You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাজনীতিতে ধর্মীয় চেতনা ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত

ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে আনা বা বিশেষ কিছু সুবিধার জন্য রাজনীতির সঙ্গে ধর্মচেতনার মিশ্রণ ঘটানাে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে এক মহা ভুল। এ ভুল ভারতীয় রাজনীতিতে নানাভাবে নানা সময়ে দেখা গেছে। এর পরিণাম শেষ পর্যন্ত এমনই অমানবিক হয়ে দাঁড়ায় যে একে ‘পাপ’ বলাই বােধহয় সঙ্গত। এর ফলে রাজনীতিতে সুস্থ মানবিক চেতনার বিকাশ ব্যাহত হয়েছে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোেধ রাজনীতিতে মজবুত ভিত তৈরি করতে পারেনি। সাম্প্রদায়িকতার ‘পাপ’ মানবিক চেতনাকে পরাজিত করেছে। আর এটা হয়ে দাঁড়ায় ভারত বিভাগের প্রধান কারণ। এই রাজনৈতিক বিচ্যুতি, বলা যায় আদর্শগত বিচ্যুতির দায় লীগ-কংগ্রেস বা জিন্না-গান্ধি কারাে কম নয়। সম্প্রদায়বাদী রাজনৈতিক ও সামাজিকসাংস্কৃতিক সংগঠনগুলাে তাে ঘৃণা-বিদ্বেষের তরবারি হাতে নিয়েই মাঠে নেমেছিল। হিন্দুমহাসভা বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস), পরবর্তীকালের শিবসেনা ও বিজেপি, অন্যদিকে মাদ্রাসা ও আঞ্জুমানে উলেমা ও ধর্মীয় সংগঠনগুলাে এবং পরবর্তী মুসলিম লীগ রাজনীতি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। . এ অবস্থার কারণে মাঝে মধ্যে বয়ে যাওয়া সাম্প্রদায়িক ঐক্যের সুবাতাস তার অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারেনি। বিশেষ করে পারেনি শাসকশ্রেণীর চতুর ভেদনীতির কারণে যে কথা বর্তমান আলােচনায় নানা প্রসঙ্গে একাধিকবার বলা হয়েছে  বলেছেন নিরপেক্ষ চেতনার একাধিক লেখক। সেখানে মূল কথা সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাবাদকে উৎসাহ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্রিটিশের দায়িত্ব এক অনস্বীকার্য তথ্য’ (সুমিত সরকার, প্রাগুক্ত)। অবশ্য এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ হিন্দুমুসলমান সমাজ ও রাজনীতিকে অধিক দায়ী বিবেচনা করেছিলেন । চেয়েছিলেন, নিজেদের পাপ যাতে নিজেরা খণ্ডন করি। কিন্তু তা হয়নি। ধর্মীয় রাজনীতি প্রসঙ্গে কংগ্রেস-খিলাফত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন একাধিক সূত্রে সমালােচনার অবকাশ তৈরি করে ছিল। গান্ধির প্রতি অভিযােগের আঙুল তােলা হয়। অবশ্য সেটা ছিল প্রত্যেকের নিজ নিজ চিন্তা ও সংগঠনগত স্বার্থের  পরিপ্রেক্ষিতে।

যেমন হিন্দুত্ববাদী নেতা কেএম মুন্সীর সমালােচনার উদ্দেশ্য বুঝতে কষ্ট হয় না। এ ব্যাপারে জিন্নার বিরােধিতার কারণও স্পষ্ট জিন্না চাননি মুসলিম-রাজনীতিতে কংগ্রেস বা গান্ধি হস্তক্ষেপ করুন। আবার ‘হােমরুল’ বা স্বরাজ আন্দোলনেরও তিনি সমর্থক ছিলেন না। নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের বাইরে স্বাধীনতা সংগ্রামেও তার কোনাে ভূমিকা দেখা যায়নি। অবশ্য মুসলিম অধিকার আন্দোলনের কথা আলাদা। কিন্তু প্রাক-চল্লিশের রাজনৈতিক নেতা জিন্না মাঝে মধ্যে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের পক্ষে কথা বলে চমক সৃষ্টি করেছেন। তাতে হয়তাে সদিচ্ছার অভাব থাকে নি। কিন্তু এ কথা মানতেই হবে যে ওইসব ঐক্য প্রচেষ্টার মধ্যেও মুসলিম সম্প্রদায়-স্বার্থের বিষয়টি তার কাছে বড় হয়ে থেকেছে। তার ঐক্য। প্রস্তাবগুলাের আগাপাছতলা বিচার করে দেখলে তাই মনে হয়। তিনি যখন। সরােজিনী নাইডু কথিত ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত’ তখনাে তিনি মুসলিম রাজনৈতিক স্বার্থের একমাত্র মুখপাত্র (সােল স্পােম্যান) হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চেয়েছেন । ওটাই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য। এখানে জিন্নাচেতনার স্ববিরােধিতা স্পষ্ট। তাতে সৃষ্টি হয়েছে ঐক্যের পথে সমস্ত কংগ্রেসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জিন্না কংগ্রেসের ভেতরে থেকেই ঐক্যের গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে পারতেন। তাতে ওই কাজে তাকে বিচ্ছিন্ন স্বতন্ত্র পথ খোঁজ করতে হতাে না। কিন্তু তিনি ওই পথের নিশানা ধরেননি। সম্ভবত কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বে হিন্দু নেতাদের প্রাধান্য তার জন্য বিপরীত বার্তা নিয়ে এসেছিল। তিনি বুঝে নিয়েছিলেন যে এ পরিবেশে তার কর্তৃত্ব গুরুত্ব পাবে না। তাই স্বতন্ত্র সংগঠনই বরণীয় মনে হয়েছে, হােক তা ধর্মীয় স্বাতন্ত্রবাদী। তাই কংগ্রেস হয়ে ওঠে তার প্রতিপক্ষ এবং সে হিসেবে রাজনৈতিক বিরুদ্ধবাদী দল।  তাছাড়া নীতিগতভাবেও গান্ধি-কংগ্রেসের সঙ্গে তিনি অনেক ক্ষেত্রে একমত হতে পারেননি। তাই সব কিছু মিলিয়ে জিন্নার রাজনীতিতে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সহমর্মিতা বা সহযােগিতার পথ ধরে চলতে পারেনি। তাদের চলার পথ হয়ে ওঠে বিপরীত ধারার। শুধু বৈপরীত্য নয়, সেটা ক্রমাম্বয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়ে পরিণত হয়। দুঃখজনক যে, জিন্নার সে লড়াইয়ে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের কোনাে স্থান ছিল না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জিন্না বরাবরই একজন নিয়মতান্ত্রিক সংস্কারের পক্ষপাতী রাজনীতিক যিনি পরে হয়ে ওঠেন স্বাতন্ত্রবাদী মুসলিম রাজনীতির একজন কট্টর প্রবক্তা। অথচ তার নেতৃত্বে লীগ হতে পারতাে মুসলিম স্বার্থ নিয়েই অসামপ্রদায়িক দল  কিন্তু সে চেষ্টা বা চিন্তা তার ছিল না।

রাজনীতিক হিসেবে জিন্নার মধ্যে ছিল এক ধরনের প্রচণ্ড স্ববিরােধিতা। যে জিন্না ১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌ চুক্তির রূপকার, তিনিই আবার ১৯২০ সালে কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে গান্ধির এক বছরের মধ্যে স্বরাজ আনার নীতির সরাসরি বিরােধিতা করেন। অবশ্য গান্ধির এ ঘােষণাও ছিল অবাস্তব। গান্ধির অসহযােগ আন্দোলনের ডাকও তার সমর্থন পায়নি। অন্যদিকে তিনি মন্টেগুচেমসফোর্ড সংস্কার প্রস্তাবেরও সমর্থক ছিলেন না। এমনকি ছিলেন না খিলাফত আন্দোলনের পক্ষে। গান্ধি ওই আন্দোলনে যোগ দিয়ে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের যে সূচনা ঘটান নীতিগতভাবে জিন্না ছিলেন এর বিরােধী। | আসলে গান্ধি-রাজনীতি কোনােভাবেই জিন্নার পছন্দসই ছিল না। ছিল না যেমন নীতিগত দিক থেকে, তেমনি ব্যক্তিগত অবস্থানের দিক থেকে। গান্ধিজিন্না দুই গুজরাতি বা কাথিওয়াড়ির মধ্যে পরস্পর বিরােধিতাই যেন তাদের রাজনীতির ভবিতব্য হয়ে ওঠে। তবে ওই যে বলেছি যেমন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তেমনি গান্ধি-বিরােধিতায় কখনাে চমক সৃষ্টি করেছেন জিন্না তাতে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সঙ্গে স্ববিরােধিতার প্রকাশও দেখা গেছে। | যেমন কংগ্রেস-খিলাফত ঐক্য সম্বন্ধে জিন্নার গান্ধি বিষয়ক মন্তব্য ছিল রীতিমতাে বােমা ফাটানাের মতাে চমকপ্রদ তার ভাষায় গান্ধি ভারতীয় জীবনযাত্রা থেকে আপত্তিকর অনেক কিছু এনে রাজনীতিতে প্রধান করে তুলে রাজনীতিকে নষ্ট করেছেন। ধর্ম ও রাজনীতিকে একাকার করা রীতিমতাে পাপ যে পাপ গান্ধি করেছেন’ (যশবন্ত সিংয়ের উদ্ধৃতি, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১২৫)। জিন্নার দুটো মন্তব্যই সঠিক। তবে বিস্ময়কর যে ১৯৪০-এ পৌছে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবক্তা হিসেবে ওই ‘পাপ’ জিন্না আরাে গভীরভাবে করেছেন। যে পাপের প্রকাশ ঘটে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক রক্তস্নানে।

ভারতীয় রাজনীতির এ জাতীয় পাপের ব্যাপক প্রভাব হিন্দু-মুসলমান সমাজে গভীরভাবে দাগ কেটেছে, হয়ে উঠেছে ভারতীয় রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ তথা বিচ্ছিন্নতার ভবিতব্য- যে বিচ্ছিন্নতাবােধ ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ডিত করেছে। এর পেছনে আরাে ভূমিকা ছিল আর্যসমাজী’ বা ‘গাে-রক্ষা সমিতি’র মতাে সামাজিক সংগঠনগুলাের । ছিল আঞ্জুমানসহ বিভিন্ন মুসলিম ধর্মীয় সামাজিক সংগঠনগুলাের অনুরূপ ভূমিকা। এতে বিচ্ছিন্নতাই শুধু বড় হয়ে ওঠেনি, সাম্প্রদায়িক সহিংসতাও বড় হয়ে ওঠে।  বিশ শতকের প্রথমার্ধে ধর্মাচরণ থেকে শুরু করে রাজনীতির প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ প্ররােচনায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ইতিহাস থেকে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বঙ্গে স্বদেশী আন্দোলন উপলক্ষে হাঙ্গামা, বিহার দাঙ্গা (১৯১৭), অনেকটা এর প্রতিক্রিয়ায় কলকাতা দাঙ্গা (১৯১৮), বেঙ্গল প্যাক্ট  বাতিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২৬ সালে বঙ্গের একাধিক স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলাের ইতিহাস এমন ধারণাই দেয়।  কিন্তু এ বিষয়ে কোনাে পক্ষেরই জননেতা বা সমাজ বিন্দুমাত্র সহিষ্ণুতার পরিচয় রাখেনি। রাজনৈতিক সংগঠনগুলাে ঐক্যের গুরুত্ব অনুধাবন করতে চায়নি। তাদের কাছে রাজনৈতিক প্রাপ্তির হিসাবটাই ছিল বড়। সে প্রাপ্তি অনৈক্যের মাধ্যমে হলেও ক্ষতি নেই। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক-বিষয়ক এ ধরনের নেতিবাচক মনােভাব নিয়ে রাজনৈতিক সংগঠনগুলাের তৎপরতা স্বভাবতই সাম্প্রদায়িক ঐক্য বিনাশের পক্ষেই কাজ করেছে। এর অবশেষ পরিণতি দেশবিভাগে। বঙ্গদেশসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দাঙ্গার ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, মসজিদের সামনে গান-বাজনা এবং ঈদ উপলক্ষে গাে-জবাই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অন্যতম কারণ। এছাড়াও রক্ষণশীল হিন্দু সংগঠনগুলাের শুদ্ধি অভিযান এবং সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ঘটনা সংঘাতের কারণ। অন্যদিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জিন্না-হক প্রমুখের লক্টে-প্যাক্ট বঙ্গীয় মুসলমান নেতৃত্বের একাংশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে । তার পরিণামেও ঘটানাে হয় সংঘাত। 

জিন্নার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ অধিবেশনে (ডিসেম্বর, ১৯১৬) বাংলার উদারপন্থী দুই মুসলমান নেতা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বার্থে মুসলমানপ্রধান দুই প্রদেশ বাংলা ও পাঞ্জাবে সংখ্যালঘুর পক্ষে কিছুটা ছাড় দিয়ে যে প্রস্তাব উত্থাপন (আবদুর রসুল) ও তা সমর্থন (ফজলুল হক) করেন তাতে বঙ্গীয় উচ্চশ্রেণীর মুসলমান নেতৃত্বে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় । নওয়াব সলিমুল্লাহর উত্তরসূরিগণ এবং ময়মনসিংহের স্বনামখ্যাত জমিদার সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী প্রমুখ ভূস্বামী-রাজনীতিক লক্ষে প্যাক্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলেন।  শেষােক্তদের বক্তব্য বঙ্গের ৫২.৬ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যার জন্য ৪০ শতাংশ সংসদীয় আসন নির্ধারণ অন্যায় ও অসঙ্গত । যুক্তিসঙ্গত কথা । অন্যদিকে জিন্না-হক-রসুল ও অনান্য উদার বা মধ্যপন্থীর বক্তব্য- সর্বভারতীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বার্থে বাংলা ও পাঞ্জাবের এটুকু ত্যাগ গুরুতর কিছু নয়। বিষয়টা সরাসরি জনস্বার্থের ছিল না। ছিল ভূস্বামী, উচ্চবিত্ত শ্রেণীর রাজনৈতিক স্বার্থের বিষয়। অন্যদিকে এ চুক্তিতে জিন্নার লক্ষ্য ছিল তার নিজপ্রদেশ বােম্বাই ও গুরুত্বপূর্ণ উত্তরপ্রদেশের জন্য কিছু বাড়তি সুবিধা আদায় । আর হক-রসুলদের লক্ষ্য কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও সর্বভারতীয় ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অর্জন ও রক্ষা।  

কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। কথাটা জন মফিন্ডের লেখায় বিশদভাবে আলােচিত হয়েছে (এলিট কনফ্লিক্ট ইন অ্যা পুরাল সােসাইটি : টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল’, ১৯৬৮)। বাস্তবিক এ ঘটনা ‘এলিট কনফ্লিক্ট’ অর্থাৎ “উচ্চবর্গীয় সংঘাত’ই বটে। কারণ, আগেই বলেছি এ ব্যবস্থার সঙ্গে নিম্নবর্গীয়দের প্রত্যক্ষ স্বার্থ জড়িত ছিল না। কিন্তু সম্প্রদায়-স্বার্থের প্রসঙ্গ টেনে এনে বিদ্বেষ বিরূপতা তৈরি রাজনীতিকদের চিরাচরিত অভাব। এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মহামেডান অ্যাসােসিয়েশন’-এর সভাপতি হিসেবে (১৯১৮) অন্যান্য সমমনা ব্যক্তি ও সংগঠন নিয়ে নওয়াব আলী চৌধুরী বঙ্গীয় মুসলিম স্বার্থের নামে যে-প্রচার শুরু করেন তা বাংলায় সাম্প্রদায়িক আবহাওয়া নতুন করে তৈরিতে অর্থাৎ পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করে। জন ব্রুমফিল্ড বঙ্গে সাধারণভাবে, বিশেষ করে ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে। কলকাতা দাঙ্গার মূল কারণ নির্ধারণ করতে গিয়ে ‘ফরগটন মেজরিটি’র (বিস্মৃত সংখ্যাগুরু’) যে তত্ত্ব হাজির করেছেন (মােস্টলি অ্যাবাউট বেঙ্গল’, ১৯৮২) তা সাম্প্রদায়িকতার সাধারণ প্রেক্ষাপট হিসাবে সঠিক মনে করা গেলেও তা উল্লিখিত কলকাতা-দাঙ্গার মূল কারণ নয়। একাধিক গবেষক লেখকের উপস্থাপিত তথ্য থেকে তা স্পষ্ট । এমনকি ক্ৰমফিল্ডের পরিবেশিত কিছু ঘটনার মর্মার্থ থেকেও তা বুঝতে পারা যায়। তবে এক্ষেত্রে বস্তিবাসী নিমবর্গীয়দের ধনাঢ্য মাড়ােয়ারিদের সম্পদ লুট তাৎপর্যপূর্ণ সন্দেহ নেই। সাম্প্রদায়িক সংঘাতে এমনটাই ঘটে থাকে। নিঃসন্দেহে লক্ষৌ প্যাক্ট (১৯১৬) বঙ্গের উচ্চবর্গীয় উচ্চাভিলাষী কিছুসংখ্যক মুসলমান রাজনৈতিক নেতাকে তাদের স্বার্থসিদ্ধির আশঙ্কায় ক্ষুব্ধ করে এবং তাদের প্রচারে রাজনৈতিক আবহে ভিন্নমাত্রার সংযােজন বিশেষ করে রাজধানী কলকাতায়, যেখানে এর প্রকাশ সর্বাধিক। প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার। কলকাতার মুসলমান জনসংখ্যার ওপর ও নিচ উভয়স্তরে অবাঙালি প্রাধান্য সমাজ ও রাজনীতিকে অনেক সময় অবাঞ্ছিত পথে চালিত করেছে। বিষয়টা সুরঞ্জন দাসের গবেষণায়ও বিশেষভাবে স্পষ্ট। ১৯১৭ সালের সেপ্টেম্বরে বিহারে কোরবানি উপলক্ষে মুসলমানদের ওপর হিন্দু সন্ত্রাসীদের আক্রমণ এক বছর পর প্রায় একই সময়ে কলকাতায় একই উপলক্ষে সংঘটিত হাঙ্গামার পক্ষে আংশিক প্রেক্ষাপট তৈরি করে। সামাজিক আবহাওয়া দূষণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে কলকাতার কয়েকটি উর্দু পত্রিকা (শীলা সেন) এবং কয়েকজন রক্ষণশীল অবাঙালি মুসলিম নেতা যেমন পাঞ্জাবি হাবীব শাহ, মাদ্রাজি কালামি ও বিহারি ফজলুল রহমান (মফিল্ড)। নিমবর্গীয় অবাঙালি মুসলমানদের সঙ্গে এদের ভালাে যােগাযােগ ছিল। তাই হাঙ্গামা ঘটানাে সহজ হয়ে ওঠে। 

তারা সেপ্টেম্বর ১৯১৮ দিনটি সম্প্রীতি নষ্ট করার সময়ক্ষণ হিসেবে স্থির করে। ঘটনা তাদের পক্ষে ছিল। সেবার কোরবানি-ঈদ ও দুর্গাপূজা একই সময়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কাজেই দুষ্টের উপলক্ষের অভাব ঘটেনি। পূর্বোক্ত পত্রিকাগুলাে সাম্প্রদায়িক প্রচারের মাধ্যমে পরিস্থিতি ঘােলাটে করে তােলে বিশেষ করে কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘােষণা করে। এ ছাড়াও পরিস্থিতির অভ্যন্তরে ছিল অবাঙালি মুসলমান বনাম বড়বাজারের বিত্তবান মাড়ােয়ারিদের দ্বন্দ্ব। ইসলাম বিপন্ন’ জাতীয় স্লোগান উত্তেজনা ছড়াতে কাজে লাগে। কিন্তু কুখ্যাত ওই দাঙ্গার (১৯১৮) প্রত্যক্ষ উপলক্ষ কোরবানি। সেপ্টেম্বর ৯ থেকে তিন দিন ধরে সংঘটিত দাঙ্গার ব্যাপকতা বড়বাজার, হাওড়া, মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে। পেছনে ভােজপুর থেকে আগত অবাঙালি মুসলমান শ্রমিক মূলত বদলা নেয়ার উদ্দেশ্যে (শৈলেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, দাঙ্গার ইতিহাস’ ১৯৯২)। তবে বিহার ও অন্যান্য অঞ্চলের নিমবর্গীয় মুসলমানও হাঙ্গামার প্রধান শক্তি হয়ে ওঠে। উপলক্ষ ধর্মীয় হলেও ১৯১৮-এর কলকাতা দাঙ্গার রাজনৈতিক তাৎপর্য সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতা বােধের বিন্দুগুলাে ছুঁয়ে গেছে। বােঝা যায় যে, ধর্মকে ব্যবহার করে জনচেতনা উত্তেজিত করে সামাজিক সহিংসতার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব । এমন এক সম্ভাবনা জাগিয়ে তােলে ওই সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা হাবীব শার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে এমন অনুমান জন মফিল্ডের। পূর্ববর্তী দাঙ্গাগুলাের চরিত্র বিচারে দেখা যায় প্রায় সবই ধর্মীয় কারণ-সংশ্লিষ্ট । কিন্তু এ দাঙ্গায় ভিন্নমাত্রার প্রকাশ। এ সময়কার অনুরূপ ঘটনাবলীতে বঙ্গীয় রাজনীতির একাংশে লক্ষৌ চুক্তিবিরােধী অসন্তোষেরও প্রকাশ ঘটতে পারে তবে প্রত্যক্ষভাবে নয়। ডিসেম্বর ১৯১৭-তে মন্টেগু ও চেমসফোর্ড দুজনেই কলকাতায় এলে চুক্তিবিরােধী তিনটি সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে লক্ষৌ চুক্তির বিপরীতে বঙ্গীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বমূলক যুক্তিসঙ্গত রাজনীতিক সুযােগ-সুবিধা বৃদ্ধি (আসন বৃদ্ধির) আবেদন জানায়। এ মঞ্চে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী অন্যতম প্রধান ব্যক্তি।

তাদের লক্ষ্য ব্যবস্থাপক সভায় অধিকসংখ্যক মুসলিম আসন অর্জন। সেজন্য শাসকশ্রেণীর ওপর নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির চাপই যথেষ্ট, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটানাের প্রয়ােজন পড়ে না। তবে কলকাতা দাঙ্গায় চৌধুরী সাহেবের কোনাে ভূমিকা ছিল না বলে মনে করা হয়। অন্যদিকে হক-রসুল গ্রুপ বা অনুরূপ চিন্তার মুসলিম লীগপন্থীরা তাে তখন লক্ষ্ণৌ চুক্তির বাতাবরণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনুসারী। স্বভাবতই এই দাঙ্গার সামাজিক-রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা   বাস্তবতা বিচারে রাজধানীর উচ্চবর্গীয় অবাঙালিদের। সুরঞ্জন দাসের বিচারব্যাখ্যায় তারা ধনী আশরাফ’ হিসেবে চিহ্নিত। তারাই কলকাতার মুসলিম জনগােষ্ঠীর নেতৃত্বে। এদের মধ্যে রয়েছে অভিজাত, ভূস্বামী, ব্যবসায়ী গােষ্ঠী (কমিউনাল রায়ট ইন বেঙ্গল’-১৯০৫-১৯৪৭’, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯১)। এরা উর্দুভাষী এবং ফার্সি-আরবি সংস্কৃতির ধারক-বাহক, বাংলাভাষা সাহিত্য বা বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে এদের কোনাে নাড়ির যােগ নেই, থাকার কথাও নয়। এরা বঙ্গদেশবাসী কিন্তু বাঙালি নয়।

এখানেই ফজলুল হকদের সঙ্গে এদের রাজনৈতিক প্রভেদ। হক গ্রুপ একদিকে গ্রামীণ মুসলমান (কৃষক-কারিগর) অন্যদিকে উঠতি-শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীর রাজনৈতিক প্রতিনিধি। সেই শক্তিতে রাজধানীতে তাদের অবস্থান। কিন্তু প্রথমােক্ত গ্রুপ রাজধানী-ভিত্তিক রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বা অধিকতর শক্তিমান। তাই উর্দুভাষী উচ্চশ্রেণী থেকে একই ভাষাভাষী বস্তিবাসী শ্রমজীবীশ্রেণী তাদের নিয়ন্ত্রণে । কলকাতার এ মুসলিম বৈশিষ্ট্য পরবর্তী কয়েক দশকেও একই রকম দেখা গেছে। তখনাে কলকাতার স্থানীয় মুসলিম নেতৃত্ব বাঙালি চেতনার ফজলুল হক, রসুল, গজনভীদের হাতে নয়, ছিল উর্দুভাষী সােহরাওয়ার্দী ও নাজিম গ্রুপের হাতে। সেখানে আবার স্থানীয় শক্তিবিচারে সােহরাওয়ার্দী ইস্পাহানিদের প্রাধান্য) ভারতবিভাগের প্রবক্তা শহীদ সােহরাওয়ার্দীর বঙ্গবিভাগের আপত্তির কারণ বুঝতে তাই কষ্ট হয় না। নিজের শক্তিকেন্দ্র কে হারাতে চায়? চনিনি সােহরাওয়ার্দী কলকাতা হারাতে । এটাই ১৯৪৭-এ তার যুক্তবঙ্গের পক্ষ নেয়ার মূল কারণ। এ অপ্রিয় সত্য অনেকে হয়তাে মানতে চাইবেন না। | পূর্বোক্ত বৈশিষ্ট্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ক্রমশ প্রসার ঘটিয়েছে বিশেষ করে কলকাতায় তার শক্তিবৃদ্ধি করেছে। চল্লিশের দশকের কলকাতায় মুসলিম রাজনীতির চরিত্র বিশ্লেষণেও এ সত্যটাই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। দেখা যাবে আধুনিক চেতনার সঙ্গে মাওলানা-নির্ভর ধর্মীয় রাজনীতির সহাবস্থান।  সােহরাওয়ার্দী ও মাওলানা আকরম খাঁ বােধহয় এদিক থেকে সঠিক উদাহরণ। ফজলুল হক সেক্ষেত্রে চল্লিশের দশকের প্রথমার্ধে যেমন ব্রাত্য তেমনি ১৯১৮ সালের বিস্ফোরক পরিস্থিতিতে ব্রাত্য না হলেও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরােধে যথেষ্ট সক্ষম নন। তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। ক্রমফিল্ড তার পর্যালােচনায় হককে নিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন গােটা মুসলমান সম্প্রদায়ের পরিপ্রেক্ষিতে । কিন্তু সেটা গােটা বঙ্গের বিচারে নয়, কলকাতাই মুসলমান সম্প্রদায়ের বিচারে সত্য। লক্ষ্ণৌ চুক্তির নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন বাদেও মূলত সব সম্প্রদায়ের সমর্থনকামী বাঙালি হওয়ার কারণে বিভিন্ন সময়ে   হকের বিরুদ্ধে চলেছে রক্ষণশীল ও সম্প্রদায়বাদী শিক্ষিত মুসলমানদের নিন্দাবাদ, কখনাে কটুক্তি । মােসলেম হিতৈষী’ তাই লিখতেই পারে যে হক মুসলমানদের একাংশের প্রীতিভাজন এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে হিন্দু সমাজে খ্যাতি প্রতিপত্তি লাভে আগ্রহী’ (ক্রমফিল্ড)। এ অভিযােগ সঠিক ছিল না ।

হক মুসলিম স্বার্থ রক্ষা করেই সামপ্রদায়িক সম্প্রীতিতে আগ্রহী ছিলেন। বহু ঘটনা তার প্রমাণ। কুখ্যাত ওই কলকাতা দাঙ্গার চরিত্র বিচার ও তার উত্তর-প্রভাব জন ব্লুমফিল্ড যেভাবে খুশি ব্যাখ্যা করতে পারেন কিন্তু একটি বিষয় একাধিক গবেষণার তথ্যমতে স্পষ্ট যে দাঙ্গার পরিকল্পনায় যেমন কলকাতার উচ্চবর্গীয় অবাঙালিগােষ্ঠী তেমনি এতে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশই বহিরাগত বিভিন্ন অবাঙালি জনগােষ্ঠীর মানুষ। প্রধানত যুক্তপ্রদেশ, বিহার, উড়িষা অঞ্চলের । তারা শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া বাঙালি নন। | আর সমাজে প্রতিষ্ঠিত শ্রেণী থেকে দাঙ্গায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিশেষভাবে দেখা গেছে অবাঙালি ধর্মপ্রচারক, সাংবাদিক ও অনুরূপ রক্ষণশীল শ্রেণীর ব্যক্তিদের যারা বাংলার বাইরে থেকে এসে কলকাতায় থিতু, মূলত জীবিকার প্রয়ােজনে (সুরঞ্জন দাস, প্রাগুক্ত)। ছিল আঞ্জুমান, ওলেমা ও সাম্প্রদায়িক সাংবাদিক গােষ্ঠীর মতাে একাধিক সংগঠন এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত । এবং লুটপাট ও সামাজিক অপরাধে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় দুবৃত্তশ্রেণীর লােক। এর পেছনে মাড়ােয়ারি বিদ্বেষ যেমন সক্রিয় ছিল তেমনি ছিল মাড়ােয়ারিদের ভূমিকা যা ১৯২৬-এর অনুরূপ সাম্প্রদায়িক সহিংসতায়ও দেখা গেছে । ১৯১৮এর সাম্প্রদায়িক হিংসা-বিভেদের ধারাবাহিকতা প্রকাশ পেয়েছে গােটা বিশের দশকে বঙ্গের বিভিন্ন স্থানে। আর এ সত্যটাও বরাবরের যে শাসন-কর্তৃপক্ষ প্রয়ােজনীয় মাত্রায় সজাগ, সতর্ক ও সক্রিয় ছিল না। থাকলে তিনদিন ধরে কলকাতায় হত্যা ও ধ্বংসকাণ্ড চলতে পারত না। প্রশাসনিক এ ঐতিহ্য ১৯৪৬৪৭ সাল পর্যন্ত একইভাবে দেখা গেছে। 

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!