জিন্না ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র
রাজনীতিতে মােহাম্মদ আলী জিন্নার প্রবেশ ভারতীয় মুসলমানদের অধিকারের দাবি নিয়ে, যদিও শুরুতে তিনি কংগ্রেস, লীগ উভয় সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। মুসলিম লীগের একজন কর্তাব্যক্তি হিসেবে তিনি সে সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত, আর কংগ্রেসের সঙ্গে একজন সহযাত্রী হিসেবে সে সময় ভারতের মুসলিম রাজনীতির বৈশিষ্ট্যই ছিল দুই নৌকায় পা রেখে চলা- এ অপ্রিয় সত্য অস্বীকারের কোনাে উপায় নেই। মাওলানা মােহাম্মদ আলী, ডা. এম. এ আনসারি, হাকিম আজমল খান, এমনকি হসরত মােহানীর মতাে শুদ্ধ দেশপ্রেমীদের আচরণ তেমন প্রমাণ দেয়। আবার কেউ কেউ অসাম্প্রদায়িক আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদী হয়েও সম্প্রদায়বাদী মুসলিম লীগ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে অনেক সম্ভাবনার মৃত্যু। ঘটিয়েছেন। যেমন বাংলায় কৃষক প্রজাপার্টির প্রধান একে ফজলুল হক এবং পাঞ্জাবে ইউনিয়নিস্ট পার্টির নেতা সিকান্দার হায়াত খান। প্রসঙ্গত, সিন্ধুর ‘জিয়ে সিন্ধু’ নেতা জিএম সৈয়দের নামও উল্লেখ করা যেতে পারে এমন ধারণা ভিত্তিহীন নয় যে এরা ঐক্যবদ্ধভাবে ভারতীয় মুসলমানদের সঙ্গত দাবিদাওয়ার কর্মসূচি নিয়েও দেশপ্রেমী গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদীর ভূমিকা পালন করতে পারতেন, সেকুলার রাজনীতির আদর্শ ধারণ করেই পারতেন। তাতে দুই প্রধান রাজনেতিক দল লীগ-কংগ্রেসের বাইরে নয়া সংগঠনে তৃতীয় রাজনেতিক শক্তির বিকাশ ঘটতে পারত সম্ভাবনা ছিল ভারতীয় রাজনীতির সুস্থ ভিন্ন পথ ধরার। বামপন্থীদের জন্য সুযােগ তৈরি হতাে এদের প্রতি সমর্থন দানের কিন্তু এরা সে পথে পা বাড়াননি বামগণতন্ত্রীরাও এমন ধারা সৃষ্টির চেষ্টা চালাতে পারতেন, সেটা দেশের জন্য মঙ্গলকর হতাে তা না করে তারা সুবিধাবাদী ও অংশত হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেসের মধ্যে আত্মনাশের পথ খুঁজে বেড়ালেন । কখনাে কংগ্রেস সােসালিস্ট পার্টি করে, কখনাে সরাসরি কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত হয়ে ভেবে দেখেননি কংগ্রেসে হিন্দুমহাসভার প্রভাবের দিকটি ভাবেননি প্রচ্ছন্নভাবে প্যাটেল থেকে নগ্নভাবে হিন্দুমহাসভা মতাদর্শের মদনমােহন মালব্য, মুঞ্জে প্রমুখের কথা যারা নানাভাবে কংগ্রেস-রাজনীতি, কখনাে গান্ধিরাজনীতিকে প্রভাবিত করে দেশটিকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দিকে ঠেলে দিয়েছেন। অবশ্য অন্যদিকে বিপরীত ময়দানে ছিল রক্ষণশীল মুসলিম লীগ রাজনীতির ভূমিকা তারাও ওই একই ধারায় কাজ করেছেন। এই প্রেক্ষাপটেই মােহাম্মদ আলী জিন্নার রাজনীতি নিয়ে, বিশেষ করে মুসলমান রাজনীতিতে তার একাধিপত্য নিয়ে, তার ‘অবসেশনের বিষয়টা নিয়ে বিবেচনা করতে হবে। ব্যক্তি হিসেবে, আইনজীবী ও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে যথাক্রমে তার প্রবল উচ্চাভিলাষ, প্রচণ্ড অহমবােধ এবং স্বভাবের ধাতব কাঠিন্য তার রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে। সর্বোচ্চ বিন্দুতে অবস্থানের বাসনা শুরু থেকেই তার মধ্যে ছিল এবং তা বাস্তবায়নের সম্ভাব্য পথ ছিল মুসলিম রাজনীতি।
সে রাজনীতির হাল ধরেই তিনি প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজেছেন। শেষ পর্যন্ত প্রবল সম্প্রদায়বাদিতার মাধ্যমে সাফল্যও পেয়েছেন। মােহাম্মদ আলী জিন্নার একটি বড় গুণ ছিল লক্ষ্য একবার নির্ধারিত হয়ে গেলে তার পেছনে নিরবচ্ছিন্ন নিষ্ঠায় লেগে থাকা যতদিন না পর্যন্ত উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়- দেহাতি বাংলায় বলা যায় কামড় খেয়ে লেগে থাকা। এ কাজটি ছিল তার স্বভাবজাত এবং ভারতীয় রাজনীতিতে এ পথ ধরেই তিনি এগিয়েছেন। ঐক্যের নিশানায় যখন কাজ হয়নি তখন অনৈকেরি পথটা তিনি সবলে আঁকড়ে ধরেছেন। অবশ্য এ বিষয়ে কংগ্রেস-রাজনীতির দায়ও অস্বীকার করা চলেনা। বিশেষ করে তাদের দোলাচলবৃত্তি নিয়ে। জিন্না বিষয়ক অভিসন্দর্ভ গ্রন্থ ‘দ্য সােল স্পােকসম্যান’-এর রচয়িতা আয়েশা জালাল লিখেছেন : ১৯৪০ সাল থেকে জিন্না (অর্থাৎ জিন্না রাজনীতির পক্ষে এমন দাবি অগ্রাধিকার পেয়ে যায় যে মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে তাকেই ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র (সােল স্পােকসম্যান)হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং এটার ওপর তিনি বরাবর জোর দিয়ে চলেছেন’ (পৃষ্ঠা ৬০)। এ দাবি অদিৗয়ের দ্বান্দ্বিক লক্ষ ছিল কংগ্রেস ও রাজ সরকার কংগ্রেসের সঙ্গে এ বিষয়ে ছিল দ্বন্দ্ব ও প্রতিযােগিতা এবং শাসকের কাছে আবেদন একমাত্র প্রতিনিধি বা মুখপাত্র হিসেবে কাজ করার চিন্তা প্রথম থেকেই জিন্নার মাথায় এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে রাজনীতির ক্ষেত্রে এর বাইরে অন্যকোনাে ভাবনা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ জন্য শাসকদের সঙ্গে দেনদরবারেও তার আপত্তি ছিলনা। চল্লিশের অনেক আগে থেকেই জিন্না এ লক্ষ্য সামনে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। কংগ্রেসের মঞ্চে এবং সর্বদলীয় সম্মেলনে তার দাবি নাকচ হয়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ জিন্না দেশ ছেড়ে গিয়ে লন্ডনে বসবাস শুরু করেন ।
কিন্তু ১৯৩২ থেকে ১৯৩৫-এ র্যামজে ম্যাকডােনাল্ড থেকে ভারতে লিনলিথগাে শাসনের আমলে ব্রিটিশরাজ সুপরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ব্যবস্থা পাকা করেন ১৯৩৫ সনে ‘সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ’ (‘কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড’) প্রবর্তনের মাধ্যমে এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিভাজক সহিংসতা সচল করে কংগ্রেসের ‘রাজ’-বিরােধী আন্দোলন দমন করা এই ব্যবস্থার মূল উপাদান ছিল ‘ভাগ কর’ নীতির প্রয়ােগে হিন্দুমুসলমানের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা এবং মুসলমান, শিখ, ইউরােপীয়, খ্রিস্টান ও অ্যাংলাে-ইন্ডিয়ানদের জন্য আসন সংরক্ষণ। প্রকৃতপক্ষে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য আসন সংরক্ষণই তাদের সম্প্রদায়-স্বার্থরক্ষার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে উদ্দেশ্যমূলকভাবে যােগ করা হয় হিন্দু-মুসলমানকে রাজনীতি ক্ষেত্রে আলাদা করতে স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা, যা শিখদের জন্য করা হয়নি। তার চেয়েও বড় কথা ইউরােপীয়দের জন্য সংরক্ষিত আসন তাদের জনসংখ্যা অনুপাতের তুলনায় অনেক অনেক বেশি ছিল, যাতে প্রদেশে ও কেন্দ্রে শাসনক্ষমতার দড়িটা হাতে রাখা যায় । এ রােয়েদাদে প্রাদেশিক শাসনের প্রতি গুরুত্ব আরােপ করা হয়। ভারতীয় রাজনীতিতে আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য এমন একটি সুযােগের অপেক্ষায় ছিলেন জিন্না। অথবা বলা যায় সুবিধা-সুযােগের পরিস্থিতি তাকে আবার রাজনীতির অঙ্গনে টেনে নিয়ে আসে মুসলিম লীগের ভাঙাচোরা ও জরাজীর্ণ সাংগঠনিক অবস্থা মেরামত করষ্টেজোরালাে ডাক পড়ে মােহাম্মদ আলী জিন্নার । যুক্ত-প্রদেশের দুই লীগ-নেতা লিয়াকত আলী খান ও চৌধুরী খালিকুজ্জামান জিন্নাকে টেনে নিয়ে আসেন লন্ডন থেকে ভারতে।
আর এটাও হয়তাে ঠিক (যা বলেছেন হডসন বা যশবন্ত সিং) যে ভারতীয় মুসলমানদের (অবশ্য উচ্চবর্গীয় ও শিক্ষিত শ্রেণির) আকাক্ষা ছিল তাদের হয়ে কথা বলার মতাে একজন শক্তিমান যােগ্য রাজনৈতিক প্রতিনিধি বা নেতার । সে যােগ্যতা জিন্নার ছিল। ছিল আরাে কারাে কারাের যারা সম্প্রদায়বাদী পথে পা বাড়ীতে ইচ্ছুক ছিলেন না। কাজেই মুসলিম লীগের জন্য একমাত্র যােগ্য নেতা মােহাম্মদ আলী জিন্না। সে মুহূর্তে এর কোনাে বিকল্প ছিল না। ভারতে এসেই জিন্না সংগঠন মেরামতের কাজে লেগে গেলেন হতাশাগ্রস্ত জিন্নার বদলে লন্ডন থেকে ফিরে এলেন নতুন জিন্না। কণ্ঠে তার চড়া সুর ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া নিয়ে এবং সমপ্রদায়বাদী হাতিয়ার নিয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জোরালাে। চ্যালেঞ্জ জানিয়ে। তিনি তখন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি ও অবিসংবাদী নেতা পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা তার জন্য যে সুযােগ এনে দেয় সে পরিপ্রেক্ষিতে জিন্নার মূল লক্ষ্য ছিল মুসলমানপ্রধান দুই প্রদেশ বাংলা ও পাঞ্জাব এবং মুসলমান ভূস্বামী ও শিক্ষিত প্রাধান্যের হিন্দুসংখ্যাগুরু যুক্তপ্রদেশ কজায় আনা। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের যে শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাব ভারতবর্ষে আইনে পরিণত হয় (১৯৩৫) তার যথাযথ সদ্ব্যবহারের অপেক্ষায় ছিলেন ভাইসরয় লিনলিথগাে । সে প্রয়ােজন মেটাতে তিনি মুসলিম লীগকে সমর্থন বা সহায়তা দেবেন এটাই যুক্তিসঙ্গত। তবু সংশয় ছিল ভাইসরয়ের মনে যে জিন্না লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবেন কি না বিশেষ করে যখন নির্বাচনের জন্য সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থাদি নেয়া হয়ে গেছে। জিন্নাও বেশ কড়া ভাষায় কংগ্রেস-বিরােধী (হিন্দুবিরােধী বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন। তার কথা হলাে ভারতীয় মুসলমান কংগ্রেসের কাছ থেকে কোনাে প্রকার রাজনৈতিক সদাচার আশা করতে পারে না। কংগ্রেস ও হিন্দুত্ববাদ তিনি একাকার করে নেন । তাই মুসলমানদের দাবিদাওয়া তাকে এবং মুসলিম লীগকেই তুলে ধরতে হবে। দায়টা তাদের, অধিকারও তাদের। আর কারাে নয়। এমন কথা জিন্না বুঝিয়ে দেন সবাইকে, যেমন কংগ্রেসকে তেমনি শাসকদের। এ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য কংগ্রেসকে পুরােপুরি হিন্দু সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করতে তার বাধেনি। অভিযোেগ পুরােপুরি সঠিক ছিল না।
আমরা তাই দেখি পৃথক নির্বাচনের সুর্যেগ-সুবিধায় উদ্দীপ্ত জিন্না তার অযৌক্তিক উদ্ধত ভাষায় দাবি রাখেন যে ‘৯৯ শতাংশ ভারতীয় মুসলমান তার সঙ্গে রয়েছে। অবশ্য কিছু সংখ্যক বিশ্বাসঘাতক, বাতিকগ্রস্ত, পাগল বা অতিমানব বাদে’ (উদ্ধৃতি যশবন্ত সিং) তার মতে, গােটা মুসলমান সমাজের পক্ষে কথা বলার অধিকার একমাত্র তারই রয়েছে। এ সময় থেকে বেশ উগ্র ভাষায় বিবৃতি দিতে থাকেন জিন্না জিন্নার এই উক্তি মনে করিয়ে দেবে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় এসে তার অনুরূপ বক্তৃতা যেখানে তিনি ভাষাআন্দোলনে যুক্ত বাঙালি ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের চিহ্নিত করেন। বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী ও ভারতীয় চর হিসেবে যারা পাকিস্তান ভাঙতে বদ্ধপরিকর। এ রকম একাধিক ঘটনা থেকে জিন্না চরিত্রের দম্ভ, অহমিকা, কাঠিন্য ও একনায়কসুলভ মনােভঙ্গি বুঝতে পারা যায় কিন্তু যখন তিনি দাবি করছেন ৯৯ শতাংশ ভারতীয় মুসলমান তার ও মুসলিম লীগের পক্ষে, তখনাে দেখা যাচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানও তার পক্ষে নেই। তাদের সমর্থন বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী অসাম্প্রদায়িক মুসলিম-প্রধান সংগঠনের পেছনে। বাংলা থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এমনকি পাঞ্জাবি পর্যন্ত ১৯৩৭-এর নির্বাচন তা প্রমাণ করে দেয় বাংলায় ফজলুল হকের নেতৃত্বে প্রজাপাটির পক্ষে ভােটসংখ্যা, পাঞ্জাবে সিকান্দার হায়াত খানের সমন্বয়বাদী ইউনিয়নিস্ট পার্টির একাট্টা বিজয়, সিন্ধুতে আল্লাবকশ প্রমুখের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ-বিরােধীদের প্রায় কাছাকাছি সংখ্যক ভােট প্রমাণ করে যে জিন্না বা মুসলিম লীগ তখনাে সমগ্র ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারেনি। এজন্য তাকে প্রায় এক দশক সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে, তখনাে পুরাে হিসেবে নয়। রাজ-এর প্রস্থান ও দেশভাগের পেছনে রয়েছে আরাে কারণ । আবারাে বলতে হয় এ অর্জনে কংগ্রেসের ভুলভ্রান্তি কম অবদান রাখেনি। মুসলমান জনতার সংখ্যাগরিষ্ঠ বা তার কাছাকাছি সমর্থন পাওয়ার যে সম্ভাবনা কংগ্রেসসহ জাতীয়তাবাদী মঞ্চের পক্ষে তিরিশের দশকের শেষ দিকেও দেখা দিয়েছিল তা হিন্দু মহাসভাপন্থীদের উগ্র কর্মসূচিতে এবং কংগ্রেসের অভ্যন্তরে হিন্দু-মহাসভা সমর্থক ও রক্ষণশীল কিছু সংখ্যক নেতার ভূমিকায় নস্যাৎ হয়ে যায়।
মুসলমান জনসমর্থনের গুরুত্ব কংগ্রেস বুঝতে পারেনি। একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, বিশ শতকের প্রথম দিকে পরিস্থিতি সেকুলার রাজনীতির অনুকূল ছিল। জিন্নার নিজ প্রদেশ তৎকালীন বােম্বাই (বর্তমান মুম্বাই)-এর মুসলিম জনতার রাজনৈতিক মানসিকতার হিসাব নিলে তা বােঝা যায়। মুসলমান জনতা এবং মুসলমান রাজনৈতিক নেতাকর্মী বিশের দশকের উত্তপ্ত সময়েও পুরােপুরি মুসলিম লীগের পেছনে ছিল না। একটি ছােট্ট পরিসংখ্যানে দেখা যায় মুসলিম লীগের গুরুত্বপূর্ণ বােম্বাই শাখার সাধারণ সদস্য সংখ্যা ১৯২২ সালে মাত্র ১০৯৩, ১৯২৩ সালে ১০৯৭, ১৯২৫ সালে ১১৮৪ জন (মুসলিম লীগের বার্ষিক রিপাের্ট, উদ্ধৃতি মুশিরুল হাসানের)। এর চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলাে কোরামের অভাবে ১৯২৯ সালে মুসলিম লীগের অধিবেশন স্থগিত করা হয়। এমনকি ১৯৩০ সালে মুসলিম লীগের বহুখ্যাত এলাহাবাদ অধিবেশনে স্যার মােহাম্মদ ইকবালের ঐতিহাসিক ভাষণের সময় (যে সময় ইকবাল ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র অঞ্চলের দাবি তােলেন) ৭৫ জন সদস্যও উপস্থিত ছিলেন না, যা সভার কোরামের জন্য প্রয়ােজনীয় ছিল (হাসান, প্রাগুক্ত)। এ অবস্থা চলেছে তিরিশের দশক অবধি। তবে একথাও ঠিক যে, ১৯৩৫-এর পৃথক নির্বাচন সংবলিত সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ নির্বাচনের সম্ভাবনা সামনে রেখে মুসলিম লীগের পালে বাতাস লাগায় । এর পেছনে ছিল জিন্নার সাংগঠনিক তৎপরতা। আর বড় বিষয় ছিল মুসলমান ভূস্বামী, উঠতি শিক্ষিত শ্রেণির উচ্চাকাক্ষার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছাত্র যুবসমাজের স্বপ্ন যা মুসলিম লীগের স্বাতন্ত্র্যবাদী রাজনীতির পায়ের নিচে কিছুটা ভিত তৈরি করে। তখনাে ভারতের দুই মুসলমান-প্রধান প্রদেশ বঙ্গ ও পাঞ্জাবে সেকুলার জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রাধান্য। কিন্তু বঙ্গে রাজনৈতিক সংগঠনগত কাঠামাে দুর্বল তার প্রমাণ মেলে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যায় এবং লীগ বা প্রজাপার্টি কারাে পক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায়। পরে হক সাহেবের রাজনৈতিক ভুলের কারণে মুসলিম লীগ ওই স্বতন্ত্র আসনগুলাে দখল করে নেয়।
সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারা রক্ষায় শাসনচক্রের সহানুভূতি বরাবরই ছিল মুসলিম লীগের দিকে কারণ লীগ কখনাে ভারতে শাসক-বিরােধী আন্দোলনের সূচনা ঘটায়নি। তাই লীগ-‘রাজ’-এর সুসম্পর্ক বরাবরের ঘটনা- কখনাে গভীর আঁতাত সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদের পর আঁতাত আরাে বেড়েছে। ভারত সচিব জেটল্যান্ড থেকে ভাইসরয় লিনলিথগাে সবাই যথাক্রমে তাদের নীতিতে ও শাসনে এ ধারাই রক্ষা করে চলেছেন। আগস্ট ১৯৩৮-এ জিন্না সরাসরি ভাইসরয়কে প্রস্তাব দেন যে, মুসলিম লীগ ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে সহযােগিতায় প্রস্তুত এমনকি এরকম প্রস্তাবও রাখেন যে, কংগ্রেস-শাসিত প্রদেশগুলােতে মুসলিম স্বার্থরক্ষায় ‘রাজ’ বন্ধু হিসেবে ভূমিকা। নিলে মুসলিম লীগ কেন্দ্রে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি সমর্থন জোগাতে পারে (লিনলিথগাে পেপারস, উদ্ধৃতি যশবন্ত সিং)। সম্প্রদায় স্বার্থে দেশের স্বাধীনতা ও স্বার্থ বিসর্জনের ভাবনাও জিন্নার হাত ধরে মুসলিম লীগের রাজনীতি হয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যে ১৯৩৯ সেপ্টেম্বরে সূচিত বিশ্বযুদ্ধ লীগ রাজনীতির জন্য শাপে বর হয়ে দাঁড়ায় । কংগ্রেস দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এ পরিস্থিতিতে দলীয় মতবিরােধের মধ্যেই রাজ-বিরােধী অবস্থান নেয়। নেয় দেশের সাধারণ মানুষও এমনকি ১৯৪১-এ যুদ্ধের চরিত্রবদল ও কমিউনিস্টদের এ যুদ্ধকে জনযুদ্ধ ঘােষণা করার পরও সাধারণ মানুষের ব্রিটিশবিরােধী মনােভাবের পরিবর্তন ঘটেনি স্বভাবতই শাসকচক্র সাহায্যের জন্য হাত বাড়ায় মুসলিম লীগের দিকে এবং জিন্নাও শাসকদের দিকে তার সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দেন জিন্নার ব্রিটিশ সহযােগিতার ধারা দেশবিভাগের সময় অবধি অক্ষুন্ন থাকে, সেজন্য ১৯৪২-এ কংগ্রেসের ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে অর্থাৎ দেশের স্বাধীনতার আন্দোলন থেকে জিন্না-লীগ দূরত্ব বজায় রেখে চলে যা ইতিপূর্বে আলােচিত। ভারতসচিব জেটল্যান্ডকে পরিস্থিতি অবহিত করতে গিয়ে ভাইসরয় লিনলিথগাে স্বীকার করেন যে, জিন্না কংগ্রেসি আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকারকে মূল্যবান সাহায্য দিয়েছেন যে জন্য তিনি তার কাছে কৃতজ্ঞ।
জিন্না সরকারবিরােধী আন্দোলনে কংগ্রেসকে সমর্থন জানালে রাজ’ সরকারের জন্য তা খুব অসুবিধাজনক হয়ে দাঁড়াত’ (লিনলিথগাে ও ভারতবর্ষ, গওহর রিজভী)। এ বিষয়ে একাধিক ইতিহাস লেখকের বিবরণ একই রকম। সুমিত সরকারও তার ‘আধুনিক ভারত’ গ্রন্থে তথ্যাদিযােগে মন্তব্য করেছেন যে ‘জিন্নাকে ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে টেনে তুলতে রাজশক্তির ভূমিকা ছিল খুবই বড়। স্বভাবতই জিন্না সে সুযােগ নিয়েছেন তার রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য । তবে সে শক্তিবৃদ্ধি স্বাভাবিক পথ ধরে চলেনি। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রকাশ ঘটিয়ে মুসলিম লীগ প্রচারে ও কর্মকাণ্ডে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে সাহায্য করেছে, পরিণামে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। ফলে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের যত অবনতি ঘটেছে মুসলমান জনমত ততই মুসলিম লীগের দিকে ঝুঁকেছে। সমঝােতার কোনাে অবকাশ রাখেনি জিন্নার রাজনীতি। গান্ধি-নেহরুর কথা বাদ দিলেও কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে সুভাষ বসু জিন্নার সঙ্গে সংলাপ, সমঝােতা ও মতৈক্যের যে চেষ্টা চালান তাতে জিন্না সাড়া দেননি। ব্যক্তিগতভাবে জিন্না গান্ধি-নেহরুকে পছন্দ করতেন না, বিশেষ করে নেহরুকে। কিন্তু সুভাষ সম্পর্কে তেমন বিরূপতা তার ছিল না। তবু সমঝােতা হয়নি। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি সুভাষ নন, কংগ্রেস সভাপতি তথা কংগ্রেসের সঙ্গে কোনাে প্রকার আপসে যেতে রাজি ছিলেন না লীগ সভাপতি জিন্না ব্যক্তিসম্পর্কও যে তার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতাে তা দেখা গেছে গান্ধি-নেহরুর সঙ্গে তার সম্পর্কের বিরূপতায়। আবার ভিন্ন কারণে কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আজাদকে সহ্য করতে পারতেন না জিন্না। অথচ আজাদ নেহরুর মতাে অসহিষ্ণু, আবেগতাড়িত ছিলেন না। ছিলেন না বক্তৃতাবিবৃতি বা সংলাপে বেসামাল তবু ধীরস্থির, বিনয়ী, নম্রবাক রাজনীতিক আজাদের সঙ্গে করমর্দন না করার অসৌজন্য দেখাতে পেরেছিলেন জিন্না সিমলা সম্মেলনে। তার বিলেতিকেতায় ও সংস্কৃতিতে এ জাতীয় আচরণ আপত্তিকর হিসেবে বিবেচিত। তবু তিনি ঐ আপত্তিকর কাজ নির্দ্বিধায় করেছিলেন।
এমন এক অস্বাভাবিক মানসিকতা ও তেমনই রাজনীতির পথ ধরে বিভাজিত মুসলমান সমাজের একাংশের রাজনৈতিক প্রতিনিধি মােহাম্মদ আলী জিন্না ওই সমাজের একমাত্র প্রতিনিধিত্বের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। তবে এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত জিন্নার সামনে শিখরে ওঠার সিঁড়ি এগিয়ে দেন দুই আঞ্চলিক নায়ক- বাংলার ফজলুল হক ও পাঞ্জাবের সিকান্দার হায়াত খান। জিন্নার একমাত্র মুখপাত্র হয়ে ওঠার পেছনে এরাই প্রধান নিয়ন্ত্রক শক্তি। যে দুই প্রদেশ নিয়ে জিন্না সর্বদা শঙ্কিত, চিন্তিত সেই দুই প্রদেশের অবিসংবাদী দুই নেতা নিজেদের দল ভেঙে দিয়ে জিন্নার হাতে সব সমর্পণে যেন দায়মুক্ত হলেন। বিষয়টা ইতিপূর্বে আলােচিত। এই দুই প্রদেশের মুসলিম জনসমর্থন পেয়ে মুসলিম লীগের মরাগাঙে ভরাজোয়ার। এর সূচনা অবশ্য ১৯৪০-এ মুসলিম লীগের লাহাের অধিবেশনে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র ভুবনের স্বাপ্নিক প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর থেকে। কিন্তু ভারতের মুসলিম রাজনীতিতে জিন্নার একাধিপত্যের প্রকৃত প্রেক্ষাপট রচিত হয় মুসলিম লীগ থেকে ফজলুল হকের বহিষ্কার ও বঙ্গে লীগ বিরােধী হক মন্ত্রিসভার পতনে এবং সিকান্দার হায়াত খানের অকালমৃত্যুতে । হক মন্ত্রিসভা পতনে অবশ্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা, অন্যায় জবরদস্তির ভূমিকা পালন করেছিলেন বাংলার গভর্নর । যেখানে লীগের সঙ্কট সেখানেই দেখা গেছে। অযাচিতভাবে ‘রাজ’-শাসনযন্ত্রের পরিত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভাব সিন্ধুতেও দেখা গেছে সেখানকার গভর্নরের লীগের পক্ষে অনৈতিক পদক্ষেপ। এ আলােচনা দীর্ঘ হতে পারত একের পর এক ঘটনার বিচারে ১৯৪৭ আগস্ট পর্যন্ত পেীছে । কিন্তু তার প্রয়ােজন নেই যখন জিন্না-প্রশস্তি সত্ত্বেও আয়েশা জালাল লিখতে পারেন যে শক্তিশালী কেন্দ্র সম্পর্কে প্রদেশগুলাের পরিপ্রেক্ষিতে লিনলিথগাে জিন্নাকে মুসলমানপ্রধান প্রদেশগুলাের একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে সক্রিয় হতে উৎসাহিত করেন (পৃ. ৭৪)। জিন্নাকে ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র করে তােলার জন্য ভারতে ব্রিটিশরাজ কতটা ব্যস্ত ছিল তাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিটি পদক্ষেপ থেকে তা বুঝতে পারা যায়। ভাইসরয়দের প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ মদতে জিন্নার দাবি নানামাত্রায় প্রকাশ। পেতে থাকে। এক সময় তিনি সরকারকে বলেন যে, মুসলিম লীগকে কংগ্রেসের। সমমর্যাদা দিতে হবে। অথচ মুসলমান জনসংখ্যা সমগ্র ভারতের একতৃতীয়াংশেরও কম। কিন্তু জিন্না গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পক্ষে নন।
তিনি প্রসঙ্গক্রমে এ কথাও বলেন যে, ভারতে গণতান্ত্রিক সরকার চলবে না, গণতন্ত্রে তার বিশ্বাস নেই। তিনি ভাইসরয়কে স্পষ্ট ভাষায় বলেন যে, সমস্যার একমাত্র সমাধান ভারত বিভাগ বিষয়টা পরে বিস্তারিত আলােচনায় বিবেচ্য এ কারণে যে, আয়েশা জালালসহ একাধিক ইতিহাস লেখক মনে করেন, জিন্না পাকিস্তান চাননি। ওটা ছিল তার দরকষাকষির হাতিয়ার। সবকিছু মিলে অতি সংক্ষিপ্ত বিবেচনায় এটা স্পষ্ট যে, জিন্নার ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে ওঠার চেষ্টায় যেমন স্থানীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ভুলভ্রান্তি অবদান রেখেছে, তেমনি তাতে অনেক বেশি শক্তিমান ভূমিকা রাজশক্তির। তাদের ইচ্ছায় এবং ক্ষেত্রবিশেষে জবরদস্তিতে দেশবিভাগের মধ্য দিয়ে ভারতের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান। তাও আবার হিন্দু-মুসলমান শিখদের রক্তস্রোতের মাধ্যমে আগেই বলেছি স্থানীয় রাজনীতির তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি জিন্নাকে সাহায্য করেছে, বিশেষ করে সাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক প্রাদেশিকতা । এক কথায় আঞ্চলিক রাজনীতি ও ভূখণ্ডপ্রেমের প্রভাব। যার ফলে এমন মনােভাব রাজনীতিতে প্রাধান্য পায় যে, পাঞ্জাব পাঞ্জাবিদের জন্য সিন্ধু সিন্ধিদের জন্য, সীমান্ত অর্থাৎ পাখতুনিস্তান পাখতুনদের জন্য’ একই ধারায় ফজলুল হকও বাংলা-বাঙালি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এ অসাম্প্রদায়িক ধারার জাতীয়তাবাদের নায়ক হচ্ছেন গাফফার খান, সিকান্দার হায়াত খান, আল্লাবকশ এবং বঙ্গের ফজলুল হক। কিন্তু রাজের কূটচালে তাদের প্রাদেশিকতার স্বাদেশিকতা জিন্না-মুসলিম লীগের পক্ষে চলে যায়। এ বিষয়ে সবশেষ কথা হলাে নানামাত্রিক এতাে চেষ্টা সত্ত্বেও জিন্না বা লীগ সমগ্র ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি বা মুখপাত্র হতে পারেনি । স্বতন্ত্র ভুবন ও দেশবিভাগ তথা পাকিস্তান ইস্যুভিত্তিক নির্বাচন সত্ত্বেও পারেনি। ১৯৪৬-এর নির্বাচনের ফলও অংশত তা প্রমাণ করে। ব্যতিক্রম একমাত্র বঙ্গদেশ। সেখানে জিন্না ঠিকই মুসলিম রাজনীতির মুখপাত্র।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক