সাম্প্রদায়িক ঐক্য-অনৈক্য ও রাজকীয় দমননীতি
বস্তুত ১৯১৮-র সহিংসতা সাম্প্রদায়িক বিরূপতার যে সূচনা ঘটায় তা সমাজে অবাঞ্ছিত স্থায়ী উপাদানেরও সংযােজন ঘটায়। সমাজ ও রাজনীতি থেকে এর স্থায়ী প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, তাৎক্ষণিক উপশমক ব্যবস্থা ছাড়া । অথবা যা নেয়া হয় তা সমাজে স্থায়ী প্রভাব রাখতে যথেষ্ট ছিল না। তাছাড়া মসজিদের সামনে বাদ্য-বাজনা ও কোরবানি নিয়ে দেশব্যাপী কত যে হাঙ্গামা- ছােট বা বড়, বছরের পর বছর- সমাজপতি বা রাজনীতিবিদগণ এ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাননি। অথচ কবি রবীন্দ্রনাথ এ দুটো বিষয় নিয়েই সহিষ্ণুতা ও মানবিক উদারতার পক্ষে উভয় সম্প্রদায়ের উদ্দেশেই কিছু পরামর্শ রেখেছিলেন। কেউ তাতে কান দেয়নি। দিলে কাজ হতাে এ অবহেলার কারণে বিশের দশকে ধারাবাহিক সাম্প্রদায়িক সংঘাত যা পরে রাজনৈতিক স্বার্থের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। আর্থ-সামাজিক ভেদ-বৈষম্য নিরসনের উদ্যোগ নেয়নি অগ্রসর সমাজের অগ্রসর অংশ বা রাজনীতির কর্তাব্যক্তিগণ । পুনরুল্লেখ সত্ত্বেও বলতে হয় রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়টি সংশােধনের জন্য বারবার শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের, বিশেষত কংগ্রেসের উদ্দেশে আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু এ দিকটায় তারা গুরুত্ব আরােপ করেননি। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস তেমন কথাই বলে। এর পরিণাম তাদের পক্ষে যায়নি। একালে সংগৃহীত ইতিহাস তথা ঘটনা ও তথ্যাদি ব্যবচ্ছেদ এমন ইঙ্গিতই দেয় যে, প্রতিকারের সুযােগ থাকা সত্ত্বেও সেখানে অবহেলা যথেষ্টই ছিল । স্বভাবত এর ফল শুভ হয়নি। ওইসব তথ্যে দেখা যায় যে ছােটখাটো আপত্তিকর। ঘটনার যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অন্যদিকে তখনকার সরকারি সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবাদি নিয়েও অসন্তোষ ছিল শিক্ষিত মুসলমান শ্রেণির মধ্যে। সব কিছু মিলেই বিপত্তি। ঘটনা নিমস্তর থেকে শুরু যাতে কিছুটা শ্রেণিগুরুত্ব রয়েছে, এবং তা পুরােপরি সাম্প্রদায়িক চরিত্রের ছিল না বলে কেউ কেউ মনে করেন কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত সঠিক মনে হয় না ।
নিমস্তরের মানুষ সহিংসতায় লিপ্ত হলেই তা শ্রেণিসংঘাত হয় না। তাতে দাঙ্গায় শ্রেণিগুরুত্বকে যুক্তিহীন প্রাধান্য দেয়া হয়। তবে দাঙ্গায় কখনাে কখনাে পরস্পর বিরােধী উপকরণ থাকে। ধর্মীয় কারণের পাশাপাশি শাসক বিরােধিতা- বিশেষ করে পুলিশ, মুনাফাবাজ মাড়ােয়ারি ও কারখানা ওভারসিয়ারদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দরিদ্র শ্রমজীবীদের উত্তেজিত করে তােলে। সেটাই কাজে লাগায় শিক্ষিত কায়েমি স্বার্থবাজ কিছুসংখ্যক মানুষ। এসব নিয়ে ছােটখাটো দু-একটি উদাহরণ উদ্ধার করেছেন সুরঞ্জন দাস, যা ছােট ঘটনা হওয়া সত্ত্বেও তাৎপর্যপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ তাে বটেই। যেমন মসজিদে পুলিশ হামলায় আহতদের চিকিৎসার জন্য হিন্দু চিকিৎসকদের ডেকে আনা হয়, শ্বেতাঙ্গ চিকিৎসককে ঢুকতে দেয়া হয়নি। (বেসরকারি তদন্ত কমিশনে মৌলভী নিজামুদ্দিনের সাক্ষ্য)। শ্রমজীবী শ্রেণির এ হাঙ্গামার শ্রেণিচরিত্র উল্লেখ করে দৈনিক বসুমতী তাদের ক্ষোভ নিয়ে যুক্তিসঙ্গত বক্তব্য ছাপে এবং একজন খ্যাতনামা হিন্দু বিপ্লবী এ সম্বন্ধে ইতিবাচক চিঠি লেখেন (দাস, প্রাগুক্ত)। কিন্তু এসব প্রক্ষিপ্ত ঘটনা যা তৎকালীন রাজনীতি বা দাঙ্গায় কোনাে প্রভাব রাখেনি। দুই তবে একটি বিষয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাঁ সম্বন্ধে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রের দায়িত্বহীন ভূমিকা, অতিরঞ্জন ও মিথ্যাচার যা উভয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এবং যা নিরপরাধ মানুষের প্রাণনাশের কারণ হয়েছে। যেমন ১৯১৮-তে তেমনি ১৯২৬-এ তেমনি বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে যা দেখেছি ১৯৪৬-এ। নির্বিকারচিত্তে সাংবাদিক নামের বিবেকহীন ও মানবিক চেতনাহীন শিক্ষিত মানুষগুলাের মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনে বা ঘটনার বিকৃতি বা অতিরঞ্জনে বিবেকে বাধেনি। একদিকে হিন্দু পত্রিকার সনাতনী হুঙ্কার অন্যদিকে মুসলমান পত্রিকার জিহাদি আহ্বান। কেউ কারাে থেকে কম যায়নি। শান্তি ও সম্প্রীতির কথা তারা একবারও ভাবেনি। প্রসঙ্গত দাস উল্লেখ করেছেন এ সময়কার পাবনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বক্তব্য যাতে সংবাপত্রের দায়িত্বজ্ঞানহীন লেখা ও মিথ্যা রিপাের্ট’ সম্বন্ধে সমালােচনা রয়েছে। আর ১৯২৬-এর কলকাতা দাঙ্গার পেছনে দেখা গেছে স্থানীয় মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান মাড়ােয়ারি বিরূপতা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মােল্লা-মৌলভী ও আঞ্জুমান জাতীয় সংগঠনের ধর্ম-সাম্প্রদায়িক প্রচার ইত্যাদির সামাজিক প্রভাব । পাশাপাশি ‘আর্য সমাজী’ ও অন্যান্য সম্প্রদায়বাদী হিন্দু সংগঠনগুলাের তৎপরতা, শুদ্ধি অভিযান ও সংবাদপত্রগুলাের সাম্প্রদায়িকতায় জ্বালানি যােগ করার পরিপ্রেক্ষিতে সামান্য উপলক্ষে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার সূত্রপাত। কলকাতা, ঢাকা, পাবনা এবং আরাে কোনাে কোনাে স্থানে।
কলকাতা দাঙ্গা (১৯২৬) চরিত্র বিচারে মাড়ােয়ারি-বিরােধী হয়েও হিন্দুমুসলমানভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তাে বটেই। অন্য অনেক কারণের মধ্যে এর প্রধান কারণ মূলত রাজনৈতিক আর্থ-সামাজিক, বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিল হওয়ার ক্ষোভ রাজনৈতিক বিচারে এর দায় মূলত ডানপন্থী কংগ্রেসের। আমার মনে হয় এখানে মাড়ােয়ারি- সিন্ধি (ভাটিয়া) মূল কারণ নয়, উপলক্ষ মাত্র সুরঞ্জন দাস একজন মুসলমান নেতার মন্তব্য উল্লেখ করেছেন যেখানে বলা হয়েছে যে, তাদের লড়াই বাঙালি হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, তা মাড়ােয়ারিদের বিরুদ্ধে। দাঙ্গায় লুটপাট, হত্যা, অগ্নিসংযােগে মাড়ােয়ারিরাই প্রধানত ক্ষতিগ্রস্ত, তবু এর অন্য একটি দিকও আছে, যা ১৯১৮ দাঙ্গা থেকে ভিন্ন। কলকাতার এই (১৯২৬) দাঙ্গায় বহিরাগত অবাঙালি হিন্দু ও মুসলমান সমানভাবে অংশ নিয়েছে। শিখ ও আর্য সমাজীদেরও অংশগ্রহণ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। যেমন সমাজের ওপরতলার তেমনি নিম্নস্তরের হিন্দু-মুসলমানের অংশগ্রহণ ছিল অবাঞ্ছিত বাস্তবতা নির্বিবাদে হিন্দু-মুসলমান গুণ্ডাদের অংশগ্রহণও যেন এক ভবিষ্যৎ অশনি সঙ্কেত। পেশাদার সমাজ-বিরােধীদের অবশ্য সব সামাজিক রাজনৈতিক উপদ্রবেই দেখা যায় তবে রাজনৈতিক উপদ্রবে সমাজ-বিরােধীদের ব্যাপক ব্যবহার বােধহয় এভাবে শুরু মূলত রাজনৈতিক নেতাদের কল্যাণে। সেক্ষেত্রে কী লীগ, কী হিন্দুমহাসভা বা কংগ্রেস একই চরিত্রের। সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিকরণের পেছনে এ ক্ষেত্রে বড় কারণ উচ্চ ও মধ্যশ্রেণির লােকদের পাওনাগণ্ডার জন্য ক্ষোভ, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় পিছাইয়া পড়া মুসলমানের পদমানমর্যাদায় সমান হওয়ার দাবি’ । তা না হলে চিত্তরঞ্জন দাসের সমম্বয়বাদী রাজনীতির (বেঙ্গল প্যাক্ট-এর) কল্যাণে নির্বাচিত ডেপুটি মেয়র শহীদ সােহরাওয়ার্দী সমাজ-বিরােধী মিনা পেশােয়ারি ও আল্লাবকশ। পেশােয়ারির মতাে কুখ্যাত গুণ্ডাদের নিয়ে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামায় দৃবৃত্তদের মদত জোগাবেন কেন? সঙ্গত দাবি আদায়ের এটা ছিল অসঙ্গতপস্থা, বিশেষ করে সােহরাওয়ার্দীদের মতাে স্বনামখ্যাত আধুনিক মানসিকতার নেতাদের পক্ষে মুসলমান সমাজের মান্যগণ্য ব্যক্তিদের পক্ষে।
বিস্ময়কর হলেও দুঃখজনক সত্য যে, মাড়ােয়ারি দোকানপাট লুটের সময় জনাব সােহরাওয়ার্দীকে অকুস্থলে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে (ন্যাশনাল আর্কাইভস, হােম পলিটিক্যাল ফাইল নং ২০৯/২৬, ভারতীয় হােম সেক্রেটারির কাছে বঙ্গীয় চিফ সেক্রেটারির চিঠি, ৫ মে, ১৯২৬, উদ্ধৃতি দাস)। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস উপলক্ষে ১৯৪৬ আগস্টে সংঘটিত কলকাতা মহাহত্যাযজ্ঞে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ভূমিকা নিয়ে একই রকম বহু কথিত অভিযােগ সবারই জানা। দাঙ্গায় তার দায় নিয়ে তদন্ত কমিশনও গঠিত হয়। কিন্তু বিশেষ কারণে তা শেষ পর্যন্ত স্থগিত হয়ে যায় । ১৯৪৬-এর প্রাদেশিক নির্বাচনে সৈয়দ নওশের আলীকে পরাস্ত করতে নড়াইল শহরে রাজাবাজারের গুণ্ডাবাহিনী পাঠানােও ছিল গণতন্ত্রের মানসপুত্র সােহরাওয়ার্দীর পক্ষে অসঙ্গত কাজ। বস্তুত সােহরাওয়ার্দীর মতাে অবাঙালি উর্দুভাষী রাজনীতিকরাই বরাবর কলকাতায় মুসলমান সমাজ ও রাজনীতির প্রধান ব্যক্তি ছিলেন যে কথা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। তবে ছাব্বিশের কলকাতা দাঙ্গায় নগরীর হিন্দু-সমাজের বিশিষ্টজনেরাও সমান সক্রিয় ছিলেন। বিশেষ করে ডানপন্থী রাজনৈতিক নেতা, ‘শুদ্ধি’, ‘সংগঠন’ ও ‘আর্য সমাজীদের মতাে ধর্মীয়-সামাজিক সংস্থার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ সাম্প্রদায়িকতার আগুনে জ্বালানি যােগ করেছেন ও বাতাস দিয়েছেন। লক্ষ্য ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচনে, বাের্ডে বা সমিতিতে নিজ সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় ঢাকা বা পাবনায় উভয় সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় অধিকাংশের তৎপরতা ছিল একই ধরনের। অবশ্য ছবিটা পুরােপুরি একতরফা ও একই রকম ছিল না। ইতিপূর্বে ১৯১৮ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত উপদ্রবের বিপরীত চরিত্রের দু-একটি ঘটনা দাসের বইতে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি এপ্রিল, ১৯২৬-এ আঞ্জুমান সংগঠন থেকেও ইশতেহার বিলি করে জানানাে হয়, যাতে বাঙালি হিন্দুর জানমালের ওপর আঘাত না পড়ে (দাস, প্রাগুক্ত)।
আর ১৯১৮-র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সম্পর্কে নিখিল ভারত কংগ্রেসের আহমেদাবাদ অধিবেশনে বঙ্গীয় সদস্য আবদুল হামিদ খা এবং প্রতাপ চন্দ্র গুহ রায় যতীন্দ্রমােহন সেনগুপ্তের বক্তব্য সমর্থন করেন এই বলে যে ওই দাঙ্গা মূলত বহিরাগত পশ্চিমা হিন্দু মুসলমানরাই ঘটায় (দাঙ্গার ইতিহাস, প্রাগুক্ত)। দাঙ্গা পরবর্তী সময়ে কুখ্যাত রাওলাট দমননীতি আইনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের অংশগ্রহণ উপলক্ষে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আহ্বান উল্লেখযােগ্য ঘটনা। বিশেষ করে কলকাতার রাজপথে হিন্দু মুসলমানের সম্মিলিত প্রতিবাদী মিছিল (এপ্রিল, ১৯১৯)। ছাব্বিশের দাঙ্গার সময়ও দেখা গেছে, প্রভাবশালী হিন্দু ও মুসলমানের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার চেষ্টা এবং উভয় সম্প্রদায়ের দুর্গতদের আশ্রয় দান । এর মধ্যে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের নামও রয়েছে যারা অনেক অসহায় মুসলমান পরিবারকে উদ্ধার করে তাদের বাড়িতে রেখেছেন। যে জন্য তাদের বসতবাড়ি আক্রান্ত হয় (দাস, প্রাগুক্ত)। কিন্তু আক্রমণকারীরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে উদারপন্থী ছাড়াও বিশিষ্ট রাজনৈতিক-সামাজিকসাংস্কৃতিক নেতা ফজলুল হক, মুজিবর রহমান, কিংবা রসুল ও গজনভিদের। চেষ্টা ছিল সম্প্রীতি রক্ষার। শুধু বঙ্গেই নয়, ভারতের দ্বিতীয় প্রধান প্রদেশ পাঞ্জাবেও অনুরূপ অবস্থা। দেখা গেছে। কলকাতা দাঙ্গার (১৯১৯) কয়েক মাস পর পাঞ্জাবে হিন্দুমুসলমান-শিখের মধ্যে যে ঐক্য গড়ে ওঠে তা সাম্রাজ্যবাদী শাসককে চিন্তিত করে তােলে। হান্টার কমিশনের রিপাের্টে দেখা যায়, অমৃতসরে রামনবমীর মিছিলে (১৯১৯) পাঞ্জাবি মুসলমান বিপুল সংখ্যায় যােগ দেয়। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ রাস্তায় এক পাত্র থেকে জল পান করছে। সে এক আশ্চর্য মানবিক সৌহার্দের দৃশ্য! ইংরেজ শাসকের স্বভাবতই আতঙ্কিত হওয়ার কথা। তারা ঠিকই আতঙ্কিত হয়ে চরম দমননীতির আশ্রয় নেয়।
এপ্রিলের ৯ তারিখেই (১৯১৯) রাজনৈতিক নেতা কিচলু ও সত্যপালকে অমৃতসর থেকে বহিষ্কার করা হয়। প্রতিবাদে পরদিন উত্তেজিত জনতা একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ চালায়। পরদিন জারি হয় সামরিক আইন। দু-দিন পর ১৩ এপ্রিল মেলা উপলক্ষে নিরস্ত্র, দেহাতি জনতা। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘেরা ময়দানে জমায়েত হয়। অশিক্ষিত মানুষের নিষেধাজ্ঞার কথা জানা ছিল না। কেউ তাদের সতর্ক করে দেয়নি। আর সেই শান্তিপূর্ণ নিরস্ত্র জনতার ওপর নিয়ম ভাঙার অপরাধে ডায়ারবাহিনী নির্বিবাদে গুলি চালিয়ে কয়েকশ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এত বড় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অপরাধে ডায়ারদের বিচার হয়নি। পাল্টা নেটিভদের ওপর চলে অত্যাচার, নির্যাতন, গ্রেফতার। প্রতিবাদে লাহােরে আবারাে হরতাল-মিছিল অভূতপূর্ব সাম্প্রদায়িক ঐক্যের প্রতিফলন ঘটিয়ে এ সব ক্ষেত্রে যা হয় পুলিশের সঙ্গে জনতার রক্তাক্ত সংঘর্ষ। শাহি মসজিদের বিশাল জমায়েতে গণকমিটি গঠিত হয়। এদের হাতে দিন কয় ছিল শহরের নিয়ন্ত্রণ, ঠিক যেন ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি পর ঢাকায় কয়েকটি দিন। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ঘটনা অনেক ভয়াবহ-মৃত্যু রক্ত ও পীড়নে। ডায়ারি শাসন সত্ত্বেও অবস্থা বিপ্লবমুখী ছিল মুসলমান-হিন্দু-শিখ জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদী শক্তির কারণে। কিন্তু আপসবাদী শিক্ষিত শ্রেণির নেতৃত্ব সেই সম্ভাবনা নষ্ট করে দেয়। বিস্ফোরক জনশক্তিকে তারা কাজে লাগায়নি। সম্ভবত তাদের শ্রেণিচরিত্রের কারণে।
রাওলাট আইন ও জালিয়ানওয়ালাবাগ নিয়ে কলকাতাও ছিল উত্তাল রবীন্দ্রনাথের মতাে শান্তিবাদী কবিও ক্ষুব্ধ চৈতন্য শান্ত করতে প্রতিবাদ সভা আয়ােজনের জন্য রাজনীতিকদের কাছে ধরনা দেন, নিজে সভাপতিত্ব করার প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু রাওলাট আইন ও সরকারি দমননীতির ভয়ে গান্ধি, চিত্তরঞ্জন কেউ এগিয়ে আসেননি। ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত ভাইসরয়কে চিঠি। লিখে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রাজ’ প্রদত্ত ‘নাইটহুড’ উপাধি ত্যাগ করেন। কিন্তু শাসক তা মেনে নেয়নি। আর কংগ্রেস প্রায় দুমাস পর তারা পাঞ্জাব বিভীষিকার বিরুদ্ধে একটি জরাজীর্ণ আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব গ্রহণ করে ভয়ঙ্কর একটি ঘটনার বিপক্ষে নম্র কণ্ঠে জাতীয় কর্তব্য শেষ করে। রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড’ ত্যাগের প্রতিবাদও সেখানে স্বীকৃতি পায় নি। গান্ধি রাজনীতির এ বৈশিষ্ট্য দেশবিভাগের পূর্বপর্যন্ত একইভাবে দেখা গেছে। এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে গান্ধি নেতৃত্ব। কংগ্রেস ঐতিহ্যবাহী আপসআবেদন পন্থার রাজনীতি থেকে ভারতীয় রাজনীতির মূলধারাটিকে পুরােপুরি সরিয়ে আনতে পারেনি । শাসকশ্রেণির ওপর চাপ হিসেবে সূচিত সরকারবিরােধী আন্দোলন (যেমন অসহযােগ, আইন অমান্য আন্দোলন) কখনাে চরম পর্যায়ে বা শেষ গন্তব্যে পৌছাতে পারেনি। পারেনি গান্ধির অহিংসনীতির কারণে গান্ধির জন্য বিষয়টা ছিল ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিত নীতি ও কার্যক্রম। তার ভালােভাবেই জানা ছিল যে, রাজবিরােধী আন্দোলন কখনাে শেষ পর্যন্ত অহিংস থাকতে পারে না। এর কারণ সরকারি দমননীতি ও এর গণপ্রতিক্রিয়া। গান্ধিসূচিত একাধিক গণআন্দোলনে তেমন প্রমাণই মিলেছে। গান্ধীর আপসবাদী রাজনীতি তথা কংগ্রেসের ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে ভারতের ভূস্বামী সম্প্রদায়, বৃহৎ বণিক ও শিল্পপতিশ্রেণির স্বার্থ জড়িত ছিল। গান্ধি-রাজনীতি, গান্ধিআশ্রম সবই চলেছে এদের অর্থ সাহায্যে, চলেছে কংগ্রেসের কার্যক্রমের অর্থ সঙ্কুলান। শুধু বিড়লা বলে কথা নয়, ‘আহমেদাবাদের মিলমালিক অম্বালাল সারাভাই-এর কাছ থেকেও সাবরমতী আশ্রম (১৯১৫) মােটা আর্থিক সমর্থন পায়। স্বরাজ তহবিলের কোটি টাকার মােটা অংশ আসে বােম্বাই, আহমেদাবাদের মিলমালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে (সরকার)। ভারতে গান্ধিরাজনীতির সূচনা ও বিস্তার এভাবে । বণিক ভূস্বামী নির্ভরতায়। এ ধারাই বরাবর চলেছে। এখনাে চলছে উপমহাদেশে।
এরা আবার একই সঙ্গে রাজভক্তও। সরকারের সঙ্গে তারা সংঘাতে যেতে নারাজ। গান্ধি-বিড়লা, বিড়লা-ভাইসরয় সংলাপ ও চিঠিযােগাযােগে এসব সত্য প্রতিষ্ঠিত । যেমন দেখা গেছে মুসলমান পুঁজিপতি ও ব্যবসায়ীকুলের জিন্না ও মুসলিম লীগ তহবিলে অকাতর দাক্ষিণ্যের ক্ষেত্রে। এ বিষয়ে সম্প্রদায়গত সংঘাত বা ভিন্ন যাত্রার অবকাশ ছিল না। শ্রেণিচরিত্রের কোনাে ব্যত্যয় ঘটেনি হিন্দু-মুসলমান বণিকদের ক্ষেত্রে। তারা একই সঙ্গে রাজভক্ত ও রাজনীতিতে সমপ্রদায়ভক্ত। বিশের দশকের শুরুতে বাংলার চটকলসহ সারা ভারতের শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক ধর্মঘটের যে জোয়ার তৈরি হয় তা ছিল অভাবিত। বলা চলে, এক ধরনের গণজাগরণের প্রকাশ তবে তার চেয়েও সম্ভবত ব্যাপক হয়ে ওঠে বিচ্ছিন্নভাবে ভারতজুড়ে কৃষক আন্দোলন বা কৃষক বিদ্রোহ। বাংলারও এ ক্ষেত্রে ছিল বলিষ্ঠ ভূমিকা। কিন্তু অসহযােগের পরিপ্রেক্ষিতে দেশময় আন্দোলনের যে সুবাতাস বয়ে যায় তার ‘আইকন’ হয়ে ওঠেন গান্ধি। গান্ধির সুবাদে কংগ্রেসের ব্যাপক জনপ্রিয়তা। তাই ‘গান্ধীরাজ এসে গেছে’ এই ঘােষণা করে ২৪ মার্চ (১৯২১) অনেক কয়েদি, অন্তত ৬৬৯ জন রাজশাহী জেল থেকে বেরিয়ে আসে (সরকার)।
সরকারি গােপন প্রতিবেদনে বিশৃঙ্খল অবস্থার কথা বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়। ‘মনে হয় আন্দোলন নেতাদের হাতের বাইরে চলে গেছে’- এমনটাই ছিল গােপন প্রতিবেদনের মূল কথা বাংলায় মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রাম ও সাঁওতাল পরগনাও হয়ে ওঠে নিমবর্গীয় মানুষের স্বরাজী মনােভাবের কেন্দ্রবিন্দু। গান্ধীর নামে এসব হলেও মজার ঘটনা হচ্ছে গান্ধি এ জাতীয় আন্দোলনের সমর্থন বা দায়গ্রহণ কোনােটাই করেননি। যেমন দরিদ্র কৃষককুলের তেমনি বিত্তহীন শ্রমিক শ্রেণির ক্ষেত্রে। সমর্থন দূরে থাক গান্ধি বরং এসব তৎপরতার রাশ টেনে ধরেন তা সত্ত্বেও বিশের দশকের প্রথম তিন-চার বছরের উত্তাল সরকারবিরােধী ক্ষোভের ঘটনাপ্রবাহ রাজশক্তিকে প্রায় নতজানু করে দিয়েছিল। (সুমিত সরকার)। প্রসঙ্গত ১৯২১ সালে হসরত মােহানির পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি (যা গান্ধি খারিজ করে দেন)- এবং সেই সঙ্গে অহিংসা বর্জনের দাবি তৎকালীন অবস্থার সঙ্গে সময়ােপযােগী আহ্বান ছিল। কিন্তু গান্ধিকংগ্রেস সে সুযােগ নেয়া দূরে থাক, স্বাধীনতা অর্জনের ঠিক বিপরীত পথ ধরে হেঁটেছে। কারণ গান্ধি তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনাে চাননি ভূস্বামী, বৃহৎ বণিক ও শিল্পপতিদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হােক সেই সঙ্গে চাননি রাজ’ সরকার বিপর্যয়ের মুখে পড়ুক তার এই রাশ টানা ও পিছটান শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির একাংশসহ জনস্তরে যে হতাশা সৃষ্টি করে তার প্রতিক্রিয়া নানাভাবে দেখা দেয় তাতে দেশের, দশের স্বার্থই ক্ষুন্ন হয়েছে। একাধিক কারণে সমাজে দেখা দিয়েছে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান- বেড়েছে মালব্য প্রমুখ হিন্দু মহাসভাপন্থীদের তৎপরতা। অন্যদিকে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ একই সঙ্গে ভিন্ন প্রতিক্রিয়ায় (কংগ্রেস নেতৃত্ব সম্পর্কে মােহভঙ্গের কারণে) বাংলা, পাঞ্জাব ও যুক্তপ্রদেশে শিক্ষিত যুবকদের একাংশ বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু সমস্যা এ ক্ষেত্রেও ছিল, ছিল ধর্মীয় চেতনা তথা হিন্দুত্ববাদের প্রভাব এক কথায় কয়েক বছরে তৈরি সাম্প্রদায়িক ঐক্য, শাসক-বিরােধী ঐক্যের গােটা চালচিত্রটাই পাল্টে যায় এর চরিত্র হয়ে ওঠে বিপরীতমুখী। ফলে রাজকীয় চাতুর্য ও দমননীতি দুই-ই ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক