হক সােহরাওয়ার্দী দ্বন্দ্ব | লীগের অগ্রযাত্রা
গ্রামবাংলায় দুর্ভিক্ষের নেপথ্য নায়ক যেমন নাজিমুদ্দিন-সােহরওয়ার্দী মন্ত্রিসভা তেমনি ব্যবসায়ীকুল বড়-ছােট সবাই। ইস্পাহানি গ্রুপ তখন বাংলায় খাদ্যপণ্য সরবরাহের প্রধান এজেন্ট। পঞ্চাশের সেই মহামন্বন্তর ঘটার পূর্বাহ্নে হাসান ইস্পাহানি ও হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মধ্যে রাজনৈতিক মেলবন্ধন ভালােই ছিল। দুজনই প্রচণ্ড রকম হকবিরােধী। একজন জিন্নার অতীব বিশ্বাসভাজন দূত হিসেবে দ্বিতীয়জন বঙ্গের মসনদে বসার উচ্চাশায়। কিন্তু কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি থেকে ফজলুল হককে বিদায় করে দেয়ার পর গভীর হতাশা নিয়ে সােহরাওয়ার্দী লক্ষ্য করেন তার বদলে কমিটিতে নেয়া হয়েছে জিন্নার বিশেষ আস্থাভাজন হাসান ইস্পাহানিকে, যে ইস্পাহানি মূলত ব্যবসায়ী, রাজনীতিক নন। সােহরাওয়ার্দী ও তার অনুসারীদের ধারণা ছিল ওই শূন্যস্থান সােহরাওয়ার্দীকে দিয়ে পূরণ করা হবে। কিন্তু তা হয়নি। কারণ জিন্নার হিসাব-নিকাশ ছিল অন্যরকম প্রথমত বঙ্গীয় মুসলিম লীগ রাজনীতি ছিল জিন্নার জন্য সমস্যা-সঙ্কটের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে তার জন্য দরকার নিরেট, অন্ধ অনুসারী। লক্ষ্য করার বিষয় যে একনায়কী মনােভাবাপন্ন জিন্না মুসলিম লীগে কোনাে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাজনীতিককে সহ্য করতে পারেননি, সহ্য করতে পারতেন না। তার প্রয়ােজন লিয়াকত-খালিকুজ্জামান বা নাজিমুদ্দিন, রাজা গজনফর আলীর মতাে অন্ধসমর্থক, যারা তার কোনাে সিন্ধান্ত নিয়ে কোনাে প্রশ্ন তুলবেন না। এই নিরেট সমর্থনে তার পক্ষে পাকিস্তান আদায় অনেকটা সহজ হয়ে উঠেছিল। কংগ্রেসে গান্ধির একাধিপত্য থাকলেও সেখানে ভিন্নমতের অভাব ছিল না। কিন্তু মুসলিম লীগে জিন্না হিটলারি ধরনের একনায়ক। বিরােধিতা মানে বহিষ্কার । যেমনটা ফজলুল হকের বেলায় ঘটেছে। হাসান ইস্পাহানিকে ওই গুরুত্বপূর্ণ পদে মনােনীত করার পেছনে দুটো সম্ভাব্য কারণ- ইস্পাহানিকে বিশ্বস্ত রাখতে খুশি করা, সেই সঙ্গে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের অর্থ-তহবিল মােটামুটি নিশ্চিত করা। সম্ভবত অন্য কারণসােহরাওয়ার্দীকে পুরােপুরি বিশ্বস্ত মনে না করতে পারা । কিছুটা হলেও সােহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিত্ব নিয়ে আশঙ্কা এবং বঙ্গীয় লীগ নিয়ে তার দুশ্চিন্তা। ফজলুল হক তেমন উদাহরণ।
বঙ্গীয় মুসলিম লীগে তাই জিন্না বরাবরই চেয়েছেন খাজা নাজিমুদ্দিনের মতাে বিশ্বস্ত রাজনীতিক কিংবা ইস্পাহানির মতাে ধনাঢ্য অনুরাগী সমর্থক। একচ্ছত্র নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে তিনি সােহরাওয়ার্দীকে হকের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন। উচ্চাকাক্ষী শহীদ সােহরাওয়ার্দীও চোখ বন্ধ করে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রচারণায় নামেন। যে প্রচারণা অনেকটা অপপ্রচারের মতােই ছিল। উদ্দেশ্য দলের প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ক্রমশ মই বেয়ে ওপরে ওঠা । কিন্তু জিন্না! তিনি ছিলেন ভিন্ন ধাতুতে গড়া। তাই সােহরাওয়ার্দীর আশা পূর্ণ হয়নি। ক্ষুব্ধ সােহরাওয়ার্দী ও তার সমর্থকরা তাদের কেউ কেউ জিন্নার কাছে এ ব্যাপারে আবেদন জানিয়ে থাকবেন। যেমন কিছুকাল আগে জানিয়েছিলেন কলকাতা লীগের কর্তাব্যক্তি গোঁড়া সম্প্রদায়বাদী, অবাঙালি রাগিব আহসান। দুর্বোধ্য কারণে হক বহিষ্কৃত হওয়ার পর খাজা নাজিমুদ্দিন জিন্নার সিদ্ধান্তে সমর্থন জানিয়েও মৃদুকণ্ঠে সােহরাওয়ার্দীর পক্ষে আবেদন জানান, যাতে ভবিষ্যতে তাকে ওয়ার্কিং কমিটিতে নেয়া হয়। সােহরাওয়ার্দীর কাছে জিন্নার প্রচ্ছন্ন বার্তা বােধহয় এভাবেই পৌছে যে ফজলুল হক লীগের শত্রু, মুসলমান সমাজের শত্রু। তার বিরুদ্ধে লেগে যাও, তাকে মুসলিম রাজনীতি, বঙ্গীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা করে ফেল ।…সােহরাওয়ার্দী কী বুঝেছিলেন তিনিই জানেন। তিনি সর্বশক্তি নিয়ে হকের বিরুদ্ধে ময়দানে নামেন। হক রাজনীতির বড় প্রতিপক্ষ নাজিমুদ্দিনও এতটা বিরূপতা ও তেজ নিয়ে হক সাহেবের বিরুদ্ধে নামতে পারেননি। অবশ্য নাজিমুদ্দিন সাহেবের এতটা শক্তিসাহস কোনােটাই ছিল না। ছিল না তুখােড় রাজনৈতিক নেতা সােহরাওয়ার্দীর মতাে সাংগঠনিক ক্ষমতা। সর্বোচ্চ নেতার প্রতি বিশ্বস্ততাই তাকে রাজনীতিতে টিকিয়ে রেখেছিল। যাইহােক সােহরাওয়ার্দী সম্ভবত দলে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে আপাতত নাজিম-বিরােধিতা শিকেয় তুলে হকের বিরুদ্ধে ঘরবাহির গরম করে তুলতে থাকেন। এই ব্যাপারে, বিশেষ করে সাংগঠনিক কার্যক্রমে তার দক্ষতা ছিল অনস্বীকার্য- যা দেখা গেছে বিভাগােত্তর কালেও।
সম্ভবত বঙ্গীয় রাজনীততে তার গুরুত্ব প্রতিপন্ন করতে জনাব সােহরাওয়ার্দী প্রচণ্ড বেগে হকবিরােধী প্রচারণায় নেমে ফজলুল হকের সমর্থক মুসলমান তরুণ সমাজ বিশেষ করে ছাত্রদের মন সাম্প্রদায়িক চেতনায় বিষিয়ে তােলেন এবং তাতে সফলও হন। কারণ নিছক ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য হিন্দু মহাসভাপ্রধান শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়কে টেনে এনে বঙ্গে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন মুসলমান সমাজ ভালাে চোখে দেখেনি। এমনকি দেখেনি নিরপেক্ষ গ্রুপও। সম্প্রতি প্রকাশিত শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তেও এমন প্রমাণ মিলবে। এসব প্রচারে ফজলুল হককে ‘বিশ্বাসঘাতক’, মুসলমান সমাজের মীরজাফর’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। ছাত্রসমাজকে এতটা বিক্ষুব্ধ করে তােলা হয় যে তারা হক সাহেবের বিরুদ্ধে আপত্তিকর স্লোগান দিতেও দ্বিধা করেনি। আর এ কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল মুসলমান পরিচালিত পত্র-পত্রিকা, বিশেষ করে ‘আজাদ’, স্টার অব ইন্ডিয়া’ ইত্যাদি। আর রাগিব আহসানের হক বিরােধিতা সব নিয়মনীতি ছাড়িয়ে গিয়েছিল হকের জনসভায় হামলা, গুণ্ডামি তাদের নিয়মিত কর্মকাণ্ড হয়ে ওঠে । অন্যদিকে সংবাদ মাধ্যমে অপপ্রচার । মাওলানা আকরম খাঁর পত্রিকা আজাদ বরাবরই ফজলুল হকের বিরুদ্ধাচরণ করে গেছে, এমনকি পাকিস্তান্ প্রতিষ্ঠার পরও। শীলা সেন মনে করেন, ‘নবযুগ’ কাগজ প্রকাশের পেছনে হক সাহেবের উদ্দেশ্য ছিল তার বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জবাব দেয়া (পৃ. ১৩০)। তবে সংঘবদ্ধ সম্প্রদায়বাদী শক্তির বিরুদ্ধে তার একক লড়াই খুব একটা বলিষ্ঠ হয়ে ওঠেনি। লড়াইটা ছিল অনেকাংশে একক শক্তিতে । অবশ্য এজন্য তিনি নিজেও কম দায়ী ছিলেন না।
তবে তার বিরুদ্ধে সােহরাওয়ার্দীর কুৎসা ও অপপ্রচার ফজলুল হককে খুবই ক্ষুব্ধ করেছিল। কিন্তু তিনি নিজেই যেখানে সম্ভাবনাময় প্রজাপার্টি নামক রাজনৈতিক বৃক্ষটির শিকড় কেটেছেন সেখানে ওই বৃক্ষের মহীরুহ হয়ে ওঠা একেবারে অসম্ভব ছিল। স্বতন্ত্র নির্বাচন ও স্বাতন্ত্রবাদী রাজনীতির প্রেক্ষাপটে প্রবীণ রাজনীতিবিদ ফজলুল হকের সমন্বয়বাদী রাজনীতির লড়াই শক্তির সমাবেশ ঘটাতে পারেনি। বঙ্গীয় মুসলিম লীগে নাজিম বনাম সােহরাওয়ার্দীর অন্তর্দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতায় নরমপন্থী বা উদার রাজনীতিকদের প্রত্যাশা ছিল হক-সােহরাওয়ার্দীর পরস্পর নির্ভরতা, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। যেমন পূর্ববঙ্গে ১৯৫৩ সালে গঠিত যুক্তফ্রন্টে হক-সােহরাওয়ার্দীর সম্পর্ক ছিল যান্ত্রিক, ছাত্রদের চাপে বাধ্যবাধকতার, যে জন্য তা ভাঙতে দেরি হয়নি। অথচ অখণ্ড বঙ্গের প্রথম হক মন্ত্রিসভায় সােহরাওয়ার্দী সদস্য ছিলেন। এরা মিলিতভাবে জনসভায় যােগও দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও দুজনের মধ্যে আন্তরিক সম্ভব বড় একটা দেখা যায়নি। আরাে একটি বিষয় বিবেচ্য যে, এই দুই ব্যক্তিত্বের মধ্যে রাজনৈতিক ভাবনার মিল ছিল না। প্রজাপার্টির ফজলুল হক এক পর্যায়ে মুসলিম লীগে যােগ দিলেও বাঙালি চেতনার ভিতটা তার মধ্যে কখনাে নষ্ট হয়ে যায়নি। এমনকি মুছে যায়নি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক চেতনার প্রভাব। তাই মাঝে মধ্যে সর্বভারতীয় রাজনীতি এবং নেতৃত্ব তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে। কিন্তু বঙ্গবাসী হওয়ার কারণে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাকে। যেমন হয়েছিলেন কংগ্রেসে চিত্তরঞ্জন, সুভাষ । তেমনি লীগে ফজলুল হক, সােহরাওয়ার্দী । আঞ্চলিক নেতৃত্বের ঊর্ধ্বে ওঠা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অন্যদের তেমন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিল না। তবে হক সাহেবের পক্ষে ওই উত্তরণে প্রধান বাধা তার ব্যক্তিত্ব, তার বাঙালিত্ব চেতনা । আর এ দুই কারণেই জিন্নার সঙ্গে তার রাজনৈতিক সংঘাত তীব্র হয়ে ব্যক্তিগত শত্রুতায় পরিণত হয়। বঙ্গীয় রাজনীতিতে অবাঙালি প্রভাব ফজলুল হক মানতে চাননি। অন্যদিকে চেয়েছেন বাংলা-বাঙালির উন্নতি যা মােহাম্মদ আলী জিন্নার মােটেই পছন্দসই ছিল না ।
এদিক থেকে সােহরাওয়ার্দী নেতৃত্বের উর্ধ্বে ওঠার প্রতিযােগিতায় কয়েক পা এগিয়ে ছিলেন। কারণ বাংলা বাঙালি নিয়ে তার কোনাে মাথাব্যথা ছিল না। তিনি নাজিমুদ্দিনের মতাে পুরােপুরি বাঙালিও ছিলেন না। সর্বভারতীয় রাজনৈতিক চেতনার তিনি বিরােধী ছিলেন। মুসলিম লীগ রাজনীতি, স্বাতন্ত্র্যবাদী রাজনীতি তথা পাকিস্তান রাজনীতির তিনি আন্তরিক সমর্থক ছিলেন। জাতীয়তাবাদী রাজনীতি নিয়ে ফজলুল হকের মতাে ‘আত্মিক দ্বন্দ্ব’ তার ছিল না। তবু রাজনৈতিক বিবেচনায় শহীদ সােহরাওয়ার্দী জিন্নার একান্তজন হয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু কেন? এ বিষয়ে বঙ্গীয় রাজনীতির ইতিহাসলেখক ও আলােচক, বিশ্লেষকদের কাছ থেকে সদুত্তর মেলে না। অনুমান যে জিন্না তার প্রতি সােহরাওয়ার্দীর একচেটিয়া বিশ্বস্ততা নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন না। ঘটনা কিন্তু ভিন্ন কথা বলে। সােহরাওয়ার্দী ছিলেন মনে প্রাণে পাকিস্তানবাদী মুসলিম লীগ নেতা। তিনি কখনাে জিন্নার বিরুদ্ধে দাঁড়াননি, বিদ্রোহ দূরের কথা। তবে ব্যক্তিত্ব-সংঘাতের সম্ভাবনা হয়তাে জিন্নার মনে ছিল কিন্তু সে ধারণা ঠিক ছিল না। পরে সােহ্রাওয়ার্দীকে দেখা গেছে পাক আমলে জিন্না-লীগ গঠন করতে যা ছিল তার। স্ববিরােধিতার আরেকটি উদাহরণ। লাহাের প্রস্তাবের দুই পাকিস্তানের ‘s’ অক্ষর মুছে এক পাকিস্তান করার ষড়যন্ত্রে তিনিই তাে জিন্নার ডান হাত। সেজন্য ক্ষুব্ধ হন আবুল হাশিম । তিন মুসলিম লীগ থেকে ফজলুল হকের বহিষ্কারের পর রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে মুসলিম লীগের গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ-বিরােধী চরিত্র নগ্নভাবে প্রকাশ পায়। এ চরিত্র শুধু কর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ছিল বঙ্গীয় নেতৃত্বের শীর্ষস্তরে। রাগিব আহসান থেকে শহীদ সােহরাওয়ার্দী বা মাওলানা আকরম খাঁর মতাে ব্যক্তি এ ত্রুটি থেকে মুক্ত ছিলেন না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হক বিরােধিতায় তা ন্যক্কারজনকভাবে প্রকাশ পায়। ফজলুল হকের জনসভায় হামলা, মিছিল করে অশ্লীল শ্লোগান, কর্মীদের মারধর কোনাে কিছুতেই কমতি ছিল না লীগ কর্মীদের। এক কথায় গুণ্ডামি ও মাস্তানি যা বিশেষভাবে দেখা গেছে নির্বাচনী প্রচার ও নির্বাচনকালে।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও নিরপেক্ষ উৎস ও গবেষকদের বিবরণ একই কথা বলে। এ ক্ষেত্রে প্রধান শক্তি ছিল ছাত্রযুবা ও পাকিস্তান। ন্যাশনাল গার্ডবাহিনী। এদের তৈরি করা হয় লাঠালাঠি-কাটাকুটির জন্য। রাজধানী কলকাতার মুসলমান সমাজে উর্দুভাষী ও রক্ষণশীলদের ছিল। প্রাধান্য। ছিল রাগিব-সােহরাওয়ার্দীদের ক্ষমতার প্রাধান্য। তুলনায় ফজলুল হক ছিলেন এদিক থেকে পিছিয়ে তার রাজনৈতিক শক্তিকেন্দ্র ছিল বরিশাল তথা পূর্ববঙ্গের গ্রাম । আরাে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে বাংলার গভর্নররা, বিশেষ করে ওই সময়কার গভর্নর হার্বার্ট ছিলেন বিশেষভাবে ফজলুল হকবিরােধী। তাদের সমর্থন ছিল মুসলিম লীগের প্রতি, গভর্নরের চোখের মণি খাজা নাজিমুদ্দিন। তাদের ক্ষমতায় রাখতে এরা অনেক সময় নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তাদের সমর্থক স্থায়ী আমলা শ্রেণি, বিশেষভাবে শেতাঙ্গ। কর্মকর্তা। আর বিধান সভার ইউরােপীয় সদস্যরা। তাদের সংখ্যা কম ছিল না। কখনাে কখনাে সংখ্যাধিক্য নির্ধারণে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এক কথায় রাজ’-বিরােধী গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে ইংরেজ শাসক ও তাদের প্রশাসন ও শ্বেতাঙ্গগােষ্ঠী সবাই ফজলুল হক-বিরােধী অবস্থান নেন যে। কারণে রাজধানী-কেন্দ্রিক রাজনীতিতে ফজলুল হক কোণঠাসা হয়ে পড়েন। রাজধানীর মুসলমান সমাজে তার প্রভাব তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রায় কমে আসে। সংসদীয় রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য তাকে হাত বাড়াতে হয় কংগ্রেস, ফরােয়ার্ড ব্লক এমনকি হিন্দু মহাসভার দিকে। আগেই বলেছি শেষােক্ত দলের সঙ্গে আঁতাত মুসলমান বিরােধিতার কারণ হয়ে ওঠে। শাসনযন্ত্রে যে হক বিরােধিতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার কিছু বিবরণ শীলা সেনের ‘বঙ্গীয় মুসলিম রাজনীতি’তে সূত্রসহ লিপিবদ্ধ । আশ্চর্য যে এসব ন্যক্কারজনক হকবিরােধী ঘটনায় শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে সংশ্লিষ্ট দেখা যায়। মনে হয় রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষা তাকে সামাজিক গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছিল। শীলা সেন উদ্ধৃত নােয়াখালী ঘটনা তার প্রমাণ।
প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টির মন্ত্রিসভা রক্ষার জন্য ফজলুল হককে এক হাতে দুই ফ্রন্টে লড়াই করতে হয়েছিল। অর্থাৎ ইংরেজ শাসনযন্ত্র এবং মুসলিম লীগ সংগঠন। এক্ষেত্রে জয় কীভাবে সম্ভব? না, আদৌ সম্ভব ছিল না। কী ভূমিকা ছিল এ পরিস্থিতিতে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর? একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে শুধু ছাত্রদেরই হকবিরােধী রাজনীতিতে দীক্ষা দেননি তিনি। একই সঙ্গে জঙ্গি ছাত্রদের সহায়তায় গ্রাম-গঞ্জে-শহরে একের পর এক জনসভায় যােগ দিয়েছেন, ভাঙা দোঁআশ বাংলায় বক্তৃতা করেছেন। সাম্প্রদায়িক বিরূপতায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। নিশ্চয়তা দিয়েছেন এই বলে যে পাকিস্তান জিতে নিতে পারলে সকল অর্থনৈতিক দুর্দশা দূর হয়ে যাবে । এসব জনসভার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ফজলুল হককে মুসলমান স্বার্থবিরােধী রাজনীতিক হিসেবে চিত্রিত করা। এ কাজটা বেশ ভালােভাবেই করতে পেরেছিলেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী । এভাবেই জনমত ধীরে ধীরে হকবিরােধী, হিন্দুবিরােধী তথা সম্প্রদায়বাদী হয়ে ওঠে। নির্বাচনের বেশ আগেই এ কাজটা সম্পন্ন হয়। পরে কিছুটা ভিন্ন ধারায় তা সার্থক করে তােলেন আরেক দক্ষ সংগঠক বর্ধমানের আবুল হাশিম, বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সেক্রেটারি । তার প্রচারে পাকিস্তান হাসিলের স্বপ্ন ছিল, কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সরাসরি প্রচার ছিল না। কিন্তু শহীদ সােহরাওয়ার্দী তার জনসভার প্রচার সম্পর্কে পূর্বাহ্নে প্রশাসনকে নিশ্চিন্ত করেন এই বলে যে তাদের বক্তব্য ও প্রচার ব্রিটিশবিরােধী হবে না । বরং এর লক্ষ্য মুসলমান জনতাকে হক রাজনীতি কংগ্রেস রাজনীতি থেকে সরিয়ে আনা (শীলা সেন)। এটাই চেয়েছে ব্রিটিশ শাসকগােষ্ঠী। এরপর নির্বিঘ্নে রাজশাসকদের পৃষ্ঠপােষকতায় বঙ্গীয় মুসলিম লীগ তাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক প্রচার সুষ্ঠুভাবে চালিয়েছে। পাকিস্তান আন্দোলন ক্রমে গ্রাম পর্যায়ে পৌছে গেছে।
এমন একজন রাজনীতিককে কীভাবে, কোন যুক্তিতে ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ হিসাবে চিহ্নিত করা যায় তা বুঝে ওঠা কঠিন। মাওলানা আকরম খাঁ ছিলেন বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সভাপতি এবং শহীদ সােহরাওয়ার্দী সেক্রেটারি । এ পর্যায়ে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ থেকে শুরু হয়। ভিন্নমতাবলম্বীদের বহিষ্কার । যেমন ঢাকার নবাববাহাদুর খাজা হাবীবুল্লাহ, হাশেম আলী খান, সৈয়দ বদরুদ্দোজা প্রমুখ। এক সময়কার হক সমর্থক রাজনৈতিক নেতা। বঙ্গীয় লীগ এর ফলে পুরােপুরি জিন্না সমর্থক হয়ে ওঠে। জিন্না এটাই চেয়েছিলেন। বঙ্গীয় মুসলিম লীগে তখন জিন্নার তিন বিশ্বস্ত অনুসারী কলকাতা ত্রয়ী (ক্যালকাটা ট্রায়াে) তথা দুষ্টচক্রের প্রাধান্য। এদের নাম হাসান ইস্পাহনি, খাজা নুরুদ্দিন ও আবদুর রহমান সিদ্দিকী- সব কজন উর্দুভাষী। তারাই নিয়ন্ত্রণ করবেন বঙ্গীয় মুসলিম রাজনীতি। এদের সঙ্গে যুক্ত হয় আরেক দুষ্টমতি শাহাবুদ্দিন। এই শাহাবুদ্দিনই ভবিষ্যতে পাকিস্তানের তথ্য সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করবেন রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করে এমনটা তখন কেউ ভাবেনি । কিন্তু সেটাই স্বাভাবিক ছিল। এমন এক রাজনৈতিক চক্র যেখানে পাকিস্তান বাস্তবায়নের মন্ত্রণাদাতা সে পাকিস্তানের রাজনৈতিক চরিত্র কী হতে পারে তার প্রমাণ মিলেছে পরবর্তীকালে পাকিস্তানের দুই দশক সময় পরিসরে। বঙ্গীয় মুসলিম লীগ রাজনীতির এই চক্রের মূল বা আসল চক্রধারী মাওলানা আকরম খাঁ। এদেরকে রাজনৈতিক বাতাস দিয়েছে মাওলানা আকরম খণ্ড খাজা পরিবার মিলে তৈরি তিন ইংরেজি বাংলা সংবাদপত্র- ‘আজাদ’, স্টার অব ইন্ডিয়া’ ও ‘মর্নিং নিউজ’। এদের সঙ্গে এঁটে ওঠা সম্ভব ছির না ফজলুল হকের। সম্ভব হয়নি লীগ রাজনীতির অভ্যন্তরে থাকা সত্ত্বেও শহীদ সােহরাওয়ার্দীর। জিন্নার সম্পূর্ণ আস্থাভাজন হতে না পারার কারণে ক্ষমতার জন্য সােহরাওয়ার্দীকে ক্রমাগত লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে। বঙ্গীয় গভর্নরের আশীর্বাদ ও দাক্ষিণ্যে ১৯৪৩ সালের এপ্রিলে যখন বঙ্গে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠিত হয় তখন মুখ্যমন্ত্রিত্বের আসনটি নির্ধারিত হয় শহীদ সােহরাওয়ার্দীর দু বছরের ছােট খাজা নাজিমুদ্দিনের জন্য। সবই জিন্নার মর্জিমাফিক এবং গভর্নর হার্বার্টের সমর্থনের জোরে । ইতিমধ্যে বঙ্গীয় লীগ রাজনীতির অন্দরমহলে অভিনীত হয়েছে অনেক নাটক, ঘটেছে অনেক কিছু।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক