বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৭ই আগস্ট, শনিবার, ৩১শে শ্রাবণ, ১৩৮১
প্রকৃতির নির্মম পরিহাস
গোটা বাংলাদেশ আজ সর্বগ্রাসী বন্যা বিপর্যস্ত। মানুষ যখন হাহাকার করছে, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে, ঠিক সেই মুহূর্তে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ দেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলে নিদারুণ আঘাত হেনেছে। যার ফলে খুলনার উপকূলবর্তী অঞ্চল বরিশাল, পটুয়াখালী ও নোয়াখালী উপকূল অঞ্চলের উপর প্রচন্ড ঝড় বয়ে গেছে এবং প্রচন্ড বৃষ্টিপাত হয়েছে। ঘন্টায় ৫০ থেকে ৬০ মাইল বেগে এই ঝড় প্রবাহিত হয়েছে। ঝড় ও বর্ষণের কারণে দেশের প্রখ্যাত মঙ্গলা বন্দর বিপন্ন হয়ে পড়েছে এবং এখন মত পানি পড়লে গোটা মঙ্গলা বন্দর জলমগ্ন হয়ে পড়বে। খুলনার দাকোপ থানা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বলেও জানা গেছে। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে খুলনা শহর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রায় এক লক্ষ লোক আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। এছাড়া বাগেরহাট, শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ, কচুয়া প্রভৃতি থানা বর্তমানেও নাকি এক থেকে দুই ফুট পানির নিচে। ওয়ালেস স্টেশন বিপন্ন। বাগেরহাটের তারাপুর, ষাটগম্বুজ, চিতলমারী, বিষ্ণুপুর ও গোটাপাড়া ইউনিয়ন সম্পূর্ণভাবে পানির নিচে রয়েছে। একটি সংবাদ সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী চালনাও সম্পূর্ণ পানির নিচে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বরিশাল শহর ও শহরতলীও জলমগ্ন হয়েছে, বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে গেছে। গতকালের সংবাদ অনুযায়ী বরিশালের কিছু কিছু অঞ্চলে গত ২৪ ঘন্টায় পানি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পশ্চিমে সৃষ্ট নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে খুলনার উপর দিয়ে ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৬০ মাইল বেগে প্রবাহিত হওয়ার পর নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং ঘন্টায় ৩৫ থেকে ৪০ মাইল বেগে বঙ্গোপসাগরের উপকূল এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই ঘূর্ণিঝড়টি পশ্চিমবঙ্গের কুস্তাই বন্দরে আঘাত হেনে ক্ষতি সাধন করেছে বলেও জানা গেছে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বরিশাল-পটুয়াখালী, পাথরঘাটা, ভোলা, নোয়াখালী, রামগতি, হাতিয়া প্রভৃতি এলাকায় ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব এলাকার উপর দিয়ে ৩০ থেকে ৪০ মাইল বেগে ঝড় বয়ে গেছে।
অন্য খবরে প্রকাশ, সব ক্ষতি মিলিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৬ লাখ লোক ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চাঁদপুরের উপর দিয়েও ঝড় এবং প্রবল বৃষ্টিপাত হয়েছে। বস্তুতঃ বাংলাদেশের মানুষের আজ এক ভয়াবহ অবস্থা। বন্যার কারণে আজ দেশের প্রায় ৩ কোটি লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ অসহায় এর মত প্রাণ হারাচ্ছে। খাবারের অভাবে মানুষ আজ হা-অন্ন হা-অন্ন রব তুলেছে। দেশের সকল মানুষের দৃষ্টি আছে সেদিকে নিবন্ধ। সরকার তার সাধ্যমত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ঠিক এমনই এক মর্মান্তিক মুহূর্তে আবার ঘূর্ণিঝড় হয়ে কয়েক লাখ মানুষের জীবন ও সম্পদ বিপন্ন করে তুলেছে। দেশের যে সকল এলাকায় বন্যার ভয়াবহতা কম ছিল নিয়তির পরিহাস এর মত ঠিক সেই সকল এলাকার উপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় হয়ে গেছে। জাতির এই মহা দুর্দিনের বন্ধু দেশগুলো যারা অতীতে সর্বদা আমাদের দুর্দিনের সময় একাত্ম হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন তারা আজ অসহায় মানবাত্মার পাশে এসে দাঁড়াবেন বলে আমরা আশা রাখি। ত্রাণকার্য জোরদার করা দরকার উপদ্রুত অঞ্চলে কিন্তু আমরা সরকারের সমর্থক সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল। তবু যা রয়েছে তার সদ্ব্যবহার এর দ্বারা কতৃপক্ষকে ছিন্নমূল মানুষের সেবা চালিয়ে যেতে হবে। জনগণকেও সরকারের ত্রাণ কাজে সহযোগী হিসেবে কাজ করতে হবে। নইলে এত বড় দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
দশে মিলি করি কাজ-
আঘাতই সংগ্রামের দুরন্ত বন্যার হিংস্র নখরাঘাতে আজ বাংলাদেশে বিপর্যস্ত ও বিপন্ন। কোটি কোটি অসহায় মানুষ বোবা পশুর মত দুর্বহ বেদনার আবর্তে অনিশ্চিত জীবন যাত্রার বাধ্য হয়ে গা ঢেলে দিয়েছে। কিন্তু তবু দেখা যায় মরণঘাতী আত্মঘাতের মধ্যে থেকেও একশ্রেণীর সংগ্রামী মানুষ বেরিয়ে আসছে নিয়তির সঙ্গে পাঞ্জা কষার মনোভাব নিয়ে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত দিয়ে তারা সর্বশক্তি ব্যয়ে রুখে দাঁড়াবার শপথে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে।
পত্রিকান্তরের প্রতিবেদনে এমনই এক সংগ্রামের বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছে। ১১ই আগস্ট সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের কেবল ট্রেঞ্জ এবং হাসনাবাদ রোজ গার্ডেন, ইসলামাবাদ, জিনজিরা, নারিন্দা রোড, খিলগাঁও, বাসাবো এই ৮টি স্টেশনে বন্যার পানি ঢুকে পড়ে। ফলে সামগ্রিকভাবে রাজধানীর বিদ্যুৎ সরবরাহ বিপর্যস্ত এবং ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে। রাজধানীতে এমনিতে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনায় এমন নয় তবে হলো মরার উপর খাঁড়ার ঘা।
রাজধানীতে বিদ্যুৎ সরবরাহ এই হুমকি মোকাবেলায় বিভাগীয় ১১ জন এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার তাদের সহকর্মীদের নিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখার লড়াইয়ে নেমেছেন। তাদের সংগ্রামের পর্বকে যথাযথ এবং নিপুন করার জন্য বন্যা কবলিত রাজধানী ঢাকাকে তারা এগারটি অঞ্চলে ভাগ করেন। সমগ্র কার্য পরিকল্পনার স্ট্রাটেজি তৈরি করছেন অভিজ্ঞ প্রকৌশলী।
বন্যার পানি চুইয়ে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবল’ এ কোন গোলযোগ দেখা দিলে তা যাতে সরাসরি ধরা পড়ে-প্রকৌশলীরা সেজন্য কোন কোন সাবস্টেশনের সঙ্গে প্রধান লাইনের সরাসরি যোগাযোগ জুড়ে দেন। কোথাও বা তিন শিফটে ৬ জন ইলেকট্রিক হেলপার সাবস্টেশনের ভেতরের বন্যার পানি সেচে ফেলছেন। ইতিমধ্যে নারিন্দা সাব স্টেশন থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করা সম্ভব হয়েছে। এবং অন্যান্য অঞ্চলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য সামগ্রিক সংগ্রাম চলছে।
মাত্র ক’দিন আগেও পত্রিকান্তরে প্রতিবেদনে আমরা বন্যা আক্রান্ত ডি,এন,ডি বাঁধ রক্ষার সংগ্রামের বর্ণনা পড়েছি। আটজন ঠিকাদারের নেতৃত্বে ছ’শ উপর শ্রমিক বাঁধের ফাটল রোধের জন্য কঠিন সংগ্রাম করেছেন এবং এখনো করছেন। এদের সঙ্গে সেচ বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিদ্যুৎ বিভাগের আরো ১৪৫ জন কর্মচারী দিনরাত ঢাকা-ডেমরা-নারায়াঙ্গঞ্জ প্রকল্পের ২১ মাইল দীর্ঘ বাঁধ রক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। শ্রমিক-মালিক ভেদাভেদ নিজের ও অন্যের কল্যাণের কথা চিন্তা করেই কর্মীরা বন্যার নিষ্ঠুর তাণ্ডবের মুখে দুঃসাহসী সৈনিকের মতো সংগ্রাম চালাচ্ছেন-তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার্হ ও বরণীয়।
উল্লেখিত দুটি ঘটনায় প্রমাণ করে যে, কোনো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে যৌথ চেষ্টার স্বেচ্ছাশ্রম ও সহযোগিতা দিয়ে অনেক কিছু করা যায়। পারস্পারিক সমঝোতা সহকারে দুর্যোগ মোকাবেলা করার মনোভাবই সেই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় মনোবল। জাতীয় সঙ্কট নিরসনের হাতিয়ারও সেইটি। একথা সত্য যে, জীবনের গল্প ও বৃহৎ পরিসরে নানাবিধ আঘাত আসবেই। ঠিক সেই মুহূর্তে অসহায় স্ববীরত্বে যদি আমরা অধিকতর নৈরাশ্যে ডুবে যায় তাহলে সকলেরই ক্ষতি। তাই আত্মশক্তি ও সমবেত শ্রমশক্তির দ্বারা বাহ্য প্রতিঘাতকে যতটা পর্যন্ত প্রতিরোধ করা সম্ভব-দৃঢ় শপথ নিয়ে সেই সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে। এরই মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ একর জমির ফসল রক্ষা পেতে পারে। ফাটল ধরা বাঁধ রক্ষা করে হাজার হাজার ঘরবাড়িকে অক্ষত রাখা যেতে পারে, আঞ্চলিক বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রেখে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার প্রচেষ্টা ও নেয়া যেতে পারে। এবং আরও অনেক কিছু করার সম্ভাবনাও রাখা যায়। এতে একক লাভ ও জাতীয় স্বার্থের সার্বিক লাভ আছে। এই মানসিকতা ও সংগ্রামী চরিত্রই আজ জাতির কাছে সবচেয়ে বড় কামনার ধন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক