You dont have javascript enabled! Please enable it! আগস্ট আন্দোলনের চরিত্রবিচার ও কুশীলবগণ - সংগ্রামের নোটবুক

আগস্ট আন্দোলনের চরিত্রবিচার ও কুশীলবগণ

আগস্ট আন্দোলন (১৯৪২) তথা ইংরেজ ভারত ছাড়’ আন্দোলন গান্ধির আহ্বানে শুরু হলেও তা দ্রুত জনস্তরে ছড়িয়ে পড়ে গান্ধির অহিংস নীতি বর্জন করে। কারণ বিশ্বযুদ্ধ ও ভারত সরকারের যুদ্ধনীতির কারণে ক্ষুব্ধ জনসাধারণ বিশেষ করে বৃহদ্বঙ্গীয় জনতা সরকারবিরােধী আন্দোলনের জন্য তৈরি হয়ে ছিল । তা না হলে আন্দোলন এত দ্রুত দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ত না। আর সরকারের দমননীতিও এত তীব্র ও ব্যাপক হয়ে উঠত না। একটা ছােট সাদামাটা উদাহরণ দিই। বিশেষ কারণে আমি তখন মাস কয়েকের জন্য নিজ গ্রামে। যাতায়াতের বিচারে দুর্গম, সেই প্রত্যন্ত গ্রামে আগস্ট আন্দোলনের প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে দেখে অবাক হই । ভাদ্রমাস  থইথই পানি। নৌকা করে একদল সশস্ত্র পুলিশ স্কুলসংলগ্ন শ্যামগ্রামের এক বাড়ি থেকে স্থানীয় কংগ্রেসনেতা নুটুবিহারীকে (পদবি মনে নেই) গ্রেফতার করে নৌকায় তােলে। অদৃশ্য হয়ে যায় নৌকা।  প্রতিবাদে স্কুলের ছাত্রদের ধর্মঘট, রাস্তায় মিছিল। শ্লোগান ওঠে “ইংরেজ ভারত ছাড়’ । আশ্চর্য, মুসলমান ছাত্ররা ওই মিছিলে যােগ দেয়নি, ব্যতিক্রম দুচারজন। কারণ বড়দের নিষেধ । পরে জেনেছি নিষেধের মূল উৎস জিন্না সাহেব ও মুসলিম লীগ। তাছাড়া সাম্প্রদায়িক চিন্তার অবদানও কম নয়- ওটা হিন্দুদের আন্দোলন’ । যেন দেশটা শুধু হিন্দুদের, মুসলমানের নয়। আসলে মূল। কারণ লীগ-কংগ্রেস দ্বন্দ্ব। এরই জের ধর্মীয় সম্প্রদায় পর্যন্ত গড়ায়। আরাে একটি উদ্ভট ঘটনা, বলা যায় গ্রামীণ রটনা, কীভাবে তৈরি কেউ জানে। রটনার মর্মকথা- গান্ধি মুসলমানদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। কাজেই আন্দোলন জায়েজ। সেজ চাচাকে ওই সংবাদে খুব উত্তেজিত দেখেছিলাম। কদিনের মধ্যেই রটনার বেলুন চুপসে যায় । তখন অবস্থা পূর্ববৎ। বুঝতে পারা যায় রাজনীতিতে সম্প্রদায় চেতনার প্রভাব চল্লিশের দশকের শুরুতেই কতটা ব্যাপক হতে শুরু করেছিল।  এমন একটি সম্ভাবনাময় আন্দোলন কি না সূচনার মাস কয় পরেই গান্ধি অস্বীকার ও বর্জন করেন। ব্যাপকভিত্তিক দক্ষ নেতৃত্বের অভাবে এবং কংগ্রেসের বিরােধিতায় আন্দোলনের মৃত্যু ঘটে। অবশ্য শাসনযন্ত্রের অবিশ্বাস্যরকম দমননীতি, সেনাবাহিনীর তৎপরতাও এ জন্য দায়ী। সৈন্যদল নামিয়ে যে।

আন্দোলন স্তব্ধ করতে হয় তা হডসন তুচ্ছ জ্ঞান করেন কীভাবে? সিভিলিয়ান লেখক না বুঝলেও ঠিকই বুঝেছিলেন শাসক, ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগাে। আর সে কারণেই উদ্বিগ্ন ভাইসরয়ের তারবার্তা প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে এই বলে যে ‘১৮৫৭ সালের পর এটা এমনই মারাত্মক বিদ্রোহ যে সামরিক নিরাপত্তার কারণে এর গুরুত্ব ও ব্যাপকতা বিশ্বের কাছ থেকে গােপন রাখতে হয়েছে’ ট্রান্সফার অব পাওয়ার, ২য়, পৃ. ৮৫৩)। এ তারাবার্তা এবং রক্তাক্ত দমন নীতি থেকে বােঝা যায় আগস্ট আন্দোলন শাসক-শক্তির ভিত্তিতে। কতটা জোরে আঘাত করেছিল। আর এটাই সত্য তা কেউ মানুন বা না মানুন। এ সত্য বুঝতে ভুল করেনি শাসক ইংরেজ। এ আন্দোলন দমন করতে সামরিক শক্তির ব্যবহার সত্ত্বেও দীর্ঘ সময় লাগার কারণ গ্রামাঞ্চলে এর বিস্তার । বাংলা সাহিত্যে এর ব্যাপকতা ও চরিত্র সম্বন্ধে। কিছু আভাস মেলে যা ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে আছে। এ আন্দোলনের । জনসংশ্লিষ্টতা ও নেতৃত্ব পরিচয় সম্বন্ধে যথেষ্ট গবেষণা হয়েছে বলে মনে হয়।। যে জন্য উল্লিখিত দুটো বিষয় নিয়ে তথ্য-প্রমাণে ঘাটতি রয়ে গেছে । অর্থাৎ আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ কোন পর্যায়ে, কী প্রকৃতিতে এবং কারা এর মূল কুশীলব- কৃষক-কারিগর শ্রেণি না শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা । অশিক্ষিত জনসাধারণ তা সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত নয়। একে পুরােপুরি কৃষক বিদ্রোহ’ (সুনীতি ঘােষ) বলা বােধহয় ঠিক নয়। শহুরে শিক্ষিত শ্রেণি এবং গ্রামাঞ্চলে কৃষক- অকৃষক জনসাধারণ আগস্ট আন্দোলনের কারিগর বলে মনে হয়। তবে প্রাধান্য শিক্ষিত ছাত্র-যুবাদের। আর নেতৃত্ব? তাও ছিল বহুবিচিত্র। স্থানীয় কংগ্রেসী, অকংগ্রেসী নেতা, আন্দোলন থেকে উঠে আসা নেতা, তাছাড়া সংগঠনগতভাবে আরএসপিআই, ফরােয়ার্ড ব্লক ও সিএসপি তাে বটেই। এমনকি কংগ্রেস হাইকমান্ড, মূলত গান্ধি। আন্দোলনের প্রতি নিন্দা জানানাে এবং অভ্যন্তরীণ চাপ সত্ত্বেও কংগ্রেস সােশ্যালিস্ট পার্টি (সিএসপি) আন্দোলন থেকে সরে আসেনি। কিন্তু একাধিক সংগঠন ও স্থানীয় ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার কারণে এতে একমুখী নেতৃত্ব ও সংহতির। অভাব ছিল। গােটা দেশব্যাপী আন্দোলন পরিচালনায় সংগঠনগত দুর্বলতা অবশেষ পরিণামে ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।

এদিক থেকে সিপাহি বিদ্রোহ তথা প্রথম স্বাধীনতা মহাবিদ্রোহের সঙ্গে এর পরিচালনা ও নেতৃত্ব দুর্বলতার মিল রয়েছে এবং মিল শাসকপক্ষের উভয়  ক্ষেত্রেই সংগঠনগত দক্ষতা, উন্নতমান অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার ও কুশলতা। তাছাড়া কংগ্রেসের মতাে বিশাল একটি সংগঠনের নেতৃত্বে অনুপস্থিতিও ব্যর্থতার একটি বড় কারণ। গণআন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও এতে ভারতীয় শ্রমিকশ্রেণির সংগঠিতভাবে অংশগ্রহণ না করার গুরুত্ব কম নয়। আগেই বলা হয়েছে শিল্প-কারখানার শ্রমিকশ্রেণির পিছিয়ে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ কমিউনিস্ট পার্টির জনযুদ্ধ’ নীতি, শাসকশ্রেণিকে যুদ্ধকালে ব্ৰিত না করার নীতি। তাছাড়া শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নগুলাের একটি বড় অংশ ছিল কংগ্রেসের (‘নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’- এআইটিইউসির) নিয়ন্ত্রণে। অথচ এ আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণি শক্তিমান উপকরণ (অংশীদার) হতে পারত। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। হলে অবস্থা ভিন্নরূপ নিতে পারত। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের চরিত্রবদল ঘটার সম্ভাবনাও সেক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ছিলনা। সুনীতিকুমার ঘােষের বিচারে বিহার ও উত্তর প্রদেশের পূর্বাংশে আগস্ট আন্দোলন কৃষক বিদ্রোহের চরিত্র অর্জন করে সেসব অঞ্চলে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও ইংরেজ শাসন অচল হয়ে পড়েছিল। সামরিক বাহিনীর সাহায্যে ব্রিটিশ রাজকে ওইসব অঞ্চলে কর্তৃত্ব উদ্ধার করতে হয়। তার মতে, ‘লড়াই ছিল ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে, কিন্তু জমিদার ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে নয়। সে ক্ষেত্রে এ বিদ্রোহকে কি চরিত্রবিচারে মতাদর্শগত বিচারে কৃষক বিদ্রোহ রূপে চিহ্নিত করা যায়? না, যায় না।  আগস্ট আন্দোলনের ইতিহাস পাঠে দেখা যায়, ব্যাপক জনসংশ্লিষ্টতা সত্ত্বেও এর পরিচালনায় ছাত্র, যুব ও শিক্ষিত শ্রেণি, মধ্যবিত্ত রাজনৈতিক নেতাকর্মীর প্রাধান্য। কংগ্রেসের শীর্ষনেতৃত্ব আন্দোলনের দায়িত্ব ও নেতৃত্ব প্রত্যাহার করলেও তাদের লড়াকু নেতাকর্মী-সমর্থকরা আন্দোলনে ব্যাপকভাবে সংশ্লিষ্ট । সংশ্লিষ্ট পূর্বোক্ত তিন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। এ উপলক্ষে আরএসপিআই-এর জয়প্রকাশ নারায়ণ বা সিএসপির অরুণা আসিফ আলীর দেশব্যাপী সংগ্রামী ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল । কংগ্রেস হাইকমান্ড আন্দোলনের তুঙ্গ পর্যায় থেকেই সহিংসতার অজুহাতে তাদেরই ডাকা আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। বিশেষ করে গান্ধিকে দেখা গেল ভাইসরয়ের সঙ্গে আলােচনায় আগ্রহী, কিন্তু ভাইসরয় গান্ধির সমঝােতার আহ্বানে সাড়া দিচ্ছেন না। বরং সর্বশক্তি দিয়ে বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত এবং সে দমনে সাম্রাজ্যবাদী নির্মমতার যথেষ্ট প্রকাশ ঘটেছিল। 

অবস্থাদৃষ্টে কংগ্রেসের চেষ্টা যাতে আত্মগােপনে থাকা তাদের সমাজতন্ত্রী নেতারা আত্মসমর্পণ করেন। এ চেষ্টা ছিল তাদের নীতিগত সিদ্ধান্তে । শুধু একা গান্ধিরই নয়, কংগ্রেস সভাপতি আজাদও তখন ওই একই নীতির অনুসারী। তখনকার দৈনিক পত্রিকাগুলাের পাতা উল্টে দেখলে কংগ্রেসের ওই স্ববিরােধী ভূমিকার প্রমাণ মিলবে। গান্ধি-কংগ্রেস সেজন্যই তখন সচেতন তরুণ সমাজের সমর্থন হারিয়েছিল। সে সমর্থন গিয়েছিল সুভাষের দিকে। যদিও সুভাষ তখন অক্ষশক্তির সঙ্গে যুক্ত। সমর্থন নামে সুভাষের দিকে হলেও তা প্রকৃতপক্ষে ছিল ফরােয়ার্ড ব্লকের দিকে।  কিন্তু আগস্ট আন্দোলনের নেতারা আত্মসমর্পণ করেননি। বরং তাদের চেষ্টা ছিল এ আন্দোলনের মাধ্যমে যুদ্ধে পিছুহটা রাজশক্তির ভারতীয় মসনদ ধরে টান দেয়া, রাজাকে খান খান করার চেষ্টা। হয়তাে সে কারণেই লিনলিথগােরও আপ্রাণ চেষ্টা তা যত অমানবিক চরিত্রেই হােক আন্দোলনের মেরুদণ্ড ভেঙে চুরমার করে দেয়া। কিন্তু কাজটা তাদের জন্য কঠিন ছিল। মেদিনীপুর, বীর মেদিনীপুর তার প্রমাণ। ছাত্র-জনতা মিলে মেদিনীপুরের কাথি তমলুকে সমান্তরাল শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছি, যাকে বলে স্বশাসন। শ্রেণিচরিত্র বিচারে এ আন্দোলন মূলত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির । যদিও এতে জনসাধারণ এবং কৃষক শ্রেণির সংশ্লিষ্টতা ছিল। এর সঙ্গে একাত্তরে সংঘটিত বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের শ্রেণিগত মিল কিছুটা হলেও রয়েছে। সেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, ছাত্র-যুবার প্রাধান্য, সঙ্গে কৃষক-জনতার অংশবিশেষ । তবে পার্থক্য বিয়াল্লিশের আন্দোলর্মে শিল্পপতি, পেশাজীবী ও বণিক শ্রেণি এক কথায় বুর্জোয়া, বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণি প্রথম দিকে দোদুল্যমান ছিল। হয়তাে তারা বুঝে দিতে চেয়েছিল আন্দোলনের পাল্লা কোন দিকে ভারি- জয় না পরাজয়ের । তাই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা সময় ব্যয় করেছে। হয়তাে ভয় ছিল শাসকের রক্তচক্ষুর। তাই তারা জাতীয় বুর্জোয়ার ভূমিকা পালন করতে পারেনি। অবশেষ সিদ্ধান্তে তারা ব্রিটিশ রাজের প্রতি সমর্থন জানিয়ে কমপ্রেডর পুঁজিপতির নিশ্চিন্ত। ভূমিকাই পালন করেছে। এদিক থেকে বিড়লা, টাটা প্রমুখ সবাই এক কাতারে যে জন্য জয়প্রকাশ নারায়ণ ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। 

এসব বৃহৎ শিল্পগােষ্ঠীর কংগ্রেসকে অর্থসাহায্য বহুকথিত ঘটনা। ঘনশ্যাম দাস বিড়লা তাে ছিলেন গান্ধির একান্তজন, প্রধান ভরসাস্থল এবং শাসক শ্রেণির সঙ্গে যােগাযােগের সেতু । বিড়লা ছাড়া গান্ধি অচল এবং বিড়লাও তার বাপুজি” কে ছাড়া অচল। কারণ বাপুর মাধ্যমে তিনি তার নিজস্ব অবস্থান সুদৃঢ় করেছেন… কারাে কারাে মতে, দেশবিভাগের নেপথ্য নায়ক তাে বিড়লাসহ বৃহৎ শিল্পপতিগণ। আগস্ট আন্দোলন শুরুর দায় কার বা কাদের- এ প্রশ্নের জবাবে বলতে হয়, অবশ্যই গান্ধির স্লোগানগুলাে তারই। আর সংগঠনগতভাবে কংগ্রেস এ আন্দোলনের আহ্বায়ক। তবে এমনটাও মনে করা হয় যে, এ আন্দোলনের নামে চাপ দিয়ে গান্ধি ব্রিটিশ রাজের কাছ থেকে কিছু রাজনৈতিক সুবিধা আদায়। করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার হিসাবে ভুল ছিল। ব্রিটিশ শাসক তখন ক্রিপস প্রস্তাবের বাইরে পা বাড়াতে রাজি ছিল না। তার কারণও ছিল। সে কারণ। আন্তর্জাতিক।  ঐতিহাসিক স্টালিনগ্রাদ যুদ্ধের সময়কাল আগস্ট ১৯৪২ থেকে শুরু। সে অসমসাহসীযুদ্ধে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে রুশবাহিনী কঠিন জার্মান ব্যুহ ভেদ করতে সক্ষম হয়, যে ঘটনা যুদ্ধ-বিশেষজ্ঞদের মতে বিশ্বযুদ্ধে এক বাঁকফেরা বিন্দু (টার্নিং পয়েন্ট)। হিটলারের বিশাল বাহিনীর অগ্রগতি স্টালিনগ্রাদ থেকে স্তব্ধ । সম্ভাব্য জয়ের সুবাতাস বুঝে নিতে চতুর চার্চিলের অসুবিধা হওয়ার কথা। নয় । তাই আগস্ট আন্দোলনের দায় সম্বন্ধে গান্ধির বিচার ব্যাখ্যা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না ব্রিটিশ শাসকগােষ্ঠী। তারা পাল্টা শক্তিপ্রয়ােগ জারি রাখার সিদ্ধান্তে অটল থাকে।  আর একথাও ঠিক যে, আন্দোলন তখন গান্ধির হাতে নেই। এর ধ্বংসাত্মক রূপ ব্যাপক হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেল-জুলুম, ফাসি-গুলি মানুষকে নিরস্ত করতে পারছে না। অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের ভারতের পক্ষে নব্য দূতিয়ালি প্রধানমন্ত্রী চার্চিল আর মেনে নিতে রাজি নন। এমনকি কাজে আসছে টাটা, বিড়লা, ঠাকুরদাস প্রমুখ শিল্পপতি এবং উদারপন্থী রাজনীতিক রাজাগােপালাচারি, তেজবাহাদুর সা, জয়াকর প্রমুখের রাজ বনাম কংগ্রেসের মধ্যে সমঝােতা তৈরির চেষ্টা। লিনলিথগাে এ বিষয়ে কঠোর ও অনড়। অনড় প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল। সর্বশেষ বিচারে দেখা যায় যে আগস্ট আন্দোলন পুরােপুরি স্তব্ধ করে দিতে সেনাবাহিনীর সাহায্য সত্ত্বেও ভারত সরকারের দুবছর সময় লেগেছিল। এ তথ্য থেকেই আগস্ট আন্দোলনের গুরুত্ব অনুভব করা যায়। অথচ ভারতীয় এবং বঙ্গীয় কমিউনিস্ট পার্টি তাদের অন্ধ আন্তর্জাতিকতার তাড়নায় আগস্ট আন্দোলনের ভুল মূল্যায়ন করেছে। এমনকি করেছেন বাংলার মননশীল মার্কসবাদী লেখকগণ । এ ধরনের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি বিদগ্ধ মার্কসীয় তাত্ত্বিকলেখকদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না।  

পাশাপাশি একথাও ঠিক যে আগস্ট আন্দোলনের সমর্থকবৃন্দ বিশেষ করে ছাত্র-যুব নেতৃত্বে এ বিষয়ে ছিল আতিশ্য। তাদের কেউ কেউ এ আন্দোলনকে ‘বিপ্লব’ হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন যা আদৌ ঠিক ছিল না। কারণ গান্ধির নির্দেশিত এ আন্দোলনে বিপ্লবের কোনাে দিকনির্দেশনা বা মতাদর্শগত তত্ত্ব উপস্থিত ছিল না। ছিল না এর পেছনে বিপ্লবী মতাদর্শের কোনাে জনসংগঠনের নেতৃত্ব। শুকনাে মাঠে রােদেপে খড়বিচালি এতটাই তেতে ছিল যে তাতে জ্বলে ওঠার জন্য দরকার ছিল স্ফুলিঙ্গ। আগস্ট আন্দোলন সেটাই জুগিয়ে দেয়। | ছােট একটি ঘটনা প্রসঙ্গত স্মরণযােগ্য। আন্দোলন শেষ হয়ে যাওয়ার কিছুকাল পর ফরােয়ার্ড ব্লকের ছাত্রফ্রন্ট নিখিলবঙ্গ ছাত্র কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন বর্ধমানের মহারাজার অতিথিশালায় । আর ওই সম্মেলনে গরমে-গুমােটে বিন্দুমাত্র অতিষ্ঠ না হয়ে ছাত্রনেতাগণ রাতভর উত্তপ্ত বিতর্কে ব্যস্ত ছিলেন এ সত্য নির্ধারণ করতে যে ‘আগস্ট আন্দোলন বিদ্রোহ না বিপ্লব’তাদের ভাষায় রিভােল্ট অর রেভল্যুশন’। যতদূর মনে পড়ে ওই সম্মেলনে বিতর্কের সুরাহা হয়নি। তবে বিদ্রোহপন্থীরা ছিলেন দলে ভারী । এবং সেখানে ছিলেন বসু পরিবারের ছাত্র-যুব নেতাগণ। তবে আমার কাছে আপত্তিকর মনে হয়েছিল বঙ্গীয় সম্মেলনে তাবৎ বাঙালি ছাত্র-যুবাদের উপস্থিতিতে নেতাদের ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা ও তর্ক-বিতর্ক। বাঙালি সন্তানের এই দুর্মতি ঔপনিবেশিক শাসনসূত্রে ধার করা। রবীন্দ্রনাথ বৃথা চেষ্টা করেছিলেন কংগ্রেসকে এ ঝোক থেকে ফেরাতে। আগস্ট আন্দোলন এর উপকরণ ও চরিত্রবিচারে ছাত্র-যুব-জনতার স্বাধীনতা অর্জনের প্রয়াস। এর তীব্রতা ও ব্যাপকতা অনেকের হিসাবে ছিল না। সবদিক বিচারে বিপ্লব নয়, এতে স্বাধীনতা-প্ৰয়াসী প্রতিবাদী বিদ্রোহেরই প্রকাশ ঘটেছে যদিও স্বতন্ত্রভাবে নিজ নিজ এলাকায়, রাঢ়বঙ্গ থেকে বিহার হয়ে মহারাষ্ট্র অবধি। বিচ্ছিন্নভাবে স্বতন্ত্র নেতৃত্বে সংঘটিত হওয়ার কারণে এবং এর নেতৃত্বে। একক বিপ্লবী মতাদর্শ ও সংগঠন না থাকার ফলে আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে পারেনি। আগস্ট আন্দোলন, গােপাল হালদার যা-ই বলুন ‘বিয়াল্লিশী বিলাস’ নয়, অবশ্যই ছাত্র-যুব-জনতার স্বাধীনতার আন্দোলন। এ আন্দোলন সুশৃঙ্খল বিপ্লবী সংগঠনের নেতৃত্বে গেরিলা যুদ্ধের দীর্ঘস্থায়ী চরিত্র নিয়ে পরিচালিত হলে সাফল্য দেখা দিতেও পারত এবং তা শেষ সমঝােতায় বা রক্তাক্ত যুদ্ধে। 

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক