1971.09.17 | ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ | আজকের এদিনে (with references)
১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ আজকের এদিনে
মুজিবনগরে জয়বাংলা পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মুস্তাক আহমেদ বলেছেন জাতিসংঘের আসন্ন সাধারন পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছে। দলটি আগামী ২০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক যাত্রা করবে। তিনি বলেন দলটি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তিনি বলেন বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করছে তবে অধিবেশনের আগে কয়েকটি দেশের স্বীকৃতি পেলে বাংলাদেশের জন্য ভাল হত। তিনি বলেন বাংলাদেশ অধিবেশনে যে সকল প্রশ্ন তুলবে সে গুলি হল শেখ মুজিবের মুক্তি, শরণার্থী সমস্যা, বাংলাদেশে পাক বাহিনীর গণহত্যা। তিনি বলেন এ সফরে তিনি জাতিসংঘ ছাড়াও আরও কয়েকটি দেশ সফর করবেন। [কালান্তর/আনন্দবাজার ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
জাতিসংঘ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করবেন লণ্ডনস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী। অপর সদস্যরা হচ্ছেন আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য শ্রী ফণীভূষণ মজুমদার এমপিএ, সৈয়দ আবদুস সুলতান এমএনএ, জনাব সিরাজুল হক এমএ্নএ (আইন মন্ত্রীর পিতা), ডঃ মফিজ এমএনএ, আজহারুল হক এমপিএ, জনাব সাহাবুদ্দিন আহমদ এম পিএ, জনাব এমএ সামাদ(আজাদ) এমএনএ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ এআর মল্লিক, ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণাকারী সাবেক পাকিস্তানী কূটনীতিক জনাব এএফএম, আবুল ফতেহ ও জনাব খুররম খান পন্নী । প্রতিনিধিদলের অপর ৪ জন সদস্য হচ্ছেন এমআর সিদ্দিকী এমএনএ, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, জনাব এসএ করিম ও জনাব এ, এমএ মুহিত। [কালান্তর/আনন্দবাজার ১৯/২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডাঃ এ.এম. মালিক ১০ সদস্যের প্রাদেশিক মন্ত্রীসভার নাম ঘোষণা করেন। মন্ত্রীসভার এ তালিকায় পিডিপি ও কাইউম মুসলিম লীগের এর কোন মন্ত্রী নেই।
মন্ত্রীরা হলেনঃ
রংপুরের আবুল কাশেম, কাউন্সিল মুসলিম লীগ
কুষ্টিয়ার নওয়াজেশ আহমদ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ
বরিশালের আখতার উদ্দিন খান, কনভেনশন মুসলিম লীগ
ঢাকার এ.এস.এম. সোলায়মান, কেএসপি
বগুড়ার আব্বাস আলী খান, জামাতে ইসলামী
খুলনার মওলানা এ.কে.এম.ইউসুফ, জামাতে ইসলামী
পাবনার মওলানা মোহাম্মদ ইসহাক, নেজামে ইসলাম
নোয়াখালীর ওবায়েদুল্লাহ মজুমদার, ক্লিন আওয়ামী লীগ
চট্টগ্রামের অধ্যাপক শামসুল হক, ক্লিন আওয়ামী লীগ
পার্বত্য চট্টগ্রামের আউংশু প্রু চৌধুরী, স্বতন্ত্র
আউংশু প্রু চৌধুরী ব্যাতিত বাকী ৯ জন মন্ত্রী শপথ গ্রহণ করেন। [পাকিস্তান, ইত্তেফাক, সংগ্রাম ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লেঃ জেনারেল নিয়াজী ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা সফর করেন। নেত্রকোনায় নিয়াজি এক জনসভায় জনতার উদ্দেশে বলেন এ অঞ্চলের মুসলমানেরা কি উদ্দেশে নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন আবাস ভুমি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল তা তরুন জনগণকে শিক্ষার জন্য তাগিদ দেন। এই সকল বিপথগামী তরুণরা তাদের পিতৃপুরুষদের প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান ধ্বংসের অপচেষ্টা চালাইতেছে। তাদের এই কার্যক্রম নিজেদের গলায় নিজেদের ছুরি মারার সমান। ভারতের প্ররোচনায় এধরনের কাজ বিশেষ লজ্জাকর। তিনি নেত্রকোনাবাসীদের তাদের এলাকায় শান্তি রক্ষা কমিটি, রাজাকার, মুজাহিদ, আলবদর বাহিনী গঠন করায় তাদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। নিয়াজি পরে স্থানীয় সামরিক দপ্তরে যান সেখানে মুক্তিবাহিনী থেকে উদ্ধারকৃত অস্রশস্র তাকে দেখানো হয়। সেখান থেকে তিনি ইটনা যান এবং সেখানে ভারত প্রত্যাগত কতক আওয়ামী কর্মীদের সাথে দেখা করেন। পরে তিনি কিশোরগঞ্জে তারাইলে রাজাকার আলবদদের সঙ্গে মিলিত হন এবং এক জনসভায় ভাষণ দেন। [পাকিস্তান, ইত্তেফাক, সংগ্রাম ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
ঢাকা থেকে করাচী পৌঁছে পিডিপি প্রাদেশিক প্রধান নুরুল আমীন বলেছেন এ এম মালিকের সরকার গঠনের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির উন্নতির ব্যাপারে আশার সঞ্চার হয়েছে। তিনি বলেন মালিক সাহেবের মন্ত্রীসভায় তার দলের অংশ গ্রহনের ব্যাপারে প্রার্থী মনোনয়নের জন্য দল তাকে ক্ষমতা দিয়েছে। তিনি এখনও এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তিনি বিভিন্ন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি বলেন পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগ দায়ী। [পাকিস্তান, ইত্তেফাক, সংগ্রাম ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
ক্যাপ্টেন শফিকুল্লাহ এর অধিনায়কে মুক্তিবাহিনী ৮ নং সেক্টরের কলারোয়া থানার বালিয়াডাঙ্গা এলাকায় (মেজর রফিক তার বইয়ে ৯ বেলুচ উল্লেখ করেছেন পাকবাহিনির ৯ বেলুচ এই নামে কোন ব্যাটেলিয়ন খুলনা বা প্রদেশেই ছিল না) এর একটি কোম্পানির সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। পরে ক্যাপ্টেন এআর আজম এর বাহিনীতে যোগ দেয়। ২ দিন তীব্র সংঘর্ষ হয়। ক্যাপ্টেন শফিকুল্লাহ এই যুদ্ধে গুরুতর আহত হন। তার যায়গায় ক্যাপ্টেন মাহবুবকে পাঠানো হয়। ক্যাপ্টেন মাহবুব গোলার আঘাতে আহত হন। ক্যাপ্টেন এআর আজম পিছু হটে আসেন। পাকিস্তানীদের ক্ষতি বেশি হয় মুক্তিবাহিনীর ৮ জন নিহত হয় ২ জন বর্ণিত অফিসার সহ অনেক আহত হয়। সুবেদার মেজর তবারক পাক বাহিনীর হাতে বন্দী হন। তার উপর অনেক নির্যাতন করা হয়। [সেক্টর ভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধ, মেজর রফিক]
পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ইউনিসেফ এবং জাতিসংঘের অপরাপর ত্রাণ-প্রতিষ্ঠান সমূহের যাবতীয় গাড়ী ও যানবাহন সামরিক কাজে ব্যবহার করছে বলে বাংলাদেশ সরকার লন্ডনস্থ মিশনের মাধ্যমে জাতিসংঘকে অভিযোগ জানিয়েছে।
১৯৭০ সালের ভয়াবহ বন্যা ও ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের সাহায্যের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র বিপন্ন মানবতার সেবায় যেসব ত্রান-সামগ্রী পাঠিয়েছিল সেগুলোও সামরিক শাসকেরা সামরিক কাজে ব্যবহার করছে।
লন্ডনে বাংলাদেশ সমর্থনের দায়ে আটক নিসেস এইচবি তালুকদারকে আজ বো স্ট্রীট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হলে সেখানে বিপুল সংখ্যক বাঙ্গালী উপস্থিত হয়ে বাংলাদেশের পক্ষে স্লোগান দেয়। তিনি বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদ আহ্বায়কের স্ত্রী। ১৫ আগস্ট পাকিস্তানীরা বাংলাদেশ বিরোধী মিছিল সমাবেশকালে মিসেস এইচ বি তালুকদার সমাবেশ ও মিছিলের কাছে পাকিস্তান সমর্থকদের স্লোগানের প্রতিবাদ স্বরূপ বাংলাদেশের পক্ষে শ্লোগান দেন। পাকিস্তানীরা সে মিছিলে শেখ মুজিব এবং ইন্দিরা গান্ধীর ফাঁসি দাবী করে স্লোগান দিয়েছিল। [যুগান্তর ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে তাঁর বাসভবনে লোকসভার সদস্য প্রবোধ চন্দ্রের বাংলাদেশ রক্তস্নান বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন। বইয়ের পৃষ্ঠা মোট ৩০০। অনুষ্ঠানে আগতদেরকে বইটি উপহার হিসেবে দেয়া হয়। প্রবোধ চন্দ্র বই লেখার জন্য দীর্ঘদিন শরণার্থী শিবির ও মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গিয়েছিলেন।এ অনুষ্ঠানে প্রবোধ চন্দ্র তার মাসিক ভাতা বাংলাদেশ সরকারকে দান ঘোষণা করেছেন এবং বই থেকে প্রাপ্ত অর্থও বাংলাদেশ সরকারকে দান করবেন বলে জানান। [পিটিআই/কালান্তর ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
ভারতের পররাষ্ট্র বিষয়ক নীতি নির্ধারণ কমিটির চেয়ারম্যান ডিপি ধর কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সাথে তার আলাপের পর এ ধারনা জন্মেছে পাকিস্তানী শাসকদের পক্ষে বাংলাদেশ দীর্ঘকাল দখল করে রাখা অস্বাভাবিক ব্যাপার হবে। তিনি বলেন যেভাবে জাতি এক হয়েছে তার নজীর পৃথিবীতে বিরল। তিনি বলেন পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের জনগনের কাছে জবাবদিহি করার দায় নেই বলে তারা যথেচ্ছ দমন পীড়ন করছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব নিয়ে তিনি কোন বিরোধ দেখছেনা। তিনি বলেন তাদের এরুপ ঐক্য আগে দেখা যায়নি। তিনি বলেন প্রধান মন্ত্রীর মস্কো সফরের চারদিন আগে তিনি মস্কো যাবেন। স্বীকৃতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন যখনই তার সরকার মনে করবে তখনই তারা বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিবে। তিনি বলেন আমেরিকা বা চীনের সাহায্যে পাকিস্তানের অর্থনীতির আর পুনরিজ্জিবন হবে না। তিনি বলেন বাংলাদেশের সদস্যরা জাতিসংঘে সরাসরি কিছু বলতে পারবে না তাদের হয়ে সদস্য কোন রাষ্ট্র কথা বলবে। তিনি বলেন আবারো তিনি আগামী ৭ অক্টোবর কলকাতা আসবেন। ডিপি ধর জানান, তিনি রাতেই দিল্লি ফিরে যাচ্ছেন। সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা এবং মুক্তিবাহিনীর সাফল্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন দেবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের স্বার্থে প্রয়োজন দেখা দিলেই স্বীকৃতি দেওয়া হবে। [পিটিআই/কালান্তর ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
আগামীকাল থেকে ৩ দিন দিল্লীতে বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সম্মেলনে ৩০ দেশের প্রতিনিধি অংশ নিবেন। ভারতের দুই কম্যুনিস্ট পার্টি দলীয়ভাবে সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে না। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের কাছে পাঠানো বার্তায় বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্মেলন আন্তর্জাতিক সমাজের বিবেককে জাগাতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের পথ সন্ধান শিগগিরই পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। [ইউএনআই/পিটিআই/কালান্তর ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
বাংলাদেশ আইনজীবী সমিতি জানিয়েছে তারা প্রবাসে বাংলাদেশ আইনজীবী সমিতির কমিটি গঠন করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মুস্তাক আহমেদকে সভাপতি হাজী আব্দুল খালেককে সাধারন সম্পাদক করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। [পিটিআই/কালান্তর ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
জাতিসংঘ গামী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা কলকাতায় জড়ো হচ্ছেন। তারা ১৫ ট্রাঙ্ক কাগজপত্র সাথে নিয়ে যাচ্ছেন। [পিটিআই/কালান্তর ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
Prepared by Salah Uddin