1971.09.12 | ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ | আজকের এদিনে (with references)
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান বাংলাদেশের কুমিল্লার এক মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বলেছেন মুক্তিসংগ্রাম কেবল পশ্চিমা শাসকদের বিরুদ্ধেই নয় মুক্তিযুদ্ধ সকল অসুভ শক্তির বিপক্ষে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিপক্ষেও। তিনি বাংলাদেশ ও পৃথিবীর সকল নিপীড়িত জনগনের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তাদের প্রতি আহবান জানান। তিনি বলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা কোন রূপকথা নয় এটি স্থায়ী ভাবে বেচে থাকবে। আমরা আর কোন আপোষ মেনে নিবনা। [কালান্তর ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
কুষ্টিয়া সফরে গভর্নর মালিক
এই দিনে তিনি সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে তার এলাকা কুষ্টিয়া সফর করেন। জেলা শান্তি কমিটি প্রধান এডভোকেট সাদ আহমেদ গভর্নরকে স্বাগত জানান। এ সময় শান্তি কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার স্লোগানে মুখরিত করে তোলেন। রাজাকার রা দেশাত্মবোধক গান গাইতে থাকেন। এ সময় তার সাথে ছিলেন কিছুদিন আগে যোগ দেয়া প্রাদেশিক চিফ সেক্রেটারী মোজাফফর আহম্মদ এবং প্রাদেশিক রিলিফ কমিশনার আনিসুজ্জামান। সেখানে তিনি বলেন অতীতের তিক্ততা ও ভুল বুঝাবুঝির অবসান করা হবে। এই লক্ষে দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য কমাতে তিনি বদ্ধ পরিকর। তিনি বলেন গনতান্ত্রিক ব্যাবস্থা পুনঃ প্রবর্তনই তার সরকারের লক্ষ্য। পরে তিনি কিছু আশ্রয় শিবির পরিদর্শন করে পর্যাপ্ত সাহায্যের আশ্বাস দেন। সাদ আহমেদ শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে তার কাছে কিছু দাবী দাওয়া পেশ করেন। পরে তিনি মেহেরপুর যান এবং সেখানে ফিরে আসা শরণার্থীদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হন তারপর তিনি নিজ শহর চুয়াডাঙ্গা সফর করে বিকেলে ঢাকা ফিরে আসেন। চুয়াডাঙ্গায় নিজ শহরে তার জনসভায় মাত্র ২০০ জন লোক উপস্থিত ছিল আর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ছিল ৩০০ জন। সভাটি হওয়ার কথা ছিল চুয়াডাঙ্গা স্টেডিয়ামে কিন্তু লোকজন তেমন না আসায় সরিয়ে নেয়া হয়। [সংগ্রাম/ইত্তেফাক ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
সম্ভাব্য ক্যাবিনেট
ইত্তেফাক পত্রিকা তাদের সুত্র অনুযায়ী ১২ জনের সম্ভাব্য একটি মন্ত্রী পরিষদের তালিকা প্রকাশ করেছে। এই তালিকায় নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ২ জনের নাম আছে তাদের একজন শেরেবাংলার পুত্র ফায়জুল হক। অন্য যাদের তালিকায় স্থান দিয়াছেন তারা হল নওয়াজেশ আহমেদ চুয়াডাঙ্গা, এএসএম সোলায়মান ঢাকা, আব্দুস সালাম চাদপুর, একেএম ইউসুফ বাগেরহাট, মং শু প্রু বান্দরবন, মওলানা আমিনুল ইসলাম কুমিল্লা, আব্দুল জব্বার খদ্দর ফেনী, শাহেদ আলী সিলেট। [সংগ্রাম/ইত্তেফাক ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
১১০ জনের মৃত্যু
পেটের পীড়ায় বন্যা উপদ্রুত পাবনা ফরিদপুর কুষ্টিয়ায় মারা গিয়েছে ১১০ জন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে আরও ২০০। এদের অধিকাংশই শিশু। প্রাদেশিক স্বাস্থ্য পরিচালক ডাঃ এ খালেক বলেছেন ঢাকা থেকে একটি চিকিৎসা দল ফরিদপুর ও যশোরে এবং রাজশাহী থেকে একটি দল পাবনায় কাজ করছে। [ইত্তেফাক/পাকিস্তান/সংগ্রাম ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
ঢাকাস্থ পাক সেনাবাহিনী বলেছে তারা কয়েকদিনে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে বেশ কয়েকজন ভারতীয় এজেন্টকে হত্যা করেছে এবং পুরানা পল্টনের এক বাড়ী থেকে বিপুল পরিমান অস্র আটক করেছে অস্রের মধ্যে আছে ৪ টি রাইফেল ৩ টি স্টেনগান ১২ টি গ্রেনেড ও বিপুল পরিমান গুলি। [সংগ্রাম/ইত্তেফাক/ পাকিস্তান ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
দালাল তৎপরতা
ফরিদপুরে জেলা পরিষদ মিলনায়তনে জেলা ছাত্র সংঘ আয়োজিত সমাবেশে ইসলামী ছাত্র সংঘ সভাপতি মতিউর রহমান নিজামি বলেছেন দুনিয়ার কোন শক্তিই ইসলামের নামে অর্জিত পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারবে না। তিনি দেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য বিগত সরকার গুলোকে দায়ী করেন। তিনি বলেন এ সময়ে ইসলামী শিক্ষা বেবস্থাকে আমল দেয়া হয়নি। তিনি বলেন বিভাগ সময়কালীন যে সাম্রাজ্যবাদীরা বাংলাকে হিন্দুস্তানির অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিল যারা পাকিস্তানকে আজিম্পুর গোরস্থান বলেছিল তাদের স্থান আজ পাক মাটিতে না হয়ে আগরতলা বা কলকাতার শ্মশানে হয়েছে। সভায় ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রাদেশিক সাধারন সম্পাদক আলী আহসান মুজাহিদ বলেন ভারত দখলের আগে আমাদের আসাম দখল করতে হবে। তিনি ভারতের ইসলাম প্রিয় জনগনকে ভারতের বিরুদ্ধে অস্র তুলে ধরার আহবান জানান। সভায় বিচারপতি ইকবাল হোসেন চৌধুরীও বক্তব্য রাখেন। [সংগ্রাম ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
মাহমুদ আলী
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সহ-সভাপতি মাহমুদ আলী জাতিসংঘ প্রতিনিধিদলের দলনেতা নির্বাচিত হওয়ায় তাহাকে এক সর্বদলীয় সংবর্ধনা দেয়া হয়। উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, গোলাম আজম, শান্তি ও কল্যাণ পরিষদের সাধারন সম্পাদক নুরুজ্জামান, প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কনভেনশন সভাপতি শামশুল হুদা, পিডিপি নেতা ইউসুফ আলি চৌধুরী মোহন মিয়া, আঞ্চলিক পিডিপি প্রধান আজিজুল হক নান্না মিয়া।
কিছুদিন আগে মাহমুদ আলী পাকিস্তান সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে ইউরোপ ও আমেরিকা সফরের অভিজ্ঞতা এই সভায় বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ইউরোপের বেতার, টিভি, সংবাদপত্রগুলো একই সুরে প্রচার করে চলেছে পূর্ব পাকিস্তানে একটা অঘটন ঘটে গেছে। পাকিস্তানের সাম্প্রতিক নির্বাচনে যে দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে তাদের ক্ষমতা না দিয়ে সেনাবাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের জনগণের দাবি নস্যাৎ করতে চায়। কারণ নির্বাচনের ফলাফল পশ্চিম পাকিস্তানিদের মন:পুত হয়নি। তিনি বলেন, ইউরোপের বুদ্ধিজীবীরা আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন, যা ঘটবার ঘটেছে। এখন যারা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে তাদের নেতার সাথে আপোস করে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। তিনি আরো বলেন, পশ্চিমা দেশসমূহে এই ধারণা জন্মেছে যে, পাকিস্তানের নির্বাচনে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে তাদের সাথে আপোস না করলে বর্তমানে সমস্যার সমাধান হবে না। আমরা তাদের বলেছি নীতিগতভাবে আমরা এর বিরোধী নই। তবে নির্বাচনে যে দল জয়ী হয়েছে সেই দলের নেতা পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছেন। এমন নেতৃত্বের সাথে আপোস হতে পারে না। আজ তাঁর সঙ্গে যদি কোনো মীমাংসায় আসতে হয় তবে তা অখন্ড পাকিস্তানের ভিত্তিতে হতে হবে।
সভায় নুরুল আমীন বলেন মাহমুদ আলীর নেতৃত্ব এ যে দলটি জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করতে যাচ্ছে তার নির্বাচন অতি উত্তম হয়েছে। দল নেতা মাহমুদ আলীর দুই মাস ইউরোপ ও আমেরিকা সফর এ অধিবেশনে তিনি কাজে লাগাতে পারবেন। তিনি মাহমুদ আলী কে দল নেতা করায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কে অভিনন্দন জানান। [সংগ্রাম ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
জামাত প্রাদেশিক সাধারন সম্পাদক আব্দুল খালেক পাকিস্তানের জাতিসংঘ প্রতিনিধিদল গঠন এর প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেন প্রতিনিধিদলে যোগ্য নিবেদিত ত্যাগীদের স্থান হয়নি। তিনি বলেন ভূট্টো সম্প্রতি বলেছেন জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা না হলে দেশে আবারো ২৫ মার্চের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এ প্রসঙ্গে খালেক বলেন ঈ কথা বলে ভূট্টো দেশদ্রোহিতা করেছেন। তিনি বলেন তিনি এক দিকে ঘন ঘন ইয়াহিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেন আর মাঝে মাঝে এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে যান। তিনি বলেন দেশের মহা সঙ্কট কালে ভূট্টোর এরুপ উক্তি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উৎসাহ যোগাচ্ছে। তিনি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ভূট্টোকে এরুপ উক্তি পরিহার করার আহবান জানান।
সৈয়দপুরের রাজনৈতিক নেতারা এক বিবৃতিতে বলেছেন ভারতকে সকল প্রকার সাহায্য বন্ধ করে দিলে শরণার্থী সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সাহায্য প্রাপ্তির কারনেই ভারত শরণার্থী সমস্যা জিইয়ে রাখছে। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন জামাতের আমীর আব্দুল কাইউম, কাউন্সিল মুসলিম লীগের মুজিবুর রহমান, নেজামের মওলানা সালেহ, ইত্তেহাদুল ওলামার মওলানা সাত্তার ও ইসলামী ছাত্র সংঘ নেতৃবৃন্দ। নেতৃবৃন্দ মার্কিন সিনেটর কেনেডির বিভিন্ন তৎপরতার নিন্দা করেন। বিবৃতিতে সেনাবাহিনী ও রেজাকারদের বিভিন্ন কার্যক্রমের প্রশংসা করা হয়। [সংগ্রাম ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
ভারত
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৯ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে তার দেশের সম্পাদিত চুক্তি সম্পর্কে আরও আলোচনার জন্য মস্কো সফর করবেন। সফরটি ২৭-২৯ সেপ্টেম্বর হবে। সফরে তিনি সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন, প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি এবং কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ব্রেজনেভের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
সেখান থেকে তিনি তার ইউরোপ এবং আমেরিকা সফর শুরু করতে পারেন। সোভিয়েতের সাথে মৈত্রী চুক্তি অনেক অস্পষ্ট ভাবে করা হয়েছিল। সে সকল অস্পষ্ট শব্দ এবং প্যারা বিষয়ে বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা তৈরি হতে পারে গান্ধীর সফরে।[যুগান্তর/কালান্তর ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁয়ে ২০ টি শরণার্থী শিবির বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এসব শিবিরে ২ লাখ শরণার্থী বাস করছে। বনগাঁও এর সাথে নৌ যোগাযোগ ছাড়া সকল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানে আটক চার ওমেগা সদস্য যশোর জেলে অনশন শুরু করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের দায়ে মামলা হয়েছে। তাদের শীঘ্রই আদালতে উঠানো হবে। মার্কিন এবং ব্রিটিশ উপ দুতাবাস তাদের আইনগত সাহায্য দিতে অস্বীকার করেছে। [যুগান্তর ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
দিল্লিতে ভারত–বাংলা মৈত্রী সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনে নেওয়া একটি সিদ্ধান্তে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে আরও দেরি হলে সাম্প্রদায়িকতা বাড়বে এবং গণতন্ত্রবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ভারত ও বাংলাদেশ—দুই জায়গাতেই প্রবল হয়ে উঠবে। ভারত–বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত এই সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনে ভারত সরকারের তিনজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ওয়াই বি চ্যাবন, মইনুল হক চৌধুরী ও সিদ্ধার্থ শংকর রায় এবং দিল্লির বাংলাদেশ মিশনের আমজাদুল হক উপস্থিত ছিলেন। [আনন্দবাজার ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ ভায়া প্রথম আলো]
ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি সাধারণ সম্পাদক রাজ্যেশ্বর রাও কানপুরে দলের উত্তর প্রদেশ রাজ্য সম্মেলনে বলেছেন তার দল বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য বাংলাদেশে ভারতের সেনা বাহিনী প্রেরণের ঘোর বিরোধী। তিনি বলেন বাংলাদেশের জনগণই তাদের দেশ মুক্ত করতে সক্ষম হবে। তিনি বলেন কমিউনিস্টরা এবং পৃথিবীর স্বাধীনতা প্রিয় জনগন তাদের পাশে থাকবে। তিনি বলেন বাংলাদেশ সমস্যা ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সমস্যা নয় যে ভার পাকিস্তান যুদ্ধ বাধতে পারে। তবে মার্কিন ও চীনা সাম্রাজ্যবাদের প্ররোচনায় পাকিস্তানের উস্কানি সম্পর্কে ভারতকে সজাগ থাকতে হবে। [কালান্তর ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
Prepared by Salah Uddin