You dont have javascript enabled! Please enable it! 1947 | সারে জাহাসে আচ্ছা'র ঐক্যবােধ টেকেনি - সংগ্রামের নোটবুক

সারে জাহাসে আচ্ছা’র ঐক্যবােধ টেকেনি

বিশের দশকে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা যেমন সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও সৌহার্দ্যের সুতাে জায়গায় জায়গায় ছিড়ে ফেলতে তৎপর হয়ে ওঠে তেমনি এ দশকেই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজ’-বিরােধী প্রতিবাদের ঐক্যও গড়ে উঠছিল এবং তা ভারতভূমির বিভিন্ন অঞ্চলে। এর কিছুটা পরিচয় পূর্বেকার আলােচনায় উঠে এসেছে। জিন্না যতই রাজনৈতিক নিয়মতান্ত্রিকতার কক্ষে বন্দি হয়ে থাকুন না। কেন, অন্যান্য মুসলমান নেতা কারাে কারাে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের প্রতি আগ্রহ দেখা গেছে। মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার প্রস্তাব ঘিরে যে বিরােধিতার প্রকাশ তার মধ্যে শুধু র্যাডিক্যাল হিন্দু রাজনীতিকই নন, বো কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মুসলমান নেতাও ওই র্যাডিক্যাল চেতনার অংশীদার- বরং একটু বেশি করেই  ডা. এমএ আনসারী, হাকিম আজমল খান, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ কিংবা জাতীয়তাবাদী উলেমা গােষ্ঠীর প্রতিনিধি আবদুল বারি প্রমুখ এক পর্যায়ে রাওলাট আইনের বিরুদ্ধেও যৌথ আন্দোলনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বাংলা, বােম্বাই, পাঞ্জাব এদিক থেকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে আসে। ইতিহাসবিদ কারাে কারাে মতে, এসব রাজনৈতিক ঘটনা মুসলমানদের রাজনৈতিক জাগরণে সাহায্য করে। বাংলায় আজাদ ও ফজলুল হকদের চেয়েও জাতীয়তাবাদী চেতনায় সেই পর্বে এক পা এগিয়ে পাঞ্জাব সাংবাদিক জাফর আলী খান এ ব্যাপারে খুব তৎপর একজন ব্যক্তি। এসবে জ্বালানি যােগ করে কবি ইকবালের জাতীয়চেতনাবাহী স্বাদেশিকতার বয়ান পরবর্তীকালের জন্য যা কিংবদন্তি হয়ে দাঁড়ায়। আধুনিক বাঙালি কবির কাব্যপঙক্তিতে স্থান পায় এ স্বদেশিয়ানা। কবি ইকবালের সেই বিখ্যাত পর্ভূক্তি ‘সারে জাহাসে আচ্ছা হিন্দুস্তা হামারা’ যেন স্বাদেশিকতার জপমন্ত্রে পরিণত হয়। সাদামাটা ভাষায় তিনি আরাে লেখেন : বিরক্ত হয়ে ছেড়েছি আজিকে মন্দির ভজনালয়, মােল্লার কথা শুনি না, ছেড়েছি উপদেশ তব কাহিনীময়… আমার কাছে তাে স্বদেশের এই ধূলিকণাগুলি দেবতাময়। 

গুরুত্ব বিচারেই ইকবালের উল্লিখিত কাব্যপঙক্তির তর্জমা ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলাে রাজনৈতিক নেতাদের স্বদেশ-চেতনা ওই কাব্য-আবেগের সমধর্মী ছিল না। তাদের কাছে ব্যক্তিগত উচ্চাশা বা দলগত স্বার্থসিদ্ধিই ছিল বড় কথা। ভাবতে অবাক লাগে যে হিন্দুস্তান হামারা’র কবি এই আল্লামা ইকবালই কি না ১৯৩০ সালে মুসলিম লীগের এলাহাবাদ অধিবেশনে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র বাসভূমির দাবি জানান তার সভাপতির ভাষণে। তবে ওই পর্যায়ে তিনি ভারত বিভাজনের কথা বলেননি। যাহােক পূর্বোক্ত সমন্বয়বাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে দমননীতির বর্বরতায় ক্ষতিগ্রস্ত পাঞ্জাবের চেহারা এক-আধটি পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গােটা পাঞ্জাবে এ আন্দোলনে নিহত শ্বেতাঙ্গ মাত্র চারজন, আর ভারতীয় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ : অন্ততপক্ষে ১২শ নিহত ও ৩ হাজার ৬শ জন আহত’ (সুমিত সরকার, প্রাগুক্ত)। নির্যাতন, বেত্রাঘাত ও বিভিন্ন ধরনের দৈহিক শাস্তি বাদেই এ হিসাব নির্মমতার দিকটা স্পষ্ট করে তােলে। এই নির্মমতাজনিত মানসিক যন্ত্রণার প্রকাশ ঘটেছে ৩০ মে (১৯১৯) ভাইসরয় চেমসফোর্ডের কাছে নাইটহুড বর্জন উপলক্ষে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে। তার মতে, হতভাগ্য পাঞ্জাবিদিগকে যে রাজদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। তার অপরিমিত কঠোরতা ও সেই দণ্ড প্রয়ােগ বিধির বিশেষত্ব আমাদের মতে কয়েকটি আধুনিক ও পূর্ব দৃষ্টান্ত বাদে সব সভ্য শাসনতন্ত্রের ইতিহাসে তুলনারহিত। | এ বিষয়ে কবি আরাে বলেছিলেন যে, বহু কোটি আতঙ্কিত ভারতবাসীর আপত্তি প্রকাশ করতে এই চিঠি । মানুষের অযােগ্য যে অসম্মানে দেশবাসীকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে তার প্রতিকারে নিজের সম্মানচিহ্ন বর্জন করে তাদের পাশে নেমে আসতে তিনি ইচ্ছুক। অবশ্য রবীন্দ্র-বিদূষক অনেকে দেরিতে চিঠি লেখার জন্য রবীন্দ্রনাতের সমালােচনা করেন যেমন সমকালে তেমনি পরে। বাংলাদেশের প্রবীণ অধ্যাপক আহমদ শরীফও এদের তালিকায় পড়েন। কিন্তু পরিস্থিতির সঠিক বিবরণ জানার জন্যই ছিল কবির অপেক্ষা।

কারণ সংবাদ প্রকাশে নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রকৃত ঘটনা জানার উপায় ছিল না। যে জন্য রবীন্দ্রনাথ বন্ধু সিএফ অ্যান্ড্রুজকে অমৃতসর পাঠান। অবস্থা এমনই ছিল যে শ্বেতাঙ্গ পাদরি অ্যান্ড্রজও শহরে ঢুকতে পারেননি। অমৃতসরে পৌছানাের সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং পরে তাকে দিল্লিতে ফেরত পাঠানাে   হয়। সেখানে কিছু সময় সংবাদ সংগ্রহের চেষ্টা করে হতাশ অ্যান্ড্রজ অবশেষে মে মাসের শেষ দিকে শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন। এরপরই রবীন্দ্রনাথের। নাইটহুড বর্জনের সিদ্ধান্ত, যা নিয়ে তিনি ভাইসরয়কে চিঠি লেখেন। রাজশাসনের নিষ্ঠুরতা শুধু জালিয়ানওয়ালাবাগেই রক্তস্রেতি বহায়নি, পরবর্তী দুদিন অর্থাৎ ১৪ ও ১৫ এপ্রিল গুজরানওয়ালায় বিক্ষোভরত জনতার ওপর আকাশযান থেকে বােমাবর্ষণ ও মেশিনগানের গুলি চালনা শাসকদের বর্বরতার প্রকাশ ঘটায়। গােটা পাঞ্জাবকে অবশিষ্ট ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয় গণহত্যার খবর প্রকাশ নিষিদ্ধ করার ফলে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি, যাবেও না কোনােদিন। বিশেষ বিশেষ এ জাতীয় ঘটনা উপলক্ষে শাসকবিরােধী ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ বা লড়াই বরাবরই প্রশাসনকে আতঙ্কিত করেছে এবং আতঙ্কের কারণে চলেছে। দমননীতির তাণ্ডব, যেমন দেখা গেছে দুদশক পরে ভারত ছাড়’ আন্দোলনে। তবে পাঞ্জাবে সম্প্রদায় নির্বিশেষ আন্দোলন দমন করতে ডায়ার প্রশাসন যে বর্বরতার প্রকাশ ঘটায় তার তুলনা বিরল। কোনাে কোনাে লেখকের মতে তখনকার পাঞ্জাবের প্রতিরােধ আন্দোলন এক ধরনের গণবিদ্রোহ। এর প্রভাব পড়ে গােটা ভারতে। কিন্তু ব্যাপক গণআন্দোলনের প্রকাশ ঘটাতে না পারার কারণ যেমন প্রচণ্ড সরকারি দমননীতি তেমনি গান্ধি কংগ্রেসের নিরাসক্তি।

রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্ববিহীন গণআন্দোলন হালবিহীন নৌকোর মতাে গন্তব্যে পৌছতে পারে না। তাই এমন সমালােচনা অস্বীকার করা কঠিন যে ‘গণবিদ্রোহের ফলে প্রচলিত ইঙ্গ-ভারতীয় সম্পর্ক ভেঙে চৌচির হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় গান্ধিজী এমন আতঙ্কিত হয়ে পড়েন যে, তিনি সরকারের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহের কার্যক্রম শুধু যে প্রত্যাহার করেন তা নয়, অমৃতসর কংগ্রেস (ডিসেম্বর, ১৯১৯) অধিবেশনে তিনি জনগণের আচরণের নিন্দা করে একটি প্রস্তাবও উত্থাপন করেন’ (অরবিন্দ পােদ্দার- রবীন্দ্রনাথ : রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ১৯৮২)। গান্ধি রাজনীতির এ বৈশিষ্ট্য আমরা বরাবর দেখেছি যে আন্দোলন অহিংস হলে তার কাছে তা জায়েজ হয় না। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ বা স্বৈরাচারবিরােধী আন্দোলন কখনাে কি অহিংস থাকতে পারে? শাসকের এক আঘাতেই তা ভেঙেচুরে যায়। তেমন উদাহরণ ভারতে অনেক রয়েছে। জালিয়ানওয়ালাবাগ জমায়েত তাে নিছক মেলার গণউপস্থিতিই ছিল। সেখানে নির্বিচারে গুলি চালানাে কোন্ অহিংসনীতির প্রকাশ? সহিংসতাকে তাে নিরামিষ অহিংসা দিয়ে জয় করা যায় না, বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদী, আধিপত্যবাদী স্বার্থ যেখানে  শক্তিমান পক্ষ । বৃথাই গান্ধি অহিংস আন্দোলনের এক অসম্ভব সাধনায় ভারতীয় মুক্তি সংগ্রামকে ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দিয়েছেন। নেতৃত্বের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় ভারতের স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। বরং তার নিরীহ স্বদেশবাসীর রক্তস্রোতে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটেছিল। এখানেই থেমে থাকেননি অধিবেশনের উপস্থিত গান্ধিবাদী শীর্ষনেতারা। অমৃতসর বর্বরতার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড বর্জনের মতাে ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ পর্যন্ত করেননি ওই নেতৃবৃন্দ অমল হােমের বিবরণমতে কংগ্রেস-মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের খেতাব বর্জন বিষয়ক প্রস্তাব উত্থাপনের চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বাংলার প্রতিনিধিরাও নীরব। এমনকি এ বিষয়ে বাঙালি সৈয়দ হােসেনের একটি প্রস্তাব অধিবেশনের সভাপতি মােতিলাল নেহরুর কারণে উত্থাপন করা যায়নি (পপাদ্দার, প্রাগুক্ত)।  গান্ধীকংগ্রেস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যত আপসবাদী চালে চলুক না কেন পাঞ্জাব বর্বরতা ও রাওলাট দমননীতির প্রতিক্রিয়ায় রাজনীতি-সচেতন ভারতীয় জনসাধারণ হিন্দু-মুসলমান-শিখ নির্বিশেষে আবারাে প্রতিবাদী ঐক্যের প্রকাশ ঘটায়।

যেমন দেখা গিয়েছিল ঘটনার অব্যবহিত পূর্বে। যেমন কুখ্যাত রাওলাট আইনের প্রতিবাদে হরতাল পালিত হয় অমৃতসর ঘটনার দিন কয়েক আগে। অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে যে ১৯১৮ সালের দাঙ্গার মতাে ন্যক্কারজনক ঘটনার ৬-৭ মাস পরই শুরু হয় হিন্দু-মুসলমানের শাসকবিরােধী ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদী তৎপরতা। সবচেয়ে অবিশ্বাস্য নাখােদা মসজিদে ১১ এপ্রিল হিন্দুমুসলমানের মিলিত সমাবেশ- তাতে মসজিদ অপবিত্র হয়নি। পরদিন নানা ধর্মের, নানা শ্রেণির মানুষের বিশাল প্রতিবাদী মিছিল ও সেনাসদস্যদের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ । ফলে কিছুসংখ্যক মৃত্যু। তাতে দমেনি মানুষ। কিন্তু দিল্লিতে এর চেয়েও বড় চমক উপলক্ষ সেই রাওলাট আইন এবং তাও অমৃতসর বর্বরতার সপ্তাহখানেক আগে। সেখানেও চলেছে সরকারবিরােধী। সমাবেশ, মিছিল ও পুলিশের গুলি। প্রতিক্রিয়ায় দিল্লির বিখ্যাত জামে মসজিদে হিন্দু-মুসলমানের এক জমায়েতে (৪ এপ্রিল) স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দকে সম্মাননা জানানাে হয় (সুমিত সরকার, প্রাগুক্ত)। তবে লক্ষণীয় যে, প্রতিটি স্থানে জঙ্গি নিমবর্গীয়দের সঙ্গে মধ্যশ্রেণির অলিখিত সমঝােতায় কোনাে সুনির্দিষ্ট আদর্শগত বন্ধন ছিল না। হিন্দু-মুসলমান ঐক্য সত্ত্বেও এটাই ছিল লক্ষ্য অর্জনের দুর্বল বিন্দু অর্থাৎ অ্যাকিলিসের গোড়ালি যা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুদিক থেকে তীরবিদ্ধ, মানে  আক্রান্ত হওয়ার কথা। বাস্তবে হয়েছেও তাই এবং এর পেছনে শাসকশ্রেণির উগ্র দমননীতি ও কূটচাতুর্য । দুই. সাম্প্রদায়িক অনৈক্য। এ সময়কার ঘটনাবলীর দুই ভিন্নমুখী প্রতিক্রিয়ার চরিত্র বিচার গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, সমকালীন রাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পরিচয় তাতে করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যা পরবর্তী রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে। করেছে দেশ বিভাগের পরিণাম রচনায় । শাসকশ্রেণির বর্বরতা তথা নির্মম দমননীতির পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধি প্রভাবিত কংগ্রেসের তাৎক্ষণিক নমনীয়তা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য  যে কংগ্রেস তাদের দিল্লি অধিবেশনে মন্টেগু-চেমসফোর্ড প্রস্তাবের সমালােচক সেই কংগ্রেসের গান্ধিবাদী নেতারাই অমৃতসর কংগ্রেসে (১৯১৯) মন্টেগুকে ধন্যবাদ জানিয়ে সহযােগিতার প্রস্তাব গ্রহণ করেন।

ওই পার্শ্ব পরিবর্তনের মূল নায়ক এম কে গান্ধি। তবে চুপ করে থাকেননি। ভিন্নমতের নেতৃবৃন্দ। গান্ধির বিরােধিতা উপেক্ষা করে সংস্কার প্রস্তাবকে হতাশাজনক বলে মন্তব্যসূচক একটি ধারা যােগ করা হয় পূর্বোক্ত ধারার সঙ্গে। এ উদ্যোগ মূলত চিত্তরঞ্জন দাস, হসরত মােহানি, বালগঙ্গাধর তিলক প্রমুখ কংগ্রেস নেতার । উল্লেখ্য জালিয়ানওয়ালাবাগ ট্র্যাজেডির বর্ষপূর্তি উপলক্ষে (১৩ এপ্রিল, ১৯২০) শহীদদের স্মরণে অনুষ্ঠিত শােকসভার অন্যতম উদ্যোক্তা জিন্নার আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ যে বাণী পাঠান তা ছিল রীতিমতাে প্রতিবাদী।  বিস্ফোরক শব্দচয়নে রচিত ওই বাণীতে বলা হয় : ‘জালিয়ানওয়ালাবাগে যে অশুভ শক্তির ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটে তা আসলে এক দানবীয় যুদ্ধের দানবিক সন্তান, …সভ্যতার মৌল ভিত্তি উৎপাটিত হওয়ায় একের পর এক নৈতিক ভূকম্প সৃষ্টি হবে, মানুষকে প্রস্তুত থাকতে হবে অধিকতর দুঃখভােগের জন্য ইত্যাদি। এর পর অবশ্য তার স্বভাবসুলভ বক্তব্যে তিনি আত্মার অজেয় শক্তিতে পশুশক্তিকে প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত হতে সবাইকে আহ্বান জানান। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে আরাে দুয়েকটি ঘটনার উল্লেখ বােধহয় প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে ডায়ারীয় বর্বরতা ও হান্টার কমিশনের রিপাের্ট নিয়ে ব্রিটিশ কমন্সসভায় অবাঞ্ছিত আলােচনা প্রসঙ্গে ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ লন্ডন থেকে (১৯২০) বন্ধু অ্যান্ড্রুজকে লেখেন, ‘তাদের বক্তৃতায় পাশবিকতা যে রকম নির্লজ্জভাবে প্রকাশ পেয়েছে এবং তাদের খবরের কাগজগুলােতে তারই। প্রতিবেদন যেভাবে কলঙ্কিত হয়ে উঠেছে, তা অতি ভয়াবহরূপেই কুৎসিত আমাদের সত্যিকার মুক্তি রেেছ আমাদের আপন হাতে, …শুধু আত্মত্যাগ ও নিরতিশয় দুঃখবরণের দ্বারাই আমরা পাব সাফল্যের সন্ধান’ (তর্জমা ও উদ্ধৃতি অমল হােমের)। 

এর পরপরই খিলাফত উপলক্ষে গান্ধি ও আলী ভ্রাতাদের চেষ্টায় কংগ্রেসখিলাফত সমঝােতা ও হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রকাশ। গান্ধির অসহযােগ আন্দোলন ও খিলাফতের সংশ্লিষ্টতা সাম্প্রদায়িক ঐক্যের পথ তৈরি করেছিল। কলকাতা ও লাহােরে বিশাল ছাত্রধর্মঘট, সর্বভারতীয় শ্রমিক ধর্মঘট ইত্যাদি মিলে জমজমাট সরকারবিরােধী পরিবেশ তৈরি হয়। বাঙলার জাতীয় আন্দোলনের গােটা ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি শক্তি ও ঐক্যের প্রকাশ সম্ভবত ১৯২১-২২-এ গড়ে ওঠা অসহযােগ খিলাফত সমঝােতা। …বাংলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন চিত্তরঞ্জন দাস ও তার তিন তরুণ সহকর্মী নেতা- মেদিনীপুরের তৃণমূল নেতা বীরেন্দ্র শাসমল, চট্টগ্রামের মধ্যপন্থী নেতা যতীন্দ্রমােহন সেনগুপ্ত ও কলকাতার বিপ্লববাদী নেতা সুভাষচন্দ্র বসু।’ সবচেয়ে বড় কথা বাংলার শহর গ্রামে ঐক্যবদ্ধ জনজাগরণ । অবিশ্বাস্য রকম কম সময়ে গােটা পূর্ববঙ্গ আলােড়িত হয়ে ওঠে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে। কলকাতাস্থ কারখানা শ্রমিকও (অধিকাশংই মুসলমান) একই কাতারে । প্রসঙ্গত এ ক্ষেত্রে কমরেড মুজাফফর আহমদের নেতৃত্বও স্মরণযােগ্য ঘটনা (সুমিত সরকার)। বাংলার বাইরে আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ বােম্বাই ও যুক্তপ্রদেশ। শুধু মধ্যশ্রেণি নয়, কৃষক ও শ্রমিক এই উভয় শ্রেণিকে গভীরভাবে স্পর্শ করে অসহযােগ আন্দোলন। পাশে সখলাফতিরা। কিন্তু পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ জনতা গােরখপুরের চৌরিচৌরায় থানা পুড়িয়ে দেয়। মারা যায় কয়েকজন পুলিশ। এ ঘটনায় গান্ধি আন্দোলন বন্ধ করে একটি বিপুল সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটান। অন্যদিকে প্রশাসনিক নির্মমতায় আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট ১শ ৭২ ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত, তাদের মধ্যে অনেক টানাটানির পর ১৯ জনের ফাঁসি, বাকি সবার দ্বীপান্তর। | এ ঘটনা থেকে ব্রিটিশরাজের আতঙ্ক সৃষ্টি ও দমননীতির নির্মমতা পরিমাপ করা যায়।

অন্যদিকে বড় বিষয় গান্ধির চরম আপসবাদিতা। জওহরলাল তার আত্মজীবনীতে লেখেন যে চৌরিচৌরার ঘটনায় আন্দোলন স্থগিত করা সম্বন্ধে গান্ধির একতরফা সিদ্ধান্তে অধিকাংশ শীর্ষস্থানীয় কংগ্রেস নেতা গভীরভাবে অসন্তুষ্ট হন, আর তরুণরা ক্ষুব্ধ। কিন্তু গান্ধি তার সিদ্ধান্তে অনড় অহিংসার নামে এমনি ধারার আপসবাদ ছিল গান্ধি রাজনীতির চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য। কংগ্রেস অধিকাংশ সময় এই আপসবাদী রাজনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। পূর্বোক্ত কংগ্রেসী প্রস্তাবের একটি বড় আপত্তিকর দিক ছিল ভূস্বামীদের  প্রতি সমর্থন। গান্ধি রাজনীতি একদিকে জমিদারদের, অন্যদিকে কমপ্ৰেডর মুৎসুদ্দি ধনপতিদের (যেমন বিড়লা) বরাবর সমর্থন জানিয়েছে। ১৯১৯ থেকে ১৯২২ বঙ্গদেশসহ ভারতীয় রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের এক শুভ সময়পর্ব। এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা গান্ধির সঙ্গে রাজনৈতিক ভিন্নমতের টানে ১৯২৩ সালের মার্চে চিত্তরঞ্জন ও মােতিলাল নেহরুর স্বরাজ্য দল গঠন এবং তাদের অভাবিত নির্বাচনী বিজয় ২১টি মুসলমান কেন্দ্রে। সে বছরের শেষ দিকে চিত্তরঞ্জনের বহুখ্যাত ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ যাতে বঙ্গে প্রশাসনিক পদে মুসলমানদের জন্য ৫৫ শতাংশ সংরক্ষণ, মসজিদের সামনে গান-বাজনা বন্ধ ইত্যাদি শর্ত নিশ্চিত করা হয়। দেশব্যাপী হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির জোয়ার বয়ে যায়। স্বরাজীরা শুধু আইনসভাতেই নয়, আঞ্চলিক ও পৌরসভাতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কলকাতায় চিত্তরঞ্জনের সাফল্যে প্রধান ভূমিকা তরুণ সুভাষচন্দ্র বসুর  সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশে স্বরাজ্য দলের ‘বঙ্গ বিজয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি জুন ১৯২৫-এ চিত্তরঞ্জনের অকাল মৃত্যুর পর। সুভাষ-বীরেন্দ্র শাসমল প্রমুখের চেষ্টা সত্ত্বেও কংগ্রেসের ভিন্নপন্থীদের হাতে ঐতিহাসিক বেঙ্গল প্যাক্টের মৃত্যু এবং হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের মূলে কুঠারাঘাত (১৯২৬)। শুধু বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিলই নয়, প্রজাস্বত্ব আইনের বিরােধিতার মতাে। একাধিক ঘটনায় কংগ্রেসের ভূমিকা হিন্দু-মুসলমানের বিচ্ছিন্নতা ঘটানাের সহায়ক হয়ে ওঠে। বিচ্ছিন্নতার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সংঘাত রাজনীতিকে দূষিত করে। আর সাম্প্রদায়িক বিরূপতার প্রেক্ষাপট রচনা করে উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয়-সামাজিক সংগঠনের কর্মকাণ্ড। যেমন ১৯২৩ থেকে ‘তবলিগ’ ও ‘তানজিম’-এর প্রচার, অন্য পক্ষে হিন্দুমহাসভা ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ব্যাপক ধর্মীয় প্রচার, স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দের শুদ্ধি অভিযান ইত্যাদি ঘটনা সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক তিক্ত করে তােলে স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দ হত্যার ঘটনা তাতে জ্বালানি যােগ করে। 

মদনমােহন মালব্য, মুঞ্জে প্রমুখ সম্প্রদায়বাদী রাজনৈতিক নেতার প্রচারাভিযান ও মুসলিম লীগের রক্ষণশীলতার পুনরুত্থান সাম্প্রদায়িক সংঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কলকাতা, ঢাকা, পাবনা, বিহার, দিল্লি, যুক্তপ্রদেশ সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার শিকার। এতসব সত্ত্বেও গান্ধি হিন্দুত্ববাদী রক্ষণশীল নেতাদের (যেমন মালব্য) সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেন। যে  মহম্মদ আলী ১৯২৩ সালে কংগ্রেস অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন তিনিই গান্ধির আচরণে ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বাড়াবাড়িতে বিরক্ত হয়ে গান্ধির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন (সুমিত সরকার)। সাম্প্রদায়িক সমঝােতায় প্রকৃতপক্ষে কোনােপক্ষেরই সদিচ্ছা বা আগ্রহ ছিল  মদনমােহন মালব্য ও মােতিলাল নেহরুর দ্বন্দ্ব এতটা তীব্র হয় যে, হিন্দুমহলে মােতিলাল মুসলমানঘেঁষা রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত হতে থাকেন। হিন্দু-হিন্দি-হিন্দু’ শ্লোগানের টানে ও পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ১৯২৬ সাল থেকে যেমন বঙ্গে তেমন গােটা ভারতে সাম্প্রদায়িক চেতনা তীব্র হয়ে উঠতে থাকে এর মধ্যে মসজিদের সামনে বাজনা ও অন্য পক্ষে গাে-জবাই এবং অনুরূপ কারণগুলাে চরম স্বেচ্ছাচারিতায় সম্প্রীতির সুতােগুলাে ছিড়তে থাকে  এই দ্বন্দ্বে জয় তৃতীয় শক্তি ব্রিটিশ রাজ’-এর। গান্ধির কাছেও গাে-রক্ষা প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে ওঠে। হিন্দু-মুসলমান সমস্যা তার কাছে অবস্থাদৃষ্টে সমাধানযােগ্য বলে মনে হয় না। এ অবস্থায় গােদের উপর বিষফোঁড়ার মতাে হয়ে ওঠে সাইমন কমিশনের (১৯২৭) ভারত শাসন বিষয়ক নয়া প্রস্তাব। সুপ্রদায়-সম্প্রীতির চেষ্টা হিসেবে জিন্নাসহ মুসলিম সংগঠনগুলাে রাজনৈতিক মতৈক্যের চেষ্টা চালায়। তাদের অধিকাংশ সাইমন কমিশন বর্জন করে। মার্চ ১৯২৭-এ জিন্নার উদ্যোগে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম সম্মেল৯েযে সমাধান প্রস্তাব তৈরি করা হয় তাতে পৃথক নির্বাচনের দাবি বাতিল করা হয় বিশেষ কয়েকটি শর্তে। যেমন সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত আসনসমেত যৌথ নির্বাচকমণ্ডলী, কেন্দ্রে-এক। তৃতীয়াংশ মুসলিম প্রতিনিধিত্ব, পাঞ্জাব ও বঙ্গে জনসংখ্যা অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব এবং সিন্ধু, বেলুচিস্তান, সীমান্ত ভূখণ্ডের স্বতন্ত্র প্রদেশের মর্যাদা কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে (১৯২৭) এ প্রস্তাব মেনে নেয়ার পর পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রের হিন্দু সম্প্রদায়বাদীদের চাপে কংগ্রেস পিছু হটে।

এরপরও চেষ্টা চলে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনে (১৯২৮) জিন্না ঐক্যের আহ্বান জানান এই বলে যে, আমরা সবাই একই ভূমির সন্তান। আমাদের একসঙ্গে থাকতে হবে ।… বিশ্বাস করুন, যতদিন হিন্দু ও মুসলমান ঐক্যবদ্ধ না হয় ততদিন ভারতের কোনাে অগ্রগতি হবে না’ (উমা কাউর, মুসলিমস অ্যান্ড। ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজম’, ১৯৭৭)। জিন্নার এ আহ্বানে কংগ্রেস সাড়া দেয়নি মূলত হিন্দু মহাসভা নেতাদের বিরােধিতার কারণে। মালব্য, মুঞ্জে প্রমুখ নেতাদের তখন কংগ্রেসের ওপর যথেষ্ট প্রভাব  প্রভাব হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার। জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভারতীয়  মুসলমানদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসনের দাবি প্রকৃতপক্ষে যুক্তিহীন ছিল না  বিনিময়ে যৌথ নির্বাচন। কংগ্রেস এসব দাবি মেনে নিলে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের পথ তৈরি হতাে। কিন্তু তা না হওয়ায় অন্য কোনাে পথেই সমাধান মেলেনি, ঐক্যের দরজা খােলেনি।  এভাবে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের পথ বন্ধ হয়ে গেলে হতাশ জিন্না লনডনে ফিরে। যান। পরে ফিরে আসেন অন্য এক জিন্নার রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে । একদিক থেকে বিচার করলে বিশের দশক ভারতীয় রাজনীতিতে ইতি ও নেতির সময়পর্ব হিসেবে চিহ্নিত হওয়া উচিত নানা ঘটনার টানে কংগ্রেস ও জিন্নার পথ ভিন্ন হয়ে যায়। কবি-রাজনীতিক ইকবালের ভারতীয় ভূখণ্ডভিত্তিক আবেগ ‘সারে জাহাসে আচ্ছা’ হাওয়ায় ভেসে যায় এবং তিরিশের দশকে গােটা বিষয়টা ভিন্ন চরিত্র নিয়ে দেখা দেয়। মুসলিম রাজনীতির নায়কদেরও অবাঞ্ছিত পরিবর্তন ঘটে যা যুক্তিবাদী, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিমনস্ক মানুষের জন্য পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছিল কিন্তু ঘটনার অনাকাঙ্ক্ষিত গতি রােধ করার মতাে ছিল না, মূলত কিছুসংখ্যক শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অদূরদর্শিতার কারণে।

 

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক