বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলন ও সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী
কথাটা আগেও বলা হয়েছে যে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতিক্ষেত্রে ধর্মীয়চেতনা বা ধর্মীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ও প্রভাব জাতিসত্তার জন্য সুস্থ পরিণাম বয়ে আনে না বিশেষ করে যেখানে একাধিক ধর্মবিশ্বাসী মানুষের বাস। কিন্তু ব্রিটিশ ভারতীয় রাজনীতিতে বঙ্গদেশে এই অবাঞ্ছিত ঘটনাই একাধিক সময়পর্বে ঘটেছে। বলাবহুল্য কোনাে পর্বেই এর তাৎক্ষণিক বা স্থায়ী পরিণাম শুভ হয়নি, মঙ্গলজনক হয়নি। বঙ্গভঙ্গবিরােধী স্বদেশী আন্দোলন তার পরিচ্ছন্ন প্রমাণ। প্রমাণ বঙ্গীয় বিপ্লবী আন্দোলনের ঘটনাবলীতে এবং কংগ্রেসের একাধিক আন্দোলনের নীতিগত ও কর্মসূচিগবিভ্রান্তিতে ধরা রয়েছে কংগ্রেস যে তার কর্মসূচির মাধ্যমে মুসলমান জনশ্রেণীতে তার অবস্থান তৈরি করতে চেষ্টা চালায়নি, এ সমালােচনা বরাবর রবীন্দ্রনাথের । কথাটা অধ্যাপক সুশােভন সরকারও বলেছেন এভাবে: পূর্ববঙ্গের ব্যাপক সংখ্যক মুসলমান চাষিদের জাগিয়ে তুলতে স্বদেহী আন্দোলন যে ব্যর্থ হয়েছিল তা অকপটে স্বীকার করেছেন রবীন্দ্রনাথ। পাবনার প্রাদেশিক সম্মেলনে (ফেব্রুয়ারি, ১৯০৮) সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী হিন্দু ‘ভদ্রলােক’ শ্রেণির লােকেরাই; এই ভদ্ৰশ্রেণির লােকেরা কখনই নিজেদের দেশের মুসলমানদের সঙ্গে কিংবা সাধারণ হিন্দুদের সঙ্গেও এক হয়ে মেশার চেষ্টা করেনি’ (প্রাগুক্ত)। আসলে মুসলমান চাষিই নয়, মুসলমান মধ্যশ্রেণি বা নিমশ্রেণিকেও কংগ্রেস আন্তরিকভাবে কাছে টানার চেষ্টা করেনি। বরং প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভায় ভােট দিয়েছে প্রজাস্বার্থের বিলের বিরুদ্ধে, যে-প্রজাশ্রেণির অধিকাংশই মুসলমান। বঙ্গভঙ্গপূর্ব দুই দশকে কংগ্রেস হিন্দু নিমবর্গীয়দের সঙ্গেও সম্পর্ক তৈরি করেনি। বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষে স্বদেশী আন্দোলনের ব্যাপকতা কংগ্রেসের তৃণমূল সম্পর্ক নিশ্চিত করে। বঙ্গ ও বাঙালি জাতীয়তা নিয়ে তৈরি হয় আবেগআলােড়ন। মুসলিম একাংশ সাময়িক তাতে যােগ দেয়। তাতেই শঙ্কিত হয় শাসকশ্রেণি । বিশেষ করে শঙ্কিত হয় আন্দোলনের প্রথম দিকে হিন্দুমুসলমানের ঐক্য লক্ষ্য করে।
এ ধারা শুরু হয় ১৯০৪ সাল থেকেই চট্টগ্রামে, বগুড়ায় মুসলমান-নেতাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিশাল প্রতিবাদী জনসভায় । বিস্ময়কর ছিল কলকাতায় ২৩ সেপ্টেম্বর (১৯০৫) হিন্দু-মুসলমান ছাত্রদের বিশাল শােভাযাত্রা যার তুলনা চলে ১৯৪৫, ১৯৪৬-এ নভেম্বর ও ফেব্রুয়ারি ও ত্রিদলীয় বিশালায়তন ছাত্রজনতার শােভাযাত্রার সঙ্গে। এমনি একাধিক সমাবেশ, শােভাযাত্রা জাতীয়তার চেতনা প্রতিফলিত করেছিল। প্রসঙ্গত নাখােদা মসজিদে মুসল্লিদের হাতে রবীন্দ্রনাথের রাখি বাঁধা এবং বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানসহ বিখ্যাত ভাষণ ছিল ঐক্যের প্রতীক। কিন্তু বাস্তবতা ছিল অন্যরকম। আগেই বলা হয়েছে সরকারি প্রচার, সলিমুল্লাহ গােষ্ঠীর স্বাতন্ত্রবাদী প্রচার, নতুন প্রদেশ মানেই আরাে বেশি চাকরি এবং সুযােগ-সুবিধা, উচ্চপদ’ ইত্যাদি উচ্চ ও মধ্যশ্রেণির মুসলমানদের স্বদেশী আন্দোলন থেকে সরিয়ে নিতে সফল হয়েছিল’ (সুমিত সরকার)। প্রকৃতপক্ষে বিভাজনপন্থীগােষ্ঠীর অর্থ ব্যয়, চক্রান্ত ও সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পটভূমিতে মুসলমান জনগােষ্ঠীর সিংহভাগ (পূর্ববঙ্গে) ক্রমে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায় । বৈরিতা তৈরি হয় স্বদেশীদের সঙ্গে। তাতে সুবিধা হয় শাসকশ্রেণির দুপক্ষকে লড়িয়ে দিতে। এতে স্বদেশিদের দায়ও কম ছিল না। আসলে লড়িয়ে দেয়ার সুযােগ তৈরি হয় স্বদেশী রাজনীতিতে ধর্মীয় উপাদানের অনুপ্রবেশে যে-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সমালােচনা ছিল বাস্তবভিত্তিক। বিষয়টার রাজনৈতিক তাৎপর্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে বলে কিছুটা উদ্ধৃতিব্যাখ্যার প্রয়ােজন রয়েছে, যা পাঠককে আমাদের বক্তব্যের পক্ষে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। ব্যাপক জাতীয়তাবাদভিত্তিক স্বাদেশিকতাকে ধর্মীয় সংস্কৃতির বৃত্তে আবদ্ধ করার কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। স্বদেশীরা ভেবে দেখেননি যে তাতে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরূপতা তৈরি হবে, তাদের সমর্থন মিলবে না। সম্ভবত তারা ওই সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি। ভাবেননি যে, শাসকশ্রেণি এর সুযােগ নিতে পারে। এদিক থেকে কংগ্রেসী নেতৃত্বের চিন্তায় বিচক্ষণতার অভাব ছিল। গণপ্রতিক্রিয়ার ব্যাপকতা তাদের দূরদর্শী হতে দেয়নি। তাই স্বদেশী মেজাজের সঙ্গে অন্তরঙ্গ যােগ ছিল রাজনীতি ও ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদের মিলন প্রয়াসের। এটিকে বারবার ব্যবহার করা হয়েছিল কর্মীদের নৈতিক শক্তিবৃদ্ধি ও জনসংযােগের প্রধান উপকরণ হিসেবে । সুরেন্দ্রনাথ দাবি করেছিলেন মন্দিরে দাঁড়িয়ে স্বদেশীদের শপথ নেয়ার’ (সুমিত সরকার)। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধে, উপন্যাসে এসবের উদাহরণ মিলবে।
অবশ্য এখানেও ভিন্নমত ছিল। যেমন ছিল বিচক্ষণ রাজনীতিকদের মধ্যে, তেমনি বুদ্ধিজীবী বা সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে। এরা ভবানী পূজা, শিবাজী উৎসব ইত্যাদি আচার-অনুষ্ঠানের সমালােচনা করে বিবৃতি দিয়েছেন বা মতামত প্রকাশ করেছেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর মতাে ধীরস্থির শান্তপ্রকৃতির পণ্ডিত এসব ‘অতীত অনুরাগ ব্যাধি বিশেষ হিসেবে বিবেচনা করেছেন (প্রবাসী ১৯০৬ খ্রি.)। আর রবীন্দ্রনাথ এসব কারণে শেষ পর্যন্ত স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন। বঙ্গভঙ্গবিরােধী আন্দোলন যেভাবে জাতীয়তাবাদী স্বদেশী আন্দোলনে পরিণত হয় বয়কট, বিদেশি দ্রব্য বর্জনে (বিশেষ করে কাপড়) তেমনি ধর্মীয় সংস্কৃতির সংযােজনে তাতে সাম্প্রদায়িক বিভেদের বীজও রােপিত হয়েছিল একের পর এক ঘটনা তার কারণ। স্বদেশী আন্দোলনের প্রাথমিক আবেগশেষে দুটো নেতিবাচক উপকরণের বিবেচনা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত এতে ছিল শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যশ্রেণির স্বার্থের প্রাধান্য। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘আমরা শিক্ষিত কয়েকজন এবং দেশের বহু কোটি লােকের মাঝখানে একটা মহাসমুদ্রের ব্যবধান। কিন্তু সেদিকে কংগ্রেসের নজর ছিল না। দ্বিতীয়ত এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ধর্মীয় সংস্কৃতির আরােপ হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটায় যা মুসলমানদের পক্ষে গ্রহণযােগ্য মনে হয়নি। এ পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক অবাঞ্ছিত ঘটনা বিচ্ছিন্নতার পরিবেশ তৈরি করে । বিলেতি বর্জনের নামে সস্তা বিদেশি কাপড়ের বদলে চড়া দামে দেশি কাপড় কেনার জবরদস্তি গরিব মুসলমান মানতে চায়নি। আন্দোলনের সুযােগে দেশি মিলমালিকদের কাপড়ের দাম বাড়ানাে মুনাফাবাজি এবং তা নিয়ে স্বদেশীকর্মীদের বাড়াবাড়ির ঘটনায় ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ আপত্তি জানান এবং স্বদেশী নেতাকর্মীদের সতর্ক করে দেন। এ উপলক্ষে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সংঘাত রবীন্দ্রনাথের আশঙ্কা সত্যে পরিণত করে। এসব বােঝার মতাে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা কংগ্রেস নেতাদের ছিল না। অথবা তারা বুঝতে চান নি।
তাছাড়া পেছনে সক্রিয় ছিল সাম্প্রদায়িক প্রচার। তাই সাম্প্রদায়িক ঐক্য নিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয় দুবছরের মধ্যে সে আবেগে ভাটা পড়ে। স্বদেশী আন্দোলনের পূর্বোক্ত ভ্রান্তি, উঠতি মুসলমান মধ্যশ্রেণীর নয়া প্রদেশে সুযােগসুবিধার প্রতি আকর্ষণ, শাসকশ্রেণির প্রচার পূর্ববাংলায় হাওয়া পাল্টে দিতে সাহায্য করে। সবকিছু মিলে এক কথায় স্বদেশী আন্দোলন তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। বরং বঙ্গভঙ্গ রদের সুফল ঘরে উঠেছে। অনৈক্য ও সাম্প্রদায়িক অশান্তির বিনিময়ে। দেখা গেছে মুসলিম বিচ্ছিন্নতার দ্রুতবৃদ্ধি’ (সরকার)। ১৯০৫ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু ঘটনা যেন ভারতের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নির্ধারণে নিয়তির রূপ নিয়ে দেখা দেয়। পূর্বোক্ত ইঙ্গিত কিছুটা স্পষ্ট করে বলা দরকার। এ আন্দোলনের প্রেরণায় যে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদের জন্ম, সেখানেও জাতীয়তাবাদের মতােই ধর্মীয় সংস্কৃতি যথেষ্ট প্রভাব রাখে। একজন স্বনামখ্যাত বিপ্লবীর মতে ধর্মীয় চেতনাপ্রভাবিত এসব আন্দোলন ‘মুসলমানদের দূরে সরিয়ে রাখতে বা বৈরী হতে সাহায্য করেছিল । গীতা আনন্দমঠ ইত্যাদিসহ ধর্মের ওপর গুরুত্ব আরােপের কারণে নেতিবাচক ফল দেখা দেয়’ (হেমচন্দ্র কানুনগাে)। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সরকারি উদ্যোগে অভিজাত ভূস্বামী ও উচ্চমধ্যবিত্ত মুসলমানদের নিয়ে স্বতন্ত্র মুসলিম রাজনীতির বিকাশ ঘটাতে ঢাকায় ১৯০৬ সালে “নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠন। এর প্রধান কারিগর যেমন ঢাকাই নবাব সলিমুল্লাহ এবং আগা খানের মতাে উচ্চবর্গীয় ব্যক্তি, তেমনি এর নেপথ্য নায়ক ব্রিটিশরাজ। রাজনৈতিক উচ্চাকাক্ষী কিছুসংখ্যক মধ্যবিত্তও এ সংগঠনে যােগ দেন। প্রসঙ্গটি পূর্বে উল্লেখিত | ‘রাজ’পক্ষে এ পদক্ষেপের তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গভঙ্গবিরােধী আন্দোলনের লাগাম টেনে ধরা, মূল উদ্দেশ্য ভবিষ্যতে কংগ্রেস রাজনীতির বিরুদ্ধে স্থায়ী সাম্প্রদায়িক প্রতিপক্ষ তৈরি করা। তাদের শেষােক্ত উদ্দেশ্য ভালােভাবেই সিদ্ধ হয়েছিল। হিন্দু-মুসলমানের রাজনৈতিক সম্পর্ক বিদ্বেষ ও তিক্ততায় পর্যবসিত হয়ে শেষ পর্যন্ত দেশবিভাগ নিশ্চিত করে।
১৯০৫ সালের বঙ্গবিভাগ ১৯৪৭ সালে অবাঞ্ছিত পরিবেশে সম্পন্ন হয়। অবশ্য ভারত বিভাজনের পটভূমিতে। এই সময়পর্বের তৃতীয় ঘটনাটি আরাে গুরুত্বপূর্ণ এবং তা শুধু বঙ্গের জন্যই নয়, সর্বভারতীয় রাজনীতির জন্য, তার গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য। তা হলাে বহু আলােচিত মর্লি-মিন্টো শাসনতান্ত্রিক সংস্কার প্রস্তাব (১৯০৯)। মূলত হিন্দুমুসলমান রাজনীতি ও তাদের ভবিষ্যৎ পৃথক করার উদ্দেশ্য নিয়ে রচিত এ প্রস্তাব বিভাজনের প্রাথমিক ভিত তৈরিতে সাহায্য করে। এই ধারায় এক দশক পর একই উদ্দেশ্য জোরদার করতে মন্টেগু-চেমসফোর্ড প্রস্তাব (১৯১৯) এবং পরবর্তী অনুরূপ প্রস্তাবাদি যা প্রসঙ্গক্রমে ইতঃপূর্বে উল্লেখিত । তবে বড় বিভাজক অস্ত্রটি ছিল হিন্দু-মুসলমানের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচন যা ওদের যাত্রাপথ ভিন্ন করে দেয়। শুধু সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থাতেই সন্তুষ্ট থাকেনি ‘রাজ’ সরকার। এ তিনটি ঘটনাই ভারতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ রচনায় একসূত্রে গাঁথা। স্বভাবতই একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভাবতেই পারেন যে এই বিভাজক-ভিত তৈরির প্রেক্ষাপটে এবং বঙ্গভঙ্গবিরােধী তুমুল রাজনৈতিক আন্দোলনের বিবেচনায় সুচতুর রাজসরকার ১৯১২ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করে। উস্কে দেয় মুসলমান সমাজে এর প্রতিক্রিয়ার আগুন বা দাহ। ইংরেজ রাজনীতির ধূর্ত খেলা! তাই রাজনীতির এ সময়পর্বটি সুসময়ের চেয়ে আসলে দুঃসময়েরই ছিল, বিশেষ করে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায়। শীলা সেনের মতে, বঙ্গভঙ্গের কারণে বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে টেনশন তৈরি হয়। কিন্তু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি আপাত-প্রাপ্তির আনন্দে এই খেলা বুঝতে পারেনি। বা তাতে গুরুত্ব আরােপ করে নি। এ উপলক্ষে বঙ্গীয় রাজনীতিতে মুসলমান, মূলত পূর্ববাংলার মুসলমান সমাজের চোখে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নভিত্তিক রাজনৈতিক চেতনার গুরুত্ব পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। তাদের চিন্তা ও তৎপরতা দুই-ই স্বতন্ত্র পথ ধরে চলায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। বিচ্ছিন্নতাবােধের পেছনে যুক্তি তৈরি হয় এবং তা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকে। রবীন্দ্রনাথের মতে, এ বিচ্ছিন্নতাবােধ অপ্রাপ্তি ও হতাশা থেকে তৈরি । তৈরি শিক্ষিত হিন্দু ভদ্রলােকশ্রেণির আচরণে যারা ‘সুদিনে-দুর্দিনে মুসলমানদের ছায়া মাড়ানাের কথা ভাবেননি।’ এবং তা যেমন সামাজিক তেমনি রাজনৈতিক পরিসরে। আগেই বলা হয়েছে কবির বক্তব্যে নিহিত বিচক্ষণতা জাতীয়তাবাদী বা বিপ্লববাদী রাজনীতিতে উপস্থিত ছিল না। প্রসঙ্গত ১৯০৮ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলনে (পাবনায়) সভাপতির ভাষণে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক বক্তব্য স্মরণযােগ্য ।
উল্লেখযােগ্য রবীন্দ্রনাথের খেদোক্তি যে এ বিষয়ে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা তার পরামর্শ মাথায় নেবার প্রয়ােজন বােধ করেননি। | একালের বহু পরিচিত শাহবাগে (তখন ঢাকাই নবাবদের অধীনস্থ এলাকা) নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের নিয়ে শিক্ষাবিষয়ক যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারা যায় রক্ষণশীলদের পাশাপাশি কিছুসংখ্যক ভিন্নচেতনার তরুণ ও বয়সী রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিতির কারণে। যেমন বরিশালের তরুণ রাজনীতিক একে ফজলুল হক কিংবা উদারপন্থী অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক নেতা হাকিম আজমল খান এবং অনুরূপ আরাে কয়েকজনের উপস্থিতি উল্লেখযােগ্য। এরা ভবিষ্যতেও নিজ নিজ বলয়ে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি বা উদারনৈতিক অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিকাশের পক্ষে কাজ করেছেন, সফলতা-ব্যর্থতা সেক্ষেত্রে যতটা বিবেচ্য তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাদের প্রচেষ্টা। আবারাে বলতে হয় বঙ্গভঙ্গবিরােধী ব্যাপক আন্দোলনের সাফল্যে মুগ্ধ কংগ্রেস বঙ্গ ও ভারতে মুসলিম রাজনীতির পটপরিবর্তনের তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টা করেনি। এমনকি মুসলিম লীগের প্রাথমিক চরিত্র (কিছুটা প্রাথমিক পর্বের কংগ্রেসের মতােই) ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বুঝে নিয়ে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের বিচক্ষণতা দেখাতে পারেনি জাতীয় কংগ্রেস। শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চায় অগ্রসর জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে বিচক্ষণতা প্রত্যাশিত বলেই সমালােচনামূলক এ মন্তব্য যা প্রকৃতপক্ষে অন্ধ বা একপেশে সমালােচনা নয় ।
ডিসেম্বর ৩০, ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ। স্থান ঢাকার শাহবাগ। মনে রাখতে হবে বিশ শতকের প্রথম দিকে বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের রাজনৈতিক আত্মচেতনার প্রকাশ। যে বিশেষ স্তরে পৌছায় তা পরে দশকে দুশকে বিকশিত হয়েছে। প্রাথমিক পর্বের কিছুটা উদারনৈতিক ও আপসবাদী চরিত্র পরে ক্রমশ সম্প্রদায়বাদী তিক্ততা ও তীব্রতায় হিংসাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। শাহবাগে অনুষ্ঠিত ওই মুসলিম সম্মেলনের শেষ অধিবেশনে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন নবাব সলিমুল্লাহ, তাতে সমর্থন জ্ঞাপন করেন স্বনামখ্যাত রাজনীতিক হাকিম আজমল খান (শীলা সেন : মুসলিম পলিটিক্স ইন বেঙ্গল, ১৯৭৬)। এ প্রস্তাবের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলাে : ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতীয় মুসলমানদের বিশ্বস্ততার প্রকাশ, তাদের রাজনৈতিক অধিকার ও স্বার্থ এবং প্রয়ােজন ও প্রত্যাশা সংরক্ষণ ও তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতি বিরূপতা-বিদ্বেষ উদ্ভবের প্রতিরােধ । শেষােক্ত সূত্রটি অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের হলেও তা শর্তহীন ছিল না। এবং পরবর্তীকালে মুসলিম লীগ শেষােক্ত সূত্রটি থেকে সরে গিয়েছিল সম্প্রদায়বাদী চেতনার টানে। এমনকি ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম লীগের ক্ষুব্ধ ও হতাশ নেতৃত্ব পূর্বোক্ত চেতনা ধরে রাখতে পারেনি। এমনকি পারেনি স্বদেশী আন্দোলনের ব্যাপকতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ায় । মুসলমান প্রধান পূর্ববঙ্গে ১৯০৭ সাল থেকে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তার প্রমাণ। আর বঙ্গভঙ্গ রদের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তাদের ক্রোধের অভিব্যক্তি ঘটে নানাভাবে। ঘটে ১৯১২ সনের ফেব্রুয়ারিতে কার্জন সাহেবের কাছে সােহরাওয়ার্দীর লেখা চিঠিতে।
বঙ্গভঙ্গ রদের প্রভাব পড়ে সর্বভারতীয় মুসলমানের চিন্তায়, বিশেষ করে রাজনীতিমনস্কদের ক্ষেত্রে। তাই ১৯২০ সালের নিখিল ভারত মুসলিম লীগের নাগপুর অধিবেশনে ভারতীয় মুসলমানদের রাজনীতিতে অধিকতর সংখ্যায় অংশগ্রহণ ও স্বনির্ভরতার আহ্বান জানানাে হয়। মুসলিম রাজনীতির সূচনাসূত্র হয়ে ওঠে বঙ্গদেশ, পূর্ববাংলা। দুবছর পর মুসলিম লীগের কলকাতা অধিবেশনে পূর্বোক্ত ক্ষোভের প্রকাশ আরাে স্পষ্ট। মুসলমান শিক্ষিতশ্রেণির নানান দাবি মূলত তরুণদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়। এদের নেতৃত্ব দেন ফজলুল হক। জোর পায়ে হাঁটতে থাকে বাঙালি মুসলমান শিক্ষিত-শ্রেণির আত্মসচেতনতার ধারা। বঙ্গীয় ও ভারতীয় মুসলমান মানসের সংক্ষুব্ধ চেতনার উপশম ঘটাতে হােক বা সেই সঙ্গে শাসকদের ভেদনীতির কৌশল বাস্তবায়নের প্রয়ােজনে হােক বঙ্গসহ ভারতীয় মুসলমানদের বিশেষ সুবিধা উপহার দিতে মর্লি-মিন্টো শাসনতান্ত্রিক সংস্কার প্রস্তাবে ধর্মসম্প্রদায়ভিত্তিক স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন নিশ্চিত করা হয়। এ সম্বন্ধে আগে বলা হয়েছে। তবে বিষয়টি ভারতীয় রাজনীতির জন্য এতই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল যে এ সম্বন্ধে হডসন তার বিশাল গ্রন্থে যে মন্তব্য করেছেন তার মূল কথা হলাে । ‘ভালাে বা মন্দ যা-ই হােক পাখার দান পড়ে গেছে। ভারতীয় সংবিধানে স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হলাে যা ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। অধিকাংশ হিন্দু রাজনৈতিক নেতা ও লেখক এবং জাতীয়তাবাদী মুসলমান অনেকে প্রস্তাবিত ব্যবস্থাকে সম্প্রদায়বাদী নির্বাচন পদ্ধতি হিসেবে। চিহ্নিত করেন। আন্তঃসাম্প্রদায়িক বিভেদ রাজনীতিতে পাকাপােক্ত করা এবং মুসলমান সমাজে সমন্বিত জাতীয় চেতনা ও জাতীয়তাবাদী সংগঠনের উদ্ভব ব্যাহত করা এর উদ্দেশ্য ছিল, যাতে আর্থ-সামাজিক উন্নতির ক্ষেত্রে ধর্মের প্রাধান্য বজায় থাকে। হডসন স্বীকার করেছেন যে, এই সমালােচনায় বাস্তবতা রয়েছে।
কারণ স্বতন্ত্র নির্বাচনের ফলে হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরনির্ভরতার অবসান ঘটবে। রাজনীতিতে তাদের চলার পথ শুধু ভিন্নই হবে না, সম্প্রদায়বাদী চরিত্রের প্রতিযােগিতা প্রধান হয়ে উঠবে যা ক্রমে সহাবস্থানের পারস্পরিকতা ব্যাহত করবে। আর সেখানে যদি তুঘােড় তৃতীয় শক্তির স্বার্থ ও ভূমিকা থাকে তাহলে কথাই নেই। এখন তারা কোনাে না কোনাে পক্ষকে দাবার খুঁটি বা কখনাে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করবে। প্রকৃতপক্ষে ভারতে ব্রিটিশরাজ তেমন কাজই করেছে এবং কখনাে কখনাে রাজনীতির ময়দানটিকে কুরুক্ষেত্রে পরিণত করেছে। হিন্দু-মুসলমান যেন সেখানে কুরু-পান্ডবের প্রতীক, আর যুদ্ধের ভাগ্য নিয়ন্তা স্বয়ং কৃষ্ণঠাকুরের শ্বেতাঙ্গ অবতার ইংরেজ শাসক। আমার বিবেচনায় পশ্চাদপদ জনগােষ্ঠীর জন্য যুক্তিসঙ্গত সংরক্ষণ ব্যবস্থাই যথেষ্ট ছিল। যেমনটা প্রায় দশক দুই পরে চেষ্টা করেছিলেন স্বরাজ্য দলের নেতা চিত্তরঞ্জন দাশ। একই কথা বলেছিলেন রাজনীতিমনস্ক রবীন্দ্রনাথ। যা-ই হােক পূর্বোক্ত বিষয়ে ইংরেজ আমলা হডসন রাজ’ ভূমিকা পর্যালােচনায় নির্মোহ বা নিরপেক্ষ হতে পারেননি। ব্রিটিশরাজ হিন্দু-মুসলমান বিভেদ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা শাসকস্বার্থে কাজে লাগিয়ে থাকলেও তারা তা তৈরি করে নি, বলেছেন হডসন। কথাটা অর্ধেক সত্য। যেটুকু ভেদ স্বাভাবিক তা বহুগুণ বাড়িয়ে তুলতে ক্রমাগত কাজ করেছে ‘রাজ’ সরকার। আর সব বাদ দিলেও পৃথক নির্বাচন তার বড় প্রমাণ। বিভাজনের হাতিয়ার কিছুতেই কখনই হাতছাড়া করেনি ‘রাজ’।
হডসন তার লেখায় এ কথাও স্বীকার করেছেন যে, ব্রিটিশরাজের পক্ষে সাম্রাজ্য চালনার প্রয়ােজনে দরকার ছিল নিজস্ব গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য কংগ্রেসের ক্রমবর্ধমান দাবি প্রতিহত করতে মুসলমানদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের মতাে একাধিক সুবিধা দিয়ে তাদের সরকার পক্ষে আনার। রাজ’ শাসন তাই করেছে। এতে মন্দ খেলার কিছুই নেই। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ সামনে রেখে দুই সম্প্রদায়কে পরস্পর বিরােধিতায় নামিয়ে দেয়া ভালাে খেলার উদাহরণ হিসেবে মেনে নেয়া যায় না। অনৈতিক মন্দ খেলাটাই তারা খেলেছে। অবশ্য এ বিষয়ে তার শেষ কথায় থলের বিড়াল বেরিয়ে এসেছে। তিনি বলেছেন, ভারতে ইংরেজ শাসকগণ ছিলেন বাস্তববাদী। তারা যদি ভারতীয় সম্প্রদায়গুলাের মধ্যে বিরাজঁমীন দ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যরক্ষার স্বার্থে কাজে লাগিয়ে থাকেন তাহলে সে কাজের পেছনে যুক্তি আছে, তাতে আপত্তির সুযােগ। কোথায় । আসলে এটাই ভারতে ইংরেজ শাসন দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। কিন্তু এ সত্য ভারতীয় রাজনীতির নেতৃত্ব- কী হিন্দু কী মুসলমান বুঝেও বােঝেনি। বরং দ্বন্দ্বটিকে তারা বাড়িয়ে তুলেছেন এবং তা টেনে নিয়ে গেছেন বিভাজনের ঘটনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। মনে রখতে হবে বঙ্গভঙ্গ এবং এর বিরুদ্ধে সংঘটিত আন্দোলনের দ্বিপাক্ষিক জটিলতা, শাসকশ্রেণির দান-প্রতিদান, বঙ্গে সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্ব ও বিশ্বপরিস্থিতি এসব কিছু মিলে বঙ্গভঙ্গ-সংশ্লিষ্ট সময় বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ও ফলাফলের জন্ম দেয় যা ছিল বিচিত্র চরিত্রের। এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই দিকই ছিল। তবে সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাসের অনিবার্য টানে কংগ্রেসলীগ কিছুকালের জন্য পরস্পরের সান্নিধ্যে আসে, আসে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক। পরবর্তীকালের ঘটনাবলীও একই চরিত্রের প্রতিফলন ঘটিয়েছে- এক কথায় ঐক্য ও অনৈক্যের ধারাবাহিক প্রকাশে।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক