You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভাঙনের প্রতিক্রিয়ায় বিপন্ন দেশ

ভাইরসয় ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ভারতবিভাগ ও ভারতত্যাগের জুন ঘােষণার পরিপ্রেক্ষিতে উৎফুল্ল ভিপি মেনন লিখেছেন, ‘প্রগতিশীল বিশ্বমতামত জুন ঘােষণাকে সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে অভিনন্দন জানিয়েছে। খ্যাতনামা মার্কিনি সাংবাদিক ওয়াল্টার লিপম্যান ওয়াশিংটন পােস্ট-এ প্রকাশিত মন্তব্য প্রতিবেদনে অ্যাটলি ও মাউন্টব্যাটেনের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা ও স্বচ্ছতার প্রশংসা করেছেন’ (পৃ. ৩৮৩)। কিন্তু এর নেপথ্য ভয়াবহতা সম্বন্ধে বােধহয় সাংবাদিক মহােদয়ের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। ঘােষণার আপাত সদর্থক দিকটাই সবার বিবেচনায় প্রাধান্য পেয়েছিল । ব্রিটিশরাজের লক্ষ্য ছিল শান্তিপূর্ণ প্ররিবেশে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ভারতত্যাগ করা যাতে ভারতে ব্রিটেনের শিল্প-বাণিজ্য স্বার্থের কোনাে ক্ষতি না হয়। সেজন্যই ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের মূল উদ্দেশ্য ছিল যাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ক পদক্ষেপের স্বীকৃতি তাদের খাতায় লেখা হয়, আর মন্দ যা কিছু তার দায় ভারতীয় রাজনীতিকদের কাঁধে বর্তায়। তাই তাদের ভয় সাম্প্রদায়িকতার দানব (যা তাদের দানা-পানিতেও লালিত-পালিত) সব হিসাব যেন ভুল করে না দেয়।  এ প্রসঙ্গে সুনীতিকুমার ঘােষ ভিন্ন তথ্য যােগ করেছেন এই বলে যে, একই সঙ্গে কমিউনিজমের আতঙ্কও তাদের ছিল। ক্ষমতা হস্তান্তরে বেশি দেরি হলে গৃহযুদ্ধেরই নয়, হয়তাে কোনাে অবাঞ্ছিত শক্তির হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে চলে। যেতে হতে পারে। কিন্তু এ ভয় নিতান্তই অমূলক ছিল। কারণ ভারতে সমাজবাদী রাজনীতি তখন তাে নয়ই এখনাে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে তেমন শক্তি অর্জন করতে পারেনি। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অঙ্গনে সম্প্রদায়বাদী শক্তিই প্রবল ও আত্মঘাতী। লক্ষ্য পছন্দসইভাবে ক্ষমতার রশি মুঠোয় নেয়া। সুনীতিকুমার মনে করেন মাউন্টব্যাটেন যে পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তর পরিকল্পনা ঘােষণা এবং সিরিল র্যাডক্লিফকে দিয়ে বিভক্ত অঞ্চলের সীমানা নির্ধারণের সময় ও তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সেই অদূরদর্শিতাই  পাঞ্জাবে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের মূল কারণ। তিনি আরাে লিখেছেন, নেহরু ও জিন্নার ক্ষমতা হাতে পাওয়ার তাড়াহুড়াে এবং লাখ লাখ মানুষের জীবনের প্রতি উন্নাসিক অবহেলাও এর কারণ (ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য রাজ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩০৭-৩১০)। 

আসলে রাজের পক্ষে প্রশাসনিক অবহেলা ও রাজনীতিকদের ক্ষমতার লােড ও অপরিণামদর্শিতা উল্লিখিত বিপর্যয়ের মূল কারণ । মনে রাখতে হবে পাঞ্জাব হিংস্রতার সূচনা জুন ঘােষণার আরাে আগে, তেমনি সীমান্ত প্রদেশে মুসলিম লীগের রাজনৈতিক সন্ত্রাস শুরু। লক্ষ্য ক্ষমতা দখল। প্রাদেশিক রাজধানী লাহােরের রাজপথ থেকে বিশেষ বিশেষ শহরে ও স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এতটা তীব্র হয়ে ওঠে যে, শেষ পর্যন্ত অস্থির মুখ্যমন্ত্রী খিজির হায়াত খান পদত্যাগ করেন সহিংসতা বন্ধ করতে (৩ মার্চ, ১৯৪৭)। লড়াকু রাজনৈতিক নেতাদের উত্তেজক বক্তৃতা, উন্মত্ত জনতার নর-নারী হত্যা, বাড়িঘর, দোকানপাট এমনকি মানুষজনও পুড়িয়ে ছাই করার মতাে নৃশংসতা অবিশ্বাস্য রূপ ধারণ করেছিল। বিশেষ করে লাহাের, অমৃতসর, রাওয়ালপিন্ডি ও আরাে বিভিন্ন স্থানে এমনকি গ্রামাঞ্চলে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি । বিপর্যয়ের আঘাত প্রধানত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কেই বহন করতে হয়। কারণ আর কিছু নয়, পাঞ্জাবে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠন ও শাসনযন্ত্র দখল। তবে জিন্নার সে আশা পূরণ হয়নি। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার প্রয়ােজনে গভর্নর ইভান জেনকিন্স ৯৩ ধারাবলে ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেন।  ব্যাপক সহিংসতা বন্ধ হলেও বিক্ষিপ্ত ঘটনা চলতে থাকে। যেমন শহরে, তেমনি গ্রামাঞ্চলে। এর দায় অবশ্যই মুসলিম লীগের। এ সময় ১৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত গভর্নরদের বৈঠকে পাঞ্জাবের গভর্নর ভাইসরয়কে স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন যে, পাঞ্জাব যদি বিভক্ত হয় তাহলে গৃহযুদ্ধ বন্ধ করতে চার ডিভিশন সৈন্য দরকার হবে (হডসন, পৃ. ২৭৩)। জবাবে ভাইসরয় বলেন, দলীয় নেতাদের সাহায্য নিয়ে এর সমাধান করা হবে যত সহজে গুরুতর একটি প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন ভাইসরয়, সমাধান মােটেই তেমন সহজ ছিল না। ইতিমধ্যেই দিল্লি, কলকাতা ও নানা স্থানে হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেছে। কারণ সম্ভবত ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা এবং নেতাদের দায়িত্বহীন বিবৃতি ও সংবাদপত্রের একই রকম ভূমিকা। সেকালের ঘটনাদৃষ্টে মনে হয় দুষ্ট সাংবাদিকতা রক্তাক্ত হাঙ্গামার সূচনায় যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল। তাই দরকার ছিল কঠোর পূর্বব্যবস্থাপনা ও নিরপেক্ষ তৎপরতা। সেটা বিঘ্নিত হয়েছে শৃঙ্খলারক্ষক বাহিনীর সদস্য কারাে কারাে সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতদুষ্ট আচরণে  একমাত্র ভরসা সেনাবাহিনী।

সেক্ষেত্রে ভাইসরয় ও প্রশাসনের নানা অজুহাত গ্রহণযােগ্য মনে হয় না। তাই পাঞ্জাবে হত্যা ও নারী নির্যাতনের মহােৎসব শুরু হয়ে যায়, উপলক্ষ যত ছােটই হােক । প্রয়াত পাঞ্জাবি মুখ্যমন্ত্রী সিকান্দার হায়াত খানের মন্তব্য এত তাড়াতাড়ি ভবিষ্যদ্বাণীর ভয়াবহ বাস্তবতা নিয়ে দেখা দেবে তেমন ভাবনা বক্তা বা শ্রোতা পেন্ডেরেল মুন কারাের ধারণায়ই হয়তাে ছিল না। দুর্বোধ্য কারণে প্রশাসন সেনাবাহিনী ব্যবহারে আগ্রহ দেখায়নি। এটা কি বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণােদিত? অবস্থার ভয়াবহতা দেখে ২৩ জুন জিন্নার অনুরােধ লাহাের। ও অমৃতসরে সহিংসতা বন্ধ করতে চরম কঠোরতা অরলম্বনের জন্য। পরদিন নেহরুর একই কথা। তিনি শহরগুলাের নিরাপত্তা সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার পরামর্শ দেন। প্রয়ােজনে সামরিক আইন জারি (হডসন)। অর্থাৎ যে দানব রাজনৈতিক নেতাদের হাতে তৈরি ও ব্রিটিশ ভেদনীতিতে পরিপুষ্ট তাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অন্তত নেতাদের ছিল না। অন্যদিকে কৌশলগত কারণ দেখিয়ে, সামরিক বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কমান্ডাররা মার্শাল ল’ জারি তথা চরম ব্যবস্থা নেয়ার বিপক্ষে গভর্নরকে পরামর্শ দেন। প্রশাসনের এ জাতীয় আচরণে ক্ষুব্ধ লীগ ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ। কিন্তু ঘটনার সূত্রপাত তাে প্রতিক্ষেত্রে তাদের অনুসারীদের হাত দিয়ে, কখনাে তাদের কোনাে অর্বাচীন নেতার উত্তেজক বিবৃতিতে। হড়সনের মতে, জুন ঘােষণার পর জুলাই হাঙ্গামা শিখদের হাত দিয়ে শুরু হলেও এর আগে রাওয়ালপিন্ডিতে তারা মুসলমানদের হাতে ভয়াবহ আক্রমণের শিকার। মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ জনতাকে শান্ত করতে কোনাে উদ্যোগ নেয়নি।  শিখদের প্রচণ্ড উদ্বেগ সীমানা কমিশনের কর্মকাণ্ড নিয়ে । শিখ নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতিও ছিল রীতিমতাে উত্তেজক। কেন্দ্রীয় সরকারের সদস্য বলদেব সিং থেকে জ্ঞানী কর্তার সিং, কারাে বক্তব্যে সংযমের লেশমাত্র ছিল না। এমনকি মাস্টার তারা সিংয়েরও নয়। এসব কিছুর মূলে পাঞ্জাব ভাগ এবং তাতে শিখদেরই সর্বাধিক ক্ষতির সম্ভাবনা। সেজন্য তারা নাশকতামূলক। তৎপরতারও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।  পাঞ্জাবকাণ্ডের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের অভিযােগ ছিল শ্বেতাঙ্গ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে গভর্নর জেনকিন্স ঘটনার জন্য দায়ী ও অভিযুক্ত করেন লীগ, কংগ্রেস ও আকালি (শিখ) দলের নেতাদের, তাদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও তৎপরতার জন্য। অভিযুক্তদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় সরদার বলদেব সিং, সরদার বল্লভভাই প্যাটেল, লিয়াকত আলী খান, গজনফর আলী খান প্রমুখ ব্যক্তির নাম। সাংগঠনিকভাবে এদের তিনটি দলকেও সহিংসতার জন্য দায়ী করা হয় । 

  গভর্নর জেনকিন্সের প্রতিবেদন বিশ্বাস করলে বলতে হয় ঘটনা নিঃসন্দেহে ভয়াবহ। মােট ৫ হাজার নিহত, তার মধ্যে ৩৮০০ অমুসলমান অর্থাৎ হিন্দু ও শিথ, বাকি ১২০০ মুসলমান। গুরুতর আহত ৩ হাজার। এদের মধ্যে মুসলমান বনাম অমুসলমানের অদ্ভুত সংখ্যাসাম্য । ঘড়ির কাঁটা যতই ১৫ আগস্টের দিকে এগিয়েছে, পরিস্থিতি ততই অবনতির দিকে দ্রুত গড়িয়েছে। ক্ষুব্ধ শিখরা অমৃতসরকে কেন্দ্র করে যে সশস্ত্র লেঠেল বাহিনী গঠন করে তাদের কাজ ছিল প্রতিরাতে কিছুসংখ্যক নিরপরাধ মুসলমান গ্রামে হামলা। হডসনের বিবরণ মতে, পার্টিশন কাউন্সিলের পরামর্শমাফিক পাঞ্জাব হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে পয়লা আগস্ট (১৯৪৭) বিশেষ সামরিক কমান্ড গঠন করা হয় (নাম ‘পাঞ্জাব সীমানা বাহিনী’)। মেজর জেনারেল রিজ এর প্রধান। এদের কাজ শুরু হতে হতে কাটাকুটির মধ্যেই ১৫ আগস্ট এসে যায়। এরপর এই বাহিনী নিয়ে দুপক্ষের প্রবল আপত্তি দেখা দেয়। আশ্চর্য যে ভারতবর্ষ-বিভাগ। ও ক্ষমতা হস্তান্তর বীভৎস সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধ করতে পারেনি। পারস্পরিক ঘৃণা-বিদ্বেষ অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতার জন্ম দেয় এবং তা তিন পক্ষেই । খাজা আহমদ আব্বাস, কৃষাণ চন্দর প্রমুখের লেখা অসাধারণ দাঙ্গাগল্প ও সাদাত হাসান মান্টোর অনুরূপ বিভাজনবিরােধী ছােটগল্প ‘টোবাটেক সিং এবং ফয়েজ আহমদ ফয়েজ প্রমুখের কবিতা আমাদের সামপ্রদায়িকতা ও বিভেদ মানসিকতার অপর দিক তুলে ধরে। যদিও সমাজের অধিকাংশ দূষিত হয়ে যায় সম্প্রদায় রাজনীতির পকির্চক্রে। এ দূষণ এমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে যে তখন কোনাে সম্প্রদায়েরই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আর মানুষ ছিল না। তারা আত্যন্তিকভাবে হয় হিন্দু না হয় মুসলমান বা শিখ। জেনারেল রিজ সহিংসতার যে ভয়াবহ বিবরণ দিয়েছেন তা পাঠ করে সুস্থ থাকা কঠিন। শুধু পুরুষ, নারী, শিশু খুন করে এরা সন্তুষ্ট থাকেনি, মানবদেহের প্রতি বিন্দুমাত্র মানবিক শ্রদ্ধা বা মমত্ববােধ তাদের ছিল না। হিংসা ও প্রতিহিংসা এমন উন্মত্ততার প্রকাশ ঘটিয়েছিল। এ পরিস্থিতি, সন্দেহ নেই।

রাজনৈতিক নেতাদের দান । তবে ‘জনমানসে হত্যা ও ঘৃণার এ বন্য উন্মত্ততা সামরিক তৎপরতার সাহায্য প্রতিহত করা যেত না’ (পৃ. ৩৪৫) এমন ধারণা কি যুক্তিসঙ্গত? ভারতবিভাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তর পর্বের আগে একই সময়ে ও অব্যবহিত পরে মানবতাবিরােধী গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও নারী নির্যাতনের যে বীভৎস ইতিহাস রচিত হয়েছিল, বিশেষ করে ১৯৪৬-৪৭-এ তার তুলনা বিরল। বলার অপেক্ষা   রাখে না যে, ভারতীয় রাজনীতিকদের পাশাপাশি শাসক ব্রিটিশরাজও এর জন্য দায়ী । ভাঙনের শেষ পর্বে এর ভয়াবহতা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌছে, বিশেষ করে পাঞ্জাবে, সীমান্তে এবং বিহারসহ ভারতের একাধিক প্রদেশে, শহরে-নগরে, কখনাে গ্রামাঞ্চলে। ইতিহাস-লেখক অনেকে এই ‘মানবিক ট্র্যাজেডি’র জন্য ভাইসরয়দের, বিশেষ করে শেষ পর্বে ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনকে দায়ী করেছেন। সম্প্রতি প্রবীণ সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার তার আত্মজীবনীতে একই কথা বলেছেন এমন মন্তব্যে যেখানেই ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটেছে সেখানেই দেখা গেছে রক্তপাত।’ অর্থাৎ স্বাধীনতার জন্য এটুকু মাসুল দিতেই হয়েছে। যে দ্রুততার সঙ্গে ভাইসরয়ের কাজ শেষ করার তাগিদ তার ফলে সৃষ্ট আতঙ্ক, অবিশ্বাস ও অনিশ্চয়তা এ জন্য দায়ী। সুনীতিকুমারসহ আরাে কেউ কেউ এমন ধারণার সঙ্গে একমত হলেও হডসন যেন পুরােপুরি তাতে সায় দেন না। তবে কুলদীপ নায়ার (যিনি একজন মৃত্তিকাঘনিষ্ঠ পাঞ্জাবি) স্পষ্ট ভাষায়ই এই নারকীয় তাণ্ডব রােধ করতে না পারার জন্য ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনকে দায়ী করেছেন তিনি কথা রাখেননি’ এমন অভিযােগ তুলে। ভাইসরয় মাওলানা আজাদকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধানে তিনি সশস্ত্র পুলিশ, প্রয়ােজনে স্থলসেনা, বায়ুসেনা, ট্যাঙ্ক কিংবা বায়ুন ব্যবহার করার নির্দেশ দেবেন। এ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনি কাজ করেন নি,, ৫৮)। কুলদীপ নায়ার আরাে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘সীমানা বাহিনীর প্রতিবেদনে যেখানে নারকীয় উন্মত্ততার প্রকাশ স্পষ্ট, সেক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গ পরিচালিত সে বাহিনী কেন কঠোর হাতে নিরপরাধ মানুষ হত্যা বন্ধ করতে তৎপর হয়নি। তার ভাষায় দায়িত্ব পালনে এ অবহেলার ব্যাখ্যা মেলে না। এমনকি ১৪ আগস্ট সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ফিল্ড মার্শাল অচিনলেক লাহােরে গিয়ে জেনারেল রিজ ও গভর্নর জেনকিন্সের সঙ্গে পাঞ্জাবে সামরিক আইন জারি সম্পর্কে দীর্ঘ আলােচনার পরও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তাদের কাছে খুঁটিনাটি সমস্যা মানুষের প্রাণের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছিল। তাদের কি উদ্দেশ্য ছিল বিভক্ত ভারতের দুদেশের মধ্যে, জনগণের মধ্যে বিদ্বেষ-বিরূপতা চিরস্থায়ী হয়ে থাকুক এবং সবই তাদের স্বদেশ ও স্বজাতির স্বার্থে।

শুধু গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞেই দেশভাগের উপসর্গ সীমাবদ্ধ ছিল না। এর সঙ্গে বড় একটি বিপর্যয় বাস্তুত্যাগ-অবিশ্বাস্য উদ্বাস্তু মিছিল ছিন্নমূল মানুষের।তারা কোথায় যাচ্ছে, কীভাবে থাকবে কিছুই জানা নেই। শরণার্থী শিবির? শুরুতে এর দুরবস্থা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিমাত্রেরই জানা। এ বিষয় নিয়ে মানবিক সাহিত্যের পরিমাণ খুব কম নয়। এ যাত্রা, এ কাফেলা শুরু হয় ৩ জুনের ঘােষণার পর থেকে। পাঞ্জাবেই নয়, বঙ্গে, বিহারে এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক নেতাদের প্ররােচনা অনেকাংশে দায়ী। একথা হডসন যদিও বলেছেন পাঞ্জাব সম্পর্কে, কিন্তু অংশত এটা সত্য বাংলাদেশ (পূর্ববঙ্গ) সম্পর্কেও । তবে প্রধানত পাকিস্তান আতঙ্ক, মুসলিম শাসনের ভয় ও অনিশ্চয়তাই সচ্ছল মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান হিন্দুদের পূর্ববঙ্গ ত্যাগের কারণ। ভারতভাগ যেমন ধর্মের ভিত্তিতে, পাঞ্জাব ও বঙ্গদেশভাগও সেই একই ভিত্তিতে, বিভক্ত স্বাধীনতা নিয়ে খুশি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, খুশি সাধারণ মানুষও। সাধারণ মানুষের খুশি হওয়ার কারণ বিদেশি শাসনের অবসান, নেতাদের আনন্দ ক্ষমতা হাতে পাওয়ার কারণে । স্বাধীন বাংলা নিয়ে কিছুটা দেনদরবার চলে সােহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও শরৎ বসু, কিরণশঙ্কর রায়ের চেষ্টায় । কিন্তু নেহরুর কঠিন বিরােধিতা ও পশ্চিবঙ্গের হিন্দু জনমতের আপত্তির কারণে এ প্রচেষ্টা হালে পানি পায়নি। বিষয়টা পরে বিবেচ্য। বিভক্ত না হয়েও ভারতবিভাগের কারণে রাজনৈতিক জটিলতায় আক্রান্ত হয়েছিল উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। স্বাধীনতাপ্রিয়, স্বাতন্ত্র্যবাদী সীমান্ত প্রদেশের পাঠান জনগােষ্ঠী মূলত খান ভ্রাতাদের রাজনীতির টানে তাদের প্রতি সমর্থন জোগায়। কংগ্রেস সমর্থন নিয়ে খান সাহেব ১৯৩৭ থেকে মন্ত্রিসভা গঠন করে শাসন কাজ চালিয়ে এসেছেন। জাতীয়তাবাদী মুসলমান হিসেবে তাদের রাজনৈতিক পরিচয়।

জিন্না অনেক চেষ্টা করে, এমনকি ১৯৪৬-৪৭ সালে আইন অমান্য আন্দোলন করেও পাঞ্জাবের মতাে সীমান্ত মন্ত্রিসভার পতন ঘটাতে পারেননি। কিন্তু মাউন্টব্যাটেনের কল্যাণে ও কংগ্রেসের ভারতবিভাগ এবং পাকিস্তান দাবি মেনে নেয়ার কারণে খানভাইদের (খুদাই খিদমতগার/লালকুর্তা) সেকুলার রাজনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। কংগ্রেস কমিটির বৈঠকে প্রবল আপত্তি জানান দুই ভাই খান সাহেব ও আবদুল গাফফার খান। কিন্তু তাতে কোনাে কাজ হয়নি। বাদশা খানের আপত্তির কথাটি বিভিন্ন জনের লেখায় একাধিকভাবে এসেছে। যেমন কংগ্রেস দেশবিভাগ মেনে নিয়ে জাতীয়তাবাদী পাঠানদের নেকড়ের মুখে ফেলে দিয়েছে (ঘঘাষ, সরকার)। অন্যদিকে কুলদীপ। নায়ার লিখেছেন কংগ্রেস বৈঠকে বাদশা খানের মিনতি : দেশভাগ মানার অর্থ।   আমাদের সর্বনাশ (‘হাম তাবা হাে গেয়ে’)। তার প্রশ্ন : শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান গঠনের জন্যই কি আমাদের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম? কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে তখন শাসন-আসন-কর্তৃত্ব অর্জনই একমাত্র লক্ষ্য। তাই পাঞ্জাবি (শিখ হিন্দু) বা বাঙালি বা পাঠানদের স্বদেশভূমির দাবি নেহরু-প্যাটেল প্রমুখ কংগ্রেসির চিত্তে কোনাে দাগ কাটেনি। দাগ কাটেনি ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের বিবেচনাতেও। গাফফার খানের স্বাধীন ‘পাখতুনিস্তানের দাবিও ভাইসরয় নাকচ করে দেন তার ভারতবিভাগ পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতিহীন এমন এক যুক্তিতে  বরং তাদের ওপর চাপিয়ে দেন জনমত যাচাই : ‘ভারত না পাকিস্তান’ কোন ডােমিনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হবেন। সীমান্তের পাঠানগণ । এই সুযােগে মুসলিম লীগের ব্যাপক প্রচার : হিন্দুস্তান। পাকিস্তান’- কাকে বেছে নেবে পাঠানগণ । প্রবল ধর্মীয় প্রচারণার মুখে লালকুর্তা দল গণভোেট বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, উপস্থিত প্রায় ৫০ শতাংশ পাঠান ভােটারদের অধিকাংশ পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন জানায়। ধর্মীয় প্রচারণার এমনই মহিমা। তবে এখানে অন্য সমস্যাও ছিল।  যেমন ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, তেমনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ। খান ভাইদের পছন্দ করতেন না ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন । তাই সীমান্তের গভর্নরের বিরুদ্ধে একদেশদর্শিতার অভিযােগ সত্ত্বেও ভাইসরয় তার প্রিয়পাত্রকে সরিয়ে আনেননি। তবে সীমান্ত প্রদেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অশান্তি (মুসলিম লীগের সৃষ্ট) এবং ভবিষ্যৎ গণভোটের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি লে. জেনারেল রীজ লকহার্টকে স্যার ওলাফের স্থলভিষিক্ত করেন। প্রকাশ্য যুক্তি গণভােট যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয় ।

হডসন এ প্রসঙ্গে মাউন্টব্যাটেনের ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার প্রশংসা করেছেন। তবে হয়তাে ইতিহাসের স্বার্থে উল্লেখ করতে ভােলেননি পেশােয়ারে অবস্থানকালে মধ্যরাতে তাকে জিন্নার হুমকির কথা। তার এক লাখ প্রতিবাদী অনুসারীর মিছিল করে পেশােয়ার গভর্নমেন্ট হাউস ঘেরাও করার হুমকি। ভাইসরয় ভয় না পেলেও এ ঘটনা নিশ্চয়ই জিন্নার ক্ষমতা সম্পর্কে তাকে প্রভাবিত করে থাকবে। তিনি তাদের দুজন প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করতে রাজি হন। এমনকি তিনি তাদের এবং মুসলিম লীগ নেতাদের আশ্বস্ত করেন এই বলে যে, তার ওপর তারা আস্থা রাখতে পারেন। যেমন রেখেছেন তাদের নেতা জিন্না। নেহরু-কংগ্রেসের আস্থাভাজন ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন স্পষ্টতই দ্বিমুখী খেলায় ক্ষেত্রবিশেষে জিন্নারও আস্থাভাজন হয়েছেন। বিশেষ করে ভৌগােলিক  দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে তার ভিন্নযাত্রায়। সম্ভবত এর কারণ। একদিকে আফগানিস্তানকে নীতিগতভাবে দূরে সরিয়ে রাখা এবং সে কারণেই স্বাধীন পাখতুনিস্তান দাবি অগ্রাহ্য করা ও ধর্মীয় চেতনার মুসলিম লীগ রাজনীতির মাধ্যমে এ অঞ্চলকে বলশেভিক স্পর্শ থেকে দূরে রাখা। এ বিষয়ে ভাইসরয় সম্ভবত নিরপেক্ষ ছিলেন না। সাম্রাজ্যবাদীর পক্ষে তা সম্ভব নয় । গণভােটের ঘটনাবলি থেকেও তেমন প্রমাণ মেলে। ঘটনা স্পষ্টই বলে দেয় মাউন্টব্যাটেন জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্ব তথা ধর্মীয় ভিত্তিতে ভারত ভাগ করেছিলেন। অবশ্য একই নীতিতে বঙ্গ ও পাঞ্জাব ভাগ করেন জিন্নার আপত্তি সত্ত্বেও। উদ্দেশ্য কংগ্রেসের সামান্য ক্ষতিপূরণ  কিন্তু প্রশ্ন থাকে কংগ্রেস বরাবর ধর্মভিত্তিক বিভাজনের নীতিগত বিরােধী হয়েও কেন শেষ পর্যন্ত ওই পথে পা বাড়াল, অখণ্ড ভারতের দাবি ছেড়ে দিয়ে। এমনকি প্যাটেলদের মতাে রক্ষণশীল সনাতনপন্থীরাও একই হাতির পিঠে সওয়ার । ইতিহাস লেখকদের মতে, জিন্নার অনড় পাকিস্তান দাবির বিপরীতে শাসক সমর্থনের বাইরে তাদের জন্য আর কোনাে বিকল্প ছিল না। খণ্ডিত ভারতেও শক্তিশালী কেন্দ্র, দুর্বল প্রদেশ ইত্যাদি ছিল তাদের জন্য বিশেষ প্রাপ্তি। বিড়লা প্রমুখ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদেরও ছিল এমনই এক বিভক্ত ভারতের দাবি  উঠতি মুসলিম পুঁজিপতিদের দূরে সরিয়ে শিল্প বাণিজ্যে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। কংগ্রেসপুঁজিপতি-ব্রিটিশরাজ এই তিন ক্ষেত্রে পরস্পর-নির্ভর শক্তি। এদের সঙ্গে হাত মিলায় সাম্রাজ্যবাদী আমলা-বুদ্ধিজীবী ।এবার সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে কথা পূর্ব প্রসঙ্গে  হডসন এ বিষয়ে খুব ভালাে রকম সাফাই গেয়েছেন একদিকে মাউন্টব্যাটেন অন্যদিকে জিন্না ও মুসলিম লীগের পক্ষে, নেপথ্যে পাঠানদের ধর্মনিষ্ঠা নিয়ে। সীমান্তের পাঠানরা যদি অন্ধ ধর্মনিষ্ঠই হবেন তাহলে দুদুটো নির্বাচনে (১৯৩৭, ১৯৪৬) গাফফার খানের দল জেতে কীভাবে?

বিশেষ করে ১৯৪৬ সালের পাকিস্তান ইস্যুর জোয়ারি হাওয়ার মুখে, যখন পাঞ্জাবে ইউনিয়নিস্ট পার্টি লীগ হামলায় ঘায়েল? তাই ঘটনার ভেতরে যেতে হয় রহস্য বুঝতে । কেন গণভােট, কেন বিশেষ জিন্নাপ্রীতি, কীভাবে লালকুর্তাদের পিছু হটানাে যাবে ইত্যাদি নিয়ে।  এ বিষয়ে ওয়ালি খানের গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘ফ্যাক্টস আর ফ্যাক্টস’ কিছুটা সাহায্যে আসবে। লন্ডনের বিখ্যাত ইন্ডিয়া অফিসের মহাফেজখানা থেকে সংগৃহীত তথ্যাদির ওপর নির্ভর করে লেখা এ বইয়ের তথ্যাদির ওপর নির্ভর করা চলে। আগেই বলেছি সীমান্ত প্রদেশের ভৌগােলিক গুরুত্বের কথা   ভারতের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমের গিরিপথগুলাে চীন, রাশিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে যােগাযােগের একমাত্র মাধ্যম হওয়ায় সীমান্ত প্রদেশের রাষ্ট্রনৈতিক গুরুত্ব অধিক । বিশেষ করে ব্রিটিশ শাসকদের বলশেভিক-আতঙ্কের কারণে। উত্তর-পশ্চিমের গােটা বলয়টি মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল বলে এদিককার রাষ্ট্রনৈতিক তাত্ত্বিক পাহারা জোরদার করতে ইসলাম ও মুসলিম লীগ এই দুয়ের প্রয়ােজন হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক বিবেচনায় এ অঞ্চলে ব্যতিক্রমী ধারা পাঞ্জাবের সেকুলার ইউনিয়নিস্ট পার্টি এবং সীমান্তের খুদাই খিদমতগাররা। নাম থেকে বােঝা যায় এরা ধর্মহীন নন, বরং আল্লাহর নিষ্ঠাবান সেবক। কিন্তু বাদশা খানের ধর্মীয় বিদ্বেষহীন চেতনার অনুসারী  সেই সঙ্গে দাসত্বহীনতায়ও বিশ্বাসী। এদের বাগে আনতে না পারলে দরকার পড়বে যড়যন্ত্র ও চতুর রাজনৈতিক খেলার এ চেষ্টাই বরাবর করে গেছে ব্রিটিশ শাসন। সব সময় যে সফল হয়েছে তা নয় নির্বাচনগুলাে তার প্রমাণ মন্ত্ৰীমিশনের গ্রুপিংও পাখতুনদের পছন্দসই ছিল না। পাঞ্জাবের সঙ্গে যুক্ত হওয়া মানে শক্তিমান পাঞ্জাবি শাসনে থাকা যা স্বাধীনতাপ্রিয় পাঠান বা বালুচরা চায়নি। তাই জুন-ঘােষণা বা ভারতবিভাগের বিরােধী হয়ে দাঁড়ায় সীমার্ল্ডের পাঠান। পাকিস্তান মানে পাঞ্জাবি শাসন। বিষয়টি এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে, কংগ্রেস-প্রীতির দিক থেকে নয়। পাঠানদের পাকিস্তানবিরােধিতার মূল কারণ পাঞ্জাবি শাসনের আশঙ্কা। কংগ্রেস তরফে মাউন্টব্যাটেনের ভারতভাগ ও পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণ গাফফার খানদের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে হয়েছে। কারণ এ প্রস্তাব গ্রহণের অর্থ সীমান্তের পাঠানদের মুসলিম লীগ, বিশেষ করে জিন্নার প্রতিশােধ স্পৃহার মুখে ঠেলে দেয়া। কংগ্রেস আত্মস্বার্থে এ কাজটিই করেছিল ।

ভবিষ্যৎ ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, পাকিস্তান সম্বন্ধে পাখতুনদের ভয় অমূলক ছিল না। খান সাহেব, বিশেষত বাদশা খান, ওয়ালি খান প্রমুখের পীড়িত রাজনৈতিক জীবন তার প্রমাণ। তাই নতুন করে একমাত্র সীমান্ত প্রদেশে গণভােট এরা মেনে নিতে পারেনি। বিশেষত যখন জুন-প্রস্তাব অনুমােদনের জন্য তা পাঞ্জাব, বঙ্গ ও সিন্ধু প্রদেশগুলােতে পাঠানে হলাে তখন সীমান্ত প্রদেশ বাদ কেন? তাদের কী ভয় ছিল সীমান্ত ব্যবস্থাপক পরিষদ (অ্যাসেম্বলি) প্রস্তাবের বিরােধিতা করবে? তাই তাদের প্রস্তাব নিশ্চিত করতে ভিন্ন কৌশল- গণভােট? তাও আবার লীগের ধর্মভিত্তিক শ্লোগান সামনে রেখে- হিন্দুস্তান না পাকিস্তান? ধর্মীয় চেতনা উস্কে দিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা তাই পরিণাম নিশ্চিত জেনে বাদশা খানের দল গণভােট প্রত্যাখ্যান করে  তা সত্ত্বেও মুসলিম লীগ ব্যাপক প্রচারের আয়ােজন করে। দেশের বিভিন্ন প্রদেশ এমনকি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের আনা হয়। সেই সঙ্গে চলে ব্যাপক ভােট জালিয়াতি। এ সম্বন্ধে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন ওয়ালি খান তার বইতে। তার মধ্যে একটি ঘটনা তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার ইস্কান্দার মির্জার বরাত দিয়ে (ওয়ালি খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩০)। সরকারি আমলা ও লীগ কর্মকর্তাদের অক্লান্ত শ্রমে গৃহীত গণভােটের ফল : মােট ভােটারদের ৫০ শতাংশ হাজির, তার অধিকাংশ পাকিস্তানের পক্ষে (২,৮৯,২৪৪)। কিন্তু মজার ব্যাপার হলাে দুর্গম ছয় এজেন্সি ও উপজাতীয় এলাকা গণভােটে বাদ দেয়া হয় । সীমান্তের মােট জনসংখ্যা ৭০ লাখ (ওয়ালি খান)। সে হিসাবে প্রায় ৩ লাখের মতাে গৃহীত ভােট সিদ্ধান্তের পক্ষে যায় না । এ সংখ্যা হওয়া উচিত ছিল ৩৫ লাখের কিছু বেশি। কিন্তু ব্রিটিশ ও জিন্নাচাতুর্য মিলে মস্ত এক রাজনৈতিক জালিয়াতি সম্পন্ন করে। ভারতভাগ ও ভারতত্যাগের পরিকল্পনা নির্ধারিত ১৯৪৮ জুন থেকে ১৯৪৭ আগস্টে এগিয়ে আনা এবং অস্বাভাবিক দ্রুৰ্ততায় কাজ শেষ করায় রাজনৈতিক নেতারা খুশি, পরিতৃপ্ত মাউন্টব্যাটেন কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষক অনেকেরই বিশ্বাস অস্বাভাবিক পদ্ধতির কারণে দেশ রক্তে ভেসেছে। বিশেষত র্যাডক্লিফ সাহেবের সীমানা কমিশনের উদ্ভট, অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে। অবশ্য ভাইসরয়ের এ কৃতিত্বে প্রশংসাবাণী ছড়িয়েছেন কেউ কেউ, যেমন ভিপি মেনন বা এইচভি হডসন । কিন্তু মাউন্টব্যাটেনের উদ্দেশ্য ছিল দেশবিভাগ ও প্রদেশ বিভাগের দায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব, তাদের দল ও পরােক্ষে ভােটার জনতার ওপর চাপিয়ে দেয়া। তাই তাদের তৈরি প্রস্তাব অনুমােদন তথা অনুসমর্থনের জন্য প্রদেশের প্রতিনিধি সভায় (অ্যাসেম্বলিতে) পাঠানাে হয়। বঙ্গে তিন ভাগে পরিস্ফুট ফলাফলে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভােট তিনভাগেই সংখ্যা হিসাবে কম নয় (যেমন- যুক্তবঙ্গে ১২৬ ভােটের বিরুদ্ধে ৯০ ভােট কিংবা পশ্চিমবঙ্গে ৫৮ ভােটের বিরুদ্ধে ২১ ভােট, অন্যদিকে পূর্ববঙ্গে ১০৬ ভােটের বিরুদ্ধে ৩৬ ভােট)। সিদ্ধান্ত একাট্টা ছিল না বিভক্ত বঙ্গ বা যুক্তবঙ্গ কিংবা ভারত-পাকিস্তান নিয়ে। একই ঘটনা পাঞ্জাবে । চাতুরীর বিষয় হলাে বিভাজনের বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশের অর্থাৎ ‘না’-ভােটের সুযােগ না রাখা। একই বিষয় দেখা গেছে সীমান্ত প্রদেশের ক্ষেত্রে। গােটা বিষয়টিই ছিল জোড়াতালি বা  গোঁজামিলের । বলা যায়, কাঠালের আমসত্ত্ব ।

একে কি গণতন্ত্রসম্মত প্রক্রিয়া বলা চলে যেখানে হ্যা’ বলার অধিকার আছে, ‘না’ বলার অধিকার নেই। তবে সর্বনাশা জগাখিচুড়ি কাণ্ড ঘটে র্যাডক্লিফের সীমানা কমিশনের কর্মযজ্ঞে। যার ফল পাঞ্জাবে গণহত্যাসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। কুলদীপ নায়ারের মতেও এর কারণ প্রশাসনের অস্বাভাবিক দ্রুততা যে জন্য আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা থেকে বিপজ্জনক পরিস্থিতির জন্ম । আমাদের বিশ্বাস : মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশাসনের উদ্বেগ বা চিন্তা ছিল না। কুলদীপ লিখেছেন, ‘যেভাবে ভারতবিভাগ। সম্পন্ন হয় তাতে আমি আতঙ্কিত হই’। তিনি বিশেষভাবে পাঞ্জাবের কথা বলেছেন। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলে বঙ্গেও ছিল একই ধরনের নৈরাজ্য। কারাে উঠান, কারাে জমির ওপর দিয়ে চলে গেছে র্যাডক্লিফের তীক্ষ তরবারি সীমারেখা চিহ্নিত করে । ক্রটি আসলে মাউন্টব্যাটেনের। শেষ মুহূর্তে সীমানা কমিশন নিয়ােগ এবং ভূমি জরিপ-টরিপ শিকেয় তুলে ঘরে বসে টেবিলে মানচিত্র বিছিয়ে দ্রুত কাটাকুটির দাগ টেনে যাওয়া। এমনটাই ছিল সীমানা কমিশনের কাজ। আর প্রবল সমালােচনার মুখে র্যাডক্লিফের মন্তব্য: এজন্য তার কোনাে অনুতাপ নেই। যদিও বিভাজিত অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছে ব্যক্তির খেয়ালখুশিতে অপ্রয়ােজনীয় দ্রুততা, অবহেলা এবং সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য এ তিনটি শব্দ বিভিন্ন তাৎপর্য নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে মাউন্টব্যাটেনের ভারতবিভাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তরে। গােটা বিষয়টি নিয়ে তাই অনেকের অনেক প্রশ্ন। বিভাজনকাণ্ডের নায়করা এসব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি। যেমন প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলির প্রথম ঘােষণামাফিক ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ ধীরেসুস্থে সবরকম ব্যবস্থা নিয়ে ১৯৪৮ জুনের মধ্যে সম্পন্ন করা হলে হয়তাে বিপুল মানবিক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানাে সম্ভব ছিল। কী অসুবিধা ছিল নয় বা সাড়ে ৯ মাস দেরিতে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটলে । সময়ের আগে ফোড় দেয়ার উদ্দেশ্য কি চমক সৃষ্টি, নাকি এর পেছনে অন্য কোনাে গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল মাউন্টব্যাটেনের? অ্যাটলি মন্ত্রিসভা তাে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল ভারত ছাড়তে। উল্লিখিত এমন এক উদ্ভট-অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের নেতৃত্বে রক্তস্রোতের নৌকায় চড়ে ভারত পাকিস্তান দুই ডােমিনিয়নের দুই বিপরীত দিকে যাত্রা।

জন্মের তারিখও কৃত্রিমভাবে বিভক্ত করা হয়- যথাক্রমে ১৫ এবং ১৪ আগস্ট (১৯৪৭) যদিও এ দায়িত্ব একদিনেই সম্পন্ন করেন ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন এরপর দেশি রাজ্যগুলাের নবাবমহারাজদের ইচ্ছামাফিক ভারত বা পাকিস্তানে যােগদানের বাধ্যবাধকতা, স্বাধীন কোনাে রাজ্যের সুযােগ না রেখে। ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার অনুমােদনক্রমে ভারতবিভাগের। মাধ্যমে ঠিকই ক্ষমতা হস্তান্তর করেন দুই প্রধান দলের নেতার হাতে কিন্তু পেছনে রেখে গেলেন অনেক সমস্যা, অনেক উপসর্গ, অনেক জটিলতা আর পরস্পরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন দুই স্বতন্ত্র ভূখণ্ড, যাদের জন্মােৎসব এক সময়ে হলেও সৌহার্দ্য’ শব্দটি তাদের অভিধান থেকে নির্বাসিত । তাই হাতের গণ্ডা পাওয়ার পরই শুরু হয়ে যায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা- মূলত পাঞ্জাব। থেকে, তারপর সর্বত্র। পরিণামে ছিন্নমূল মানুষের বিশাল কাফেলা চরম বিপর্যয়। মাথায় নিয়ে। যেন এক অন্তহীন যাত্রা! স্বভাবতই প্রশ্ন : এ স্বাধীনতা, এ। দেশভাগের সার্থকতা কোথায়? এ সম্পর্কে ইংরেজ আমলা পেন্ডেরেল মুনও বিপরীত মন্তব্য করেছেন তার লেখা ডিভাইড অ্যান্ড কুইট’ বইটিতে। তার সমালােচনা একাধিক ক্ষেত্রে তবে মাউন্টব্যাটেনের সম্পর্কে তা খুবই স্পষ্ট : ভারতত্যাগের বিষয়ে মাউন্টব্যাটেন যে বিরাট কৃতিত্ব দাবি করেন তা ফাঁপা শােনায়। এর বেশি। একজন আমলা ভাইসরয় সম্পর্কে কিইবা বলতে পারেন? বলার কারণ মুন দীর্ঘদিন পাঞ্জাবে কাজ করেছেন। সিকান্দার হায়াতের সঙ্গে তার কথােপকথন স্মর্তব্য  অতিদ্রুততায় যথাযথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা না নিয়ে দেশভাগ সম্পন্ন করার পরিণাম পাঞ্জাবের গণহত্যা, প্রতিক্রিয়ায় দেশের অন্যত্র নরহত্যা। কৃতিত্বের । পেছনে বিরাট এ রক্তাক্ত অন্ধকার ছায়া। সুমিত সরকারও এসব বক্তব্যের সঙ্গে একমত।

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!