বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৭ই সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার, ৩১শে ভাদ্র, ১৩৮১
সতেরই সেপ্টেম্বর–আজ শিক্ষা দিবস
আজ শিক্ষা দিবস। ও গণতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ষাট দশকের গোড়ার দিকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সতেরই সেপ্টেম্বর সেই আন্দোলনের একটি স্মরণীয় দিন। শহীদী আত্মার তাজা রক্ত শপথে দিনটি সমুজ্জ্বল হয়ে আছে।
এটা সত্তুর দশকের মাঝামাঝি সমাজ। শিক্ষা আন্দোলনের পর তা আরো ব্যাপক আন্দোলনের রূপ গ্রহণ করে স্তরে স্তরে এগিয়ে চলে সংগ্রামী প্রবাহ। স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলন শিক্ষা-ভাষা-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্তরানুক্রমিক বিকাশ। একসময় দাবি করে যে আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত ছিল সময়ের আবর্তে নিজেরাই নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে এলো সমস্ত সংগ্রামী জনতা। সে সংগ্রামে বিজয় এলো। এলো দীর্ঘদিনের উপেক্ষিত আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের সুযোগ।
সেই স্বাধীনতার পরও কেটে গেছে বত্রিশ মাস। ভাষা শিক্ষার যে অবস্থা অর্থনীতির অবস্থাও ঠিক তেমনি। বরং বলতে দ্বিধা নেই শিক্ষাজীবনের নৈরাজ্য বেড়েছে, ভাষা-সংস্কৃতির উন্নতিবিধান এর দিক থেকে আপাতত মুখ ফিরিয়ে রাখাই সুবিধাজনক বলে মনে করে চলেছেন জাতীয় নেতৃবৃন্দ। নেতৃবৃন্দ যে শিক্ষাব্যবস্থাকে উপনিবেশিক বলে স্বাধীনতার আগে এবং পরে চিন্তা করে আসছেন তাই চালু রয়েছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট কবে নাগাদ কার্যকরী হতে শুরু করবে তার কোনো আভাস মেলেনি।
সবচাইতে অবনতি ঘটেছে শিক্ষার মান আর শিক্ষাঙ্গনগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ এর। বই পুস্তক ছাপানো নিয়ে কেলেঙ্কারি, বাজারে কাগজের দুষ্প্রাপ্যতা সবকিছুর মিলিয়ে একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। শিক্ষাঙ্গনগুলোতে এক শ্রেণীর ছাত্র নামধারী ডাণ্ডাবাজদের আধিপত্য অভিভাবকদের তাদের সন্তান-সন্ততির নিরাপত্তা সম্বন্ধে শঙ্কিত করে তুলেছে।
আশার ছিটে-ফোঁটা খবর যে নেই তা নয়। বহু দিনের উপেক্ষিত প্রাইমারি শিক্ষকদের দিকে সরকারি সাহায্য সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারিত করা হয়েছে। নতুন শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে মেনে নেয়া হয়েছে পুরান অনেক দাবি। সরকারের তরফ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ এর। শিক্ষাকে গণমুখী করে তোলার নানা সুপারিশও সন্নিবেশিত হয়েছে ঐ রিপোর্টে।
সাধারণ মানুষের কাছে শিক্ষার আলো পৌছে দেয়ার নানা আহ্বান এবং আবেদন জানানো সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত নেয়া হয়নি অথচ বিপ্লব পরবর্তীকালে এদিকটাতে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে সবাই আশা করেছিলেন। আসলে এর প্রয়োজন উপলব্ধি করতে জাতীয় নেতৃবৃন্দ ব্যর্থ হয়েছেন বলে অনেকের অভিযোগ। একটা কালো রাত্রির দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে আমরা যে নতুন আলোর সন্ধানে যাত্রা শুরু করেছি তা সাধারণ মানুষের মনে রেখাপাত করতে পারেনি। দেশের এক ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে অন্ধকারে ফেলে রেখে মুষ্টিমেয় কিছু লোক সততা ও এবং আন্তরিকতা নিয়েও যদি কোনো লক্ষ্য অর্জনে অগ্রসর হন তবে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। সফল বিপ্লবের ইতিহাস তাই সাফল্যের সঙ্গে গোটা জাতিকে শিক্ষিত এবং আলোকিত করে তোলার উদ্যোগ এর সাথে সম্পৃক্ত।
আজ সতেরই সেপ্টেম্বর। উপনিবেশিক আমলে শিক্ষা আন্দোলনের একটা পবিত্রতম স্মরণীয় দিন। স্বাধীনতার মুক্ত হওয়ায় সেই আন্দোলনের মূল ধারাকে উপলব্ধি করার সাথে সাথে তা বাস্তবায়নের পথে কতটুকু সাফল্য অর্জিত হয়েছে তাও মূল্যায়ন এর দিন আজ এই সতেরই সেপ্টেম্বর।
ইসরাইলের পুনরস্ত্রীকরণ
মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের আগুন একবারে নিভে যায় নি। ছাই চাপা আগুন এর মতই ধিকি ধিকি জ্বলছে। সামান্য খোঁচা খেলেই আবার যেকোনো সময় জ্বলে উঠতে পারে।
আগুন যে নিবেনা বা নেভার কোন সম্ভাবনা নেই তারই প্রমাণ হলো ইসরাইলের পুনরস্ত্রীকরণ। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মিঃ ইৎজাক ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিঃ জেরান্ড ফোর্ডের মধ্যে আলোচনা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নিয়ে। গত সপ্তাহে ফোর্ড রবিন আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে ইসরাইলের বিনষ্ট ফ্যান্টম জেট এর ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ৫০টি ফ্যান্টম জেট সরবরাহ করবে ইসরাইলকে।
ফ্যান্টম জেট ইতিপূর্বে সরবরাহ করার চেষ্টা যে হয়নি তেমন নয় তবে এতদিন বিলম্বে কারণ হলো আরব রাষ্ট্রগুলোর বিক্ষোভকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান পরিস্থিতিকে অনুকূল মনে করে ইসরাইলকে শুধু ৫০টি ফ্যান্টম জেটই দিচ্ছেনা সঙ্গে আড়াইশো প্যাটন ট্যাংক, কেবেরা, হেলিকপ্টার, যুদ্ধ জাহাজ, লেজার নিয়ন্ত্রণ স্মার্ট বোমা এবং বাছাই করা অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রও সরবরাহ করবে।
নতুন করে অস্ত্রশস্ত্র ও ফ্যান্টম জেট সরবরাহের ফলে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে পরিস্থিতিতে আরো ঘোলাটে হয়ে উঠবে। উঠেছেও তাই। ইসরাইল গত ৯ই আগস্ট এরপর আবার বিমান হামলা চালিয়েছে দক্ষিণ লেবাননের গ্রামাঞ্চলে। সাত মিনিটের অভিযানে ক্ষতির পরিমাণটা কি তা এখনো জানা যায়নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাঠিও যাতে না ভাঙ্গে আবার সাপও যাতে না মরে সেই রকম একটা নীতি মধ্যপ্রাচ্য বর্তমানে অনুসরণ করছেন বলে মনে হয়। এতে আর যাইই হোক মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির পথ প্রশস্ত হওয়া দূরে থাকুক, আরো বাড়বে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব ডঃ হেনরি কিসিঞ্জার শাটল কর্কের মতোই মধ্যপ্রাচ্যে ঘুরে বেরিয়েছেন তাই শান্তির সন্ধানে। কিন্তু তখনকার হাবভাবে বোঝা গিয়েছিল যে সত্যিই বুঝি স্থায়ীভাবে মধ্যপ্রাচ্যে আকাশে শান্তির শ্বেত কপোত উড়বে। তেমন একটা সম্ভাবনা দেখা যায়নি যে এমন নয়। সিরিয়া, মিশর ও ইসরাইলের সৈন্যপসারণ ও পারস্পারিক চুক্তির ফলে শান্তির পক্ষে পরিবেশটা অনুকূলই হয়ে উঠেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে আবার সমরাস্ত্র ফ্যান্টম জেট সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নেওয়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে তেমন কোনো যুক্তি খাড়া করা যাচ্ছে না। এটা তো সত্য কথা যে, সমর সজ্জায় সজ্জিত হয়ে তার যাই হোক শান্তির কথাটা উচ্চারণ করা যায় না।
একটু গভীরভাবে তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে, মিঃ নিক্সন বিদায় নেবার পর নয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট মুখে শান্তির কথা বললেও কার্যত অন্য পথে চলছেন। দিয়াগো গার্সিয়ায় মার্কিন নৌ-ঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনাটি কিছুদিন আগে পর্যন্ত চাপা পড়লেও আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রেসিডেন্ট ফোর্ড দিয়াগো গার্সিয়া ঘাঁটি নির্মাণের স্বপক্ষে বক্তব্য রেখেছেন এবং তার তোড়জোড়ও চলছে।
সবকিছু দেখেশুনে বলতে হচ্ছে যে, ইতিহাস বড় নির্মম৷ ইতিহাস যে কথা বলে তা সকলেরই জানা। অথচ মানুষ ইতিহাসের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে নারাজ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও হয়েছে তাই। ভিয়েতনামের পরও যদি তাদের দৃষ্টিশক্তি উন্মোচিত না হয় তাহলে বলার কিছু থাকে না। তবে এটা ঠিক যে যুদ্ধের আগুনটাকে জিইয়ে রেখে আর যাই হোক নিশ্চিন্ত এবং নির্ভাবনায় কারো পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। যুদ্ধের আগুনের আঁচ সকালের গায়ে লাগবে কম বেশি। কাজে ও পথ না মাড়ানোই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। এ কথা যেমন ইসরাইলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমনি প্রযোজ্য ইসরাইলের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেলাতেও।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক