কোন্ ভাঙনের পথে ভারতবর্ষ
ভারতীয় রাজনীতির সম্প্রদায়ভিত্তিক দ্বন্দ্ব যেন ইতিহাসের ঘটনা-নির্দিষ্ট প্রতিযােগিতা, যেখানে ঘটনা সবচেয়ে ক্ষমতাধর। কেউ চাইলে মিলে-অমিলে একে মিনি কুরুক্ষেত্রও বলতে পারেন, যেখানে ঘটনার নিয়ন্ত্রক অংশত হলেও কৃষ্ণরূপী ব্রিটিশরাজ। তবে এ প্রতিদ্বন্দ্বিতার যুদ্ধে জয়-পরাজয় উভয় পক্ষের। এক্ষেত্রে ব্যক্তির ভূমিকা কখনাে নিয়তির মতাে। সেসব ব্যক্তির মধ্যে প্রধান। গান্ধি-জিন্না-নেহরু, তার নিজস্ব ভূমিকায় আজাদ, পাশে দাঁড়িয়ে প্যাটেল। নেপথ্যে ‘রাজ’-প্রতিনিধি ভাইসরয়। সবাই মিলে মিনি কুরুক্ষেত্রের ময়দান রচনা- সেখানে যে যার মতাে করে তৎপর বলী চলে লড়াইয়ের মহড়া। অখণ্ড ভারত (শক্তিশালী কেন্দ্র) নিয়ে কংগ্রেস নেতাদের অনড় ভূমিকার কথা ইতিহাস-পাঠকের জানা। কিন্তু ইতিহাসের ইতিহাস প্রশ্ন তােলে তাদের এ মনােভাব কতটা আন্তরিক, কতটা নিঃস্বার্থ ছিল? আরাে প্রশ্ন সেক্ষেত্রে মসনদ দখলই কি একমাত্র লক্ষ্য ছিলনা? এজন্য অতীত ঘটতে খুব দূরে না গেলেও চলে। অন্তত ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ (আগস্ট) পর্যন্ত ঘটনাবলির পর্যালােচনাই যথেষ্ট। তাতে এটুকু স্পষ্ট যে, ভারতীয় সংখ্যালঘু মুসলিম স্বার্থের পক্ষে মুসলিম লীগের দাবিগুলাের বিপরীতে কংগ্রেস বৃহত্তর জনপ্রতিনিধিত্বকারী দল হিসেবে কিছু নমনীয়তা, কিছু উদারতা দেখালে এবং বিরাজমান সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি বিচারে কিছু বিচক্ষণ ছাড় দিলে হয়তাে ভারতবিভাগ রােধ করা যেত। তা সম্ভব হতাে অতি আত্মবিশ্বাস, উচ্চমন্যতার মতাে কিছু বিষয় যদি কংগ্রেস বড় করে তুলত। দেশবিভাগ-বিষয়ক মনােযােগীপাঠ এমন সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে। এ ধরনের বক্তব্য আরাে দু-একজনের মতাে করে না হলেও ভিন্নভাবে বলেছেন এইচ, ভি হডসন। তার ভাষায়, “A little greater humility, a little less certainty of righteousness, might have saved their ideal of a united india of all communities’ (দ্য গ্রেট ডিভাইড, পৃ. ১৮২)। নিজেকে সঠিক, অভ্রান্ত ভেবে লেনদেনে উদারতার অভাবও যে অচলাবস্থার জন্য দায়ী তাতে ভুল নেই। অন্যদিকে দৃঢ়তা প্রদর্শনের জায়গাতে কংগ্রেস যে ভুল করেছে এমন উদাহরণও তুলে ধরেছেন হডসন (পৃষ্ঠা ১৭২-৭৩)। যথাসময়ে কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের বলিষ্ঠতা তারা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দেখাতে পারেননি। মূলত দেশব্যাপী সহিংসতার ভয়ে। তাই বলে জিন্নার কি এ ব্যাপারে কোনাে দায় ছিল না? অবশ্যই ছিল। কারণ।
তিনিই তাে ১৯৪০ সাল থেকে ভারতভাগের রেসে জেতার বাজি ধরে মাঠে নেমেছিলেন। অপেক্ষা করে থাকতেন প্রতিপক্ষের ভুল চালের বিপরীতে পাল্টা। সঠিক চাল দেয়ার জন্য। সেক্ষেত্রে কংগ্রেসের অতি-আত্মবিশ্বাসী না হয়ে ধীরস্থির সতর্ক পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিল। কিন্তু তেমন সুযােগ কংগ্রেস কমই নিতে পেরেছে। কথাগুলাে খােলামেলাভাবে বলেছেন হডসন, (পৃ. ১৮২)। উল্লেখ করেছেন নেহরুর কিছু মারাত্মক ভুলের কথা, যা ভারতভাগের পথ প্রশস্ত করেছে। সে ভুলগুলাে অবশ্য পাঠকমাত্রেরই চোখে পড়ে। তবে পাকিস্তান নিয়ে জিন্নার ‘অবসেসন’-এর কথা জিন্নার প্রতি। সহানুভূতিসম্পন্ন একাধিক লেখক বলেছেন, আয়েশা জালাল বা তার একই ধারার একাধিক ব্যক্তি যা-ই লিখুন না কেন। কিছুটা ওই ঘরানারই স্ট্যানলি উলপার্ট (‘জিন্না অব পাকিস্তান, ১৯৮৪) জিন্নার পাকিস্তান বিষয়ক যেসব বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন তাতেও স্পষ্ট যে ভারতভাগ্ ও পাকিস্তান ছিল জিন্নার প্রথম ও শেষ কথা। যেমন জিন্না বলেন, দশ কোটি