You dont have javascript enabled! Please enable it! দেশভাগ ও উদ্বাস্তুকথা - সংগ্রামের নোটবুক

দেশভাগ ও উদ্বাস্তুকথা

দেশভাগের একটি বড় অমানবিক দিক ছিন্নমূল উদ্বাস্তু জনশ্রেণীর ধনমান ও মর্যাদার আর্থ-সামাজিক ট্রাজেডি । যেমন বিভক্ত পাঞ্জাবে তেমনি বিভক্ত বঙ্গদেশে। আমরা ভাবছি আপাতত বঙ্গদেশ ও বাঙালিকে নিয়ে। তবে পাঞ্জাবের ঘটনাবলী ছিল ভয়াবহ। প্রবীণ পাঞ্জাবি সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার সম্প্রতি প্রকাশিত তার আত্মজীবনীতে সে ভয়াবহতার কিছু রেখাচিত্র তুলে ধরেছেন। প্রাণরক্ষার প্রবল আকাঙক্ষায় সৃষ্ট বাস্তুত্যাগে জনতার বিশাল কাফেলাকে তিনি আখ্যায়িত করেছেন স্বস্থানত্যাগী মানুষের হিমবাহ’ রূপে ‘দুই বিপরীত মুখে একই দেশের মানব সন্তানের যাত্রা, যা কেউ চায়নি, কেউ ভাবেও নি। কিন্তু সে অস্বাভাবিক জনস্রোত বন্ধ করার প্রক্রিয়া তাদের জানা ছিল না। বিনা অপরাধে যাদের ঘরবাড়ি মাটি ছাড়তে হয়েছে হিন্দুমুসলিম শিখ, স্বভাবতই তাদের মনে সঞ্চিত ক্ষোভ, বিদ্বেষ, ঘৃণা, হিংসা টগবগ করে ফুটেছে। সে ফুটন্ত চেতনার প্রতিক্রিয়াও স্বাভাবিক ছিল না  দিল্লিতে সেই ক্ষোভের সাম্প্রদায়িক প্রকাশ, নেপথ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল। বাংলার অবস্থা পাঞ্জাবের মতাে না হলেও এখানে দেখা গেছে সংখ্যালঘুদের মনে আতংক আর ভয়। অন্যদিকে প্ররােচনা ও বিত্তবানদের সম্পদ দখলের চেষ্টা, সব কিছু মিলে বিত্তবান ও মধ্যবিত্তশ্রেণীর হিন্দুদের দেশত্যাগ। সেই সঙ্গে অচিরেই ভারতীয় হাঙ্গামার প্রতিক্রিয়ায় বা স্থানীয় উপদ্রব হিসাবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাবলীর চাপে কথিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাস্তত্যাগ নিয়মিত হয়ে ওঠে। কেউ কেউ এদের চিহ্নিত করেছেন প্রান্তিক মানুষ হিসাবে।  এ প্রক্রিয়া অবশ্য বঙ্গে শুরু হয় দেশভাগের আগেই ১৯৪৬-আগস্টে সংঘটিত কলকাতা হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় নােয়াখালি-ত্রিপুরায় দাঙ্গার সময় থেকে। সাতচল্লিশের বঙ্গভাগ সে অস্থিরতায় আরাে গতি সঞ্চার করে। যারা হিসেবি মানুষ তারা কিছু অর্থের বিনিময়ে ঘটনার আগেই ঘরবাড়ি ছেড়েছেন, তবে অধিকাংশকেই বিরূপ পরিস্থিতিতে সম্বলহীন অবস্থায় অজানা অচেনা   গন্তব্যে পাড়ি দিতে হয়েছে। তাৎক্ষণিক লক্ষ্য সীমান্ত অতিক্রম করে স্বধর্মী স্বদেশে আশ্রয় গ্রহণ, যেদেশ বিভক্তির কারণে বিদেশ হয়ে গেছে । এই আশ্রয়গ্রহণ স্বধর্মীগণ খুশিমনে মেনে নেননি। ঘটি-বাঙাল বিরােধ সরস বয়ানে হালকা ভাবে নিলেও তা অনেক আগেকার কথা। তাই পশ্চিমবঙ্গের আদি বাসিন্দা, বিশেষ করে তাদের রক্ষণশীল শ্রেণীর চোখে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত “রিফিউজিদের ভিন্ন জগতের, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ বলে মনে হয়েছে, বিশেষ করে তাদের ভাষায়, আচরণে ।

কেন তাদের স্বাচ্ছন্দ্যে ভাগ বসাতে এসেছে অনাত্মীয় এক জনগােষ্ঠী, ধর্মে যদিও মিল? অর্থনৈতিক স্বার্থের এমনি মাহাত্ম যে সে স্বধর্মীকেও কখনাে কখনাে ছাড় দেয় না। যেমন আমরা পরবর্তীকালে দেখেছি পাকিস্তান আমলে মূলত অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে পূর্বপাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিস্ফোরণ। উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের অবসা, ঘটানাে। পাকিস্তানি মুসলিম শাসন থেকে মুক্তি। ১৯৪৭-এ দেশবিভাগের পরিণামে সৃষ্ট উদ্বাস্তু সমস্যার মুখােমুখি হয়ে পশ্চিম বঙ্গবাসী হিন্দু সম্প্রদায় ও স্থানীয় প্রশাসনের বিরূপ আচরণ ওই অর্থনৈতিক তত্ত্বটিকেই নতুন করে সত্য প্রমা করে। ‘ফ্রন্টিয়ার’ সম্পাদক কবি সমর সেনও তার লেখা ‘বাবু বৃত্তান্ত’ বইতে উদ্বাস্তুদের প্রতি বিরূপ আচরণের কথা উল্লেখ করেছেন এভাবে :  ‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে অনেক ছিন্নমূল উদ্বাস্তু এখনে এসেছেন। একসঙ্গে নয়, খেপে খেপে । কেন্দ্রীয় সরকার তাদের পুনর্বাসনের জন্য এমন কিছু করেন নি। যতটা করেছেন উত্তর ভারতে ।… পাঞ্জাব দিল্লী ইত্যাদি জায়গায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বীভৎস নরমেধ চলে, লক্ষ লক্ষ লােক আদিবাস ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হন, নতুন জায়গায় গিয়ে যে সমস্যার মুখােমুখী হন, তার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল … যারা ক্ষমতা পেলেন তাদের কোন ক্ষতি হয়নি, তারা মর্মস্পর্শী বক্তৃতা দেবার সুযােগ পেয়েছেন।…  ‘পূর্বপাকিস্তানে ও পশ্চিমবঙ্গে উত্তর ভারতের মতাে ভয়াবহ তাণ্ডব ঘটেনি। মাঝেমাঝে গণ্ডগােল বেঁধেছে। লােক মরেছে, আতঙ্কে অনেকে এখানে চলে এসেছেন। এখান থেকে কতজন পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছেন? এখানকার উদ্বাস্তুরা সবাই কলকাতায় বা আশপাশে নেই, অনেককে বাইরে পাঠানাে হয়েছে, যেমন  দণ্ডকারণ্যে।… উদ্বাস্তুদের আগমন পশ্চিমবঙ্গের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে সন্দেহ নেই ।… আসলে পশ্চিমবঙ্গের অনেকের মনােবৃত্তি উন্নাসিক, উদ্বাস্তুরা সরকারী বেসরকারীভাবে যথেষ্ট সহানুভূতি পান নি’ (বাবু বৃত্তান্ত, পৃ. ১১৮)।

সমর সেন সরাসরি না বললেও এটা স্পষ্ট যে পাক শাসকদের মতােই ভারতীয় শাসকদেরও বাঙালি-বিরূপতা নানা ঘটনায় প্রমাণিত। তবে স্বধর্মী, স্বজাতি পশ্চিমবঙ্গীয়দের বিরূপ অভ্যর্থনা পূর্ববঙ্গীয় উদ্বাস্তুদের কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। তাই দীর্ঘ সময় ধরে তাদের দুঃসহ জীবনযাপন, পুরাে এক প্রজন্মে, অবশ্য অসচ্ছলদের ক্ষেত্রে । বলতে হয় উদ্বাস্তু সমস্যা দেশভাগের পরিণামে এক নতুন মাত্রার জন্ম দিয়েছে। এ সমস্যা উদ্বাস্তু কারাে কারাে ব্যক্তিগত লেখায় উঠে এসেছে, যেমন বরিশালের দীপক পিপলাই বা মাগুরার দীপংকর রায় প্রমুখ। বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গের নাট্যব্যক্তিত্ব সুধী প্রধানেরও নজর এড়ায় নি। স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে তিনি লিখেছেন : উত্তর ভারতের নেতারা বহুদিন ধরেই বাঙালি বিদ্বেষী ছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন যে তার কাছে একজন বিশিষ্ট হিন্দি সাহিত্যিক বলেন, বাংলাভাষার মৃত্যু না হলে ভারতের সর্বনাশ । ভারত বিভাগের ফলে বাংলা ফে দ্বিখণ্ডিত হল তার প্রথম আঘাত এল ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর’ (‘বিভক্ত ভারতে পশ্চিম বঙ্গের সমস্যা, ঈশান, ১৯৯৮)। আসলে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে ধীরেসুস্থে । তাৎক্ষণিক আঘাত জাতিসত্তার ওপর এবং তার ফলে সৃষ্ট উদ্বাস্তু সমস্যা। সুধী প্রধান আরাে বলেছেন, “দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে যারা পশ্চিমবঙ্গে এল কেন্দ্রীয় সরকার তাদের জন্য বিশেষ কিছুই করে নি ।… কেন্দ্রীয় সরকারের লক্ষ্য ছিল… বাঙালিকে ধ্বংস করা এবং জাতিসত্তা হিসাবে বাঙালিকে দুর্বল করা’ (প্রাগুক্ত)। একই চেষ্টা ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারেরও। পশ্চিমবঙ্গ এ মূল বিষয়ে কতটা সচেতন বলা কঠিন। | দেশভাগের পরিণাম সম্প্রদায়গত বিভাজন ঘটিয়েই শেষ হয়নি। উদ্বাস্তু সমস্যা ঘিরে পশ্চিমবঙ্গে আঞ্চলিক বিভেদেরও জন্ম দিয়েছে। ভাগ্যতাড়িত একশ্রেণীর মানুষের জন্ম দিয়েছে যাদের নাম ‘রিফিউজি’ তথা বাস্তুত্যাগী, শরণার্থী । পাঞ্জাব থেকে বাংলা পর্যন্ত এ ট্রাজেডির বিস্তার। তবে স্বধর্মীয়দের আঞ্চলিক মানসিক বিভাজন একমাত্র তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গে দেখা গেছে  একে  বাঙাল, তায় বাস্তুত্যাগী । আর সেজন্য স্বধর্মীর অবজ্ঞা থেকে আপন হীনমন্যতার মধ্যেই জন্ম নেয় তাদের প্রতিবাদী চেতনা যা রাজনীতিকেও স্পর্শ করে । কলকাতার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত একাধিক রাজনৈতিক রচনায় দেখেছি ‘রিফিউজি’ রাজনীতি নিয়ে বিচার-ব্যাখ্যা এবং রিফিউজি তরুণদের বামরাজনীতি শক্তিমান করা নিয়ে তির্যক মন্তব্য। পেছনে ফেলে-আসা জীবনের স্মৃতি সম্বল করে প্রতিকূল পরিবেশে নতুন প্রত্যাশার জগত তৈরি এদের লক্ষ্য হয়ে ওঠে। তবু ‘রিফিউজি’ শব্দটির সঙ্গে জড়িত অবজ্ঞা যেন লেবেলের মতাে এদের গায়ে সেঁটে থাকে। দেশভাগ এদের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। পরিবর্তে উপহার দিয়েছে সহিংসতার ক্ষত ও আতংকের তিক্ত স্মৃতি । এ সমস্যা এদের বিত্তবান বা উচ্চমধ্যবিত্তের জন্য ততটা নয় যতােটা নিম্নমধ্যবিত্ত ও অসচ্ছল ছিন্নমূল মানুষের জন্য। ইতিহাস ও সাহিত্য এদের কিছুটা মান্য করলেও আশ্রয়দাতা সমাজ তা করেনি।

কৃপাণধারী, উগ্রমেজাজী শিখ উদ্বাস্তু যেটুকু সুবিধা আদায় করে নিতে পেরেছে বাঙালি উদ্বাস্তু তা পারেনি। তাই তার গতি পুরনাে দিলি বা অনুরূপ কলকাতায় নয়, বিরূপস্থান বা অস্থানে। এ পরিস্থিতির প্রতীকী ছবি আঁকেন বরিশালের সম্পন্ন পিপলাই পরিবারের তরুণ সদস্য ও আমাদের দেশ ছিল পূর্বপাকিস্তানের বরিশালে, আমরা উদ্বাস্তু পরিবার গ্রামের বাড়ি-জমি-পুকুর, শহরের বাড়ি-জমি সবকিছু ফেলে আসতে হয়েছে দেশভাগের ফলে। বাপ-ঠাকুর্দার ভিটে যেমন ছিল বরিশালে, মা-দাদুর ভিটে তেমনি খুলনায়। ওঁরাও উদ্বাস্তু। কখনাে কাশী, কখনাে মধুপুর, কখনাে কলকাতার জনক রােড কিংবা বড়বাগান-নানা ঘাটে ঠোক্কর খেতে খেতে শেষবন্দর বেহালা। আর ভবানীপুর-মেটিয়াবুরুজ-পাইকপাড়া-এন্টালি ইত্যাদি জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে দিদিমা থিতু হয়েছিলেন ট্যাংরা অঞ্চলে’ (আমার প্রশ্নভূমি : বাংলাদেশ’, দীপক পিপলাই)।  সম্পন্ন পরিবারেরই যদি এমন ‘ঠোক্কর খাওয়া’ দশা সেক্ষেত্রে অসচ্ছল উদ্বাস্তুদের দুর্দশার কথা ভাবাই যায় না। ওই সব শরণার্থীর গতি হয় শিয়ালদা প্ল্যাটফর্ম থেকে মধ্যপ্রদেশের দণ্ডকারণ্য বা দূর আন্দামানে । জীবন সেসব স্থানে বড় কঠিন। আদি বাসস্থানের মতাে সহজ স্বচ্ছন্দ নয়। তাহলে ভিটে ছেড়ে কেন চলে আসা, দুঃসহ অনিশ্চিত জীবনযাত্রার কাছে কেন আত্মসমর্পণ? যুক্তিসঙ্গত কারণ অবশ্যই রয়েছে যেমনটা আলােচনায় উল্লেখ করা হয়েছে। মূল কারণ পূর্বঘটনাবলী-নির্ভর ভাবনায় পাকিস্তান’ নামক মূর্তিমান আতংক।  

তাছাড়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ছােট বড় ঢেউ একের পর এক দেখা দিয়েছে। দীর্ঘ সময় জুড়ে। জিন্নার নিরাপত্তামূলক গ্যারান্টি সত্ত্বেও তার মুসলিম লীগ শাসন সে গ্যারান্টির মর্যাদা রাখে নি । দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রতিরােধের চেষ্টা দূরে থাক, ক্ষেত্র বিশেষে, যেমন ঢাকায়, সৈয়দপুরে, খুলনায়, চট্টগ্রামে বিহারিদের অথবা স্থানীয় দুবৃত্তদের তারা উসকে দিয়েছে সহিংসতা ঘটাতে। পাকিস্তানি শাসকদের গােপন লক্ষ্যই ছিল পূর্ববঙ্গ থেকে যথাসম্ভব সংখ্যালঘু বিতাড়ন যাতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায় ।  প্রথমত পূর্বপাকভূমি থেকে বিধর্মী বিতাড়ন যা ছিল পাকিস্তানি শাসনের রাজনৈতিক আদর্শ। দ্বিতীয়ত পাকিস্তানের মােট জনসংখ্যা বিচারে ঈষৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গকে হিন্দু বিতাড়নের সুবাদে সংখ্যালঘু প্রদেশে পরিণত করা । সেকারণে পাঞ্জাবের ভয়াবহতা পূর্ববঙ্গে দেখা না গেলেও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও বাস্তুত্যাগীদের সীমান্ত অতিক্রম দীর্ঘ সময় ধরে লাগাতার ঘটনা হয়ে থেকেছে। যা এখনাে ক্ষীণ ধারায় বহমান। অথচ পাঞ্জাবের ভয়াবহ দাঙ্গা ও উদ্বাস্তু মিছিল দেশভাগ-সংশ্লিষ্ট সময়ের মধ্যেই শেষ পাকিস্তানি শাসকদের বিশেষ করে সামরিক শাসকদের এই ‘স্যাডিস্ট’ মানসিকতার সুস্পষ্ট প্রকাশ দেখা গেছে পূর্বপাকিস্তানে একাত্তরের গণহত্যায় । যেখানে হিন্দুসম্প্রদায় আক্রমণের প্রধান শিকার। সে বিবরণ ধরা আছে ইঙ্গ-মার্কিনি পত্রপত্রিকাগুলোতে। সেকারণেই সাতচল্লিশে পূর্ববঙ্গের হিন্দু জনসংখ্যা ক্রমশ কমে এখন ১০-১২ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এই সেদিন বলেছেন : এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে হিন্দু জনগােষ্ঠীর অস্তিত্ব থাকবে না। অবশ্য আমার তা মনে হয় না, ইতিহাস এতটা নির্মম হওয়ার কথা নয়। দেশবিভাগের প্রাক্কালে শাসন ক্ষমতার লােভে ঘটনার টানাপড়েনে লীগ-কংগ্রেস দ্বন্দ্বে যে সাম্প্রদায়িক হিংসার আশ্রয়-প্রশ্রয়, তার ওপর ভর করেই শেষ পর্যন্ত দেশবিভাগ ও ক্ষমতার হস্তান্তর । হয়তাে তাই হিংসাই দেশভাগ ও কথিত স্বাধীনতার একমাত্র সত্য হয়ে ওঠে। সব সমস্যা মিটাতে দেশভাগ ও ক্ষমতাগ্রহণের পরও তাই হিংসার প্রকাশ বন্ধ হয় না ।

সর্বোপরি মাউন্টব্যাটেনর্যাডক্লিফ সাহেবদের অপরিণামদর্শিতায় রুটির টুকরাে নিয়ে হিংসার প্রবল প্রকাশ যার নাম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, আসলে গণহত্যা । হিংসাকে মাথায় রেখে  সম্ভবত রাজনীতিকদের স্বগতােক্তি হিংসার উদ্দেশে : ‘একমাত্র তােমাকে সত্য বলে জানি’। কত ভাবে যে হিংসার রাজনৈতিক ব্যবহার! সেজন্যই দেশ রক্তের জোয়ারে ভেসেছে, ভিজেছে মাটি। রাজনীতিকদের চোখের পাতা কাঁপেনি, তাদের কারাে গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগেনি। এমন কি আকাশযান থেকে মৃত্যুভয়তাড়িত ছিন্নমূল মানুষের দীর্ঘ, অন্তহীন কাফেলা দেখেও নেতার মনে হয়নি : ভুল হয়ে গেছে, এখনি ভুলটা শুধরে নেই। না, তেমন সুমতি তার বা তাদের কারাে হয়নি। স্বাধীনতার সুবাদে অন্তহীন হিংসার পরিণামে জন্ম জোড়াশব্দ ‘রিফিউজি’ ও ‘উদ্বাস্তু’, আর তাদের মিছিল। উদ্বাস্তু থেকে শরণার্থী, জীবন-ধারার দুটো তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ। দুটো শব্দই মানবমর্যাদাকে কুরে কুরে খেয়েছে। তবু স্পর্শ করেনি রাজনীতির চৈতন্য। এখনাে সে হিংসার রেশ রয়ে গেছে।  দেশভাগ বাংলাভূখণ্ড ও বাঙালি জাতিসত্তাকে এবং তার দুই প্রধান ধর্মসম্প্রদায়ের চেতনাকেই বিভক্ত করেনি, ভূখণ্ড ভিত্তিতে ও চৈতন্যের জগতে সমধর্মী সম্প্রদায় বিশেষকেও দ্বিখণ্ডিত করেছে। এ বিভাজন স্বাভাবিক নয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান-ভিত্তিকও নয়। ইতিহাস যেকোনো ঘটনাকে তার আপন তাৎপর্যে মেনে নেয়, কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের বিচারে তা গ্রহণযােগ্য নাও হতে পারে প্রসঙ্গত বিপরীত চরিত্রের একটি ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে যেমন তুলেছেন সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে বিশ্লেষণে আগ্রহী দীপক পিপলাই । তার প্রশ্ন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে, যাদের মধ্যে বাস্তুত্যাগীর সংখ্যা পূর্ববঙ্গীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের তুলনায় অনেক কম। তার ভাষায় বারবার দাঙ্গা ও গণহত্যা সত্ত্বেও হিন্দুপ্রধান দেশে বাঙালি মুসলিমদের বাস করা যদি স্বাভাবিক হয়, তাহলে মুসলিম-প্রধান দেশে বাঙালি হিন্দুদের পক্ষে ‘চৌদ্দপুরুষের ভিটেতে থেকে যাওয়াই স্বাভাবিক নয় কেন?’ একই কথা বলেন আরেক বাস্তুত্যাগী সমাজসেবী প্রাণতােষ বন্দ্যোপাধ্যায় । যিনি পূর্বাপর সহাবস্থানে বিশ্বাসী, ধর্ম ও ভূখণ্ড নির্বিশেষে।

তাদের বক্তব্য যুক্তিসঙ্গত। তবে এর মধ্যে যে ‘কিন্তু’ রয়েছে সে বিষয়টির ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ পাকশাসকদের রাজনৈতিক চিন্তা বরাবরই ছিল সম্প্রদায় বিদ্বেষে জারিত। মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ববঙ্গকে যথাসম্ভব হিন্দুশূন্য করা। লীগ শাসনের ফ্যাসিষ্ট চরিত্র এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও বিহারিদের বিজাতীয় বিদ্বেষ ইত্যাদি মিলে হিন্দুমানসে যে আতংক, ভয়, অস্থিরতা দেখা দেয় তার পরিণামে ব্যাপক হারে সংখ্যালঘুর স্বদেশত্যাগ । অনিশ্চিত ভবিষ্যত মাথায় নিয়ে  পথে বেরােনাে। তবে পশ্চিমবঙ্গীয় মুসলমানদের উদ্বাস্তু হওয়ার পরিবর্তে স্থিতির মনােভাব সত্যই ব্যাখ্যার দাবি রাখে। কারণ সেখানকার শাসনও সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত ছিল না। এমন কি এখনাে নয়। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলা দরকার যে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানের তুলনায় পূর্ববঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায় বিত্ত, সম্পদ ইত্যাদি বিচারে, এক কথায় অর্থনৈতিক দিক থেকে ছিল অনেক অগ্রসর । তাই ধর্মীয় বিদ্বেষ ছাড়াও বিস্তর জায়গা জমি বিষয় সম্পত্তি দালানকোঠা দোকানপাট ইত্যাদি ভােগ দখলের আকাক্ষা স্থানীয় মুসলমানের কম ছিল না। এ পার্থক্যটুকুও উদ্বাস্তু সংখ্যার ভিন্নতার বিশেষ কারণ । অর্থাৎ অর্থনৈতিক বৈষম্য ঘুরে ফিরে যেমন বিভাগপূর্ব কালে তেমনি বিভাগােত্তর কালেও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদচেতনা ও সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি প্রধান করে তুলেছে। অর্থনৈতিক অগ্রসরতাই রাজনীতির কলাকৌশলে বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং বাস্তত্যাগেরও কারণ হয়ে ওঠে। আমাদের অনেকেরই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উপযুক্ত বক্তব্যের পক্ষে তথ্য জোগান দিতে পারে। তবু দাঙ্গাহাঙ্গামার কথা মাথায় রেখে কিছু যুক্তি কিছু ভাবনা বলে, পূর্ববঙ্গের সম্পন্ন হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান শ্রেণী প্ররােচনার মুখেও ব্যাপক হারে দেশত্যাগ করলে সেকুলার সামাজিক শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হতাে না। তাৎক্ষণিক কিছু ক্ষতি হলেও আখেরে এর ফল্‌ ভালাে হতাে। অর্থশক্তির গুরুত্ব তাদের অজানা ছিল না। তাছাড়া সমাজে উদীয়মান মুসলিম গণতন্ত্রীরা তাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দুষ্ট শক্তির প্রতিরােধে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতাে।

যেমন দেরিতে হলেও চৌষট্টির দাঙ্গার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ : পূর্বপাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ । কিন্তু ততখানি মনের জোর তাদের ছিল না। তাই স্বদেশত্যাগই তাদের বিবেচনায় সঠিক মনে হয়েছিল। তাদের কারাে কারাে বিচারে ‘নিয়তি’ । কারণ ‘নিরাপত্তা’ শব্দটি তাদের অস্তিত্বের অংশ হয়ে ক্রমাগত ঘণ্টা বাজিয়েছে। সে নিরাপত্তা জানমাল ইজ্জতের। সেই সঙ্গে ধর্মরক্ষারও বটে। এত কটা সূচক অনিশ্চয়তায় বাঁধা পড়লে তখন দাঁড়াবার মতাে জায়গা থাকে না; নিশ্চিন্ত নিঃশ্বাসের অবকাশ মেলে না। তখনকার বিচ্ছিন্ন কিছু হিংসাত্বক ঘটনা পল্লবিত হয়ে আস্থার সব আলাে নিবিয়ে দেয়। রাতের অন্ধকার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে এগিয়ে আসে। তবে সে নিরাপত্তা গৃহত্যাগে। দেশবিভাগ তার নানামাত্রিক অনুষঙ্গ ও উপসর্গ নিয়ে একটি সীমিত মাপের ঘটনা নয়। এর উত্তর-প্রভাব এখনাে বহমান। যেমন ছােট বড় সামপ্রদায়িক  সহিংসতায় তেমনি দীর্ঘ ছায়াফেলা উদ্বাস্তু মিছিলে । প্রথম যাত্রার উদ্বাস্তুদের অধিকাংশই হয়তাে আজ আর নেই। কিন্তু তারা সমাজে, রাজনীতিতে যে দাগ কেটে রেখে গেছেন, উত্তরপুরুষে তাদের যন্ত্রণা, ভাবনা ও ভবিষ্যত প্রত্যাশা বা স্বপ্নের বীজ রেখে গেছেন সেসবের বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না । তা থেকে অঙ্কুর গজাবেই, হয়তাে বা ছায়াবৃক্ষের জন্ম দেবে।

কী কথা বলবেন তারা? সংঘাতের না মৈত্রীর? আমার বিশ্বাস, বর্তমান সময়ের আকাক্ষার সাথে তাল মিলিয়ে তারা শান্তি ও বিভেদহীন সহাবস্থানের কথাই বলবেন সব তিক্ত স্মৃতি দূরে সরিয়ে। কারণ বিভেদের বিষফল তাদের পূর্বসূরিদের খেতে হয়েছে, এবং তা অনিচ্ছায় হলেও। তাই আর বিভেদ নয়, এমনটিই হতে পারে তাদের উচ্চারণ । কিন্তু অন্য পক্ষ কি তা সাদরে গ্রহণ করবে? না কি, সেই পুরাতন দ্বন্দ্বে ফিরে যাবে? জিন্নার অর্থহীন ‘মাইনরিটি’ তত্ত্বের জের ধরে যে ‘রিফিউজি’ তত্ত্বের জন্ম তার কি অবসান ঘটবে না কখনাে? কি সে ক্ষতচিহ্ন থেকেই যাবে । এবং তা বয়ে বেড়াতে হবে সীমান্তের ওপারে কিছু সংখ্যক মানুষকে তাদের প্রজন্মান্তরে? কয়েক পাতার উদ্বাস্তু প্রসঙ্গ শেষ করতে চাই এই বলে যে দেশভাগ ও তার রক্তে রঞ্জিত সময় ঘিরে এই যে ছিন্নমূল মানুষের দীর্ঘ মিছিল-এমন একটি ট্রাজিক ঘটনা যা সমাজে আলােড়ন তুলেছে ঠিকই। কিন্তু তা কোনাে লেখক-প্রতিভার হাত ধরে এক বা একাধিক মহৎ উপন্যাসের জন্ম দেয় নি কেন? ‘ওয়র অ্যান্ড পীস’ না হােক, এ যুগের পাঠকমন অনুযায়ী কালােত্তীর্ণ হবার গুণসম্পন্ন একটি বা একাধিক উপন্যাস তাে জন্ম নিতে পারতাে? কারণ এত বড় মানবিকঅমানবিক ঘটনার তুলনা বিরল।  হ্যা, লেখা হয়েছে কিছু কবিতা গল্প দু-তিনটে উপন্যাস। কিন্তু তা তাে সাহিত্য অঙ্গনে বা পাঠক সমাজে সাড়া ফেলে নি। কেন এত বড় ঘটনা-সামাজিক-রাজনৈতিক-মানবিক ঘটনা মেধাবী লেখকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নি? এর কারণ আমার কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়। আসলে তা কি সত্যের মুখােমুখি হবার ভয়? বিশাল ট্রাজিক সত্যের? যে সত্য সহিংসতার অমানবিক চরিত্র সবার সামনে তুলে ধরবে? তা তাে হওয়ার কথা নয়। এটাইতাে লেখকের কাজ এর অন্য কারণ কি প্রতিভাবান লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অভাব? কিংবা ঘটনা-তাড়িত না হওয়ার কারণে? কিন্তু দ্রষ্টার অভিজ্ঞতাও তাে মহৎ সৃষ্টির জন্য  কম বড়াে উপাদান নয়? না কি এলিটশ্রেণীর বা নিজদের চেহারা-চরিত্র উন্মােচন করতে চান নি তারা? সেটাও তাে হবার কথা নয়। এই উম্মােচন, অঙ্কন লেখকেরই দায়িত্ব, তার সামাজিক দায়বদ্ধতা। তাহলে? যাই হােক, ছয় দশকেরও অধিক সময়ে অনেক রক্ত নিয়ে, অনেক জল, অনেক পানি গঙ্গা, পদ্মা, যমুনা দিয়ে বয়ে গেছে। অনেক অভিজ্ঞতা, অনেক তাজা করুণ দৃশ্যপট হারিয়ে গেছে এক একটি পরিবারের মানুষের সঙ্গে সঙ্গে। সময় দ্রুত গড়িয়ে চলেছে। এখন আর বােধ হয় সম্ভব নয় তাজা-অভিজ্ঞতাহীন প্রান্তরে দাঁড়িয়ে তেমন কোনাে সৃষ্টির। তবে ইতিহাস সেসব ধরে রাখতে পারে তার শাদামাঠা বয়ানে-সেটাও তেমন ভাবে হয়নি। ইতিহাসের একটি অধ্যায় ‘উদ্বাস্তুকথা’ হারিয়ে যাবে আমাদের সচেতনতার অভাবে কিংবা অবহেলায়? তা কি ইতিহাসের নিয়ম? একদা শিকড়হীন বা ছিন্নমূল মানুষের কাহিনী তার রক্তক্ষরা ট্রাজেডি জীবনের সত্য হয়ে সাহিত্যের পাতার লিপিবদ্ধ থাকবে না? এও কি হয়?

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক