সাধারণ নির্বাচন ও মুসলিম রাজনীতি
নানাদিক বিচারে তৎকালীন ভারতীয় রাজনীতিতে সিমলা বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত অবশ্য মূলত বৈঠক ভেঙে যাওয়ার কারণে! এর সঙ্গে যুক্ত দুটো ঘটনা। ব্রিটেনের নির্বাচনে শ্রমিক দলের বিজয় এবং যুদ্ধে জাপানের পরাজয় ও আত্মসমর্পণ ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা শ্রমিক দলের জয়ে উল্লাস প্রকাশ করে তাদের অভিনন্দন জানান। স্টাফোর্ড ক্রিপস এবারও মন্ত্রী। যুদ্ধাবস্থার কারণে ভারতে নির্বাচন দীর্ঘ সময় স্থগিত ছিল। এখন সেখানে নির্বাচন হওয়া দরকার, এমন ভাবনা তার এবং আরাে অনেকের জিন্না বিশেষভাবে খুশি নির্বাচনে কংগ্রেসকে একহাত নেয়া যাবে, নিজেকে ও মুসলিম লীগকে মুসলিম ভারতের একমাষ্ট্র প্রতিনিধি বা মুখপাত্র প্রমাণ করা। সম্ভব হবে। তার বক্তৃতায় (৬ আগস্ট,১৯৪৫) জিন্না স্পষ্ট ভাষায় সিমলা বৈঠকের ব্যর্থতার জন্য গান্ধিকে দায়ী করে বলেন যে, এবার মুসলিম লীগ নির্বাচন করবে ‘পাকিস্তান দাবিঞ্জ(পাকিস্তান ইস্যু) ভিত্তিতে যাতে সাংবিধানিক সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা যায়। কংগ্রেসও নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী। তবে তাদের দাবি নির্বাচন মুক্ত, নিরাপদ পরিবেশে হওয়া আবশ্যক। অবশ্য এ দাবির নেপথ্য কারণ অগ্রাহ্য করার মতাে ছিল না। মুসলিম লীগের যুদ্ধংদেহী ভাব, তাদের ‘ন্যাশনাল গার্ড’ নামীয় উগ্র ক্যাডার বাহিনী, প্রতিপক্ষের ওপর হামলা ইত্যাদি বিষয় সম্ভবত ওই বক্তব্যের মূল কারণ। কেন্দ্রে ও প্রদেশে মুসলিম আসনের নির্বাচনে দৃষ্ট। ঘটনাবলী ওই আশঙ্কার বাস্তব প্রতিফলন। হুমায়ূন কবির থেকে সৈয়দ নওশের আলী, আশরাফউদ্দিন চৌধুরী থেকে আবদুল হালিম গজনভি প্রমুখ জাতীয়তাবাদী প্রার্থীর কারাে কারাে ওপর দৈহিক আক্রমণ ও তাদের প্রত্যেকের নির্বাচনী সভায় লীগ ক্যাডারদের হামলা তার প্রমাণ। অন্তত একটি ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে দৈনিক পত্রিকার বিবরণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের একচেটিয়া জয়ের কিছু রহস্য স্পষ্ট করে তােলে।
ইতিমধ্যে ভাইসরয় ওয়াভেল তার লন্ডন সফরে কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে শলাপরামর্শ শেষে দিল্লিতে ফিরে ঘােষণা করেন যে, এই শীতেই কেন্দ্রে ও প্রদেশগুলােতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে (১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫)। শুনে জিন্নার ঘােষণা যে এবার তাদের নির্বাচনী দাবি একটাই- পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান এবং বাংলা ও আসাম নিয়ে সার্বভৌম, স্বতন্ত্র পাকিস্তান গঠন করতে হবে। এ আহ্বানে কিছুটা সাড়া দেখা যায় পশ্চিমাঞ্চলের নেতাদের মধ্যে। তবে বঙ্গীয় মুসলমানদের মধ্যে এই সাড়া ব্যাপকভাবে এবং তা প্রধানত আবুল হাশিম, শহীদ সােহরাওয়ার্দী প্রমুখ নেতার তৃণমূলস্তরে প্রচারের গুণে । সেই সঙ্গে মৌলভী-মাওলানাদের ধর্মীয় প্রচার মুসলিম লীগের নির্বাচনী পালে হাওয়া জোরদার করে। তাছাড়া দৈনিক আজাদ’-এর সাম্প্রদায়িক প্রচারও কম গুরুত্ব। বহন করেনি। এ সময়টাতে মাস দুয়েকের জন্য আমি গ্রামে চেনা গ্রামটাকে তখন রাজনৈতিক দিক থেকে অচেনা মনে হয়েছে। গ্রামের যেসব নিমবর্গীয় তরুণ এক সময় রাজনীতির ‘র’ বুঝত না, সম্পন্ন বাড়িতে বা ক্ষেতখামারে কাজের বাইরে আর কিছু তাদের বােধের অন্তর্গত ছিল না তাদেরও দেখা গেল গ্রাম্য ভাষায় জিন্না-বন্দনা ও কংগ্রেস-বিরােধী গান গাইতে। এবং তা বেশ চড়া মেজাজে। এর অর্থ ভােট-সাম্প্রদায়িকতা প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত পৌছে গেছে। দেখে অবাক লেগেছে। গ্রাম থেকে শহরে ফেরার পথে শিয়ালদা স্টেশনে অনেকক্ষণ অপেক্ষা সন্ধ্যার পর অন্য ট্রেন ধরব বলে তাই হালকা চালে পায়চারি করতে গিয়ে চোখে পড়েছে মুসলিম লীগের ন্যাশনাল গার্ড নামীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর মাস্তান চেহারার কয়েকজন যুবক সার বেঁধে দাঁড়ানাে, আর থেকে থেকে ক্রমাগত ফুকার : মুসলিম লীগ কাউন্সিলর’, ‘মুসলিম লীগ কাউন্সিলর’ আমি কাউন্সিলর নই বুঝে এক বিশালদেহী কর্মী মাছি তাড়ানাের ভঙ্গিতে তার পেশল হাতের ধাক্কায় আমাকে সরিয়ে দেয়। তারপর সেই ‘ফুকার’ তখনকার রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবর্তন নড়াইল শহরেও কিছুটা দেখা গেছে বিশেষ করে কলেজের মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশে। তাদের রাজনৈতিক মানসিকতার পরিচয় মিলেছে তাদের বাের্ডিং হাউসের সামনে দেবদারুপাতায় সজ্জিত ‘জিন্নাহ গেট’ তৈরিতে । আরাে মিলেছে পরে প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় সৈয়দ নওশের আলীর বিরুদ্ধে অনাচারী মিছিল ও কুৎসিত শ্লোগানে এবং সৈয়দ সাহেবের জনসভায় ইটপাটকেল নিয়ে আক্রমণে । এসব অবশ্য শহরবিশেষের ঘটনা কিন্তু গােটা নির্বাচন পরিস্থিতি ধর্মান্ধতার টানে এক অনাচারী চরিত্র অর্জন করেছিল দুয়েকটি নিরপেক্ষ সংবাদপত্রের বয়ানেও এমন ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে।
নির্বাচন ঘােষণার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের মধ্যে কেমন এক ধরনের অনিশ্চয়তার ভাব দেখা দেয়। একদিকে মুসলিম লীগের উগ্র বৈরিতা, অন্যদিকে কংগ্রেসের মুসলিমনীতি বিষয়ক দোদুল্যমানতা। বিষয়টা ভিপি মেননের লেখায় উঠে এসেছে (পৃ. ২২১)। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা হয়েছে, মুসলমান জনতার সমর্থন আদায়ে গান্ধির কাছে মাওলানা আজাদের প্রস্তাব এবং এ সম্বন্ধে কংগ্রেসের মুক্তচিন্তার গুরুত্ব। এ প্রস্তাব ছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য কিছু মাত্রায় সাংবিধানিক ছাড় তথা সুযােগ-সুবিধা। কিন্তু এ বিষয়ে কংগ্রেস নেতৃত্বের অবশেষ মতামত বড় একটা জানা যায়নি, লিখেছেন ভিপি মেনন। আমার ধারণা, এ প্রস্তাব এসেছে বেশ দেরিতে। ইতিমধ্যে গঙ্গা-পদ্মায় অনেক জল, অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। এ সময়ে কংগ্রেসের কিছু করার ছিল সময়ের ঘণ্টা বেজে গেছে। কিছু করার যথার্থ সময় ছিল ১৯৩৭-৩৮-এ। তবু অভিযােগ রয়েছে কারাে কারাে লেখায় যে, কংগ্রেস কোনাে কোনাে। জাতীয়তাবাদী মুসলমান প্রার্থীকে অর্থ সাহায্য দিয়েছে। আসলে জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও শৃঙ্খলার যথেষ্ট অভাব ছিল যেজন্য মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ১৯৪৫-৪৬ সালের নির্বাচনে তারা সুবিধা করতে পারেনি। তাদের কেউ কংগ্রেস প্রতীকে, কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে, কেউবা অন্য দলবিশেষের পক্ষে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। স্বভাবত তাদের সবার পেছনে আকাক্সিক্ষত মাত্রায় অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক সমর্থন ছিল না । তাছাড়া কংগ্রেস প্রতীকে অন্তত বাংলায় বা যুক্তপ্রদেশে বা পাঞ্জাবে মুসলমান প্রার্থীর নির্বাচনে প্রতিযােগিতা বাস্তবতা বিচারে সঠিক ছিল না। সৈয়দ নওশের আলী বা আশরাফউদ্দিন চৌধুরী সম্বন্ধে নিশ্চিত এ কথা বলা যায়। তাদের উচিত ছিল ১৯৪০ সালের পরই জাতীয়তাবাদী মুসলিম ফ্রন্ট গঠন করা যার পেছনে কংগ্রেসের প্রচ্ছন্ন সমর্থন থাকতে পারে ফ্রন্ট গড়ার উদ্যোগ তারা অবশ্য নিয়েছেন, তবে দেরিতে, শেষ মুহূর্তে, যেমন শীলা সেন লিখেছেন (মুসলিম পলিটিক্স ইন বেঙ্গল, প্রাগুক্ত)।
লীগরাজনীতির বাইরে মুসলিম রাজনৈতিক গ্রুপগুলােকে নিয়ে সর্বভারতীয় ভিত্তিতে ফ্রন্ট গঠিত হয় ১৮ সেপ্টেম্বর (১৯৪৫)। আশ্চর্য যে এ উদ্যোগ আর কেউ নেয়নি, নিয়েছিল জমিয়াতুল উলেমা হিন্দ নামের ধর্মীয় সংগঠন। এতে অন্তর্ভুক্ত জমিয়াতুল উলেমা, মুসলিম মজলিস, মমিন কনফারেন্স, কৃষক প্রজাপার্টি এবং আমান ওয়াতানের মতাে কয়েকটি গ্রুপ, যাদের ঠিক পার্টি বলা চলে না। কুমিল্লার আশরাফউদ্দিন চৌধুরীর ওপর লেখা ‘রাজবিরােধী’ বইটিতে চৌধুরী সাহেবের জবানিতে তার নির্বাচন প্রচার অভিযানে মুসলিম লীগ সন্ত্রাসীদের হামলার কথা লেখা হয়েছে। তার ওপর দৈহিক আক্রমণের চেষ্টার কথা রয়েছে তাতে । ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে লীগের এ বৈশিষ্ট্য প্রায় সর্বত্র দেখা গেছে। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়াইয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে করাচিতে এদের আরেকটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২ অক্টোবর (১৯৪৫)। মূল লক্ষ্য লীগ-বিরােধী বিকল্প রাজনৈতিক ধারা গঠন। কংগ্রেস এ ব্যাপারে কোনাে উদ্যোগ নেয়নি। একমাত্র শরৎ বসু এক বিবৃতি মারফত জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের কংগ্রেসের ছাতার নিচে সংঘবদ্ধ করার কথা বলেন (পৃ. ২০২)। কিন্তু অন্তিম পর্যায়ে সেটাও হতাে আরেক ভুল । কারণ জিন্না ও মুসলিম লীগের ক্রমাগত কংগ্রেসবিরােধী প্রচার মুসলমান জনতার কান এতটা ভারী করে রেখেছিল যে, কংগ্রেস নয় স্বাধীন বিকল্প পার্টি বা ফ্রন্ট গঠন হতে পারত সঠিক সিদ্ধান্ত। এ সাংগঠনিক কাজটি করা উচিত ছিল অন্ততপক্ষে ১৯৪০ সালে যখন মুসলিম লীগের রাজনৈতিক শিকড়-বাকড় মুসলিম জনমানসের খুব একটা গভীরে ছড়িয়ে যায়নি। তবু মনে রাখতে হবে মুসলিম লীগের ক্রমাগত কংগ্রেস-বিরােধী প্রচার এবং কংগ্রেসের কিছু ভুলভ্রান্তির কারণে মুসলমান সম্প্রদায়ের বড়সড় অংশ কংগ্রেসকে হিন্দু স্বার্থের সংগঠন হিসেবে ভাবতে শুরু করে । বড় সমস্যা, কংগ্রেস এ বিষয়টা ততখানি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেনি।
মুসলিম লীগ-বিরােধী বিকল্প মুসলিম রাজনীতির অকালবােধন সম্বন্ধে মনে হয় কিছু জানা দরকার জিন্নার ‘পাকিস্তান ইস্যু’ ভিত্তিক নির্বাচনী ঘােষণার পর বঙ্গীয় মুসলিম লীগ বিষয়টাকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে। বঙ্গীয় লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম এ বিষয়ে একটি তাত্ত্বিক মেনিফেস্টো তৈরি করে তাতে ঘােষণা করেন : “আসুন, আমরা সবাই লড়াইয়ে নামি’ । হাশিমসােহরাওয়ার্দী এই দুই নেতা জেলা পর্যায়ে সফর করতে থাকেন। পরে তারা গ্রামগঞ্জে পর্যন্ত পৌঁছে যান যে জন্য প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের সর্বোত্তম বিজয় বঙ্গদেশে। নির্বাচনী প্রচারে আবুল হাশিম বাদে আর সবার কণ্ঠেই ছিল সাম্প্রদায়িক জিহাদি নারা যা বিজয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। অন্য কারণগুলাে খুব স্পষ্ট যা আগে বিশদভাবে বলা হয়েছে। এবং এর মূলে রয়েছে স্বয়ং ফজলুল হকের তার প্রজাপার্টিসহ একদা মুসলিম লীগে যােগদান। লীগ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর হকের পক্ষে নতুন করে লীগ-বিরােধী রাজনৈতিক দল গঠন বা প্রজাপাটি পুনর্গঠন সহজ ছিল না। কারণ লীগও কৃষক-প্রজাদের।
এমন স্বপ্ন দেখিয়েছিল যে পাকিস্তান অর্জিত হলে তাদের ঘরে দুধ-মধুর নহর বয়ে যাবে এবং হিন্দু জমিদারের অত্যাচার-শশাষণ বন্ধ হবে, বন্ধ হবে ভয়াবহ। মহাজনি শােষণ । এসব প্রচারের প্রভাব কম ছিল না। তবু সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা চলে জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতাদের, যদিও অনেক দেরিতে। জমিয়াতুল উলেমার বঙ্গীয় শাখা প্রধান উদ্যোক্তা, সঙ্গে কৃষক। প্রজাপার্টি (মে, ১৯৪৪)। প্রজাপার্টির নেতা হাশেম আলী খান এ উদ্যোগে হাল ধরেন। পরে এ প্রচেষ্টা চলে সর্বভারতীয় ভিত্তিতে, দিল্লিতে ন্যাশনালিস্ট মুসলিম সম্মেলন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে (৬-৮ মে, ১৯৪৪) যে সম্বন্ধে আগে বলা হয়েছে। এদের মূল বক্তব্য কেন্দ্রে জাতীয় সরকার গঠন যাতে হিন্দু-মুসলমান অনৈক্য দূর করা যায়। সেজন্য উদ্যোগ নেয়া হয় সর্বভারতীয় মুসলিম মজলিস গঠনের। ফজলুল হক এ উদ্যোগের প্রতি অভিনন্দন জানান। কৃষক প্রজা পার্টির সেক্রেটারি শামসুদ্দিন আহমদও সম্মেলনে যােগ দেন। তারা জানতেন এ পর্যায়ে তাদের যাত্রাপথ খুব কঠিন। দিল্লি সম্মেলনের পর ফজলুল হকের চেষ্টায় কলকাতায় অনুরূপ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় (২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৪)। তাদের চেষ্টা ব্যাহত হয় গান্ধি-জিন্না আলােচনার ফলে যখন গান্ধি জিন্নাকে। মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে মেনে নেন। রাজনীতির এমন এক নৈরাজ্যিক অবস্থায় ভাইসরয় ওয়াভেলের সিমলা বৈঠক আহ্বান এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে কংগ্রেস ও মুসলমান সম্প্রদায় থেকে মুসলিম লীগকে প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নিয়ে বৈঠক শুরু করেন। তাতে করে সমস্যা। সমাধানের বদলে আরাে জটিলতা সৃষ্টি হয়। সব মিলিয়ে নির্বাচনে পরিস্থিতি মুসলিম লীগের জন্য ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে। কেন্দ্রের সব কটি আসন তারা দখল করে। প্রদেশগুলােতে মােট ৫০৯টি মুসলিম আসনের মধ্যে ৪৪২টি আসনেই মুসলিম লীগ জয়লাভ করে। সামগ্রিক বিচারে মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রধান দল হিসেবে মুসলিম লীগ স্বীকৃতি পায়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের তুলনায় এটি ছিল বড়সড় অর্জন। সে হিসেবে মুসলিম সম্প্রদায়ের জনমতে পাকিস্তান এক স্বীকৃত সত্য হয়ে ওঠে। কিন্তু এর বিপরীত সত্যও অস্বীকার করা চলে না। যেমন মুশিরুল হাসান। বলেন : ভােট সংখ্যা হিসাব করলে পাকিস্তানি উন্মাদনা ও ধর্মীয় প্রচারের মধ্যেও জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের অবস্থান খুব একটা খারাপ নয়। তিনি অবশ্য যুক্তপ্রদেশে কয়েকজন খ্যাতনামা জাতীয়তাবাদী নেতার বিজয়ের কথা।
উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বঙ্গে একমাত্র লীগ-বিরােধী নেতা ফজলুল হক দুই আসনে বিজয়ী । মুশিরুল হাসানের প্রদত্ত সারণিতে দেখা যায় মুসলমান আসনগুলােতে মুসলিম লীগ যেখানে পেয়েছে ৬৪ দশমিক ৭ শতাংশ ভােট, সেখানে জাতীয়তাবাদী মুসলমান পেয়েছে ১৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং কংগ্রেস ১৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ ভােট। এ দুয়ের যােগফল নিয়ে মুশিরুল হাসানের হিসাব। অন্যদিকে লীগের নির্বাচনী সাফল্য সত্ত্বেও মুসলমান-প্রধান গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ পাঞ্জাবে মুসলিম লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি এবং মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেনি। বরং সেকুলার ইউনিয়নিস্ট পার্টির নেতা খিজির হায়াত খান তিওয়ানা কংগ্রেস ও আকালি শিখ দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সম্মিলিত মন্ত্রিসভা গঠন করেন এবং তা ফজলি হাসান ও সিকান্দার হায়াতের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারাবাহিকতায় । সীমান্তপ্রদেশে কংগ্রেস ও গাফফার খানের দল মিলে লীগবিরােধী মন্ত্রিসভা গঠন করে। সিন্ধুতে সরকারি ও ইউরােপীয় গােষ্ঠীর সমর্থন নিয়ে সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কোনােমতে লীগ মন্ত্রিসভা গঠিত হয় । একইভাবে আসামে। একমাত্র বাংলায় লীগ স্বচ্ছন্দ সংখ্যাধিক্য আসন নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করে। সােহরাওয়ার্দী হন মুখ্যমন্ত্রী। যে বঙ্গে সােহরাওয়ার্দীকে কেন্দ্রীয় নির্বাচনী তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দ করতে চাননি জিন্না, নির্বাচনে সেই বঙ্গের মাধ্যমেই পাকিস্তান দাবির প্রতিষ্ঠা। সব প্রদেশে ক্ষমতাসীন হতে না পেরে অসন্তুষ্ট জিন্না তাই রাজনৈতিক দেনদরবারেই কেবল তিক্ততা প্রকাশ করেননি, শেষ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের রক্তস্নানের মধ্য দিয়ে দেশভাগ ও পাকিস্তান অর্জন নিশ্চিত করেন। সে রক্তস্নানের কেন্দ্রস্থলও বঙ্গদেশ। পরে সে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা অন্যত্র ছড়িয়ে যায়।
পাকিস্তান তাই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। হয়েছে। তির্যক, অমানবিক হিংসার পথ ধরে। সমর্থনে ব্রিটিশ রাজ। সাধারণ নির্বাচনের ফল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করে দেখলে অন্তত এটুকু স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে এতে করে বঙ্গদেশ বাদ দিলে সর্বভারতীয় ভিত্তিতে পাকিস্তানের পক্ষে একচেটিয়া রায় প্রকাশ পায়নি। তখনাে ভারতভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার তরবারি জিন্নার হাতে পুরােপুরি উঠে আসেনি। অবিভক্ত ভারতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনভিত্তিক সাংবিধানিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে হাওয়া খুব জোরালাে হয়ে উঠতে পারেনি। এ পর্যায়ে কংগ্রেসের পক্ষে প্রয়ােজন ছিল হিসাব-নিকাশ করে সতর্ক পদক্ষেপ। কিন্তু সাধারণ আসনে কংগ্রেসের একাট্টা বিজয় কংগ্রেসী নেতাদের মধ্যে অতিআত্মবিশ্বাসের উন্মাদনা তৈরি করে যা তাদের জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। তদুপরি বিহারে শাসনতান্ত্রিক উচ্ছঙ্খলতা, যুক্তপ্রদেশের গড়মুক্তেশ্বরে বীভৎস দাঙ্গা এবং স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের তা জায়েজ করার চেষ্টা (অর্থাৎ নােয়াখালী দাঙ্গার প্রতিক্রিয়া হিসেবে উপস্থাপন) মুসলমান জনস্তরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এভাবে কংগ্রেসের সেকুলার ভাবমূর্তি নষ্ট হতে থাকে। বিহারী দুষ্কর্ম’, সম্পর্কে যশবন্ত সিংয়ের লেখায়ও সমালােচনা প্রকাশ পেয়েছে (পৃ. ৩৫৬) এবং সেই সঙ্গে গড়মুক্তেশ্বর দাঙ্গার বিষয়েও। স্বভাবতই এসব প্রদেশে সংখ্যালঘু নিরাপত্তার বিষয়টি জনসমাজে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হতে থাকে। কংগ্রেসের যথাযথ নজর সেদিকে ছিল না। সে হিসেবে ব্রিটিশ তদারকিতে অনুষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক সমঝােতার তর্কবিতর্কও কংগ্রেস মেটাতে চেষ্টা করেনি। এক কথায় লেনদেনের হিসাব-নিকাশে কংগ্রেস পক্ষে সতর্কতা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অভাব ছিল। আবারাে বলব নির্বাচনী ফলজনিত অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাস কংগ্রেসের ভুল পদক্ষেপের সহায়ক। হয়েছে। বলা বাহুল্য, জিন্না সে সুযােগ নিতে ভুল করেননি, দেরি করেননি। পরে কংগ্রেস বুঝতে পেরেছে লক্ষ্য তাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক