1971.09.14 | ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ | আজকের এদিনে (with references)
১নং সেক্টরে যৌথ আক্রমনের সিদ্ধান্ত
১নং সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর সেনা অফিসারদের সাথে ভারতীয় পূর্বাঞ্চল সেনা কমান্ডার লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় গেরিলা ও ভারতীয় নিয়মিত সৈন্যবাহিনী নিয়ে একসাথে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়।
সংক্ষেপে পরিকল্পনাগুলো নিম্নরূপ –
১। যে ক্যাম্প গুলোতে পাকসেনা কম আছে সেগুলো আগে দখল করা
২। প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালানো এবং তাদের ক্ষয়ক্ষতি করার চেষ্টা করা
৩। পাকসেনাদের যোগাযোগ ব্যাবস্থা ধ্বংস করা
৪। গেরিলা কার্যক্রম বাড়ানো
১ নং সেক্টর কমান্ডার ঃ মেজর রফিক, এডজুটেনট ক্যাপ্টেন এনাম, ফ্লাইং অফিসার সাখাওয়াত, সাব সেক্টর কমান্ডার লেঃ ফজলুর রহমান, ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা বাচ্চু, সুবেদার আলী হোসেন ও আরেকজন সুবেদার
ভারতীয় কমান্ডারের এই সিদ্ধান্ত ভারতীয় সরকারেরই সিদ্ধান্ত বলে জানানো হয়।
সিলেটে পাক বাহিনীর আক্রমন
পাক বাহিনীর একই সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ৪ নং সেক্টরের বিয়ানীবাজার, বড়লেখা, জকীগঞ্জ থানা অবস্থানে (সাব সেক্টর ১ ও ২) ব্যাপকভাবে আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধের প্রস্তুতি থাকায় মুক্তিবাহিনির ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর ৭ জন বীরযোদ্ধা শহীদ ও কয়েকজন আহত হন। ১ নং সাব সেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন মাহবুবুর রহমান সাদি ২ নং সাব সেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন ক্যাপ্টেন রব।
নওগাঁর ধামইরহাট পত্নীতলা সীমান্ত হামলা
এই দিনে মেজর গিয়াসের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্লাটুন খঞ্জনপুর / রামচন্দ্রপুর হাটে পাকিস্তানী সৈন্য অবস্থানে হামলা করে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানীদের ২০ জন সৈন্য ও ১২ জন রাজাকার নিহত ও একজন মুক্তি বাহিনী নিহত ও ২ জন আহত হওয়ার কথা স্বীকার করেছে। পাকিস্তান সরকারের সুত্র উল্লেখ করে পত্রিকা সমুহ মুক্তিবাহিনীর ৬০ জন নিহত ও ২২ জন কে আটক করার খবর প্রকাশ করেছে এবং মুক্তিবাহিনীর প্রচুর অস্র আটক করার সংবাদ প্রকাশ করেছে। [মেজর রফিক ১১ টি সেক্টরের বিজয় কাহিনী]
গভর্নর মালিকের বেতার ভাষণ
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডাঃ আবদুল মোতালেব মালিক বেতার ভাষণে বলেন জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্যোগ শুরু করার উদ্দেশে প্রেসিডেন্ট আমাকে এই প্রদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিযুক্ত করেছেন। আমি আপনাদের সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করছি এই জন্য যাতে প্রদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা যায়। আজকের যুবক শ্রেণী তো জানে না যে, নতুন এক জাতির বাসভূমি আমাদের এই পাকিস্তানকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য আমাদের কত পরিশ্রম করতে হয়েছে। পরিশেষে আমি আরো বলতে চাই যে, আমার সরকার একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার। যে মুহুর্তে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে এবং নির্ধারিত কার্যক্রম অনুসারে উপনির্বাচন সমাপ্ত করা হবে, সেই মুহুর্তে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে জনগণের সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হবে।’ তিনি ভারতে গমনকারী সকলকে ফিরে আসার আহবান জানান এবং আশ্বাস দেন যে ফিরে আসলে তাদের কোন ক্ষতি হতে দেয়া হবেনা। [ইত্তেফাক/সংগ্রাম/ অন্যান্য ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
কিছু সংখ্যক ইবিআর, ইপিআর সদস্য এর আত্মসমর্পণ
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ শাখা জানায় প্রদেশের ময়মনসিংহ দিনাজপুর যশোর সিলেট কুষ্টিয়া কুমিল্লা ও ভোলায় কিছু সংখ্যক ইবিআর, ইপিআর সদস্য আত্মসমর্পণ করেছে। তাদের স্ব স্ব ইউনিটে ফেরত পাঠানোর পর কিছু আর্থিক সাহায্য সহ ছুটি প্রদান করা হয়। আত্মসমর্পণকারীরা বেশীরভাগই অস্র সহ আত্মসমর্পণ করেছে। ছাত্র, আওয়ামী লীগ কর্মী ও কিছু ইপিআর অস্র ছাড়াই আত্মসমর্পণ করেছে। আত্মসমর্পণকারীরা অভ্যর্থনা কেন্দ্রে জানায় তারা তাদের পরিবারবর্গকে সাথে আনতে পারেনি। তারা তাদের অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। [ইত্তেফাক/সংগ্রাম/অন্যান্য ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
৬০ বিদ্রোহী নিহত
পাকিস্তান সরকারের মুখপাত্র বরাত দিয়ে পত্রিকা গুলি লিখেছে রাজশাহী জেলার ভারতের বালুঘাট সীমান্তের খাঞ্জানপুর এলাকায় ভারতের বিএসএফ ৭৭ ব্যাটেলিয়নের একদল বাহিনী ফিল্ড গান এবং গোলন্দাজ সহায়তা নিয়ে ভারতীয় চররা আক্রমন চালালে পাকিস্তানী সৈন্যরা পাল্টা হামলা চালায়। হামলায় ৬০ বিদ্রোহী নিহত হয়েছে। পাকিস্তান বাহিনী এখান থেকে ২২ জন আটক করা হয়েছে। এ ঘটনায় প্রচুর অস্র আটক করা হয়েছে। [ইত্তেফাক/সংগ্রাম/ অন্যান্য ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
ইরাকী সাহায্য
পাকিস্তান সরকার জানিয়েছে ফিরে আসা পূর্ব পাকিস্তানী শরণার্থীদের জন্য ইরাক ৩ লাখ ৯৬ হাজার টাকা দিয়েছে। [ইত্তেফাক/সংগ্রাম/অন্যান্য ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
বরিশালের পল্লী এলাকায় বিদ্রোহী তৎপরতা
বরিশালে ভারতীয় চরেরা লঞ্চ চলাচল বাধা সৃষ্টি করছে। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে তারা হামলা চালিয়ে ধন সম্পদ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের ভয়ে পল্লী এলাকার ইউ সি মেম্বার চেয়ারম্যানেরা আতংকে এখন শহরে অবস্থা নিয়েছে। মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায় দোকানপাট প্রায় বন্ধ থাকছে। মুলাদিতে জীবনযাত্রা অচল করে ফেলেছে ভারতীয় চরেরা। সম্পূর্ণ বরিশাল মহকুমায় তাদের তৎপরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন ঘটনায় এ মহকুমায় ১০-১২ জন নাগরিক ভারতীয় চরদের হাতে নিহত হয়েছে। (দৈনিক সংগ্রাম ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)
ইয়াহিয়ার ইরান সফর
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পাক-ভারত বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্যে দুই দিনের সফরে তেহরানের পৌঁছেন। বিমানবন্দরে তাকে অভিনন্দন জানান ইরানের শাহানশাহ রেজা শাহ পাহলভি। ইয়াহিয়ার সাথে সফর সঙ্গী হয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব সুলতান মোহাম্মদ খান, পিআইএ এর এমডি এয়ার ভাইস মার্শাল জাফর আহমেদ পাকিস্তানে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত মাশেখ করিমদানি। এর আগে ইয়াহিয়া খান করাচী থেকে তেহরান রওয়ানা হওয়ার সময় করাচী বিমান বন্দরে তাকে বিদায় জানান সিন্ধুর গভর্নর লেঃ জেঃ রাখমান গুল, উপদেষ্টা এইচ এম সূফী এবং নৌ বাহিনী প্রধান এডমিরাল মোজাফফর হাসান।[ইত্তেফাক/সংগ্রাম/অন্যান্য ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
খুররম খান পন্নি
ফিলিপাইনে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত খুররম খান পন্নি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করায় পাকিস্তান সরকার তার স্থলে এ এ ফারুককে নিয়োগ দেয়। পাকিস্তান সরকার এক বিবৃতিতে বলেন পন্নির নিয়োগ ছীলো রাজনৈতিক এবং তাকে আগেই প্রত্যাহারের নির্দেশ ছিল। [ইত্তেফাক/সংগ্রাম/অন্যান্য ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
গভর্নর মালিকের টেলিভিশন সাক্ষাৎকার
গভর্নর এ এম মালিক বিবিসি সাংবাদিক রোনালড রবেসনের সাথে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন দিন দিন বিদ্রোহীদের তৎপরতা কমে আসছে এবং তিনি বলেন বিদ্রোহীরা এখনো পূর্ব পাকিস্তানের কোন এলাকা দখল করতে পারেনি। ৩১ আগস্ট নিয়োগ পাওয়া গভর্নর বলেছেন ১০ জন মন্ত্রী নিয়ে তিনি তার প্রশাসনের কাজ শুরু করেছেন। তার মন্ত্রীসভায় আওয়ামী লীগের একজন সদস্য আছে (সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ১৪ সেপ্টেম্বর) মন্ত্রীদের এখনও দপ্তর বণ্টন করা হয়নি।
করাচীতে আবুল কাসেম
কাউন্সিল মুসলিম লীগের প্রাদেশিক সাধারন সম্পাদক আবুল কাসেম করাচীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ইসলামিক আদর্শের ভিত্তিতে এদেশে একদলীয় শাসন ব্যাবস্থা চালুর দাবী জানান। তাহার দাবীর ব্যাপারে তার দলের সমর্থন রয়েছে। তিনি আশা করেন অপর মুসলিম লীগ তার সিদ্ধান্ত সমর্থন করবে। দেশের দুইটি অংশ ভৌগোলিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হইলেও ইসলামিক আদর্শের কারনে খুব কাছাকাছি। এদেশে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির সুযোগ দেয়া হবে না। [ইত্তেফাক/সংগ্রাম/অন্যান্য ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
জাতিসংঘ প্রতিনিধিদল
জাতিসংঘ প্রতিনিধিদলের নেতা নির্বাচিত হওয়ায় যারা তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তাদের প্রতি পিডিপি ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আলী অভিনন্দন জানিয়েছেন। জাতিসংঘ প্রতিনিধিদলের সদস্য এটি সাদি আজ নিউইয়র্কের পথে ঢাকা ত্যাগ করেছেন এবং এডভোকেট জুলমত আলী আগামীকাল রওয়ানা হবেন। [ইত্তেফাক/সংগ্রাম/অন্যান্য ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
ভারতের তৎপরতা
বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার্থে কয়েকটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাফরুল্লাহ চৌধুরী ভারতে এসেছেন। [যুগান্তর/কালান্তর ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গসহ সীমান্ত রাজ্যগুলোকে সম্ভাব্য পাকিস্তানি আক্রমণ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে। রাজ্যের মুখ্য সচিব জেসি সেনগুপ্ত সাংবাদিকদের বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গসহ সারা দেশে অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। যেকোনো সময় পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমন করতে পারে। [যুগান্তর ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
কাশ্মীর বিধান সভায় ধ্বনি ভোটে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের প্রস্তান গৃহীত হয়েছে। প্রস্তাবের উপর ভাষণ দান কালে মুখ্যমন্ত্রী জিএম সাদিক বলেন বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি না দেয়া হলেও যাতে লাখ লাখ শরণার্থী দেশে ফিরে যেতে পারে সে ব্যবস্থা করার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহবান জানান। [যুগান্তর ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
রাতে আসামের করিমগঞ্জের ২ মাইল দূরে করিমগঞ্জ থেকে ধর্মনগর মুখী যাত্রীবাহী ট্রেনে শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে ৬ টি বগী লাইনচ্যুত হয়, একজন নিহত হয় এবং ১৫ জন আহত হয়েছে। বিস্ফোরণে ২৬০ মিটার রেল লাইন উড়ে যায়। পুলিশ বলেছে এটি পাক গুপ্তচরদের কাজ। একটি অবিস্ফোরিত বোমা ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। বোমাটি প্লাস্টিক বোমা। রেল প্রশাসন বলেছে লাইন মেরামতে কমপক্ষে ১৮ ঘণ্টা লাগবে। ঘটনার আগে ঘটনাস্থলের কাছে মহিবাসন রেল স্টেশনে পাক বাহিনী মর্টার আক্রমন করেছিল। [যুগান্তর ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত কেনেথ গলব্রেথ দিল্লীতে সাংবাদিকদের বলেছেন বাংলাদেশের শরণার্থীদের দেশে ফিরে যাবার পর তাদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা থাকা প্রয়োজন। তাদের নিরাপত্তার জন্যই তারা তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়েই বাংলাদেশে ফিরে যাবেন। তিনি বলেন দেশের দু অংশের মধ্যে এখনো আপোষের একটা সম্ভাবনা আছে। আপোষ না হলে পশ্চিম পাকিস্তানেরই ক্ষতি হবে। তিনি বলেন ভিয়েতনামের মত বাংলাদেশের আরেকটি বিপর্যয় কাম্য নয়। তিনি বলেন তিনি গান্ধী বাদী এবং বাংলাদেশে কোন সামরিক সমাধান সমর্থন করেন না। [যুগান্তর ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
Prepared by Salah Uddin