মুসলমান একত্র হলে পাকিস্তান আসবেই, ইনশাল্লাহ আমরা জয়ী হব। এজন্য দরকার ঐক্য ও আত্মার ওপর বিশ্বাস’ (পৃ. ২৪১)। ব্যক্তিজীবনে ধর্ম ও ধর্মাচরণ নিয়ে নিস্পৃহ জিন্নার। কণ্ঠে আল্লার ওপর বিশ্বাস রাখার কথা বড় অদ্ভুত শােনায়! শুধু তা-ই নয়, জিন্না এমন কথাও বলেন আমরা হিন্দুর দাসত্ব থেকে মুক্তি চাই’ (পৃ. ২৪৮)। আহমেদাবাদে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, (অক্টোবর, ১৯৪৫) পাকিস্তান আমাদের জন্য জীবনমরণ প্রশ্ন । ভারতের সব মুসলমান এক আল্লায় বিশ্বাসী এক জাতি। তারা পাকিস্তান চায়। তারা পাকিস্তান আদায় করবেই ।… মাথার ওপর পাকিস্তানি চাদ জ্বলজ্বল করছে, আমরা তা পাবই’ (পৃ. ২৫১)। পশ্চিমা কেতার জীবনযাপনে অভ্যস্ত জিন্নার মুখে ধর্মভিত্তিক উত্তেজক বক্তৃতা স্ববিরােধী হলেও তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য ছিল খুবই সহায়ক। জিন্নাসহ মুসলিম লীগ নেতাদের বক্তৃতা মুসলিম ভারতে যথেষ্ট উন্মাদনা। সৃষ্টি করে, বিশেষ করে বঙ্গে ও পাঞ্জাবে যে জন্য এ দুটো প্রদেশ অবশেষ বিচারে পাকিস্তান আদায়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এরপরই যুক্তপ্রদেশ ।
সিমলা বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর পাঞ্জাবের গভর্নর জোরের সঙ্গে বলেন, ‘মুসলিম লীগকে পাকিস্তান দাবি থেকে সরিয়ে আনতে না পারলে পাঞ্জাবে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাবে’ (উলপার্ট, পৃ. ২৪৭)। পাম্রাবের মুখ্যমন্ত্রী খিজির হায়াত খানও অনুরূপ মন্তব্য করেন। অন্যদিকে বঙ্গীয় গভর্নরের মন্তব্য : ‘জিন্না না থাকলে পাকিস্তান আইডিয়া ভেঙে টুকরাে টুকরাে হয়ে যেতাে’ (প্রাগুক্ত)। স্টানলি উলপার্টের বিবরণে জিন্না ও পাকিস্তান প্রসঙ্গ এমন চরিত্র নিয়ে নানাভাবে এসেছে। যে-গৃহযুদ্ধের কথা ১৯৪৫-এ বলা হয় তা আরাে ব্যাপকভাবে শুরু হয় ১৯৪৭-এর মাঝামাঝি সময়ে পাঞ্জাবে, মূলত ভাইসরয় মাউন্টবাটেনের ভারত বিভাজন প্রকল্প দ্রুত সমাপনের পদক্ষেপে । সে পদক্ষেপ ছিল প্রশাসকদের মতের বিরুদ্ধে। এমনকি এ বিষয়ে সর্বনাশের বার্তা পাঠিয়ে ছিলেন পাঞ্জাবের গভর্নর ইভান জেনকিন্স (১১ জুলাই, ১৯৪৭)। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৭-এর সময়পর্বে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরেফিরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আগুন জ্বলেছে। মাউন্টব্যাটেন-র্যাডক্লিফের বেহিসাবি দ্রুত সমাপনের দায়ে লাখ লাখ নর-নারী নিহত, কয়েক কোটি উদ্বাস্তুদশা বরণ করেছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের কূটকৌশলী সফলতার পেছনে রয়েছে শাসক আমলাতন্ত্র বিশেষত মাউন্টব্যাটেনের আত্মবিশ্বাসী, সাম্রাজ্যস্বার্থবাদী তৎপরতা, যা ব্যাপক রক্তপাতের সূচনা ঘটায়। অবশ্য সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দায় লীগকংগ্রেসেরও কম নয়, বিশেষ করে জিন্নার অনমনীয় মনােভাবের কারণে। ভারতে ইংরেজ শাসনের শেষভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন। তার দায়িত্ব পালনের মেয়াদ মাত্র পাঁচ মাসের মতাে হলেও তাকে নিয়ে আলােচনা ও বিচার ব্যাখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। কখনাে পক্ষে কখনাে বিপক্ষে। ইংরেজের ভারতভাগ ও ভারতত্যাগ নির্ধারিত সময়ের দশ মাস আগেই শেষ করেন মাউন্টব্যাটেন, পেছনে যদিও রক্তনদীর ভয়াবহতা। বলা যেতে পারে যে মাউন্টব্যাটেন ভাঙনের দূত হয়ে ভারতে আসেন। লীগ-কংগ্রেস দ্বন্দ্বের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ ফিল্ড মার্শাল ওয়াভেলের পরিবর্তে রিয়ার অ্যাডমিরাল মাউন্টব্যাটেন ভাইসরয়ের আসনে বসে কাজ শুরু করেন ২৪ মার্চ (১৯৪৭) থেকে। ব্যাপক ভুখণ্ড কাটাকুটির মাধ্যমে ভারত বিভক্ত করে ‘চিরশত্রু’ ভারত ও পাকিস্তান ডােমিনিয়নের জন্ম নিশ্চিত করেন তিনি। ভারত ডােমিনিয়নের গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন, যদিও স্বল্প সময়ের জন্য ।
ভারতে মাউন্টব্যাটেনের সাফল্যের কারণ একাধিক। হডসন এ সম্পর্কে আলােচনায় মাউন্টব্যাটেনের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কিছু সংখ্যক ব্যক্তিত্বের তুলনামূলক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন যা প্রাসঙ্গিকই নয়, গুরুত্বপূর্ণও বটে। একই সঙ্গে তিনি মন্ত্রীমিশনের ব্যর্থতার কথাও বলেছেন। তার মতে, এর মূল কারণ মন্ত্রীশিনের মূল দায়িত্ব ছিল শুধু আলােচনার, অন্যদিকে মাউন্টব্যাটেনের হাতে ছিল সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা। কথাটা অবশ্য চার বছর আগেকার ক্রিপস মিশন সম্বন্ধে আরাে বেশি খাটে। তবে আমার মনে হয় এর চেয়েও বড় কারণ স্বাধীনভাবে কাজ করার পক্ষে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে মাউন্টব্যাটেনের শর্ত আদায়, যে সুবিধা ভাইসরয় ওয়াভেলের ছিল না। সেই সঙ্গে অবশ্যই বিচার্য তার ব্যক্তিত্ববৈশিষ্ট্য ও চাতুর্য, রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে তার প্রভাব, কোনো কোনাে ভারতীয় রাজনীতিকের কাছ থেকে ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুবাদে সহায়তা আদায়ের মতাে ঘটনাবলি। পরােক্ষে ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটও তাকে সাহায্য করে। যেমন লীগ-কংগ্রেসের দীর্ঘকালীন দ্বন্দ্বে ক্লান্ত নেতাদের ক্ষমতালাভের প্রবল তাগিদ ও অস্থিরতা। এ জাতীয় সব সুবিধা কাজে লাগাতে পেরেছিলেন মাউন্টব্যাটেন, যেসব সুবিধা পাননি ক্রিপস বা ওয়াভেল। তাছাড়া হডসনের মতে মাউন্টব্যাটেনের স্ত্রী এডুইনার নেপথ্য সাহায্যসহযােগিতা ভাইসরয়ের কাজে সহায়ক হয়েছে এৱর্ণধর্মজাতপাত নিয়ে এডুইনা। ছিলেন সংস্কারমুক্ত। ভারতে এসে তিনি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেননি । ভারতীয় নারীদের সমস্যায় ও সমাজসেবীর কাজে নিজেকে যুক্ত করেছেন এডুইনা। তার সাহস, বুদ্ধিমত্তা, ব্যক্তিগত সৌন্দর্য ও মানবিক বােধ উদ্দিষ্ট কাজে সাহায্য করেছে (পৃষ্ঠা ২০৬)। তাই ক্রিপস বা ওয়াভেল করতে পারেননি, ভারতীয় রাজনীতির দ্বন্দ্ব, জটিলতা ও সমস্যার মধ্যেই তা পেরেছেন লক্ষ্য অর্জনে সফল মাউন্টব্যাটেন। ক্রিপস ও মাউন্টব্যাটেন দুজনই আলােচনায় দেনদরবারে দক্ষ। দুজনই যথেষ্ট। আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু চতুর চালে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে মাউন্টব্যাটেন বােধ হয় অধিক পারদর্শী। হতে পারে আভিজাত্যের মহিমা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মন্ত্ৰীমিশন প্রস্তাবে দেশভাগের কোনাে পরিকল্পনা ছিল না । ছিল ভারতীয় মুসলমানদের আর্থ-রাজনৈতিক সুযােগ-সুবিধার পক্ষে গ্রুপিং ব্যবস্থা, প্রদেশের অধিকতর ক্ষমতা। এতে আপত্তি ছিল কংগ্রেসের ।
দুইপক্ষের বিপরীতমুখী আপত্তি মেটাতে পারেনি মন্ত্রীমিশন । অতএব ব্যর্থ। মাউন্টব্যাটেনের কোনাে সীমাবদ্ধতা ছিল না। তাই তিনি দুইপক্ষের সঙ্গে খােলা মনে নানারকম সম্ভাবনা নিয়ে আলােচনা করতে পেরেছেন। জিন্নার সঙ্গে আলাপের পর যখন বুঝেছেন সমঝােতায় দেশভাগ অপরিহার্য, তখন সে পথেই হেঁটেছেন, তবে জিন্নাকে একহাত নিয়ে । জিন্না যা চেয়েছেন তার সঙ্গে যা চাননি। তা বাড়তি উপহার দিয়ে। এর পরিণাম শুভ হয়নি। অন্যদিকে কংগ্রেসের সঙ্গে আলােচনায় গান্ধির চেয়ে নেহরু ও অংশত প্যাটেলকে গুরুত্ব দিয়েছেন। হডসনের মতে, ক্রিপসের বড় ভুল ছিল গান্ধির মতামত ও ক্ষমতার ওপর অধিক আস্থা স্থাপন। মাউন্টব্যাটেনের বাড়তি সুবিধা ছিল এক বছর আগে (মার্চ, ১৯৪৬) সিঙ্গাপুরে নেহরুর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও তাদের মধ্যকার সুসম্পর্ক। মাউন্টব্যাটেনের সাফল্যের পেছনে ঘটনার গুরুত্ব অনেক। তবে হডসন সংশ্লিষ্টদের ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্যের ওপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন অধিক। তাই নেহরু ও মাউন্টব্যাটেনের শিক্ষা, মানসপ্রবণতা, ব্যক্তিত্ব-সাদৃশ্য ও গণতান্ত্রিক চেতনা সম্বন্ধে লিখেছেন। তার মতে ‘নেহরু দার্শনিক, আদর্শবাদী আর মাউন্টব্যাটেন বাস্তবতাবাদী কর্মতৎপর ব্যক্তি। তারা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। নেহরু ও মাউন্টব্যাটেন দুজনই আবেগপ্রবণ (জিন্নার ঠিক বিপরীত) কিন্তু দ্বিতীয়জন নেহরুর মতাে অস্থির ও ভাবােচ্ছাসে তাড়িত নন।’
রাজনৈতিক জীবনে নেহরুর প্রাথমিক নির্ভরশীলতা পিতা মতিলাল নেহরুর ওপর, পরে দীর্ঘ সময় গান্ধির ওপর। আশ্চর্য সাতচল্লিশে গান্ধি নন, মাউন্টব্যাটেনকে তিনি আস্থায় নিয়েছেন অনেক সময় (হডসন)। এ সময় প্যাটেলের মতামতেও কখনাে কখনাে প্রভাবিত হন নেহরু। অন্যদিকে মাউন্টব্যাটেন আত্মবিশ্বাসী, আত্মনির্ভর’বিপরীত স্বার্থের একজন ক্ষমতাবান মানুষকে আস্থায় নেয়া নেহরুর জন্য সঠিক ছিল না। হডসন সরস বাক্যে একথা পরােক্ষে কবুল করেছেন। তার ভাষায় এরা দুজন হাত ধরাধরি করে চলার মতাে মানুষ। কিন্তু এদের একজনের হাতে দস্তানা, অন্যজনের হাত দস্তানাহীন। খালি হাত ও দস্তানাপরা হাতে অনেক তফাৎ। বাঁ-হাতের দস্তানা ডান হাতের জন্য অচল।’ এ রূঢ় সত্য কি জানতেন না নেহরু? নাকি ক্ষমতায় আসীন হওয়ার তাড়নায় সহজ সত্য ভুলে গিয়েছিলেন। ভারতীয় রাজনীতির এই শেষ ক’মাসের নৈরাজ্যিক পর্বে ঘটনার ওপর মাউন্টব্যাটেনেরই প্রভাব সবার চাইতে বেশি। বাকি সবাই ঘটনা দ্বারা কমবেশি তাড়িত । এ জাতীয় তাড়নায় এডুইনারও নেপথ্য ভূমিকা অনস্বীকার্য। ভাইসরয়ের সুতাে টানাটানির চালে রুক্ষ-মেজাজ সরদার প্যাটেলও নিস্তেজ। অবশ্য ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার টানে। তাই দেশভাগে অনিচ্ছুক কংগ্রেসকে নড়াতে সফল হন মাউন্টব্যাটেন । লক্ষ্য অর্জনে গান্ধি নন, নেহরুর ওপর এবং মেননের সাহায্যে অংশত সরদার প্যাটেলের ওপর নির্ভর করেন ভাইসরয় ।
কারণ গান্ধি এ পর্যায়ে কিছুতেই ভারতভাগ মেনে নিতে চাননি। তার দিক থেকে বিভাজন এড়াতে প্রস্তাবের পর প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যা কখনাে দুই।কংগ্রেস প্রধান, কখনাে জিন্না মানতে রাজি হননি। ফলে গান্ধির শেষ আশ্রয় তার প্রার্থনা সভায় ভারতভাগের বিরুদ্ধে বক্তৃতা- তাতেও কোনাে সুফল দেখা যায়নি। ভয়ানক হতাশ গান্ধি, কংগ্রেসের একদা সর্বাধিনায়ক মহাত্মা গান্ধি’! অন্যদিকে জিন্নার সঙ্গে আলােচনায় যথারীতি অন্য ভাইসরয়দের মতাে মাউন্টব্যাটেনেরও অস্বস্তি কম ছিল না। তবে তার স্বভাবসুলভ চাতুর্যে, ব্যক্তিত্ববৈশিষ্ট্যগুণে অন্যদের চেয়ে অন্তত এক-পা এগিয়ে ছিলেন তিনি। ব্যক্তিগত প্রতিবেদনে মাউন্টব্যাটেন জিন্নাকে ‘আবেগহীন, শীতল, উদ্ধত ও উন্নাসিক মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন (হডসন)। তার সঙ্গে আলােচনার শুরুতেই মাউন্টব্যাটেন বুঝতে পারেন এই আইনজীবী রাজনীতিককে বাগে আনা মােটেই সহজ নয়। কথায় কথায় জিন্না লীগ ওয়ার্কিং কমিটি বা উপদেষ্টার দোহাই দিলেও ভাইসরয় ঠিকই বুঝতে পারেন ‘জিন্নার উপদেষ্টা জিন্না নিজেই। অন্যদের তুলনায় এক্ষেত্রে ছিল সেয়ানে সেয়ানে লড়াই । | প্রকৃতি ও মেজাজে জিন্না ও মাউন্টব্যাটেন সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর মানুষ হওয়ার কারণে তাদের সংলাপে কখনাে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়নি। নিজের দাবির বাইরে প্রতিক্ষেত্রে জিন্নার নেতিবাচক বক্তব্য ভাইসরয়ের কাছে। রীতিমতাে বিরক্তিকর মনে হয়েছে। তুর্লনায় নেহরুর সঙ্গে আলাপে স্বাচ্ছন্দ্যবােধ করেছেন মাউন্টব্যাটেন আমার বিশ্বাস জিন্নার জীবনে, আলােচনায় রাজনীতিক জিন্নাকে চালিত ও প্রভাবিত করেছেন আইনজীবী, তথা আইনজ্ঞ জিন্না। যে জন্য তার সঙ্গে তর্কে পেরে ওঠা কঠিন ছিল। তার ‘না’ ম্যানিয়াও বােধ হয় এর অন্যতম কারণ। এ বিষয়ে তৎকালীন দৈনিক যুগান্তর’এ তার সম্বন্ধে সরস মন্তব্য (১৯৪৬) পড়েছিলাম যে তার নাম জিন্না বলেই বােধ হয় সব প্রশ্নেই তার জবাব ‘জী-না’।
বিষয়টি অবশ্য একতরফা নয়। কংগ্রেসের সঙ্গে সংলাপে অন্য লীগ। নেতারাও খুব বিরক্ত, বিশেষ করে, অন্তর্বর্তী সরকারে মুখােমুখি প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানের কারণে। মাউন্টব্যাটেনের এক প্রশ্নের জবাবে লিয়াকত আলী খান বলেন : ‘অন্তর্বর্তী সরকারে কংগ্রেসের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এদের সঙ্গে চলা অসম্ভব । কংগ্রেসের সঙ্গে থাকার বদলে মুসলিম লীগকে যদি স্বতন্ত্র মুসলমান রাষ্ট্র হিসেবে সিন্ধুর মরুভূমিও দেয়া হয় তাহলেও তা আমার কাছে অধিকতর গ্রহণযােগ্য মনে হবে’ (হডসন)। লীগ-কংগ্রেস নেতাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ১৯৪৬-৪৭ সালে এমনই এক অসহিষ্ণু বিতৃষ্ণায় পৌছেছিল । তাই মাউন্টব্যাটেন যখন সমস্যা সমাধানে জিন্নার মতামত জানতে চান, তখন শেষােক্তের জবাব- সমাধান একমাত্র একটাই, আর তা হলাে ভারতের ওপর সার্জিক্যাল অপারেশন চালানাে। অন্যথায় ভারতবর্ষ ধ্বংস হয়ে যাবে’ । কংগ্রেস নেতাদের সারাক্ষণ অবস্থান পরিবর্তন নিয়েও অভিযােগ তােলেন জিন্না। তার মতে, মন্ত্রীমিশন প্রস্তাব এখন এক অর্থহীন বিষয় । ভারতবিভাগ ও পাকিস্তানই সমস্যার একমাত্র সমাধান। | চতুর ভাইসরয় তখন জিন্নার যুক্তিতেই জিন্নাকে পরাস্ত করেন। তার বক্তব্য: যে দ্বিজাতিতত্ত্বের সুচিন্তিত নীতি অনুযায়ী ভারতবিভাগ গ্রহণযােগ্য, সেই নীতিমাফিকই হিন্দু-মুসলমান অধ্যুষিত বঙ্গ ও সেই সঙ্গে শিখ অধ্যুষিত পাঞ্জাবকেও সমপ্রদায় ভিত্তিতে ভাগ করতে হবে। এর কোনাে বিকল্প নেই । কিন্তু জিন্না কাটাকুটির পাকিস্তান নিতে রাজি নন। ভাইসরয়ও পিছু হটতে। গররাজি। তার প্রস্তাব দুটো- প্রথমত মন্ত্ৰীমিশন প্রস্তাব যাতে রয়েছে অখণ্ড ভারতে দুর্বল কেন্দ্র, শক্তিমান প্রদেশ, পাকিস্তানি চেতনার আঞ্চলিক বিভাগ ও এবিসি গ্রুপিং যা নিয়ে কংগ্রেসের আপত্তি। জিন্নার কাছে এটা গ্রহণযােগ্য মনে হওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত ভারত বিভাগ, বাংলা পাঞ্জাব বিভাগ, কাটাছেড়া পাকিস্তান জিন্না কোটা চান! জবাবে জিন্নার দাবি, টিকে থাকার মতাে পাকিস্তান, ভারতীয় মুসলমানদের নিজস্ব জাতিরাষ্ট্র ও নিজস্ব সামরিকবাহিনী চাই । বাংলা-পাঞ্জাবআসাম ভাগ চলবে না। কিন্তু জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভাজন তাে। নীতিমাফিক যুক্তিসঙ্গত, পূর্ণাঙ্গ পাকিস্তান সেক্ষেত্রে ধােপে টেকে না। তাই ভাইসরয় জিন্নার দাবি অযৌক্তিক বিবেচনায় প্রত্যাখ্যান করেন।
অন্যদিকে লীগ-কংগ্রেসের তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার জের শুধু দলীয় সমর্থকদের মধ্যেই নয়, প্রচারের গুণে তা জনস্তরে পৌছে । ভাইসরয় থেকে শুরু করে ব্রিটিশরাজের শীর্ষ প্রতিনিধি সবাই সন্তুষ্ট। সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির ফলাফল এ পর্যায়ে পৌছেছে যে তাতে যে কোনাে মুহূর্তে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। অবস্থা এমনই যে হিন্দু বা মুসলমান এজন্য পরস্পরকে দায়ী করছে, ব্রিটিশরাজকে নয়। পরিস্থিতি একেবারে গৃহযুদ্ধের পর্যায়ে। এমন অবস্থাই চেয়েছিলেন ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন, যাতে গৃহযুদ্ধের দায় শাসকশ্রেণির ওপর না বর্তায়। সহিংসতা ও বিভাজনের জন্য রাজনৈতিক নেতারাই যেন দায়ী বিবেচিত হন। রাজপুরুষদের লেখা নােট, প্রতিবেদন ও চিঠিপত্রে এমনটাই প্রতিফলিত। দায়িত্ব হাতে নেয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই পরিস্থিতির উত্তাপ উপলব্ধি করেন ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন। লেখেন, গৃহযুদ্ধ বুঝি তার হাতের ওপর দিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে । অন্যদিকে লর্ড ইস্মে লেখেন : মনে হচ্ছে যে কোনাে মুহূর্তে বুঝি বিস্ফোরণ ঘটতে যাচ্ছে । যুক্তি নয়, লজিক নয়, এর পেছনে নিছক ভাবাবেগের প্রাধান্য।…ব্রিটিশ-বিরােধী মনােভাব নেই বললে চলে। রয়েছে সাম্প্রদায়িক ঘৃণার সর্বগ্রাসী অগ্নিশিখা।’ | সব কিছুর দায় রাজনৈতিক নেতাদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চিন্তা যে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও তার চিফ অব স্টাফ লর্ড ইসমে প্রমুখের ছিল রাজ-সরকার সমর্থকদের লেখায়ও তা বােঝা যায়। হডসন লিখেছেন, ভাইসরয় সিদ্ধান্তে আসেন যে মন্ত্ৰীমিশন প্রস্তাব বা অনুরূপ কোনাে প্রস্তাব নিয়ে মতৈক্যের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। তাছাড়া হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ক্রমেই অবনতি ঘটছে। এ অবস্থায় তার প্রস্তাবগুলাের উদ্দেশ্য ভারতবিভাগের দায়-দায়িত্ব ভারতীয়দের ওপরই চাপিয়ে দেয়া (পৃ. ২৯৪)। কথাগুলাে এত স্পষ্ট করে কম লেখকই বলেছেন। অবশ্য একইরকম কথা বলেছিলেন ভিপি মেনন যার আনুগত্য প্রধানত ব্রিটিশরাজের প্রতি, অন্যদিকে সরদার প্যাটেলের সঙ্গে রয়েছে তার গভীর সম্পর্ক। তারও মন্তব্য, প্রস্তাবের উদ্দেশ্য দেশভাগের দায় ভারতীয়দের ওপর চাপিয়ে দেয়া (পৃ. ৩৫৪)। এই দায় চাপানাে শুধু নেতাদের ওপরই নয়, জনসাধারণের ওপরও, বিশেষ করে আসামে (সিলেট নিয়ে) ও সীমান্ত প্রদেশে গণভােট ব্যবস্থার মাধ্যমে । গণভােটের উদ্দেশ্য জনমত চাই, তারা ভারত কিংবা পাকিস্তান কোন্ পক্ষে থাকবে।
কিন্তু তীব্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের মুখে হিন্দু-মুসলমান জনতা কোনদিকে থাকবে তা খুবই স্পষ্ট। তাই মাউন্টব্যাটেন প্রসঙ্গে এ কথাও সত্য যে লীগ-কংগ্রেস নেতাজীও ধােয়া তুলসীপাতা ছিলেন না। তারাও কিছুতেই ঐকমত্যে পৌছতে পারেননি। আর মন্ত্রীমিশন প্রস্তাব যখন গৃহীত হলাে না তখন মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাবে গােটা বিষয়টার নীতিগত দিক পাল্টে যায়। সেখানে প্রদেশগুলাের অধিকার ও ক্ষমতা হ্রাস পায়। পাঞ্জাব ও বাংলায় মুসলমান ও অমুসলমান প্রতিনিধিগণ। পৃথকভাবে প্রদেশ ভাগের পক্ষে বা বিপক্ষে মতামত দেবেন। তেমনি আসামে ও সীমান্ত প্রদেশে, যে কথা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু পাঞ্জাবভাগের পরিণতি মারাত্মক হবে বলে মত প্রকাশ করেন পাঞ্জাবের গভর্নর ইভান জেনকিন্স । আর সীমান্তে নতুন করে জনমত যাচাইয়ের প্রবল বিরােধিতা করেন খান ভ্রাতরা, যে জন্য শেষ পর্যন্ত তাদের দল ওই জনমত যাচাই বর্জন করে। কারণ মুসলিম লীগ তথা জিন্নার উদ্দেশ্য ছিল কংগ্রেস-সমর্থিত খান মন্ত্রিসভার পতন ঘটানাে। আর সেইসঙ্গে প্রচার- কোরআন ও গীতার মধ্যে কোনটি বেছে নেবে সীমান্তের পাঠানগণ। লীগ রাজনীতির জাদুকাঠি ছিল ধর্মীয় প্রচারণা, তাতে আরাে ছিল সত্যমিথ্যার ভেজাল ।
মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাবের শাখা-প্রশাখা নিয়ে গভর্নরদের মধ্যেও ভিন্নমত ছিল। যেমন বঙ্গীয় গভর্নর ফ্রেডরিক বারােজ বাংলার স্বাধীন অবস্থানের সুযােগ রাখার পক্ষে ছিলেন। অন্যদিকে বারােজ ও জেনকিন্স দুজনেই সীমান্ত প্রদেশে গণভােটের বিরােধী এবং পাঞ্জাব-গভর্নর মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন । ছেচল্লিশে যেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে, সেক্ষেত্রে নতুন করে একমাত্র সীমান্ত প্রদেশে গণভােটের অর্থ জিন্নাকে খুশি করা এবং পাঠানদেরকে তাদের কট্টর বিরােধীদের হাতে তুলে দেয়া। এর পরিণাম আমরা দেখেছি বিভাগােত্তর সীমান্ত প্রদেশে । গাফফার খান ঠিকই বলেছিলেন যে, কংগ্রেস দেশভাগ মেনে নিয়ে তাদের নেকড়ের হাতে ছেড়ে দিচ্ছে। পাকিস্তানে তার বাকি জীবন কেটেছে জেলে। তার স্বাধীন পাখতুনিস্তানের দাবি কিছুতেই মেনে নেননি ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন । যেমন মানেননি দেশভাগ প্রস্তাব কিছু দিন স্থগিত রাখতে মাওলানা আজাদের সনির্বন্ধ অনুরােধ অবশ্য নেহরু-প্যাটেল কঠিন জুটির বিরুদ্ধে আজাদ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিকে বশ মানাতে পারতেন না। গান্ধি তখন দেশভাগের বিপরীতে দাঁড়িয়েও ওয়ার্কিং কমিটির ওপর কোনাে প্রকার চাপ তৈরি করেননি। অথচ অতীতে করেছেন। করেছেন হসরত মােহানি উত্থাপিত স্বাধীনতা প্রস্তাব বা সুভাষচন্দ্রের কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার বিরুদ্ধে। যাই হােক এক জটিল ও চরম নৈরাজ্যিক অবস্থার মধ্যে ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের ভারতবিভাগ পরিক্রমা, নীতিগতভাবে দুদিক ধরে চলা, যদিও মূল লক্ষ্য ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী স্বার্থরক্ষা আর এ লক্ষ্য অর্জনে নতুন নতুন ভাবনাচিন্তা ও প্রস্তাব, কখনাে নতুন নায়কের মুখ। সবকিছু মিলিয়ে প্রবাদ বচনের মতাে ‘অসময়ে বর্ষাকাল হরিণী চাটে বাঘের গাল’ অবস্থা। মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব বাতিল হওয়ার পর, কী আশ্চর্য, তৎকালীন রিফর্মস কমিশনার ভিপি মেননের ওপর দায়িত্ব পড়ে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রস্তাব তৈরির আর মেননের প্রস্তাব একপা পিছিয়ে ভারতের জন্য ডােমিনিয়ন মর্যাদার স্বাধীনতা এবং তা কমনওয়েলথ-এ জোটবদ্ধ হয়ে। কী চমকপ্রদ রাজভক্তি? আরাে বিস্ময়কর যে সরদার প্যাটেলের সঙ্গে আলােচনার ভিত্তিতে মেননের প্রস্তাব তৈরি করা হলেও সমাজবাদী ধারণার নেহরু তা খুশিমনে গ্রহণ করেন । এতে যেমন ব্রিটেনের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্পর্ক নিশ্চিত করা হয়, তেমনি থাকে শক্তিশালী কেন্দ্রের ব্যবস্থা। শেষােক্ত বিষয়টি কংগ্রেস বিশেষ করে নেহরুপ্যাটেলের খুবই কাম্য ছিল, এমনকি গান্ধিরও। গােটা প্রস্তাবটি নিয়ে মাউন্টব্যাটেনের খুশি হওয়ার কথা, এমনকি অ্যাটলি মন্ত্রিসভারও। ভাইসরয়ের মন্তব্য ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জন্য এত বড় সুযােগ আর দেখা যায়নি’ (ম্যানসার, TOP, ১০ম খণ্ড) । অন্যদিকে জিন্না ও মুসলিম লীগ তাে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের গােয়ালে ঢুকতে বরাবর একপায়ে খাড়া। প্রসঙ্গত বাংলাভাগ সম্বন্ধে একটি কথা বলা দরকার যে, ধর্মীয় ভিত্তিতে ভারতভাগ মানতে হলে একই নীতিতে বঙ্গভাগও মানতে হয়।
যুক্তি অবশ্য দুটোকেই অগ্রাহ্য করে। আবার এক যাত্রায় পৃথক ফলও চলে না। কারণ ভারতভাগের পরিকল্পনায় স্বাধীন বাংলা মুসলিম জনপ্রাধান্যের কারণে। পাকিস্তানের সঙ্গে যােগ দিত, তখনকার রাজনৈতিক সামাজিক সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি এমনই ছিল। আদর্শ বা যুক্তিসঙ্গত শ্লোগান হওয়া দরকার ছিল : না পাকিস্তান, না-বাংলাভাগ। চাই গ্রুপিং থেকে বেরিয়ে আসার অধিকারসহ শক্তিশালী প্রদেশ ও দুর্বল কেন্দ্রের অখণ্ড ভারত ফেডারেশন। লীগ-কংগ্রেসের কল্যাণে তা সম্ভব হয়নি। কাজেই বাংলাভাগের দোষ বা দায় কংগ্রেস বা অমুসলমান বাঙালির ওপর চাপানাে যুক্তিগ্রাহ্য নয়। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-বিদ্বেষ তখন এমন পর্যায়ে ছিল যে পরস্পরের প্রতি আস্থা বা বিশ্বাসের সামান্য জায়গাটুকুও শেষ হয়ে গিয়েছিল । পাকিস্তান যেমন হিন্দুর জন্য আতঙ্ক, অখণ্ড ভারত তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুশাসন মুসলমানের পক্ষে তেমনই অগ্রহণযােগ্য। এ অবস্থায় নিরাপত্তার বাস্তব নিশ্চয়তা ছাড়া কোনাে প্রস্তাবে নিশ্চিত হওয়া কারাে পক্ষে সম্ভব ছিল না । বিভাগােত্তর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা (দুই ভূখণ্ডেই) তা প্রমাণ করেছে । জিন্নানেহরুর নিরাপত্তা গ্যারান্টি ধােপে টেকেনি।
মানতেই হবে ভারত বিভাগের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনীতিকদের নয়, প্রধানত আমলাতন্ত্রেরই জয়। সব পরিকল্পনার মৃত্যু ঘটিয়ে কমনওয়েলথভুক্ত ডােমিনিয়ন স্ট্যাটাস’, সবার ওপরে নেহরু-প্যাটেলের তাতে পূর্ণ আস্থা । সাম্প্রদায়িক শাস্তির যে আশ্বাস তাতে ছিল তা তাৎক্ষণিক তাে নয়ই, পরবর্তী সময়ের জন্যও অবাস্তব প্রমাণিত হয়। রক্তে দেশ ভাসে। তার মধ্যেই নেহরুর ভাষ্যে ‘নিয়তির সঙ্গে অভিসার’ স্বাধীনতার । কিন্তু রােমান্টিকতা রাজনীতির জন্য সাজে না। তার ফলাফল প্রায়শ তেতাে । মাত্র দুই মাসাধিক সময়ের মস্তিষ্কচর্চা ও টাইপরাইটারের খটাখট । এপ্রিলমে (১৯৪৭) দুমাসেই সব খতম। তিন বছরের কিছু অধিক সময়েও ভাইসরয় ওয়াভেল যা পারেননি, ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন সেই মূল কাজটি দুমাসে, এবং তার বাস্তবায়ন শেষ করেন মােট সাড়ে চার মাসে (১৯৪৭-আগস্ট)। ‘ডােমিনিয়ন মর্যাদার যে স্বশাসনের গার্হস্থ্য প্রস্তাব ১৬ মে (১৯৪৭) ভিপি মেননের খসড়ামাফিক তৈরি তা সব পক্ষের সমর্থন পেতে মােটেই দেরি হয়নি। মনে হয় তারা সবাই তৈরি হয়ে বসেছিলেন কত তাড়াতাড়ি ভােগের অমৃত পরিবেশন করা হবে। নেহরু সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাবের পক্ষে লিখিত সম্মতি জানান। জিন্না তার স্বভাববৈশিষ্ট্যমাফিক মৌখিক সম্মতি দেন, লিখিত কিছু নয়। | উৎফুল্ল মাউন্টব্যাটেনের ১৮ মে মেননকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডন অভিমুখে যাত্রা। লন্ডনে অ্যাটলি মন্ত্রিসভা ও কমন্স সভায় ভারতত্যাগ ও ভারতবিভাগ এবং ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে আলােচনা এবং তা গ্রহণ এবং ৩১ মে (১৯৪৭)। আত্মতৃপ্ত ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের দিল্লি প্রত্যাবর্তন। ইতিমধ্যে জিন্নার আরেক বাগড়া, দুই পাকিস্তানের সংযােগ সেতু করিডাের’ চাই। কিন্তু সে দাবি শেষ পর্যন্ত টেকেনি। বড় কথা হলাে ক্ষমতার জন্য তখন সবাই ব্যাকুল, অস্থির। কাজেই প্রস্তাব গ্রহণে দেরি হয়নি। কংগ্রেস ও শিখ প্রতিনিধির কাছ থেকে লিখিত ও লীগ প্রতিনিধি জিন্নার মৌখিক সম্মতি আদায় করে ৩ জুন (১৯৪৭) সকালে মাউন্টব্যাটেন সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠকে বসেন এবং সেদিন সন্ধ্যায় সে খবর দেশবাসীর উদ্দেশে প্রচার করেন। ক্ষমতা হস্তান্তর হবে ১৯৪৮ জুনের পরিবর্তে ১৫ আগস্ট (১৯৪৭)। লন্ডন থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলিও একই ঘােষণা প্রচার করেন। ইংরেজ শাসন থেকে ভারতের মুক্তির ভবিতব্য এভাবে নির্ধারিত হয়।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক