জিন্নার পাকিস্তান পাকিস্তানের জিন্না
দ্বিজাতিতত্ত্ব ও বিচ্ছিন্নতার দাবিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লড়াই ও ভারতবিভাগ নিয়ে সংঘটিত মানবিক ট্রাজেডি সত্ত্বেও তৎকালে এ সম্বন্ধে যত কিছু আলােচনাসমালােচনা তার বহুগুণ তাত্ত্বিক বিচার-ব্যাখ্যা চলেছে পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার হস্তান্তর ও তার প্রাসঙ্গিক ঘটনাবলী নিয়ে। এখনাে তা চলছে রাজনৈতিকরাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্বের নানা দিক বিবেচনায় প্রকৃতপক্ষে দেশবিভাগ (১৯৪৭) এমনই এক রাজনৈতিক তাৎপর্যময় ট্রাজিক ঘটনা যে এর দায়ভাগ থেকে উপমহাদেশবাসী কারাে মুক্তি নেই। দেশভাগের জন্য দায়ী রাজনীতির কুশীলব সবাই প্রয়াত এবং তারা এখন জবাবদিহির উর্ধ্বে বলেই বােধ হয় বিষয়টি নিয়ে নানামাত্রিক ব্যবচ্ছেদ রাজনৈতিক অঙ্গন ছেড়ে বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে আশ্রয় নিয়েছে। জন্ম দিচ্ছে নানান ভাবনা বিচারের মাধ্যমে বিতর্ক এ অঙ্গনে বিদগ্ধ পণ্ডিতদের বিচরণ কম নয়। যেমন পাকিস্তানে তেমনি ভারতে, ততােধিক পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে। এ বিষয় নিয়ে বিচার ভাবনায় যেমন রয়েছে ঐতিহ্যবাহী ধারা তেমনি ভিন্নমতের রিভিশনিস্ট ধারা-এর মধ্যে যােগ দিচ্ছে অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ গ্রুপের বৈদগ্ধ্য অন্যদিকে এদের বাইরে একেবারে নিজস্ব ভাবনায় প্রণােদিত লেখক বা গবেষক, রাজনীতিক বা ইতিহাসবিদ তাদের লেখায় নিজ নিজ মত প্রকাশ করে চলেছেন। তাতে বিতর্কের পরিধি আরাে বিস্তৃত হচ্ছে। হচ্ছে বিশেষ করে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সম্ভাব্য পরিণাম এবং ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের জটিলতার কারণে এ যেন এক অন্তহীন বিতর্কের ডিসকোর্স। দেশবিভাগ ঘটনার সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ভারতীয় আমলা ডি. পি. মেনন তার বইতে (১৯৫৭) প্রত্যক্ষদর্শীর ঐতিহাসিক বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন, কচিৎ মন্তব্য ও মূল্যায়নে (‘দ্য ট্রান্সফার অব পাওয়ার ইন ইন্ডিয়া’, ১৯৫৭)। একই রকম দীর্ঘ বিবরণ, ইতিহাসকথা নিকোলাস মানসার-এর ট্রান্সফার অব পাওয়ার’ শীর্ষক গ্রন্থ যা বহুখণ্ডে বিভক্ত।
এ ধরনের তথ্যমূলক ইতিহাসের বাইরে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ধর্মী রচনাই সর্বাধিক, সেই সঙ্গে রাজপুরুষদের নােট, প্রতিবেদন, ডায়েরি, চিঠিপত্র, গােপনবার্তা ইত্যাদি মিলে পার্টিশন বা বিভাজন সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার পড়ে শেষ করা কঠিন। এখন লেখকদের নজর মূলত ঘটনা ও কুশীলবদের তৎপরতা বিশ্লেষণের দিকে। তাতে কখনাে বিতর্কের হাওয়া ওঠে, আবার তা মিলিয়ে যায়। কোনাে কোনাে বক্তব্য বা সিদ্ধান্তের রেশ থেকে যায় তর্ক-বিতর্কের জন্ম দিতে। এসব আলােচনায় জিন্না বিষয়ক বিচার ব্যাখ্যা বা মূল্যায়ন অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে। যেমন আয়েশা জালালের জিন্না বিষয়ক গ্রন্থ ‘দ্য সােল স্পােকসম্যান’ (১৯৮৫) অভিসন্দর্ভে ধৃত কিছু সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে কারাে কারাে মতামত প্রকাশ পেয়েছে। জিন্না পাকিস্তান চান নি’-জালালের এমন সিদ্ধান্ত মুশিরুল হাসানসহ কেউ কেউ মানতে নারাজ। এ মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপি নেতা যশবন্ত সিং তার ঢাউস বই ‘জিন্না/ইন্ডিয়া-পার্টিশন ইন্ডিপেন্ডেন্স’-এ ভারত বিভাজনের সিংহভাগ দায় তৎকালীন কংগ্রেস-নেতৃত্বের ওপর চাপিয়েছেন, ছুঁয়ে গেছেন আয়েশার সিদ্ধান্ত। হুসেইন হাক্কানি আয়েশা জালালের সিদ্ধান্তকে জিন্নার পক্ষ নিয়ে কিছুটা বিস্তৃত করেছেন এই য (পাকিস্তান বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি’, ২০০৫)। সম্পূর্ণ ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দুইখণ্ডে লেখা সুনীতিকুমার ঘােষের “ইন্ডিয়া/অ্যান্ড/দ্য রাজ’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে (১৯৯৫) ভারতবিভাগ নিয়ে আংশিক আলােচনা, তাতেও বিভাজনের অনেকখানি দায় কংগ্রেসের ওপর আরােপিত। ব্রিটিশ ভারতে কর্মরত সাবেক রিফর্মস কমিশনার এইচ. ভি. হডসন ‘দ্য গ্রেট ডিভাইড’ (১৯৬৯) গ্রন্থে (যা মূলত তথ্যমূলক) ভারতবিভাগের দায় লীগকংগ্রেস উভয় দলের শীর্ষ নেতাদের বলে মনে করেছেন। তবে জিন্নার দায় সেক্ষেত্রে যেন বেশি। স্ট্যানলি উলপার্ট (‘জিন্না অব পাকিস্তান’, ১৯৮৪)-এর লেখা মূলত এ ধারারই। অন্যদিকে আর. জে. মুর তার ‘জিন্না অ্যান্ড দ্য পাকিস্তান ডিমান্ড’ প্রবন্ধে দীর্ঘ আলােচনা শেষে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে এসেছেন যে ‘এমন অনুমানের পেছনে যুক্তিতর্কের কোনাে সমর্থন নেই যে জিন্নার পাকিস্তান। দাবি অখণ্ড ভারতে ক্ষমতার জন্য দেনদরবারের প্রচেষ্টা বা সে দাবি নিয়ে তিনি। নিজ ফাদে আটকা পড়েছেন’ (১৯৯৫)। অর্থাৎ পাকিস্তান দাবি নিয়েই জিন্নার রাজনীতি ।
প্রকৃতপক্ষে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে (লক্ষ্মৌ প্যাক্ট) বা বিশের দশক কিংবা তিরিশের দশকের জিন্নার সঙ্গে মুসলিম লীগের লাহাের অধিবেশনের জিন্নার অনেক পার্থক্য। জিন্না ততদিনে বুঝে নিয়েছেন যে কংগ্রেসের সঙ্গে বসে অখণ্ড ভারত মেনে তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবেনা। ভারত ভাগ করে মুসলমানদের জন্য (এমন কি তার নিজের অহবােধ পূরণের জন্যও) স্বতন্ত্র ভুবনের কোনাে বিকল্প নেই । আইনজ্ঞ জিন্নাকে তাই ভেবেচিন্তে বেছে নিতে হয়েছে ধর্ম নামক প্রবল শক্তিমান এক হাতিয়ার যা তার রাজনৈতিক সংগঠনে শক্তি সঞ্চার করবে। সম্প্রদায়বাদী স্বার্থ প্রচারের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ মুসলমানদের দিয়ে হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেসের মােকাবিলা করা সহজ হবে। তাই লীগের জন্য রাজনৈতিক রণকৌশল এ ধারায়ই ঠিক করে নেন জিন্না। মুসলিম লীগের লাহাের অধিবেশনে (১৯৪০) প্রদত্ত জিন্নার দীর্ঘ ভাষণের অনুপুঙ্খ বিচার বুঝতে সাহায্য করে যে ধর্ম অর্থাৎ ইসলাম, তার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি তিনি তার রাজনৈতিক লক্ষ্য পাকিস্তান অর্জনের বিষয় করে তুলেছিলেন। রাজনৈতিক প্রয়ােজনের কাছে তিনি ব্যক্তিজিন্নাকে বিকিয়ে দিয়েছেন। আচরণে ও বক্তব্যে হয়ে উঠেছেন স্ববিরােধী। ১৯৪০ থেকে তার প্রতিটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ, বিবৃতি, ভাষণ ও সংলাপের সারমর্ম এমনটাই প্রমাণ করে। ব্যক্তিজীবনে ধর্মাচারী ও ধর্মনিষ্ঠ না হলেও রাজনীতিচর্চায় দুটো বিষয় তার বিশ্বাসের অংশ হয়ে দাঁড়ায় যেমন হিন্দুমুসলমান দুই স্বতন্ত্র জাতি (দ্বিজাতিতত্ত্ব)-অখণ্ড ভারতে তাদের সহাবস্থান সম্ভব নয়। এখানে তিনি ইতিহাসের সত্য অস্বীকার করেছেন। তার বক্তৃতায় তিনি বারবার ইসলামি ঐতিহ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। বহুউদ্ধৃত ১৯৪৭-আগস্টে তার সেকুলার বক্তৃতা সম্ভবত আইনবিদ জিন্নার কৌশলী বয়ান। কারণ তার বিভাগােত্তর আচরণ ও বক্তৃতা, বিশেষ করে ১৯৪৮ মার্চের ঢাকা বক্তৃতা পুরােপুরি গণতান্ত্রিক চেতনা ও সেকুলার চেতনা বিরােধী। তাতে বাঙালি বিদ্বেষ, ভারতবিদ্বেষ ও ধর্মীয় বয়ানও প্রকট ।
প্রকট প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিরােধিতা যে প্রাদেশিক ক্ষমতার জন্য তিনি বিভাগপূর্ব কালে সােচ্চার এবং শক্তিশালী কেন্দ্রের বিরােধী। অথচ পাকিস্তানে সেই শক্তিশালী কেন্দ্রেরই তিনি প্রবক্তা। শেষােক্ত বিষয়গুলাের উল্লেখ সংশ্লিষ্ট লেখকদের রচনায় দেখা যায় না। | আয়েশা জালালের এমন ধারণা ঠিক নয় যে জিন্না মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান সম্পর্কে আলােচনায় ও লেনদেনে প্রস্তুত ছিলেন। আমাদের আলােচনায় ইতঃপূর্বে জিন্নার অনেক বক্তৃতার উল্লেখ রয়েছে যেখানে তিনি পাকিস্তানই সাম্প্রদায়িক সমস্যার একমাত্র সমাধান এবং এর কোনাে বিকল্প নেই বলে বারবার জোরালাে দাবি জানিয়েছেন। তার অনুসারী শীর্ষ নেতাদেরও একই কথা বলতে শােনা গেছে। আসলে কংগ্রেসের বিরােধিতার মুখে পাকিস্তান তার জন্য এক ধরনের ‘অবসেসন’ হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় বিষয় : হিন্দু মুসলমান স্বতন্ত্র জাতি বিধায় মুসলমানদের স্বতন্ত্র জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তার যেকোনাে আলােচনায় নিশ্চিত পূর্বশর্ত হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে ভারতবিভাগ ও পাকিস্তান দাবি অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। অখণ্ড ভারতে স্বশাসিত মুসলমান রাষ্ট্র বা কনফেডারেশন তার কাছে গ্রহণযােগ্য মনে হয়নি। তাই গ্রুপিংসহ মন্ত্রীমিশন প্রস্তাব নেহরুর আলটপকা মন্তব্য উপলক্ষে অজুহাত তৈরি করে ঐ প্রস্তাব বাতিল করে দেন। অথচ মন্ত্ৰীমিশন প্রস্তাব মর্মবস্তু বিচারে অখণ্ড ভারতে একরকম পাকিস্তানই উপহার দিয়েছিল জিন্নাকে। যেকারণে কংগ্রেস অনিচ্ছার সঙ্গে ওই প্রস্তাব গ্রহণ করে। সামান্য কারণে ওই প্রস্তাব বর্জন জিন্নার পক্ষে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত বলে মনে হয় না। প্রকৃতপক্ষে ভারতবিভাগ নিশ্চিত করা ও গান্ধি-নেহরুর স্বপ্ন ভঙ্গ জিন্নার প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ভারত কে খণ্ডিত করতে গিয়ে তাকেও অবশ্যখণ্ডিত পাকিস্তান নিয়ে ভারত ছাড়তে হয়। জিন্না যেমন তুখােড় আইনজ্ঞ তৈমনি চৌকশ রাজনীতিক। তা সত্ত্বেও তিনি ভেবে দেখেন নি যে তার পরিকল্পিত পাকিস্তানে ভারতীয় মুসলমানের সবাইকে তিনি বসবাসের সুযােগ দিতে পারবেন না। ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের যে ভিত্তিতে তার পাকিস্তান দাবি ও ভারতভাগ তাতে তিনকোটিরও বেশি সংখ্যক মুসলমান ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের শহরে গ্রামে গঞ্জে ছড়ানাে ছিটানাে থেকে যাবে ।
অথচ তাদেরও তিনি পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তারা ধর্মীয় উন্মাদনায় পাকিস্তানের দাবিতে প্রতিবাদী মিছিলে শামিল হয়েছে। তাদের একাংশ সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় অংশ নিতেও দ্বিধা করেনি। আবার পালটা সহিংসতার শিকারও হয়েছে। জিন্না জানতেন এই হতভাগ্যদের কংগ্রেস শাসনে ভারতে ফেলে যেতে হবে তা সত্ত্বেও তার রাজনৈতিক প্রয়ােজনে এদের কাছে বাস্তবতা গােপন করে তাদের সমর্থন আদায় করতে তার বাধে নি। ১৯৪০-এ রামগড় কংগ্রেস অধিবেশনে এবং বিভিন্ন সময়ে মওলানা আজাদ ভারতীয় মুসলমানদের সামনে পাকিস্তানের এই সীমাবদ্ধতার কথা স্পষ্ট ভাষায় ব্যাখ্যা করেন। অনুরােধ জানান। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে । অর্থাৎ জিন্নার ঠিক বিপরীত ধারার বক্তব্য। আজাদের উদাত্ত আহ্বান, এগারাে শ বছরের সহাবস্থানের প্রতি সম্মান জানিয়ে সেকুলার জাতীয়তার শিকড় বাকড়গুলাে কেটে না ফেলতে। বরং সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষার ব্রত নিয়ে স্বাধীনতার লড়াইয়ে শামিল হতে। কুলদীপ নায়ার তার আত্মজীবনীতে ১৯৪৫ সালে লাহােরে মওলানা আজাদের ব্যক্তিত্ব ও বক্তব্যের প্রশংসা করে লিখেছেন যে সাম্প্রদায়িকতার প্রবল ঢেউ যখন নেতাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল আজাদ তখনাে সেকুলার অবস্থানে দৃঢ় পায়ে দাঁড়ানাে (পৃ. ৬৩)। কিন্তু ওরা তার কথা শােনেনি। পাকিস্তানের স্বপ্নে মুগ্ধ ভারতীয় মুসলমান ঐ স্বতন্ত্র ভুবনে তাদের সমৃদ্ধ আশ্রয়ের ঠিকানা খুঁজেছে। ঐতিহ্যবাহী সহাবস্থানের জাতীয়তা যে যৌথ সম্পদ এ সত্য তারা বুঝতে চায় নি । আর এ ধারার শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষ ভাবতে চাননি দীর্ঘকালে অখণ্ড ভারতে সৃষ্ট শিল্প-সাহিত্য স্থাপত্য ভাস্কর্য কীভাবে বিভাজিত হবে? গালিব ও মীর তকী, মুন্সী প্রেমচন্দ বা মূলকরাজ আনন্দ, খাজা আহমদ আব্বাস বাকুষান চন্দর, সাদাত হাসান মান্টো বা ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে কি বিভক্ত করা যাবে ভারত-পাকিস্তানের দাবিতে? কিংবা বঙ্গের রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুভবুদ্ধির কথা বােঝেনা, বুঝতে চায় না। বুঝতে চাননি জিন্না বা নেহরু প্যাটেল। তাদের ভুল ভ্রান্তির ফলে সৃষ্ট বিপরীত স্রোত পুরুষানুক্রমে লালিত মৃত্তিকাগভীরের শিকড়গুলােকে বেশ কষ্ট করেই উপড়ে নিয়েছিল বিভাজনের টানে।
জিন্না-অনুসারীদের অনেকে যেমন খালিকুজ্জামান, ইসমাইল খান, ছাতারের নবাব, মাহমুদাবাদের রাজা, বােম্বের চুন্দ্রীগড় প্রমুখ তাদের ঐতিহ্য লালিত শিকড় উপড়ে পাকিস্তানে হিজরত করতে অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্ব ও যন্ত্রণার সম্মুখীন হয়েছেন (মুশিরুল হাসান)। অবশ্য জিন্নার কথা আলাদা। স্বচ্ছচিন্তায়, নিরপেক্ষ বিচার ব্যাখ্যায় প্রশ্ন উঠে আসে পাকিস্তানের পক্ষে প্রকৃত জনসমর্থন কেমন ছিল। হিন্দুপ্রধান প্রদেশগুলাের বিভ্রান্ত মুসলমানদের পাকিস্তান সমর্থনের পেছনে মানসিক কারণ বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাপীড়িত অঞ্চল ও সন্নিহিত ভূমিতে। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে ভূস্বামী ও শিক্ষিত এলিটরাই ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে বড় খুঁটি। তাদের সঙ্গে মুৎসুদ্দি ও উঠতি পুঁজিপতিশ্রেণী-ইস্পাহানি, দাউদ, আদমজী, হারুন প্রমুখ। এদের অর্থনৈতিক-সামাজিক প্রভাব জনসাধারণ্যে ছিল বিপুল। তাদের সঙ্গে ছিল পেশাজীবী-আমলা-টেকননাক্র্যাট। এদের দ্বারা প্রভাবিত সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মােহাম্মদ আলী জিন্নার ব্যক্তিগত প্রভাবে । তাসত্ত্বেও তথ্যাদি বিশ্লেষণে দেখা যায় জিন্নার পাকিস্তান নিয়ে দ্বিধা সংশয় ছিল অনেকের। ছিল বিরােধিতাও । প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে পাকিস্তান অর্জনে জিন্নার জয় কীভাবে? জবাব খুব সােজা। জিন্নার রাজনৈতিক কলাকৌশল, ব্রিটিশরাজের সহযােগিতা, ধর্মীয় প্রচার (মৌলবি-মাওলানাদের সমর্থন) এবং মুসলিম লীগের সন্ত্রাসী ক্যাডারবাহিনীর দাপটে ভােটবাক্সের জয়, সর্বোপরি কংগ্রেস ও সরকার পক্ষে গৃহযুদ্ধের ভয়। এ জাতীয় সবকিছুর প্রভাবে ব্রিটিশরাজ নিশ্চিত হয় যে ভারত বিভাগের বিকল্প কিছু সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশরাজ এ পথেই হেঁটেছে। ভারতভাগ ও পাকিস্তান মঞ্জুর করেছে। কিন্তু প্রদেশভাগসহ অনেক কাটাকুটি করে, উভয় পক্ষকেই একদিকে সন্তুষ্ট, অন্যদিকে অসস্তুষ্ট করে। উদ্দেশ্য বিভাজিত দুই রাষ্ট্র (ডােমিনিয়ন) যাতে চিরদিনের জন্য পরস্পরের শত্রু হয়ে থাকে। আর সে ব্যবস্থার কারণে হিন্দুমুসলমান-শিখ হিংস্র সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় পেশােয়ার থেকে বঙ্গদেশের মাটি নিজদের রক্তে রঞ্জিত করেছে। এই ছিল ব্রিটিশের উপহার বহু-আকাক্ষার ধন পাকিস্তান প্রাপ্তির পরিণাম। এ বৈরিতার অবসান ঘটেনি।
একুশ শতকে পৌছেও ১৯৪৭-এর ‘আদিপাপ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা থেকে তারা বিরত থাকতে পারছে না। বাংলাদেশও এ পাপ থেকে মুক্ত নয়। পাকিস্তান থেকে যে বাংলাদেশের জন্ম সেকুলার ভাবনা নিয়ে তার পরিণতিও ভিন্ন নয় । জিন্নার পাকিস্তানি ভূত এখনাে আমাদের তাড়া করছে। জামায়াত তাে আছেই । সম্প্রতি কওমি মাদ্রাসার হেফাজতি ইসলামের উত্থান তার প্রমাণ। সেই সঙ্গে একাধিক ইসলামি ধর্মীয় জঙ্গিবাদী সংগঠন দেখা দিচ্ছে। কে বলবেন, বাংলাদেশী সমাজের সর্বাংশ সেকুলার? জিন্নার এই পাকিস্তানের পক্ষে ভারতের সব মুসলমান নাম লিখিয়েছিলেন? যেজন্য জিন্নার তখন অনমনীয় দাবি যে তিনি সমগ্র ভারতীয় মুসলমান জনতার একমাত্র মুখপাত্র’ (সােল স্পেক্সম্যান’)। হ্যা ১৯৪৬-এ পৌছে তিনি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের মুখপাত্র, তবে সবার নন। তখনাে সেকুলার ভারতের পক্ষে জাতীয়তাবাদী মুসলমান-ব্যক্তিবিশেষ ও সংগঠন উল্লেখযােগ্য সংখ্যক। মুসলমান কংগ্রেস নেতা ছাড়াও জমিয়েতে উলেমায়ে হিন্দু, আহরার, মােমিন ও শিয়া সম্প্রদায় এবং সীমান্তের খুদাইখিদমতগার ও সিন্ধুর জিয়ে সিন্দপন্থীরা সংখ্যায় কম নয়। তেমনি পাঞ্জাবের খাকসারগণ। মুশিরুল হাসান লিখেছেন ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সন পর্যন্ত মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের সর্বভারতীয় সম্মেলনগুলাে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরা সবাই জিন্নার ভারতবিভাগ ও পাকিস্তান প্রকল্পের বিরােধী, তবে ভারতীয় মুসলমানদের সঙ্গত দাবি-দাওয়া বিসর্জনের পক্ষপাতী নন। এরা ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতারও সমর্থক। এদের রাজনৈতিক বিশ্বাস আক্রান্ত হয়েছে মুসলিম লীগ সন্ত্রাসীদের হাতে যা আমরা দেখেছি বাংলাতেও।
আবার ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে লাঞ্ছিত বা আক্রান্ত হয়েছেন। মুশিরুল হাসান উত্তরাঞ্চলের এমন কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরেছেন। যেমন মওলানা আবুল কালাম আজাদ, সাংবাদিক আবদুর রাজ্জাক মালিহাবাদী (সম্পাদক, ‘হিন্দ’) ওই আক্রমণের শিকার। মওলানা মােহাম্মদ কুদ্স ও মােহাম্মদ ইসমাইল কোনােরকমে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন জমিয়ত সভাপতি হােসাইন আহমদ মাদানিকে উত্তরবঙ্গের সৈয়দপুরে লীগপন্থী ক্ষিপ্ত লােকদের হাত থেকে উদ্ধার করে পুলিশ (ইন্ডিয়া’স পার্টিশন সংকলন, অক্সফোর্ড প্রকাশনা)। কিন্তু তাই বলে মুসলিম জনতার উপর জিন্না ও মুসলিম লীগের ব্যাপক প্রভাব ছিল না এমন ভাবনাও যুক্তিহীন প্রকৃতপক্ষে লাহাের প্রস্তাব এবং তার আগে ও পরে, বিশেষ করে চল্লিশের দশকের প্রায় সাত বছরে লীগ রাজনীতির ধর্মভিত্তিক প্রচারণা ও হিন্দুভারতে বসবাসের ভয়ভীতির ব্যাপক প্রচার সিংহভাগ মুসলিম মানসে গভীর প্রভাব তৈরি করে। এমন অপপ্রচারও চলেছে যে ব্রিটিশ শাসনের অনুপস্থিতিতে স্বাধীন ভারতে মুসলমান জনতার ধর্মকর্ম পালন ব্যাহত হবে। ধর্মীয় চেতনা, ধর্মপালন বিঘ্নিত হবার ভয়, নিরাপত্তার অভাববােধ, স্বতন্ত্র ভুবনে প্রতিযােগিতাহীন অবস্থান ইত্যাদি কারণে জিন্নার প্রতি আস্থা ও তার পাকিস্তানের প্রতি মুসলিম মানসে মুগ্ধতা তৈরি হয়। যুক্তি সেখানে হার মানে। বিভাগােত্তর পরিস্থিতি প্রমাণ করেছে মূল কারণ অনেক ক’টাই যুক্তিহীন। | জিন্নার ধর্মীয় চেতনাভিত্তিক পাকিস্তান মুসলমান সংখ্যাগুরু অঞ্চলের জন্য ইতিবাচক হলেও (যেমন বঙ্গ, পাঞ্জাব ইত্যাদি) ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য সর্বনাশের পরিস্থিতিই সৃষ্টি করে। ধর্মীয় প্রচারের প্রভাবে এ সত্য হিন্দু সংখ্যাগুরু প্রদেশের মুসলমান জনতা বুঝতে পারেনি। জানা ছিল না যে তাদের অবস্থা শিখণ্ডির মতাে হবে, পায়ের নিচে মাটির নির্ভরতার অভাব ঘটবে। বিভাগােত্তর কালে তেমনটিই ঘটেছে।
সেজন্যই জিন্নার পাকিস্তান তৎকালীন ভারতীয় মুসলিম স্বার্থের একাধিক ‘এজেন্ডার সমাধান করতে পারেনি। বরং পাকিস্তান কারাের জন্য অত্যধিক সুবিধা, আবার অনেকের জন্য অসুবিধা বা সংকট তৈরি করেছিল। তেমন সমস্যা পূর্ববঙ্গীয় বাঙালি মুসলমান স্বার্থ নিয়ে যে জন্য প্রত্যাশিত পাকিস্তান। অর্জনের পরও তাদের পাকিস্তানি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। এ বিচ্ছিন্নতার বীজ জিন্নার পাকিস্তান। পরিকল্পনার মধ্যেই নিহিত ছিল। শিক্ষা-আর্থ-সামাজিক দিক থেকে অনেক পশ্চাদপদ বাঙালি মুসলমান তা বুঝতে পারেনি। বিশেষ করে কৃষক ও কারিগর-প্রধান নিম্নবর্গীয় মানুষ । লীগের নির্বাচনী ইশতেহার, আশ্বাস ও প্রচার তাদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। জিন্নার পাকিস্তান যে উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় আমলা, ভূস্বামী ও এলিট শ্রেণী ও অনুরূপ পাঞ্জাবি স্বার্থ-ভিত্তিক এবং তা বাঙালি-স্বার্থবিরােধী ঐ সত্য শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভাবনায় ধরা দেয়নি। তাই জিন্না তাদের কাছেও ছিলেন পরিত্রাতা কায়েদে আজম’। | শিক্ষিত ও রাজনীতিক শ্রেণীর বাঙালি তা না বুঝলেও সিন্ধুর জাতীয়তাবাদীদের (আল্লাবকশ সমরু থেকে জি. এম. সৈয়দ প্রমুখের) চেতনায় তা স্পষ্ট হয়েই ধরা দিয়েছিল। তবে ধারণা ছিল না বিহার ও সন্নিহিত অঞ্চল থেকে মােহাজিরগণ এসে সিন্ধু, বিশেষ করে করাচি শহর দখল করে নেবে। নিজ রাজধানীতে তারা সংখ্যালঘু, জীবনযাত্রার নানা খাতে প্রতিযােগিতার সম্মুখীন হবে। থেকে থেকে জাতিগত সহিংসতায় পাকিস্তানের অবাঞ্ছিত চরিত্র তাদের সামনে উঠে এসেছে। সীমান্তপ্রদেশের পাঠান তথা পাখতুনগণ বরাবরই সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী। সেই সঙ্গে লীগ বিরােধী। এমনকি ১৯৩৭-এর নির্বাচনে গাফফার খানের খুদাই। খিদমদগারদের একচেটিয়া বিজয় এবং ১৯৪৬-এ পাকিস্তান দাবির জোয়ারের সময়ও বিজয় একই সত্য প্রমাণ করেছে । জবরদস্তির গণভােট (১৯৪৭) সত্ত্বেও তাদের লড়াই অব্যাহত থেকেছে। থেকেছে পাকিস্তান আমলেও। মাউন্ট ব্যাটেন কিছুটা নমনীয় হলে ১৯৪৭-এই সীমান্তপ্রদেশে স্বাধীন পাখতুন রাষ্ট্র জন্ম নিতাে। | আর বেলুচিস্তানের স্বাধীনচেতা ভিন্ন এখুনিক জাতিগােষ্ঠীর মানুষও পাঠানদের মতাে জিন্নার পাকিস্তান প্রকল্পের বিরােধী।
ব্রিটিশ রাজত্বকালে তারা স্বতন্ত্র রাষ্ট্রসত্তার দাবি জানিয়েছে। মন্ত্রীমিশনের কাছে কালাত-এর স্বাতন্ত্র ও স্বাধীনতার স্মারকলিপি পেশ করা হয়। তাদের স্বাধীনতার আন্দোলন দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে । ১৯৪৭-এর ক্রান্তিক্ষণে চলেছে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক, দেনদরবার । অবাক হওয়ার মতাে ঘটনা যে ১৯৪৭ সালের ১২ আগস্ট কালাত সরকার স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়ে তাদের নিজস্ব পতাকা উত্তোলন করে (কুলদীপ নায়ার)। পাকিস্তানের সঙ্গে একাত্ন হবার যে আহ্বান জানান জিন্না তারা তা অগ্রাহ্য করে। পরে অবশ্য একধরনের সমঝােতা হয়। কিন্তু বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতার সংগ্রাম প্রবল পাকিস্তানি আক্রমণের মুখেও অব্যাহত থেকেছে । এই তাে বছর কয় আগে বেলুচিস্তানের নেতা নওয়াব আকবর খান বুগতি চোরাগােপ্তা পাকআক্রমণে নিহত হন। তবু তাদের সংগ্রাম চলছে। কুলদীপ নায়ার লিখেছেন, একজন শীর্ষস্থানীয় বালুচ নেতা তাকে বলেন, ভারতের সঙ্গে সীমান্ত যােগাযােগ থাকলে তারা অনেক আগেই পাকিস্তান থেকে মুক্ত হতে পারতেন (পৃ. ৫৪)। পরিস্থিতি বিচারে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ভূখণ্ড বিভাজন পাকিস্তানের রাজনৈতিক নিয়তি যা পাকিস্তান জন্মলগ্ন থেকে জিন্নার হাত থেকে গ্রহণ ও বহন করে চলেছে। বিভাগােত্তর কালে পাকিস্তান তার নিজস্ব একক জাতিসত্তা গড়ে তুলতে পারে নি মূলত পাঠান বালুচ ও অংশত সিন্ধিদের স্বাতন্ত্রবােধের কারণে । আর বাঙালিদের পাক শাসকগণ তাে বিজাতীয় জ্ঞান করেছে। ইংরেজি “পি’ (P) অক্ষরের প্রতীকে পাঞ্জাব একাই হয়ে উঠেছে প্রকৃত পাকিস্তান। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিচারে এটাই পাকিস্তানের জন্য অপ্রিয় সত্য।
ভারতবিভাগ বিষয়ক বিশাল তথ্যভাণ্ডার এবং লেখকদের বিচার-বিশ্লেষণ থেকেও পাকিস্তানকে একটি স্বাভাবিক রাষ্ট্র হিসাবে বিবেচনা করা কঠিন। ভারত বিভাগের জটিল রাজনীতির অসমন্বিত দ্বন্দ্বের পরিণাম ‘পাকিস্তান’। বিভাজন সম্ভবত এই রাষ্ট্রের অনিবার্য নিয়তি। তাই দুই যুগের মধ্যে পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিশ্চিত করে। এখনাে সে বিভাজন-প্রবণতা শেষ হয় নি। একাধিক সমস্যা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে তাড়া করে চলেছে। এবং তা পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে। হডসন মনে করেন পাকিস্তানের রূপকারগণের (রূপকার বলতে তাে একজনই, মােহাম্মদ আলী জিন্না) ধারণা ছিল যে পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে এবং প্রথাসিদ্ধ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তারা নির্বাচনে সংসদীয় ক্ষমতা অর্জনে পশ্চিমকে ছাড়িয়ে যাবে (পৃ. ৫৭৬)। তেমন আশংকা থেকে পাকিস্তানের রাজধানী করাচি, পিন্ডি হয়ে ইসলামাবাদে স্থিত হয়েছে। দ্রুত উন্নতি অবকাঠামাে নির্মাণে ও শিল্পায়নে। পরিণামে পূর্ব-পশ্চিমে অর্থনৈতিক বৈষম্য যা বিচ্ছিন্নতার মূল সূত্রটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, এবং তা বাস্তবে পরিণত করেছে। ভারতবিভাগের মৌলিক ঐতিহ্য এবং পাক শাসন ব্যবস্থার কারণে জিন্নার পরিকল্পিত পাকিস্তানি জাতীয়তা যেমন তৈরি হয় নি, বিচ্ছিন্নতাবােধের মুখে গঠিত হয়নি জাতিরাষ্ট্র, হয়েছে ধর্মীয় রাষ্ট্র (ইসলামি রাষ্ট্র)। তাই গণতন্ত্র চর্চার বদলে সামরিক, বেসামরিক সর্বখাতে পাকিস্তান ইসলামিকরণের (ইসলামি জোশের) পথ ধরে চলেছে। কিন্তু ধর্মীয় সংহতি রাষ্ট্রীয় সংহতি দৃঢ় করে তুলতে পারেনি। এর কারণ অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মুসলমানদের পাকিস্তান-বিরােধী রাজনীতি প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তপ্রদেশের মুসলিম মানসিকতার পরিচয় নিতে গেলে কিছুটা অবাক। হতে হয়। লিয়াকত-খালিকুজ্জামানদের মতাে শীর্ষ লীগ নেতাদের আবাসভূমি যুক্তপ্রদেশে লীগের বিজয় সত্ত্বেও সেখানে জাতীয়তাবাদী সেকুলার প্রার্থীদের মােট ভােটসংখ্যা ছিল প্রদত্ত ভােটের প্রায় ৩১ শতাংশ। সংখ্যাটা একেবারে হেলাফেলার মতাে নয়। কারণ লীগের প্রচণ্ড ধর্মীয় প্রচারণা তথা কাবা না কাশী’ মন্তব্যের উস্কানি সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে ৩১ শতাংশ মুসলমান পাকিস্তানের বদলে অখণ্ড ভারতের পক্ষে ভােট দিয়েছে (মুশিরুল হাসান, পৃ. ৪০-৪১)। মুশিরুল হাসান মনে করেন, কংগ্রেসের পক্ষে বিচক্ষণতার অভাব ও ভুলভ্রান্তি ঘটলে আসন সংখ্যা ও ভােটসংখ্যা আরাে বৃদ্ধি পেতাে। তার মতে ভারতবিভাগ ট্রাজেডির মূল কারণ ‘অতি অল্প সংখ্যক লােক বহুসংখ্যকের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেছিল।
আর তারা সবাই শিক্ষিত উচ্চবর্গীয় মুসলমান। ভারতবিভাগের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক যেমনই হােক একথা অস্বীকার করা যায় না যে পাকিস্তান ধর্মীয় রাজনীতি-প্রসূত জটিলতার এক যুক্তিহীন সন্তান। জনক অসাধারণ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন আইনজ্ঞ রাজনীতিক মােহাম্মদ আলী জিন্না। পাকিস্তান এখনাে জিন্নাঘাষিত ধর্মীয় রাজনীতির প্রভাব বহন করে চলেছে । শুদ্ধ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। মুক্ত হতে পারে নি সংশ্লিষ্ট উপসর্গ থেকে যেজন্য খুন, গুম, রক্তক্ষয়ী সহিংসতার রাজনীতি নিয়মিত ঘটনা। ভারত এদিক থেকে কিছুটা ভালাে অবস্থানে থেকেও সামপ্রদায়িকতা ও বিচ্ছিন্নতার উপসর্গ থেকে পুরােপুরি মুক্ত নয়। যুদ্ধংদেহী সম্পর্ক পাকভারতের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা স্নান করে দিচ্ছে। শান্তি, শুভবুদ্ধি ও সৌহার্দ্য, সহিষ্ণুতা ও বিচক্ষণ পদক্ষেপই শুধু তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে। পারে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতার দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে । কিন্তু তেমন সম্ভাবনা দুর অস্থ। কারণ ভারতবিভাগ ও পাকিস্তান প্রস্তাবের অন্তর্নিহিত স্ববিরােধিতা ও অসমম্বিত দ্বন্দ্বগুলাে নিয়েই বিচক্ষণ জিন্নার অদূরদর্শী। অর্জন যা তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি। অবশ্য তেমন কোনাে স্বপ্ন পাকিস্তান। অর্জনের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে মনে হয় না। যে সব সাংবিধানিক দাবির ভিত্তিতে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জিন্নার লড়াই, তার বিপরীত দাবিগুলােই (যা ছিল। কংগ্রেসের) জিন্না পাকিস্তানে প্রবর্তন করেন। যেমন শক্তিশালীকেন্দ্র, দুর্বল প্রদেশ, প্রাদেশিকতাকে পাকিস্তান-বিরােধিতা হিসাবে চিহ্নিত করা, একভাষা একনেতা-একদেশ’ স্লোগান ইত্যাদি। | প্রচ্ছন্ন সমস্যা নিয়ে জিন্না যে-পাকিস্তানের স্থপতি তাতে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কোনাে ইচ্ছা জিন্নার স্বল্প মেয়াদেও দেখা যায় নি । আর তেমন চিন্তা যে পরবর্তী শাসকদের মধ্যেও ছিল না তা পাকিস্তানের সেনানায়কদের চিন্তায় ও কর্মে প্রতিফলিত। হডসন লিখেছেন ইস্কান্দার মীর্জা বা আইউব। থানের মতাে জেনারেলদের বিশ্বাস ছিল যে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় পাকিস্তান। ভেঙে পড়বে, বিশেষ করে পূর্ব ও পশ্চিম দ্বন্দ্বে (পৃ. ৫১৪)। রাজনৈতিক নেতাদেরও একই ধারণা ছিল ৫ আসলে ঘটনা ছিল এর বিপরীত। গণতন্ত্রই ভাঙন ঠেকাতে পারতো।
আর পাকিস্তানের নিজ অবস্থান নিয়ে কী ভাবতেন জিন্না। সে সব নিয়ে অনেক গল্প, অনেক চুটকি রয়েছে যা তার একনায়কসুলভ মানসিকতার প্রমাণ দেয়। এর জন্য লীগের শীর্ষনেতাদের দায় কম নয়। সব ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে সমর্পণ করে তারা নির্ভার হয়েছিলেন। ভারতবিভাগ ও পাকিস্তান গঠন যখন নিশ্চিত তখন জিন্নার অবস্থান ঈশ্বরতুল্য। তার কথাই শেষ কথা, হােক তা যুক্তিহীন। তাই লাহাের প্রস্তাবের দুই পাকিস্তানকে তিনি এক ধমকে এক পাকিস্তানে পরিণত করেন। | নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন দিল্লির ইম্পিরিয়াল হােটেলের সুসজ্জিত বলরুমে, জুন ৯, ১০ (১৯৪৭)। শাহি জমজমাট আয়ােজন। থেকে থেকে মুমুর্মুহু স্লোগান ‘শাহেন শা-ই পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ কায়েদে-আজম জিন্দাবাদ’। ক্ষমতার এমন প্রতাপই বােধহয় চেয়েছিলেন জিন্না যা একমাত্র পাকিস্তানেই সম্ভব-দ্য গ্রেট ডিকটেটরের অবিশ্বাস্য মর্যাদা! ওই সভায় অবশ্য পাকিস্তান-বিরােধী, পাঞ্জাব-বিভাজন বিরােধী খাকসারদের অতর্কিত হামলা-কোথায় জিন্না’ হুংকারে। স্বভাবতই খাকসার বনাম সশস্ত্র ন্যাশনাল গার্ডদের সংঘর্ষ, ভাঙচুর, কিছু রক্তপাত ও গ্রেফতারের মধ্যদিয়ে সংঘাত শেষ। শক্ত ধাতুতে তৈরি জিন্না এ ঘটনায় বিচলিত হননি। ঐ সভার প্রস্তাবে প্রেসিডেন্ট জিন্নার হাতে ওঠে লীগের সম্পূর্ণ ক্ষমতা। এমনটাই চেয়েছিলেন জিন্না। লীগ মানেই জিন্না। পরবর্তী মাস দুই পাকিস্তানের স্থপতি জিন্নার সময় এমন মুগ্ধতার পরিবেশেই কেটেছে। বােম্বের মালাবার হিলসের সুরম্য প্রাসাদ ভবন থেকে জিন্নার করাচি যাত্রা ৭-ই আগস্ট (১৯৪৭)। সেখানেও অবিশ্বাস্য রাজসিক অভ্যর্থনা। সেখানেও শাহেন শা জিন্দাবাদ’ স্লোগান। ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে আরােহণ ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের একমাত্র সাধনা। ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বের (সাে সিেক্সম্যান) দাবিও ওই আকাক্ষার রকমফের। অবাক হবার মতাে ঘটনা-কোথায় দিলি-করাচি আর কোথায় পূর্ববঙ্গের দূরদুর্গম গ্রাম। সেখানেও এক দীনতম শ্রমিকের কণ্ঠে ১৫ আগস্টে গর্বিত উচ্চারণ-“জিন্না আমাদের বাদশা, কী আশ্চর্য মিল! পাকিস্তানে জিন্নার এ অর্জন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ ধরে নয়। তার লড়াই সাম্প্রদায়িক চেতনার, ধর্মীয় বিভেদচেতনার পথ ধরে।
সেখানে গণতন্ত্রী রাজনৈতিক আদর্শের কোনাে বালাই নেই । উচ্চাভিলাষই একমাত্র কথা। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল পদটি তার চাই, এ বার্তায় হতবাক মাউন্টব্যাটেন। এভাবে ক্ষুব্ধ অহমিকা চরিতার্থ করেন জিন্না তার পাকিস্তানে। | বিভক্ত ভারতের দুই ডােমিনিয়ন রাষ্ট্রে গান্ধি জিন্না এই দুই প্রধান নেতার শেষ পথ অবশ্য ভিন্ন হয়ে যায়। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ভুল-ক্রটি সত্ত্বেও শেষ পর্বে গান্ধির সঠিক সিদ্ধান্ত ক্ষমতাবলয়ের বাইরে অবস্থান গ্রহণ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখা। শেষােক্ত কারণে উগ্র স্বধর্মীর গুলিতে মৃত্যুবরণ । অন্যদিকে জিন্না বেছে নেন দেশের সর্বোচ্চ শাসনপদ ‘গভর্নর জেনারেল অব পাকিস্তান’ । বিচক্ষণ রাজনীতিক ভেবে দেখেন নি : ‘এ মণিহার’ তার প্রয়ােজন ছিল কিনা । কারণ পাকিস্তানের মানুষ তাকে ‘শাহেন শা’র আসনে বসিয়ে ছিল তাদের অন্তরের টানে। তার রাজনৈতিক কর্মের ভুল ক্রটির হিসাব না করে। পূর্বাহ্নে বিজয়ী হলেও শেষ দানে গান্ধির কাছে হেরে গেছেন জিন্না। সে হারের মাত্রা আরাে বেড়েছে যখন গান্ধি হত্যার প্রতিক্রিয়ায় জিন্নার মন্তব্য : একজন হিন্দুনেতার মৃত্যুতে শােকবার্তা জানাচ্ছি। জিন্নার পাকিস্তান সম্প্রদায়বাদী রাজনীতির এই ঐতিহ্য থেকে এখনাে মুক্ত হতে পারে নি। পুরােপুরি পারেনি ভারতও। করাচির উদ্দেশ্যে জিন্নার শেষযাত্রা (১২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮) ছিল আবেগহীন, নিরাসক্ত, শাদামাঠা পরিবেশে যা পাকিস্তানের স্থপতি ও গভর্নর জেনারেলের যােগ্য ছিল না, প্রাপ্য ছিল না পাকিস্তানের কাছে। সে রাতেই করাচিতে তার মৃত্যু। সে সংবাদে নেহরুর প্রতিক্রিয়ায় রাজনৈতিক সমালােচনা ছিল। তবে শেষ বক্তব্য ছিল ভিন্ন : ‘এখন আমার চিন্তায় তার সম্বন্ধে কোনাে তিক্ততা নেই। শুধুই আছে গভীর বিষন্নতা’ (যশবন্ত সিং)। দেশবিভাগের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এমন অদ্ভুত ধারাবাহিকতা নিয়ে এগিয়ে চলেছে।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক