বঙ্গ-ভারতীয় রাজনীতি ও মুসলমান সমাজ
ব্রিটিশ-ভারতে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন স্তরের আইনসভায় ও অন্যত্র অধিক সংখ্যায় ভারতীয় সদস্যের অন্তর্ভুক্তি ও শাসন ব্যবস্থায় সহযােগিতার বিষয়গুলাে প্রাতিষ্ঠানিক মাত্রা পায়। দাবি-দাওয়া পেশ করার সুযােগ-সুবিধাও তৈরি হয়। রাজ’ প্রশাসনও সুযােগ-সুবিধার মুঠো একটু একটু করে খুলতে থাকে। ১৮৯২ সালে ভারতীয় কাউন্সিল আইনে বেসরকারি সদস্যের সংখ্যা বাড়ানাে হয় এবং উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বঙ্গীয় কংগ্রেস নেতাদের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক কাউন্সিলে যােগ দেয়ার সুযােগ আসে। যেমন বােম্বাইয়ে গেলে ও ফিরােজশাহ মেহ্তার মতাে নেতৃবৃন্দ। শীর্ষ প্রশাসনের উদারনৈতিক বা রক্ষণশীল সব শাসকেরই দেশীয়দের সম্বন্ধে মূলনীতি ছিল ‘বিভেদ ও শাসন’ কৌশলের দক্ষ ব্যবহার। অবশ্য সুযােগ-সুবিধাদানের ক্ষেত্রে উদারপন্থী ভাইসরয়গণ (যেমন রিপন) ছিলেন কিছুটা খােলামেলা। কিন্তু রাজনীতির বিষয়টি সর্বদা নিয়মনীতি মেনে মসৃণভাবে চলেনি। বিশ শতকের শুরুতে কংগ্রেস অধিবেশনের মঞ্চ থেকে নানাবিধ সংস্কারের দাবি উঠতে থাকে কিংবা ওঠে বিশেষ বিশেষ সরকারি নীতির উদারনৈতিক সংস্কারের দাবি। এসব ক্ষেত্রে সিংহভাগ সুবিধাই হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাগে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায় : তারা ইংরেজের ইস্কুলে আগেভাগে অধিক মনােযােগের সঙ্গে লেখাপড়া করে শিক্ষিত হওয়ার কারণে নানামাত্রিক সুযােগ-সুবিধার অধিকাংশই তাদের হাতে চলে এসেছে । মুসলমান সমাজ এদিক থেকে পিছিয়ে থাকে । কিন্তু উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় মুসলমানদের তুলনায় শিক্ষা ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অধিক পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমানের অবস্থা ছিল সত্যই করুণ। শাসকদের মধ্যে কেউ কেউ ওই ভেদনীতির বাস্তবায়নে ভারতীয় মুসলমানদের বিশেষ সুবিধাদানের কথা ভাবতে থাকেন। তাদের চিহ্নিত করা হয় পশ্চাৎপদ জাতি’ হিসেবে। সম্ভবত সরকারি প্রেরণায়, কারাে মতে ভাইসরয় মেয়ের নির্দেশে সিভিলিয়ান উইলিয়াম হান্টার ওই নীতির সমর্থনে মুসলমানদের পশ্চাদপদ অবস্থার বিশদ বর্ণনায় লেখেন “দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ গ্রন্থটি (১৮৭১)। ভাইসরয় ডাফরিনের ভাবনায়ও ভারতের মুসলমান সম্প্রদায় হয়ে ওঠে পিছিয়ে পড়া একটি ভিন্ন জাতি’ (১৮৮৮)। তাদের জন্য দরকার সংরক্ষণ নীতি এবং প্রতিনিধি নির্বাচনের স্বতন্ত্র ব্যবস্থা। এর প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেতে খুব দেরি হয়নি। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে শুরু হয় হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব। ভারতীয় মুসলমান জনগােষ্ঠী যে বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়, এথনিক বিচারে একটি জাতিসত্তা নয় এ সহজ সত্য নিয়ে কে অভিজাত ভাইসরয়দের সঙ্গে তর্ক করতে যাবে? কার ঘাড়ে কটা মাথা? তবু লেখাজোখার প্রতিবাদ যে হয়নি তা নয়।
উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় বনাম বঙ্গীয় প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক এগিয়ে ছিল প্রথমােক্ত অঞ্চল শিল্পপুঁজির বিকাশে । বাংলা রাজনৈতিক চেতনায় এগিয়ে থাকলেও এদিকে এগিয়ে যেতে পারেনি। কারণ হিসেবে বলা হয় ‘দ্রলােক’ বাঙালির ব্যবসা ও শিল্পকারখানায় অনাসক্তি এবং জমিতে অর্থ বিনিয়ােগে অভিজাত ভূস্বামী হয়ে ওঠার ঝোক। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এদিক থেকে তাদের সহায়তা করে। এ তত্ত্ব সম্বন্ধে নব্য ইতিহাস বিশ্লেষক কেউ কেউ ভিন্নমত পােষণ করেন। | তবু গুজরাতি, মাড়ােয়ারি, পার্সি বেনিয়াদের জমজমাট শিল্প ও ব্যবসার সাম্রাজ্য অস্বীকার করা যায় কীভাবে? সারি সারি নাম, তখন তাে বটেই এখনাে চেনা। এ পরিস্থিতিতে বঙ্গে গুটিকয় পুরনাে ধারাবাহিকতার মুসলমান জমিদার এবং বিকশিত হওয়ার অপেক্ষায় ভার্দের মধ্যশ্রেণি ও বিপুল সংখ্যক নিমবর্গীয় মুসলমান কৃষক, তাতি-জোলা ও কারিগর শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত মানুষ। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই তাদের নিত্যধর্ম । বাংলায় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ক্রমশ বেড়েছে। অথচারী শিক্ষিত শ্রেণি ও এলিটগােষ্ঠী, ভূস্বামী, পেশাজীবী এমনকি মহাজনদের নিয়ে হিন্দু বাঙালি তখন প্রতিবেশী মুসলমান থেকে অনেক এগিয়ে। বৈষম্য দ্বন্দ্বের কারণ। সর্বভারতীয় ভিত্তিতে কোনাে কোনাে প্রদেশে সাম্প্রদায়িক বৈষম্য লক্ষণীয়। মাত্রায় উপস্থিত ছিল। তাতে কখনাে যুক্ত হয়েছে ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার বিভেদ। কৃষক বনাম জমিদার সমীকরণটা স্কুল বিচারে মুসলমান বনাম হিন্দু তথা ধর্মীয় সমীকরণে পরিণত হয়েছে। যেমন মালাবারে মােপলা কৃষক বিদ্রোহ যা রীতিমতাে আলােড়ন সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে এর চরিত্র বিচারে দুই বিপরীত মতের উদ্ভব- শ্রেণিবিদ্রোহ ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত হিসেবে। হিন্দু মহাসভানেতা মুঞ্জের রিপাের্টের ভিত্তিতে এ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথও বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। সুপ্রকাশ রায়ের মতে মােপলা অভ্যুত্থান অর্থনৈতিক স্বার্থের টানে বাস্তবিকই কৃষক বিদ্রোহ। সুমিত সরকার লিখেছেন- “মােপলা অসন্তোষের বীজ। স্পষ্টতই কৃষি সম্পর্কিত।
দ্বিতীয় উদাহরণটি আমরা নেব বঙ্গদেশের পাবনা থেকে, যেমন ১৮৭৩-এ পাবনার কৃষক বিদ্রোহ। জমিদার তরফে ক্রমাগত কর বৃদ্ধি, নানা উপলক্ষে দৈহিক পীড়ন ইত্যাদি সব কিছুর বিরুদ্ধে মহারানীর রায়ত’ হিসেবে সুবিচার চেয়ে দরিদ্র চাষিদের বিদ্রোহ। প্রজাদের অধিকাংশ মুসলমান, জমিদার হিন্দু। তা সত্ত্বেও এ বিদ্রোহকে শ্রেণিচরিত্র বিচারে কৃষক বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ আন্দোলনের তিন প্রধান নেতার মধ্যে দুজনই হিন্দু- ঈশানচন্দ্র রায় ও শম্ভুপাল, তৃতীয়জন জোতদার খুদি মােল্লা (সুমিত সরকার)। এ আন্দোলনের বিরােধী ছিল ভূস্বামী-প্রধান রাজনৈতিক সংগঠনগুলাে, যেখানে আবার হিন্দুপ্রাধান্য। প্রচারের কল্যাণে বিষয়গুলাে অবাঞ্ছিতরূপে সম্প্রদায় চেতনা স্পর্শ করেছে। লক্ষণীয় যে কংগ্রেস কখনাে এ জাতীয় কৃষক আন্দোলনের প্রতি তাত্ত্বিক সমর্থনও জানায়নি। উনিশ শতকে ভারতে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক চেতনার যে উদ্ভব ও বিকাশ তার অন্যতম প্রধানকেন্দ্র বঙ্গদেশ। এ বিষয়ে দুই সম্প্রদায়েরই তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রয়েছে যদিও চাবিকাঠি ধরা ছিল ব্রিটিশ শাসকদের হাতে। বিষয়টা সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটের হওয়া সত্ত্বেও উনিশ শতকী বঙ্গীয় রেনেসাঁস তথা নবজাগরণ এর ভিত তৈরি করেছে। যেমন রাজনীতিতে, তেমনি সাহিত্যসংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়ে। শেষেক্তটি যথেষ্ট প্রভাব রেখেছে জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির ক্ষেত্রে। পরবর্তী আলােচনায় তা স্পষ্ট হবে। পাশ্চাত্য গণতন্ত্র ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলােয় উজ্জ্বল ইউরােপীয় রেনেসাঁসের প্রভাব সত্ত্বেও বঙ্গীয় রেনেসাঁসের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের যে শক্তিমান ধারা তৈরি হয় তার সঙ্গে প্রবলভাবে হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী রক্ষণশীলতাও প্রধান হয়ে ওঠে। এর নিশ্চিত ফল হলাে রাষ্ট্রীয় সামাজিক জীবনে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা। রামমােহন-বিদ্যাসাগর, মাইকেল-ইয়ংবেঙ্গল পর্ব পার হয়ে এসে স্বাদেশিকতার যে। চরিত্র তাতে সাম্প্রদায়িক চেতনার বিষাক্ত প্রকাশ সর্বাধিক। উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতীয়-বঙ্গীয় রাজনীতি সেই বিষ-প্রভাব ধারণ করেছে, লালন করেছে এবং এর বিস্তার ঘটিয়েছে। উনিশ শতকে সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে তকালীন বাংলাকাব্য ও উপন্যাস পূর্বোক্ত সাম্প্রদায়িক চেতনার উৎস। যেমন রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের টড রচনা প্রভাবিত ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ যা স্বাদেশিকতাকে মুসলমান বিরােধিতায় শক্তিমান করে তােলে। এর প্রেক্ষাপটে রাজপুত শৌর্যবীর্যের কাহিনী। এর ফলে স্বাদেশিকতা আর সর্বজনীন স্বাদেশিকতা থাকেনি। তাতে সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক রক্ষণশীলতা স্থান করে নেয়। একই ধারায় হেমচন্দ্র-নবীনচন্দ্রের কাব্যরচনা।
সেখানে নবীন সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ সাম্প্রদায়িক চেতনায় দুষ্ট। রঙ্গলালের রচনা স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে’ পঙক্তিতে উদ্দীপ্ত মুসলিম তরুণ ‘যবনের দাস হে’ চরণে পৌছে সে উদ্দীপনা আর ধরে রাখতে পারে না, বরং হোঁচট খায়। তবে সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতার সর্বাধিক প্রকাশ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-৯৪) আনন্দমঠ, দুর্গেশনন্দিনী, চন্দ্রশেখর, দেবী চৌধুরানী ও সীতারাম-এর মতাে উপন্যাসে। এর মধ্যে আনন্দমঠ উগ্র মুসলমান বিরােধিতায় স্বাদেশিকতাকে একমুখী সাম্প্রদায়িকতায় বিষাক্ত করে তােলে। ‘বন্দেমাতরম’ তাই সম্প্রদায় বিশেষের জাতীয় সংগীত হয়ে অপর সম্প্রদায়ের প্রবল বিরােধিতার মুখােমুখি হয়। | আনন্দমঠ ও বন্দেমাতরম মন্ত্র হিন্দুত্ববাদকে যেমন উজ্জীবিত করে, তেমনি জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। মুসলমান সমাজ ও রাজনীতিতে এর প্রতিক্রিয়া ছিল পুরােপুরি নেতিবাচক এবং পাল্টা ধর্মীয় চেতনায় তিক্ত । এ বিষয়ে অধ্যাপক সুশােভন সরকারের বক্তব্য ভিন্ন নয়। তার স্র ভাষায় ‘দেশপ্রেমিক লেখকরা শুধু হিন্দু কাঠামােবিশিষ্ট প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিকেই মহিমান্বিত করে তুলতেন না, সেই সঙ্গে স্বাধীনতার দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরতেন রাজপুত, মারাঠা, শিখদের সংগ্রামের কথা। প্রতিটি সংগ্রামেই প্রতিপক্ষ এক ও অভিন্ন মুসলিমরা। এর ফলে জাতীয় চেতনায় আরাে তীব্র হয়ে উঠেছিল হিন্দুপ্রবণতা, তার ফল খুব সুখকর হয়নি’ (বাংলার রেনেসাঁস)। ঘটনার প্রতিক্রিয়া কিন্তু স্র থাকেনি, পরবর্তী ইতিহাস তাই বলে। রাজনীতি ও সমাজে হিন্দুত্ববাদিতা, আচার-আচরণে সনাতনী প্রভাব, শুদ্ধি অভিযান ও সনাতনী হিন্দু সংস্কৃতির প্রচার, শিবাজী উৎসব, ভবানী পূজা ইত্যাদির বিপরীতে মুসলমান সমাজে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবন ও চেতনাশুদ্ধির অভিযান চলে মূলত ওয়াহাবি ও ফারায়েজি আন্দোলনের মধ্যে। এ প্রভাব বঙ্গীয় মুসলমান সমাজে কম ছিল না। যেমন ছিল ফারায়েজি আন্দোলনের প্রথম পর্বে ধর্মীয় প্রভাব । ওয়াহাবি আন্দোলন শুধু সমাজভিত্তিক নয়, এর ছিল তীব্র ব্রিটিশ-বিরােধী রাজনৈতিক চরিত্র । ভাইসরয় মেয়াে আন্দামান সফরে গিয়ে এক ওয়াহাবি সন্ত্রাসবাদীর হাতে নিহত হন। প্রসঙ্গত মাওলানা কেরামত আলী জৌনপুরীর বাংলার জেলায় জেলায় ধর্মীয় প্রচার উল্লেখযােগ্য ঘটনা।
এভাবে উনিশ শতকে সাহিত্য ও ধর্মীয় প্রচারের মাধ্যমে সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে যে প্রভাব প্রবলভাবে আত্মপ্রকাশ করে তার প্রতিফলন ঘটে হিন্দুত্ববাদিতায় ও পাল্টা মুসলিম ধর্মবাদিতায়। জাতীয় চেতনা এভাবে বিভাজিত হয়ে দুই ভিন্ন বিন্দুতে স্থিত হয়। দুই ধারার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রতিফলিত হয় কংগ্রেস, হিন্দুমহাসভা, মুসলিম লীগ প্রভৃতি সংগঠনের তৎপরতায় । দুই সমাজেই এর প্রভাব ছিল যথেষ্ট। তবে শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অগ্রসর হিন্দু সমাজে এর চর্চা হয়েছে অধিকতর মাত্রায়। আমরা তাই লক্ষ্য করি সে সময় হিন্দু সমাজের বিদগ্ধ সাহিত্যিক ও সমাজসেবীদের হাত দিয়ে সমাজ ও রাজনীতির তৎপরতায় সঙ্কীর্ণ হিন্দুত্ববাদিতার প্রকাশ ঘটে। সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয় রাজনারায়ণ বসুর মতাে বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবীর তাই ঘােষণা যে হিন্দু শ্রেষ্ঠত্বই হচ্ছে তার আন্দোলনের মূল সুর’ (সুশােভন সরকার)। একই ধারায় রাজনারায়ণ বসু, গােপাল মিত্র ও ঠাকুর ভ্রাতাদের প্রতিষ্ঠিত সামাজিক সম্মিলন পরিষদ ‘জাতীয় মেলার পরিবর্তে হয়ে ওঠে ‘হিন্দু মেলা’ (১৮৬৭)। স্বাদেশিকতায় এই মেলার প্রভাব নিতান্ত কম ছিল না। কিন্তু তা সঙ্কীর্ণ বিশেষ একটি ধর্ম-সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনায় আবদ্ধ থাকে। এ বিষয়ে উদাহরণ ও আলােচনা বাড়িয়ে লাভ নেই। ভারতীয় রাজনীতির বড় সমস্যা হলাে তা কখনাে অবিচ্ছিন্নধারায় ধর্মবিযুক্ত বা সম্প্রদায় প্রভাবমুক্ত হয়ে উঠতে পারেনি। এ অবাঞ্ছিত বাস্তবতা ইতিহাস পাঠকের কাছে যত দুঃখজনক হােক তা মেনে না নিয়ে উপায় নেই। তাই জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অসাধারণ মেধাবী শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী আনন্দমােহন বসু ও পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী মিলে ১৮৭৬ সালের জুলাই মাসে ভারত সভা (ইন্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েশন) নামে যে সংগঠন তৈরি করেন তাতে অসাম্প্রদায়িক নামী ব্যক্তিগণ (যেমন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় বা রেভারেন্ড কৃঞ্চমােহন বন্দ্যোপাধ্যায়) যােগ দিলেও এর প্রভাব জনমানসে পৌছতে পারেনি। সে চেষ্টাও তাদের ছিল না ।
নরমপন্থী ভাইসরয় রিপনের ‘প্রজাস্বত্ব আইন’ (১৮৮৫) পাসের মতাে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তাদের রাজনৈতিক চেতনায় দাগ কাটেনি। কাটেনি তাদের শ্রেণিস্বার্থ ও শ্রেণি। অবস্থানের কারণে। এখানেও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পাশাপাশি যে শ্রেণি বিভেদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাতেও বিরূপ প্রভাব বিপুলসংখ্যক মুসলমান কৃষককারিগর শ্রেণির ওপরে। ভারত সভা’ বা জাতীয় কংগ্রেস তাদের সর্বজনীন জাতীয় চেতনার ঘােষণা সত্ত্বেও সফলভাবে ওই সর্বজনীন চেতনা লালন করতে বা বিস্তার ঘটাতে পারেনি। ক্রমে শেষােক্তটিতে প্রভাব রেখেছে ধর্মীয় সংস্কৃতি। লক্ষ করার বিষয়। যে, কংগ্রেসের প্রথম দুই দশকের অধিবেশনে সাতবারই সভাপতিত্ব করেন পাঁচ বাঙালি- উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, আনন্দমােহন বসু, রমেশচন্দ্র দত্ত ও লালমােহন ঘােষ । তারা এ সময়ে আসামের চা শ্রমিকদের নিয়ে কথা বলেছেন, নারী অধিকার নিয়ে আলােচনা করেছেন, একাধিক রাজনৈতিক দাবি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কিন্তু বঙ্গের নিপীড়িত বিশাল কৃষক-কারিগর শ্রেণির দাবি নিয়ে কথা বলেননি। ঘটনাচক্রেই তাে ইতিহাসের ধারায় এ মানুষগুলাে মুসলমান সম্প্রদায়ের। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কল্যাণে স্বদেশচেতনার যত প্রকাশই ঘটুক তার বাস্তব চরিত্র সর্বজনীন, সর্বসম্প্রদায়বাদী হয়ে ওঠেনি। বরং থেকে থেকে স্বনামধন্য বাঙালি কৃতী পুরুষদের তৎপরতায় তাতে ধর্মীয় চেতনার প্রভাব পড়েছে । উনিশ শতকী সাম্প্রদায়িক সাহিত্য ও রাজনীতির কথা তাে বলা হয়েছে, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সনাতন ধর্মীয় প্রচারের সামাজিক প্রভাব। যেমন রামকৃষ্ণ- শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দের (১৮৬২-১৯০২) হিন্দু শ্রেষ্ঠত্বের প্রচার। তার প্রচারে সর্বজনীনতার প্রকাশ সত্ত্বেও অধ্যাপক সুশােভন সরকার পর্যন্ত লিখেছেন যে, তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু। তাই তার কর্মকাণ্ড হিন্দু পুনরুত্থানের মনােভাবকে আরাে পুষ্ট করে তুলেছিল’ (প্রাগুক্ত)। বঙ্গীয় মনীষার হাত ধরে ধর্মীয় জাতীয়তার যে প্রকাশ তার রাজনৈতিক পরিণাম শুভ হয়নি। হয়নি জাতীয় রাজনীতির অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ও স্ববিরােধিতার জন্য । রাজনীতির অন্যতম দুর্বলতা হিসেবে অধ্যাপক সরকার চিহ্নিত করেছেন ‘মুসলমান সম্প্রদায়ের সক্রিয় সমর্থনের অভাব’ (প্রাগুক্ত)। বিষয়টি নিয়ে তিনি খােলামেলা আলােচনা করেছেন অনেকটা নির্মোহ দৃষ্টিতে। বলেছেন যে, ‘কিছু বিশিষ্ট মুসলমান ব্যক্তি কংগ্রেসের সঙ্গে ছিলেন ঠিকই, কিন্তু মুসলমান জনমত ধীরে ধীরে তাদের নিজস্ব, স্বতন্ত্র পথের দিকেই অগ্রসর হতে শুরু করেছিল।’
কারণ আর কিছু নয়। প্রথমত কংগ্রেসে ক্রমাগত হিন্দুত্ববাদের প্রভাব বৃদ্ধি, হিন্দু মহাসভার মতাে ধর্মীয় সম্প্রদায়বাদী সংগঠনের নেতাদের উপস্থিতি ও প্রভাব । দ্বিতীয়ত মুসলমান-প্রধান কৃষকশ্রেণি ও মুসলমান জনস্বার্থের প্রতি কংগ্রেসের উদাসীনতা। হিন্দু ও মুসলমান সমাজের অসমবিকাশ ও বৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে সেদিকে নজর দেয়া কিংবা পশ্চাৎপদদের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থার ভাবনা- কোনােকিছুই কংগ্রেস নেতৃত্ব রাজনৈতিক কর্তব্য বা কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করেনি। তারা বাইরের মিল বা শ্লোগানের মিলেই খুশি ছিলেন। অথচ বিষয়টা খুবই জরুরি ছিল। ভাবেননি জীবিকার মিলের’ (রবীন্দ্রনাথ) কথা, অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসের কথা। অথচ কবি হয়েও রবীন্দ্রনাথ সেসব সমস্যা নিয়ে ভেবেছিলেন এবং যুক্তিসঙ্গত সমাধানের পরামর্শও দিয়েছেন তার একাধিক প্রবন্ধে। কিন্তু অদূরদর্শী কংগ্রেস নেতৃত্ব ওই স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায়নি। প্রথমদিকে কংগ্রেসে বেশ কয়েক জন প্রভাবশালী মুসলমান নেতার উপস্থিতি তাদের দূরদর্শিতা সীমিত করে রাখে। তাই মুসলমান সমাজের অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামায়নি কংগ্রেস। কথাটা শ্রী সরকার বলেছেন ভিন্নভাবে এবং তা মুসলমানদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে কংগ্রেসী জাতীয়তাবাদীরা মুসলমানদের…দাবি দাওয়াগুলােকে একবাক্যে প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে নিন্দা করতেন। কংগ্রেসের মধ্যেও মুসলমানরা রয়েছেন- এই ব্যাপারটাই তাদের ওই বিশ্বাসকে আরাে জোরদার। করে তুলেছিল। মুসলমানদের দাবিগুলােকে ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক দাবি। হিসেবে খারিজ করে দেয়া হতাে। কিন্তু একটা ব্যাপার তারা কিছুতেই বােঝার চেষ্টা করতেন না যে…কংগ্রেসের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হলেও মুসলমানদের শ্লোগানগুলাে মধ্যবিত্ত শ্রেণির…সেই অংশটির স্বার্থকেই প্রতিফলিত করত যে অংশটি ছিল পশ্চাৎপদ এবং ঘটনাচক্রে তারা ছিল মুসলমান। সামাগ্রিক জনসাধারণ সম্বন্ধে হিন্দুদের মূল যুক্তি ছিল যে জনসাধারণের মধ্যে ধর্মীয় ব্যাপারে কোনাে রকম বিচিছন্নতাবাদী মনােভাব নেই। এ চিন্তাও সঠিক ছিল না। আসলে মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমতার আকাঙক্ষা তারা বুঝতে পারেননি। যেটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত শ্রেণিই তাদের স্বার্থের জন্য নিমবর্গীয়দের উৎসাহিত করে থাকে, তাদের কাছে টানে এবং সংঘবদ্ধ সমর্থন জোগানাের কাজে উদ্দীপনা সৃষ্টিতে সাহায্য করে। সেই মুসলমান মধ্যশ্রেণির স্বার্থের বিষয়ও তাদের মাথায় ছিল না।
এর কারণ অবশ্য শ্রেণিপ্রতিযােগিতা। এ প্রতিযােগিতাই মুসলমানদের স্বাধীনতার যৌথ লড়াই থেকে সরিয়ে নিয়েছে। সুশােভন সরকারও বলেছেন যে, রবীন্দ্রনাথ কংগ্রেসী নেতাদের এই ভুল যুক্তির জবাব দিয়েছিলেন তার লেখায়। প্রকৃতপক্ষে এ বিষয়টা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ খুবই ভাবিত ছিলেন এবং শিক্ষা, পদমান মর্যাদায় সমতার প্রয়ােজনের কথা একাধিক লেখায় উল্লেখ করেছিলেন। এমনকি তিনি এ কথাও বলেছিলেন যে, কংগ্রেসের কোনাে কোনাে শীর্ষনেতা তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কবির ভাবনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিশেষ করে তৃণমূল স্তরে গ্রামীণ জনসংখ্যার দুঃখ-দুর্দশা ও অভাবের কথা নিয়ে। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করেই ভিন্নভাষ্যে বলতে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বুঝেছিলেন যে (চাষা ব্যাটা ঠিকই বুঝিয়াছিল’-রবীন্দ্রনাথ)। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে সম্প্রদায়গতভাবে কালাপানির ব্যবধান এবং গ্রাম-নগরের মধ্যে মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের মতাে তফাৎ এই সত্য রবীন্দ্রনাথ। বা দু-একজন রাজনীতিক বুঝলেও কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় অধিকাংশ নেতা বুঝতে চাননি। উঠতি মধ্যশ্রেণি বা তৃণমূল স্তরে দরিদ্র শ্রেণির মধ্যেও অন্তত সেসময় ধর্মীয় বিষয়টা প্রধান ছিল না, ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিন্তা, সামাজিক পদমর্যাদার বিবেচনা। আর গ্রামীণ প্রজাদের মধ্যে ছিল জমিদার ভূস্বামীদের আর্থ-সামাজিক শশাষণ, পীড়ন ও দৈহিক নির্যাতন থেকে মুক্তির ভাবনা। ক্রমে রাজনীতির কল্যাণে তা সাম্প্রদায়িকতা ও বিচ্ছিন্নতার পথ ধরে। সাম্প্রদায়িক সাহিত্যের ভিন্ন দিক প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, উনিশ শতকের ওই প্রবল সাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি পরােক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে সাহিত্যের যে। বিপরীত ধারার প্রকাশ মধুসূদন, দীনবন্ধু মিত্র, কালিপ্রসন্ন সিংহ বা মীর মশাররফ হােসেনের রচনার মাধ্যমে তা অনেকটা গৌণধারা। সে ধারার পক্ষে সম্ভব হয়নি হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদের মতাে শক্তিমান ধারাকে প্রতিহত করা। কারণ ক্ষেত্রবিশেষে ধর্মের জোর হয়ে ওঠে বেশি, বিশেষ করে যখন তাতে অর্থনৈতিক বা অনুরূপ স্বার্থ যুক্ত হয়। | সাহিত্যের সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে, এর প্রভাব শিক্ষিত শ্রেণিতে এমনকি শিশুপাঠ্য বইতেও কতটা ব্যাপক হয়েছিল তার উল্লেখ করেছেন সুমিত সরকার। প্রসঙ্গত লালা লাজপত রায়ের আত্মজীবনীতে সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ক শিশুপাঠের অভিজ্ঞতা স্মরণযােগ্য। স্মরণযােগ রক্ষণশীল ও চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী নেতা বিপিনচন্দ্র পালের মন্তব্য : রাজনীতি অবহেলিত হয়েছে বিমূর্ত ধর্মের স্বার্থে। পরিণামে পুরনাে জাতীয় সংগীতের স্থান নিয়েছে ধর্মীয় সংগীত’ (১৯০৩ খ্রি.)। বন্দেমাতরমও তাে মাতৃভূমিবন্দনা সূত্রে দেবীবন্দনা অথবা এর বিপরীতটি। স্বধর্মে বিশ্বাসী বাঙালি মুসলমান কীভাবে একে গ্রহণ করবে?
সাহিত্যের পাশাপাশি ইতিহাসেও একইরকম সম্প্রদায়বাদী চরিত্রের প্রকাশ সম্প্রদায় চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছে। এ বিষয়ে উল্লেখযােগ্য যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ যদি শ্বেতাঙ্গদের কথা বাদও দিই। মুঘল শাসন, বঙ্গের নবাবী শাসন এদের সাম্প্রদায়িকতায় জ্বালানি যােগ করেছে। এদের বিপরীত ধারায় ছিলেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় প্রমুখ একাধিক ইতিহাস-লেখক। যেমন নিখিলনাথ রায়। সমাজ ও রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ভারতে, বিশেষ করে বঙ্গদেশে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক পর্যালােচনার ক্ষেত্রে অন্তত একটি বিষয়ে অধিকাংশ পশ্চিমা (শ্বেতাঙ্গ) ইতিহাসবিদ-লেখক রক্ষণশীল ভারতীয় হিন্দু-মুসলমান ইতিহাস লেখকের সঙ্গে একমত যে ভারতে হিন্দু-মুসলমান শত শত বছর ধরে পাশাপাশি বাস করে এবং একই ঘটনাক্রমের সহযােগী হয়েও পরস্পর থেকে ভিন্ন। এ ভিন্নতার ভিতটাকে তারা জাতি-জাতীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে চিহ্নিত করেছেন। | যেমন ভারত-বিভাগ বিষয়ক একটি মােটা বইয়ের লেখক এইচ.ডি হডসন। লিখেছেন : “হিন্দু-মুসলিম দুই জনগােষ্ঠী একই এথনিক উৎস থেকে উদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও শুধু ধর্ম বিশ্বাসেই ভিন্ন নয়, তারা ভিন্ন জীবনযাত্রা ও মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও। বলা যায়, এরা স্বতন্ত্র বংশগত জনগােষ্ঠী।’ এ জাতীয় তত্ত্বের প্রচার রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি সব কিছুর বিচারে চলেছে। ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার থেকে বিপ্লবী অরবিন্দ ঘােষ বা হিন্দু মহাসভানেতা সাভারকর এবং সৈয়দ আহমদ বা মােহাম্মদ আলী জিন্নী থেকে নবাব সলিমুল্লাহ বা মৌলানা আকরম খাঁ সবাই এ জাতীয় তত্ত্বের প্রবক্তা।
জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা আমরা জানি। এ কথাও জানি, স্বধর্মের রীতিনীতি পালন করেন না যে জিন্না তিনিই রাজনৈতিক প্রয়ােজনে দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্ভব ঘটিয়ে ধর্মকে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধিতে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অথচ এই জিন্না এক সময় হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। রাজনীতির কথা বাদ দেই, কারণ রাজনীতিতে নীতি বলতে কিছু নেই সেখানে সব রকম আচরণই সিদ্ধ। | একই কথা খাটে হিন্দুত্ববাদী, ব্রাজনীতিবিদগণ সম্পর্কে। খাটে অরবিন্দ ঘােষ বা বিপিনচন্দ্র পাল থেকে সাভারকর, তিলক-লাজপত-মালব্য বা মুঞ্জে সম্পর্কে । ভিন্ন ভিন্ন কারণে, বিশ্বাস বা রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের এবংবিধ মত। কিন্তু বুদ্ধিজীবী, ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ কেন সম্প্রদায়বাদিতার পথ ধরবেন? এর কারণ আমার মনে হয় স্থানীয়দের ক্ষেত্রে অন্ধ ধর্মীয় রক্ষণশীলতা আর পশ্চিমাদের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা। সেখানে যুক্তি, নিরপেক্ষ চিন্তা বা নির্মোহ মানসিকতা প্রাধান্য পায় না। | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ইতিহাস-অধ্যাপক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার উনিশ শতকের বঙ্গদেশ বিষয়ক তার বইতে বঙ্গীয় হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ভিন্নতা উল্লেখ করে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে, হিন্দু মুসলমান দুই স্বতন্ত্র জাতি। তার মতে, নান্দনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যবিচারেও তারা ভিন্ন যদিও ছশ বছর ধরে তারা পাশাপাশি বাস করে এসেছে (‘Glimpses of Bengal in the Nineteenth century’, 1960)।
অবশ্য তিনি স্বীকার করেছেন যে, অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বাসে, আচরণে, সংস্কারে হিন্দু-মুসলমানে মিল রয়েছে কিন্তু তা গৌণ। তাদের অবস্থান দুই স্বতন্ত্র কক্ষে। প্রায় হুবহু একই রকম কথা বলেছেন ১৯৪৪ সালে কলকাতায় পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সােসাইটির সম্মেলনে মূল সভাপতি আবুল মনসুর আহমদ তার ভাষণে। তার মতে, শুধু ধর্ম বিশ্বাসেই হিন্দু-মুসলমান ভিন্ন নয়, তাদের মধ্যে যথেষ্ট মাত্রায় মিল যেমন আছে তেমনি গরমিলও অনেক এবং মিল নয়, গরমিলই প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ (মােহাম্মদী ১৩৫১)। এরা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে জাতিত্বের মর্যাদায় চিহ্নিত করেছেন যা বিজ্ঞানসম্মত বিবেচনা নয়। অধ্যাপক মজুমদার শুধু বঙ্গের কথা নয়, গােটা ভারতের প্রসঙ্গে ওই কথা। বলেছেন। এ বিষয়ে নৃতত্ত্ববিদ বা ইতিহাসবিদ কেউ কেউ (ড. নীহাররঞ্জন রায়) বিপরীত কথা বলেন। বলেন, একেবারে আধুনিককালের একাধিক ইতিহাসবিদ, বাঙালি ও অবাঙালি। যেমন বরুণ দে, রােমিলা থাপার, অমলেশ ত্রিপাঠী, বিপানচন্দ্র, হরবংশ মুখিয়া প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য এ কথাই বলেছেন ভিন্ন ভাষায়। তার মতে হিন্দু-মুসলমান ধর্মে না মিলতে পারে কিন্তু জীবিকায়, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং আরাে নানা ক্ষেত্রে তাদের মিলনের প্রশস্ত ক্ষেত্র রয়েছে। ভারত-বিভাগ সম্পর্কে আলােচনায় লেনার্ড গর্ডন তার দেশভাগ বিষয়ক রচনায় উল্লিখিত সূত্রগুলাের বিচারে যা লিখেছেন তার মর্মকথা হলাে বিশ্বের একাধিক দেশে ধর্মীয় ভিন্নতা এবং তা নিয়ে বিভিন্ন এথনিক জনগােষ্ঠীর মধ্যে গুরুতর দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঘটলেও সেখানে ভূখণ্ড বিভাজন ঘটেনি। অবশ্য যেখানে এই ভিন্নতার সঙ্গে অর্থনৈতিক কারণ ও ভূখণ্ড দূরত্ব যুক্ত হয়েছে সেখানে হয়তাে বিভাজন ঘটতে পারে। স্বভাবত কেউ সিদ্ধান্তে আসতে পারেন, প্রচারে বা তত্ত্বে যাই বলা হােক দেশবিভাগের মূক কারণ ধর্মীয় নয়, তা অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক যদিও উনিশ বা বিশ শতকে ধর্ম রাজনীতির নেপথ্য প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে।
প্রাসঙ্গিক একটি বক্তব্য এই বিভক্তি বিষয়ে। জিন্না তুঘােড় আইনজীবী, একই সঙ্গে প্রতিভাবান রাজনীতিক। উভয় ক্ষেত্রেই তথ্য, যুক্তি, তর্ক, বিতর্ক তার পেশাগত মূলধন । জিন্না যদি বিশ্বাসই করবেন যে হিন্দু-মুসলমান জনগােষ্ঠী দুই ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী হয়েই দুই ভিন্ন জাতি, তাহলে রাজনৈতিক জীবনের প্রথম পর্বে কংগ্রেসে সংশ্লিষ্ট হয়ে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রবক্তা হবেন। কেন? বলবেন কেন যে দুই সম্প্রদায়ের অনৈক্য ভারতে বিদেশি রাজের স্থায়িত্বের কারণ। তাই দরকার ভারতীয় রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য। ঘটনা তাে বলে, ঐক্যে ব্যর্থ হয়ে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশন থেকে ব্যর্থতা নিয়ে হতাশ জিন্নার রাজনীতি থেকে আপাত বিদায়। পরে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জিহাদি মনােভাব নিয়ে আবার তার প্রতিশােধের রাজনীতি শুরু। সেখানে সবচেয়ে ধারালাে অস্ত্র ধর্মের ব্যবহার। গােটা বিষয়টিই রাজনৈতিক হিসাবনিকাশের, ঐতিহাসিক সত্যের নয়। দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যবহার ব্যক্তিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে, লক্ষ্য অর্জনে। ভারতে-বঙ্গে হিন্দু মুসলমান সম্পর্কের রাজনৈতিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য খোজার প্রক্রিয়ায় কিছু ঘটনা যেন অমােঘ নিয়তির মতাে মনে হয়, যেগুলাের ওপর সমকালীন কোনাে পক্ষেরই নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কিন্তু সত্য বা বাস্তবতা চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও সেদিকে কেউ নজর দেয়নি, সেসব সমস্যার সমাধান বা গ্রন্থির জট খােলায় কেউ মনোেযােগী হয়নি। ভারতে শীর্ষ ইংরেজ আমলা বা রাজনীতিকের জানা ছিল- ‘ভাগ করো, শাসন করাে’ কিংবা ‘হিন্দুমুসলমান সমস্যা জিইয়ে রাখাই ভারতে ব্রিটিশ শাসন অব্যাহত রাখার শক্তিমান পূর্বশর্ত (কুপল্যান্ড, উদ্ধৃতি সরকার)। তেমনি কংগ্রেস-লীগ নেতাদেরও তা জানা ছিল। তাই বলা যায় ভারতের স্বরাজ, স্বশাসন বা স্বাধীনতার জন্য হিন্দু-মুসলিম ঐক্য কথাটা ছিল জাদুকরী বাক্যবন্ধ ।
এ সম্পর্ক তৈরিতে সুযােগ এসেছে, সুযােগ গেছে, রাজনীতিকদের বিচক্ষণতা-বুদ্ধি-যুক্তি সেখান কাজ করেনি বা সুফল তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু ব্রিটিশরাজ সুবিধাগুলাে কাজে লাগিয়েছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত । সর্বশেষ সে চেরাগ ধরা ছিল শেষ ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের হাতে। তিনি দ্রুতগতিতে ঐতিহ্যবাহী বেনিয়া চাতুর্যে সেটা ব্যবহার করে ভারত ভেঙে চিরশত্রু দুই ডােমিনিয়নের জন্ম দিয়ে একসময় স্বদেশে ফিরে যান। ভারত-বিভাজনের গােটা সমস্যার পেছনে একটা অপ্রিয় সত্য হলাে ভারতীয় উপমহাদেশ প্রধান দুই ধর্ম সদায়ের আবাসভূমি হলেও সেখানে বহু ভাষাসংস্কৃতি-নির্ভর এথনিক জাতিগােষ্ঠীর বাস। ‘ভারত মাতা হিসেবে যত বন্দনা করা হােক ভারত কখনাে এক জাতির এক ভাষাভাষীর দেশ নয় । এর একক জাতীয়তা বিজ্ঞানসম্মত (নৃতত্ত্বসম্মত) নয়, এর মূল জাতীয়তা ভূখণ্ডভিত্তিক; আধুনিক বিচারেও একাধিক ভূখণ্ডভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র ভারত (অখণ্ড ভারত নয়)। | বহুভাষী বহু জাতিসত্তা-সংস্কৃতির জনগােষ্ঠীর একত্রবাসের কারণে জাতীয়তা বিষযক সঙ্কট তার নিয়তি। একক জাতিসত্তা-জাতীয়তা না থাকার কারণে ধর্মকে জাতীয়তা, ধর্মসম্প্রদায়কে জাতি হিসেবে দাবি ও গ্রহণ করা সহজ হয়ে উঠেছিল। এ সুযােগ জিন্না নিয়েছিলেন। অন্যদিকে বিপ্লবী দলগুলাে এবং কংগ্রেস হিন্দুত্ববাদের প্রেক্ষাপটে অখণ্ড ভারত ও ভারতীয় জাতীয়তার রাজনৈতিক স্বপ্ন লালন করেছে। এ বিষয়ে কংগ্রেস নেতৃত্ব এতটাই নিশ্চিত ছিল যে, এ ক্ষেত্রে তারা কোনাে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ছাড় দেয়ার কথা ভাবতে পারত না। অথচ যে সনাতন ভারত বা রামরাজ্যের কথা গান্ধি ভাবতেন বা স্বপ্ন দেখতেন প্রাচীন যুগে তেমন।
অখণ্ড ভারতীয় সত্তার অস্তিত্ব ছিল না। ছিল না পরবর্তী পাঠান বা মুঘল যুগে। ইংরেজ আমলে যে ভারত ভূখণ্ড তৈরি (শাসনতান্ত্রিক এক ইউনিট) তাও দীর্ঘ সময় ধরে একটা-দুটো করে দেশীয় শাসনাধীন রাজ্য গ্রাস করে। সর্বশেষ অবস্থানেও ব্রিটিশ ভারতের বাইরে ছিল নামকাওয়াস্তে হলেও অনেক স্বশাসিত দেশীয় রাজ্য, তাদের ভাষায় ‘প্রিন্সলি স্টেটস’। বিভিন্ন সময়ে লীগ-কংগ্রেসের দেনদরবারে উভয়ের অনড় ভূমিকা, বিশেষ করে অখণ্ড ভারত ও শক্তিশালী কেন্দ্র বিষয়ক কংগ্রেসের অনড় ভূমিকা। সমঝােতার পথ ব্যাহত করেছে। দাঙ্গা বা কোনাে রাজনৈতিক কারণে হিন্দুমুসলমান সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতেও লীগ বা কংগ্রেস ভাবতে পারেনি ধর্মীয় উপাদানকে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিচরণের সুযােগ-সুবিধা দেয়া ক্ষতিকর হবে। কিন্তু ধর্মীয় চেতনা এমন এক মারাত্মক তীর যা অন্ধ উন্মাদনায় পরাক্রমশালী হয়ে ওঠে। তখন তাকে ঠেকানাে খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। | তাই ‘বন্দেমাতরম’ ভিত্তিক স্নােগানে হিন্দুত্ববাদী প্রতীক ও দেবদেবী নিয়ে ভারতীয় জাতীয়তার রাজনৈতিক পদক্ষেপ যতটা শক্তসমর্থ হয়েছে পাল্টা মুসলমান প্রতিক্রিয়া ‘আল্লাহু-আকবর’ ধ্বনিত্রে তাদের শক্তি সংহত করতে চেয়েছে। ফলে স্বদেশী বা অসহযােগ আন্দোলনের স্বাদেশিকতা বা ত্যাগ মুসলমান মনে দাগ কাটতে ব্যর্থ হয়েছে দুই সম্প্রদায়ের চলা এভাবে ক্রমাগত পৃথক পথ ধরেছে। ভাবতে অবাক লাগে যে, কংগ্রেসের জ্ঞানীগুণী পণ্ডিত নেতৃবৃন্দ কেন ধর্মীয় রাজনীতির সমস্যা ও বিপদ অনুধাবন করতে পারেননি। তাদের প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সাহায্যে। আনন্দমঠ’ ও দেবীবন্দনাধৃত বন্দেমাতরমের বদলে কোনাে সেকুলার শ্লোগান সাম্প্রদায়িক চেতনা নমনীয় করতে পারত, সবার পক্ষে গ্রহণযােগ্য হতাে।
ভারতীয় জাতীয়তার (ভূখণ্ডভিত্তিক) প্রশ্নে জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস ভারতের ভাষা- সংস্কৃতিভিত্তিক জাতিসত্তাগুলােকে বিবেচনায় আনেনি। কারণ তাতে ভারতের অখণ্ডতা ক্ষুন্ন হতে পারে বলে তাদের মনে হয়েছে। অথচ ভাষাজাতিসত্তার স্বীকৃতি ছিল বিজ্ঞানসম্মত চিন্তা। এ চিন্তা আমলে আনা হলে দেশভাগ হয়তাে অনিবার্য হতাে না। না আনার ফল যে ভালাে হয়নি ১৯৪৭আগস্ট তার প্রমাণ। আমলে না আনার কারণে ভাষিক জাতিসত্তার স্থান দখল করে ধর্ম এবং তা নানা ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় । রাজনীতিতে জাতিত্বের প্রতিনিধি। হয়ে ওঠে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান, পার্সি ধর্ম সম্প্রদায়। রাজনৈতিক বিকাশ ও দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে তিনটি সম্প্রদায় শক্তিমান হয়ে ওঠে- হিন্দু, মুসলমান, শিখ। এরাই ভারতের রাজনৈতিক নাট্যমঞ্চে প্রধান খেলােয়াড়। খেলার মূল নেপথ্য নায়ক ব্রিটিশরাজ যাদের হাতে পুতুলনাচের সুতাে । ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের টানাপড়েনের মধ্যে যেসব ঘটনা ভবিষ্যৎ ভারতবিভাগের রাজনৈতিক অশনিসঙ্কেতের মতাে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় তার একটি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ তথা বঙ্গবিভাগ। এ সময় এবং চার দশক পরও বঙ্গই হয়ে ওঠে ভারত বিভাগের মুল নেপথ্য শক্তি। বঙ্গেই ইংরেজ শাসনের সূচনা এবং বঙ্গকে কেন্দ্র করেই এর সমাপ্তি। বঙ্গীয় রাজনীতির গুরুত্ব তাই ছােট করে দেখা চলে না যদিও দুই প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন লীগ-কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে বঙ্গ তার চালিকাশক্তি সংহত করতে পারেনি। বঙ্গ সেখানে ব্রাত্য। আসলে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার গুরুত্ব বুঝে নিতে পারলে আমরা দেশবিভাগজনিত সত্যাসত্যের কাছাকাছি পৌছতে পারব। ভারতবর্ষের দুই গুরুত্বপূর্ণ মুসলমানপ্রধান প্রদেশ বঙ্গ ও পাঞ্জাব দেশবিভাগরাজনীতির দাবার ছকে মূল খুঁটি হিসেবে বিবেচনা করেছেন একাধিক ইতিহাসলেখক। আমার বিবেচনায় এ ক্ষেত্রে বঙ্গই প্রধান। ১৯৪৬ সালেও যে দুটো ঘটনা ভারত বিভাগের নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে বিভাজন অনিবার্য করে তােলে তাহলে পাকিস্তান ইস্যুতে সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গে মুসলিম লীগের একচেটিয়া বিজয় এবং প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের সূত্রে ১৬ আগস্টে সূচিত কলকাতা মহাহত্যাযজ্ঞ ও তার প্রতিক্রিয়া। তাই ভারতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ বিচারে বঙ্গীয় রাজনীতির ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
এর সূচনা অবশ্য বিশশতকের প্রথম দশকে। ঘটনাঁ বঙ্গভঙ্গ । তাই বঙ্গ নিয়েই আলােচনা। সে আলােচনায় সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাঙালি মুসলমানের শিক্ষা, যােগ্যতা, হীনমন্যতা, পরিচিতি সঙ্কট এবং সেইসব সূত্রে একই ভাষাভাষী হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে ভেদচেতনা । কখন কীভাবে তার আত্মচেতনার সূত্রপাত তার বাঙালিত্ব ও মুসলমানত্ব ঘিরে অর্থাৎ তার জাতিসত্তা ও ধর্মীয় সত্তার সংঘাতে এবং পরিণামে স্থায়ী সিদ্ধান্তে উপস্থিতি, সেগুলােও বিচার্য বিষয়। আত্মচেতনা শিক্ষিতশ্রেণি থেকেই গড়ে ওঠে, প্রকাশ পায় এবং ধীরগতিতে রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনাবলীর টানে ছড়িয়ে যায়। এর পেছনে মূল কারণ। অর্থনৈতিক স্বার্থপূরণ, সুযােগ-সুবিধা অর্জন। এই সূত্রে স্বাতন্ত্র্যবাদী চেতনার প্রকাশও ঘটতে পারে যা এক পর্যায়ে সাম্প্রদায়িকতার চরিত্র অর্জন করে । এমনকি ঘটতে পারে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সাম্প্রদায়িক সংঘাত। বঙ্গে তেমন একাধিক উদাহরণ রয়েছে যেমন রয়েছে ভারতে। দুটো উদাহরণই যথেষ্ট বঙ্গভঙ্গ বিরােধ উপলক্ষে ১৯০৭ সালে এবং বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিলের পর ১৯২৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।
মােটামুটি হিসেবে বিশশতক থেকে রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে হিন্দুমুসলমান সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয় এবং নানা ঘটনার জের ধরে এর দশকওয়ারি বিস্তার। তবে এর পটভূমি তৈরি হয়েছিল পূর্বাপর ব্রিটিশ কূটনীতি ও উনিশ শতকে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে হিন্দুত্ববাদিতার রাজনীতিকরণের মধ্য দিয়ে। সেই সঙ্গে ইসলামের নামে ধর্মীয় সংস্কার ও ধর্মবাদী আত্মচেতনারও প্রকাশ। আবার এ কথাও ঠিক যে, উনিশশতক অবধি সামপ্রদায়িক সম্পর্ক মােটামুটি স্থিতিশীল ছিল। হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করেছে । পারস্পরিক স্বাতন্ত্র্য ও সহযােগিতা নিয়ে (শীলা সেন)। | কিন্তু হিন্দুভূস্বামী ও এলিটশ্রেণির ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ব, রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদ এবং শিক্ষা ও পদমানমর্যাদায় উঠতি মুসলমান শিক্ষিতশ্রেণি ও স্বল্পসংখ্যক উর্দুভাষী বিত্তবান বা ভূস্বামী মুসলমানের উচ্চাকাঙ্ক্ষার টানে পারস্পরিক সম্পর্কে প্রতিযােগিতার মনােভাব তৈরি হয়। ১৯০৫ সালে ভাইরসয় কার্জনকৃত বঙ্গভঙ্গ এবং তা রদ করতে ব্যাপক গণআন্দোলন ওই পটভূমি তৈরি করে। ১৯০৬ সালের অক্টোবরে আগা খানের নেতৃত্বে এক সম্ভ্রান্ত মুসলমান প্রতিনিধি দল ভাইসরয় মিন্টোর সঙ্গে দেখা করে তাদ্ধের সুযােগ-সুবিধা বিষয়ক দাবিদাওয়া পেশ করেন। যদিও দাবি মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষে কিন্তু সেসব ছিল ওইসব অভিজাত, ভূস্বামী ও কিছু সংখ্যক উচ্চমধ্যশ্রেণির আর্থ-সামাজিক স্বার্থপূরণের উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে ব্রিটিশ কূটনীতি তৈরি ছিল দুই সম্প্রদায়ের চলার জন্য পৃথক পথ তৈরি করে দিতে। এই পথ ধরে পরবর্তী সময়ে উঠতি মুসলমান মধ্যবিত্ত তাদের সুযােগ-সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে স্বাতন্ত্রবাদী পথ ধরে। স্বতন্ত্র পরিচিতি যে তাদের লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করবে শাসকশ্রেণির আচরণে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভাইসরয় মিন্টোর স্পষ্ট মনোেভাব- ৬ কোটি জনসংখ্যাকে সরকারবিরােধী ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে’ (ভিপি মেনন, ট্রান্সফার অব পাওয়ার ইন ইন্ডিয়া, ১৯৫৭)।
এ মন্তব্য লেডি মিন্টোর ডায়েরি থেকে উদ্ধৃত সাম্প্রদায়িক বিভাজনের কথা মাথায় রেখে সরকারি উদ্যোগে নবাব সলিমুল্লাহ, জমিদার সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী প্রমুখ উচ্চশ্রেণির মুসলমানদের নিয়ে জাতীয় কংগ্রেস গঠনের ২১ বছর পর একই হাতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা পাল্টা সংগঠন হিসেবে ১৯০৬ সালে। ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে, মুসলিম লীগের প্রথম সমাবেশ-অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। কাকতালীয় মনে হলেও তাৎপর্যপূর্ণ যে, ওই বছরই হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠা সাম্প্রদায়িক বিভেদের পথ প্রশস্ত করে তুলতে। বঙ্গভঙ্গের পক্ষে কার্জন সাহেব ও তার শীর্ষ আমলাগণ যুক্তি হিসেবে যাই বলুন কেন এর মূল উদ্দেশ্য বঙ্গে শাসকবিরােধী আন্দোলন, বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ও ক্রমবর্ধমান স্বদেশীচেতনার প্রকাশ বন্ধ করা । ওই আন্দোলন ছিল প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের। স্বল্পসংখ্যক নেতৃস্থানীয় মুসলমান শাসকবিরােধী আন্দোলনে যুক্ত হন। বঙ্গভঙ্গের আরাে লক্ষ্য ছিল ইংরেজবিরােধী আন্দোলনের শক্তি হ্রাস করার পাশাপাশি মুসলমানপ্রধান প্রদেশ তৈরি করে তাদের সুযােগ-সুবিধার প্রসার ঘটিয়ে বঙ্গীয় মুসলমানের সমর্থন নিশ্চিত করা। বঙ্গভঙ্গের ঘােষণা ১৯০৫ সালের ৭ই জুলাই, সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় ১৬ অক্টোবর ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু এ বিভাজনের প্রতিক্রিয়া হয় ব্যাপক যা অভাবিত শাসকশ্রেণির জন্য। ভূস্বামী, মধ্যবিত্ত, পেশাজীবী ও ছাত্রকুলের এ আন্দোলন প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের হলেও স্বনামখ্যাত অনেক মুসলমান নেতা বঙ্গভঙ্গবিরােধী আন্দোলনে যােগ দেন। যেমন আবদুল হালিম গজনভি, ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, আবুল হুসেন, দীদার বক্স, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, কাজেম আলী মাস্টার, আবুল কাসেম, সাংবাদিক মুজীবর রহমান, সৈয়দ আলী ইমাম ও হাসনান ইমাম, ব্যারিস্টার মজহারুল হক, মুজফফর আহমদ, ইসমাইল হােসেন সিরাজী প্রমুখ নানা পেশার খ্যাতিমান ব্যক্তি।
কিছুসংখ্যক মুসলিম সাময়িকী আন্দোলনের পক্ষে সােচ্চার হয়। এর কারণ মূলত জাতিগত আবেগ। তবে নতুন প্রদেশগঠন উপলক্ষে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিচার এবং রক্ষণশীল চেতনার কারণে উচ্চবর্গীয় মুসলমান অনেকে যেমন নবাব সলিমুল্লাহ, নওয়াব আলী চৌধুরী প্রমুখ বঙ্গভঙ্গের পক্ষ সমর্থন করে প্রচারে নামেন। তাদের পক্ষে সুবিধা তৈরি হয় যখন স্বদেশী আন্দোলনে ক্রমে হিন্দুত্ববাদী প্রভাব প্রকাশ পেতে থাকে (শীলা সেন)। স্বদেশী জিনিস কিনুন’ ‘স্বদেশী শিল্প গড়ে তুলুন শ্লোগান জাতীয়তাবাদী হওয়া সত্ত্বেও সে আবেদন পশ্চাদপদ মুসলমান মধ্যবিত্ত মানসে উদ্দীপনা সৃষ্টি করেনি। আর প্রধানত উর্দুভাষী উচ্চবিত্ত বা ভূস্বামী মুসলমানের রক্ষণশীলতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের আবেদন সাড়া না জাগানােরই কথা। তাছাড়া আন্দোলনে ছিল হিন্দুত্ববাদী ধর্মীয় চেতনার প্রভাব যা মুসলিম অনীহার কারণ হয়ে ওঠে। | বঙ্গভঙ্গবিরােধী আন্দোলন দমনে শাসকশ্রেণি সাম্প্রদায়িকতা প্রচারের পথ গ্রহণ করে। এ কাজে সমর্থন জোগায় নবাব সলিমুল্লাহ প্রমুখ স্বামী ও রক্ষণশীল মুসলমান সমাজপতিগণ। প্রচারের কাজে লাগানাে হয় মােল্লামৌলবীদের। কিছুকাল পরেই পূর্ববঙ্গে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে জনমত বাড়তে থাকে। স্বদেশী আন্দোলনের হিন্দুকর্মীদের কর্মসূচিগত বাড়াবাড়ি মুসলমান জনতার মনে অসন্তোষ তৈরি করে। বিষয়টা রবীন্দ্রনাথ তার একাধিক লেখায় উল্লেখ করেছেন। সমালােচনা করেছেন স্বদেশী আন্দোলনে হিন্দুয়ানির অনুপ্রবেশ নিয়ে, তাদের জবরদস্তি নিয়ে।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক