You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভারতবিভাগ কি অনিবার্য ছিল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ভয়াবহতার কথা বাদ দিলে বিশ শতকে দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ভারতবিভাগ ও ইংরেজ শাসকের ভারতত্যাগ (১৯৪৭, আগস্ট)। বিভাজিত উপমহাদেশে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান নামের দুই ডােমিনিয়ন রাষ্ট্র। নয়া শাসক যথাক্রমে জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ । এ ঘটনার গুরুত্ব শুধু ভূখণ্ড বিভাগ ও শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য নয়, গুরুত্ব এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রক্তাক্ত মানব ট্রাজেডির কারণে । মৃত্যুর নিষ্ঠুরতা, নারী নির্যাতন ও ছিন্নমূল-বাস্তুহীন মানুষের অপরিসীম যন্ত্রণা পূর্বোক্ত অবাঞ্ছিত ট্রাজেডির চালচিত্র সৃষ্টি করেছিল। গুরুত্বপূর্ণ সেই ভারতবিভাগ তথা দেশৰ্ভৰ্গ ও সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলীর ইতিহাস নিয়ে তাই ভারতে ও বিদেশে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। সেসব লেখা যেমন ঘটনার বিবরণ নিয়ে তেমনি সেসবের বিশ্লেষণে ঘটনার তাৎক্ষণিক চিত্ৰবিচারে ও পরবর্তী পরিণাম দৃষ্টে বিচলিত কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক চেতনাতাড়িত প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে তাদের রচনায়  সম্প্রতি প্রবীণ সাংবাদিক-কলামিস্ট কুলদীপ নায়ার তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন সেসময়কার অমানুষিক উন্মত্ততার কথা। তার মতে দেশভাগের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। এরপরও ঘটনার ভয়াবহতা বিচারে সংবেদনশীল লেখক, বুদ্ধিজীবী, এমনকি রাজনীতিমনস্ক মানুষের মনে এমন প্রশ্ন উঠতে পারে, ভারতবিভাগ কি অনিবার্য ছিল? এর কি কোনাে বিকল্প ছিল না যেপথ ধরে তৎকালে বিরাজমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা যেতাে? সেই সঙ্গে এত মৃত্যু, এত রক্তপাত, এত নির্যাতনের হাত থেকে মানুষের রেহাই মিলতাে? পথ ছিল কিন্তু শীর্ষনেতা। কারােরই সে দিকে নজর বা আগ্রহ ছিল না। উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব পেতে বিভাজন-সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলীর বিশদ পর্যালােচনা দরকার। অন্তত দরকার পরিণাম-নির্ধারক বিশেষ কিছু সময়ক্ষণ ও ঘটনার তাৎপর্য বিচার এবং সেই সঙ্গে দেশভাগের বিকল্প সম্ভাবনার তাত্ত্বিক অনুসন্ধান। পর্যালােচনায় একটি বিষয় নিশ্চিত, এবং ইতিহাস লেখকগণও  একমত যে ভারতে হিন্দু-মুসলমান অনৈক্যের পথ ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক ধর্মীয় সম্প্রদায়চেতনার যে প্রকাশ তারই শীর্ষ পরিণতিতে ভারতভাগ ও পাকিস্তানের জন্ম। তবে এ দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় অখণ্ড ভারতে ঐক্যের পথ ধরে স্বাধীনতা অর্জনের সম্ভাবনাও উকি দিয়ে গেছে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের অবহেলায় বা অনিচ্ছায় সে সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গেছে কখনাে নষ্ট হয়েছে তাদের বিভ্রান্তিকর বা ভুল পদক্ষেপে কখনাে সে বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে।

অনৈক্যের প্রশ্নে একটি বাস্তব সত্য অস্বীকার করা চলে না যে জাতি, সম্প্রদায়, গােত্র, পরিবার সর্বত্রই, এমন কি ব্যক্তিতে ব্যক্তিতেও নানা কারণে ভেদাভেদ, বিবাদ-বিসম্বাদ ঘটে, আবার তা মিটেও যায় সদিচ্ছা বা শুভবুদ্ধির কল্যাণে  যদি না যেতাে তাহলে সমাজে মানুষ পাশাপাশি বসবাস করতে পারতাে না। বিশ্ব তখন এক অশান্তির ভুবন হয়ে দাড়াতে। কিন্তু ভারতীয় সমাজের বড় সমস্যা ছিল সাময়িক বা অস্থায়ী সামাজিক ভেদ বা বিবাদকে রাজনৈতিক অঙ্গনে টেনে এনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির কাজে ব্যবহার করা। ধর্ম সেখানে বড় একটি প্রেরণা (প্ররােচনা বলাই সঠিক)দায়ক উপাদান। অন্যভাবে বলা যায় শিক্ষিতচিন্তার আধুনিক দুর্বুদ্ধির টানে সমাধানযােগ্য সামাজিক সমস্যাকে ধর্মের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সমস্যায় পরিণত করা হলে সে সমস্যা বৈনাশিক চরিত্র ধারণ করতে পারে । ভারতে তেমনটিই ঘটেছিল। ধর্ম বরাবরই জনমানসে এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় যা নিয়ে রাজনীতির খেলায় অনর্থ ঘটানাে সম্ভব। ধর্মীয় রক্ষণশীলতা নিয়ে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের উদাহরণ বিশ্বে রয়েছে। এর পরিণাম শুভ হয়নি। আর এ রাজনীতি গণতন্ত্রসম্মত নয়। নয় মানবিক চেতনা-নির্ভর। কিন্তু মােহাম্মদ আলী জিন্না দ্বিজাতিতত্ত্বের মােড়কে ভারতীয় মুসলমানের রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার অজুহাতে মুসলিম ধর্মসামপ্রদায়িক রাজনীতির সাংগঠনিক প্রকাশ ঘটান মুসলিম লীগের লাহাের অধিবেশনে বিচ্ছিন্ন, স্বতন্ত্রভুবনের প্রস্তাব পাশ করিয়ে (১৯৪০, ২৩-এ মার্চ)। হিন্দু-মুসলমান অনৈক্যের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছিল এর প্রায় চারদশক আগে । মুসলিম লীগের জন্মলগ্ন থেকে (১৯০৬)। অবশ্য এ অনৈক্য বা সাম্প্রদায়িক বিভেদের শিকড়বাকড় জন্ম নেয় আরাে আগে উনিশ শতকে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক সাহিত্যের রাজনৈতিক প্রভাবে (মূলত আনন্দমঠ উপন্যাসের   মুসলমান বিরূপতা ও বন্দেমাতরম মন্ত্রে একই সঙ্গে দেবীবন্দনা ও স্বদেশ বন্দনার পারস্পরিকতায়)।

এ প্রভাব ছড়িয়ে যায় জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী রাজনীতিতে, এবং বঙ্গ থেকে পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে যুক্ত হয় হিন্দুত্ববাদ, সেই সঙ্গে শিবাজি উৎসব, ভবানিপূজা ইত্যাদি ধর্মীয় উপাদান। গঠিত হয় হিন্দু মহাসভা, আর্য সমাজ, গােরক্ষা সমিতি ইত্যাদি। শীর্ষ জাতীয় নেতাদের চেতনায় ধর্মীয় স্বাতন্ত্রবাদ প্রধান হয়ে ওঠে। এর চরম প্রকাশ তিরিশের দশকের শেষদিকে হিন্দুমহাসভা-প্রধান সাভারকারের ঘােষণায় যে হিন্দু মুসলমান দুই ভিন্ন জাতি । সেকুলার চেতনার কংগ্রেসী জাতীয়তাবাদী নেতা কাউকে এ জাতীয় ঘােষণা ও তৎপরতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। এমন কি অরবিন্দের মতাে ধীমান যখন হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে ধর্ম ও জাতীয়তাকে একাকার করেন তখনাে কেউ এ সর্বনাশা চিন্তার বিরুদ্ধে দাঁড়ান নি। | অন্যদিকে মুসলমান ধর্মবাদীদেরও এ বিষয়ে পিছিয়ে থাকতে দেখা যায় নি। সেখানেও ধর্মীয় শুদ্ধতা রক্ষার অভিযান, ওয়াহাবি, ফারায়েজি ধর্মীয় আন্দোলন, আমান ও অন্যান্য সামাজিক সংগঠন এবং বঙ্গভঙ্গবিরােধী আন্দোলনের (১৯০৫ থেকে) প্রেক্ষাপটে সরকারি মদতে ১৯০৬ সনে ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজনীতিকে দ্বিধাবিভক্ত করতে সাহায্য করে। মূল চেতনা ধর্মীয় স্বাতন্ত্রবাদ, সেই সঙ্গে সংখ্যালঘু ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক-সামাজিক অধিকার রক্ষার দাবি-দাওয়ার প্রাধান্য।  অনৈক্য ও বিভাজনের এই দ্বিমাত্রিক প্রেক্ষাপটে যুক্ত হয় প্রধান শক্তি হিসাবে ইংরেজ শাসকের ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতির বাস্তবায়ন  তাদের আশীর্বাদী। হাত প্রসারিত হয় ভারতজয়ের প্রথমপর্বে হিন্দু সমপ্রদায়ের দিকে। শিক্ষিত হিন্দু সমাজের আত্মচেতনার প্রসার ও আত্মশাসনের আকাক্ষার বিরুদ্ধে শাসনযন্ত্রের দাক্ষিণ্য দেখা দেয় মুসলমান সম্প্রদায়ের দিকে, তাদের কাছে টানতে। এ প্রসঙ্গে উইলিয়াম হান্টারের লেখা ‘দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমান্স’ (১৮৭১) স্মর্তব্য।

ওদেরই কথা ধার করে বলা যায় : রাজনৈতিক খেলা ভালােই জমিয়ে তােলে ইংরেজ শাসক। দুর্ভাগ্য, ভারতীয় রাজনীতিকগণ এ বিষয়ে সচেতনতার প্রকাশ ঘটাতে পারেন নি। এ বিষয়ে তাদের তেমন আগ্রহ দেখা যায় নি। ভারতীয় রাজনীতির এ ত্রিধারায় যেসব ঘটনা ও কালক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, ইতিহাসের বিশদ আলােচনায় না যেয়েও সেগুলাের বিচার ব্যাখ্যা   উপরে উল্লিখিত প্রেক্ষাপটে ভারত বিভাগের উৎস সন্ধানে যথেষ্ট। সে অম্বেষায় ১৯৪০-এর লাহাের প্রস্তাবই নয়, যেতে হয় আরাে পেছনে সুনির্দিষ্ট ঘটনার। সন্ধানে ১৯০৫ সনে বঙ্গভঙ্গবিরােধী আন্দোলনে, ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায়, ১৯০৯ সনে মর্লি-মিন্টো শাসন সংস্কার প্রস্তাবে, ১৯১৯ সনের একই ধারার মন্টেগু-চেমসফোর্ড প্রস্তাবে, ১৯২৬ সনে চিত্তরঞ্জন দাসের বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিলের ঘটনায়, ১৯২৮ সনে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনে মুসলিম লীগ ও জিন্নার ঐক্য প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানে, ১৯৩৫ সনে ইংরেজ শাসকের সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ প্রবর্তনে, ১৯৩৭-এ লীগ কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গঠনের অনৈক্যে, ১৯৩৯-এ সূচিত বিশ্বযুদ্ধের রাজনৈতিক প্রভাব বিবেচনায়, ১৯৪০ সনে লাহাের প্রস্তাবের গুরুত্ব নির্ধারণে, ১৯৪৫-এ সিমলা বৈঠক ও ওয়াভেল পরিকল্পনার ব্যর্থতা অনুধাবনে, ১৯৪৬-এ জওহরলালের অপরিণামদর্শী উক্তি ও ১৯৪৬ জুলাই-এ জিন্নার ততােধিক অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত ১৬ই আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘােষণার পরিণাম বিবেচনায় । এমনি কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে সৃষ্ট অবিশ্বাস-অনাস্থা, বিদ্বেষ-বিরূপতা ক্রমে ঘৃণা ও বিচ্ছিন্নতাবােধের জন্ম দেয়। পূর্ব ঐক্য ও সম্প্রীতি এবং সহাবস্থানের কোনাে জায়গা অবশিষ্ট থাকে না। ব্যতিক্রমীরা সংখ্যায় ও শক্তিতে গৌণ। বিশেষ কালক্ষণের এ ঘটনাগুলাে যেন রাজনৈতিক রসায়নাগারে সংঘটিত পরস্পর সংশ্লিষ্ট ধারাবাহিক বিক্রিয়া, বলা যেতে পারে ‘চেইন রিঅ্যাকশন’ । এদের মধ্যে কয়েকটি বুঝি নিয়তি নির্ধারিত ঘটনা। তবে সব কটিই কমবেশী গুরুত্ব নিয়ে একলক্ষ্যে ধাবমান লক্ষ্য ভারত-ভাগ (তথা মুসলমানের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান)। তাছাড়া কয়েকটি ঘটনা যেন অর্জুনের লক্ষ্যভেদী শরসন্ধান, অব্যর্থ নিশানায় ছুটে গেছে মানবতা-বিরােধী তীর হয়ে রক্তাক্ত দেশভাগ নিশ্চিত করতে।

প্রতিটি কালক্ষণ আলােচনায় না এনেও গুরুত্বব্যঞ্জক ঘটনাগুলাের তাৎপর্য ব্যাখ্যাই বােধহয় প্রতিপাদ্য বিষয় যুক্তিগ্রাহ্য করে তােলার জন্যে যথেষ্ট। ব্রিটিশ ভেদনীতির সূচনা যে কত আগে থেকে শুরু তার প্রমাণ ১৮৮৮ সনে ভাইসরয় ডাফরিনের মন্তব্য থেকে বােঝা যায়। যেমন পাঁচ কোটি ভারতীয় মুসলমান তাদের একেশ্বরবাদ, ধর্মীয় উন্মাদনা, পশু উৎসর্গ ও সামাজিক সাম্য নিয়ে কোনাে ধর্মীয় সম্প্রদায় নয়, বরং একটি জাতি’ (পিটার হার্ডি, সুমিত সরকার)। অবাক হবার কিছু নেই যদি জিন্না তার রাজনৈতিক প্রয়ােজনে সম্প্রদায়কে জাতিত্বে পরিণত করার বহুমহাজনের উক্তি গ্রহণ করে থাকেন। এ বিভ্রান্তিকর তথ্য, অনৈতিহাসিক তত্ত্ব প্রমাণ করতে ১৮৭১ সালে হান্টার তার বইতে বিশদ আলােচনা শেষে এমন মন্তব্য করেন যে ভারতীয় মুসলমান  একটি জাতি, ব্রিটিশ শাসনে যাদের সর্বনাশ ঘটেছে। এভাবে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্যমূলকভাবে জাতি পরিচয়ে চিহ্নিত করার রাজনৈতিক দুর্বুদ্ধি। ব্রিটিশ শাসকদের পক্ষ থেকে শুরু হয় যা জিন্না পরে (১৯৪০) দ্বিজাতিতত্ত্বে প্রকাশ করেন লাহাের প্রস্তাবে এবং সে তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলমান জাতির জন্য ভারত ভেঙে স্বতন্ত্ররাষ্ট্র গঠনের দাবি জানান। এ ঘটনা অনেক পরের  হিন্দু-মুসলমানের রাজনৈতিক বিভেদ, পূর্বঘটনাবলী মেনে নিয়েও বলা যায় বঙ্গভঙ্গবিরােধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, প্রতিক্রিয়া ও সংশ্লিষ্ট শাসনতান্ত্রিক ঘটনাবলী থেকে শুরু। ভাইসরয় লর্ড কার্জনের বঙ্গবিভাগের (১৯০৫) উদ্দেশ্য ছিল এক ঢিলে দুই পাখি মারা বিপ্লববাদী আন্দোলনপ্রবণ বাংলাকে বিভক্ত করে ব্রিটিশ শাসন নিশ্চিন্ত করা । অন্যদিকে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে নতুন প্রদেশ গঠন করে বাঙালি হিন্দুমুসলমানের মধ্যে বিভেদ নিশ্চিত করা। শেষােক্ত ব্যবস্থা পূর্ববঙ্গের পশ্চাদপদ উঠতি মুসলমান শিক্ষিতশ্রেণীর জন্য ছিল আশীর্বাদ স্বরূপ । শিক্ষায়, চাকুরিতে, পদমান মর্যাদার নানাদিক বিচারে ।

কিন্তু বাঙালি জাতিসত্তা বিভাজনের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় যে ব্যাপক শাসকবিরােধী আন্দোলন দেখা দেয় তা শুধু রাজধানী কলকাতাকেন্দ্রিক ছিল না । তাতে পূর্ববঙ্গীয় মুসলমান শিক্ষিতশ্রেণীর যথেষ্ট সংশ্লিষ্টতা ছিল। ছিল জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতৃবৃন্দের ইতিবাচক ভূমিকা যেমন গজনভি, রসুল, সিরাজী, ইসলামাবাদী, আবুল হুসেন, লিয়াকত হােসেন প্রমুখের বলিষ্ঠ প্রতিবাদী ভূমিকা । ভয় পেয়েছিল ইংরেজ শাসক যে কারণে ১৯১১ সনে বঙ্গভঙ্গ রদ। কিন্তু মধ্যবর্তী সময়ে বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় পূর্ববর্তী ঐক্যে ফাটল ধরে । নবাব সলিমুল্লাহ ও নওয়াব আলী চৌধুরী গ্রুপ ও শীর্ষ শাসনকর্তাদের সরাসরি মাঠপর্যায়ে প্রচার, স্বদেশী নেতাদের আন্দোলনে ধর্মীয় প্রতীকী চরিত্র (হিন্দুত্ববাদী) আরােপ, স্বদেশী পণ্য কেনাকাটার জবরদস্তিতে প্রতিক্রিয়ার টান জোরালাে হয়ে ওঠে। সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাই নয়, কোথাও কোথাও সংঘাত দেখা দেয়, বিশেষ করে ময়মনসিংহ, জামালপুর, কুমিল্লা প্রভৃতি অঞ্চলে (১৯০৬-০৭ সনে)। সেইসময় জমিদার মহাজন বিরােধী কৃষক অভ্যুত্থান, তাতে সাম্প্রদায়িক চরিত্রের প্রকাশ  অন্যদিকে বিপ্লববাদে হিন্দুত্ববাদের প্রকাশ (গীতা, বন্দেমাতরম, ভবানীপূজা ইত্যাদি)। বিষয়গুলাে রবীন্দ্রনাথের তীব্র সমালােচনার কারণ হয়ে ওঠে। শিক্ষা, শিল্পকারখানা, সংস্কৃতি সব কিছু মিলে জাতীয়তাবােধের সেকুলার স্বদেশীয়ানার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। মূলত ধর্মীয় সংশ্লিষ্টতায় ও কিছু বাস্তব কারণে। 

বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার নেতিবাদী প্রভাব নিশ্চিত করতে শাসক-শ্রেণীর দুটো উদ্যোগ ভবিষ্যত রাজনীতির জন্য সর্বনাশা হয়ে ওঠে। প্রথমত ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা। দ্বিতীয়ত, অধিক গুরুত্বপূর্ণ মর্লি-মিন্টো প্রস্তাবে (১৯০৯) হিন্দু-মুসলমানের পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে বিভেদ সৃষ্টির বীজতলা পত্তন যা আবার ১৯১৯-এ মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসনতান্ত্রিক সংস্কারে আরাে পাকাপােক্ত করা হয়। এক্ষেত্রে সংখ্যালঘুর জন্য সংরক্ষণই যথেষ্ট ছিল। শেষ বিচারে বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষে স্বদেশী আন্দোলনের বড় অবদান সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দেশাত্ববােধক গান, জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থান ও বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদের বিস্তার। কিন্তু শেষ দুটোতে হিন্দুত্ববাদের উপস্থিতি সাম্প্রদায়িক ঐক্যের ক্ষেত্রে বিপরীত নিশানাই নিশ্চিত করে। স্বদেশী আন্দোলন শুধু জাতীয়তাবাদী চেতনারই প্রকাশ ঘটায়নি, হিন্দু এলিট ও ভূস্বামী শ্রেণীকে সংঘবদ্ধ ও শক্তিমান করে তুলতে সাহায্য করে। এর বিপরীতে ক্রমবর্ধমান প্রজা অসন্তোষ বিশ থেকে তিরিশের দশকে শক্তিমান প্রজাআন্দোলন সংগঠিত করে (যা ছিল ব্যাপকভাবে মুসলমান-প্রধান)। এ দুই রাজনৈতিক শক্তিতে দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রাধান্য হিন্দু-মুসলমান বিভেদের পথ তৈরি করে । সুমিত সরকারের মতে “হিন্দুপ্রধান বাঙলা কংগ্রেসের ভুল ভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতার ফলে মুসলিম বিচ্ছিন্নতার পরিপুষ্টি’ । মধ্যবর্তী সময়ে বাংলাবিহারসহ একাধিক প্রদেশে সায়িক দাঙ্গা ধর্মীয় ও শ্রেণীগত কারণে । স্বদেশী আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক বিভেদ চেতনার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যের চেষ্টাও চলেছে। এ চেষ্টার স্মরণীয় প্রতিফলন দেখা যায় চিত্তরঞ্জন দাস ও মােতিলাল নেহরুর স্বরাজ্য দলের (১৯২৩) সামপ্রদায়িক ঐক্যের সাফল্যে।

বিশেষ করে চিত্তরঞ্জনের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’-এর কারণে হিন্দু-মুসলমান আসনে স্বরাজীদের বাংলা জয় । চিত্তরঞ্জনের এ প্রচেষ্টায় তার তিন তরুণ সহযােগীর ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা- মেদিনীপুরের বীরেন্দ্র শাসমল, চট্টগ্রামের যতীন্দ্রমােহন সেনগুপ্ত ও কলকাতার সুভাষচন্দ্র বসু। রাঢ়বঙ্গ, পূর্ববঙ্গ ও মধ্যবঙ্গের সমন্বয়ের কারণে অবিশ্বাস্য সাফল্য। কিন্তু কংগ্রেসের শর্ষেতে ছিল ভূতের আশ্রয়, আন্তরিকতার অভাব । তাই চিত্তরঞ্জনের আকস্মিক অকালমৃত্যুর (জুন, ১৯২৫) মতাে নিয়তিনির্ধারিত ঘটনার পর ঐক্য ও সম্প্রীতির সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায় । সুভাষ ও বীরেন্দ্র শাসমলের চেষ্টা সত্ত্বেও কংগ্রেস বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিল করে (১৯২৬) মূলত তাদের দক্ষিণপন্থী নেতৃত্ব ও হিন্দুমহাসভাপন্থীদের প্রভাবে। মােতিলাল নেহরু   স্বধর্মীদের সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারের শিকার হয়ে পিছু হটেন। এ সময় হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলাের জয়জয়কার। শুরু হয়ে যায় সাম্প্রদায়িক সংঘাত।  অবশ্য অন্যদিকে ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত হিসাবে আখ্যায়িত জিন্নারও চেষ্টা সম্প্রদায়িক ঐক্যের, মূলত ১৯১৬ (লক্ষৌ প্যাক্ট) থেকে ১৯২৮ সন পর্যন্ত। তার প্রস্তাবের মূল বিষয় ছিল অখণ্ড ভারতের কেন্দ্রে এক তৃতীয়াংশ মুসলমান আসন, প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সংখ্যালঘুর জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং সিন্ধুর প্রাদেশিক মর্যাদার মতাে কিছু দাবি। | মােটামুটি হিসাবে যুক্তিসঙ্গত এসব দাবি কংগ্রেস তখন মানতে রাজি ছিল না। কারণ দুর্বোধ্য অথবা বলা যায় নিজ শক্তি সম্বন্ধে অগাধ বিশ্বাস। পরবর্তীকালে এর চেয়ে বেশি ছাড় দিয়েও কংগ্রেস ভারতভাগ ঠেকাতে পারে নি ।

হিন্দু-মুসলমান ঐক্য প্রচেষ্টার গুরুত্বপূর্ণ সর্বদলীয় কলকাতা সম্মেলনেও (১৯২৮) মুসলিম লীগের অনুরূপ প্রস্তাব এবং জিন্নার সাম্প্রদায়িক ঐক্যের আহবান প্রত্যাখ্যাত হয় মূলত কংগ্রেসের দক্ষিণপস্থা ও হিন্দুমহাসভাপন্থীদের চাপে  হতাশ, ক্ষুব্ধ জিন্নার মন্তব্য : এখন থেকে আমাদের পথ বিভক্ত হয়ে গেল। এরপর তার লন্ডন-প্রবাস । এসব ঘটনায় কংগ্রেসের অপরিণামদর্শী অদূরদর্শিতাই প্রকাশ পেয়েছে। সংখ্যালঘু রাজনীতির প্রতি সহানুভূতি ও ভেদনীতির ওপর নির্ভরতা ব্রিটিশ শাসনের বৈশিষ্ট্য বলেই বােধহয় ১৯৩২ সনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামজে ম্যাকডােনাল্ড ভারতের জন্য সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদের রূপরেখা তৈরি করেন। এ প্রস্তাবের প্রধান বৈশিষ্ট্য পূর্ব ধারায় স্বতন্ত্র নির্বাচন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন (অটোনমি) এবং সংখ্যাঘুর জন্য আসন সংরক্ষণ (যা ইউরােপীয়দের জন্য ছিল সর্বাধিক) ও ভাইসরয়ের সর্বময় ক্ষমতা, প্রদেশের ক্ষেত্রে গভর্নরদের। এ ব্যবস্থা ১৯৩৫ সনে ভারতে শাসনতান্ত্রিক আইনে পরিণত। এভাবে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতার পাকা সড়ক তৈরি। কংগ্রেস ক্ষুব্ধ। কিন্তু বিরােধিতা ছাড়া তাদের করার কিছু ছিল না। আন্দোলনে গেলে তাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি হতাে। | ইতােমধ্যে নির্বাচন ঘােষণা । ফিরে এসেছেন জিন্না মুসলিম লীগের হাল। ধরতে, কিন্তু ভিন্ন এক জিন্না যার চোখে কংগ্রেস এখন প্রতিপক্ষ। ঘােষিত ১৯৩৭-এর প্রাদেশিক নির্বাচন সাম্প্রদায়িক নীতিতে হলেও এর ফলাফল সম্ভবত অখও গণতান্ত্রিক ভারতের জন্য শেষ সুযােগ তৈরি করেছিল । বিশেষ করে বঙ্গ ও যুক্তপ্রদেশকে কেন্দ্র করে। পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশ সেকুলারপন্থীদের দখলে। বঙ্গদেশে প্রজাপার্টি ও লীগ কেউ নিরঙ্কুশ  সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এ অবস্থায় ফজলুল হকের আহ্বান সত্ত্বেও কংগ্রেস প্রজাপার্টির সঙ্গে যুক্তমন্ত্রীসভা গঠনে অসম্মতি জানায়। অগত্যা বঙ্গে লীগপ্রজাপাটি মিলে মন্ত্রীসভাগঠন। | এ ঘটনার গভীর রাজনৈতিক তাৎপর্য কংগ্রেস বুঝতে পারেনি। জিন্নার রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা সম্বন্ধেও তাদের সঠিক ধারণা ছিল না। তাই প্রবাদের ভাষায় ‘হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠ্যালা’ কংগ্রেসের পক্ষে, যা কংগ্রেস একাধিক বার করেছে এবং ভারতবর্ষকে বিভাজনের দিকে ঠেলে দিয়েছে । প্রতিক্ষেত্রেই জিন্না সে সুযােগ নিয়েছেন। যেমন এক্ষেত্রে বাংলার শেরকে কোলে তুলে নিয়ে পরিচর্যা করা (অবশ্য পরে ছুঁড়ে ফেলার জন্য) যার ফলে বিভ্রান্ত হকের প্রজাপার্টিসহ মুসলিম লীগে যােগদান, এবং তার আত্মহননের পথ তৈরি করা। দ্বিতীয় ঘটনা কোনাে কোনাে ইতিহাসবিদের মতে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বিচারে দুটোই তুল্যমূল্য। জিন্না যুক্তপ্রদেশ ইসু’কে যতই গুরুত্ব দিন।

কেন প্রকৃতপক্ষে একাধিক ঘটনায় বাংলাই তার পাকিস্তান অর্জনে প্রধান শক্তি । জিন্নার আহবান ছিল যুক্তপ্রদেশে কংগ্রেস-লীগ যুক্ত মন্ত্রীসভাগঠন। কিন্তু কংগ্রেস তাতে সাড়া দেয়নি নির্বাচনে একেশ্বর হওয়ার কারণে। মুশিরুল হাসানের মতে এটা কংগ্রেসের মারাত্মক ভুল হিসাব । যুক্তপ্রদেশের গভর্নরের আশংকা ছিল, এ ধরনের ঐক্য যুক্তপ্রদেশে মুসলিম লীগের সাংগঠনিক ক্ষমতার জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াব (মুশিরুল হাসান)। অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের ভিত তৈরি হতাে । বঙ্গে ও যুক্তপ্রদেশে কংগ্রেসের এ ভুল পদক্ষেপ কারাে কারাে মতে পাকিস্তান গঠনের তথা ভারতভাগের পক্ষে মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত। | বিশ্বযুদ্ধ যে জিন্না ও তার লীগের পক্ষে শাপে বর হয়েছিল তা হডসন, মেনন থেকে সবাই উল্লেখ করেছেন। এর কারণ কংগ্রেসের শাসক-বিরােধিতা ও আন্দোলন এবং লীগের শাসক সমর্থন। কংগ্রেস মন্ত্রীসভার পদত্যাগ ছিল। আরেক ভুল যা লীগের জন্য বিরাট সুযােগ এনে দেয়। জিন্না এ সুযােগের সদ্ব্যবহার করেন যা লীগের সাংগঠনিক শক্তিবৃদ্ধির সহায়ক হয়ে ওঠে। আর ভাইসরয় লিনলিথগাে যুদ্ধাবস্থায় জিন্না ও লীগের দিকে সমর্থনের এক হাত নয়, দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবে এটা ঠিক যে সবকিছুর পরও জিন্না সর্বশেষ প্রত্যাখ্যান (যুক্তপ্রদেশে) মেনে নিতে পারেন নি, যেমন পারেন নি ১৯২৮-এর কলকাতা সম্মেলনের ঘটনা। এবার প্রতিযােগিতা ও সংঘাতই নীতি হিসাবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন জিন্না। পরিণামে দ্বিজাতিতত্ত্ব ভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী লাহাের প্রস্তাব পাশ (১৯৪০)। এর পর থেকে কংগ্রেসকে প্রবল প্রতিপক্ষ হিসাবে বিবেচনা করে যেকোনাে মূল্যে তাকে মােকাবিলা করার সিদ্ধান্ত জিন্নার । ভারতভাগ ও পাকিস্তান অর্জন হয়ে ওঠে। 

তার জীবনের ধ্রুবতারা, অথবা বলা যায় অর্জুনের লক্ষ্যভেদ ও আকাঙ্ক্ষা পূরণ । চিত্রাঙ্গদার মতাে বলতে হয় তুমি অর্জুন, তুমি অর্জুন’। | ফলে কংগ্রেস যখন স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলনে নেমেছে লীগ তার বিরােধিতা করেছে (যেমন ১৯৪২-এর ভারত ছাড় আন্দোলন)। এক্ষেত্রে লীগ মানে জিন্না । জিন্না তখন লীগের সর্বাধিনায়ক। বিশ্বযুদ্ধ, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল, ভাইসরয় লিনলিথগােসহ সবাই, সবকিছুই তখন জিন্নার জন্য সৌভাগ্যের জাদুকাঠি । তাই জিন্নাও ‘এক দল, এক নেতা, এক শ্লোগান’-এ সওয়ার । শ্লোগান : ভারত ভেঙে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান চাই । কিন্তু শাসকশ্রেণী নানা কারণে, বিশেষত কংগ্রেসের আন্দোলন সংঘটিত করার। ক্ষমতার কারণে সে মুহূর্তে ভারতভাগের পক্ষে ছিল না। তারা তখন জিন্নাকে অন্য কিছু দানে সন্তুষ্ট করার নীতি গ্রহণ করে চলেছে। তাই সমঝোতার লক্ষ্যে সিমলা বৈঠক, ওয়াভেল পরিকল্পনা ইত্যাদি।

কিন্তু জিন্নার জেদের কাছে সব ভণ্ডুল হয়ে যায়। অযৌক্তিক দাবি নিয়ে চলতে থাকেন জিন্না সমঝােতা প্রস্তাব বা বৈঠক অকার্যকর করে তুলতে। ইতােমধ্যে ব্রিটেনে বড় পরিবর্তন। নির্বাচনে ব্রঙ্কণশীল দলের পরিবর্তে শ্রমিক দলের জয় । চার্চিলের স্থলে উদারপন্থী ক্লেমেন্ট অ্যাটলি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচারে তাদের সিদ্ধান্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ক্ষমতার হস্তান্তর ও সুসম্পর্ক রেখে ভারত ত্যাগ। আর সে উদ্দেশ্যে সমঝাের জন্য ভারতে কেবিনেট মিশন (মন্ত্রীমিশন) প্রেরণ তাদের প্রস্তাবের বিশেষত্ব ভারতের অখণ্ডতা রক্ষা, সেই সঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমানের অধিকার রক্ষায় আধা-পাকিস্তান ধরনের ব্যবস্থা, প্রদেশগুলাের ক্ষমতা বৃদ্ধি, দুর্বল কেন্দ্র ইত্যাদি । বিশেষ করে সম্প্রদায় সংখ্যাধিক্য বিবেচনায় প্রদেশগুলােকে তিনটি গ্রুপে বিভাজন (গ্রুপিং ব্যবস্থা)। অনেক টানাপড়েন। শেষে মিশন প্রস্তাবে লীগ কংগ্রেসের সম্মতি। ইতােমধ্যে সাধারণ নির্বাচনে জিন্নার বঙ্গদেশ জয়, সীমান্তপ্রদেশে হার, অন্যত্র জয় এবং পাঞ্জাব বাদে অন্যত্র লীগ মন্ত্রীসভা গঠন।  বাহুতে, পেশীতে যথেষ্ট শক্তি নিয়ে দেনদরবার শেষে কিছুটা অহমিকা ধরে রেখে, অনেকটা অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে জিন্নার মন্ত্রীমিশন প্রস্তাবে সম্মতিজ্ঞাপন। হিন্দু আসনে একাট্টা বিজয়ে আত্মহারা কংগ্রেস এবারও পরিস্থিতি বিচারে ভুল করে, লীগের শক্তি পরিমাপে অদূরদর্শিতার পরিচয় দেয়। অথচ এ মূল্যায়ন একজন সাধারণ রাজনীতিকের জন্যও ছিল সহজ। এ ভুলের দায় ঠিক দলের নয়, নবনির্বাচিত দলীয় সভাপতি জওহরলালের । 

এমনিতেই নানা বিষয় নিয়ে মন্ত্রীমিশন প্রস্তাব গ্রহণ-বর্জনে লীগ কংগ্রেসে টানাপড়েন চলছিল এর মধ্যে নেহরুর এক বেফাস উক্তিতে বিনা মেঘে বজ্রপাত । দিনটা ছিল ১০ জুলাই, ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দ। কংগ্রেসের নবনির্বাচিত সভাপতি জওহরলালের, কী ভেবে তা কেউ জানে না, সাংবাদিক সম্মেলনে হঠাৎ মন্তব্য যে, কংগ্রেস মিশন প্রস্তাগ্রহণ করলেও সেখানকার নিয়মনীতিতে। তাদের হাত পা বাধা নেই । বিকল্প চিন্তার স্বাধীনতা তাদের রয়েছে। তাছাড়া কেন্দ্রের হাতে শুধু তিনটে বিষয় থাকবে সেটাও ঠিক নয়। বলা বাহুল্য এ বক্তব্য দূরদর্শিতার পরিচায়ক ছিল না। এর পরিণাম হয়ে ওঠে ভয়াবহ। আজাদ সঙ্গে সঙ্গেই এ বক্তব্য ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে মন্তব্য করেন। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি তাদের পূর্ব অবস্থান নিশ্চিত করে বিবৃতির মাধ্যমে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নেহরুর বক্তব্যে লীগ নেতৃত্বে এবং ব্রিটিশরাজ মহলে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আর জিন্না? হিসাব নিকাশ করে মিশন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেই ক্ষান্ত হন না, পাকিস্তান অর্জনের জন্য ১৬ আগস্ট ভারতব্যাপী ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ ঘােষণা করেন। এ সংগ্রাম হয়ে ওঠে জিহাদ। তাদের ভাষায় কংগ্রেস তথা হিন্দু এবং ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে। এর অকুস্থল হয়ে ওঠে বঙ্গের রাজধানী কলকাতা। সেখানে লীগ মন্ত্রীসভা, সােহরাওয়ার্দি মুখ্যমন্ত্রী। কলকাতা নগর-শীর্গের প্রধান নেতা ইস্পাহানিসিদ্দিকীদের জ্বালাময়ী সাম্প্রদায়িক ভাষণে হিন্দুদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘােষণা। হিন্দু মহাসভাও সমান তীব্রতায় প্রচারে নামে পরিণামে মহা কলকাতা হত্যাকাণ্ড’, বলা চলে সাম্প্রদায়িক গণহত্যা। সৱোতার কফিনে শেষ পেরেক।  কারণ এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় নােয়াখালিতে দাঙ্গা, পালটা প্রতিক্রিয়ায় বিহারে হত্যাযজ্ঞ যা কলকাতাকেও ছাড়িয়ে যায়। এর প্রভাব দেখা দেয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে। গান্ধি-নেহরু-প্যাটেলদের অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন চুরমার। পরবর্তী ঘটনাবলী এর ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়া বা চেইন রিঅ্যাকশন’। ফলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে মাত্রায় অবিশ্বাস, অনাস্থা, বিদ্বেষ-বিরূপতা ও ঘৃণা জন্ম নেয় তাতে সমঝােতার কোনাে জায়গাই আর অবশিষ্ট থাকে নি।  লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে রাজনৈতিক মিনি কুরুক্ষেত্রের নায়কদের অসহিষ্ণুতা, জেদ, অপরিণামদর্শিতা, সর্বোপরি প্রবল রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ঐক্য ও সম্ভাবনা সব নষ্ট করে দেয়, নিবার্য ভারতবিভাগ অনিবার্য করে তােলে। ভারতভাগ ঠেকাতে দরকার ছিল কিছু মাত্রার সহিষ্ণু উদারতা ও লেনদেনের মানসিকতা। ভারতভাগকে পরবর্তীকালে লেখক-বিশ্লেষকগণ নানা অভিধায় চিহ্নিত করেছেন। কেউ বলেছেন ঐতিহাসিক ভুল’ যে ভুলের হাত ধরে সম্ভাবনার বিসর্জন। পরিণামে খণ্ডিত ভারত ও পােকায় খাওয়া পাকিস্তান’। রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অভাবে নেতাগণ বিভাগের ভবিষ্যত দেখতে পাননি।  

 

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!