পাকিস্তান অর্জন কতটা ইতিবাচক রাজনীতির প্রতিফলন
চল্লিশের দশক নানাদিক থেকে, বিশেষত রাজনীতি ক্ষেত্রে যেন ভারতের ভাগ্যনিয়ন্ত্রক সময় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। অবশ্য বঙ্গদেশে এই দশকটি ছিল দ্বিমাত্রিক ব্যঞ্জনায় বিশিষ্ট। একদিকে সম্প্রদায়বাদিতা, অন্যদিকে প্রগতিবাদী সমাজচেতনা দুইয়ে মিলে ইতি ও নেতির বৈপরীত্য নিয়ে হাজির হয়েছিল। সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় ও রাজনীতির একাংশে এমন প্রগতিবাদী চেতনার প্রকাশ এর আগে বঙ্গে দেখা যায়নি। তবে এক্ষেত্রে ছিল হিন্দু শিক্ষিত শ্রেণির প্রাধান্য। তবে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে এর রাজনৈতিক চেতনা ও ঘটনাবলীই ছিল প্রধান নিয়ামক শক্তি। বিশ্বযুদ্ধ তাতে প্রধান উপাদান সরবরাহ করেছিল, এমনকি রাজনৈতিক ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও। কারণ যুদ্ধের কারণে শুরুতে বিপর্যস্ত ব্রিটিশসিংহের বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রতিবাদী ভূমিকায় নেমে দেশের স্বাধীনতার দাবি নতুন করে তোলে। স্বভাবতই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সমর্থন আদায় করতে ভারতীয় শাসকশ্রেণি, বিশেষ করে ভাইসরয় লিনলিথগাে জিন্নার দিকে সহযােগিতার জন্য হাত বাড়ালেন, যথারীতি পেয়েও গেলেন। ভারতসচিব জেটল্যান্ডের কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভাইসরয় জানান : কংগ্রেসের দাবি-দাওয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জিন্না আমাকে অতীব মূল্যবান সাহায্য-সহযােগিতা দিয়েছেন যে জন্য তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। যদি জিন্না কংগ্রেসের দাবির প্রতি সমর্থন জানাতেন তবে তা আমাদের প্রশাসন ও ব্রিটিশ সরকারের ওপর গুরুতর চাপ সৃষ্টি করত। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে, কী ছিল কংগ্রেসের দাবি? উত্তর স্পষ্ট : ভারতের স্বাধীনতা। আর ইতিহাস বলে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কখনাে আগ্রহ দেখাননি জিন্না কিংবা নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে মুসলিম লীগ রাজনীতি সংখ্যালঘু রাজনীতির অজুহাতে শাসক শ্রেণির সঙ্গে হাত মিলিয়ে দাবি-দাওয়া আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে গেছে।
জিন্নার নেতৃত্বে তা আরাে কুশলী ও কৌশলী হয়েছে এই যা সে সুযোেগ নিয়েছে ইংরেজ শাসক দুই পক্ষকে নিরন্তর লড়াইয়ে ব্যস্ত রাখতে। যুদ্ধ ও কংগ্রেসের দাবি- এ দুই প্রতিকূলতার মুখে সম্ভবত ভাইরসয় লিনলিথগাে জিন্নাকে কংগ্রেসের দাবি প্রতিহত করতে, রাজনৈতিক দাবি উত্থাপন করতে উৎসাহ জোগাতে থাকেন- এমন ধারণা অনেকের পরবর্তী ঘটনা প্রমাণ করে, তেমন ধারণা ভুল ছিল না। জিন্নার স্বতন্ত্র ভুবনের চিন্তার পেছনে আরাে একাধিক কারণ সক্রিয় ছিল। যেমন চিরাচরিত মুসলিম স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়াদি। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর উত্তরপ্রদেশসহ হিন্দুপ্রধান প্রদেশগুলােতে যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠনে কংগ্রেসের অসম্মতি এবং সেসব স্থানে লীগ তথা মুসলিম স্বাতন্ত্র্য অস্বীকার করার মতাে বিষয় যা জিন্নাকে সমঝােতার জায়গা থেকে সরিয়ে দেয়। এ ঘটনা কংগ্রেসের দুয়েকজন বিচক্ষণ রাজনীতিকের চোখে রাজনৈতিক ভুল হিসেবে চিহ্নিত। পরে এ সত্য সবারই স্বীকৃতি পায়, বিশেষ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাস লেখকদের কাছে। তবে এক্ষেত্রে ব্রিটিশ রাজ’-এর নীতি, ভূমিকা ও চাতুর্য গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত, সেই সঙ্গে মূল্যায়ন। কারণ তারা সর্বদাই অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণে যথেষ্ট দক্ষ ছিল। ১৯৩৭-এর নির্বাচন ফল তাদের জন্য খুব একটা স্বস্তিদায়ক হয়নি, হয়নি সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের জন্য। তবু মুসলিম লীগের পক্ষে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণে কিছু সম্ভাবনা কংগ্রেসের অদূরদর্শী পদক্ষেপে নষ্ট হয়ে যাওয়া জিন্নার জন্য অসম্ভুষ্টির কারণ হয়ে ওঠে। এমন এক পরিস্থিতিতে শাসকরাজ জিন্নার দিকে নজর দেবেন এটাই স্বাভাবিক। দেশীয় রাজ্যগুলাের শাসকগণ তাে বরাবর ব্রিটিশরাজের পক্ষে। শুধু প্রজাবিদ্রোহ দমনে সহায়তার জন্যই নয়, অন্য কোনাে কারণেও মাথা নাড়তে গেলে গদিচ্যুত হতে হবে তাই। উদাহরণ রয়েছে ওয়ারেন হেস্টিংসের আমল থেকেই । বিভাজননীতিতে তপসিলিদের আলাদা করতে খুব একটা সুবিধা হয়নি শাসকদের, মূলত গান্ধির হরিজননীতির কারণে। পরবর্তী ভরসা জিন্না ও লীগ পরিচালিত মুসলমান সমাজ। অগত্যা সেদিকেই হাত বাড়ানাে। বিশেষ করে ইউরােপে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে জিন্না-তােষণনীতি তাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেসের আন্দোলন, স্বাধীনতা দাবি এবং ক্রমবর্ধমান জনসংশ্লিষ্টতা শাসকদের জন্য শঙ্কার কারণ হয়ে ওঠে। তাই তাদের জন্য দরকার শক্তিমান কংগ্রেসবিরােধী রাজনৈতিক শক্তি। আর বৃহত্তর মুসলিমসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে মুসলিম লীগই পারে এ শক্তি জোগাতে।
সেজন্য দরকার ভবিষ্যতে লীগকে, জিন্নাকে ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এ পরিকল্পনার পরিণতি বিবেচিত হতে পারে ভারত। ভেঙে স্বতন্ত্র মুসলিম ভুবন প্রতিষ্ঠা করা। একালের ভারতবিভাগ বিষয়ক নানামাত্রিক বিশ্লেষণে এমন সত্যই উঠে আসে যে, ভারতবিভাগ ও স্বতন্ত্র মুসলমান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় লীগের প্রধান সহায়ক শক্তি ছিল ব্রিটিশরাজ। সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ (১৯৩৫) এ লক্ষ্য অর্জনে ছিল সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। গােটা বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন ঘটনা, পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে গােয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন ভারত সচিবের কাছে, যার মূল কথা হলাে ভারতবিভাগ ও ভারতীয় মুসলিম জাতির (নেশন) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা (উদ্ধৃতি ওয়ালি খান, ফ্যাক্টস আর ফ্যাক্টস : ভারতবিভাগের অপ্রকাশিত কাহিনী, ১৯৮৭, বাংলাদেশ)। অবশ্য ব্রিটিশসিংহের অন্য একটি আশঙ্কা বা ভয় ছিল বলশেভিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। তবে এমন যুক্তিও ছিল যে ভারতীয় জঙ্গি মুসলিম শক্তি সঙ্গত কারণে নাস্তিক বলশেভিকদের কাছে সাহায্য চাইবে না। অন্যদিকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে মুসলিম রাষ্ট্র গঠন করা গেলে তা রুশ সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে মজবুত প্রাচীর হিসেবে কাজ করবে। এভাবে ব্রিটিশ কূটনৈতিক চিন্তার রাজনৈতিক রূপায়ণ হয়ে ওঠে জিন্নার ধর্মীয় দ্বিজাতিভিত্তিক ভারতবিভাগ ও স্বতন্ত্র মুসলিম ভুবন প্রতিষ্ঠা (অর্থাৎ পরবর্তী সময়ে কথিত পাকিস্তান)। আশ্চর্য যে, ঐতিহাসিক যে লাহোর প্রস্তাবে এ পরিকল্পনা তুলে ধরা হয় সে বিষয়টি নিয়েও জিন্নার মতে তুখােড় আইনজীবী-রাজনীতিবিদকে বারবার ব্রিটিশ পরামর্শের জন্য ভাইসরয়ের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। ঘটনা তাই বলে। কারণ এ সময়ে ওই পরিকল্পনা ঘিরে যথেষ্ট ভিন্ন মত উপস্থিত ছিল। যেমন গুরুত্বপূর্ণ পাঞ্জাব প্রদেশের সেকুলার রাজনীতিবিদ সিকান্দার হায়াত খানের জাতিসত্তা-ভিত্তিক সাতটি প্রদেশের স্বায়ত্তশাসননির্ভর ভারতীয় ফেডারেশন, বলা যেতে পারে কনফেডারেশন পরিকল্পনা যা জিন্না এক কথায় নাকচ করে দেন। আয়েশা জালাল মনে হয় এ তথ্যটি বিচারে আনেন নি। নাকচের কারণ আরকিছু নয় ।
অখণ্ড ভারত (যা গান্ধি-নেহরুর স্বপ্ন) কোনাে মতেই তার কাছে গ্রহণযােগ্য নয়। বরং ভারতসচিব জেটল্যান্ড ও উপসচিব মুরহেডের সঙ্গে খালিকুজ্জামান-আলােচিত বিভক্ত ভারতে মুসলিমপ্রধান অঞ্চল নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রই বিবেচ্য হয়ে ওঠে এবং মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি তা গ্রহণ করে জিন্নার সম্মতি সাপেক্ষে। কিন্তু জিন্না কখনাে ভেবে দেখেননি যে, ভারতীয় মুসলমানদের ভবিষ্যৎ হিন্দুশাসনের হাত থেকে মুক্ত করতে গিয়ে তার প্রস্তাবে সাড়ে তিন কোটি ভারতীয় মুসলমান হিন্দু শাসনে থেকে যাবে, যে কথা মাওলানা আজাদ ভারতবিভাগের আগে ও পরে একাধিকবার বলেছেন। বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে এদের অবস্থা কি খুব স্বস্তিকর হবে বিশেষ করে যখন তারা ছিলেন অন্ধ আবেগে পাকিস্তানের পক্ষে? মুসলমানপ্রধান প্রদেশভিত্তিক বিভাজনের নীতিতে বড় অসুবিধা ছিল, বিপুল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলাের শহর-গ্রামে ছাড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুসলমান জনসংখ্যা কীভাবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে? কোনাে সীমানা নির্ধারকের সাধ্য নেই তাদের স্বপ্নের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা। অসম্ভব হলেও একমাত্র উপায় গােটা ভারতীয় মুসলমানদের শহর-গ্রাম থেকে কুড়িয়ে স্বতন্ত্র ভূখণ্ডে নিয়ে যাওয়া। এ কাজটি যেমন অবাস্তব, তেমনি স্বতন্ত্র অঞ্চলগুলােতে স্থানাভাবও অসম্ভবের আওতায় পড়ে। সম্ভবত এসব সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাননি জিন্না। তাই ভারতবিভাগ ও পাকিস্তানের পক্ষে ক্রমাগত যুক্তি-অযুক্তি খাড়া করেছেন। ওয়ার্কিং কমিটিতে প্রস্তাব পাস করিয়ে ৬ ফেব্রুয়ারি (১৯৪০) জিন্না তৎকালীন ভাইসরয়কে জানান তার পরিকল্পনার কথা এবং ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহাের অধিবেশনে তা উপস্থাপনের কথা। উপস্থাপনের অর্থ প্রস্তাব পাস, ভারতবিভাগ সময়ের ব্যাপার মাত্র। ইসরয় তাদের সাম্প্রদায়িক অর্জনের কথা ভারতসচিব জেটল্যান্ডকে জানান। তাদের সমর্থন নিয়ে ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহাের অধিবেশনে প্রস্তাব পাস যা ইতিহাসে লাহাের প্রস্তাব নামে পরিচিত। এর মূল বিষয় ছিল ভারতবিভাগের মাধ্যমে পশ্চিমে ও পুবে মুসলিমপ্রধান অঞ্চলে দুটো স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। পশ্চিমে পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান এবং পুবে পূর্ববাংলা ও আসাম (যদিও আসাম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ নয়)। শুরু থেকেই এভাবে স্বতন্ত্র মুসলিম ভূখণ্ড নিয়ে নীতিগত স্ববিরােধিতা। অন্যান্য স্ববিরােধিতার কথা না হয় বাদই গেল। এ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন ফজলুল হক, সমর্থন জানান চৌধুরী খালিকুজ্জামান। এ প্রস্তাব উপস্থাপনে ফজলুল হকের উদ্দেশ্য ছিল অনুন্নত বাঙালি মুসলমানের স্বার্থরক্ষা করে বাংলা, বাঙালির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা। তিনিও তখন ভাবেননি বাঙালি-অসমী জাতিসত্তার দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের সম্ভাবনার বিষয়টি।
পরদিন (২৪ মার্চ) ভারতীয় কাগজগুলােতে (হিন্দু সম্প্রদায় পরিচালিত) বড় বড় হরফে ছাপা হয় পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার কথা। অথচ লাহাের প্রস্তাবের কোথাও পাকিস্তান’ শব্দটির উল্লেখ ছিল না। তাই পরবর্তী সময়ে জিন্না তার তিক্ত মন্তব্যে এমন কথা বলেছেন, হিন্দু কাগজগুলাের কল্যাণে আমাদের পাকিস্তান’ প্রাপ্তি। এভাবে পাকিস্তান শব্দটি বিশেষ ধর্মীয় তাৎপর্যে মুসলমান জনগােষ্ঠীর কাছে আত্মিক প্রিয়তা পেয়ে যায় । তিক্ত রাজনীতির বিরূপতা এভাবে বিপরীত স্বার্থ সিদ্ধ করতে থাকে। বলতে হয় নিয়তির নির্মম পরিহাস। লাহাের প্রস্তাব শুরুতে সর্বশ্রেণির ভারতীয় মুসলমানদের সমর্থন পায়নি। জাতীয়তাবাদী মুসলমান নেতৃত্বের সমর্থক মুসলমান জনসংখ্যা তার প্রমাণ। সিন্ধুর মুখ্যমন্ত্রী আল্লাবকশ সমরু থেকে সীমান্ত প্রদেশের লালকুর্তা নেতাদের সমর্থক জনগােষ্ঠী, এমনকি পাঞ্জাবের সেকুলার, ইউনিয়নিস্ট নেতা সিকান্দার হায়াত খানের মতাে জনপ্রিয় নেতাদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য । তবু এ কথা সত্য যে, লাহাের প্রস্তাব রাজনৈতিক অঙ্গনে তীরন্দাজি খেলার লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায়। এ বিষয়ে ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান’ লেখে : এ মুহূর্তে ভারতে বিশৃঙ্খলার রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন জিন্না’ (২ এপ্রিল, ১৯৪০)। লাহাের প্রস্তাবের সাংগঠনিক ও সাংবিধানিক জটিলতাদি বিচার করেই এ মন্তব্য। মুসলিম লীগ সদস্য ড. সৈয়দ আবদুল লতিফ তার মন্তব্যে সঠিক বিন্দুটি চিহ্নিত করেছিলেন এ বলে যে, মূল সমস্যা মুসলমানপ্রধান প্রদেশগুলাের মুসলিম অধিবাসীদের নিয়ে নয়, বরং সমস্যা তাদের নিয়ে যেখানে তারা সংখ্যালঘু এবং যারা জিন্নার লাহাের পরিকল্পনার ফলে চিরদিন এতিম হয়ে থাকবে। একথা মাওলানা আজাদেরও। তাই লতিফ দুর্বল কেন্দ্র নিয়ে গঠিত অখণ্ড ভারতে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল গঠনের পক্ষে যেখানে স্বেচ্ছাস্থানান্তরের সুযােগ থাকবে। অন্যদিকে অন্যান্য মুসলিম শিল্পপতির মতাে স্যার আবদুল্লাহ হারুন ভারতবিভাগসহ স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে, মূলত তাদের প্রতিযােগিতাহীন শ্রেণিস্বার্থের সমৃদ্ধির সম্ভাবনায় ।
স্যার মােহাম্মদ শাহনেওয়াজ খান অবশ্য ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থার পক্ষে যার কিছুটা পরবর্তী কেবিনেট মিশন প্রস্তাবের সঙ্গে তুলনীয়। সিকান্দার হায়াতের কথা আগেই বলা হয়েছে । প্রকৃতপক্ষে লাহাের প্রস্তাবে ধৃত ভারতবিভাগ ও স্বতন্ত্র মুসলমান রাষ্ট্রের দাবি অনেকটা হঠাৎ করেই আসে এবং তা ভূখণ্ডভিত্তিক ও বিভাজনধর্মী হওয়ার কারণে এর গুরুত্ব নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলে। পরবর্তীকালে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বলা হতে থাকে যে, লাহাের প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্য শুরুতে ছিল মুসলমান স্বার্থ। আদায়ের উপলক্ষ বা কৌশল মাত্র যা পরে দৃঢ় দাবিতে পরিণত হয়। এ তত্ত্বটি প্রধানত আয়েশা জালালসহ রিভিশনিস্ট ঘরানার অবদান যা জিন্না চরিত্র ও তার তৎপরতা বিচারে সঠিক মনে হয় না । আরাে মনে হয় না এ কারণে যে, গােটা পরিকল্পনা ও প্রস্তাবের নেপথ্য কারিগর ব্রিটিশরাজ। তাদের ইচ্ছা এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্রিটিশবিরােধী ও অখণ্ড ভারতের প্রবক্তা কংগ্রেসকে শায়েস্তা করা। সে কাজটা তাদের ইচ্ছামতােই সম্পন্ন হয় ব্যাপক রক্তপাতের মাধ্যমে সামনে হিমশীতল রক্তের একজন সেনাপতি, নরহত্যায় নৃশংসতায় যার কিছু আসে-যায় না। সে উদাহরণ ১৯৪৬-এর আগস্টে স্পষ্টই দেখা গেছে। আর এই লাহাের প্রস্তাব যে আসলেই পাকিস্তান প্রস্তাব, ভারত ভেঙে দুটুকরাে করে দুই ডােমিনিয়ন তৈরির প্রস্তাব তা ভারতসচিবের কাছে ভাইসরয় লিনলিথগাের লেখা চিঠির বক্তব্যেও স্পষ্ট। স্পষ্ট জাফরুল্লাহ খানকে দেয়া নির্দেশনামায়। সে নির্দেশে শুধু প্রস্তাব তৈরি নয়, ভারতবর্ষকে দুই ডােমিনিয়নে বিভক্ত করে মানচিত্র তৈরির কথাও ছিল। এ বিষয়ে ১২ মার্চ (১৯৪০) ভাইসরয় লিনলিথগাে ভারতসচিবকে লেখেন যে, তার নির্দেশমাফিক জাফরুল্লাহ ভারতবিভাগের মানচিত্রসহ প্রস্তাব তৈরি করছে। জাফরুল্লাহ কাদিয়ানি বিধায় বিষয়টি গােপন রাখা হয়েছে। এর কপি জিন্নাকে এবং সম্ভবত আকবর হায়দারিকে (হায়দরাবাদের) পাঠানাে হয়েছে ইত্যাদি (ওয়ালি খান, প্রাগুক্ত)। লাহাের প্রস্তাব যদি আদপেই রাজনৈতিক প্রত্যাশা-প্রাপ্তির দরকষাকষিই হয়ে থাকবে তাহলে প্রতিটি বিকল্প প্রস্তাবে জিন্না তার আপত্তি জানাবেন কেন।
বিষয়টি ইতিপূর্বে আলােচিত হয়েছে। ১৯৪১ সালে মুসলিম লীগের মাদ্রাজ অধিবেশনে জিন্না তার সভাপতির ভাষণে সুস্পষ্ট ভাষায় মুসলমানদের জন্য ভারত ভাগ করে দুটো স্বাধীন, স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবি আবারাে তুলবেন কেন। এরপর খালিকুজ্জামানসহ একাধিক শীর্ষনেতা আরাে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, ‘পাকিস্তানের চেয়ে কম কোনাে কিছুই মুসলিম লীগ মেনে নেবে না। এমনকি দীর্ঘস্থায়ী ব্রিটিশ উপস্থিতিও তাদের কাছে গ্রহণযােগ্য বিবেচিত হবে (আর. জে. মুর, প্রাগুক্ত)। বাস্তবে পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থায় খালিকুজ্জামান কথিত ব্রিটিশনির্ভরতা ঠিকই দেখা গেছে। যেমন প্রশাসনে, তেমনি সেনাবাহিনীর শীর্ষপদে । আর, জে, মুরের বিবরণ মতে, ১৯৪৯ সালেও পাকিস্তানের তিনজন গভর্নর ও তিন চিফ অব স্টাফ এবং ৪৭০ জন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন ইংরেজ । শুধু জিন্নার কারণে গভর্ণর জেনারেল পদে মাউন্টব্যাটেনকে বসানাে হয়নি। আর মাউন্টব্যাটেন তাতে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ইতিহাস তেমন প্রমাণ দেয় । ইতিমধ্যে বলা হয়েছে, বিকল্প প্রস্তাবগুলাে নাকচ করার মধ্য দিয় জিন্না ভারতীয় মুসলমান জনসমাজে এমন ভাবমূর্তি তৈরি করেন যে তিনি সবকিছুই করছেন সম্ভাব্য হিন্দু শাসনের বিপদ থেকে ভারতীয় মুসলমানদের রক্ষার উদ্দেশ্যে। এবং ১৯৪৪ সালে পৌছে তার পায়ের নিচে মাটি যখন মােটামুটি শক্ত তখন (ফেব্রুয়ারি) তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন, এখন ব্রিটেনের উচিত ভারতকে দুই সার্বভৌম জাতির জন্য বিভক্ত করার উপযােগী সংবিধান তৈরি করা’ (মুর)। পাকিস্তান দাবির মর্মকথা ছিল হিন্দু ভারতের বাইরে ভারতীয় মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও সমৃদ্ধি যা অখণ্ড ভারতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে ব্যাহত হবে। এই ডাকে প্রধানত বাঙালি মুসলমান সাড়া দেয় যদিও পশ্চিমের মুসলমানপ্রধান প্রদেশগুলাের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র প্রকৃতির। পাকিস্তান ইস্যুভিত্তিক ১৯৪৬-এর প্রাদেশিক নির্বাচন যদি মাইলফলক হিসেবে ধরা যায় তাহলেও দেখা যাবে, এরপর সীমান্ত প্রদেশের ওপর জবরদস্তি করে পাকিস্তান চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। সিকান্দার-খিজিরের পাঞ্জাব বিভাজিত পরিণতি চায়নি, ফলে রক্তস্নান গােটা পাঞ্জাবজুড়ে। সিন্ধু মােহাজির ভারে আক্রান্ত। বেলুচিস্তানে জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন চলছে। পাকিস্তান একমাত্র বিভাজিত পাঞ্জাবের আর্থ-সামাজিক স্বার্থরক্ষা করে চলেছে। আর বাঙালির কাঁধে পাকিস্তান এমন ভারী বােঝা হয়ে চেপেছিল যে, অনেক রক্তের বিনিময়ে সে বােঝা নামাতে হয়েছে বাঙালিকে। অবাঞ্ছিত সহিহসতায় ও নেতিবাচক রাজনীতির মাধ্যমে অর্জিত পাকিস্তান এভাবে সংশ্লিষ্ট জাতিসত্তা ও তাদের ভূখণ্ডগুলােকে স্পর্শ করেছে এবং করে চলেছে যা তাদের আকাক্ষার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক