You dont have javascript enabled! Please enable it!

জিন্না পাকিস্তান চাননি  প্রশ্নবিদ্ধ মিথ

ভারতীয় রাজনীতির দাবার ছকে কংগ্রেসের তুলনায় হয়তাে কিছুটা বেশিই চাতুর্য ও বুদ্ধিমত্তা নিয়ে খেলেছেন লীগ সভাপতি মােহাম্মদ আলী জিন্না। আশ্চর্য যে, সময় ও ঘটনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার পক্ষে কাজ করেছে। আর রাজশক্তি তাে বরাবরই তার পক্ষে  যে রাজশক্তি তাকে ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র রাজনৈতিক মুখপাত্র হয়ে উঠতে সহায়তা করেছে। বিষয়টা ইতিপূর্বে আলােচিত। আর এক্ষেত্রে জিন্নার কৌশলটা হচ্ছে ঘরােয়া বা আন্তর্জাতিক যে কোনাে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনায় (ইস্যুতে) তিনি কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত দেখে নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নিতেন বলেছেন হডস। কংগ্রেস বিষয়টা লক্ষ্য করেছিল, না উপেক্ষা করেছে তা আমাদের জানা নেই তবে জিন্নার পদ্ধতি বরাবরই ছিল এ রকম। যেমন বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে ভারতীয় রাজনীতির প্রতিক্রিয়া নিয়ে। আগে। বলা হয়েছে এ যুদ্ধ জিন্না ও মুসলিম লীগের জন্য শাপে বর হয়ে ওঠে।  সেপ্টেম্বরে (১৯৩৯) বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারতের ব্রিটিশ শাসক ভাইসরয় লিনলিথগাে ঘােষণা করেন (৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯) যে ব্রিটিশরাজ ও জার্মানির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ভারতে এখন যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থা বিরাজ করছে।’ এর অর্থ জরুরি অবস্থার শাসন। এদিক-ওদিক মাথা নাড়লে অর্থাৎ আন্দোলন-টান্দোলনে গেলে জরুরি অবস্থার আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর আন্দোলন মানে কংগ্রেস। লীগ তাে জন্মাবধি ব্রিটিশ-বিরােধী স্বাধীনতাবাদী বা স্বরাজ্যবাদী আন্দোলনগুলাে থেকে দূরে থেকেছে। কখনাে রাজ বিরােধিতায় নামেনি। এই ছিল মুসলিম লীগের রাজনৈতিক চরিত্র  স্বভাবতই জরুরি অবস্থা, যুদ্ধাবস্থায় রাজনৈতিক দিক থেকে ‘রাজ’-এর একমাত্র ভরসা জিন্না ও মুসলিম লীগ, এক কথায় জিন্নালীগ। হিসাব-নিকাশে বেনিয়াজাতি বড় ওস্তাদ না হলে সমুদ্রের ওপার থেকে বাণিজ্য করতে এসে এত বড় একটি উপমহাদেশ দখল করে নিতে পারে? এ হিসাবটা দেশি রাজনীতিকদের কমই ছিল। ছিল না বলেই ওদের ভাগ কর, শাসন কর নীতি চোখের সামনে দেখেও বড় বড় নেতা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেননি। 

যাই হােক, পাশার দান ঠিক মতােই পড়ল যুদ্ধ ঘােষণার প্রায় পক্ষকালের মধ্যেই কংগ্রেস ফ্যাসিস্ট নাৎসি শক্তির বিরুদ্ধে নিন্দাবাদ জানিয়েও ভারতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে রাজ-এর মনােভাব জানতে চেয়ে এবং জরুরি অবস্থা জারির বিরােধিতা করে প্রস্তাব গ্রহণ করে। জিন্না অপেক্ষা করছিলেন। কংগ্রেসের মনােভাব ও সিদ্ধান্তের জন্য। সেটা জানা হয়ে যাওয়ার পর ১৮ সেপ্টেম্বর (১৯৩৯) জিন্না-লীগের বক্তব্য তুলে ধরা হয়। তাদের মতে, ভারতীয় ব্রিটিশরাজ বর্তমান পরিস্থিতিতে মুসলমান সমর্থন অবশ্যই আশা করতে পারে যদি তারা এমন নিশ্চয়তা দেন যে মুসলিম লীগের অনুমােদন ছাড়া ভারতে কোনাে সংবিধান প্রণয়নের চেষ্টা করা হবে না এবং ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলা ও যে কোনাে প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ‘ভেটো দেয়ার অধিকার মুসলিম লীগের থাকবে (হডসন, ‘দ্য গ্রেট ডিভাইড’ পৃ. ৭৭-৭৮)। এ প্রস্তাব ও সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্টভাবেই বলা যায় জিন্না ও লীগের ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র হওয়ার দাবি ১৯৪০-এর পর থেকে শুরু (আয়েশা জালাল) হয়নি। এর সূচনা আগে থেকেই। বর্তমান প্রস্তাবের (অক্টোবর, ১৯৩৯) আগেও নানাভাবে জিন্না তার এ মনােভাব প্রকাশ করেছেন যা নিয়ে ইতিপূর্বে আলােচনা করা হয়েছে। আসলে একমাত্র মুখপাত্র’ হওয়ার বিষয়টি গােড়া থেকেই জিন্নার মাথায় এমনভাবে গেঁথে যায় যে, এটাই তার রাজনৈতিক জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে স্বতন্ত্র ভুবনের চিন্তা ।

কংগ্রেস ও লীগের পরস্পর-বিরােধী অবস্থান ও প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে হডসনের মন্তব্য: ‘সেপ্টেম্বর ১৯৩৯-এর যুদ্ধাবস্থার পরিবেশে কোনাে সরকারের পক্ষে পরস্পর-বিরােধী এসব দাবি-দাওয়া মেনে নেয়া সম্ভব ছিল  বাস্তবিকই শক্তির এই ত্রিকোণ-দ্বন্দ্ব ভারতবিভাগের পূর্বপর্যস্ত সচল ছিল। এবং এ বিষয়ে প্রায় সবাই একমত যে এই অনড় দ্বন্দ্বই ভারতবিভাগ নিশ্চিত করেছিল। এর দায় জিন্নার হলেও কংগ্রেস দায়মুক্ত ছিল না। কংগ্রেসের বরাবরের দাবি বয়স্ক জনভােটে নির্বাচিত গণপরিষদ সংবিধান তৈরি করবে সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষার ভিত্তিতে এবং তা স্বাধীন ভারতে । অন্যদিকে জিন্নার দাবি তাদের সম্মতি ব্যতিরেকে কোনাে সংবিধান তারা মেনে নেবেন না। ভাইসরয় লিনলিথগাে এ দ্বন্দ্বের সুযােগ ভালােভাবে নিতে পেরেছিলেন। বিশেষ করে প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিসভার পদত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে । কংগ্রেসের ক্ষমতা ত্যাগের অদূরদর্শিতা মুসলিম লীগের শক্তি বৃদ্ধি করে। মধ্যপন্থী বা দোদুল্যমান মুসলমান নেতা অনেকে লীগের শিবিরে। একে একে জমায়েত হতে থাকেন। কংগ্রেসের মন্ত্রিত্ব ত্যাগে উৎফুল্ল জিন্না    ভারতীয় মুসলমানদের শুকরিয়া দিবস পালনের আহ্বান জানান (২২ ডিসেম্বর, ১৯৩৯)। কী অদ্ভুত স্যাডিস্ট’ মানসিকতা!

এই পরস্পর-বিরােধিতার মুখে জিন্না স্পষ্ট ভাষায় একাধিকবার দাবি জানিয়েছেন, ভারতের হিন্দু-মুসলমান দুই ভিন্ন জাতি এবং সে হিসেবে তারা ভারত শাসনে অংশ নেবে’। কথাটা ভি পি মেনন, এইচ ডি হডসন কিংবা আয়েশা জালাল সবাই উল্লেখ করেছেন। এটা স্পষ্টই জিন্না-কথিত দ্বিজাতিতত্ত্বের পক্ষে অভিমত যা পরে লাহাের প্রস্তাবে জোরালােভাবে তুলে ধরা হয় । এর আগের একটি ঘটনায়ও দেখা যায় দ্বিজাতিতত্ত্ব ও ভারতভাগ করে পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব ভারত সচিব জেটল্যান্ডের কাছে তুলে ধরেন মুসলিম লীগ নেতা খালিকুজ্জামান। খালিকুজ্জামানের বক্তব্যে জানা যায়, লন্ডনে গােলটেবিল বৈঠকের ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক হতাশায় আক্রান্ত খালিকুজ্জামান (১৯ মার্চ, ১৯৩৯) লনডনে জেটল্যান্ডকে ভারতের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বিশেষ সম্ভাবনার কথা বলেন। তাতে স্পষ্টই ভারত ভাগের কথা বলা হয়। এবং ভারতসচিব ‘হ্যা’ ‘না’ কিছু না বললেও এ প্রস্তাবের বিরােধিতা করেননি। (উদ্ধৃতি, যশপ্ত সিং, প্রাগুক্ত)। বরং কিছুটা সহানুভূতির সুরেই কথা বলেছেন তিনি। জিন্নার একের পর এক বিবৃতি তার রাজনৈতিক কার্যক্রম প্রমাণ করে যে নানা কারণে ভারত দ্বিখণ্ডিত করে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র ভুবন (পাকিস্তান) প্রতিষ্ঠা তার জন্য যেন জীবনমরণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল । জেদের বশবর্তী হয়ে যুক্তিতর্কের বাইরে দাঁড়ানাের কারণে তিনি ভেবে দেখতে চাননি যে ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রদেশে, শহরে এবং অলিতে-গলিতে, গ্রামগঞ্জে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি এমনভাবে বাস করছে যে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভূখণ্ডভিত্তিতে ভারতের হিন্দু-মুসলমানকে পুরােপুরি আলাদা করা অসম্ভব। কথাটা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ একাধিকবার বলেছেন এবং সে সম্ভাব্যতা বিচার করেই তিনি যুক্তি দিয়ে, তথ্য দিয়ে মুসলমানদের জন্য খণ্ডিত ভারতের অংশ নিয়ে পাকিস্তান গঠনের অবাস্তবতা প্রমাণ করতে চেয়েছেন তার বক্তব্যে। সে অবাস্তবতা সামাজিক-রাজনৈতিক। শেষ পর্যন্ত তার আশঙ্কাই। সত্যে পরিণত হয়েছে । জিন্নার জেদে সাড়ে তিন কোটি মুসলমান জনসংখ্যা ভারতে ফেলে রেখে ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জিন্নারই ভাষায় পােকায় কাটা পাকিস্তান’ গঠিত হয়। 

জিন্না কথিত ওই রাজনৈতিক তত্ত্বের কারণে পেছনে ফেলে যাওয়া কয়েক কোটি মুসলমান ভারতে রাজনৈতিক বিচারে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয় । উপমহাদেশ ভেঙে গঠিত হয় চিরবৈরী দুই ডােমিনিয়ন ভারত ও পাকিস্তান (জিন্না ও মুসলিম লীগের ভাষায় হিন্দুস্তান ও মুসলমানিস্তান তথা পাকিস্তান)। দুই ডােমিনিয়নের সীমানা নির্ধারণেও সেই অবাস্তবতার প্রকাশ ঘটেছে। বঙ্গবিভাগের সময় দেখা গেছে জেলা ভাগ, মহকুমা ভাগ করেও ভাগবাটোয়ারায় সুবিচার করা যায়নি। কারাে জমির ওপর দিয়ে, কারাে উঠানের ওপর দিয়ে বিভাজন রেখা টানতে হয়েছে। অশেষ দুর্ভোগ তৈরি হয়েছে র্যাডক্লিফের টানা সীমান্তরেখার উভয় পারের মানুষের জন্য। বিদেশি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কেউ কেউ (যেমন এমার্সন) এ বিভাজনজাত রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ‘অদ্ভুত রাষ্ট্র’ বা ‘উদ্ভট রাষ্ট্র’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আরাে এ কারণে যে সেই এক রাষ্ট্রের দুই অংশের মধ্যে সীমান্তহীন হাজার মাইলের ব্যবধান। সে উদ্ভটত্বের দায়ও পুরােপুরি জিন্নার, যিনি লাহাের প্রস্তাবের দুই পাকিস্তানকে তার দুর্বুদ্ধির খোচায় এক পাকিস্তানে পরিণত করেন। বলেন, states-এর ‘এস (s)’ অক্ষরটি টাইপের ভুলে যুক্ত হয়েছে। স্ট্যানলি উলপার্ট তার ‘জিন্না অব পাকিস্তান’ গ্রন্থে (অক্সফোর্ড গ্রুপের) একাধিক মন্তব্যে জিন্নার পাকিস্তান বিষয়ক অবসেশনের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। উল্লেখ করেছেন জিন্নার অসম্ভব অহম্বােধের কথা। তার মতে, জিন্না ভাইসরয় লিনলিথগাে বা ভারতসচিব জেটল্যান্ডের চেয়েও শীতল রক্ত ও অসীম ধৈর্যের মানুষ’  যদি লাহাের প্রস্তাবের সময় থেকেও ধরা যায় তাহলেও দেখা যাবে যে জিন্নার বক্তৃতা ও দেনদরবার কোনােটিতেই সমঝােতার মনােভাব ছিল না । ছিল ভারতভাগ করে পাকিস্তান আদায়ের জেদ।

এ আদায়ের জন্য বরাবর দুটো নীতি অনুসরণ করেছেন জিন্না। প্রথমত, তার মতে ভারতের হিন্দু মুসলমান দুই ভিন্ন জাতি (ধর্মীয় সম্প্রদায় নয়), তাদের সহাবস্থান সম্ভব নয় (যদিও শত শত বছর তারা একসঙ্গে থেকেছে)। দ্বিতীয়ত, বিদেশি শাসনমুক্ত ভারতে মুসলমান হিন্দুশাসনে থাকবে না, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সামাজিক কারণে তাদের জন্য ভিন্ন রাষ্ট্র চাই এবং তা ভারতভাগ করে। এ তথ্যগুলাে ইতিহাসবিদ সবাই উল্লেখ করেছেন, কিন্তু ব্যাখ্যা বিচারে কেউ কেউ তাতে ভিন্ন তাৎপর্য আরােপ করেছেন। কিন্তু জিন্না একথাও বলেছেন, ভারতীয় মুসলমান হিন্দুর দাসত্বে থাকবে না। | আয়েশা জালাল তার ‘দ্য সােল শােকসম্যান’ বইতে দাবি করেছেন যে লাহাের প্রস্তাব প্রকৃতপক্ষে জিন্নার জন্য ছিল ‘দেনদরবারের কাউন্টার’ এবং তা দেশবিভাগ বা পাকিস্তান আদায়ের জন্য নয়। কথাটা ২০০৫ সনেও হুসেইন  হাক্কানি একই সুরে বলেছেন তার বই ‘বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি’তে । কিন্তু ঘটনা ও তথ্য তাদের এ দাবি সমর্থন করে না। | জালালের অভিসন্দর্ভে উল্লিখিত মতামত মেনে নেয়া কঠিন। আগেই বলেছি। অনেক ঘটনা ও বক্তব্য এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই যায়। আসলে একালে অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ গ্রুপের সংশােধনবাদী গবেষকদের একাংশে জিন্নার রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ভিন্ন আদলে তুলে ধরার প্রবণতা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । এবং তা শুধু জিন্না প্রসঙ্গেই নয়, ভারতবিভাগের দায়দায়িত্ব নিয়েও বটে। সেক্ষেত্রে চেষ্টা মূল দায় কংগ্রেসের ওপর চাপাননা। ইতিহাস বিচারের এ ধারা পুনর্বিবেচনাবাদী। (রিভিশনিস্ট) হিসেবে চিহ্নিত  একে সংশােধনবাদীও বলা চলে। শুধু আয়েশা জালাল নন, একাধিক গবেষক এ ধারায় যুক্ত। যেমন অসীম রায়ের একটি আলােচনা সংশােধনবাদী প্রেক্ষাপটে ভারত বিভাগের শীর্ষ রাজনীতি’ (সম্পাদনা : মুশিরুল হাসান)। অসীম রায় পূর্বোক্ত প্রবন্ধে মাওলানা আজাদের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তাতে আজাদ নেহরুকে সতর্ক করেছিলেন এই বলে যে ভারতবিভাগে রাজি হলে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না এবং বিভাজনের দায় লীগের নয় কংগ্রেসের ওপরই পড়বে।

এখন অনেকের বিচার-ব্যাখ্যায় বিভাগের দায় সেদিকেই ঘুরতে শুরু করেছে। এমনকি তাতে দায়দায়িত্ব বিষয়ক নতুন কিছু শাখা-প্রশাখার উদ্ভব ঘটছে এবং সিদ্ধান্তগুলাে (পুনর্বিবেচনাবাদী ধারার) জিন্নার পক্ষে যাচ্ছে । যশবন্ত সিং-এর ঢাউস বইটাও ওই একই ধারার। তবে বিশেষ উদ্দেশ্য সেখানে পরিস্ফুট । সে উদ্দেশ্যটি রাজনৈতিক যা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিজেপির তাত্ত্বিক অবস্থান সুদৃঢ় করতে সহায়ক হতে পারে  আরাে স্পষ্টভাষায় ভারতভাগের দায়টা পুরােপুরি কংগ্রেসের ওপর চাপানাে গেলে অখণ্ড ও সনাতন ভারতপন্থীদের রাজনৈতিক প্রচারে সুবিধা হয়। আর একটি কথা, জিন্না কনফেডারেশন চাইলে মন্ত্রীমিশন প্রস্তাব বিনাশর্তে মেনে নিতেন। কারণ ওই প্রস্তাব কনফেডারেশন তুল্যই ছিল। কিন্তু জিন্না কনফেডারেশন চাননি, বরং লাগাতার পাকিস্তান দাবিই তুলে ধরেছেন। তাই জিন্না কনফেডারেশনে রাজি ছিলেন, এমন বক্তব্য ধােপে টেকে না। ইতিহাস পাঠকের জন্য ভারতবিভাগ, জিন্না ও কংগ্রেস’ বিষয়ক তাত্ত্বিক আলােচনা বেশ চিন্তাকর্ষক হয়ে দাঁড়িয়েছে এর ব্যাপকতা ও ধীমান। ইতিহাসবিদগণের তাতে অংশগ্রহণের কারণে। চরিত্র বিচারে এগুলােকে ‘বিভাজন সাহিত্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা মনে হয় অসঙ্গত হবে না। বর্তমান প্রবণতা হলাে বিভাজন বিতর্ককে দুই বিপরীত ধারায় বিন্যস্ত করা । একদিকে প্রচলিত ধারণা-ভিত্তিক ইতিহাস যা মূলত নব্যতাত্ত্বিকদের বিচারে রক্ষণশীল বা ঐতিহ্যবাদী ধারা, অন্যদিকে নব্য বিপরীত ধারাটিকে বলা হচ্ছে ‘রিভিশনিস্ট বা সংশােধনবাদী। সংশােধনবাদীদের বক্তব্যের ও সিদ্ধান্তের পক্ষে দাঁড়িয়ে অসীম রায় তার পূর্বোক্ত প্রবন্ধে চমক লাগানাে বাক্যবন্ধে যা বলেছেন সে বিষয়ের সঙ্গে একমত হওয়া কঠিন। তার ভাষায় ‘জিন্না ও কংগ্রেসের লড়াইয়ে দুই পক্ষই তারা যা চাননি প্রকাশ্যে সেটার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, এবং যা বলেছেন সেটা আসল কথা ছিল না।

প্রকৃতপক্ষে যা চেয়েছেন তা খােলামেলা বলেননি। বরং তাদের মৌল উদ্দেশ্যমূলক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও তৎপরতায় বিশ্বাস হননই করেছেন। তারা তাদের মূল উদ্দেশ্য গােপন রেখে ভিন্ন মূর্তিতে প্রকাশ্য লড়াই চালানাের কারণে ভারতবিভাগ বিষয়ক চিরাচরিত ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা আদপেই ঠিক নয়। এগুলাে নব্যতাত্ত্বিকদের পক্ষে বেশ চমক লাগানাে কথা। | চার-পাঁচ ছত্রের এই কথাগুলাের ব্যাখ্যায় নামলে বড় একটি প্রবন্ধ লেখা হয়ে যেতে পারে। তবে বিশদ ব্যাখ্যায় না গিয়েও এ বক্তব্যের মর্মোদ্ধার করা যায় এভাবে : কংগ্রেস মুখে অখণ্ড ভারত ও শক্তিশালী কেন্দ্র দাবি করেও ভারতবিভাগ চেয়েছে। অন্যদিকে জিন্না ভারতভাগের দাবি তুলেও পাকিস্তান চাননি। যে কথা বলেছেন আয়েশ জালাল ও আরাে দু-একজন। তাদের বক্তব্য : জিন্না ভারতীয় মুসলমানদের দাবি-দাওয়া আদায়ের রাজনৈতিক দরকষাকষির উদ্দেশ্য নিয়ে স্বতন্ত্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবি তুলেছিলেন। তিনি ভারত ভেঙে পাকিস্তান চাননি। | কিন্তু চমক লাগানাে এসব কথার ভিত্তি বড় নড়বড়ে। যুক্তিগুলাে অসংলগ্ন । জিন্নার রাজনৈতিক মানসিকতা এবং কংগ্রেসের ভারতমাতা ভাবমূর্তি ও শক্তিশালী কেন্দ্রভিত্তিক ফেডারেশনের পরিকল্পনা নিয়ে অনড় অবস্থান উভয় পক্ষেই যথাক্রমে তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের অঙ্গ হয়ে উঠেছিল এবং তা এমন ধর্মীয় অনড়তার চরিত্র অর্জন করেছিল সে সেখানে থেকে পেছন ফেরা যায় না। বিকল্প একটাই । সর্বনাশ দেখা দিলে বুদ্ধিমানের মতাে অর্ধেক ছেড়ে বাকি অর্ধেক রক্ষা করা । শাস্ত্রীয় প্রবচনে যা অর্ধেক এক্ষেত্রে তা কংগ্রেসের জন্য ভারতের বৃহত্তর অংশ বিশেষ এবং জিন্নার জন্য তা এক-দশমাংশ জনসংখ্যা ও আনুপাতিক ভূমিত্যাগ। উভয় পক্ষই ক্ষুব্ধ। ক্ষোভ নিয়েই তাদের সান্ত্বনা। যারা লক্ষ্য অর্জনের জন্য রক্তাক্ত পথে তৎপর হতে পারেন তারা কি সেই লক্ষ্য নিয়ে অভিনয় করতে পারেন? জিন্না বা গান্ধি নেহরু? মনে হয় না।  

সত্য বলতে কি নব্যতাত্ত্বিকদের জিন্নার দাবি বিষয়ক বক্তব্য ১৯১৬ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত শর্তসাপেক্ষে গ্রহণযােগ্য মনে করা গেলেও তিরিশের দশকের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে লন্ডন থেকে ভারতে ফিরে এসে মুসলিম লীগের হাল ধরা জিন্নার বক্তব্য ও পদক্ষেপ নয়া ব্যাখ্যার পক্ষে যথেষ্ট তথ্য ও যুক্তি জোগায় না। বরং ১৯৩৫-এ ব্রিটিশরাজের কমিউনাল অ্যাওয়ার্ডের সমপ্রদায়বাদী। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট জিন্নার পরবর্তী কার্যক্রম, বক্তব্য-বিবৃতি সবকিছুই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে দাঁড়ায়। দাঁড়ায় ভারতভাগের ও পাকিস্তান দাবির পক্ষে। জিন্না যে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক দাবি হিসেবে পাকিস্তান অর্থাৎ খণ্ডিত ভারতে স্বতন্ত্র মুসলিম বাসভূমির দাবিতে অটল ছিলেন তা যেমন ১৯৪০-এর লাহাের প্রস্তাবের আগে, তেমনি ওই প্রস্তাবের পরে এ সম্বন্ধে তার বক্তৃতা-বিবৃতিতে যথেষ্ট স্পষ্ট । তাতে ঘােরপ্যাচ নেই। ‘পাকিস্তান’ শব্দটি লাহাের প্রস্তাবে ব্যবহৃত হলেও পশ্চিম ও পূর্ব সীমান্তবর্তী অঞ্চলে স্বতন্ত্র মুসলিম ভূখণ্ড তাে। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানই, নামে কী আসে-যায় । স্বতন্ত্র মুসলমান রাষ্ট্রগঠনে জিন্নার ভূমিকা যে কতটা অনড় ও গভীর ছিল তা বােঝা যায় যখন তিনি বলেন, পাকিস্তান অর্জন তার এবং ভারতীয় মুসলমানদের জন্য জীবনমরণের প্রশ্ন এ ধরনের কথা দৃঢ়কণ্ঠে কড়া ভাষায় বহুবার বলেছেন জিন্না। এগুলাে কি কথার কথা বা ‘দেনদরবারের ভাষা? স্ট্যানলি উলপার্ট জিন্নার দার্দিাওয়া সম্বন্ধে নমনীয় হয়েও লিখেছেন : ‘পাকিস্তান দিবসের বাণীতে জিন্না আবিষ্কার করেন চক্রান্ত, ক্ষমতা নিয়ে খেলা এবং এসব থেকে উত্তরণের পথ ঐক্য ও আল্লাহর ওপর বিশ্বাস’ (পৃ. ২৪)। সেই সঙ্গে তার দৃঢ় ঘােষণা : দশ কোটি মুসলমান একত্র হলে পাকিস্তান আসবেই ইনশাল্লাহ আমরা জয়ী হব’ (পৃ. ২৪১)।

এসব কথার তাৎপর্য নিয়ে ভুল ব্যাখ্যার সুযােগ নেই। আমরা জানি ভাষার যেমন আছে বহুমুখী রূপে উপস্থাপনার জাদু, তেমনি আছে। প্রচণ্ড উদ্দীপক শক্তি। তার দৈহিক শক্তির বাহ্য ভঙ্গি (বডি ল্যাঙ্গুয়েজ) থেকে কোনাে দাবির গভীরতা বা গৌণতা বুঝে নিতে পারা যায়। পাকিস্তান সম্বন্ধে জিন্নার বক্তব্য উপস্থাপন ও ভাষা ব্যবহার মনােযােগী পাঠককে বুঝতে সাহায্য করে যে, ভারত বিভাগভিত্তিক স্বতন্ত্র মুসলমান ভুবন গঠনে জিন্না কতকটা দৃঢ়পণ ছিলেন- বলা যায় চরমপন্থী । আর এই দৃঢ়তা ও অনমনীয় আকাক্ষার   কারণেই পাকিস্তান অর্জন তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। অবশ্য ওই ধাতব ইচ্ছার সঙ্গে সাফল্যের পথে যুক্ত হয়েছিল জিন্না নামক তীক্ষ্ণবুদ্ধি আইনজীবীর দক্ষ পদক্ষেপ। লাহাের প্রস্তাবে ‘পাকিস্তান’ বিষয়ক অস্পষ্টতা (হডসন) সত্ত্বেও দাবির মূলনীতিতে কোনাে অস্পষ্টতা ছিল না, ছিল তা বাস্তবায়নের পদ্ধতিতে। মূল দাবি স্পষ্টই ছিল বিভক্ত ভারতে স্বতন্ত্র মুসলমান আবাসস্থল বা রাষ্ট্র। এর। পেছনে বহুকথিত বক্তব্য- “হিন্দু মুসলমান দুই ভিন্ন জাতি- এক কথায় তারা সব কিছুতে ভিন্ন- কাজেই সহাবস্থান অসম্ভব। যদিও ইতিহাস এক্ষেত্রে ভিন্ন কথা বলে। লাহাের প্রস্তাবে অস্পষ্টতা থাকলেও অধিবেশনের (১৯৪০ মার্চ) সভাপতি হিসেবে জিন্নার দীর্ঘ ভাষণ মােটেই অস্পষ্ট ছিল না। তার সাম্প্রদায়িক তত্ত্ব (দ্বিজাতিতত্ত্ব), স্বতন্ত্র নির্বাচন, হিন্দু-মুসলমানের ভিন্নতা, কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদিতা, ভারতীয় মুসলমানের ধর্মীয় ঐতিহ্য ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যধারণ ইত্যাদি বিষয় রাজনৈতিক কৌশলে ধরা হয়। যে জন্য তার বক্তৃতার বিশেষ অংশের লাখ লাখ কপি ভারতীয় মুসলমানের হাতে পৌছায়। সে লিফলেট সাম্প্রদায়িক বিরূপতা তৈরিতে সাহায্য করে। কথাগুলাে এর আগেও বলা হয়েছে। এখন প্রয়ােজনে পুনরাবৃত্তি।

এসব কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য কি কথার কথার প্রতিফলন? মুশিরুল হাসান তাই সঙ্গত যুক্তিতেই বলেন যে, জিন্না, লাহােরে লড়াইয়ের হাঁক (war cry) দিয়েছেন- যে লাহােরের রয়েছে, সাংস্কৃতিক সমম্বয় ও সংহতির গৌরবময় ইতিহাস। বহুজাতিক রাষ্ট্রের সমম্বয়বাদী যে তত্ত্বের বাস্তবতা সম্পর্কে হাকিম আজমল খান, এমএ আনসারি, মাওলানা আজাদ প্রমুখ সেকুল্যার রাজনীতিবিদ তুলে ধরেছিলেন জিন্না তা নস্যাৎ করে দিয়ে বলেন যে, হিন্দু-মুসলমানের একক রাষ্ট্রিক জাতীয়তা নেহাতই একটি স্বপ্ন।’ এই বক্তব্যের সমর্থনে আরাে অনেক কথা বলেছেন তিনি। জিন্না যদি আন্তরিকভাবে পাকিস্তান না চাইবেন, লাহাের প্রস্তাব যদি ক্ষমতার অংশীদারিত্ব নিয়ে দরকষাকষির প্রস্তাবই হয়ে থাকে তা হলে তিনি যুদ্ধংদেহী’ ঘােষণায় স্বতন্ত্র মুসলমান রাষ্ট্রের পক্ষে সাম্প্রদায়িক শ্লোগান তুলতেন না যা জনমানসে বিরূপ সাম্প্রদায়িক প্রভাব বিস্তার করেছিল। যা পরে রক্তক্ষয়ী সহিংসতায় পরিণত । অথচ একই সময়ে (১৯৪০) মাওলানা আজাদ রামগড়। কংগ্রেসের বক্তৃতায় বহুজাতি-বহুভাষা-বহুধর্মী ভারতীয় নাগরিকের জন্য গ্রহণযােগ্য সমন্বয়বাদী ব্যবস্থার পক্ষে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তথ্য ও যুক্তি তুলে ধরছিলেন ইতিহাস-ঐতিহ্য উদ্ধার করে। জিন্না সেসবের বিরােধিতাই করেছেন। 

মানবমনে বা জনমনে হয়তাে গড়ার চেয়ে ভাঙনের টানের প্রতি আকর্ষণ থাকে বেশি। এই সহজাত সত্য সম্ভবত ভারতীয় মুসলিম নেতৃত্বের মনকে প্রভাবিত করে থাকবে। বাস্তবে তা করেছে লাহাের প্রস্তাবে এবং লাহাের প্রস্তাবে ধৃত দ্বিজাতিতত্ত্বের পক্ষে জিন্নার তাৎক্ষণিক ও ক্রমাগত বক্তব্য উপস্থাপন এবং ক্রমাগত বিচার-ব্যাখ্যায় । সহাবস্থান ও শান্তির ললিত বাণী’ সেখানে বাস্তবিকই ‘ব্যর্থ পরিহাস’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মুশিরুল হাসানের ভাষায় ‘এসব বক্তব্যমন্তব্য ছিল অশুভ সঙ্কেত’ ও তেমনই বার্তাবাহী যদিচ তখনাে তা অখণ্ড ভারতের বিরুদ্ধে জিহাদে পরিপূর্ণ শক্তি অর্জন করে উঠতে পারেনি। কিন্তু অপ্রিয় সত্য হলাে কংগ্রেস সে পরিস্থিতির তথা তৎকালীন পরিস্থিতি বা দুর্বলতার রাজনৈতিক সুযােগ গ্রহণ করতে পারেনি। | মুসলিম শিক্ষিত জনসংখ্যা ও ভূস্বামী পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তপ্রদেশের কথাই যদি ধরা যায় (যেখান থেকে লিয়াকত-খালিকুজ্জামানদের মতাে লীগ নেতৃত্বের উদ্ভব) সেখানে ১৯৩৬ সালেও মুসলিম লীগের পক্ষে সমর্থন খুব জোরালাে ছিল না। প্রদেশের গভর্নর হারি হেইগ ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত ভাইসরয়ের কাছে যেসব গােপন বার্তা পাঠিয়েছেন তাতে দেখা যায় সেখানকার উচ্চবিত্ত শ্রেণি, বিশেষ করে ভূস্বামী বাদে সাধারণ শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ কমই ছিল। হয়তাে তাই ১৯৪০-এ লাহাের প্রস্তাব ও জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বের সাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণা সংবলিত উগ্র বক্তব্যের ইশতেহারের বিশেষটার্গেট ছিল যুক্তপ্রদেশ। এখানে আবারাে বলতে হয় কংগ্রেস মুসলমানমানস জয়ে এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণে অনেকটা উদাসীনতাই দেখিয়েছে। যুক্তপ্রদেশে লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠনে অস্বীকৃতি জানিয়ে কংগ্রেস এবং নেহরু পর্বতপ্রমাণ ভুল করেছিলেন। এ অভিমত সব বিশ্লেষকের। মুসলমানপ্রধান বঙ্গ-পাঞ্জাবের পর রাজনৈতিক বিচারে যুক্তপ্রদেশের গুরুত্ব ছিল অনস্বীকার্য। লীগের লাহাের অধিবেশনে দ্বিজাতিতত্ত্বের সমর্থনে জিন্না যখন বলেন : “এটা একটা স্বপ্ন যে হিন্দু-মুসলমান মিলে কোনােদিন একটি সমন্বিত জাতীয়তা তৈরি করতে পারবে, এটা ভুল ধারণা তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে, জিন্না মনেপ্রাণে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র ভুবন চাইছেন। স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থান অসম্ভব। এমনকি এ কথাও বলেছেন, দুটি জাতিকে একক রাষ্ট্রের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করা হলে- যেখানে একটি জাতি সংখ্যাগরিষ্ঠ অপরটি সংখ্যালঘু, সেখানে অসন্তোষ দেখা দিতে বাধ্য এবং অবশেষ পরিণামে তা ধ্বংস হতে বাধ্য। 

তিনি আরাে বলেন, ‘ভারত যুগ যুগ ধরে হিন্দু ভারত ও মুসলমান ভারত হিসেবে বিভাজিত ছিল। তার মতে, বর্তমান ঐক্য ব্রিটিশ শাসনের কারণে ঘটেছে। এখানে জিন্না কৌশলগত বক্তব্য পেশ করেছেন ভূখণ্ড ও জাতিকে সমরূপী হিসেবে উপস্থিত করে। মুঘল শাসনে বিশাল ভারত ঐক্যবদ্ধভাবে থাকা সত্ত্বেও ছােট স্বাধীন রাজ্যের অস্তিত্বও ছিল। কিন্তু সেখানে মূল দ্বন্দ্ব তখন ভূখণ্ডের অধিকার নিয়ে, হিন্দু-মুসলমান নিয়ে নয়, যা জিন্না ভিন্নভাবে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে বারবার উল্লেখ করেছেন। মুঘল ভারতে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাস করেছে সাধারণ সমঝােতা ও শান্তি নিয়ে । এটা ঐতিহাসিক সত্য । | দ্বিতীয়ত একাধিক রাজ্যের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা নিয়ে বিচ্ছিন্ন থাকার বিষয়টা সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ছিল না। হিন্দুরাজ্য যেমন মুঘল শাসন থেকে। স্বাধীন রাজ্য হিসেবে বিচ্ছিন্ন থাকতে চেয়েছে, তেমনি একাধিক মুসলমান শাসনকর্তাও মুসলিম-দিল্লির শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে থাকতে চেয়েছে। এজন্য বলা যায়, বহুজাতিক ও বহুভাষিক উপমহাদেশে স্বাতন্ত্রের ভিত্তিটা তখন ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক চরিত্রের ছিল না। ছিল ক্ষমতার লড়াই এবং তা মূলত রাজ্য ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক এদিক থেকে আধুনিক গণতান্ত্রিক যুগে পৌছে পূর্ব-ইতিহাসের নজির তুলে বিচ্ছিন্ন মুসলমান রাষ্ট্র গড়ার যুক্তি তাই ধােপে টেকে না। সে   সমন্বিত সহাবস্থানে জিন্ন গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। আসলে ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রচার করে জিন্নাই গৃহযুদ্ধের ভাবনা মাথায় রেখে এগিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৬-৪৭-এ মহাসাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নীতি গ্রহণ করে গৃহযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করেছিলেন এবং যুক্তভারতে দেনদরবার নয়, গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে ভারতভাগ ও পাকিস্তান গঠন করে তার ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন। এ সত্য অস্বীকারের উপায় নেই। লাহাের প্রস্তাব, হিন্দু-মুসলমান ঘিরে দ্বিজাতিতত্ত্ব ও ভারতবিভাগ শুধু জিন্নারই রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল না, ছিল ভারতীয় শাসক ব্রিটিশরাজেরও। তাদের ‘ভাগ কর শাসন কর’ নীতি ওই বিভাজনের প্রেক্ষাপট এবং ১৯৩৫-এর সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ ওই দ্বিভাজিত রাজনীতির বীজতলা যা স্বতন্ত্র নির্বাচনের মাধ্যমে ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করেছে। অবশেষে তা সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও হত্যাযজ্ঞের বিষবৃক্ষে পরিণত হয়। 

ইতিহাস পাঠকের অবাক হওয়ার কথা যে লাহাের প্রস্তাব শাসকরাজের তাৎক্ষণিক সমর্থন পেয়েছিল (মুশিরুল হাসান)। কিন্তু ইতিহাসের মনােযােগী পাঠকের জন্য তা বিস্ময়কর নয়। ইতিহাসবিদ সবার একই বক্তব্য ওই ‘ভাগ কর শাসন কর’ নীতি সম্পর্কে । এটা তারই ধারাবাহিকতা। লাহাের প্রস্তাবের রচয়িতা কে এবং এর পেছনে কোন্ শক্তি কাজ করেছে এসব তথ্য ইতিহাসে স্পষ্টই ধরা আছে। আছে জাফরুল্লাহ খান ও ব্রিটিশরাজতন্ত্রের সংশ্লিষ্টতা । ওয়ালি খানের দেশবিভাগ বিষয়ক গ্রন্থে (ফ্যাক্টস আর ফ্যাক্টস) তা বিশদভাবে তথ্যসহকারে লিপিবদ্ধ। এমনকি ‘সােল স্পােকসম্যান’ রচয়িতা আয়েশা জালালের বক্তব্যেও দেখা যায় যে, লাহাের প্রস্তাবের সময়ক্ষণ ব্রিটিশরাজের প্রয়ােজনমাফিক নির্ধারিত হয় এবং তা জরুরি হয়ে ওঠে কংগ্রেসের দাবি-দাওয়া ও আন্দোলনের কারণে’ (পৃ. ৬০)। অর্থাৎ কংগ্রেসের রাজ-বিরােধিতা, স্বাধীনতার দাবি ইত্যাদি কারণে ব্ৰিত, বিরক্ত, অসন্তুষ্ট ব্রিটিশ শাসককে জিন্নার সাহায্য নিতে হয় । মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র বিষয়ক লাহাের প্রস্তাব ব্রিটিশরাজের জন্য রাজনৈতিক স্বস্তির প্রস্তাবও বটে। শুধু সময়ক্ষণ নির্ধারণই নয় ইতিহাসেরূতথ্য আরাে বলে, গােটা প্রস্তাবটাই ব্রিটিশ স্বার্থ-প্রণােদিত ও ব্রিটিশ পরিকল্পনাপ্রসূত। উদ্দেশ্য ক্রমাগত স্বাধীনতার দাবি তােলা সংগঠন কংগ্রেসকে একহাত নেয়া । ঠিক যেমনটি দেখা গেছে। বঙ্গভঙ্গবিরােধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ দাঁড় করাতে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠনে ‘রাজ’-এর সহায়তাদানে। হিন্দু-মুসলমান সামপ্রদায়িক দাঙ্গায় শাসকশ্রেণির নির্বিকার নিক্রিয় ভূমিকাও তাদের শাসননীতির অংশ ছিল। বিভিন্ন ঘটনায় রাজ’ সরকারের পক্ষ থেকে লীগ ও জিন্নার প্রতি সমর্থনের প্রমাণ মেলে। পাঞ্জাবের সেকুলার রাজনৈতিক নেতা খিজির হায়াত খান ভাইসরয়কে পাকিস্তান সম্বন্ধে তাদের ধারণা স্পষ্ট করে জানাতে এবং অযৌক্তিক হলে সেটা বর্জন করতে আহ্বান জানান। কিন্তু ভাইসরয় এ বিষয়ে নির্বাক থাকাই যুক্তিযুক্ত মনে করেন। খিজিরের আপত্তি ছিল পাকিস্তান ধারণার সঙ্গে ধর্মীয় চেতনার সংশ্লিষ্টতায়।

একই ধারণা ছিল সিকান্দার হায়াতের, যা ইতিপূর্বে উল্লেখিত  এমনকি সিন্ধুর আল্লাবকশ একই কারণে সিন্ধুর গভর্নর সাহেবের বিরাগভাজন হন। ভাইরসয়দের ভূমিকা বরাবরই ছিল স্বতন্ত্র নির্বাচন ও পাকিস্তান প্রসঙ্গে জিন্নাকে সমর্থনের আয়েশা জালাল পাকিস্তান ও জিন্না সম্পর্কে হডসনের ইতিবাচক মতামতের কথা উল্লেখ করেছেন ঠিকই, কিন্তু হডসনই আবার তুলে ধরেছেন বিপরীত   মন্তব্য । তার মতে, কংগ্রেস যতই সহযােগিতার বক্তব্য উপস্থিত করেছে মুসলিম লীগ (জিন্না) ততই বিপরীত শর্তাদি তুলে ধরেছে এবং ১৯৪১ সালে লীগের মাদ্রাজ অধিবেশনে লাহাের প্রস্তাব শুধু অনুমােদিত হয়নি মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্রে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এমনকি জিন্নার আবারাে যুক্তিহীন দাবি। ভাইসরয়ের কাছে যে কেন্দ্রে মুসলমান প্রতিনিধিত্ব হবে হিন্দুদের সমান, তার ভাষায় পঞ্চাশ-পঞ্চাশ। জনসংখ্যা বিচারে যে দাবি একেবারেই যুক্তিহীন। সংশােধনপন্থীরা (রিভিশনিস্টগণ)ও বলেন, জিন্নার পাকিস্তান দাবি ছিল ক্ষমতার অংশীদার হতে দরকষাকষি । কিন্তু কী দাবি ছিল তার, কী নিয়ে দরকষাকষি? শুধু প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনই নয়- কেন্দ্রে সমান সমান আসন, এমনকি তার ক্ষুব্ধ বক্তব্য- ‘গান্ধির তিন ভােট, আর আমার একটি ‘(১৯৪০)। ভুলে গেলে চলবে কেন যে, ভারতে মুসলমান মােট জনসংখ্যার একতৃতীয়াংশেরও কম? আসলে জিন্না চেয়েছিলেন অবাস্তব নানা দাবি তুলে সব রকম সমাধানের রাস্তা বন্ধ করে দিতে, যাতে শেষ পর্যন্ত চরমপন্থায় (সহিংসতায়) পাকিস্তান অর্জন সম্ভব হয়। | এটা ঠিক যে, মুসলিম লীগের শীর্ষনেতাকে কেউ কেউ (যারা হিন্দুপ্রধান প্রদেশের ভূস্বামী বা উচ্চবর্গীয় বাসিন্দা), ভারতবিভাগের বদলে মুসলিম স্বার্থ রক্ষা করে কোনােরকম সর্বভারতীয় সমাধান চেয়েছিলেন। এর কারণ শুধু ভূখণ্ডের টানই নয়, কারণ তাদের আর্থ-সামাজিক স্বার্থ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি রক্ষা, যেজন্য তারা ছিন্নমূল হতে চাননি। যেমন বােম্বাই প্রদেশের বিশিষ্ট লীগনেতা আইআই চুন্দ্রীগড় যিনি বােম্বাই ছেড়ে চলে যেতে চাননি। যুক্তপ্রদেশের খালিকুজ্জামানেরও প্রথম দিকে কিছুটা তেমন প্রবণতা ছিল। নেহরুর সঙ্গে এক পর্যায়ে যথেষ্ট ভালাে সম্পর্ক ছিল তার। ঠিক যেমন মাহমুদাবাদের নবাব যিনি প্রথম দিকে কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। ছিলেন। এদের সঙ্গে নেহরু পরিবারের (বিশেষ করে মােতিলাল নেহরুর) ছিল গভীর সৌহার্দ্য। জিন্নার সে সমস্যা ছিল না। কাথিওয়াড় থেকে করাচির সঙ্গে তার জন্মসূত্রের সম্পর্ক। সেখানে তিনি স্ট্রেঞ্জার’ বা অচেনা অতিথি নন। তাছাড়া তিনি মুসলিম লীগের সর্বাধিনায়ক । করাচি বাদেও সম্ভাব্য পাকিস্তানের সব স্থানই তার বাসস্থান, সব ঘরই তার ঘর- কায়েদে আজম’ বলে কথা।

‘পাকিস্তান ধারণা’ জিন্নার রাজনৈতিক চিন্তায় কতটা গভীরতা নিয়ে উপস্থিত ছিল, তাতে ধর্মীয় উপাদান কতটা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অন্তুর্ভুক্ত ছিল।  তার প্রমাণ মেলে ধর্মাচরণে উদাসীন জিন্না যখন লাহাের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেন : ‘জাতিতত্ত্বের যে কোনাে সংজ্ঞার বিচারে মুসলমান একটি জাতি। তাদের নিজস্ব আবাসস্থল, নিজস্ব অঞ্চল এবং রাষ্ট্র থাকতে হবে, মুক্তস্বাধীন মানুষ হিসেবে বাঁচতে হবে’ তখন কি প্রশ্ন তােলা যায় যে, জিন্না পাকিস্তান চাননি। একদা প্যান-ইসলামিজমবিরােধী জিন্না রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে প্যান-ইসলামের পতাকাও উর্ধ্বে তুলে ধরেন। | চল্লিশ থেকে সাতচল্লিশের প্রথমার্ধ অবধি জিন্নাসহ মুসলিম লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা, এমনকি খালিকুজ্জামানও একের পর এক বক্তব্যে পাকিস্তান দাবির পক্ষে কথা বলতে থাকেন, বিকল্প কোনাে ব্যবস্থা সম্বন্ধে নয়। ফেব্রুয়ারি ১৯৪২-এ খালিকুজ্জামান বলেন যে, ব্রিটিশ শাসনমুক্ত ভারতে পাকিস্তানের চেয়ে কম কোনাে প্রস্তাব মুসলমানগণ মেনে নেবে না। আরাে একধাপ এগিয়ে তিনি বলেন, পাকিস্তানের জন্য দরকার হবে ব্রিটিশপুঁজি ও সহায়তা এবং তা নিজের পায়ের ওপর দাঁড়ানাের ক্ষমতা অর্জনের পূর্বপর্যন্ত’ (আর. জে. মুর, ‘জিন্না ও পাকিস্তান দাবিতে উদ্ধৃত)। | মুর মনে করেন, মিয়া বশীর আহমদের উগ্র বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রস্তাব জিন্নার লাহাের প্রস্তাবের পাকিস্তান ধারণার উৎস ভিন্নমতে তা ইকবাল। কিন্তু স্যার ইকবাল তাে ভারত বিভাগ চাননি- চেয়েছেন ভারতের পশ্চিম ভূখণ্ড-সীমানার মধ্যে মুসলমানদের স্বশাসিত আবাসস্থল। কিন্তু জিন্না ইকবাল প্রশস্তির সূত্রে তাদের দুজনের চিন্তার মিল উল্লেখ করে বলেন যে, নানা সাংবিধানিক জটিলতা তথা সমস্যার সমাধান হলাে পাকিস্তান (মুর, উদ্ধৃতি)।

তার বিচারে ভারতের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান মুসলমান জাতীয়তাবাদে (দ্বিজাতিতত্ত্ব) এবং বিচ্ছিন্নতাবাদে (পাকিস্তান দাবি)। একথা ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে জবাব। জিন্নার শিষ্যগণ সবাই তারস্বরে একই দাবি তুলে ধরতে থাকেন। চল্লিশ থেকে ১৯৪৪-এর মধ্যে রাজনৈতিক পারদের যথেষ্ট ওঠানামা, ১৯৪২-এ গান্ধির ইংরেজ ভারত ছাড় আন্দোলন’, সর্বোপরি বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব এসব বিচিত্র পরিস্থিতির সুযােগে শাসকদের সমর্থনপুষ্ট মুসলিম লীগ-প্রধান জিন্না সরকারের সুনজরে আসেন। সে সময়ও (ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪) তার জোরালাে দাবি ভাইসরয়ের কাছে, ব্রিটিশরাজের কাছে, যাতে ভারত বিভাগের মাধ্যমে দুটো সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করা হয়। পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান যথাক্রমে ভারতীয় মুসলমান ও অমুসলমানদের জন্য (দ্র. জিন্নার বক্তৃতা ও রচনাবলী)।  এ জাতীয় অনড় অবস্থান, বিশেষ করে দ্বিপাক্ষিক বা ত্রিপক্ষীয় সংলাপের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনাদি একটি সত্যই প্রমাণ করে যে, জিন্না সত্যই মনেপ্রাণে   পাকিস্তান চেয়েছেন। সময় যত গড়িয়েছে, তার এ অবস্থান ক্রমে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৪৫ থেকে, যখন নানা ঘটনায় এটা স্পষ্ট যে, বিদেশি শাসক ভারত ছেড়ে যেতে ইচ্ছুক, অবশ্য তার প্রভাব যতটা সম্ভব রেখে । শ্রমিক দল ব্রিটেনে ক্ষমতায় আসার (জুলাই, ১৯৪৫) পর ব্রিটিশ নীতির এ পরিবর্তন। অবস্থাদৃষ্টে জিন্নাও পাকিস্তান দাবি আদায়ে অনড় অবস্থান গ্রহণ করেন। যেমন গান্ধি ও কংগ্রেস বা মধ্যপন্থীদের সঙ্গে দেনদরবারে বা সংলাপে তেমনি শাসকরাজের সঙ্গে আলােচনায় বা দাবি পেশ করার ক্ষেত্রে। তিনি যে পাকিস্তান দাবিতে কতটা অনড় ছিলেন এবং তা শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা আদায়ের উপলক্ষ (জালাল কথিত দরকষাকষি’) হিসেবে থলিতে রাখেননি তা বােঝা যায় মধ্যপন্থী সাঞ্জ (তেজবাহাদুর সাপ্র) কমিটির প্রস্তাবের মতাে একাধিক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের ঘটনায়।

সাড়ে সাত বছর তার ভারত শাসনের মেয়াদ শেষ করে ১৯৪৩-এর অক্টোবর ভাইসরয় লিনলিথগাে যখন লন্ডনে ফিরে যান (হডসনের ভাষায় ‘হতাশা নিয়ে’) তখন তার কৃতিত্ব ভারতীয় রাজনীতিতে আগের তুলনায় অনেক বেশি দ্বন্দ্ব, বিরূপতায় তিক্ত বিভাজন ঘটানােয় একই সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতাকে অধিকতর কঠোর অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব অবশ্যই তার । কথাটা। পরােক্ষে স্বীকার করেছেন হডসন। অবশ্য তিনি তার শাসন দক্ষতার অনেক প্রশংসাও করেছেন তার বইতে। সবাইকে অবাক করে লিনলিথগাের পদে এলেন এক সেনানায়ক (ফিল্ড মার্শাল লর্ড ওয়াভেল) রাজনীতি সম্বন্ধে যার বিশেষ কোনাে অভিজ্ঞতা ছিল না। ভালাে যােদ্ধা হলেই কি ভালাে রাজনীতিজ্ঞ হওয়া যায়, এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। এ প্রশ্ন হডসনও করেছেন চমকপ্রদ তুলনামূলক মন্তব্যে যে, ‘লর্ড লিনলিথগাে’র ভাইসরয়ী শাসন যদি নেতিবাচকতায় শেষ হয়ে থাকে তাহলে ওয়াভেলের শাসন শেষ হয়েছে হতাশার মধ্যে’ (পৃ. ১১১)। যথারীতি কংগ্রেসের প্রতি কঠোর নীতি অবলম্বন করেই ওয়াভেলের শাসনকার্য পরিচালনা শুরু। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা পূর্বপ্রসঙ্গ ‘জিন্না-পাকিস্তান’ পর্যালােচনায় ফিরে দেখতে পাই ১৯৪৪-এর গােটা বছরটা এবং পরবর্তী বছরের প্রথমার্ধ কংগ্রেস-লীগ সমঝােতার প্রস্তাবগুলাে জিন্না একের পর এক প্রত্যাখ্যান করে চলেছেন।

রাজাগােপালাচারির প্রস্তাব তার ভাষায় ‘ছায়া, ফলের খােসা এবং ভাঙাচোরা, পােকায় খাওয়া (মহ্ ইট) পাকিস্তান’। কথাটা বহুজনউদ্ধৃত। আর ১৯৪৪-এর সেপ্টেম্বরে জিন্নার সঙ্গে গান্ধির সাক্ষাৎ ও আলােচনা যে  ব্যর্থ হবে এটা অনেকেরই ধারণায় ছিল। বাস্তবে তাই ঘটে। যে গান্ধিকে জিন্না  শত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন তার সঙ্গে দেনদরবার কি কখনাে ফলপ্রসূ হতে পারে? স্বভাবত ভাইসরয় ওয়াভেল হতাশ, অসন্তুষ্টও বটে। গণপরিষদ গঠন। বিষয়ক তার প্রস্তাবও থােপে টেকেনি, খােদ ভারত সচিবের কাছেও এবার ওয়াভেল-আমেরি দ্বন্দ্ব, তারা বিপাকে ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ভারত ছেড়ে আসতে চেয়ে নানা জালে, অনেকটা মাকড়সার জালের আঠায় আটকে পড়ার মতাে অবস্থা তাদের।ভারতীয় রাজনীতির এ জটিলতা অবশ্য কড়ায়-গণ্ডায় এমনভাবে মিটিয়ে দেন পরবর্তী ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন, যা চিরকালের মতাে স্মরণযােগ্য। তার হাত দিয়ে জন্ম নেয় চিরশত্রু বা চিরবৈরী দুই ভূখণ্ড, ভারত ও পাকিস্তান। গত ৬৫ বছর ধরে এ শতা চলছে। চলবে দীর্ঘ সময় ধরে, যতদিন না প্রদেশগুলাে তাদের স্বাধীন সত্তা অর্জন করতে পারে। উপমহাদেশীয় রাজনীতির কী মহিমা প্রায় দুশ বছরের ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবে। কাজেই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী লীগ-কংগ্রেসকে মেলাতে কী ওয়াভেল পরিকল্পনা, কী। আমেরি ভাবনা সব ভেস্তে যায়। এমনকি প্রত্যাখ্যাত হয় সাঞ্জ কমিটির প্রস্তাব। এ প্রস্তাবে মূল সুপারিশ ছিল : কেন্দ্রে জাতীয় সরকার গঠন, তফসিলি হিন্দুগণ বাদে হিন্দু-মুসলমান আসন সমতা- সাংবিধানিক পরিষদে ও কেন্দ্রে এবং তা। যৌথ নির্বাচনের ভিত্তিতে অখণ্ড ভারতে এর মূল গুরুত্ব দুটো বিষয়ে এক, অখণ্ড ভারতে যুক্ত নির্বাচন ও লীগ-কংগ্রেসের সংখ্যাসাম্য, যে সমতার জন্য জিন্না বরাবর জোরালাে দাবি জানিয়ে আসছিলেন, যা জনসংখ্যা বিচারে অযৌক্তিকই ছিল । তবু প্রত্যাখ্যান। এর অর্থ জিন্না পাকিস্তানের বিকল্প কোনাে কিছু মানতে চাননি, চাওয়া তত দূরের কথা।

প্রত্যাখ্যানের মূল কারণ যৌথ নির্বাচন ও অখণ্ড ভারত। তাছাড়া পাকিস্তান প্রস্তাব অর্থাৎ ভারতবিভাগ ওই সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত না থাকা। অথচ এক সময় এই জিন্নাই সংখ্যাসাম্যে যৌথ নির্বাচনের পক্ষে ছিলেন। এখন ১৯৪৫-এ পৌছে যখন দেখা যাচ্ছে মুসলিম লীগ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে মুসলমান জনসমর্থনে, তখন পাকিস্তান বাদে কোনাে প্রস্তাবই জিন্নার কাছে গ্রহণযােগ্য হতে পারে না। এরপরও কি বলা যাবে জিন্না পাকিস্তান চাননি। তিনি অখণ্ড ভারতে মুসলমানদের পক্ষে সম্মানজনক ক্ষমতার অংশীদারিত্ব চেয়েছিলেন? কোনাে সমঝোতা প্রস্তাবেই জিন্নার ভূমিকা এ তত্ত্ব সমর্থন করে না।  এই বিশেষ রাজনৈতিক বিচারে ১৯৪৫-৪৬ বছর দুটো ছিল ভারতবিভাগের পরিণাম নির্ধারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সময়। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, সাঞ্জ কমিটির সুপারিশ হিন্দুত্ববাদীরাও সমর্থন করেনি। করেনি ওই হিন্দু-মুসলমান সংখ্যাসাম্যের কারণে। জিন্না যদি সত্যই অখণ্ড ভারতের পক্ষে আন্তরিক হতেন   তাহলে তার বহুকথিত সংখ্যাসাম্যের সুবিধা নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিজয় অর্জন করতে পারতেন। কিন্তু পাকিস্তান পরিকল্পনা তাকে এতটা অভিভূত করে রেখেছিল যে, ওই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এর অন্তত একটা বড় কারণ (যা প্রসঙ্গান্তরে হয়তাে একাধিকবার বলা হয়েছে) ভারত ভেঙে গান্ধি-নেহরুর ওপর প্রতিশােধ নেয়া, তার প্রতি কংগ্রেস মঞ্চের অবহেলা, তার নিজের হিসেবে যা অবমাননা, তা কড়ায়-গণ্ডায় মিটিয়ে দেয়া। এ পরিস্থিতির সৃষ্টি গান্ধি-জিন্না-রাজ- এই ত্রিভুজ ঘিরে । জয়-পরাজয়ের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছেড়ে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে গান্ধি-নেহরু-আজাদ প্রমুখের সঙ্গে ক্ষমতার অংশগ্রহণ জিন্নার পক্ষে কোনােক্রমেই সম্ভব ছিল না। তাতে ভারত রসাতলে যাক, ক্ষতি নেই। পােকায় খাওয়া পাকিস্তান নিয়েই তার আত্মতৃপ্তি। অন্তত অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন তাে ভেঙে দেয়া গেল ।

জানুয়ারি ১৯৪৫-এ আবারাে সমঝােতার চেষ্টা। যেটা কংগ্রেস নেতা ভুলাভাই দেশাই এবং লীগনেতা লিয়াকত আলী খানের উদ্যোগে যা ‘ দেশাইলিয়াকত চুক্তি’ নামে পরিচিত। তাতে ভাইসরয় ওয়াভেলেরও সম্মতি ছিল। বােম্বাই গভর্নর এ বিষয়ে ভাইসরয়ের প্রতিনিধি হিসেবে জিন্নার মতামত যাচাই করতে গেলে জিন্না বলেন- এ সম্বন্ধে তিনি কিছুই জানেন না (হডসন)। এটা কি সম্ভব যে, জিন্নার মতাে একনায়কলীগপ্রধানের অজ্ঞাতে লিয়াকত আলী খান দেশাইয়ের সঙ্গে একটা সমঝােতা পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলবেন? এমন সাহস কোনাে লীগ নেতার ছিল না। ওয়াভেল হতাশ।  ছমাস পর (১৯৪৫) জুন মাসে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রাজনৈতিক সমঝােতার উদ্দেশ্যে সিমলা কনফারেন্সের আয়ােজন। মূলত ভাইসরয় ওয়াভেলের চেষ্টায় । এখানেও মতভেদ। সংখ্যাসমতা বিষয়ক ছাড় দেয়া সত্ত্বেও মুসলমান প্রতিনিধিত্ব (সােল স্পােকসম্যান) নিয়ে দ্বন্দ্ব। কংগ্রেসী মুসলমান, এমনকি কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আজাদকেও মানতে নারাজ জিন্না। এ ধরনের মতামত গণতন্ত্রের কোন্ বিধিসম্মত সেটা সংশােধনবাদী লেখকগণ। ভেবে দেখেছেন বলে মনে হয় না। এ তাে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অস্বীকার- অর্থাৎ সব মুসলমানকেই ইচ্ছায় হােক অনিচ্ছায় হােক মুসলিম লীগকে সমর্থন করতে হবে- অন্য কোনাে দলে যােগ দেয়া চলবে না। এ কোন্ দেশি জবরদস্তি? কিন্তু জিন্না তা করেছেন। কারণ তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নন- এটা তার নিজেরই কথা ।

সবচেয়ে গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি হয় যখন জিন্না তার বক্তৃতায় দাবি করেন যে, পাকিস্তান ব্যতিরেকে কোনাে সংবিধান মুসলিম লীগ মেনে নেবে না। লীগ  যে কোনাে প্রকার সাধারণ কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের বিরােধী(হডসন)। লীগকংগ্রেসের বিপরীত অবস্থান ভারতীয় রাজনীতিতে সঙ্কট সৃষ্টি করে। লীগের ভারতবিভাগ (পাকিস্তান) ও কংগ্রেসের অখণ্ড ভারত অনেকটা দুই মেরুতে অবস্থানের মতাে হয়ে ওঠে। হিন্দু-মুসলমান সংখ্যানুপাত সত্ত্বেও সমস্যা তৈরি হয় জিন্নার অনড় দাবিতে যে, সব কজন মুসলমান সদস্য লীগ সংগঠন থেকে নিতে হবে। কারণ তার মতে তিনি ও মুসলিম লীগ ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি। কিন্তু তখনাে জিন্না এবং মুসলিম লীগ সমগ্র ভারতীয় মুসলমানের একমাত্র মুখপাত্র নয়; সংখ্যাগরিষ্ঠ বৃহৎ অংশের প্রতিনিধি। সেক্ষেত্রে সব মুসলমান প্রতিনিধিকে লীগ থেকে নেয়ার দাবি যুক্তিতে টেকে না। তার ওই উদ্ভট দাবির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সীমান্তের সেকুলার নেতা ডা. খান সাহেব বলেন যে, কংগ্রেস একমাত্র হিন্দুদের সংগঠন নয় । এ কথা বলার কারণ কংগ্রেসে তখনাে বেশ কিছু সংখ্যক মুসলমান নেতা রয়েছেন। তাদের অনুসারী বা সমর্থকদের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। বঙ্গদেশের বাইরে পশ্চিমের প্রদেশগুলােতে নির্বাচনী জরিপই তেমন প্রমাণ দেয়। দেয় ভােটার সংখ্যায়, যা মুশিরুল হাসান উল্লেখ করেছেন।

তাহলে কেন জিন্নার অযৌক্তিক জেদ মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি হওয়ার? কারণ একটাই। সব সমঝোতা প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দেয়া। তার মর্জিমাফিক অর্জন নিশ্চিত করা। ইর্ডসনের ভাষায় : কংগ্রেসের দাবি স্বাধীনতা আর জিন্নার দাবি পাকিস্তান’* একটু ঘুরিয়ে বলতে গেলে কংগ্রেসের দাবি অখণ্ড, অবিভক্ত স্বাধীন ভারত আর জিন্নার দাবি বিভক্ত ভারতের পটভূমিতে স্বাধীন পাকিস্তান। এ দুই বিপরীত বিন্দুর মিলন কিছুতেই সম্ভব নয় । যথারীতি ওয়াভেলের চেষ্টা ব্যর্থ, ব্যর্থ সিমলা সম্মেলন। ওয়াভেল পরিকল্পনাও বাতিল । সৈনিক-ভাইসরয় মহাবিরক্ত। | জিন্না যে ভারতীয় ফেডারেশনে সম্মানজনক অবস্থানের পরিবর্তে স্বতন্ত্র মুসলিম আবাসস্থল পাকিস্তানের দাবিতে অনড় ছিলেন তার প্রমাণ তিনি পদে পদে রেখেছেন। তার বক্তব্য বরাবর কংগ্রেস পরিপ্রেক্ষিতে ঐক্য-বিরােধী, বলা যায় বিচ্ছিন্নতাবাদী। সিমলা সম্মেলনের সময়ও তার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা স্বতন্ত্র পাকিস্তানের পক্ষেই যায়। বিশেষ করে তিনি যখন বলেন : লীগ ও কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাকিস্তান ও অখণ্ড ভারতের ধারণা পরস্পরবিরােধী। একইভাবে বলা যায়, যে কোনাে মূল্যে পাকিস্তান অর্জন করতে হবে এমন ধারণায় বিশ্বাসী হয়ে ১৯৪৫-৪৬-এর নির্বাচনে লীগের লড়াই পাকিস্তান ইস্যুভিত্তিক এবং পাকিস্তান অর্জনের জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ (১৯৪৬)  আহ্বান করতেও তিনি দ্বিধা করেননি। এমনকি বীভৎস কলকাতা দাঙ্গা (পাকিস্তান অর্জনে দাবার চাল) তাকে বিচলিত করেনি। বরং এ বিষয়ে বিদেশি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জিন্না বলেন : “আমার মতে সরাসরি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ছাড়া অন্য কোনাে বিকল্প নেই। এ বিষয়ে তার পরবর্তী বক্তব্য নির্মম পরিহাসের মতাে শােনায় যখন তিনি বলেন : “পাকিস্তানে আমি অমুসলমান ও বর্ণহিন্দুদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিচ্ছি।’ কিন্তু তার এ গ্যারান্টি একেবারেই অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। এবং তা ভারতবিভাগের অব্যবহিত পরেও। আসলে লাহাের প্রস্তাবের পর থেকে লীগের প্রচারে মুসলমান জনগােষ্ঠীকে ধর্মীয় চেতনায় এমনভাবে তাতিয়ে তােলা হয় যে তার ফলে তুচ্ছ কারণে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা যেন এক স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।

সাম্প্রদায়িকতার ও ধর্মীয় বিদ্বেষের নিরবচ্ছিন্ন প্রচার মুসলমান মানসকে ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতায় সহাবস্থানের বিপরীত বিন্দুতে দাঁড়াতে সাহায্য করে। মুসলিম লীগের ন্যাশনাল গার্ড তাে ছিল সন্ত্রাসী ক্যাডার বাহিনী, যাদের সঙ্গে বেলচাধারী খাকসাররাও পেরে ওঠেনি। এ তাে গেল সাংগঠনিক দিক যা ধর্মের নামে অনেকটা জিহাদি স্টাইলে মুসলিম জনমতকে লীগের পেছনে সংহত হতে সাহায্য করেছিল। আর স্বপ্ন দেখিয়েছিল এমন এক স্বতন্ত্র ভুবন পাকিস্তানের যেখানে দুধ-মধুর নহর বয়ে যাবে দুস্থ বা নিমবর্গীয় মানুষের সামনে পাকিস্তান ছিল অর্থনৈতিক সচ্ছলতার স্বপ্ন, কৃষকদের কাছে বিশেষত বঙ্গে জমিদারি শােষণ-শাসন অবসানের নিশ্চয়তা আর বৃহৎ মুৎসুদ্দি ও পুঁজিপতিদের জন্য প্রতিযােগিতাহীন অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তােলার সুযােগ-সুবিধা। মূলত শেষােক্ত শ্রেণি ছিল লীগের অর্থনৈতিক শক্তি যারা মনেপ্রাণে ভারতভাগ ও পাকিস্তান চেয়েছে। পাকিস্তান এভাবে মুসলিম জনগােষ্ঠীর বিভিন্ন শ্রেণীর স্বার্থ স্পর্শ করেছে। বাস্তবে কী হবে হবে সে বিবেচনা অন্তত নিম্নবর্গীয়দের মাথায় ছিল না। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান প্রস্তাবের হাতিয়ার নিয়ে এবং তা অর্জনে রক্তাক্ত পথ গ্রহণেও দ্বিধাহীন জিন্না গান্ধি-নেহরু ও কংগ্রেসের সঙ্গে লড়াইয়ে নামেন। এর পেছনে যতটা ছিল মুসলিম জনগােষ্ঠীর স্বার্থ অর্জন তার চেয়ে অনেক বেশি তার ব্যক্তিগত অহমবােধ তৃপ্তি, গান্ধি-নেহরুর বিরুদ্ধে প্রতিশোেধ গ্রহণ এবং সে কাজে ভূস্বামী ও পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষা ও তাদের সাহায্য গ্রহণ । তাই যেকোনাে মূল্যে তার পাকিস্তান চাই, হােক তা পােকায় খাওয়া। তবে এটাও ঠিক যে জিন্না তার স্বপ্নের পাকিস্তান সম্বন্ধে এতটা নিশ্চিত ছিলেন যে এর  বিপরীত দিকটা তিনি উপেক্ষা করেন মূলত তার রাজনৈতিক শক্তির কারণে। সে বাস্তবতার মুখােমুখি হয়ে তিনি অখণ্ড ভারতে সংখ্যাসাম্যভিত্তিক শাসন শক্তির অধিকারী হওয়ার চেয়ে পােকায় কাটা পাকিস্তানই অধিক গ্রহণযােগ্য মনে করেছিলেন। তাই ভুল হবে ভাবলে যে জিন্না পাকিস্তান চাননি। প্রসঙ্গত আরাে একটি তথ্য মনে রাখা দরকার যে ভারতের অমুসলমান পুঁজিপতিগণ মুখে অখণ্ড ভারতের কথা বললেও তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ভারতবিভাগ যাতে হিন্দুস্তানি ভারতে প্রতিযােগিতাহীন পরিবেশে শিল্পবাণিজ্যের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তােলা যায়। বিড়লা, টাটা, গােয়েঙ্কা, ঠাকুরদাস প্রমুখ বৃহৎ পুঁজিপতিদের বক্তব্য ও তৎপরতা থেকে তা বােঝা যায়। এ বিষয়ে বিশদ আলােচনা করেছেন সুনীতিকুমার ঘােষ তার ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য রাজ’ গ্রহে।

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!