অগ্নিগর্ভ ভারত : ছাত্র-জনতা-শ্রমিক ও নৌ-সেনা তৎপরতায়
সিমলা বৈঠকের ব্যর্থতা ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে হতাশা ও অস্থিরতার কালােছায়া বিছিয়ে দেয় তার প্রভাব থেকে ত্রিভুজের কোনাে কোণই মুক্ত ছিল। এমনকি জনমনেও তার ছাপ পড়ে। ক্রিপস প্রস্তাব নিয়ে আলােচনার সময় যে-নেহরু মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন একটা মীমাংসার জন্য’ (সুমিত সরকার) তার পক্ষে এবার আরাে অস্থির হয়ে ওঠারই কথা। আর জিন্না? তার শীতল সহিষ্ণুতায় চিড় ধরবে না এমন কথা কি জোর দিয়ে বলা যায়? তবে তার বহিঃপ্রকাশ হয়তাে এতটা ঘটেনি, এই যা। বিয়াল্লিশে গান্ধি চাপমুক্ত হন। “ইংরেজ ভারত ছাড়’ আন্দোলনের সূচনা ঘটিয়ে। এবার শুধু পথ হাতড়ে ফিরছেন। সমাধান মিলছে না। সবদিককার পরিস্থিতি বিচারে ভারত তখন অগ্নিগর্ভ অবস্থায় । পেন্ডেরেল মুন-এর মতে, ১৯৪৫-৪৬ সময়পর্বে ভারত এক ‘আগ্নেয়গিরির কিনারায় দাড়িয়ে (তার ভাষায় On theedge of a volcano)। প্রকৃতপক্ষে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৬ এই পুরাে সময়টিই নানাদিক থেকে বিস্ফোরক চরিত্রের। এবং তা সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে। বিয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলন থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের প্রতিবাদে তীব্র গণবিস্ফোরণ, সারাভারত ডাক ধর্মঘট, শ্রমিক ধর্মঘট, অবিশ্বাস্য নৌসেনা বিদ্রোহ, বাংলায় তেভাগা আন্দোলন, তেলেঙ্গানায় সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ প্রভৃতি মিলেই আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরক পরিস্থিতি, যা । সামাল দেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায় শাসকশ্রেণির পক্ষে।
সময়ের তাৎক্ষণিক হিসেবে তখনকার গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যুদ্ধশেষে বন্দি। আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার, তাও আবার দিল্লির লালকেল্লায় যে লালকেল্লা। দখলের শ্লোগান ছিল সুভাষ পরিচালিত ওই বাহিনীর। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে জাপানি সহায়তায় সিঙ্গাপুরে ঘাঁটি তৈরি করেন সুভাষ এবং ১৯৪৩ সালের অক্টোবরে আজাদ হিন্দ ফৌজ ও আজাদ হিন্দ সরকার অর্থাৎ স্বাধীন ভারতীয় সরকার গঠনের ঘােষণা দেন। জাপানের হাতে বন্দি ভারতীয়। সেনাদের মুক্ত করে গঠন করা হয় ওই ফৌজ। মুসলমান শিখ ও হিন্দু সেনা ও অফিসারদের সমবায়ে গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক সুভাষচন্দ্র বসু। এ বাহিনীতে ছিল মুসলমান সংখ্যাধিক্য, কিন্তু তাতে কোনাে অসুবিধা দেখা দেয়নি সর্বাধিনায়কের নির্দেশ পালনে। বরং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এ বাহিনীর নানা ধর্মবিশ্বাসী সদস্যদের মধ্যে ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকাশ যা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য । হডসনের হিসাব মতে, এ বাহিনীতে যােদ্ধা সদস্যের সংখ্যা মাত্র বাইশ হাজার, এবং বেসামরিক খাতে সদস্য সংখ্যা বিশ হাজার। কিন্তু এদের মনােবল ছিল অদম্য। সবচেয়ে অভিনব ঘটনা ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের নায়িকা ঝাসির রানী লক্ষ্মী বাঈয়ের স্মরণে গঠিত হয় আজাদ হিন্দ ফৌজের নারী বাহিনী। সবাই সুভাষের অনুগত।
জাপানি সহযােগিতায় এ বাহিনীর অভিযান আসামের কোহিমা পর্যন্ত পৌছায় যেখানে স্বাধীন ভারতের পতাকা উড়তে থাকে। এসব ঘটনা বঙ্গদেশ ও বাঙালিকে তাে বটেই গােটা ভারতীয় সমাজকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপ্ত করে তােলে। ব্রিটিশ শাসনাধীন বিভিন্ন স্তরের ভারতীয় সেনাদের মধ্যেও বিদ্যত্তরঙ্গ বয়ে যায় যা পরে নৌসেনাদের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহে প্রকাশ পায় । এই প্রথম এ উপলক্ষে দেশব্যাপী স্বাদেশিকতার অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকাশ ঘটে যা রাজনৈতিক নেতাদের চেষ্টায় ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। কিন্তু জাপানিদের পরাজয় ও আত্মসমর্প ঘটনার গতি পাল্টে দেয়। সেই সঙ্গে আরেক অঘটন কথিত বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু। কিন্তু তাতে স্বাদেশিকতার উদ্দীপনা শেষ হয়ে যায়নি। বরং বন্দি আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের প্রতিবাদে দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। এর সর্বোচ্চ প্রকাশ বাংলার রাজধানী কলকাতায়। তখন বাঙালি তরুণের কণ্ঠে আজাদ ফৌজের সমর সংগীত ধ্বনিত হতে থাকে- ‘কদম, কদম, বাঢ় হয়ে যা। কংগ্রেস আজাদ হিন্দ ফৌজের ঘটনাবলী সুনজরে দেখেনি কিন্তু প্রবল জনমত উপেক্ষা করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই কংগ্রেস কমিটির প্রস্তাব যাতে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনা বা অফিসারদের অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য শাস্তি দেয়া না হয়। অন্যথায় এক ট্র্যাজেডির সৃষ্টি হবে। শুধু তাই নয়, বিশিষ্ট কংগ্রেসী আইনজীবী ভুলাভাই দেশাই বন্দিদের পক্ষে দাঁড়ান। এগিয়ে আসেন উদারপন্থী নেতা তেজবাহাদুর সাঞ্জ। এমনকি তাদের পক্ষ সমর্থনে যােগ দেন নেহরু। একটি দেশের মুক্তির জন্য যে সেনাবাহিনী লড়াই করেছে তারা ইতিহাস-লেখক হডসনের মতে কালপ্রিট’। সাম্রাজ্যবাদী চেতনার চাপে ইতিহাসবিদের নিরপেক্ষতা এভাবে হারিয়ে যায়।
কিন্তু ওই ফৌজিদের স্বদেশপ্রেমের প্রতিদান দিতে ভুল করেনি বঙ্গ ও ভারতবাসী জনগণ এবং তা সম্প্রদায় নির্বিশেষে। বিচারাধীন আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনা ও অফিসারদের মুক্তির দাবিতে গােটা দেশ টালমাটাল, বিশেষ করে বঙ্গদেশ ও তার রাজধানী কলকাতা। তরুণদের মুখে মুখে ফিরছে তিনচারজন বন্দি-অফিসারের নাম- শাহনেওয়াজ খান, পিকে সায়গল ও গুরুব সিং ধীলন যথাক্রমে মুসলমান, হিন্দু ও শিখ । ভিপি মেননের মতে, ‘এই বিচার প্রচেষ্টা ছিল একটা বিরাট ভুল। ১৯৪৫-এর নভেম্বর। বিচারের অপেক্ষায় একসঙ্গে কাঠগড়ায় দাঁড়ানাে বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী তিন ভারতীয় । অপরাধ- তারা স্বদেশের মুক্তি তথা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে। আর সেজন্য সেই স্বদেশেরই রাজধানী দিল্লির লালকেল্লায় তাদের বিচার শুরু হয়েছে। এই ঘটনা দেখে দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ, কুদ্ধ। আর সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে তরুণদের চোখে তারা জাতীয় বীর। তাদের মুক্তির জন্য সমাজে রীতিমতাে আলােড়ন। এ উপলক্ষে সুভাষ হয়ে ওঠেন স্বাধীনতাযুদ্ধের বীরউত্তম সেনানী। স্বাধীনতাকামী তারুণ্যের মধ্যমণি । পিছিয়ে পড়েন গান্ধি-নেহরু। আজাদ হিন্দ ফৌজের উচ্চারিত ‘জয় হিন্দ’ (জয় ভারত) স্বাধীনতাকামীদের জন্য প্রতীক্ট শ্লোগান হয়ে ওঠে সর্বজনীন চরিত্র নিয়ে, যেমন এদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধে স্লোগান হয়ে ওঠে ‘জয় বাংলা’ । কংগ্রেস চিরশত্রু সুভাষের অনুগত সেনানীদের পক্ষে আইনি ও রাজনৈতিক লড়াই বেশ জোরেশােরেই চালাতে থাকে। ভুলে যায় পূর্বেকার সুভাষ-বিরােধী বক্তব্যের কথা। আর যারা সুভাষচন্দ্রকে ‘কুইসলিং’ বলে গালাগাল করেছিলেন অবস্থাদৃষ্টে তাদের পিঠ তখন দেয়ালে ঠেকে গেছে। আজাদ হিন্দ ফৌজ সংক্রান্ত বিষয়টি প্রধানত যে ত্রিপক্ষকে বিশেষভাবে স্পর্শ করে তারা হলাে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি ও ব্রিটিশরাজ। প্রেক্ষাপটে ভারতীয়, বিশেষ করে বাঙালি জনতা (তার সিংহভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত)। তবে তা মুসলিম লীগকেও স্পর্শ করে সম্ভবত ধর্মীয় কারণে । পরিস্থিতি অর্থাৎ জনমনােভাব লক্ষ্য করে সবচেয়ে বিচলিত ভারতের ইংরেজ শাসকশ্রেণি । ভাইসরয় ওয়াভেল থেকে প্রাদেশিক গভর্নরবৃন্দ ও শ্বেতাঙ্গ আমলা প্রশাসন। তাদের ভয় আরেকটি বিয়াল্লিশ (ভারত ছাড় আন্দোলন) জেগে না ওঠে। অবস্থা তেমনই বা তার চেয়েও গুরুতর চরিত্রের প্রকাশ ঘটায়। অসন্তোষ ভারতব্যাপী । এর সর্বোচ্চ রূপ শুরুতে কলকাতায়, যে কলকাতাকে সবচেয়ে রাজনীতি সচেতন শহর হিসেবে গণ্য করা হয়। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে অন্যত্র ।
আর এই কলকাতায়ই আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দিদের মুক্তির দাবিতে ১৯৪৫-এর নভেম্বরে (২১ থেকে ২৩) ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মতাে ঘটনা দেখা দেয়। দেখা দেয় গণঅসন্তোষের প্রবল এক বিস্ফোরণ। ছাত্রদের প্রতিবাদী মিছিলে ধর্মতলায় পুলিশের গুলিতে ছাত্রহত্যা ব্যাপক ও ক্রুদ্ধ গণআন্দোলনের প্রকাশ ঘটায়। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে, ওই ছাত্রআন্দোলনে যােগ দেয় কমিউনিস্ট পাটির ছাত্র সংগঠন এবং মুসলিম ছাত্রলীগ। তিন দলের পতাকা নিয়ে ছাত্রদের নির্ভয় মিছিল সবাইকে অবাক করে দেয়। এতে এতটা আবেগ তৈরি হয় যে সাধারণ মানুষ, ছােটখাটো পেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে যােগ দেয় । শ্রমিক ধর্মঘট এ প্রতিবাদকে সর্বজনীন চরিত্রে পরিণত করে। ট্রামে-ট্রেনে আগুন লাগে। রাস্তায় অবরােধ তৈরি করা হয়। নির্ভীক প্রতিবাদী মানুষ গুলির মুখেও দৌড়ে পালায় না। মােটামুটি হিসাবে গুলিতে নিহতের সংখ্যা তেত্রিশ, আহত কমপক্ষে ২০০ সাধারণ মানুষ । আর ৭০ জন ব্রিটিশ ও ৩৭ জন মার্কিন সৈন্য আহত। ভাঙচুর করা হয় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ১৫০টি গাড়ি (সুমিত সরকার)। সে সময়ের দৈনিক পত্রিকাগুলাে আলােড়ন তােলে মৃত্যুকে তুচ্ছ করা ছাত্রজনতার সংগ্রাম নিয়ে, প্রথম দিন পুলিশের গুলিউত শহীদ রামেশ্বর, সালামকে নিয়ে, যাদের নাম কিংবদন্তির মর্যাদা পেয়ে তরুণদের মুখে মুখে ফেরে। কয়েক মাস পর এ বিষয় নিয়ে জীবনবাদী কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন তার অবিস্মরণীয় উপন্যাসিকা ‘চিহ্ন’। বলতে হয় ‘চিহ্ন’ নভেম্বর বাস্তবতার অসামান্য একটি চালচিত্র। বিশ-বাইশ বছরের তরুণ গুলিবিদ্ধ গণেশ কাহিনীর নায়ক। তার বােধে ওই আন্দোলন এক বিস্ময়, তার চেতনাকে গ্রাস করে রাজপথের জনতা আর পুলিশের কাণ্ড। সেই যেন ভিড় হয়ে গেছে নিজে। …হাঙ্গামা যে এমন অনড়, অটল, ধীরস্থির হয়, বন্দুকধারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে মানুষ এদিকওদিক এলােমেলাে ছােটাছুটি করে না, এ তার ধারণায় আসে না। মনে হয় যেন রাজপথে, রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে শব্দচিত্র এঁকেছেন ‘চিহ্ন’ উপন্যাসের লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় । ভাবি, একুশে-বাইশে ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) ঢাকার গণআন্দোলনে পুলিশের হত্যাকাণ্ড নিয়ে এমন একটি উপন্যাস লেখা হলাে না। কেন বাংলাদেশে। জনগণের সাহস ও অনমনীয় দৃঢ়তায় অবাক বঙ্গদেশের গভর্নর কেসি একই কথা লেখেন নভেম্বর অভ্যুত্থান সম্বন্ধে যে গুলির মুখেও জনতা সরে যাচ্ছে না। আর ২৭ নভেম্বর ভাইসরয় ওয়াভেল এ বিষয়ে ভারতসচিবকে লেখেন যে, গভর্নর কেসি অবাক এই প্রতিবাদ-আন্দোলনের পেছনে ব্রিটিশ-বিরােধী চেতনা লক্ষ্য করে । তার ধারণা গােটা পরিস্থিতি এখনাে বিপজ্জনক ও বিস্ফোরণধর্মী (ম্যানসার, প্রাগুক্ত, খণ্ড ৬)।
এ আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলগুলাের ভূমিকা বিশেষত লীগকংগ্রেস সম্বন্ধে একটি বিষয় পরিষ্কার বুঝে নেয়া দরকার যে তারা সরাসরি এ বিদ্রোহ-প্রতিম ঘটনাকে তাদের রাজনীতিতে ধারণ করেনি। তুমুল। গণঅভ্যুত্থানের চাপে কংগ্রেস এতে অংশ নেয়। কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় দুএকজন নেতা, যেমন গান্ধি-প্যাটেলের প্রতিক্রিয়া থেকে তা বােঝা যায়। বােঝা যায় কংগ্রেস-বিড়লার যােগাযােগ, বিড়লার ছােটাছুটি ও শাসকদের সঙ্গে দেনদরবার ও আশ্বাসদানের মতাে ঘটনায় (‘ইন দ্য শ্যাডাে অব মহাত্মা’, প্রাগুক্ত)। একই চরিত্রের প্রকাশ লীগ নেতৃত্বে। নির্বাচনের আগে কোনাে রাজনৈতিক দলই গণআন্দোলন পছন্দ করে না। এটা এক চিরায়ত রাজনৈতিক সত্য। তাই দেখি এ ঘটনার প্রায় ১৭ বছর পর পূর্ববঙ্গে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সম্বন্ধে গণতন্ত্রী রাজনীতিকদের একই ভূমিকা। নভেম্বরের অভাবিত ঘটনা সম্বন্ধে ঘনশ্যাম দাস বিড়লা বিলেতের জনৈক বড়কর্তাকে আশস্ত করেন এই বলে যে, নেহরুর উত্তেজক বক্তৃতা নিছকই তাৎক্ষণিক বিষয়। টিভি-সিরিয়ালের ডায়ালগের মতাে তার আশ্বাস : সব ঠিক হয়ে যাবে’। কিন্তু সবকিছু ঠিক হয়নি, ব্রিটিশ শাসকের হিসাবমতাে ঠিক হয়নি, তাই তাদের সােনার ভারত ছেড়ে যেতে হয়েছে। সে হিসাবে কিছুটা হলেও ঠিক হয়েছে লীগ কংগ্রেসের চাওয়া-পাওয়া। ওই প্রবল প্রতিবাদী অভ্যুত্থানে জিন্না-লীগের যােগদান কিছুটা দুর্বোধ্য এ কারণে যে বিয়াল্লিশ আগস্টের মতাে কোনাে শাসক-বিরােধী গণআন্দোলনে জিন্না-মুসলিম লীগ কখনাে যােগ দেয়নি। আর কংগ্রেসের সঙ্গে তাে যােগ দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমার ধারণা লীগের ছাত্রফ্রন্টের বামঘেঁষা ও গণতন্ত্রমনা ছাত্রদের যােগদান। যেমন চাপে ফেলে জিন্নার সম্মতি আদায় করে তেমনি দ্বিতীয় কারণ হতে পারে আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দিদের মধ্যে মুসলমান, বিশেষ করে পাঞ্জাবি মুসলমান সংখ্যাধিক্য। শেষােক্ত বিষয়টি মুসলমান জনশ্রেণিকে স্পর্শ করেছিল । জিন্না হয়তাে তা লক্ষ্য করে থাকবেন, তাই এটুকু ছাড় । আর সে কারণে অভ্যুত্থান নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারিতে (১৯৪৬) পৌছে যাওয়ার পরও ছাত্রসূচিত গণঅভ্যুত্থানের প্রভাবে রাজপথের সাম্প্রদায়িক ঐক্য রাজনীতিতে স্থায়ী জায়গা করে নিতে পারেনি।
সঙ্গতকারণে ব্রিটিশ শাসকদের ভয় আতঙ্কে পৌছায়, বিশেষ করে হিন্দুমুসলমান সম্প্রীতি লক্ষ্য করে । রাজা ষষ্ঠ জর্জকে লর্ড ওয়াভেলের পাঠানাে বার্তায় (৩১ ডিসেম্বর, ১৯৪৫) অবশ্য ওই সম্প্রীতি সাময়িক বাঁক ফেরা’ হিসাবে ধরে নিয়ে স্বস্তি পেতে চেয়েছেন তারা (ম্যানসার, প্রাগুক্ত)। আসলে লীগ-কংগ্রেসের কল্যাণে বিষয়টি তেমন চরিত্রেই পৌছে যায়। চতুর বেনিয়াবুদ্ধি ঠিকই বুঝে নেয় ভারতীয় রাজনীতিকদের স্বার্থবুদ্ধি ও চারিত্র্য বৈশিষ্ট্য। আর বুঝবেই না কেন যখন গান্ধিসহ শীর্ষ কংগ্রেস নেতারা এ বিষয়ে বঙ্গীয় গভর্নর কেসির সঙ্গে একের পর এক দেখা করে চলেছেন সম্ভবত শাসকদের আশ্বস্ত করতে। দেখা করেছেন ভাইসরয়ের সঙ্গেও। অবস্থাদৃষ্টে ব্রিটিশরাজ বিচার প্রক্রিয়ায় কিছুটা ছাড় দিয়ে অবস্থা আয়ত্তে আনতে চেষ্টা করে। যেমন বলা হয় যেসব ফৌজি সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা বা নৃশংস আচরণের অভিযােগ রয়েছে কেবল তাদেরই বিচার করা হবে, অন্যদের নয়। রাজনীতিকদের জন্য আরেকটি সুখবর হলাে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলােচনার জন্য উচ্চপর্যায়ের একটি কেবিনেট মিশন ভারতে পাঠানাে হবে। এমন আশ্বাস। উদ্দেশ্য ভারতে ক্ষমতার হস্তান্তর উনিশ শতকের ধীমান লেখক কালিপ্রসন্ন সিংহ তথা ‘হুতােম প্যাচা’র ভাষায় বলতে হয় তবু হুজুগ মিটল না । লালকেল্লার বিচারে আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্য আবদুর রশীদকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়ার প্রতিবাদে ছাত্ররা আবার রাজপথে নামে। এ আন্দোলনের ঢেউ নভেম্বরকেও ছাড়িয়ে যায়। দুই পর্বের এ গণবিস্ফোরণ এতটাই স্পর্শ করে কবি, লেখক ও সংস্কৃতিসেবকদের যে কবি বিষ্ণু দে জনসমর্থন-চেতনার প্রকাশ ঘটান ‘ফেব্রুয়ারি খুঁজে পায় নভেম্বরের সীমার মতাে পঙক্তি রচনা করে। ফেব্রুয়ারির (১৯৪৬) ছাত্র-জনতার প্রচণ্ড বিক্ষোভের দিনটি পরিচিতি পায় রশীদ আলী দিবস’ হিসেবে। চরিত্র নভেম্বরের মতােই, ১১-১৩ ফেব্রুয়ারি শহর কলকাতা অচল। ছাত্রদের চাপে হিন্দু-মুসলমান জনতার প্রতিবাদী ঐক্য গড়ে ওঠে। লীগ-কংগ্রেস-কমিউনিস্ট পার্টির পতাকা একসঙ্গে উড়তে থাকে। মিছিলে, সমাবেশে । এবারও কেন্দ্রবিন্দু কলকাতা। কাছাকাছি সব শ্রমিক এলাকায় ধর্মঘট, চাকা বন্ধ।
ওয়েলিংটন স্কয়ারের বিশাল জনসমাবেশে বক্তৃতা করেন মুসলিম লীগ নেতা শহীদ সােহরাওয়ার্দী, কংগ্রেস নেতা সতীশ দাশগুপ্ত আর কমিউনিস্ট নেতা সােমনাথ লাহিড়ী। এ সংঘর্ষে সরকারি হিসাবে নিহত ৮৪ জন, আহত ৩০০ জন (গৌতম চট্টোপাধ্যায়, উদ্ধৃতি সুমিত সরকার)। বিক্ষোভ দমনে পুলিশ ও সেনাবাহিনী একযােগে কাজ করে। প্রতিবাদে সারাদেশে শ্রমিক ধর্মঘট দেখা দেয় । এর মধ্যে ১৮ ফেব্রুয়ারি (১৯৪৬) থেকে সূচিত বােম্বাইয়ের শ্রমিক ধর্মঘট উল্লেখযােগ্য। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলাের লক্ষ্য ছিল শাস্তির আবহ সৃষ্টি । মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের সে ইচ্ছা আরাে প্রবল। কারণ ধর্মঘট মানেই ক্ষতি। সেই সঙ্গে শাসকশ্রেণির সঙ্গে সুসম্পর্ক নষ্ট। তাছাড়া সামাজিক বিশৃঙ্খলা । নেতারা না চাইলেও এ আন্দোলনের প্রভাব পড়ে ভারতীয় নৌসেনাদের ওপর। শ্বেতাঙ্গঅশ্বেতাঙ্গ বৈষম্য ঘিরে দীর্ঘদিনের সঞ্চিত ক্ষোভ এ উপলক্ষে বেরিয়ে আসে। বিদ্রোহ করে ভারতীয় নৌসেনারা। শুরু ১৮ ফেব্রুয়ারি (১৯৪৬) বােম্বাইতে পরে তা ছড়িয়ে পড়ে করাচি, কলকাতা ও মাদ্রাজে নাবিকদের মধ্যে। বাইশে ফেব্রুয়ারি নাগাদ বিদ্রোহী নাবিকরা বােম্বাইয়ে ২২টি জাহাজ দখল করে নেয়। এমনকি ব্রিটিশ ভাইস অ্যাডমিরালের ফ্ল্যাগশিপও তাদের দখলে চলে আসে। বিদ্রোহী জাহাজগুলাের মাস্তুলে পূর্বোক্ত তিন দলের পতাকা তােলা হয়। সামপ্রদায়িক ঐক্যের সুবাতাসে উড়তে থাকে ত্রিদলীয় পতাকা। তাদের দাবির মধ্যে যেমন ছিল তাদের কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের নানাদিকের অবসান তেমনি আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের মুক্তি এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার ইত্যাদি। অর্থাৎ নিজস্ব অর্থনৈতিক দাবির পাশাপাশি রাজনৈতিক দাবিও ছিল। সারাদেশে তখন রাজনৈতিক চেতনা এত স্পষ্ট, উত্তাপ এত তীব্র যে লীগ-কংগ্রেস নেতৃত্ব সম্ভবত প্রমাদ গােনে পাছে শাসক-বিরােধী আন্দোলনের নেতৃত্ব বামরাজনীতি ও জনগণের হাতে চলে যায়।
তাই ২২ ফেব্রুয়ারি (১৯৪৬) যখন নৌসেনাদের সমর্থনে গােটা বােম্বাই হরতালে অচল তখন লীগ-কংগ্রেস শীর্ষনেতৃত্ব শান্তির ধুয়া তােলে, তাতে সাড়া দেয় না সংগ্রামী জনতা। একমাত্র ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি তাদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায়। রাজপথে চলতে থাকে এক ধরনের খণ্ডযুদ্ধ। কলকারখানা বন্ধ। ক্ষুব্ধ মানুষ রাজপথে। তাদের স্তব্ধ করতে সেনাবাহিনী পথে নামে। সরকারি হিসাবে নিহত-আহতের সংখ্যা কলকাতা বিক্ষোভের থেকে বেশি। সে হিসাবে ২২৮ জন নিহত এবং ১০৪৬ জন আহত, সেই সঙ্গে ৩ জন পুলিশ নিহত ও ৯১ জন আহত (ম্যানসার, খণ্ড ৬)। শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী নৌসেনাদের আত্মসমপর্ণ করতে হয় গান্ধি-প্যাটেলজিন্না প্রমুখের চাপে এবং এই আশ্বাসে যে তাদের বিরুদ্ধে কোনাে প্রকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে না । তেইশে ফেব্রুয়ারি (১৯৪৬) সেই কালাে দিন, মিথ্যা স্তোকে আত্মসমর্পণের দিন । তখনাে নৌসেনাদের মনােবল এত অটুট যে তাদের দাবি তারা ব্রিটিশ শাসকদের কাছে নয়, লীগ-কংগ্রেসের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন। কিন্তু লীগ-কংগ্রেস নেতৃত্ব তাদের কথা রাখেনি, জনগণের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তারা তাদের দেশপ্রেমের ও জনহিতৈষণার প্রমাণ রাখে। এ উপলক্ষে একটি ছােট তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৬-এ ধর্মঘটী শ্রমিকদের সংখ্যা ছিল ১৯,৬১,৯৮৪ এবং এবং সেই সঙ্গে সমর্থন অগুনতি ছাত্র, তরুণ, কর্মী, কৃষক, সরকারি কর্মচারী, বেসরকারি কর্মচারী, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির মানুষ এমনকি পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বেশ কিছুসংখ্যক সদস্যের। অর্থাৎ একটি বৈপ্লবিক পরিস্থিতি, যে পরিস্থিতি একটি রাজনৈতিক-সামাজিক বিপ্লব ঘটানাের ক্ষমতা রাখে। কিন্তু সে সম্ভাবনা নষ্ট করে দেয় যতটা শাসকশ্রেণি, তারচেয়ে বেশি লীগকংগ্রেস রাজনীতি। ইতিমধ্যে হায়দারাবাদ রাজ্যের তেলেঙ্গানায় কৃষক বিদ্রোহের সূচনা, সূচনা উত্তরবঙ্গে ভাগচাষিদের তেভাগা আন্দোলন ইত্যাদি। কিন্তু এগুলােকে সমন্বিত শক্তিতে পরিণত করা যায়নি, তেমন চেষ্টাও হয়নি। এ বিষয়ে যে দায়িত্ব ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির পালন করা কথা নানা কারণে তাদের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। কংগ্রেস ও লীগের তুলনায় জনসমর্থন আদায়ে তাদের শক্তিসামর্থ্য অপেক্ষাকৃত কমই ছিল তারচেয়ে বড় কথা বিপ্লব ঘটানাের মতাে রাজনৈতিক চিন্তা ও কৌশল কোনােটাই তাদের ছিল না। স্বভাবতই বিভিন্ন দশকে সংঘটিত ব্যাপক জনবিস্ফোরণ ঢেউ তুলে হারিয়ে গেছে। যেমন বিফলে গেল সর্বশেষ ১৯৪৫-৪৬-এর শ্রমিক-কৃষক-ছাত্রজনতার তীব্র গণবিস্ফোরণ। তাই ঘটেছে সমঝােতার মাধ্যমে ক্ষমতার হস্তান্তর ।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক