You dont have javascript enabled! Please enable it! দেশবিভাগ বিচার একুশ শতকে দাঁড়িয়ে-১ - সংগ্রামের নোটবুক

দেশবিভাগ বিচার  একুশ শতকে দাঁড়িয়ে-১

বিপ্লবে নয়, বিদ্রোহে নয়, ভারতে ক্ষমতার হস্তান্তর আপসবাদী পথে ব্রিটিশ রাজ-এর প্রতিনিধি হিসাবে ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন তার চতুর হিসাব মাফিক ভারতবিভাগের মাধ্যমে তাদের ভারতত্যাগের সিদ্ধান্ত কার্যকর করেন। ভারত ও পাকিস্তান নামক দুই ডােমিনিয়নের শাসনভার তুলে দেন যথাক্রমে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের হাতে। ক্ষমতার হস্তান্তর সম্পন্ন হয় ১৫ আগস্ট মধ্যরাতের আগে ও পরে। কংগ্রেস ও লীগের পক্ষে এ অনুষ্ঠানের নায়ক যথাক্রমে জওহরলাল নেহরু ও মােহাম্মদ আলী জিন্না। সবাইকে হতবাক করে ক্ষমতার কাটাকুটি শেষের এ অনুষ্ঠানে গান্ধি অনুপস্থিত ভারতবিভাগ তার মনঃপূত ছিল, তাই প্রসঙ্গত মনে করতে পারি লীগের লাহাের অধিবেশনে (১৯৪০) পাঞ্জাবকেশরী সিকান্দার হায়াত খানের অনুপস্থিতির ঘটনা। ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষের বিভাজন তথা বহুকথিত ‘পার্টিশন’ এক রক্তাক্ত ঐতিহাসিক ঘটনা যা মানব ট্রাজেডি’ হিসাবেও চিহ্নিত  বহুদিন থেকে এ ঘটনা অনেক প্রশ্ন ও বিচার ব্যাখ্যার সম্মুখীন। অবশ্য মাত্র জনাকয় স্বনামখ্যাত নেতা ভারতবিভাগের সময় এর বিরােধিতা করেন। তাদের ধারণা ছিল দেশবিভাগ সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান নয়, বরং তাতে নতুন সমস্যা দেখা দেবে। তবে সমাধানের নামে দেশবিভাগ যে কী ভয়াবহতার জন্ম দিতে পারে এবং সেই সঙ্গে কত যে উপসর্গ তৈরি করতে পারে তা নেতাদের ধারণায় ছিল না। বিভাগােত্তর পর্বেও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও অন্যান্য উপসর্গ দুই ভূখণ্ডের বুদ্ধিজীবী ও জনগণকে তাড়িত করেছে এবং শেষােক্তদের অন্তহীন দুর্ভোগ ও যন্ত্রণার মুখে ফেলেছে । আর শাসকদের কাউকে কাউকে বিব্রত করেছে। নেহরুলিয়াকত চুক্তি তার উদাহরণ। তবে এতে বড় একটা সুফল মিলেনি রাজ-এর ভারতত্যাগের ভাবনায় ও কার্যক্রমে সদিচ্ছার অভাব না থাকলেও ছিল তাদের ভবিষ্যত-স্বার্থের কূটচাতুর্য  যশবন্ত সিং-এর ভাষায় ‘বিদায়কালে ব্রিটিশ আমাদের স্বাধীনতাকে দ্বিখণ্ডিত করে দিয়ে গেছে’ (পৃ. ৪৭৮)। তার মতে আমরা তাদের চেয়েও সরেস, জনগণকে স্বাধীনতার সারসুধা ভােগ করতে দেইনি। ব্যক্তি যশবন্তের এ জাতীয় বক্তব্যের সততা তার দল বিজেপি সম্বন্ধেও একই প্রশ্ন তুলতে পারে। কিন্তু তিনি তুলেছেন বলে জানি না।  উপমহাদেশের মানুষ, বিশেষ করে নিম্নবর্গীয় ও সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার সুফল যতটা পেয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি দুর্ভোগের শিকার হয়েছে।

এর দায় তৎকালীন ভারতীয় নেতাদের যেমন জিন্না-নেহরু-প্যাটেল। এমন কি গান্ধিও সে দায় পুরােপুরি এড়াতে পারেন না। তবে ভারত বিভাগ ও তজ্জনিত সহিংসতার মূল দায় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান-দাবির অনড় নায়ক জিন্নার সবচেয়ে বেশি। এদের পরবর্তী শাসকগণও একই ধারার। শুধু পাকিস্তান অর্জনের জন্য জিন্না ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানের প্রায় হাজার বছরের সহাবস্থানের ইতিহাস অস্বীকার করেছেন। নিছক রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য তিনি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে জাতি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তুলেছেন অনৈতিহাসিক দাবি যে হিন্দু-মুসলমান নানা অভিধায় পরস্পর-বিরােধী পৃথক জাতি, তাদের সহাবস্থান সম্ভব নয়। তাই তাদের স্বার্থে দরকার ভারতবিভাগ ও স্বতন্ত্র পাকিস্তান ভূখণ্ড (১৯৪০)। এ দাবিতে ছিল সংকীর্ণ ধর্মীয় চেতনার প্রতিফলন। আসলে রাজনৈতিক ইচ্ছাপূরণ। অবশ্য ইতিহাস পর্যালােচনায় এ সত্য অপেক্ষাকৃত কম আলােচিত যে জিন্নাই দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রথম প্রবক্তা নন । লাহাের প্রস্তাবের বছর দুইতিন আগে উগ্র হিন্দুত্ববাদী হিন্দুমহাসভানেতা সাভারকরের বক্তব্যে শােনা গেছে এমন দাবি যে ‘হিন্দু-মুসলমান স্বতন্ত্র জাতি’ দেশবিভাগ এ মানসিকতার অবসান ঘটাতে পারে নি। ভারতে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিজেপি’র উত্থান ও ক্ষমতা দখল অন্তত একটি প্রমাণ। সেই সঙ্গে স্মর্তব্য তাদের একাধিক সহযােগী সংগঠনের (আর. এস, এস, বা শিবসেনা ও বজরং দল) নেতাদের উগ্র সম্প্রদায়বাদী প্রচার। দ্বিজাতিতত্ত্বের পরােক্ষ আভাস রয়েছে কবি ইকবালের স্বতন্ত্র মুসলিম অঞ্চলের দাবিতে। তবে তিনি ভারতভাগ চান নি।  অন্যদিকে বিভাগপূর্বকালে কংগ্রেস-লীগ বা হিন্দুমহাসভার মতাে পরস্পরবিরােধী সংগঠনের বাইরে যেমন ছিল বামরাজনীতির দুর্বল অস্তিত্ব তেমনি ছিল জাতীয়তাবাদী মুসলমান নামের একাধিক সেকুলার সংগঠন। যেমন মােমিন, আহরার তেমনি ধর্মীয় সংগঠন হয়েও সেকুলার চেতনার জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দ যারা ভারতবিভাগের বিরােধী, হিন্দুমুসলিম ঐক্যের প্রবক্তা। তবে তাদের মধ্যে ছিল সংহতির অভাব। এছাড়া রাজনৈতিক বিচারে মােটাদাগে সেকুলার সংগঠন বঙ্গে ফজলুল হক পরিচালিত ‘কৃষক প্রজাপাটি’ এবং পাঞ্জাবে সিকান্দার হায়াত খানের ইউনিয়নিস্ট পার্টি, সীমান্তের খুদাইখিদমদগার দল, সিন্ধুতে আল্লাব প্রমুখের সিন্ধি জাতীয়তাবাদী সংগঠন ।

কিন্তু এদের পরস্পরবিচ্ছিন্নতা তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি গঠনের সম্ভাবনা নষ্ট করে দেয়। তবু  আল্লাবকশ বা ফজলুল হকের এ বিষয়ে বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা উল্লেখযােগ্য হলেও ভারতবিভাগ রদে এরা সফল ভূমিকা রাখতে পারেননি। যশবন্ত সিং তার বইতে জিন্না-বিষয়ক সহৃদয় পর্যালােচনায় একটি কৌতূহলােদ্দীপক প্রশ্ন রেখেছেন : “ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের জন্ম ভারতবিভাগের কারণে । ১৯৪৭-আগস্টের পূর্বপর্যন্ত আমরা এক ছিলাম। এখন আমরা তিন স্বতন্ত্র সত্তা, কিন্তু সত্যই কি আমরা পৃথক? এমন প্রশ্ন না করে পারছি না’, (পৃ. ৪৮৩)। এ প্রশ্নের জবাব বিদগ্ধ বিজেপি নেতারই ভালাে জানার কথা। তাদের দলীয় বিচারে সহাবস্থান তাে অধীনতার নামান্তর। বিজেপি নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ীর শাসনামলে শিক্ষা, ইতিহাসচর্চা থেকে সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনে হিন্দুত্ব আরােপের চেষ্টাসহ সেকুলার সংবিধান পরিবর্তনের দাবিও উত্থাপিত হয়। উদ্দেশ্য আধুনিক ভারতকে হিন্দুভারত হিসাবে গড়ে তােলা। বঙ্গে উনিশ শতকী নবজাগরণের হিন্দুত্ববাদ বিশ শতকে পৌছেও প্রভাব রেখেছে জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লববাদী আন্দোলনে। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরাও বসে থাকে নি। দ্বিতীয় বঙ্গবিভাগের (১৯৪৭) প্রধান কারিগর তাে হিন্দুমহাসভা, সঙ্গে কংগ্রেস। আর এখন মুসলিম নিধনযজ্ঞের প্রধান পুরােহিত নরেন্দ্র মােদীকে সামনে রেখে বিজেপির চেষ্টা ভারতকে হিন্দুত্ববাদে পৌছে দেবার । এর পরও বিজেপি নেতা যশবন্ত সিং কী ভেবে লেখেন : ‘সত্যই কি আমরা ভিন্ন? ভারতবিভাগে সম্প্রদায়বাদী রাজনীতি প্রধান ভূমিকা রেখেছে সন্দেহ নেই। ক্রমাগত প্রচারে (এবং স্বতন্ত্র নির্বাচনের কারণেও) বিভেদ ও বিরূপতা হিন্দু মুসলমান জনমানসে গভীর প্রভাব রেখেছিল। সে প্রভাব কি তিন দেশের জনচেতনা থেকে অন্তর্হিত? ঘটনাবলী দেখে তা মনে হয় না। তাই এমন অনুমান কি ভুল হবে যে, বিরাজমান পরিস্থিতিতে বিভক্ত দেশগুলােতে আমরা বােধহয় আর আগের মতাে সহােদর নই। বরং মানবিক সৌহার্দ্য টিকিয়ে রাখার চেষ্টাই এখন কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয়তার নামে ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবাদিতা ও বিচ্ছিন্নতার টান সবাইকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, যেমন দেখা গেছে প্রধানত চল্লিশের দশকে। সমপ্রদায়বাদীচেতনা এখনাে ক্রমবর্ধমান। ভারতবিভাগ যে কোনাে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারেনি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছাড়াও ভাষা জাতিসত্তা ও সংস্কৃতিনির্ভর জাতীয়তাবাদী বিচ্ছিন্নতার লড়াইও তার প্রমাণ। যেমন ভারতে তেমনি পাকিস্তানে। লড়াই মােটামুটি হিসাবে সেকুলার চরিত্রের। তবে সেক্ষেত্রেও হতাশার প্রাধান্য । 

ব্যতিক্রম শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় (১৯৭১)। হডসনও তার বইতে ১৯৮৫ সনে লেখা নয়া উপসংহারে এই হতাশার কথা ব্যক্ত করেছেন। তার ভাষায় নেতাদের প্রত্যাশা মাফিক ‘বিদেশী শাসন থেকে মুক্ত হয়েও উপমহাদেশে গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধির সােনালি যুগ ধরা দেয় নি’ (পৃ. ৫৬৬)।  জবাবে বলা যায়, যে-পদ্ধতিতে ক্ষমতার হস্তান্তর ও চিরশত্রু দুই দেশের জন্মদান সেই বিরােধ-বিদ্বেষের পটভূমিতে গণতান্ত্রিক সমৃদ্ধির স্বর্ণযুগ দেখা দেবার কথা নয়। অবশ্য সাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ও দেশ-বিভাজন এ দুই ক্ষেত্রেই ভারতীয় রাজনীতিকদের তুলনায় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের দায়দায়িত্ব কোনাে অংশে কম ছিলনা। বিষয়টি মূল আলােচনায় বিশদভাবে এসেছে । রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বাস্তবে যে কতটা প্রভেদ থাকে ইউরােপীয় রাজনীতির ইতিহাসেও তার উদাহরণ। রয়েছে। কথাটা অবশ্য হডসনও উল্লেখ করেছেন। ফরাসি বিপ্লবের প্রাথমিক পর্বে কবি ওয়ার্ডসওয়র্থের স্বাপ্নিক উপলব্ধি : ‘সেই প্রভাতে বেঁচে থাকা যে কী মধুর’! কিন্তু সে মাধুর্য টকে যেতে বেশি সময় লাগে নি। বিভাগােত্তর উপমহাদেশে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমীকরণে পরিস্ফুট হতাশার কারণ একাধিক। প্রায় প্রতিটি কারণের সঙ্গে দেশবিভাগ কমবেশি জড়িত । এমন কি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও। বঙ্গদেশ ও পাঞ্জাব বিভাজন এদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ । অন্যান্য দিকেও বিভাজনসৃষ্ট নেতির প্রভাব ব্যাপক। প্রথম থেকেই পারস্পরিক বৈরিতার কারণে উভয় রাষ্ট্রে বিপুল সামরিক ব্যয় অর্থনৈতিক চাপের একটি বড় কারণ । তাছাড়া উত্তর-পশ্চিমে সীমান্ত প্রতিরক্ষা সম্পর্কে ধর্মভিত্তিক সৌহার্দ্যের ওপর ভরসা ছিল জিন্নার যা আদপেই ফলপ্রসূ হয় নি। পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। বরং পাকিস্তানি তালেবান ও ধর্মীয় যুদ্ধবাজদের সাহায্যে আফগানিস্তান জবরদখলের পর সমস্যা আরাে বেড়েছে। এমন কি বর্তমান সময়ে তা আরাে জটিল।  এসব জটিলতার কারণে গােটা পাকিস্তান এখন বােমাবারুদ ও গুম হত্যার নৈরাজ্যিক ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে। নৈরাজ্যের অন্যতম প্রধান কারণ শুধু ভারতের সঙ্গে কয়েক দফা যুদ্ধই নয়, সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন পরাশক্তির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে তাদের স্বার্থপূরণ, জম্মুকাশ্মীর নিয়ে লাগাতার যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতি, বিশেষ করে বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিক্রিয়া জনিত বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তুর (মােহাজিরের) পুনর্বাসন ব্যবস্থার মস্ত চাপ ইত্যাদি।

শেষােক্ত বিষয়টি ঘিরে সিন্ধি-বিহারি দ্বন্দ্ব ক্রমে এমন সহিংস অবস্থায় পৌছেছে যে তাতে পাকিস্তানের সংহতিতে টান পড়েছে। রাজধানী করাচি জ্বলছে, সেখানে সিন্ধিরা নিজবাসভূমিতে সংখ্যালঘু বিহারি জনগােষ্ঠী  রাজনৈতিক সংগঠন (এম. কিউ. এম) তৈরি করে স্থায়ী দ্বন্দ্বের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধির স্বপ্ন নিয়ে যে পাকিস্তান অর্জন সেখানে শান্তি অনেক দূরে করাচি রক্তাক্ত, রাওয়ালপিন্ডি বুলেটবিদ্ধ, ইসলামাবাদে প্রবল সন্ত্রাস- সরকার-প্রধান নিহত। বেলুচিস্তানে বােমাবাজি ও চরম অশান্তি । একই অবস্থা সীমান্ত প্রদেশে। একের পর এক রাষ্ট্রপ্রধান হত্যা কি গণতন্ত্রী আধুনিক রাষ্ট্রের লক্ষণ? সেই সঙ্গে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদের প্রভাব? ইতিহাস লেখক অনেকেই উল্লেখ করে থাকেন, ১৯৪৭ আগস্টে (১১ই) জিন্নার গণতন্ত্রধর্মী বক্তৃতার কথা। কী মনে করে দিয়েছিলেন তিনিই জানেন। কারণ জিন্না তার রাজনৈতিক জীবনে কখনাে গণতন্ত্রের চর্চা করেন নি। আদর্শ। হিসাবেও গণতন্ত্রকে গ্রহণ করেন নি। বলেছেন, ভারতের জন্য গণতন্ত্র এক অচল আইডিয়া। লীগ সংগঠনে তিনি ছিলেন একনায়ক। মুসলিম লীগের শীর্ষনেতা কারাে সাহস ছিল না জিন্নার অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানায়। একমাত্র ফজলুল হক প্রতিবাদ করেছিলেন। পরিণামে বহিষ্কৃত ।  নিজে ধর্মাচারী না হয়েও ধর্মকে রাজনৈতিক প্রয়ােজনে ব্যবহার যে জিন্নার কত বড় ভুল পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থা আর প্রমাণ। তার একনায়কসুলভ স্বেচ্ছাচারী মানসিকতার প্রমাণ মিলেছে ১৯৪৮ মার্চে ঢাকায় তার রাজনৈতিক বক্তৃতায়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিরুদ্ধে সমাজবাদী রাজনীতি ও ভারতের বিরুদ্ধে বিষােদারে এবং মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি সংস্কৃতির আহ্বানে। ঐ বক্তৃতায় জিন্না গণতন্ত্রকে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। ছাত্রদের বড়সড় অংশে ঐ বক্তৃতার পরে দেখা দিয়েছিল বিতৃষ্ণা।

দীর্ঘসময় বেঁচে থাকলে বাংলায় তার অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা কোন্ তলানিতে গিয়ে ঠেকতাে তা অনুমান করা চলে। ১৯৪০ মার্চে লাহােরের লীগ সম্মেলনে ধর্মীয় রাজনীতির শ্লোগান তুলে ১৭ বছরে তার বিজয়। পাকিস্তান সে। উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। লীগ নেতাদের কথায় কথায় তাদের কায়েদে আজম’-এর ‘ইসলাম বিপন্ন’ ইত্যাদি বক্তব্যের উদ্ধৃতি। পরিণামে ১৯৫৬ সনে পাকিস্তান হয়ে ওঠে গণতন্ত্রী রাষ্ট্রের বদলে ইসলামি রাষ্ট্র। রাষ্ট্রশাসনে ইসলাম বিপন্ন’ এই ধুয়া তুলে চলেছে কত যে অনাচার, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্যাতন তার ইয়ত্তা নেই। সংখ্যালঘুর ওপর নির্যাতন নিয়মিত বিষয় হয়ে উঠেছিল যে জন্য বিভাগােত্তর ১৯৪৭-এর পূর্ববঙ্গে অমুসলমানদের সংখ্যা ক্রমশ কমে বর্তমানে ১০-১২ শতাংশে এসে পৌঁছেছে। পাকিস্তান এই রাজনৈতিক উত্তরাধিকারই বহন করছে। তাই জিন্নার ১১ আগস্টের (১৯৪৭) গণতান্ত্রিক বক্তৃতা অর্থহীন ‘গিমিক’ বলে মনে হয়। মনে হয় আরাে কিছু ঘটনায়। কুলদীপ নায়ার তার আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন, ১৯৪৭-এ পাঞ্জাবে যে সব অমুসলমান মাটির টানে পাকিস্তানে নিজ বাস্তুভিটায় ফিরে যেতে চেয়েছেন তাদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে । স্বভাবতই তাদের দুর্বিসহ উদ্বাস্তু জীবন, জীবনজীবিকার জন্য লড়াই। শুধু পাঞ্জাবে নয়, পূর্ববঙ্গেও চলেছে সীমান্তের দিকে ছিন্নমূল মানুষের কাফেলা। সে ধারা এখন ক্ষীণ হলেও একেবারে শেষ হয় নি। স্বাধীনতাসংগ্রামী সীমান্তের বাদশা খান প্রতিবাদ-কারাগার-প্রতিবাদ করেই জীবন শেষ করেছেন। সমাজবাদী ওয়ালি খান দীর্ঘ সময় জেলে কাটিয়েছেন।

 একই অবস্থা সিন্ধুর জি, এম, সৈয়দ বা আবদুল মজিদ সিন্ধি প্রমুখের। সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতি পাকিস্তানে শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয় নি। সামরিক শাসন ও হত্যার রাজনীতি নিয়ে পাকিস্তান যেন এক নৈরাজ্যিক রাষ্ট্র । স্বভাবতই ‘গ্যারিসন প্রদেশ’ পাঞ্জাব হয়ে ওঠে পাকিস্তানি রাজনীতির নিয়ন্ত্রক ভূখণ্ড এ পাঞ্জাব সিকান্দার হায়াত খানের স্বপ্নের পাঞ্জাব নয় । জিন্নার হাত ধরে ধর্মীয় রাজনীতির যে ঐতিহ্য পাকিস্তান ধারণ ও লালন করেছে তার পরিণতি পাকিস্তানের জন্য শুভ্র হয় নি। জিন্না-লিয়াকত সে পরিণতি দেখে যেতে পারেন নি। ধর্ম ওসমরতন্ত্র হয়ে ওঠে পাকিস্তানের রাজনৈতিক আদর্শ, শাসনতান্ত্রিক আদর্শ, পাকিস্তান-আন্দোলনের দু একজন শীর্ষনেতা শেষ বয়সে (সম্ভবত পাকিস্তানের পরিণতি দেখে) পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মগ্লানিতে ভুগেছেন এরী অবশ্য একসময় হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রবক্তাও ছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস নেতাদের কিছু ভুল ভ্রান্তি তাদের পাকিস্তান আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেয়। কুলদীপ নায়ার তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও এদের দু একজনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লিখেছেন যে তৎকালীন যুক্তপ্রদেশের শীর্ষনেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান বার্ধক্যে ও দীর্ঘস্থায়ী রােগে আক্রান্ত অবস্থায় ভারতবিভাগের জন্য প্রচণ্ড অনুতাপ প্রকাশ করেছেন। এক ধরনের অপরাধবােধ তাকে তাড়িত করেছে এমন অনুশােচনায় যে যুক্তপ্রদেশের মুসলমানদের ভারতে ফেলে রেখে এসে তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। পাকিস্তান গঠন ছিল ভুল। একই কথা মাহমুদাবাদের নবাবেরও যিনি তারুণ্যে নেহরু পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এবং কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতি-সম্পন্ন ছিলেন। পরে জিন্নার আকর্ষণে তিনি লীগ ওয়ার্কিং কমিটির কনিষ্ঠতম সদস্য। কুলদীপ নায়ারের মতে বহসংখ্যক মুসলমান ভারত বিভাগের পক্ষে ছিলেন না (পৃ. ১৯)। কথাটা যুক্তপ্রদেশে লীগ-বিরােধী ভােট সংখ্যা উল্লেখ করে মুশিরুল হাসানও বলেছেন (ইন্ডিয়াস পার্টিশন, পৃ. ২৮-৩০)। 

প্রকৃতপক্ষে বিভাগােত্তর কালের অবাঞ্ছিত ঘটনাবলী, স্বপ্নের পাকিস্তান নিয়ে স্বপ্নভঙ্গের তিক্ততা, অর্থনৈতিক সমস্যা ইত্যাদি অনেক কিছুর পরবর্তী পােস্টমর্টেম’ থেকে অনেকের কাছে মনে হয়েছে যে তাৎক্ষণিক আবেগের তরবারিতে ভারতবর্ষ থেকে পাকিস্তান কেটে আলাদা করে আনার দ্রুত সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। বিশেষ করে ভারতে কয়েক কোটি মুসলমানকে ফেলে আসা শুধু অনৈতিকই ছিল না, ছিল রাজনৈতিক দিক থেকে অন্যায় ও ভুল সিদ্ধান্ত। শেষােক্ত বিষয়টি পাকিস্তান পােস্টমর্টেমে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, পাকিস্তান নিয়ে যদি এতই সমস্যা, এত অবাঞ্ছিত উপসর্গ, মুসলিম স্বার্থ যদি পুরােপুরি পূরণই না হয়ে থাকে তাহলে পাকিস্তান অর্জনের জন্য কেন অমন প্রবল উম্মাদনা তৈরি হয়েছিল যে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য পাকিস্তানের কোনাে বিকল্প নেই। পশ্চাদপদ ও বৃহৎসংখ্যক দরিদ্র বঙ্গীয় মুসলমানের কথা যদি বাদও দি, শিক্ষিত-সম্পন্ন-ভূস্বামী-প্রধান যুক্তপ্রদেশের মুসলমানই বা কেন অনুরূপ উম্মাদনার অংশীদার হয়েছিলেন? দু একটি তথ্য প্রশ্নের যথার্থতা প্রমাণ করবে । গুরুত্বপূর্ণ হিন্দুপ্রধান যুক্ত প্রদেশে জনপ্রশাসনের নির্বাহীপজে মুসলমান প্রায় ৪০ শতাংশ, বিচার-বিভাগে ২৫ শতাংশ, কৃষি বিষয়ক পদে ২৫ শতাংশ, পুলিশে (ডি, এস, পি) ২৮ শতাংশ, ইন্সপেক্টর পদে ৩০ শতাংশ, সাব-ইন্সপেক্টর পদে ৪৪ শতাংশ, প্রকৌশল বিভাগে (প্রথম শ্রেণী) ২০ শতাংশ, আয়কর বিভাগে ৩০.৭ শতাংশ, শিক্ষায় ২৬.৭ শতাংশ (প্রথম শ্রেণী), পরিদর্শক ৩২.২ শতাংশ, সমবায়ে গেজেটেড অফিসার্স ৩৭.৫ শতাংশ। বােম্বাই, মধ্যপ্রদেশ ও বিহারে অবস্থা খুব একটা ভিন্ন নয় (মুশিরুল হাসান পৃ. ২৩-২৪)। এ তথ্য ১৯৩৯ সনের । জনসংখ্যার অনুপাতে সন্তোষজনক অবস্থান। পরিস্থিতি কি এক বছরে (১৯৪০) এতই মন্দ হয়ে গেল যে মুসলিম স্বার্থ বিপন্ন বলে জিহাদি ডাক দেওয়ার প্রয়ােজন পড়ে ছিল? জিন্নার ক্ষোভ ছিল মূলত যুক্তপ্রদেশ নিয়ে যেখানে মুসলিম অবস্থান সচ্ছন্দ। ক্ষোভের কারণ সেখানে লীগ-কংগ্রেস যুক্তফ্রন্ট না হওয়া। তাই বিচ্ছিন্নতার আহবান (দ্বিজাতিতত্ত্ব)। কংগ্রেস এর দায় এড়াতে পারে না। অবশ্য তুলনায় বঙ্গীয় মুসলমানের অবস্থা ছিল বিপরীত যা নিয়ে জিন্না কখনাে মাখা ঘামান নি।  

পাকিস্তানপন্থী গবেষকগণ নিজ নিজ ধারায় দ্বিজাতিতত্ত্ব যুক্তিসঙ্গত প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। কেউ হিন্দু-মুসলমান ভিন্নতার, কেউবা বৈরিতার ইতিহাস টেনে পাকিস্তানকে ইতিহাসের সত্য হিসাবে ধরতে চেয়েছেন। অর্থনৈতিক দিকে গুরুত্ব আরােপ করেছেন। ফারজানা শেখ ‘ইসলামি ভ্রাতৃত্ব, ইসলামি সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব ও ইসলামি শাসনে মুসলমান’ ইত্যাদি নিয়ে নানা যুক্তির অবতারণা করেছেন যার পেছনে যুক্তির চেয়ে ধর্মীয় আবেগের প্রাধান্য (Community and Consensus in Islam : Muslim Representation in Colonial India’, 1989, P230)। এসব যুক্তি যে অসার প্রায় হাজার বছরের ইতিহাস বিভেদ ও সৌহার্দের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিয়ে তা প্রমাণ করে। দীর্ঘ ব্রিটিশ শাসনে হিন্দুমুসলিম মিলে যেসব ব্রিটিশ-বিরােধী বিদ্রোহ বা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে সেসবের লক্ষ্য ছিল একটাই- স্বাধীন ভারত, বিভক্ত ভারত নয় । মনে রাখতে হবে ইংরেজের বঙ্গ দখলের (১৭৫৭) পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে শুরু হয় ফকির ও সন্ন্যাসীবিদ্রোহ। এর পর ক্রমাগত বিদ্রোহ ও আন্দোলন। আধুনিক পর্বে এসে জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের রাজনৈতিক আদর্শ গণতন্ত্র, মুসলিম জাতীয়তাবাদ (‘মুসলিম ন্যাশনালিজম’) নয়। অর্থাৎ সম্প্রদায়বাদী রাজনীতি নয়, সেকুলার রাজনীতি তাদের উপজীব্য। ধর্ম ও ধর্মাচরণ সেখানে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের অন্তর্গত। মুসলিম লীগ ১৯০৬ সাল থেকে মুসলিম উচ্চশ্রেণীর স্বার্থ নিয়ে যে দেনদরবার করেছে তাতে রাজনৈতিক আদর্শ। বলতে কিছু ছিল না। তবে ১৯৪০-এ ঘােষিত দ্বিজাতিতত্ত্বে ছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদ তথা স্বাতন্ত্র্যবাদ, বিচ্ছিন্নতা যার লক্ষ্য। তবু মানতে হয় যে বিশ শতকের প্রথমার্ধে (মূলত ১৯০৫ থেকে ১৯৪৭ আগস্ট) মুসলিম রাজনীতি কোনাে সুনির্দিষ্ট একক রাজনৈতিক আদর্শ বহন ও লালন করেনি। সেখানে পরস্পর-বিরােধী চরিত্র ছিল প্রকট।

জাতীয় কংগ্রেস ও বিপ্লববাদী রাজনীতির ছিল ভিন্ন ভিন্ন সুনির্দিষ্ট আদর্শ তাদের মধ্যে মত-পথের ব্যবধান ছিল গভীর । সেখানেও ছিল স্ববিরােধিতার মিশ্রণ । কংগ্রেসের শক্তি ও দুর্বলতা দুইই ছিল এর সাংগঠনিক চারিত্র বৈশিষ্ট্যে। অর্থাৎ গণসংগঠন হয়ে ওঠার পর কংগ্রেস আসলে একটি পার্টি নয়, বাস্তবে হয়ে ওঠে একটি রাজনৈতিক মঞ্চ। কংগ্রেস তার ঘােষণায় সেকুলার ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতীক হলেও সেখানে হিন্দুত্ববাদী ও হিন্দুমহাসভাপন্থীদের উপস্থিতিতে ছিল অদ্ভুত এক স্ববিরােধিতা। তার চেয়ে বড় স্ববিরােধিতা কংগ্রেস সােসালিস্টদের অবস্থান, কিংবা বিপ্লবী সমাজবাদীদের উপস্থিতি। ডান, বাম, মধ্যবাম ও জাতীয়তাবাদের মিশ্রণের মধ্যে সংযােজন খিলাফতপন্থী মুসলিম রাজনীতি- হাকিম আজমল খান বা মাওলানা মােহাম্মদ আলী, শওকত আলী। মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে অবশ্য ব্যতিক্রমী হিসাবে ধরা উচিত। কারণ আজাদ মাওলানা হয়েও একজন সেকুলার, স্বাধীনতাসংগ্রামী রাজনীতিক। একদা বিপ্লবী দলেও নাম লিখিয়েছিলেন। অন্যদিকে গান্ধি সেকুলার হয়েও প্রগাঢ় হিন্দুত্ববাদী, গােরক্ষা যার ধর্মের অংশ। আবার খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গেঐক্য গড়তে তার বাধে না। কংগ্রেসের এই বিচিত্রসভায় রাজনৈতিক বিচারে নানামতের সমাহার। কথিত আদর্শ হিসাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মুসলিম জাতীয়তাবাদ, বিভিন্ন ধারার বাম মতাদর্শ, শুদ্ধ সেকুলার চেতনার গ্রুপ, এর মধ্যেও চরমপন্থী ও নরমপন্থী মিলে কংগ্রেস ভারতীয় রাজনীতির এক অদ্ভুত আয়ুর্বেদী পাচন। এমন একটি রাজনৈতিক মঞ্চের পক্ষে অর্জুনের মতাে এক লক্ষ্যের আদর্শ নিয়ে এগিয়ে চলা সম্ভব নয়। কংগ্রেসের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা বা ব্যর্থতার এটা অন্যতম প্রধান কারণ। তাছাড়া ছিল ভূস্বামী স্বার্থ, কমপ্রেডর পুঁজিপতি স্বার্থ, শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীর স্বার্থ, ঘােষিত স্বদেশী ও জনস্বার্থ- যেগুলাে পরস্পরবিরােধী। নেতৃত্ববৈশিষ্ট্য বিচারেও ভারতীয় রাজনীতিতে স্ববিরােধিতা ব্যাপক। অথচ এরা কমবেশী মেধাবী রাজনীতিবিদ। রাজনৈতিক আদর্শ বিচারে গান্ধি জিন্না গুজরাতি হয়েও সর্বমাত্রায় বিপরীত মেরুর, অথচ ভিন্ন মাত্রায় গান্ধি মােহানি বিপরীত চিন্তার । সেকুলার নেহরুর সঙ্গে সেকুলার আজাদের মিলের চেয়ে অমিল বেশি। রােমান্টিক সমাজবাদী জওহরলাল আর রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী প্যাটেল এক পর্ভূক্তিতে বসার মতাে নন অথচ কাজ করতে হচ্ছে এক সঙ্গে। চিত্তরঞ্জন ও গান্ধি যদি কখনাে এক নৌকোর যাত্রী হতে পারেন সুভাষ-গান্ধি কখনােই নন। ফজলুল হক ও জিন্না ঘটনার টানে এক যাত্রায় শরিক হলেও দুজনে ভিন্ন নৌকোর যাত্রী। আবার মাওলানা মােহাম্মদ আলী ও জিন্নার মতাে দুই প্রতিভা প্রচণ্ড রকম বিপরীত মতাদর্শের। এমন অনেক বৈপরীত্যে বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ভারতীয় রাজনীতি ঘুরপাক খেয়েছে। 

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক