You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.03.23 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় |কৃষি উন্নয়নের বাস্তব ব্যবস্থা নিন | সূতা বন্টনের নয়া সমন্বিত পরিকল্পনা | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৩শে মার্চ, শনিবার, ১৯৭৪, ৯ই চৈত্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

কৃষি উন্নয়নের বাস্তব ব্যবস্থা নিন

সম্প্রতি প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদে জানা গেছে যে, সারাদেশে এবার ইরি চাষ ও ধানের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। ইরি চাষের জন্য দেশের কৃষকরা যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল তা আজ নানা কারণে স্তিমিত হয়ে গেছে। যে সব কারণে চাষীদের উৎসাহ স্তিমিত হয়ে গেছে তাহলো—চাহিদার তুলনায় গভীর নলকূপ ও পাওয়ার পাম্পের অভাব, যন্ত্রাংশের অভাবের কারণে বহু নলকূপ বিকল হয়ে গেছে। জ্বালানী তেলের অভাব, কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অবহেলা, প্রাকৃতিক কারণ—যেমন খরার ফলে খালবিল নালা শুকিয়ে গেছে—ইত্যাদি কারণের জন্যে ইরি চাষ ও ধানের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। যেহেতু ইরি ধানের ফলন বেশী এবং এই ধানের জন্য একটি বিশেষ চাষের প্রক্রিয়া রয়েছে সেহেতু এর দিকে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আরো বাস্তবমুখী হওয়া প্রয়োজন ছিল। পূর্বাহ্নেই সেচ ব্যবস্থার জন্যে আবশ্যকীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত ছিল। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে যে, পাম্প ও গভীর নলকূপের আশায় দেশের বহু অঞ্চলের চাষী অধিক ফলনশীল ইরি ধান চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু পাওয়ার পাম্পের অনিশ্চয়তায় তারা আজ হতাশ হয়ে পড়েছে। যে সকল পাম্প ও নলকূপ বিকল হয়ে রয়েছে তারও মেরামত করার কোনো কার্যকরী উদ্যোগ কর্তৃপক্ষের নেই। বগুড়ার বিভিন্ন জায়গায় পাওয়ার পাম্প ও নলকূপের অভাবে সংকট দেখা দিয়েছে এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। দিনাজপুরের অবস্থাও একই প্রকার। ঢাকা, ফরিদপুরেও ইরি চাষে উৎসাহী কৃষকরা হতাশ হয়ে পড়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন থেকেও একই ধরনের সংবাদ পাওয়া গেছে। এছাড়া যে সকল জায়গায় ইরি চাষ হয়েছিল সেখানে সেচের অভাব দেখা দিয়েছে এবং প্রয়োজনীয় সারের অভাবে মাজরা পোকায় ইরি আক্রান্ত হয়েছে। আমাদের কৃষি দপ্তর এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন বলে ভুক্তভোগীদের জানা নেই। কীটনাশক ঔষধের ব্যবস্থা অদ্যাবধি করা হয়নি। চলতি বছরে দেশে প্রথমে পঁয়ত্রিশ হাজার ও পরে আরো দশ হাজার পাওয়ার পাম্প চালু করার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু জানা গেছে, পাম্পের অভাবে নাকি এ সিদ্ধান্ত আজ আর কার্যকরী হচ্ছে না। তবে পঁয়ত্রিশ হাজার পাম্প ইতিমধ্যেই বিলি করা হয়েছে—বাকী দশ হাজারের বিষয়টি সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সংবাদে প্রকাশ, পাওয়ার পাম্পের চাহিদা চলতি বছরে অত্যন্ত বেশী ছিল কিন্তু কর্তৃপক্ষ সে তুলনায় পাঁচ ভাগও পূরণ করতে পারেননি। যন্ত্রাংশ, তেল, কারিগর ইত্যাদি ব্যাপারে কিছু সমস্যা থাকলেও চলতি বছরে পাওয়ার পাম্প ও গভীর নলকূপ স্থাপনে এমন অনতিক্রম্য কোনো সমস্যা ছিল না যে, যার দরুণ গোটা কর্মসূচীই বানচাল হয়ে যাবে। কয়েকদিন পূর্বে কৃষি প্রতিমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে, এ বছর নাকি পাওয়ার পাম্প দেওয়া আর সম্ভব হবে না—আগামী বছর দেওয়া হবে। ‍কৃষি প্রতিমন্ত্রীর এ ঘোষণা সরাসরি কৃষকদেরকে মর্মাহত করেছে। অথচ কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম বিশেষ করে টেলিভিশনে পাওয়ার পাম্প সংগ্রহের জন্য সবিশেষ তাগাদা আজো দেওয়া হচ্ছে। কৃষি প্রতিমন্ত্রী আর তথ্য বিভাগের এই বক্তব্যের বৈপরীত্য আমরা অনুধাবন করতে সক্ষম হইনি। কৃষি বিপ্লবের শ্লোগান দিয়ে কর্তৃপক্ষের যদি পাওয়ার পাম্প ও গভীর নলকূপ স্থাপনের ব্যাপারটিকে হেয় করে দেখেন তাহলে কৃষিক্ষেত্রে উল্টো বিপ্লব যে হবে এ কথা সহজেই অনুমেয়। আমরা তাই কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করবো—কৃষির উন্নতির জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করুন, কেননা এদেশের অগ্রসর-অনগ্রসর সবই কৃষির উন্নতি-অবনতির সঙ্গে জড়িত। অতএব কৃষিক্ষেত্রের অদূরদর্শিতা আমাদের পতনই ডেকে আনবে।

সূতা বন্টনের নয়া সমন্বিত পরিকল্পনা

সূতা বন্টনের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি ও বিভিন্ন মহলের অভাব অভিযোগ ইত্যাদি যাচাই করে সরকার সম্প্রতি একটি ‘সমন্বিত পরিকল্পনা’ গ্রহণ করেছেন। এতে রেশন কার্ডের মাধ্যমে সূতা বন্টন করা হবে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হলে প্রকৃত তাঁতীদের মধ্যে সুষমভাবে সূতা বন্টন সম্ভব হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন যে, বন্টনে অব্যবস্থা দূর করতে এবং টাউট ফড়িয়াদের উৎখাত করতেই সরকার ৩টি সংস্থার সমন্বিত সহযোগিতার মাধ্যমে সূতা বন্টনের এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ জন্যে ইতিমধ্যে দেশে প্রকৃত তাঁতীদের সংখ্যাও নিরূপণ করা হয়ে গেছে।
বর্তমান পরিকল্পনায় কুটির শিল্প কর্পোরেশন, ভোগ্যপণ্য সরবরাহ কর্পোরেশন ও সমবায়গুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টায় এ বন্টনের কাজ নিষ্পন্ন করা হবে। প্রশাসনিক ও রেশন কার্ডের সুষম বন্টনের দায়িত্ব কুটির শিল্প কর্পোরেশনের, সূতা বন্টনের দায়িত্ব ভোগ্যপণ্য সরবরাহ কর্পোরেশনের এবং কারিগরি প্রশিক্ষণ, পরামর্শ দান, ঋণ ও বাজারজাত করণের দায়িত্ব সমবায়গুলোর উপর ন্যস্ত থাকবে বলে এ পরিকল্পনায় প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
তাঁতীদের যে রেশন কার্ড দেয়া হবে তাতে তাঁতীর নম্বর, তাঁতের ধরন, বিভিন্ন কাউন্টের সূতা মাসিক চাহিদা ও যে পরিমাণ সূতা দেয়া হবে তার পরিমাণ লেখা থাকবে। রেশন কার্ড বন্টন কালে কুটির শিল্প কর্পোরেশন স্থানীয় সরকারী সংস্থা ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোর সাহায্য নেবেন।
আরো জানা গেছে যে, সূতার সুষম ও নিয়মিত সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সারা দেশে ন্যায্যমূল্যের দোকান রাখা হবে। ভোগ্যপণ্য সরবরাহ কর্পেরেশন মিল ও টিসিবি’র কাছ থেকে সূতা তুলে সোজা বিভিন্ন গুদামে পাঠাবে। রেশন কার্ড দেয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সমবায়ের মাধ্যমে সূতা বন্টনের বর্তমান ব্যবস্থাও অব্যাহত থাকবে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন।
সত্যিই, প্রকৃত তাঁতীদের মাঝে সূতার সুষম বন্টনের জন্যে সরকারের এ আগ্রহ সর্বতোভাবেই প্রশংসা কুড়াবার দাবী রাখে। অন্ততঃ দেশ যে ভুয়া তাঁতীতে ছেয়ে গেছে, বা টাউট ফড়িয়াদের উৎখাত করে প্রকৃত তাঁতীদের হাতে সূতা দেয়া উচিত এ কথাটা যে সরকার অনুধাবন করতে পেরেছেন, সেটাই বা কম কি? এখন, প্রশ্ন হচ্ছে, যে উদ্দেশ্যে এ সমন্বিত প্রচেষ্টার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তা সত্যিই ফলপ্রসূ হবে কি? না কি নতুন ধরনের পুরনো অব্যবস্থার দৌরাত্ম্যই চলতে থাকবে?
একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, যে ৩টি স্তর চিহ্নিত করে সরকার এ পরিকল্পনা নিয়েছেন তার প্রত্যেকটি স্তরেই দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতির যথেষ্ট অবকাশ আছে। আসলে, স্তর একটি, তিনটি কিম্বা দশটি হোক তাতে কিছু আসবে যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে প্রত্যেক স্তরেই প্রকৃত ন্যায়নিষ্ঠ ও দেশপ্রেমিক কর্মীর প্রয়োজন আছে। যে ব্যক্তির মধ্যে পেছন দোরের পয়সার লোভ আছে, কিংবা যার সামনে জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থই মূল্যবান, তাকে যে কোনো স্তরে রাখলে বা সে যে কোনো স্তরে থাকলে সুষম বন্টনের যে কোনো পরিকল্পনা পরিণামে ব্যর্থ হতে বাধ্য। সুতরাং, পরিকল্পনা যাই হোক, যাদের হাতে সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত কার দায়িত্ব, তাদের ব্যক্তিগত চরিত্র ও ন্যায়নীতি বোধ কতটুকু বা উপযুক্ত কিনা সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সর্বাগ্রে নিশ্চিত হওয়া উচিত।
অবশ্য, বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় শিল্প সমিতির সভাপতি এক বিশ্লেষণে দাবী করেছেন যে, সরকার গৃহীত এ সমন্বিত পরিকল্পনা ফলপ্রসূ হবে না। তার মতে, প্রকৃত তাঁতীদের মাঝে রেশন কার্ড ও ন্যায্যমূল্যে সূতা বন্টনের সমস্ত দায়িত্ব সমিতির উপরই ছেড়ে দেয়া উচিত। তিনি বলেন, জাতীয় সমবায় শিল্প সমিতি ছাড়া অন্য কোনো সংস্থার উপর এ দায়িত্ব ন্যস্ত হলে সত্যি করে তাঁতীদের পরিবর্তে আগের মতো ভুয়া তাঁতীদের হাতেই নাকি সূতা চলে যাবে।
এখানেও ঠিক সেই একই কথাই বলে চলে। সৎ, নিঃস্বার্থ ও ন্যায়নিষ্ঠ দেশপ্রেমিক সমবায়ী ছাড়া সমিতির পক্ষেও কোনো সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। সমিতি কি এমন নিশ্চিত গ্যারান্টি দিতে পারেন যে, তাদের মাধ্যমে সূতা বন্টন হলে সূতা বেহাত হবে না বা আসল তাঁতীদের হাতে পৌঁছুবেই?
সমিতির সভাপতি উল্লেখ করেছেন যে, দেশের মোট তাঁত শিল্পের শতকরা ৭৫ ভাগ সমবায়ভুক্ত। এ হিসাব প্রকাশের পর গত ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকার দেশী কারখানায় উৎপাদিত সূতার শতকরা ৭৫ ভাগ সমবায়ের মাধ্যমে তাঁতীদের মাঝে বন্টনের সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে, সূতা পাবার লোভে ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থার আওতাভুক্ত বহু তাঁতী নতুন করে সমবায় সমিতি গঠন করে। ফলে রাতারাতি দেশে নাকি প্রায় ২ লাখ ভুয়া তাঁতীর জন্ম হয়। এরপর অনেক হৈ চৈ শেষে সমবায় সমিতির সহযোগিতায় সরকার ভুয়া তাঁতীদের সূতা বন্টন বন্ধ করে দেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের চাপে আবার সূতা বন্টনে সম্মত হন। আর এইভাবেই নাকি ভুয়া তাঁতীর জন্ম হতে থাকে।
অবশ্য, আসল তাঁতী কে তা নির্ধারণের জন্যে জাতীয় সমবায় শিল্প সমিতির সভাপতি যে প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটা বিবেচনাযোগ্য বলে অনুমিত হয়। তিনি বলেছেন, একই দিনে সারাদেশে একই সময়ে ব্যাপক ও বাস্তবমুখী জরিপ চালিয়ে তাঁতীদের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করতে হবে। তা না হলে একই তাঁত বিভিন্নভাবে সেই কুমিরের বাচ্চাকে সাতবার দেখানোর মতোই সুযোগ থেকে যাবে। আর ভুয়া তাঁতীরা বেমালুম আসল তাঁতী হিসেবে নির্ণীত হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে কাপড় তৈরীর আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদির যেমন রং, রাসায়নিক দ্রব্য, তাঁতের খুচরা যন্ত্রাংশ, সানা, মাকু, ফিকাঠ ইত্যাদির যে আগুন দাম হয়েছে এবং মজুরী, সার্ভিস চার্জ, দক্ষিণা ইত্যাদি যে হারে বেড়েছে, তাতে কেবলমাত্র রেশন কার্ডে ন্যায্যমূল্যে সূতা দিলেও বাজারে কাপড়ের দাম আশানুরূপভাবে কমবেনা।
যাহোক, তাঁর প্রস্তাব সরকার কিভাবে বিচার করবেন, সেটা সরকারই ভালো জানেন। তবে আমাদের কথা হচ্ছে সূতার সুষম ও নিয়মিত বন্টন যাতে ব্যাহত না হয় কিম্বা ভুয়া তাঁতীদের হাতে যাতে সূতা পড়ে কালোবাজারের পণ্য না হয় সেটাই সর্বাগ্রে নিশ্চিত করতে হবে। একজন তাঁতীর মাসে কতটুকু সূতার প্রয়োজন তাও নির্ধারণ করতে হবে। এমন যেন না হয় যে, প্রয়োজন ৪০ পাউন্ড সূতার আর দেয়া হয় মাত্র ১০ পাউন্ড। এতে কালোবাজারীর সুযোগ থেকে যায়। কারণ, প্রয়োজনের তাগিদে তাঁতীকে কালোবাজার থেকেই সূতা কিনতে হয়। এটা বন্ধ করতে হবে। আবার ঠিক প্রয়োজনীয় কাউন্ট মতোই যাতে তাঁতী সূতা পায় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে, শুধু কাগুজে পরিকল্পনা নিলে আসল লাভ কিছুই হবেনা। মানুষের দুর্দশাও কমবেনা। যেকোনো পরিকল্পনাকে ব্যাপক ও বাস্তবভিত্তিক হতে হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন