অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে বেজায় টানাপড়েন
প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘােষণার আগেও লীগ-কংগ্রেস দ্বন্দ্বে ঘটনা হয়ে ওঠে সমস্যা-জটিল। ব্রিটিশরাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া হিসেবে কেবিনেট মিশন প্রস্তাব দুই পরস্পর-বিরােধী দল লীগ-কংগ্রেসকে দিয়ে গ্রহণ করানাে এবং একটি সাময়িক অন্তর্বর্তী সরকার গঠন। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় কোন্ দল কটা আসন পাবে তাই নিয়ে । স্বভাবতই প্রত্যেকে চাইবে নিজ নিজ পাতে ঝােল টানতে, তা যুক্তিসঙ্গত হােক বা না হােক । বিষয়টি ইতিপূর্বে আলােচিত হয়েছে যে কয়েক সপ্তাহের সংলাপ শেষেও অচলাবস্থা না কাটায় ভাইসরয় ওয়াভেল কেবিনেট মিশনের সঙ্গে আলােচনা করে ১৬ জুন (১৯৪৬) এক বিবৃতির মাধ্যমে তাদের নিজস্ব প্রস্তাব ঘােষণা করেন। চৌদ্দ সদস্যের সম্ভাব্য নির্বাহী কাউন্সিলে কংগ্রেস, লীগ ও অন্য সংখ্যালঘুদের যথাক্রমে সংখ্যানুপাত ৬:৫:৩। বলা হয়, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব নিরসনের কথা ভেবে এই সংখ্যানুপাতের প্রস্তাব । যে কথা তারা বলেননি তাহলে সম্প্রদায় সমস্যার কারণে জনসংখ্যার হিসাব না মেনে লীগকে বেশি। আসন দেয়া হয়েছে। মূলত দুটো কারণে কংগ্রেস এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। প্রথমত সংখ্যাসাম্য, দ্বিতীয়ত তাদের পক্ষ থেকে মুসলমান সদস্য দিতে না পারা। দ্বিতীয় কারণ তাদের কাছে অধিক গুরুত্ব পায় । দুটো আপত্তিই গণতন্ত্রের রীতিনীতির যুক্তিতে টেকে। তবে সব ক্ষেত্রে, সব সময় অঙ্কের হিসাবমাফিক চলা যায় না। কাউকে কাউকে কিছুটা ছাড় দিতে হয় । কিন্তু এক্ষেত্রে কেউ সে ছাড় দিতে চায়নি। শেষ ঘণ্টা বাজার আগে কংগ্রেস মাউন্টব্যাটেনের কূটচালে মাত হয়ে ছাড় দিতে রাজি হয় খণ্ডিত ভারত ও খণ্ডিত স্বাধীন পাকিস্তান মেনে নিয়ে। এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা নেহরু-প্যাটেলের। যা হােক, ওয়াভেল প্রস্তাব প্রত্যখ্যান সম্পর্কে পেন্ডেরেল মুন লিখেছেন : “গান্ধি শেষ মুহূর্তে বাগড়া না দিলে কংগ্রেস কেবিনেট মিশন কথিত অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব মেনে নিত এবং জুলাইয়ের শুরুতে কেন্দ্রে কংগ্রেস-লীগ।
কোয়ালিশন সরকার গঠিত হতাে। সেক্ষেত্রে পরবর্তী কয়েক মাসের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখা দিতাে না’ (ওয়াভেল ডায়েরি, উদ্ধৃতি ঘােষ, প্রাগুক্ত)। কিন্তু সে কথা কি নিশ্চিত করে বলা যায়? কারণ জিন্নার আচরণে যা দেখা গেছে তাতে অন্তত একটি বিষয় স্পষ্ট যে পাকিস্তান প্রস্তাব আস্তিনে রেখে জিন্না ব্রিটিশ উত্থাপিত প্রস্তাবগুলাে নিয়ে সংলাপে বসেছেন এবং অগণতান্ত্রিক বা অযৌক্তিক দাবি পেশ করে আলােচনা ভাঙার পথ তৈরি করেছেন। তাই পাকিস্তানকে হাতিয়ার (আয়েশা জালাল ও অন্যান্য) নয়, বরং পাকিস্তানের জন্য আর সব সম্ভাবনা তিনি নানা দাবির হাতিয়ারে খণ্ডিত করেছেন। সেসব ক্ষেত্রে তার মূলকথা একটাই : মুসলিম স্বার্থ বিপন্ন’। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জিন্না নিজ দলেও নিয়মকানুনের ধার ধারতেন না। এদিক থেকে তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের সর্বাধিনায়ক বা একনায়ক। নিজের প্রস্তাবিত নিয়মও তিনি প্রয়ােজনমতাে ভেঙেছেন। যেমন অন্তর্বর্তী সরকারে যােগ দেয়ার জন্য যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে মুসলিম লীগ প্রস্তাবিত পাঁচ সদস্যের অন্তর্ভুক্ত করে, যে বিষয়ে মাওলানা আজাদ ভাইসরয়ের কাছে লেখা চিঠিতে অভিযােগ বা আপত্তি উত্থাপন করেছেন্ট) তফসিলি হিন্দু মি, মণ্ডল যদি লীগ সদস্য না হয়েও মন্ত্রীমণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন তাহলে মুসলমান কংগ্রেসি। নেতা কেন কংগ্রেস প্রস্তাবিত মীমণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন না। মাওলানা আজাদের এই বক্তব্যে যুক্তি রয়েছে। আর এই যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, তার ওয়ার্কিং কমিটি এমনি একাধিক কারণে অনিচ্ছার সঙ্গে ১৬ জুনের (১৯৪৬) অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব গ্রহণে অপারগতা জানাচ্ছে (২৫ জুন, ১৯৪৬)। লীগ-কংগ্রেসের এ জাতীয় কঠিন টানাপড়েনে ভাইসরয় ওয়াডেলের ‘ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। একদিকে কংগ্রেস অন্যদিকে লীগ, মধ্যিখানে কেবিনেট মিশন- প্রত্যেকে নিজস্ব মতে স্থির- ভাইসরয়ের হাঁসাস ভিন্ন উপায় কী?
আমাদের মনে হয় মুসলমান সদস্য মনােনয়ন ইস্যুটিকে কংগ্রেস দেশের বৃহত্তর দল হিসেবে দেশ ও সম্প্রদায় স্বার্থে হালকাভাবে নিতে পারত, জিন্নার কাঠিন্যের বিরুদ্ধে অনুরূপ কাঠিন্য প্রকাশ না করে। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্বেও কঠিন চিন্তার, সম্প্রদায়চিন্তার অভাব ছিল না, যেমন বল্লভভাই প্যাটেলের মতাে রাজনৈতিক নেতা। অবস্থা অনুকূল বিধায় জিন্না-লীগ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব (১৬ জুনের) বিবৃতিসহ গ্রহণ করে এবং প্রত্যাশায় থাকে যে কংগ্রেসের টালবাহানার কারণে সরকার গঠন করতে তাদের ডাকা হবে। কিন্তু বৃহত্তর জনপ্রতিনিধিত্বের দল কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন যুক্তিযুক্ত মনে করেননি ভাইসরয় এবং কেবিনেট মিশনের কোনাে কোনাে সদস্য। এর পেছনে অবশ্য গৃঢ়তর কারণ কংগ্রেসের আন্দোলন সংঘটিত করার ক্ষমতাই নয় সেখানে বামপন্থীদের প্রাধান্য বিস্তারের আশঙ্কা। কংগ্রেস যাতে তার চরমপন্থীদের হাতে ছিনতাই না হয়। অবশ্য সে মুহূর্তে তেমন সম্ভাবনা ছিল না বিশেষ করে সুভাষচন্দ্রের অনুপস্থিতিতে। তবে বাম রাজনীতির শক্তিবৃদ্ধি, বিভিন্ন খাতে ধর্মঘট দেশে যথেষ্ট অস্থিরতা তৈরি করে চলছিল। তদুপরি আজাদ হিন্দ ফৌজের মতাে বিষফেঁাড়ার উপস্থিতি যা ব্রিটিশরাজের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তাই ভাইসরয়ের ধর্না কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে (অবশ্য তার প্রাসাদেই) যা তার একান্ত মহলে অস্বাভাবিক ঠেকেছে। ঠেকলে কী হবে? ওয়াভেলের চেষ্টা যে কোনােভাবে হােক একটি গ্রহণযােগ্য সমাধানে পৌছানাে। এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা। ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিতে চাননি ভাইসরয় । লীগকংগ্রেসের অদ্ভুত দ্বন্দ্বের টানাপড়েনে অনভ্যস্ত সৈনিক ভাইসরয় এতটা হতাশায় আক্রান্ত হন যে ভাইসরয়ের দায়িত্ব থেকে তাৎক্ষণিক অব্যাহতির কথা তার মনে হতে থাকে। তার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল ২৯ জুন কেবিনেট মিশন সদস্যগণ স্বদেশের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগেই লীগ-কংগ্রেসকে নিয়ে একটা সমঝােতায় পৌছানাে। কিন্তু লীগ-কংগ্রেসের একগুঁয়েমি তাকে হতাশা ও ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দেয়। সে দায়ভাগে না চাইতে তার অব্যাহতি মেলে কিছু সময় পরে এবং কিছুটা অসৌজন্যমূলকভাবে । হয়তাে এর পেছনে ক্রিপসের হাত ছিল। এটাও ছিল নিয়তিতাড়িত ঘটনা, যা দেশভাগের পথ সহজ করে দেয়।
কিন্তু ওয়াভেলের চেষ্টায় আন্তরিকতার অভাব ছিল না, অন্তত আজাদের তেমনই ধারণা। সঙ্গত কারণে ওয়াভেলের চিন্তা- কোনাে একক দল নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন না করা, হােক লীগ বা কংগ্রেস। এদিকে পরিস্থিতি দেখে জিন্না মহাবিরক্ত, মূলত মুসলিম লীগকে কংগ্রেসের অনুপস্থিতিতে এককভাবে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান না জানানাের কারণে। স্বভাবতই লীগ বা জিন্নার প্রতিক্রিয়ার ফলবােম্বাইয়ের আহমেদাবাদে জঘন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অবশ্য তাতে রাজের কিছু যায়-আসে না। কিন্তু যেসব বিষয়ে ‘আসে-যায় তাহলাে শ্রমিক অসন্তোষ, ধর্মঘট- যেমন কমিউনিস্ট পার্টির ডাকে ২৯ জুলাই কলকাতায় ডাক ধর্মঘটের সমর্থনে সফল হরতাল। এসব বিষয়ে ৯ আগস্টের গােয়েন্দা প্রতিবেদন হলাে- ‘শ্রমিক অসন্তোষ ক্রমেই বিপজ্জনক মােড় নিতে শুরু করেছে। কাজেই একটি দায়িত্বশীল সরকার এ সম্বন্ধে সঠিক ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারবে’ (ম্যানসার)। কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী অংশেরও এ বিষয়ে উদ্বেগ কম ছিল না? বিশেষ করে সরদার প্যাটেলের মতাে নেতাদের। তারা চাইছেন না বাম রাজনীতির ক্ষমতা বৃদ্ধি হােক। বিদেশসচিব পেথিক লরেন্সের কাছে ওয়াভেলের পাঠানাে বার্তায় এসব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা রয়েছে। রয়েছে এমন কথাও যে, প্যাটেল সরকার গঠনে যােগ দিতে আগ্রহী এবং সরকার গঠিত হলে কংগ্রেস শক্ত হাতে কমিউনিস্টদের দমন করবে, যাতে শ্রমিক অসন্তোষ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে না পারে । ভাইসরয়ের ওপর ভারতসচিবের দিক থেকে চাপ ছিল দ্রুত অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য। যাতে সব দিক ভালােভাবে সামাল দেয়া যায়, বিশৃঙ্খলা দমনের দায় যাতে স্থানীয় নেতাদের ওপর পড়ে। আলােচনায় কংগ্রেসের গড়িমসির মধ্যেও সরকার গঠনের ইচ্ছা বেশ প্রবলই ছিল। এবার জিন্নার কিছু প্রশ্ন কংগ্রেসের প্রতি ব্রিটিশরাজের নমনীয় ভাবের কারণে সব শুনে ভারতসচিবের নির্দেশ আপাতত জিন্নাকে হিমঘরে রেখে কংগ্রেস তরফে নেহরুকে সরকার গঠন করতে ডাকা হােক। তবে মুসলমান আসনগুলাে পূরণ না করাই ভালাে, যাতে মুসলিম লীগের জন্য দরজা খােলা থাকে। সেভাবেই আলােচনা, সেভাবে ব্যবস্থা নেয়া।
কংগ্রেস, বিশেষ করে নেহরু-প্যাটেল প্রমুখ আমন্ত্রণের জন্য এক পায়ে খাড়া ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের পর ভাইসরয়কে নেহরুর পক্ষ থেকে জানানাে হয় যে তারা দায়িত্ব গ্রহণে প্রস্তুত। মুসলিম লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠনেও তাদের আপত্তি নেই। দেশের জন্য এ মুহূর্তে দরকার একটি শক্তিশালী, কার্যকর, স্থায়ী সরকার, যারা দেশের মনকে জানে এবং সাহসের সঙ্গে কাজ চালাতে পারবে । শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ মন্ত্রীমণ্ডলীর এবং সম্রাটের সম্মতি সাপেক্ষে ২ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। লীগ তখনাে মন স্থির করে উঠতে পারেনি কিন্তু তারা ক্ষুব্ধ। মুসলিম লীগের জঙ্গি চরিত্রের কথা নির্বাচন উপলক্ষে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর তেমনই প্রকাশ দেখা গেল। জাতীয়তাবাদী বা কংগ্রেসি মুসলমান নেতাদের জিন্না প্রকাশ্যে কুইসলিং’ নামে অভিহিত করে গালাগালি দিতে দ্বিধা করতেন না। এমনকি ভাইসরয় ওয়াভেলের কাছে লেখা চিঠিতেও তিনি এ শব্দটি ব্যবহার করেছেন (ভিপি মেনন)। তাই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রথম পর্বে কংগ্রেস মনােনীত মুসলিম সদস্য স্যার শাফায়াত আহমদ খান মুসলিম লীগ গুণ্ডাদের আক্রমণে গুরুতরভাবে আহত হবেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। সেই সঙ্গে ঘটে বােম্বাই শহরে বিক্ষিপ্ত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, ঘটক মুসলিম লীগের ক্যাডার বাহিনী। মুসলিম লীগ এই চরিত্র অর্জন করে চল্লিশের দশকে পৌছে লীগ-সভাপতি জিন্নার হাত ধরে, তার পরিচর্যায় এর বিকাশ বিশেষ করে ন্যাশনাল গার্ড গঠনের মধ্য দিয়ে। এ জাতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি চরম পর্যায়ে পৌছে ১৯৪৫ থেকে। পাকিস্তান আমলেও লীগ শাসকশ্রেণির মধ্যে এই সহিংস চরিত্রের প্রকাশ লক্ষ করা গেছে সমালােচক বিরােধীদলীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করার নীতি প্রয়ােগে । ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশে অবিভক্ত বঙ্গে সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার শাসনামলেও দেখা গেছে এমনই উদাহরণ কুখ্যাত কলকাতা হত্যাকাণ্ডের বিবরণ প্রত্যক্ষদর্শীর তাে বটেই ইতিহাস পাঠকের পক্ষেও ভােলা কঠিন।
স্বভাবতই বাংলায় সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল না। জনঅসন্তোষ এ পর্যায়ে পৌছে যে, সােহরাওয়ার্দী নিজেই কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠনের কথা ভাবতে থাকেন, যাতে জনসাধারণের আস্থা অর্জন করা যায় । কিন্তু জিন্না তার এই প্রস্তাব উড়িয়ে দেন কৃতকর্মের আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হতে থাকার কারণেই কি সােহরাওয়ার্দীদশভাগের পর কলকাতা ছেড়ে পাকিস্তানে না গিয়ে সাম্প্রদায়িক শান্তির প্রচারে গান্ধির সহযােগী হন? অবশ্য এর পেছনে আরাে একটি কারণ স্পষ্ট। পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠনে জিন্নার আশীর্বাদধন্য খাজা নাজিমুদ্দীন গ্রুপের প্রাধান্য এবং খাজা সাহেবকে মুখমন্ত্রীপদে বরণ । শহীদ সােহরাওয়ার্দীর রাজনীতির ভিত কলকাতা ও কলকাত্তাই মুসলমান যাদের গরিষ্ঠ অংশ উর্দুভাষী। অন্যদিকে খাজা স্যার নাজিমুদ্দীন ঢাকাই নবাব পরিবারের সদস্য এবং বিভাগ-উত্তর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় তাদের প্রভাব যথেষ্ট। এমনি একাধিক কারণ সােহরাওয়ার্দীকে দেশবিভাগের অব্যবহিত পর বেশ কিছুকাল বিষন্ন, বিচ্ছিন্ন ও হতাশাগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতায় পরিণত করেছিল। তদুপরি মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের বিরােধিতার মুখে তিনি ঢাকা যেতে স্বাচ্ছন্দবােধ করেননি। পরে অনুকূল অবস্থায় তার ঢাকায় আগমন। আবারাে অন্তর্বর্তী সরকার প্রসঙ্গ। জিন্না হয়তাে বুঝতে পেরেছিলেন যে চটজলদি ভাইসরয়ের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করা ঠিক হয়নি। কারণ তার অধিকাংশ দাবিই পূরণ করা হয়েছিল। তাই হয়তাে দ্বিতীয় বিবেচনায় তারই নির্দেশে স্যার নাজিমুদ্দীন ভাইসরয়ের কাছে প্রস্তাব রাখেন যে, কংগ্রেস প্রদেশ বিষয়ক জেদ পরিত্যাগ করে ১৬ মের বিবৃতি মেনে নিলে জিন্না হয়তাে মিশন প্রস্তাব গ্রহণ ও অন্তর্বর্তী সরকারে যােগ দেয়ার বিষয় পুনঃবিবেচনা করতে পারেন। | ভাইসরয় নাজিমুদ্দীনের প্রস্তাব শুনে অবাক হন, সেই সঙ্গে খুশিও। কারণ তারও অস্বস্তি ছিল মুসলিম লীগকে বাইরে রেখে সরকার গঠন ও পরিচালনার বিষয়ে। তিনি সময় নষ্ট না করে বিষয়টি নিয়ে গান্ধি ও নেহরুর সঙ্গে আলাপ করেন। কিন্তু নেহরু-জিন্নার মধ্যে যে জমাট আগ্নেয় শিলার বাধাবন্ধক তা অপসারণ খুব সহজ কাজ ছিল না। এ দুই ব্যক্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাতুতে গড়া। একজন আবেগপ্রবণ, তরল ও চঞ্চল প্রকৃতির, অন্যজন শীতল রক্তের ধীরস্থির। ব্যক্তিত্ব, কঠিন শিলাখণ্ডের মতাে। এই দুই বিপরীত মেরুর দূরত্ব দেশভাগের একাধিক কারণের মধ্যে অবশ্যই অন্যতম। নেহরুর ‘হৃদয়াবেগের দ্বারা চালিত। হওয়ার কথা আজাদ একাধিকবার উল্লেখ করেছেন তর আত্মজীবনী গ্রন্থে।
ক্ষমতার এমনই জাদু যে জিন্নার মতাে শীতল রক্তের মানুষও ক্ষমতার উত্তাপ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। নেহরু-প্যাটেলদের মতাে জিন্নারও একমাত্র লক্ষ্য ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকার, আর সেজন্যই স্বতন্ত্র ভুবন পাকিস্তান দাবি। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তাৎক্ষণ্টিক লক্ষ্য কেন্দ্রে অন্তর্বর্তী সরকার । ভুল শুধরে নেয়ার পদ্ধতিটাও পরােক্ষ যাতে ব্যর্থতার গ্লানি সরাসরি তাকে স্পর্শ। করতে না পারে। তাছাড়া আরাে একটি পূঢ় উদ্দেশ্য ছিল জিন্নার ।। নাজিমুদ্দীনের পর এবার সোহরাওয়ার্দী। দিল্লিতে এসে তিনি বলেন যে, কংগ্রেস যদি লীগের দিকে আন্তরিক সহযােগিতার হাত বাড়ায় তাহলে জিন্না তার দাবির চেয়েও কম নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবেন (ভিপি মেনন)। এ যেন আমন্ত্রণ পাওয়ার জন্য দুপা বাড়ানাে অন্য এক জিন্না । ভাইসরয় বুঝে নিলেন, এখন সময় হয়েছে জিন্নাকে ডেকে পাঠানাের এবং একটা মীমাংসায় পৌছানাের। এ বিষয়ে ভারতসচিবের সম্মতিও পাওয়া গেল। নেহরুরও এ ব্যাপারে দ্বিমত নেই। অতএব ভাইসরয়-জিন্না বৈঠক ১৬ সেপ্টেম্বরে। দুজনের দীর্ঘ আলােচনা সহযােগিতার আবহে । ভাইসরয়ের পক্ষ থেকে আশ্বাস প্রদেশ নিয়ে, গ্রুপিং নিয়ে এবং সংখ্যগরিষ্ঠকে মাথার ওপর চড়তে না দেয়ার। কিন্তু শেষমেশ পাথরে ঠোক্কর কংগ্রেস পক্ষের মুসলমান প্রতিনিধি নিয়ে । জিন্নার বক্তব্য, তার অনুসারীগণ এটা মানতে চাইবে না। আসলে আপত্তি বরাবরই জিন্নার । বােধহয় ভেতরে হাসি চেপে ওয়াভেলের মন্তব্য : ওদের না মানাটা খুবই দুঃখজনক। কিন্তু এর পরিণামও খুবই গুরুতর। তাই বিষয়টি নিয়ে জিন্না যেন ভেবে দেখেন পরে আবার আলােচনায় বসা যাবে (ভিপি মেনন)। এরপর কয়েক দফা আলােচনা জিন্না, নেহরু, গান্ধিকে নিয়ে চক্রাকারে ।
ঘুরে-ফিরে সেই জাতীয়তাবাদী মুসলমান ইস্যু’ । জিন্নার যুক্তিহীন দাবি মানতে নারাজ কংগ্রেস। এটা আসলে গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্ন। এরপর আবার জিন্নার সঙ্গে ভাইসরয়ের বৈঠক (২ অক্টোবর)। সময় দ্রুত এগিয়ে চলেছে, ঝরঝর করে বালি নেমে যাচ্ছে। ভাইসরয় জিন্নাকে বােঝাতে চাইছেন সময়ের গুরুত্ব এবং এই বিশেষ ইস্যুতে কংগ্রেসের অনড় অবস্থানের কথা। শেষ পর্যন্ত জিন্না তার ৯ দফার ভিত্তিতে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডাকতে রাজি হন। এরপর ওই ৯ দফা নিয়ে দফাওয়ারি আলােচনা। হ্যা’, ‘না’ হ্যা’র মধ্য দিয়ে সময়ের বালি গড়িয়ে চলেছে। ওয়াভেল তার ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে। যাচ্ছেন, বুঝতে পারছেন ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের জটিল মনস্তত্ত্ব । অবশেষে বরফগলার পালা। ভাইসরয় নেহরুকে জানান, জিন্নার সম্মতিপত্র পাওয়া গেছে। যেন এক বিরাট যুদ্ধজয়। তবে জিন্নার মনােনীত সদস্যদের মধ্যে একজন অমুসলমান থাকবেন। অর্থাৎ দাঁতের বদলে দাঁত। শেষ পর্যন্ত জিন্নার তরফ থেকে নামের তালিকা এলাে : লিয়াকত, চুন্দ্রীগড়, নিশতার, গজনফর, তবে শেষ যে নামটি সুৰার জন্যই অভাবিত (জিন্নার সারপ্রাইজ’!), তাহলাে যােগেন মণ্ডল । শেষোক্ত জনের জীবনের ট্রাজেডি হলাে জিন্নার কুহকে পড়ে ও আত্মস্বার্থের টানে পাকিস্তানে এসেও তার শেষ যাত্রা ফের ভারতে। পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িকতার চাপে আবার দেশত্যাগ। দিনটি ছিল ১৫ অক্টোবর ভাইসরয় ওয়াভেলের জন্য একটি স্বস্তিদায়ক দিন। মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তী র্সরকারে যােগ দিচ্ছে’। লীগ অন্তর্বর্তী সরকারে যােগ দিচ্ছে’ । কাগজে কাগজে মােটা হরফে হেডলাইন। এদের জন্য আসন ছেড়ে একে একে বেরিয়ে গেলেন শরৎ বসু, স্যার শাফায়াত আহমদ খান ও সৈয়দ আলী জহির । মহামহিম ম্রাট সমুদ্রের ওপার থেকেই এই পাঁচজনকে বরণ করে নিলেন। কায়েদে আজম জিন্দাবাদ’ ধ্বনি উঠল মুসলিম লীগ শিবিরে। ভাইসরয় ওয়াভেল ভুলেও বুঝতে পারেননি এ স্বস্তি কত ঠুনকো। যার শেষ। ভালাে তার সব ভালাে প্রবাদ যে কত বড় সত্য ব্যক্তিজীবনে, জাতীয় জীবনে, রাজনৈতিক জীবনে মানুষ তা বারবার ঠেকে বুঝেছে। লীগ পক্ষের সদস্য মনােনয়নে খুশি হননি নেহরু। কেন হননি তা স্পষ্ট ভাষায় ভাইসরয়কে জানিয়েছেন তিনি। গান্ধিও খুব একটা স্বস্তিবােধ করেননি। তবে বুঝতে পারছিলেন, মুসলিম লীগ লড়াইয়ের মানসিকতা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারে যােগ দিয়েছে। এবার শুরু হবে নতুন লড়াইয়ের পালা। কিন্তু কী করা যাবে- ‘নিয়তি কেন বাধ্যতে’। আর ভাইসরয় ওয়াভেল? আপাত সাফল্যে তিনি বুঝতে পারেননি যে জিন্নাকে চিনতে তার অনেক দেরি।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক