর সঙ্গে কথা বলি,
২৪
তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন- জীবনে আমাকে এত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমি ভাবতে পারিনি। আমি বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে এই রােগীদের বাঁচাবাে।
পাকিস্তানিরা কোনাে রকম সাহায্য-সহযােগিতা করছে না, দেশে এত সার্জন থাকতেও অপারেশন করার জন্য কাউকে সহায়ক হিসেবে দিচ্ছে না। সেই সময় আমার স্ত্রী মারিয়ম আমাকে ফোন করে সাহস জুগিয়েছিল । সে হাসপাতালে চলে আসে এবং পাকিস্তানিদের সঙ্গে কথা বলে, তবুও তারা অনুমতি দেয়নি বাইরে থেকে আরাে সার্জন বা সহযােগী ডাক্তার দিতে। সেই সময় আমার স্ত্রী আমাকে আবারও সাহস দেয় এবং রােগীদের দ্রুত অপারেশন শুরু করতে বলে। এরপর আমাকে আরও একটি চরম সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কাকে আগে অপারেশন করবাে? তিনি বললেন- আমার মনে হলাে ফজলুল হককে বাঁচানাের সম্ভাবনা আছে, তাকে আগে অপারেশন করি। পরে জহুরুল হককে অপারেশন করবাে। কেননা তার অবস্থা অত্যন্ত জটিল, ক্ষত সর্বত্র তাকে বাঁচানাে কঠিন হবে। যদি একজনকেও বাঁচানাে সম্ভব হয়, সেই চেষ্টা করতে হবে । এদিকে খাওসা দুইজনের দিকে সমানভাবে নজর ও সেবা দিয়ে যাচ্ছে, রক্তস্নাত রােগীদের মুখ, হাত, পা মুছিয়ে অপারেশনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। সে রােগীদের নাম জানে না, কোথায় তাদের দেশের বাড়ি? কেন তাদের গুলি করা হয়েছে? কিছুই জানে না। শুধু জানে শেখ মুজিব ও আরাে কিছু লােককে ক্যান্টনমেন্টে আটক করে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে এদের আনা হয়েছে। মুজিব ভাইয়ের জন্য তার মন খুব অস্থির। জহুরুল হকের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করল, আপনি কি শেখ মুজিবুর রহমান? মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়েও জহুর মৃদু হেসে বলেছিল, না, আমি জহুরুল হক। দীর্ঘদেহি, ঘন গোঁফ ছিল জহুরের । কিছুটা সাদৃশ্য ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দৈহিক গড়নে। খাওসার বিশ্বাস হয় না, সে বুঝতে পারে না এরা কারা? তবুও সে বুঝতে পারে এরা অকুতােভয় যােদ্ধা! জহুর পানি খাওয়ার জন্য খাওসার কাছে বারবার অনুরােধ করে। তাঁর খুবই পানির পিপাসা পেয়েছিল । খাওসার মায়া হয়, কিন্তু অপারেশনের রােগীকে পানি দেওয়া যায় না, তুলাতে পানি ভিজিয়ে জহুরের ঠোটের কাছে ধরেন, দুই ফোঁটা পানি দেওয়ার জন্য। মুহূর্তের মধ্যে জহুর তার হাতটা শক্তভাবে চেপে ধরেন। তিনি আরাে পানি খেতে চান। মৃত্যু পথযাত্রী এক যােদ্ধার এই সংবেদনশীল মুহর্তটি খাওসা কোনাে দিন ভােলেননি। জীবনের গতিতে, নানা পথ পাড়ি দিয়ে ৭০ বছর বয়সে দাঁড়িয়েও আজও তার মনে সেই বিশেষ মুহূর্তটি অমলিন হয়ে আছে।
Reference:
৬৯ –এর শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক ও মুক্তিযুদ্ধ – নাজনীন হক মিমি