দেশভাগের নিয়তি নেহরু বনাম আজাদ নেপথ্যে প্যাটেল
দীর্ঘ প্রায় দুই শতক ভারত শাসনের পর অবস্থার বিরূপতায় ব্রিটিশ-রাজ তার উপনিবেশ ছাড়তে বাধ্য হয় (ক্ষমতা হস্তান্তর ১৫ই আগস্ট, ১৯৪৭)। তাদের ভারতত্যাগের শেষ সময়পর্বে ভারতের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেসের দুই নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু নানাসূত্রে সেই জটিল রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তকালে কংগ্রেস-সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাঞ্ছিত-অবাঞ্ছিত দেশভাগে রয়েছে তাদের বিশেষ ভূমিকা যা ইতি ও নেতিতে সংশ্লিষ্ট। ‘দ্য গ্রেট ডিভাইড’-গ্রন্থের লেখক এইচ. ভি হডসন ভারত বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার ব্যক্তিত্ববিচার গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছেন। তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য গান্ধি, জিন্না, নেহরু, আজাদ । সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট দুই ভাইসরয় ওয়াভেল ও মাউন্টব্যাটেন। সম্ভবত তিনি ভেবেছেন সংলাপে, রাজনৈতিক পদক্ষেপে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যক্তি আবেগ ও নিরাসক্তি, বিচক্ষণতা ও অপরিণামদর্শিতা যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। ঘটনার ভালাে মন্দ, সঠিক বেঠিক পরিণতি সে অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। তাই ব্যক্তিত্ব বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যক্তি ভূমিকায় মনে হয় সর্দার প্যাটেলকেও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত যদিও তার ভূমিকা নেপথ্যে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সন্ধিক্ষণে ঠিকই গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতা হস্তান্তরের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত বৈঠক ও সংলাপের দীর্ঘকালীন প্রথমপর্বে মাওলানা আজাদ ছিলেন কংগ্রেস সভাপতি। এবং অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ শেষ বর্ষে সভাপতির দায়িত্বে নেহরু তাদের বক্তৃতা, বিবৃতি, সংলাপ, আলােচনা এবং চিন্তার বিচক্ষণতা বা দুর্বলতা রাজনৈতিক ঘটনার গতি প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করেছে, এমন বলা বােধহয় ভুল হবেনা । তবে এটাও ঠিক যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা একক ব্যক্তির নয়, প্রাথমিক পর্যায়ে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির, পরে কাউন্সিলের (মুসলিম লীগের ক্ষেত্রে একক ভাবে সংগঠনের সভাপতি মােহাম্মদ আলী জিন্নার)। তা সত্ত্বেও দলের সভাপতি হিসাবে কিছুটা বাড়তি সুবিধা বা ক্ষমতা থাকে এবং সেটা নির্ভর করে সভাপতির ব্যক্তিত্বের ওপর, কিছুটা পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর।
তিরিশ থেকে চল্লিশের দশকের মধ্যে নেহরু দুই মেয়াদে এবং আজাদ এক মেয়াদে কংগ্রেস-সভাপতি, ১৯৩৯-এ সুভাষ নির্বাচিত, কিন্তু পদত্যাগে বাধ্য। এরপর ১৯৪০ থেকে আজাদ নির্বাচিত বিহারের রামগড়ে কংগ্রেস অধিবেশনে বছরটি নানা ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ । অন্যদিকে ১৯৩৬-এ নেহরু সভাপতি, পরবর্তী দুই বছরও একই রকম গুরুত্বপূর্ণ । ইতিপূর্বে নেহরুর ব্যক্তিত্ববৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে মাউন্টব্যাটেনের পাশাপাশি তুলনামূলক আলােচনা করা হয়েছে। পুনরাবৃত্তির প্রয়ােজন নেই। তবে নেহরুর সমাজবাদ-গান্ধিবাদে একই সঙ্গে আত্নস্থ হওয়া (দুধ ও তামাকে সমান আগ্রহ) এবং হিন্দু-মুসলিম রাজনীতি সম্পর্কে তার কিছু অবাস্তব ধারণা গুরুতর সমস্যা তৈরি করে। সে সম্বন্ধে একটি উদাহরণ। যে যুক্তপ্রদেশে লীগ কংগ্রেস কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন নিয়ে সমস্যা ভারতবিভাগের সম্ভাবনাকে একপা এগিয়ে দিয়েছিল সে সম্পর্কে তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি নেহরুর ভূমিকা তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করেনা। বরং এক ধরনের অবাস্তব চিন্তার প্রকাশ ঘটায় । আসলে বিষয়টি ছিল দৃষ্টিভঙ্গির। কংগ্রেসের উপরমহলে বেশ কিছু সংখ্যক মুসলমান নেতার উপস্থিতির কারণে নেহরুর মনে এমন ধারণা জন্মে যে, মুসলমান সমর্থনের জন্য অন্যকোনাে সংগঠনের যেমন মুসলিম লীগ) সঙ্গে সমঝােতার কোনাে প্রয়ােজন নেই। কিন্তু পরিস্থিতি বাস্তবে এর বিপরীতই ছিল। মুসলিম লীগের প্রাপ্ত ভােটের হিসাব (১৯৩৭) নিলেই বিষয়টা সঠিক বােঝা যেতাে । কিন্তু নেহরু সে দিকে তাকান নি। যুক্তপ্রদেশের লীগনেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান মে, ১৯৩৭-এ লীগ-কংগ্রেস সমঝােতার প্রস্তাব নিয়ে নেহরুর সঙ্গে দেখা করার পর শেষােক্তজন রাজনৈতিক তত্ত্বের মতাে করে পূর্বোক্ত বক্তব্য তুলে ধরেন। অন্যদিকে খালিকুজ্জামানের মতে প্রাদেশিক আইনসভাগুলােতে লীগ-কংগ্রেস সমঝােতা নিশ্চিত করা গেলে ভারতীয় রাজনীতিতে ব্রিটিশ হস্তক্ষেপের সুযােগ ও সম্ভাবনা কমে যাবে, স্বাধীনতার পথও প্রশস্ত হবে (পাথওয়ে টু পাকিস্তান’)। কিন্তু নেহরুর ধারণা, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা কিছুসংখ্যক ভূস্বামী, ধনিক ও এলিট শ্রেণীর তৈরি। এর সঙ্গে জনসাধারণের কোনাে সম্পর্ক নেই ভিন্নমত প্রকাশ করে খালিকুজ্জামান বলেন যে ভারতে হিন্দুমুসলমান রাজনৈতিক সম্পর্ক একেবারেই ভিন্ন ধরনের, বিদেশী উদাহরণ এখানে অচল। নেহরু একথা মানতে রাজি হননি। যুক্তপ্রদেশে কংগ্রেস মুসলিম সমাজে জনসংযােগের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতেও বাস্তবতা বােঝেনি।
সম্ভবত এ অবাস্তবতা কংগ্রেসের শীর্ষনেতা অনেকের মধ্যেই ছিল। তাই কংগ্রেসনেতা মাওলানা আজাদ একাধিকবার মুসলিম স্বার্থ ও মুসলিম লীগ সম্পর্ক নিয়ে কংগ্রেসের আরাে উদার হওয়ার প্রয়ােজন উপলব্ধি করেও তাদের দলীয় চিন্তার বাইরে আনতে পারেননি। পূর্বোক্ত লীগ-কংগ্রেস সমঝােতার বিষয়ে খালিকুজ্জামানের সঙ্গে মাওলানা আজাদের একক বৈঠক (১২ জুলাই, ১৯৩৭) এবং আরেক কংগ্রেস নেতা গােবিন্দবল্লভ পন্থকে নিয়ে বৈঠকের (১৫জুলাই) বক্তব্য ও চরিত্র হয়ে দাঁড়ায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং কংগ্রেস প্রস্তাব এমনই ছিল যা লীগের জন্য আত্মঘাতী । কাজেই সমঝােতা ঐ বৈঠকেই শেষ । বিষয়টি পূর্বে আলােচিত। এর অর্থ আজাদ মেরুদণ্ডহীন ব্যক্তিত্বের রাজনীতিক এমনটা নয়। কংগ্রেসের নিজস্ব ঘরােয়ানীতি, বিশেষ করে গান্ধি-প্রভাবিত নীতির ওপর আজাদসহ কংগ্রেসী মুসলমান নেতাদের নিজস্ব প্রভাব খুবই কম ছিল। যেমন আরেক ডাকসাইটে নেতা হসরত মােহানি যার স্বাধীনতা প্রস্তাব কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে গুরুত্ব পায়নি। পরবর্তী সময়ে দেখা যাবে যে ভারতীয় স্বরাজবিষয়ক ক্রিপস প্রস্তাব (১৯৪২) বা কেবিনেট মিশন প্রস্তাব বা ওয়াভেল পরিকল্পনার মতাে কয়েকটি ক্ষেত্রে সেগুলাের গ্রহণ-বর্জন বিষয়ক আজাদের ভাবনা গান্ধি বা কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির কাছে গ্রহণযােগ্য মনে হয়নি । অথচ ভারতের অখণ্ডতা রক্ষায় এগুলাের রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অনস্বীকার্য। এর অর্থ কি তাহলে এমন দাঁড়ায় যে কংগ্রেস রাজনীতিতে মুসলিম নেতাদের চিন্তা হালে পানি পায়নি। জিন্না এমনই ভাবতেন রাজনৈতিক চিন্তায় জওহরলাল নেহরু কতটা জাতীয়তাবাদী, কতটা সমাজবাদী তা নিয়ে বিতর্ক কম ছিলনা ১৯৩৬ সনের এপ্রিলে কংগ্রেসের লক্ষ্মেী সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে নেহরু বলেন, তার দৃঢ়বিশ্বাস বিশ্বসমস্যা ও ভারত সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে সমাজতন্ত্রে । কথাটা অস্পষ্ট মানবিকতার প্রশ্নে নয়, বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক বিচারে সত্য। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া দারিদ্র্য ও বেকারত্বের মতাে সমস্যাদি দূর করার অন্যকোনাে পথ নেই।’
তাহলে কি এমন ভাবা সঙ্গত হবে যে জওহরলাল নেহরু সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পথে ভারতের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন। এমনকি ওই ভাষণে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলােপের কথাও বলেছেন, অবশ্য নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে। যেমন ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া সফরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। এমন কি রাবীন্দ্রিক ধারায় ষলশেভিক একনায়কী শাসনের সমালােচনাও রয়েছে নেহরুর বক্তব্যে তার কথা দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছি। কারণ আমি একজন জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক। জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নতির জন্যই আমাদের লড়াই । কংগ্রেসে সমাজতন্ত্র নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। তাই কংগ্রেসের ওপর সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ চাপিয়ে দিতে চাইনা’ ইত্যাদি এর অর্থ কি তাহলে এমনই দাঁড়ায় যে পশ্চিমা দেশ সফরে আহরিত সমাজতন্ত্র ছিল নেহরুর চিন্তায় এক ধরনের রােমান্টিক উচ্ছ্বাস? হয়তাে তাই সেজন্য আন্তর্জাতিক রাজনীতির বুকনি শেষে জওহরলাল বারবার গান্ধিবাদই মাথায় তুলে নিয়েছেন। গান্ধিবাদের আপসবাদিতাও মেনে নিয়েছেন নেহরু। শুধু কি তাই। ১৯৪২ জানুয়ারিতে জওহরলাল তার বক্তব্যে গান্ধিনেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করেন। কোথায় রইল তার সমাজতন্ত্র? রাজনৈতিক আদর্শবিষয়ক ব্যক্তিগত বিশ্বাস যদি রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করা হয় তাহলে তা ইউটোপীয় হয়ে দাঁড়ায়, কিংবা হয় চমক সৃষ্টির ফ্যাসান। গান্ধি বিষয়টাকে সেভাবেই বুঝে নিয়েছিলেন। তার হিসাবে ভুল ছিল না। তাই দেখা যায় স্বাধীন ভারতে নেহরুর প্রধানমন্ত্রীত্বে কমিউনিস্ট দমন, পীড়ন, জেল জুলুম-নির্যাতন। যদিও এক্ষেত্রে মূল নায়ক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাটেল।
সমাজতন্ত্র দূরে থাক, জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে নেহরুর আপসবাদ, বিশেষ করে সুভাষ-বিরােধিতার ক্ষেত্রে। কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্রের চিঠির জবাবে নেহরু লেখেন : ‘আমি আপনার দ্বিতীয়বার সভাপতি হবার বিরােধী ছিলাম। কারণ একাধিক। গান্ধিজির সঙ্গে আপনার বিচ্ছিন্নতা আমি চাই নি । তাছাড়া এতে কংগ্রেসের বামঘরানার ক্ষতিই হবে । কারণ একলা চলার মতাে শক্তি তাদের নেই। “আর কংগ্রেস সভাপতিপদে আপনি জয়ী হলেও কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতার সমর্থন অর্থাৎ গান্ধিবাদীদের সমর্থন আপনার পক্ষে যাবে না। তাই আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রস্তুতি নেওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সভাপতিপদে আপনার জয়ের ফলাফল যতটা ভালাে তার চেয়ে অনেক মন্দ পরিণাম তৈরি করেছে’ । এমনই ছিল স্বাধীনতা অর্জনে প্রবল প্রত্যাশী সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্মপন্থা সম্বন্ধে নেহরুর বিরাগ । জাতীয়তাবাদী-সমাজবাদী নেহরুর এ প্রতিক্রিয়ায় হয়তাে অবাক হয়েছিলেন সুভাষ । ত্রিপুরিতে সভাপতির ভাষণে তিনি স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশরাজকে চরমপত্র দেবার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। স্বাধীনতাপ্রেমী সমাজবাদী নেহরুর এ সম্পর্কে নেতিবাচক আচরণ প্রত্যাশিত ছিলনা সুভাষচন্দ্রের। নেহরুর প্রতিক্রিয়া থেকে তিনি বুঝতে পারেন যে কংগ্রেসের গান্ধিপন্থী নেতাদের সমর্থন পাবেন না তিনি। পাবেন না এমনকি সমাজবাদী জওহরলালেরও সমর্থন। | তাই নির্দ্বিধায় আপসবাদ থেকে সরে এসে মর্যাদাব্যঞ্জক কণ্ঠে বলতে পেরেছেন কংগ্রেসের পুতুল সভাপতি হয়ে থাকার চেয়ে পদত্যাগ শ্রেয়’ (২৯ এপ্রিল, ১৯৩৯)। অতএব গান্ধির ইচ্ছাপূরণ। গান্ধিবাদী কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির অনৈতিক আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন পি,সি, জোশি, ড, গঙ্গাধর অধিকারী, অজয় ঘােষ, আর, ডি, ভরদ্বাজ প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতা (১৩ই আগস্ট, ১৯৩৯) (Indian Struggle for Independence’, P114)। আর ব্যক্তিগত ভাবে রবীন্দ্রনাথ গান্ধিকে লেখা চিঠিতে প্রতিবাদ জানান। হতে পারে সমাজবাদী জওহরলালের কথা মনে রেখে সুভাষচন্দ্র বলেন : বামপন্থা বলতে সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধিতা বােঝায়। বর্তমান যুগ সাম্রাজ্যবাদবিরােধিতার আন্দোলনকাল। আমরা দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছি । স্বাধীনতা এলে জাতীয় পুনর্গঠন পর্বের কাজ শুরু হবে। সেটা হবে সমাজতান্ত্রিক পর্যায়ের কর্মকাণ্ড। কিন্তু বর্তমানে স্বাধীনতার লড়াই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। পরবর্তী পর্যায়ের তৎপরতায় বামপন্থা ও সমাজবাদ সমার্থক’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৫)।
নেহরুর সমাজবাদ নিয়ে উচ্ছ্বাসসহ্য করলেও সুভাষের কট্টর সাম্রাজ্যবাদবিরােধী স্বাধীনতা সংগ্রাম হজম করতে রাজি ছিলেন না গান্ধি । তাই কংগ্রেস থেকে শেষ পর্যন্ত সুভাষচন্দ্রের বহিষ্কার, অভিযােগ দলীয় শৃংখলাভঙ্গের। কংগ্রেস আঙ্গিনাতেই বামপন্থীদের নিয়ে ঘটনার পরপরই তাই সুভাষ বসুর নেতৃত্বে ফরােয়ার্ড ব্লক গঠন। অবশ্য এর আগে সুভাষের চেষ্টা ছিল গান্ধির সঙ্গে সমঝােতার । কিন্তু গান্ধি এ ব্যাপারে রাজি ছিলেন না। বরং সুভাষকে জাতীয় রাজনীতি থেকে সরিয়ে রাখার পরিকল্পনা তৈরি করতে থাকেন নিঃশব্দে । একাজ তার জন্য সহজই ছিল। তৎকালীন রাজনীতিতে আপসবাদী মানসিকতার পরিপ্রেক্ষিতে সুভাষচন্দ্রের আহ্বানে রামগড়ে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে আপস-বিরােধী প্রতিবাদ-প্রদর্শিত হয় । সুভাষ তার ভাষণে কংগ্রেস নেতাদের ব্রিটিশরাজের সঙ্গে সহযােগিতা ও আপসবাদের অভিযােগ এনে এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহ্বান জানান। অন্যদিকে বামপন্থী একাংশের ‘ঐক্য শৃংখলা’ ‘তৃতীয় ফ্রন্ট’ ইত্যাদি শ্লোগানের আওতায় তাদের দোদুল্যমানতার সমালােচনা করেন। সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী সংগ্রামের তৎকালীন গুরুত্বের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। কেননা যুদ্ধের কারণে ব্রিটিশ-সিংহ বেকায়দা অবস্থায়।
নেহরু-প্যাটেল যখন পাকিস্তান দাবির কাছে নতি স্বীকার করছেন, গান্ধি নীরব, গাফফার খান প্রবলভাবে প্রতিবাদী, তখন ওয়ার্কিং কমিটির সভায় সহকর্মীদের নীতিভঙ্গে ক্ষুব্ধ, আহত আজাদ নিঃশব্দে ঘরের এককোণে বসে ক্রমাগত সিগারেট টেনে চলেছেন মনের অস্থিরতা চাপা দিতে। রামমনােহর লােহিয়া অবশ্য এ ঘটনা অন্যভাবে দেখেছেন। আজাদ প্রতিবাদ করেননি এমন অভিযোেগ তার। কিন্তু বিষয়টার অন্য দিকও রয়েছে। ভারতের অখণ্ডতা বজায় রেখে ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ক আজাদের কোনাে প্রস্তাবই গান্ধি বা নেহরু বা কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মনঃপূত হয়নি। অবস্থাদৃষ্টে তিনি বুঝে নিয়েছিলেন যে নেহরু প্যাটেলপ্রসাদ প্রমুখ সহকর্মী সবাই ক্ষমতার জন্য অস্থির হয়ে বরাবরের নীতি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত, সেখানে তার একক প্রতিবাদ গ্রাহ্য হবে না। তাই ওই অমােঘ দিনটিতে নীরবতাই প্রশস্ত মনে করেছেন আজাদ। গান্ধিও অবস্থাদৃষ্টে প্রকাশ্যে বিরােধিতা করেন নি। তবে নেহরুকে আজাদ বলেছিলেন : “দেশভাগ মেনে নেওয়ার জন্য ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবেন। কিন্তু নেহরু সে নীতিকথায় কান দেন নি। | তার ক্ষমতার মধ্যে যতটা সম্ভব ভারতের অখণ্ডতা রক্ষায় ততটা চেষ্টা চালিয়েছেন আজাদ। এজন্য জিন্নার চক্ষুশূল ছিলেন তিনি। রামগড় কংগ্রেসে (১৯৪০) সভাপতির ভাষণে তিনি বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে। সেক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও আজাদ বরাবর কঠোর ভাবে দেশভাগবিরােধী এবং পাকিস্তান দাবি মানতে নারাজ। তাই চেষ্টা করেছেন তার সভাপতি থাকাকালীন সময়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্রিটিশ প্রস্তাবগুলাে কাটছাটের মাধ্যমে ওয়ার্কিং কমিটিতে গ্রহণ করাতে।
কিন্তু পারেননি একেকজনের বিরােধিতায়। কখনাে গান্ধি প্রায়শ নেহরু-প্যাটেল প্রমুখের কারণে। এরা তখন প্রবলভাবে দেশভাগ-বিরােধী। | অথচ শেষ দুজনের হাত দিয়েই শেষ পর্যন্ত দেশভাগ নিশ্চিত হয় জিন্নার পাকিস্তান দাবি মেনে নেওয়ার কারণে। আবারও বলতে হয়, গান্ধি তার দুই প্রিয় শিষ্যকে দেশভাগ থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করেন নি। হয়তাে গভীর অভিমান–তার মতামত না নিয়ে দেশভাগে সম্মতিদান যা শেষপর্যন্ত অন্যদের সমর্থনে গৃহীত হয়। নেহরু তখন কংগ্রেসের সভাপতি। তার সেই আলটপকা মন্তব্য, পরিবর্তে জিন্নার প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘােষণা, কলকাতা গণহত্যা ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে আজাদের নেহরু বিরূপতার অর্থ বােঝা যায় ।
তাই নিজেকে ধিক্কার দিয়েছেন। সভাপতি পদের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে নেহরুর নাম প্রস্তাব করার ঘটনা মারাত্মক ভুল’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। আর দেশভাগের জন্য পরােক্ষভাবে নিজেকেও দায়ী করেছেন। তার আত্মজীবনীর গােপন ৩০ পৃষ্ঠায় যেসব অপ্রিয় ঘটনার প্রকাশ তাতে নেহরুর সংশ্লিষ্টতা অনেক বেশি কিন্তু ওই ভুল সংশােধনের কোনাে উপায় ছিল না । ওই যে কথায় বলে : ‘পাশার দান পড়ে গেছে’, পেছন ফেরার পথ বন্ধ। নেহরুর বিভ্রান্তিকর অস্থির চিন্তার তৎকালীন শেষ উদাহরণ সম্ভবত ১৯৪৭-এ পাঞ্জাব ত্রিধা-বিভক্ত করার প্রস্তাব, সেখানে প্যাটেল তার সমর্থক আর আজাদ গান্ধি তাতে অনুপস্থিত মাউন্টব্যাটেন খুশি। বিভাজন-বিরােধী হিসাবে যিনি কথায় কথায় বলকানাইজেশনের প্রসঙ্গ তােলেন তিনি পাঞ্জাবই নয়, বঙ্গবিভাগেরও পক্ষে, যুক্তবঙ্গের বিরােধী প্রকারান্তরে জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্ব মেনে নেন নেহরু-প্যাটেল। তাই দেখে আজাদ ক্ষোভে তিক্ত, আর গান্ধি অভিমানে নীরব। পরিণামে জিন্নার জয় কিন্তু আজাদের ক্ষুব্ধ নীরবতা যুক্তিগ্রাহ্য হলেও গ্রহণযােগ্য নয়। গাফফার খানের মতাে তারও প্রতিবাদ করা উচিত ছিল । কিন্তু তিনি তা করেন নি আর গান্ধি সম্বন্ধে ভিন্নমত সত্ত্বেও নমনীয়তা ও সমালােচনা করার কারণ কি তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বলে? নাকি গান্ধির প্রতি তার নীতিগত দুর্বলতা ছিল? বিষয়টি গবেষণার যােগ্য। লৌহমানব’ নামে পরিচিত সরদার বল্লভভাই প্যাটেল, শীর্ষস্থানীয় কংগ্রেসনেতা প্যাটেল রাজনৈতিক মতাদর্শে রক্ষণশীল ও হিন্দুত্ববাদী ঘরানার এ হিসাবে কংগ্রেসের উদারপন্থীদের চেয়ে রক্ষণশীলদের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর। তার চিন্তাভাবনা গভীরভাবে সমাজবাদ-বিরােধী। সম্প্রদায়বাদী বলে তার বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিল। এর প্রমাণও মিলেছে স্বাধীন ভারতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে তার কর্মকাণ্ডে, বিশেষ করে দিল্লি দাঙ্গা দমনে উদাসীনতায় যা গান্ধিকে পীড়িত করেছে। তবু গান্ধি এই প্রিয় শিষ্যের প্রতি কঠোর হতে পারেন নি। বরং ক্ষুব্ধ হয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে পরােক্ষে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
তাতে কাজ হয়নি, বরং নিজের প্রাণ দিতে হয়েছে শিষ্যের উদাসীনতায়। কংগ্রেস-সভাপতি পদের জন্য যথেষ্ট আকাক্ষা পােষণ করেও প্যাটেল প্রকাশ্য বিদ্রোহে নিজেকে সমালােচনার যােগ্য করে তােলেন নি। যা করেছেন নেপথ্যে থেকেই । কূটবুদ্ধিতে নেহরুকে পরাজিত করে শেষ চালে দেশভাগের প্রস্তাব গ্রহণের সব ব্যবস্থা পাকা করেন। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির দক্ষিণপন্থীরা তখন তার পক্ষে। ভাইসরয় লুইস মাউন্টব্যাটেন পর্যন্ত তার মতামত আমলে নিচ্ছেন। ভি.পি. মেননকে দূত হিসাবে ব্যবহার করছেন প্যাটেলের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা এবং তার মতামত সপক্ষে আনার জন্য। এ ব্যাপারে সফলও হন মেননের দু-দিক-কাটা কূটবুদ্ধির চালে। ভারতবিভাগ প্রকৃতপক্ষে প্যাটেলের ইচ্ছাতেই সম্পন্ন হয়। সেখানে আজাদের ভূমিকা হিসাবে আনার মতাে নয়। এমনকি নেহরুও দোটানার মধ্যেই শেষ পর্যন্ত ব্যাটেন ও প্যাটেলের সঙ্গে একমত হন । প্যাটেলের রাজনৈতিক রক্ষণশীলতা শুধু তার সম্প্রদায়বাদী ঘটনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না । সব চেয়ে বড়াে প্রমাণ ভারতীয় নৌসেনাদের ব্রিটিশ বিরােধী বিদ্রোহ দমনে ও শেষ মুহূর্তে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গে যা কারাে কারাে। বিশ্লেষণে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র শামিল। গান্ধি এ দায়িত্ব কংগ্রেসের তরফ থেকে প্যাটেলকেই দিয়েছিলেন। গান্ধি নিজেও ওই বিদ্রোহের পক্ষে ছিলেন না। এক্ষেত্রে নেহরুর পরিবর্তে প্যাটেলকেই যােগ্য বিবেচনা করেছিলেন । জিন্না এই প্রথম একটি ক্ষেত্রে প্যাটেলের সঙ্গে এক কাতারে । আর প্যাটেলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমাজবাদ-বিরােধী সমাপন তেলেঙ্গানার (তৎকালীন দেশীয় রাজ্য হায়দারাবাদের অন্তর্গত অঞ্চল) কৃষক বিদ্রোহবিরােধিতা এবং পরে স্বাধীন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে তা কঠোর হাতে দমন করা। এসব ক্ষেত্রে, এমন কি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমনের ক্ষেত্রেও তিনি প্রধানমন্ত্রী নেহরুর মতামত বা পরামর্শ যে কানে তােলেন নি ইতিহাস তেমন তথ্যই লিপিবদ্ধ করে রেখেছে। তার রাজনৈতিক আকাক্ষাপূরণ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে যেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রী নেহরুর চেয়েও ক্ষমতাধর ।
তাই আবেগপ্রবণ জাতীয়তাবাদী ও দোদুল্যমান সমাজবাদী জওহরলাল নেহরুর চেয়ে রাজনৈতিক শক্তি সামর্থ্যে প্যাটেল অনেকাংশে দড়। শীর্ষ কংগ্রেসীদের সমর্থনও ছিল তার দিকে। নেহাৎ গান্ধির সমর্থনের জোরে নেহরু কংগ্রেসে দু’নম্বর নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ গান্ধির পরই নেহরু। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরের শেষদিককার ঘটনাবলীতে দেখা যায় দাবার ছকে রাজার পরেই প্যাটেল, মন্ত্রী’ নামের খুঁটি। সেই ক্রান্তিকালে কংগ্রেস রাজনীতিতে সরদারজীই দু’নম্বর নেতা, এমন কি শেষ চালে তিনি গান্ধিকেও ছাড়িয়ে গেছেন। ধীর স্থির, স্বল্পবাক প্যাটেল। এমতাবস্থায় মাওলানা আজাদের সাধ্য কি প্যাটেলপন্থীদের বিপরীতে তার মতামত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে প্রতিষ্ঠিত করেন। বরং ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্নমত সত্ত্বেও ওয়ার্কিং কমিটির মতামত তাকে মানতে হয়েছে, সভাপতিপদে থাকা না-থাকা উভয় পরিস্থিতিতে। তাই কংগ্রেস নেতৃত্বে আজাদের অবস্থান। কত নম্বরে তা নির্ধারণ করা খুব কঠিন। তার আদর্শবাদ-নিষ্ঠা, গভীর অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি কারণে তিনি কংগ্রেস-সভাপতি হতে পেরেছিলেন। সেক্ষেত্রেও কংগ্রেসে তার মতামতের প্রভাব কমই ছিল। তুলনা চলে আরেক কংগ্রেস নেতা যার নামে দিল্লির আনসারিনগর, সেই ডা. এম, এ, আনসারির সঙ্গে। এমন মূল্যায়ন অপ্রিয় শােনালেও সর্বভারতীয় ভিত্তিতে কংগ্রেস রাজনীতির জন্য সত্য। সত্য হিসাবে দেখা গেছে অংশত চিত্তরঞ্জন ও সুভাষচন্দ্রের ক্ষেত্রে। আনসারি-আজমল-আজাদদের অবমূল্যায়নের মাশুল দিতে হয়েছে কংগ্রেসকে ভারতমাতার অঙ্গচ্ছেদের মাধ্যমে । কালক্ষণের বিচক্ষণতা ও পরিণামদর্শিতায় অবাঞ্ছিত দেশভাগ এড়ানাে সম্ভব ছিল। কিন্তু তেমন পরিচয় কংগ্রেস এই বিশেষ ক্ষেত্রে রাখতে পারেনি। তাই দেশবিভাগ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক