বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৯শে নভেম্বর, সোমবার, ১৯৭৩, ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
ভেজালকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই
ভেজাল আর ভেজাল। সারাদেশ জুড়ে শুধু ভেজালের ছড়াছড়ি। ভেজালের দৌরাত্ম্যে সমস্ত দেশের মানুষ আজ প্রাণান্ত হয়ে উঠেছে। যেদিকেই তাকানো যায় শুধু একটি একটিমাত্র জিনিসকেই অনুভব করা যায়। এহেন বস্তু নেই যাতে ভেজাল নেই।
খবরে প্রকাশ যে, বিষাক্ত আটা এবং ছাতু খেয়ে পাবনার প্রায় তিনশ’ লোক মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে এবং এদের অনেকেরই অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। পাবনা সদর থানার হেমায়েতপুর, চর আশুতোষপুর, মালিগাছা, গাছপাড়া, ভাড়ারা, সালাইপুর, মাঝিপুর, আরিফপুর, নুরপুর প্রভৃতি এলাকার খোলা বাজারের আটা এবং ছাতু খেয়েই এই দুরবস্থা।
আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে নারী, শিশু ও পুরুষ সহ সব বয়সের লোকই আছেন। আপাততঃ জাতিসংঘের ট্রাকে করে রোগী নেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে বলে জানা গেছে।
আমাদের দেশের অতি মুনাফালোভী ও মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলাকারী অসাধু ব্যবসায়ীদের আমরা চিনি। কারণ, তারা আলাউদ্দিনের চেরাগ নিয়ে অহরহই আমাদের আশে-পাশে ঘুরে বেড়ায়। অথচ তাদের সহজে ধরাও সম্ভব হয় না। আবার ধরা পড়লেও চেরাগের বলে তারা সবাইকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আইনের আওতা থেকে নিষ্কলঙ্ক বেরিয়ে আসে।
এর প্রধান কারণ হচ্ছে এই যে, এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আমাদের দেশে যে সব আইন প্রচলিত আছে তা খুবই মান্ধাতার আমলের এবং ঠুনকো। আবার তাদের জন্যে যে শাস্তির বিধান আছে তাও নিতান্ত মামুলী বা অপর্যাপ্ত।
অর্থাৎ এসব আসামী ধরা পড়লে প্রথমে পুলিশের হেফাজতে চলে যায় এবং খুব একটা গণ-জানাজানি না হলে টু-পাইসের বদৌলতে বেকসুর সেখান থেকে আইনের গাড়ীতে করেই বাড়ীতে চলে আসে।
আবার কেসটা যদি একটু গণ-জানাজানির মধ্যে হয়, তাহলে তাকে টু-পাইসের চেরাগের বলে জামাতার আদরে পুলিশের হেফাজতে রাখা হয় এবং সেখান থেকে আইন বই বেছে বেছে একটা জামিনযোগ্য ধারায় কেস দিয়ে কোর্টে পাঠানো হয়। তারপর অদৃশ্য হস্তের লীলাখেলায় জরিমানা হয় অথবা খালাসও পেয়ে যায়। এসবে আসামীর কিছু আসে যায়না। কারণ এমন ঠুনকো কেসে পড়ে পড়ে সে ঝানু হয়ে গেছে এবং এসব খরচপাতি সে মালের কষ্টিং-এর সময় থেকেই তুলে নেয়।
এতে ফল হয় এই যে, ভেজালকারীরা দিনের পর দিন নানান ফন্দি-ফিকির করে মানুষের নানান নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে অবাধে ভেজাল দিতে থাকে যার চরম শিকার হয় আমাদের দেশের অতি সাধারণ নিরীহ মানুষেরা যারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে থাকতে পারে না কিম্বা চোরাই পথে ফরেন গুডস দিয়ে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে পারে না।
তাই দেশের বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের আবেদন যাতে, পাবনার এই দুঃখজনক ঘটনাকে আপনারা একটি ‘লোনলি কেস’ মনে না করে একটি সর্বব্যাপক সতর্কতার ঘটনা বলে মনে করেন। কারণ এমন ভেজাল শুধু পাবনাতেই নয়, দেশের প্রায় সব অংশেই অপ্রতিহত গতিতে চলছে।
সুতরাং এই মুহূর্তেই খোলা বাজারের সমস্ত খাদ্যদ্রব্যের পরীক্ষা নেওয়া কিম্বা খোলা বাজারে মাল বিক্রিকারী সবাইকেই তার মাল বিক্রির আগে পরীক্ষায় বাধ্য করার মতো প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা উচিত।
আবার এমন পরীক্ষা শুধুমাত্র একদিনের অভিযান চালিয়ে সম্পন্ন করলে চলবেনা। প্রত্যেক খোলা বাজারেই একটি করে পরীক্ষা কেন্দ্র খুলে নিয়মিতভাবে মালামাল পরীক্ষা করে বিক্রির জন্যে অনুমোদন করার ব্যবস্থা করা উচিত।
মাঝে মধ্যে বা আকস্মিকভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ব্যবস্থাও অবস্থা আয়ত্তে আনতে সাহায্য করবে।
তবে সবচেয়ে বেশী যে জিনিসের প্রয়োজন তা হচ্ছে এই যে, ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের দেশে যে প্রচলিত আইন আছে তার আমূল সংস্কার সাধন করে ভেজালকারীদের চরম দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। তা’ না হলে খাদ্য-বিষক্রিয়ার এ অভিশাপ থেকে কোনোদিনও আমাদের সাধারণ মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হবেনা।
কৃষিক্ষেত্রে সমবায় অপরিহার্য
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভূমি ও রাজস্বমন্ত্রী জনাব আবদুর রব সেরনিয়াবাত একটি বার্তা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে দেশে অনতিবিলম্বে সমবায় পল্লী গঠনের কথা ঘোষণা করেছেন। অনতিবিলম্বেই সরকারের এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। মন্ত্রী বলেছেন, ভূমিহীন দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে সমবায় পল্লীর জমি বন্টন করা হবে। এ সকল জমি একশত বিঘার বেশী যাদের জমি ছিলো তাদের কাছ থেকে সংগৃহীত হয়েছে। সংগৃহীত এ জমির পরিমাণ ছিয়াত্তর হাজার একর হবে। স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত জমির মালিকগণ এই পরিমাণ জমি সরকারের নিকট সমর্পণ করেছেন। ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে জমি বন্টনের পূর্ব ঘোষিত সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করার জন্যে সরকার আগস্ট মাসের মধ্যে চার লাখ বাষট্টি হাজার একর জমি বিতরণের যে নির্দেশ দিয়েছিলেন মন্ত্রী জনাব সেরনিয়াবাত সাক্ষাতকারে তাও উল্লেখ করেছেন। কৃষকগণ ভবিষ্যতে সমবায় খামার করার জন্যে বিলিকৃত জমি কাজে লাগতে পারবেন বলে মন্ত্রী অভিমত প্রকাশ করেন। ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষি সমবায় খামারের কাজ শুরু হয়েছে বলেও মন্ত্রী তথ্য জানিয়েছেন। সমবায় পল্লী গঠনের সরকারী সিদ্ধান্তকে আমরা অভিনন্দন জানাই। দেশের সার্বিক কৃষি উন্নয়নের জন্যে সমবায়ের গুরুত্ব অপরিসীম, দেশের গোটা কৃষি ব্যবস্থাকে সমবায় খামারের মধ্যে এনে নিয়ন্ত্রিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে ভবিষ্যতে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। প্রাথমিক অবস্থায় শুধু বিলিকৃত জমি যা একশত বিঘার অতিরিক্ত হিসেবে পাওয়া গিয়েছে তাকে সমবায়ের মাধ্যমে চাষাবাদ করার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে অভিনন্দনযোগ্য। এছাড়া খাস জমিও সমবায় খামারে এনে চাষাবাদ করা একটি কার্যকরী পদক্ষেপ। এর জন্যে সরকার সমবায় পল্লী গঠনের যে সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছেন তাকে আমরা স্বাগত জানাই। অত্যন্ত দক্ষতা ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে যদি সমবায় পল্লী গঠন করা যায় তাহলে কৃষি ক্ষেত্রে আশাতীত সুফল ফলবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
আবর্জনা পরিষ্কারের নির্দেশ
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন মন্ত্রী দশদিনের মধ্যে সকল আবর্জনা দূর করে শহর পরিচ্ছন্ন রাখার জন্যে পৌর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। স্থানীয় একটি বার্তা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশিত খবরে প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন মন্ত্রী আকস্মিকভাবে গত শনিবার পৌরসভা কার্যালয় পরিদর্শন করেন এবং সে সময়ে পৌর কর্তৃপক্ষকে এ নির্দেশ দেন। শহরে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্যে প্রয়োজনীয় কারিগরি এবং আর্থিক সাহায্য প্রদানের আশ্বাস দিয়ে মন্ত্রী বলেছেন দশদিনের মধ্যে শহর পরিচ্ছন্ন করতে ব্যর্থ হলে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত পনেরো দিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী পৌর কর্তৃপক্ষের প্রতি অন্যূন তিনটি নির্দেশ জারী করলেন। গত তেসরা নভেম্বরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য দেওয়া সত্ত্বেও পৌর কর্তৃপক্ষের উন্নয়নমূলক কাজ কেন সন্তোষজনক দেখা যাচ্ছে না সেজন্যে ১৫ই নভেম্বরের মধ্যে রিপোর্ট পেশ করার জন্যে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। ঐ তারিখেই মৌচাক থেকে রামপুরার দিকে প্রধান সড়কের অব্যবস্থার জন্যে দায়ী পৌর কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার জন্যেও প্রধানমন্ত্রী আরেকটি নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে পুনরায় পৌর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিতে হ’লো শহর পরিচ্ছন্নের জন্যে।
পৌর কর্তৃপক্ষের প্রতি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বার বার নির্দেশ প্রদান পৌর কর্তৃপক্ষ কতটা কর্মতৎপরতা রয়েছেন সে কথাই প্রমাণ করছে।
রাজধানী এবং মহানগরী ঢাকার রাজপথ অথবা ছোটপথ কিংবা শহরের ভিতরে খানিকটা ফাঁকা জায়গা বা নীচু জায়গা এবং ছোট বড় নালা-নর্দমা ইত্যাদি যেদিকেই তাকানো যাক না কেন সর্বত্র চোখে পড়বে পচা আবর্জনা, জঞ্জাল যাকে বলা যায় মশামাছি তৈরীর কারখানা।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক