You dont have javascript enabled! Please enable it!

যুদ্ধ দুর্ভিক্ষ ও দুঃশাসনের কালােছায়া

স্বদেশ-বিদেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৯৪২ সাল নিঃসন্দেহে এক তাৎপর্যপূর্ণ কালখণ্ড। এর মধ্যে আগস্ট মাস বিশেষ একটি সময়বিন্দু। এ সময়ের দুটো ঘটনায় তা প্রতিফলিত। প্রথমত, ভারতে গান্ধি ঘােষিত ইংরেজ ভারত ছাড় প্রস্তাব কংগ্রেসে গৃহীত এবং সেই সূত্রে ব্যাপক প্রতিবাদী আন্দোলনের সূচনা যা সরকারি দমননীতির প্রতিক্রিয়ায় দ্রুত সহিংস রূপ ধারণ করে। ভাইসরয় লিনলিথগাের প্রশাসন তা কঠোর হাতে দমনের সিদ্ধান্ত নেয়। দ্বিতীয়ত, স্টালিনগ্রাডে রুশী আত্মদান ও বীরত্বের প্রভাবে আগস্টের শেষ দিক থেকে যুদ্ধের গতি পরিবর্তন যা বিশ্ব ইতিহাসে বিশেষ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। বিশ্বের শান্তিবাদী মানুষের জন্য স্টালিনগ্রাডের যুদ্ধ স্বস্তির সম্ভাবনা বয়ে আনে। বিশ্বযুদ্ধের এ নাটকীয় গতি পরিবর্তন মিত্রশক্তির অন্যতম সদস্য ব্রিটিশরাজের পায়ের নিচে মাটি শক্ত হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দেয় এবং উপনিবেশে বিশেষত ভারতে তাদের প্রশাসনিক ভূমিকার পরিবর্তন ঘটে।  এমনিতেই যুদ্ধকালীন গৃহীত ব্যবস্থাদি প্রান্তিক ভারত বিশেষত বঙ্গদেশের জন্য নানামুখী দুর্ভোগের কারণ হয়ে উঠেছিল। আগস্ট আন্দোলন তাতে বিদ্রোহী হাওয়ার জোগান দেয়। এর ওপর চলে পাল্টা দমননীতির নির্মমতা। এর সর্বাধিক প্রকাশ দেখা যায় বিহার-বঙ্গে। বাংলায় তখন ফজলুল হকের নেতৃত্বে প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন ফ্রন্টের সরকার শাসনকার্য পরিচালনা করছে।  এ মন্ত্রিসভার প্রতি বিরূপ যেমন শ্বেতাঙ্গ শাসক তেমনি বেসরকারি শ্বেতাঙ্গ গােষ্ঠী এবং বিশেষ করে বাংলার গভর্নর। আর বঙ্গীয় মুসলিম লীগের রাজনৈতিক বিরােধিতা তখন রাজনীতির নৈতিকতা ও সব রকম সৌজন্যবােধের সীমা অতিক্রম করে, বিশেষভাবে বঙ্গীয় লীগ নেতাদের ভাষণে ও আচরণে । এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য স্যার নাজিমুদ্দিন ও শহীদ সােহরাওয়ার্দী। তারা বিধানসভায় এবং রাজপথে-ময়দানে বক্তৃতায় হক মন্ত্রিসভাকে অভিযুক্ত করেন। মিত্রশক্তির বিরােধী এবং ফ্যাসিস্টশক্তি ও সুভাষ বসুর রাজনৈতিক সহযােগী হিসেবে বর্ণনা করে (বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার কার্যবিবরণী)।  এর মূল কারণ, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সুভাষ- ভ্রাতা শরৎ বসু ও ফরােয়ার্ড ব্লকের সঙ্গে ফজলুল হকের সৌহার্দ্য এবং ফরােয়ার্ড ব্লক কোয়ালিশন ফ্রন্টের শরিক বলে।

অবাক হওয়ার নয় যে, নাজিম-সােহরাওয়ার্দীর পক্ষে কাজ করেছে শাসক-সহযােগী ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকা, মূলত এর সম্পাদক আর্থার মুরের কল্যাণে । পরিস্থিতি এমনি দাঁড়ায় যে, ফজলুল হকের বিরুদ্ধে কয়েকটি আপত্তিকর নিবন্ধ স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত হয় যে জন্য হক সাহেব সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন (প্রাগুক্ত, অমলেন্দু দে)।  জিন্না ও মুসলিম লীগ কীভাবে ভারতীয় ইংরেজ শাসকদের পােষ্যপুত্র হয়ে ওঠে তা চল্লিশের দশকের সাত বছরব্যাপী ইতিহাসের পাতায় পাতায় রাজনৈতিক ঘটনার চরিত্র নিয়ে ধরা আছে। আমলা গােষ্ঠী, শ্বেতাঙ্গ সমর্থক পত্রিকা ও বেসরকারি ইউরােপীয় গােষ্ঠী থেকে শুরু করে বঙ্গীয় গভর্নর ও ভাইসরয় পর্যন্ত সবাই প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে জিন্না-লীগকে নগ্ন ও প্রচ্ছন্ন সমর্থন জানাতে লজ্জাবােধ করেনি, তাদের নৈতিকতায় বাধেনি। শাসনযন্ত্র এ সময় কট্টর কংগ্রেস-বিরােধী, বিরােধী কংগ্রেস-সংশ্লিষ্ট বাম ঘরানার, জাতীয়তাবাদী মুসলিম সংগঠন ও প্রজাপার্টিরও।  আরাে একটি বিষয় বিবেচনায় রাখা দরকার যে, মূলত ফজলুল হক প্রমুখের আত্মঘাতী পদক্ষেপ এবং হিন্দুমহাসভার মতাে সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সঙ্গে আঁতাত মুসলমান সমাজে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করেছে। এর প্রমাণ মেলে ১৯৪৩ সালে অনুষ্ঠিত বেঙ্গল কাউন্সিলের নির্বাচনী ফলাফলে। এ সময় থেকে ১৯৪৬-৪৭ পর্যন্ত নানা ঘটনা লীগ রাজনীতিকে ক্রমাগত শক্তিশালী করেছে। আর মুসলিম লীগ ভারতীয় মুসলমানদের সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত পথে টেনে নিয়ে গেছে, যেমন ওই পথে হেঁটেছে কংগ্রেসের রক্ষণশীল অংশ এবং সাভারকর ও হিন্দুমহাসভার মতাে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। এর সর্বাধিক প্রভাব পড়েছে বঙ্গে। কারণ বঙ্গীয় মুসলমান তুলনামূলক বিচারে। ভারতের অধিকাংশ প্রদেশের মুসলমানদের চেয়ে পশ্চাদপদ।  এ অবস্থায় মুসলিম লীগের আপ্রাণ চেষ্টা ছিল হক মন্ত্রিসভার পতন ঘটানাে। এ বিষয়ে মুসলিম লীগ সদস্যরা ফজলুল হকবিরােধী অপপ্রচারে এতটাই বেপরােয়া হয়ে ওঠে যে দূর মফস্বল শহরে থেকেও তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। যুদ্ধাবস্থাও মুসলিম লীগকে সাহায্য করেছে। নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি ও খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতির মতাে বিষয়াদি ছিল সামরিক কর্তৃপক্ষ ও আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল, মন্ত্রিসভা সেখানে অনেকটা অসহায়। 

কিন্তু বিরাজমান পরিস্থিতির জন্য নিয়মমাফিক মন্ত্রিপরিষদই দায়ী হওয়ার কথা। আর এ উপলক্ষে নাজিমুদ্দিন-সােহরাওয়ার্দী, বিশেষভাবে সােহরাওয়ার্দী হক মন্ত্রিসভাকে শাসনতান্ত্রিক ব্যর্থতার জন্যই দায়ী করেন না, ব্যক্তি ফজলুল হককে দায়ী করেন হিন্দু-মুসলিম অনৈক্যের দূত হিসেবে। বিধানসভায় তার বক্তব্যে এমন উদ্ভট অভিযােগও উত্থাপিত হয় (প্রাগুক্ত)। এ সম্বন্ধে অমলেন্দু দে বিধানসভায় সােহরাওয়ার্দীর ২৭ মার্চের (১৯৪৩) দীর্ঘ বক্তৃতার অংশ উদ্ধৃত করেছেন তার বইতে। এমনকি একই সুরে পরিবেশিত নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতাও তুলে ধরেছেন, যেখানে হিন্দু সম্প্রদায়কে ফজলুল হক সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। অবশ্য এসব উদ্ভট বক্তব্যের বাস্তবতা নাকচ করে বক্তৃতা করেছেন কিরণশংকর রায়, এমনকি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিও। একই দিনে (২৭ মার্চ) ফজলুল হক তার দীর্ঘ বক্তৃতায় উল্লিখিত অভিযােগের যুক্তিনিষ্ঠ জবাব দেন। তিনি বলেন, সােহরাওয়ার্দী সারাজীবন ধরেই তার শত্রুতা করেছেন। তিনি কখনই তার ক্ষতি করার সুযােগ নষ্ট করেননি। করেননি তার একান্ত নিকটজন হওয়া সত্ত্বেও’ ইত্যাদি (প্রাগুক্ত)। হক বুঝতে পেরেছিলেন যে মুসলিম লীগের ক্রমাগত অপপ্রচার এবং গভর্নর হার্বার্টের মরিয়া প্রচেষ্টার কারণে এ মন্ত্রিসভা বেশিদিন ধরে রাখা যাবে না। তা ছাড়া দেশের অবস্থাও নানাদিক থেকে সঙ্কটের সম্মুখীন। তাই তিনি সর্বদলীয় প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সে ক্ষেত্রে গভর্নর রাজি হলে তিনি পদত্যাগ করতে প্রস্তুত রয়েছেন বলে জানান। গভর্নর এ সুযােগ হাতছাড়া করেননি। তিনি মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হককে পরদিনই (২৮ মার্চ) ডেকে পাঠান এবং জাতীয় সরকার গঠনের কোনাে প্রক্রিয়া শুরু না করে এবং মুখ্যমন্ত্রীকে তার সহকর্মীদের সঙ্গে আলােচনার সুযােগ না দিয়ে অনেকটা জোর করেই পূর্বপ্রস্তুত একটি পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর দিতে তাকে বাধ্য করেন। এটা ছিল সরকার তরফে হকবিরােধী ষড়যন্ত্রের অংশ, যেখানে ন্যায়নীতি ও যুক্তির কোনাে বালাই ছিল না।

এভাবেই হক মন্ত্রিসভা বাতিল এবং ৯৩ ধারাবলে বঙ্গে গভর্নরের শাসন জারি । আশ্চর্য যে, পাকিস্তান আমলে প্রায়। একইভাবে ৯২-ক ধারা জারি করে পূর্ববঙ্গে হক মন্ত্রিসভা বাতিল করা হয় (৩০ মে, ১৯৫৪)। এদেশে ইংরেজ শাসকগণ লর্ড, ব্যারন, স্যার যাই হােন না কেন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে তাদের জুড়ি ছিল না। বেনিয়াবৃত্তিতেও তারা তুলনারহিত। কথা দিয়ে কথা না রাখা অর্থাৎ বিশ্বাস হননে অদ্বিতীয় ব্রিটিশ শাসকদের ঐতিহ্যের ধারক গভর্নর জন হার্বার্টও কথা দিয়ে কথা রাখেননি। তাকে এহেন অপকর্মে সমর্থন জুগিয়েছেন গভর্নর জেনারেল লর্ড লিনলিথগাে । তাতে তার নীতিবােধ আহত হয়নি। সাম্রাজ্যের স্বার্থরক্ষা বলে কথা।  গভর্নর হার্বার্ট যে বঙ্গে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য তার বিশেষ ক্ষমতার অন্যায় ব্যবহার করে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার পতন ঘটাতে পারেন তা প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টির নেতাদের একেবারে অজানা ছিল না। কিন্তু হক পরিস্থিতির শিকার এবং রাজশক্তির কাছে তার হার না মেনে উপায় ছিল না। তবু ফজলুল হক ও শামসুদ্দিন আহমদ ভাইসরয়ের কাছে প্রেরিত তারবার্তায় সংঘটিত অন্যায়ের প্রতিবাদ জানান এবং গভর্নরকেও চিঠি লেখেন (২৪ এপ্রিল, ১৯৪৩) । কিন্তু তাতে কোনাে সুবিচার মেলেনি। |সর্বদলীয় জাতীয় সরকারের বদলে গভর্নরের চেষ্টায় স্যার নাজিমের নেতৃত্বে বঙ্গে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠিত হয় ২৪ এপ্রিল (১৯৪৩)। সমর্থন আদায় করা হয় কয়েকজন তফসিলি সদস্যের অবশ্য দুই দুইটি মন্ত্রিত্বের বিনিময়ে। জিন্না এ রাজনৈতিক বিজয় (ইংরেজ শাসকের বদৌলতে) উদযাপন করেন দিল্লিতে মুসলিম লীগ অধিবেশনে দীর্ঘ বক্তৃতায় এবং ফজলুল হককে বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়ে।  ইংরেজ শাসকের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে কলকাতা টাউন হলে অনুষ্ঠিত বিশাল এক সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয়তাবাদী নেতা আবদুর হালিম গজনভি। প্রধান বক্তা একে ফজলুল হক। তিনি সভায় ঘটনার অনুপুঙ্খ বিবরণ পেশ করেন। এ সভায় সৈয়দ বদরুদ্দোজাসহ একাধিক নেতা বক্তৃতা করেন। নিন্দা জানানাে হয় গভর্নরের অন্যায় ও অসাংবিধানিক আচরণের।

ঐতিহ্যবাহী এ টাউন হলে অতীতে রবীন্দ্রনাথ এবং একাধিক রাজনৈতিক নেতা সরকারি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তৃতা করেছেন যা ঐতিহাসিক তাৎপর্যে মূল্যবান।  প্রসঙ্গত ‘রাজ’ শাসন সম্পর্কে দু-চার কথা বলা দরকার, বিশেষ করে ক্লাইভ-হেস্টিংস-ডালহৌসিদের সঠিক উত্তরসূরি ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগাে এবং তার গভর্নরকুল ও প্রশাসন সম্বন্ধে। ভাগ কর শাসন কর’ নীতির চরম প্রকাশ্য উদাহরণ রেখেছিলেন ভাইসরয় লিনলিথগাে ও তার অধীনস্থ গভর্নরগণ । তাদের স্বেচ্ছাচারিতার চরম উদাহরণ দেখা গেছে বঙ্গে, আসামে, সিন্ধুতে ।  জবরদস্তি করে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার পতন ঘটিয়ে যেভাবে জাতীয় সরকার গঠনের নামে ধােকা দিয়ে শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগের নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভা গঠন করানাে হলাে তাতেই ক্ষান্তি ছিল না বাংলার গভর্নর স্যার জন হার্বার্টের। আরাে ষড়যন্ত্র লুকানাে ছিল তার আস্তিনের ভেতর।  রাজনীতির অনাচার হিসেবে পরিচিত হর্স ট্রেডিং অর্থাৎ দলবদলের সুযোেগ করে দিতে গভর্নরের উদ্যোগে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভার সদস্য সংখ্যা ১৩-তে উন্নীত করা হয়। সেই সঙ্গে একই সংখ্যক পার্লামেন্টারি সেক্রেটারির পদ অনুমােদন করা হয়। অথচ মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক অনেক চেষ্টা করেও তার মন্ত্রিসভার সদস্য সংখ্যা আট থেকে আর বাড়াতে পারেননি। গভর্নর সাহেব অনুমতি দেননি। এমনই ক্ষমতা ছিল গভর্নরদের এবং তা ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের বদৌলতে। সংখ্যা বাড়ানাের সুযােগে অনেক লােভী রাজনীতিক কে কাছে টানা সহজ হয়ে ওঠে। সহজ হয় মন্ত্রিসভা গঠন। সিন্ধুর জাতীয়তাবাদী নেতা মুখ্যমন্ত্রী আল্লাবক্সও অনুরূপ অন্যায়ের শিকার। ‘খান বাহাদুর’ ও ‘নাইটহুড’ খেতাব বর্জনের অপরাধে স্থানীয় গভর্নর তাকে পদচ্যুত করেন এবং মুসলিম লীগকে ডেকে এনে মন্ত্রিসভা গঠনের ব্যবস্থা করে দেন গভর্নর। একই সময়ে (১৯৪২) আসামে মুসলিম লীগ দলকে একইভাবে মন্ত্রিসভা গঠনের সুযােগ করে দেয়া হয়। এভাবে ১৯৪২-৪৩ সাল থেকে বিশেষভাবে মুসলিম লীগের ক্রমবর্ধমান শক্তিসঞ্চারে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করে রাজ’ শাসকগােষ্ঠী। বঙ্গের দুর্দিনে এ সময়ে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা শাসকগােষ্ঠীর সঙ্গে গান্ধি কংগ্রেসের আঁতাত তৈরির তথা সমঝােতার চেষ্টা, বিশেষ করে যখন আগস্ট আন্দোলনের জেরে দেশ জ্বলছে, দেশ পুড়ছে। আন্দোলন, গুলি, মৃত্যু, ফাসি তখনকার নিয়মিত ঘটনা। সমঝােতা স্থাপনে ব্যর্থ হলে গান্ধির চিরাচরিত প্রতিক্রিয়া অনশন। অনশন শুরু ৯ ফেব্রুয়ারি (১৯৪৩) থেকে ২১ দিনের জন্য ২ মার্চ পর্যন্ত ।

ইতিহাস লেখকদের মতে অনশনের কারণ দুর্বোধ্য- তবে আপাতদৃষ্টিতে নিঃশর্ত মুক্তির জন্য। নেপথ্য কারণ জনমনে এবং শাসনযন্ত্রের ওপর প্রভাব সৃষ্টি। কারণ গান্ধির মতাে রাজনৈতিক ভাবমূর্তিসম্পন্ন ব্যক্তির অনশনে মৃত্যু বিশ্ববােদ্ধামহলে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য। কিন্তু ভাইসরয় লিনলিথগাে তবু অনড়। তার মতে, এ জাতীয় অনশন এক ধরনের রাজনৈতিক ‘ব্লাকমেইল’ ছাড়া কিছু নয়। রাজশাসকের সঙ্গে গান্ধির সমঝােতা প্রচেষ্টা হালে পানি পায়নি। বৃথা গেছে একুশ দিনের অনশন । এক বছরেরও পর তার বন্দিত্ব ও অন্তরীণদশার অবসান ঘটে (৬ মে, ১৯৪৪)। | যাই হােক, আবার বঙ্গীয় প্রসঙ্গে আসা যাক। সত্যি ১৯৪৩ সাল বাংলার রাজনীতিতেই নয়, জীবনযাপনের জন্যও ছিল সঙ্কটের কাল। আগস্ট  আন্দোলনের জের তখনাে ভালােভাবেই চলছে। এর মধ্যেই পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গে সরকারি (শাসকরাজের) নীতির কারণে গ্রামাঞ্চলে খাদ্যাভাবে দুর্ভিক্ষের অশুভ ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, পরে যা পঞ্চাশের মহামস্বন্তর নামে কুখ্যাতি অর্জন করেছে। | সরকারি নীতির কারণে এমন সম্ভাবনা লক্ষ্য করেই ১৯৪২ সালের আগস্টে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক বঙ্গীয় গভর্নরকে তাদের খাদ্য মজুদ ও সরবরাহ নীতি পরিবর্তনের জন্য চিঠি লিখে আহ্বান জানান। কিন্তু গভর্নর তাতে কান দেয়া দরকার মনে করেননি। অন্যদিকে এপ্রিলে গঠিত নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভা এ বিষয়ে গুরুত্ব আরােপ করেনি। শহীদ সােহরাওয়ার্দী তখন খাদ্যমন্ত্রী। শীলা সেন লিখেছেন, সােহরাওয়ার্দী কলকাতায় লঙ্গরখানা খুলে দুর্ভিক্ষজনিত মৃত্যুর মােকাবেলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আসলে খাদ্য মজুত ও সরবরাহের পদক্ষেপ সােহরাওয়ার্দীর আগেই নেয়া উচিত ছিল। কারণ লঙ্গরখানা খােলা সত্ত্বেও কয়েক লাখ দরিদ্র গ্রামীণ জনতার মৃত্যু ঘটে কীভাবে? প্রকৃতপক্ষে যাদের বদান্যতায় মন্ত্রীমণ্ডলী গঠন তাদের জনবিরােধী খাদ্যনীতি ও অন্যান্য নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা বা ব্যবস্থা গ্রহণের সাহস বা শক্তি কোনােটাই মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন বা খাদ্যমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর ছিল না। এ ব্যর্থতা গােটা মন্ত্রীমণ্ডলীর।

এর ফলে পঞ্চাশের মন্বন্তরে গ্রামীণ দরিদ্র জনসংখ্যার মৃত্যু সরকারি হিসাবে ১৫ লাখ, সমকালীন অন্য হিসাবে ৩৫ লাখ এবং বহু কথিত নানা সূত্রের হিসাবে ৫০ লাখ। বাংলায় এ অমানবিক মৃত্যু নিয়ে রচিত হয়েছে মন্বন্তর সাহিত্য, দেখা গেছে শিল্পী জয়নুল আবেদীনের রেখাচিত্রে মৃত্যুর ভয়াবহতা। আশ্চর্য যে তা সত্ত্বেও এ দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যুর মিছিল, ‘ফ্যান দ্যাও’ আর্তি নাজিম। মন্ত্রিসভার অস্তিত্বে সামান্যতম আঁচড় কাটতে পারেনি। মজুতদার, কালােবাজারি দুবৃত্তরা লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে অর্থেবিত্তে ফুলে ফেঁপে কলাগাছ হয়ে ওঠে। কিন্তু মন্ত্রিসভা তাদের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নিতে চেষ্টা চালায়নি। লক্ষ্য করার বিষয় যে, এ মৃত্যু বাঙালি মধ্যবিত্তকে স্পর্শ করেনি। করেছে গ্রামের দরিদ্র জনগােষ্ঠীকে। তবে শিল্পী সাহিত্যিককুলের চৈতন্য গভীরভাবেই স্পর্শ করেছিল। শুধু চালের সঙ্কটই নয়, এ সময় চিনি, কেরােসিন, নুন ইত্যাদি অত্যাবশ্যক সামগ্রীও দুর্মূল্য হয়ে ওঠে, কোথাও কোথাও দু’প্রাপ্য। এ সময়ে সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দী নড়াইল মহুকুমা শহরে এসে টাউন হলে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তার দোআঁশলা বাংলায়- তাই নিয়ে বিস্তর হাসাহাসি! টাউন হলে।   ছাত্র ও শহুরে মধ্যবিত্ত ছাড়াও ছিল সিভিকগার্ড-হােমগার্ড ও কমিউনিস্ট নেতাকর্মীদের উল্লেখযােগ্য উপস্থিতি। মন্ত্রীর আশ্বাসে আশ্বস্ত হননি শহরের মানুষ।  ভাবতে অবাক লাগে এমন এক জাতীয় দুর্যোগ ও গণমৃত্যু সত্ত্বেও মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে ফজলুল হকের মতাে ধীমান রাজনীতিকদের কেউ অভিযােগের আঙুল তােলেননি। না বিধানসভায়, না ময়দানে জনসভায় । দাবি তােলেননি তাদের ব্যর্থতাজনিত পদত্যাগের। বরং সে সময়কার রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালােচনায় দেখা যায় বাংলায় মুসলিম লীগের রাজনৈতিক শক্তি ক্রমবর্ধমান। কী আশ্চর্য স্ববিরােধী ঘটনা। আরাে চমৎকার ঘটনা যে এ সময় বঙ্গে খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহের ‘সােল এজেন্ট’ ছিল জিন্নার আশীর্বাদধন্য ইস্পাহানি। পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর দায় তাদের ওপরও বর্তায় (পড়ুন বঙ্গীয় বিধানসভায় খাদ্য পরিস্থিতির ওপর মন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর বক্তৃতা, ৫ জুলাই, ১৯৪৩)।

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!