You dont have javascript enabled! Please enable it!

লীগ-কংগ্রেস দ্বন্দ্বের রাজনীতি

ভারতে মুসলিম লীগ রাজনীতির লক্ষ্য ছিল প্রতিযােগিতাহীন পরিবেশে আত্মােন্নয়নের নিশ্চয়তা, যা ক্রমে স্বতন্ত্র ভুবনের দাবিতে পেীছে আর এ লক্ষ্য অর্জনে সবচেয়ে শক্তিশালী সামাজিক উপাদান ধর্মীয় জাতীয়তার নীতি গ্রহণ এবং এর প্রায়ােগিক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার হাতিয়ার ব্যবহার নেতাদের চোখে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। সে নেতৃত্বে বরাবর উচ্চবর্গীয় ভূস্বামীপ্রধান এবং শিক্ষিত এলিটশ্রেণি  স্বভাবত শেষােক্ত ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমান অনেকটা পিছিয়ে ছিল  এই শ্রেণিস্বার্থ পুঁজি করে মুসলিম রাজনীতির যাত্রা যেমন কংগ্রেসের একটু ভিন্নভাবে  গান্ধি বনাম জিন্না তথা কংগ্রেস বাম মুসলিম লীগ যদি ভারতীয় রাজনীতির দ্বান্দ্বিক চরিত্রের মূল হয়ে থাকে (যা দেশ বিভাগভিত্তিক রাজনৈতিক ইতিহাসে বরাবর বিধৃত) তাহলে এর তত্ত্বগত দিক ছিল শক্তিশালী কেন্দ্রভিত্তিক শাসনব্যবস্থা বনাম প্রাদেশিকু স্বাধিকারভিত্তিক দুর্বল কেন্দ্রের ফেডারেল ব্যবস্থা। খুঁটিয়ে দেখলে এতে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির তত্ত্ব নিহিত ধর্মীয় জাতীয়তাভিত্তিক স্বতন্ত্র ভুবনের রাজনীতি এর ব্যবহারিক দিক উল্লিখিত প্রতিযােগিতার রাজনীতি নিয়ে রাজশক্তির শিখণ্ডিকে সামনে রেখে লীগকংগ্রেসের লড়াই  এ লড়াইয়ের বাস্তবতা বুঝতে প্রধান দুই ব্যক্তিত্ব গান্ধি-জিন্নার ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, চিন্তাভাবনা ও বিশ্বাসের দিকগুলােও বিচার করে দেখতে হয়। সেই সঙ্গে তাদের সহযাত্রী কুশীলবদের এ বিষয়টা কংগ্রেসের ক্ষেত্রে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু মুসলিম লীগের ক্ষেত্রে সেটা খাটে না কারণ সেখানে মােহাম্মদ আলী জিন্নার কথা বা ভাবনা বা সিদ্ধান্তই শেষ কথা বাকি সবাই ‘জি হ্যা’ বলে খালাস- তা যত বড় ভূস্বামী তিনি হােন না কেন এক্ষেত্রে ভূস্বামী লিয়াকত আলী বা মননশীল রাজনীতিক খালিকুজ্জামান একই কাতারে বিপরীত দিকে কংগ্রেস রাজনীতিতে গান্ধি যথেষ্ট শক্তিমান ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও গান্ধিকে নানা চালে নেহরু-প্যাটেল-রাজাগােপালাচারি বা মাওলানা আজাদ প্রমুখকে শান্ত রাখতে হয়েছে। কিন্তু মুসলিম লীগে জিন্না একেশ্বর। 

বলা হয়ে থাকে গান্ধি কংগ্রেস রাজনীতিকে জনগণের আঙিনায় পৌছে দিয়েছিলেন। এর পেছনে ছিল মূলত তার রাজনেতিক আদর্শ- অহিংসা তথা শান্তিবাদ। কারাে মতে, সবার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। সেইসঙ্গে শহরগ্রামের তাত্ত্বিক ঐক্যে ছিল চরকা খাদিখদ্দর, যা ভারতীয় হিন্দুমানসে ব্যাপক প্রভাব তৈরি করে এভাবে তিন দশক সময় গান্ধি কংগ্রেসে, কখনাে কখনাে বিতর্কিতও হয়েও অবিসংবাদী নেতা কংগ্রেসি রাজনীতি তথা ভারতীয় রাজনীতির দুর্ভাগ্য যে কংগ্রেস সংগঠন তার বিকল্প বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্ম দিতে পারেনি বা পারলেও তা সর্বতােভাবে গ্রহণযােগ্য হয়ে ওঠেনি। গান্ধির ব্যক্তিত্ব হডসনের মতে নম্র, বিনয়ী, সদালাপী ভারতীয় বৈশিষ্ট্যের হয়ে অন্তর্নিহিত শক্তিতে বলীয়ান। মূলত তার অহিংসানীতি, অনশনব্রত ইত্যাদির জোরে গান্ধি দ্রুতই কংগ্রেস নেতৃত্ব জয় করে নেন, নিজেকে সবার ওপরে বসাতে সক্ষম হন। তার সনাতন ভারতীয় চরিত্র ভারতীয় হিন্দুমানসকে ব্যাপকভাবে আকর্ষণ করার প্রধান কারণ, অথচ তিনি একজন শিক্ষিত পরিবারের সদস্য এবং বিলেতি শিক্ষায় একজন ব্যরিস্টার কিন্তু রাজনীতিতে সেসব ছাপিয়ে তার সন্ত’ প্রকৃতিই প্রধান হয়ে ওঠে। পশ্চিমাদের কাছে বহুকথিত ‘অর্ধনগ্ন ফকির’ আবার কারাে কারাে বিবেচনায় রাজনীতিতে ছলাকলা ও কূটনীতিতে পারদর্শী ব্যক্তিত্ব  গান্ধি চরিত্রের দুই পাশ্বমুর্থ সত্ত্বেও ভারতীয় রাজনীতি তার প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি  এমনকি সুভাষ-প্রভাবিত বাংলা বা বঙ্গীয় কংগ্রেসও। কারাে কারাে মতে ভারতীয় চারিত্র্যবৈশিষ্ট্যের কারণে গান্ধি তার অহিংসা ও সত্যাগ্রহ নীতি নিয়ে রাজনৈতিক ভুবন দখল করেছিলেন। অবশ্য ভারতীয় হিন্দুদের । যদিও স্বাধীনতা ও স্বাদেশিকতার টানে বেশ কিছুসংখ্যক মুসলমান রাজনৈতিক নেতা কংগ্রেসে যােগ দিয়েছিলেন তবু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনতা বরাবর গান্ধির প্রভাব-বলয়ের বাইরে।  এর প্রধান কারণ আদর্শবাদী আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব সত্ত্বেও তার হিন্দুত্ববাদী বিশ্বাস ও আচরণ যেখানে ব্যতিক্রম সেখানে সমর্থন দেখা গেছে। যেমন গান্ধি-খিলাফত ঐক্য আন্দোলন। এটা কারাে বিচারে সঙ্গতকারণেই রাজনৈতিক সুবিধাবাদ, যা অবশেষ বিচারে ফলপ্রসূ হয়নি। তার বহু-উচ্চারিত রামধুনের সর্ববাদী পঙক্তি ঈশ্বর-আল্লাহ তেরে নাম সবকো সম্মতি দে ভগওয়ান’ মুসলিম-মানসে প্রভাব রাখেনি। 

এর একটা প্রধান কারণ হতে পারে নিম্নবর্গীয় মুসলমান বিশেষ করে দরিদ্র বঙ্গীয় কৃষক কারিগর শ্রেণি গান্ধিরাজনীতি থেকে কোনাে সুবিধা পায়নি। বরং গান্ধিরাজনীতি আদর্শগত দিক থেকে জমিদার ভূস্বামী ও বৃহৎ বণিক মুৎসুদ্দি শ্রেণির স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যা তৃণমূলস্তরের বিত্তহীনদের স্বার্থের বিপরীত চরিত্রের । তাই শুকনাে রামধুন সংগীতে মুসলমান স্বার্থের চিড়ে ভেজেনি। এসবের সুযােগ-সুবিধা নিয়েছিলেন মােহাম্মদ আলী জিন্না এবং তা মুসলিম লীগ রাজনীতির ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছিলেন। ব্যবহার করেছিলেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতেও। এ ক্ষেত্রে মােহাম্মদ আলী জিন্নার ব্যক্তিত্ব ও চারিত্র্য বৈশিষ্ট্য তাকে খুবই সাহায্য করেছিল। সাহায্য করেছিল রাজনৈতিক পরিবেশ, কিছু ঘটনা, সর্বোপরি ভারতীয় রাজের কম-বেশি নানামাত্রিক সমর্থন। অবশ্য সেটা তাদের প্রয়ােজনে কংগ্রেস-লীগ দুটো সংগঠনই রাজশক্তির সহায়তায় গঠিত তা সত্ত্বেও এই দুয়ের রাজনেতিক যাত্রা ছিল সম্পূর্ণ বিপরতি দিকে। যেমন এক পর্যায় থেকে বিশেষ বিশেষ সময়ে অহিংসার প্রবক্তা গান্ধি নেতৃত্বেই রাজবিরােধী অসহযােগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, সবশেষে “ইংরেজ ভারত ছাড়’ আন্দোলন শাসকদের রীতিমতাে বেকায়দায় ফেলে দেয়  আর চরমপন্থী সুভাষ বসুর ভূমিকা তাে বরাবরই প্রচণ্ড রকম রাজবিরােধী কিন্তু মুসলিম লীগ? প্রাক জিন্না-পর্বে বা জিন্নার নেতৃত্বে কখনন শাসকবিরােধী গণআন্দোলনের জন্ম দেয়নি মুসলিম লীগ। দেশের স্বাধীনতা অর্জনের দাবিতেও জিন্না বা লীগ কোনাে প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তােলেনি জিন্নাসহ শীর্ষলীগ নেতাদের কাউকে দেশের স্বার্থে কারাবাস করতে হয়নি শাসকদের সঙ্গে সমঝােতার রাজনীতি, কখনাে মুসলমানদের রাজনেতিক-অর্থনৈতিক অধিকারের দাবিতে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আর কংগ্রেসের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের মধ্যদিয়ে চলেছে জিন্না-লীগের রাজনীতি। মােটামুটি হিসেবে ত্রিশের দশক থেকে অবশ্য এর জন্য কংগ্রেসের ভুলভ্রান্তির দায়ও রয়েছে।  তাই বলে একজন রাজনীতিক আইনজীবী হয়ে দেশের স্বাধীনতা। আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট হবেন না বা নিজের মতাে করে সেদিকে পথ তৈরি করবেন জিন্না- এটা ভাবতে বড় অদ্ভুতই লাগে। তবু এটাই সত্য,এটাই বাস্তবতা। তবে এর পেছনে কারণও রয়েছে।

আর তা হলাে তার চারিত্র্যবেশিষ্ট্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার ব্যক্তিগত জীবন (পারিবারিক) ও রাজনৈতিক জীবনের (সাময়িক) হতাশাজনিত প্রতিক্রিয়া। পারিবারিক ক্ষতিটা মেরামত করা যাবে না ধরে নিয়েই জীবিকা (আইন। ব্যবসা) ও রাজনীতি পুরােপুরি জীবনের সঙ্গী করে নেন জিন্না। তাতে তার ব্যক্তিত্ব-বৈশিষ্ট্যের অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটে তার স্বভাব-শীতল প্রকৃতি ও উপভােগ্য একাকিত্ব লক্ষ্য অর্জনে পুরােপুরি সহায়তা করে পশ্চিমা ধাচের পােশাক ও মানসিকতা দুই-ই তাকে স্বদেশের মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে রাজনীতির সঙ্গে জনগােষ্ঠীর একটা অবিচ্ছেদ্যসম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও জিন্না রাজনীতিক হয়েও সত্যিকার অর্থে জননেতা ছিলেন না তিনি তা হতেও চাননি  এদিক থেকে তিনি গান্ধির একেবার বিপরীত মেরুতে তিনি এলিট শ্রেণির রাজনীতিক  জনতার আবেগ ও সমর্থন তিনি উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ব্যবহার করেছেন। তার রাজনৈতিক লক্ষ্য যদি সম্প্রদায় বিশেষের স্বার্থের অনুকূল হয়ে থাকে তাে ভালাে কিন্তু মূল রাজনীতিটা তার অহমবােধ, তার লক্ষ্য অর্জনে সমর্পিত । তাই রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের প্রবক্তা হয়েও নিছক ব্যক্তিগত কারণে তার পক্ষে বিপরীত পথে চলা সম্ভব হয়েছিল  বিষয়টা আদর্শগত হলে এমন পরিবর্তন সহজ হতাে না। ব্যক্তিক কারণ স্বাদেশিকতার ঊর্ধ্বে প্রাধান্য পেত না  কিন্তু জিন্নার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল, একজন অভিজাত রাজনীতিবিদ জনস্বার্থের টানে নয়, ব্যক্তিক প্রতিশোধের বােধ থেকে তার পূর্বধ্যান-ধারণা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে অসাম্প্রদায়িকতার পরিবর্তে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিকে তার লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। তাই মে ১৯২৪ সালে যে জিন্না ঐক্যের কথা বলেন সেই জিন্না একযুগ পর অর্থাৎ ১৯৩৬ সালের মার্চ মাসে এর ঠিক বিপরীত কথা বলেন। বলেন যে, হিন্দু-মুসলমানকে স্বতন্ত্রভাবে নিজ নিজ সাম্প্রদায়িক ধারায় সংগঠিত হতে হবে (হডসন)।  বছর দেড়েক পর তিনি এক বক্তৃতায় মুসলমানদের আলাদা জাতি হিসেবে চিহ্নিত করে দ্বিজাতিতত্ত্বের আভাস দেন। হিন্দুস্তান শুধু হিন্দুদের জন্য যার অর্থ মুসলমানদের জন্য দরকার স্বতন্ত্র বাসস্থান গান্ধির মতে এটা তার এক ধরনের যুদ্ধ ঘােষণা’  এরপরই তার রাজনৈতিক আত্মােনন্মাচন, ১৯৪০ মার্চে ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব’ যার অর্থ স্বতন্ত্র ভুবনের দাবি (পাকিস্তান) এরপর আর তিনি পেছন ফিরে তাকাননি। ইতিপূর্বে প্রবর্তিত ব্রিটিশরাজের ‘সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ’ (১৯৩৫) অর্থাৎ কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড তার রাজনীতির ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায় আর সেই স্বতন্ত্র নির্বাচন ও যে কোনাে মূল্যে ভারতীয়। মুসলিম স্বার্থরক্ষার রাজনীতি তার একমাত্র রাজনীতি হয়ে দাড়ায়।  

জিন্না-রাজনীতির সাম্প্রদায়িক চরিত্র বদলের কারণ ভিন্ন ভাষায় হলেও ভারতবিভাগ বিষয়ক ইতিহাস লেখকরা প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন। কংগ্রেস রাজনীতির সঙ্গে চলতে গিয়ে তার আহত অহমবােধ উদ্ধার জিন্নার রাজনৈতিক লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। সেটা হয়ে ওঠে তার রাজনৈতিক আদর্শ। হডসন দুটো কারণেই সমান গুরুত্বারােপ করেছেন, যা আগে বলা হয়েছে। (‘ব্যক্তিক কারণ ও রাজনৈতিক বিশ্বাস’)। দুটো কারণই তাকে তিরিশের দশকের শেষদিক থেকে চল্লিশের দশকে পৌছে ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবক্তা’ করে তােলে। মুসলিম জাতীয়তাবাদ ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ছাপিয়ে তার কাছে চরম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় তার গর্ব, তার অহঙ্কারের জায়গাটিকে পরিপূর্ণ মর্যাদায় তুলে ধরা তার লক্ষ্য হয়ে ওঠে  সেজন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে তৈরি ছিলেন জিন্না।এজন্য তাকে মাত্র দুই দশক সময় নানা তৎপরতায় ব্যয় করতে হয়েছে (হডসন)। আর যশবন্ত সিং বলেছেন: কংগ্রেসের সমগ্রতাবাদ (টোটালিটারিয়ানিজম) অবশেষে জিন্নাকে সমপ্রদায়বাদীতে পরিণত করে’ (পৃ. ২০৬)। বাঙালি মুসলিম লীগ রাজনীতিক কামরুদ্দীন আহমদও মােটামুটিভাবে জিন্নার রাজনৈতিক পালাবদলের পেছনে ব্যক্তিগত কারণটাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছেন। খুব কাছ থেকে দেখা ও জানার অভিজ্ঞতা থেকে জনাব কামরুদ্দীন তাকে মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। তার ভাষায়, নইলে চল্লিশ বছর বয়সে আঠার বছরের মেয়ে রতন বাঈকে কেন বিয়ে। করেছিলেন।… এটা ভালবাসা না একটা ধনী নাইট পার্সীকে অপদস্থ করার মানসিক আকাক্ষা’ (বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৩-৯৪)। এমনকি সাংবাদিক গাস্থারের মতামত উদ্ধার করে তিনি জিন্নাকে ‘অস্বাভাবিক। লােক’ ও ‘একনায়ক হিসেবে ভাবতে চেয়েছেন। প্রশ্ন তুলেছেন তার গভর্নর জেনারেল’ হওয়া নিয়ে। শেষােক্ত বিষয় নিয়ে আরাে কেউকেউ একই প্রশ্ন। তুলেছেন গান্ধির সঙ্গে তুলনা করে। আর মাউন্টব্যাটেনের মতে, ‘জিন্না এক সাইকোপ্যাথিক কেস’ (TOP, Vol.X P190)।

আরাে একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে, জিন্না তার রাজনেতিক জীবনের প্রথম দিকে যতই সাম্প্রদায়িক ঐক্যের কথা বলুন না কেন তিনি রাজনীতি শুরু করেন ‘আঞ্জুমানে ইসলামে’ যােগ দিয়ে (১৮৮৭)। এরপর মুসলিম লীগ, মাঝখানে কংগ্রেসের অধিবেশনে যােগ দেয়া এবং সম্পর্ক রেখে চলা । কিন্তু নওরােজির ভাবশিষ্য হয়েও কখনাে কংগ্রেসে যােগ দেননি তার একমুখী চিন্তা ও চলা’র কথা অনেকে বলেছেন। সে ক্ষেত্রেও অন্যদের সঙ্গে ঐকমত্যে হেক্টর  বলিথাে জিন্নাকে ব্যবহারের দিক থেকেও অতীব শীতল ও দূরপ্রান্তের মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন (‘ইন কোয়েস্ট অব জিন্না’)। টুপি শেরােয়ানি ভূষণ। হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত জিন্না পােশাকে এবং পরেও অর্থাৎ বরাবরই বিলেতি সাহেবী কেতার মানুষ। তাই ধর্মের জন্য রাজনীতি নয়, তার রাজনীতির জন্য তিনি ধর্মকে (ইসলাম) হাতিয়ার হিসেবে তুলে নেন। অন্যদিকে গান্ধির হিন্দুত্ববাদিতা, গােরক্ষা তার বিশ্বাসের অংশ আর অহিংসা তার রাজনৈতিক হাতিয়ার। সর্বোপরি মাথা থেকে পা পর্যন্ত তিনি সনাতন ভারতীয় এবং প্রাচীন ভারতীয় চেতনার প্রতীক এমন দুজন নেতার তুলনামূলক বিশ্লেষণ চলে, কিন্তু দুজনের একপথে যাত্রা কখনাে সম্ভব নয়। স্বভাবে, বিশ্বাসে, কর্মে দুজন সম্পূর্ণ দুই মেরুর বাসিন্দা। যশবন্ত সিংয়ের উদ্ধৃতিতে জিন্না গান্ধিকে শুধু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন না, ভাবতেন ‘একজন ভঙ্গীসর্বস্বক, কপট ও আত্মম্ভরী’ রাজনীতিক হিসেবে। এমন বিপরীতপস্থার দুই রাজনীতিকের এক গালিচা দূরে থাক, এক কাতারে চলাও সম্ভব ছিল না। এ সত্য জিন্না বুঝলেও গান্ধি বুঝতে চাননি। তাই দুজনের যাত্রা দুই বিপরীত দিকে বিশেষত স্বদেশী রাজনীতির ক্ষেত্রে। অশেষ তিক্ততায়। বিষয়টা মনোেযােগী বিচারেও প্রর্মনই দাঁড়ায়- দুই বিপরীত রাজনৈতিক তত্ত্ব ও লক্ষ্য নিয়ে বিপরীত চরিত্রের দুই রাজনেতিক নেতার পথ চলা দ্বান্দ্বিক না হয়ে পারে না। বাস্তবে হয়েছেও তাই। স্বভাবতই ভারত বিভাগকে রাজনেতিক নিয়তি নির্ধারিত বলে ভাবা যেতে পারে। অনেকে মনে করেন তা অনিবার্য ছিল । কিন্তু ঘটনা তা অনিবার্য করে তােলে। আর সেসব ঘটনার অধিকাংশই রাজনীতির উল্লিখিত দুই নায়কের তৎপরতায় এবং তাদের হাত ধরে। রাজনেতিক পরিবেশও তাদের সহায়তা করেছে।

অথবা বলা চলে তারা সে পরিবেশ তাদের জন্য সহায়ক করে তুলেছেন। তবে সে ক্ষেত্রে ভারতীয় মুসলিম নেতা সবাই একটি বিষয়ে সােচ্চার ছিলেন এবং তা হলাে ভারত শাসনের ফেডারেল ব্যবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ যা সংখ্যালঘু মুসলিম স্বার্থরক্ষায় সাহায্য করবে।  খিলাফত নেতা মাওলানা মােহাম্মদ আলী মৃত্যুর আগে তার শেষ ইচ্ছা জানাতে গিয়ে (জানুয়ারি, ১৯৩১) বলেছিলেন যে ভারতের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে ছােটখাটো বেনিয়া গােষ্ঠী তৎপর। এদের তিনি চান না। তার চেয়েও বেশি অনাকাক্ষিত বিদেশি বেনিয়ারা (তার ভাষায় ‘দোকানদার জাতি’) এদেশ শাসন করুক। অন্যদিকে স্বতন্ত্রনির্বাচন বাদ দিয়েই ১৪ দফার মর্মবস্তু নিয়ে ফেডারেশন পঠিত হােক যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যালঘুর স্বার্থ ক্ষুন্ন করবে না  তিনি প্রাদেশিক কর্তৃত্বের দাবি উল্লেখ করে বলেন যে, ‘সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান না হলে ভারতে গৃহযুদ্ধ বাধবে।’ কংগ্রেস সভাপতি হয়েও মাওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রায় একই সুরে। কথা বলেছেন তার ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ বইতে। তার মতে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মধ্য দিয়েই বহু জাতি, বহু ভাষা ও সংস্কৃতির দেশ ভারতে ফেডারেল শাসনব্যবস্থায় সংখ্যালঘু জনগােষ্ঠীর ভয়ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতার মনােভাব দূর করা সম্ভব। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতি, এমনকি কংগ্রেস রাজনীতিও ওই পথ ধরে হাঁটেনি। উল্লিখিত সংখ্যালঘুতত্ত্ব শিখদের বেলায় প্রযােজ্য হওয়ার কথা ওই তাত্ত্বিকদের মনে আসেনি। বরং শাসকরাজ মুসলমানদের রাজনৈতিক খেলায় দাবার ঘুটি হিসেবে ব্যবহারের জন্য বিশ শতকের শুরু থেকেই সংখ্যালঘুতত্ত্বের আলােকে শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের প্রস্তাব উত্থাপন করে এসেছে, যার সর্বশেষ কার্যকর ব্যবস্থা ১৯৩৫ সালের সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ (কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড)। স্বতন্ত্র নির্বাচন ও প্রাদেশিক ক্ষমতা5)এর মুখ্য বিষয় এতে ভারতীয় জনগােষ্ঠীকে (যদি জাতি কথাটা ব্যবহার না করাও হয়) বিভক্ত করার অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে কংগ্রেস ও জতিীয়তাবাদী মুসলমান নেতৃবৃন্দ লেখায় ও বক্তব্যে প্রতিবাদ করেছেন, যদিও জিন্না ও মুসলিম লীগ এর পক্ষে তাদের সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছে। জিন্নার ভাষা তখন বেশ তীব্র   তার মতে, ‘হিন্দু দাসত্ব থেকে মুক্তি তাদের লক্ষ্য (স্ট্যানলি উলপার্ট)। উলপার্টও জিন্নাকে শীতল রক্তের অসীম ধৈর্যের ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করেছেন  মাওলানা মােহাম্মদ আলীর দাবি ও বক্তব্য সঠিক হলেও কিছু প্রশ্ন মাথা তুলে দাঁড়ায়। যেমন মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে মুসলিম শাসনের প্রাধান্য চাইলে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশেও একই নীতি মানতে হয় ।

কিন্তু সে ক্ষেত্রে  জিন্না ও লীগের অভিযােগের অন্ত ছিল না। এ ধরনের স্ববিরােধিতা উভয়দিক থেকে ভারতীয় রাজনীতিকে ক্রমে সংঘাতের পথে নিয়ে গেছে। অথচ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সত্ত্বেও কেউ গণতান্ত্রিক বিকল্প ব্যবস্থার কথা বলেন নি  বলেন নি সম্প্রদায়বাদী রাজনীতির বদলে জাতি ও ভাষাভিত্তিক ফেডারেশন। গঠনের কথা। যেমন বাঙালি, ওড়িয়া, তামিল, তেলেগু, মালায়ালাম, মারাঠি, গুজরাটি ভাষিক জাতিগােষ্ঠীর কথা। এতে সাম্প্রদায়িক সংঘাত এড়ানাে সম্ভব হতাে।  এমনকি সমাজবাদী হিসেবে পরিচিত জওহরলাল এমন প্রস্তাব তুলতে পারতেন কিন্তু তিনিও তা করেননি বরং শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষে ওকালতি করে তিনি ড. মাহমুদকে বলতে পেরেছেন; ‘প্রদেশের ক্ষমতায়নের আমি বিরােধী  তাতে প্রাদেশিকতার প্রবণতা বাড়বে। হুবহু একই কথা বলে ছিলেন জিন্না ১৯৪৮ সালের মার্চে ঢাকা সফরে এসে তার বক্তৃতায়, এবং তা আরাে কঠোর ভাষায়  জিন্না না বুঝতে চাইলেও সমাজবাদী ধ্যান-ধারণার সঙ্গে ভালােভাবে পরিচিত জওহরলালেরতাে ‘জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বিষয়ক’ লেনিনীয় ধারণার বিষয়টি না জানার কথা নয়। যে গান্ধি বিচক্ষণ ও সহিষ্ণু রাজনীতিক হিসেবে বহুর চোখে শ্রদ্ধেয়, তিনিইবা বিলেতে গােলটেবিল বৈঠকে কীভাবে বলেন, কংগ্রেস ভারতীয় জনতার একমাত্র প্রতিনিধি এবং তা ধর্মবর্ণ ও সংগঠন নির্বিশেষে (১৯৩১) হয়তাে তাই প্রায় এক দশক পর জিন্নার দাবি তিনি ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র’ (‘সােল শােকসম্যান’- আয়েশা জালাল)  গােলটেবিল বৈঠকের ব্যর্থতা ও দলগুলাের বা প্রতিনিধিদের চরম অনৈক্যই সম্ভবত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামজে ম্যাকডােনাল্ডকে কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড প্রণয়নে (১৯৩২) উৎসাহী করে তােলে  ওই একই বিষয়ে একাধিকবার জওহরলাল নেহরুর অদূরদর্শী উক্তিও বিস্ময়কর  তার মতে, রাজনেতিক সংলাপের পক্ষে ভারতে শুধু দুটো শক্তি রযেছে- এক কংগ্রেস, দ্বিতীয় শাসকরাজ  স্বভাবতই জিন্না এর প্রতিবাদে বলবেন, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে দুটোই দল কংগ্রেস ও লীগ, সেখানে তৃতীয় শক্তি শাসকরাজ। কাজেই কোনাে সংলাপই লীগ বা জিন্নাকে বাদ দিয়ে হতে পারে  ‘সােল স্পােকসম্যান’-এর পক্ষে পুরাে যুক্তি না থাকলেও তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের রাজনৈতিক প্রতিনিধি তাে মুসলিম লীগ এবং তার একচ্ছত্র সভাপতি জিন্না সেক্ষেত্রে লীগ ও জিন্নাকে পাশ কাটানাে কংগ্রেস নেতাদের জন্য সঠিক পদক্ষেপ ছিল না  অবশ্য অনুরূপ মত প্রকাশ করেন মাওলানা আজাদ। এভাবে লীগ-কংগ্রেসের দ্বন্দ্ব এবং শাসক ইংরেজের চাতুর্য পর্যায়ক্রমে ভারত বিভাগের পথ তৈরি করতে থাকে এবং এ ক্ষেত্রে ১৯৩৫-এর প্রস্তাব। ভারতীয় রাজনীতির সাম্প্রদায়িক যাত্রার পাকা সড়ক তৈরি করে দিয়েছিল। 

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!