You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিশ্বযুদ্ধ ও ভারতীয় কমিউনিস্টদের ‘জনযুদ্ধ’

ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির বরাবরের সমস্যা তত্ত্বে ও বাস্তবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারা । দাদা পার্টির তত্ত্বে ভর দিয়ে তাদের পথচলা। এখানেই চীনা। পার্টির সঙ্গে তাদের প্রভেদ। প্রভেদ সাফল্যে-ব্যর্থতায়। কারাে কারাে যুক্তিএর কারণ মূলত শাসক শ্রেণীর প্রচণ্ড দমননীতি । কিন্তু কমিউনিস্টদের ওপর নির্যাতন ও দমননীতি কোথায় চলেনি? চীন, ভিয়েতনাম, ক্যাম্পুচিয়া, এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশে কোথায় নয়? হিটলারের অভ্যুত্থানের পর নাৎসি। জার্মানিতে কমিউনিস্ট পার্টিকে তাে উইচ হান্টিং’-এর মতাে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আমাদের মনে পড়ে,অগ্নিগর্ভ’ (ফায়ার আন্ডারগ্রাউন্ড) বইটির বক্তব্য। আত্মগােপনে থেকেও রেহাই পাননি অনেক কমিউনিস্ট নেতা। দেশত্যাগ করতে হয়েছে ব্রেখটের মতাে খ্যাতনামা কবি, নাট্যকারকে । বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে। এমনি আরাে অনেককে। তৎকালীন ইউরােপীয় সাহিত্যে এ জাতীয় কিছু প্রমাণ ধরা রয়েছে। আমরা এখনাে মনে করি জুলিয়াস ফুচিকের ফঁসির মঞ্চ থেকে। মনে করি লাের্কা বা নেরুদার কিছু কিছু রচনা। সেই সঙ্গে কডওয়েল, রাল্ফ ফক্স প্রমুখ শহীদের কথা। আসলে বিশ্বের দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টি উগ্র জাতীয়তাবাদী বা স্বৈরশাসনের নির্যাতন ও দমনপীড়নের মধ্য দিয়ে তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। এজন্য তাদের বিপরীত আদর্শের সংগঠন ব্যবহার করতে হয়নি ভারতীয় পার্টির মতাে।  ব্রিটিশ ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি কৃষক বিপ্লব বা সর্বহারা বিপ্লবের মতাদর্শ নিয়ে সংগঠিত হতে চেষ্টা করেনি। বরং শাসকগােষ্ঠীর চাপ প্রতিহত করতে কংগ্রেসের সঙ্গে পথ চলতে চেষ্টা করেছে যা মতাদর্শভিত্তিতে যুক্তিসঙ্গত ছিল না। ভারতীয় রাজনীতির সম্প্রদায়গত প্রভাবের কারণে এক সময় কমিউনিস্ট পার্টি লীগ কংগ্রেসের ঐক্য চেয়ে শ্লোগান তুলেছে যা বাস্তবে কখনাে হওয়ার ছিল না। তাছাড়া ওরা কমিউনিস্ট পার্টিকে বরাবরই সহযাত্রী নয়, শত্রুই ভেবেছে। কেন্দ্র থেকে প্রান্তিক স্তরে দলগুলােতে এমন ভাবনাই দেখা গেছে। তাই মহকুমা শহরে দেখেছি পরস্পরবিরােধী রাজনৈতিক দল লীগ ও কংগ্রেসের দুই নেতা কালান্দার সাহেব ও জ্যোতিষ চক্রবর্তীকে কমিউনিস্টদের ঐক্যের স্লোগান নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে ও কমিউনিস্ট পার্টিকে “ইংরেজের দালাল’ সম্বােধনে মজা পেতে। লীগ নেতা ভুলে গিয়েছিলেন যে জিন্নার একহাত বরাবর ইংরেজশাসকের দিকে বাড়ানাে ছিল। কেন জানি কমিউনিস্ট পার্টি এসব বাস্তবতা বুঝতে চায়নি। বুঝতে পারে নি। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির পরনির্ভরতার কারণ নেতৃত্বে দক্ষিণপস্থার প্রভাব নাকি যােগ্য নেতৃত্বের অভাব? পার্টি সেক্রেটারি পি.সি জোশি তাে একক। শক্তিতে আন্দোলন গড়ে তোেলা কঠিন মনে করতেন।

অথচ এক পর্যায়ে ছাত্রশ্রমিক-কৃষকদের নিয়ে রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তােলা তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল  কিন্তু মতপথের দ্বন্দ্বে তারা সঠিক দিক-নিশানা খুঁজে পাননি। রাজনৈতিক দোদুল্যমানতা তাদের শক্তিমান গণসংগঠন গড়ে তুলতে দেয়নি। আমার ধারণা, সঠিক নীতি ও রণকৌশল গ্রহণে ব্যর্থতা ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সােভিয়েত ইউনিয়ন আক্রান্ত হওয়ার পর যুদ্ধের চরিত্র নিয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি আলােচনায় বসে। অর্থাৎ যুদ্ধটা দুই কুকুরের লড়াই অন্য কিছু তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলেছে । শুরুতে এ যুদ্ধ তাদের বিচারে ছিল দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চরদখলের লড়াইয়ের মতাে। পাঠকের মনে পড়তে পারে এ দেশে একাত্তরে উগ্র চীনাপন্থীদের ছােট একটি গ্রুপের দুই কুকুরের লড়াই’ শীর্ষক থিসিসের কথা।  ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি কিন্তু ১৯৩৯-৪০ সালে যুদ্ধ-বিরােধী ভূমিকায় । যুদ্ধে ভারতবাসীর ভূমিকা সম্পর্কে তাদের নীতি ও শ্লোগান না এক পাই, না। এক ভাই’। অর্থাৎ মাংসখণ্ডের অধিকার নিয়ে দুই কুকুর লড়াই করতে থাকুক। ওই ধারণা বড় একটা ভুল ছিল না। তবু এর মধ্যে একটু ‘কিন্তু ছিল। বিশদ বিচারে দু-চারজনের কথা জানি (অবশ্য বছর কয় পরে) যাদের হিসাব ছিল একটু ভিন্ন। অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট বনাম ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তুলনামূলক বিচার । কিন্তু আসল সমস্যা ছিল সিপিআই-এর নিজের মধ্যে অর্থাৎ কংগ্রেসের লেজুড়বৃত্তির মধ্যে।

অবশ্য এ কথাও মানতে হবে যে ভারতে ইংরেজ শাসক যতটা কংগ্রেস বা বিপ্লবী-বিরােধী ছিল তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ভীত, আতঙ্কিত ছিল কমিউনিস্টদের নিয়ে- এক কথায় ‘লাল জুজুর ভয়। ‘সব লাল হাে জায়েগা’র ভয়। সেজন্য একটি শ্রমিক আন্দোলনের বই বা রুশবিপ্লব  বিষয়ক বই নিষিদ্ধ হয়ে যেত বিপ্লববাদীদের পুস্তিকার মতাে। ভাবতে পারা যায়। রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ নিয়ে কী ভয় ভারতীয় শ্বেতাঙ্গ শাসকদের? | এমন এক বাস্তবতায় অর্থাৎ প্রচণ্ড দমননীতির মুখে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি’ (‘সিপিআই’) নিজের পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে চেষ্টা করেনি। চেয়েছে। কংগ্রেসের আড়াল নিয়ে চলতে। এ নীতি সঠিক ছিল না। সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সহযােগিতার পরও নিজের মতাে করে নিজস্ব পথে চলাই ঠিক- তাতে দমন-নির্যাতন-উৎপীড়নের ধারা সত্ত্বেও। শ্রমিক ও কৃষক। সংগঠনের মাধ্যমে ক্রমশ শক্তি সঞ্চয়ের সম্ভাবনা ভুল হিসাব ছিল না। বিশ্ব ইতিহাসে মুক্তিসংগ্রামের ধারা লক্ষ্য করে দেখলে বুঝতে পারা যায় যে বিপ্লবী গণসংগঠন গড়ে তােলার মাধ্যমেই বিপ্লবের সাফল্য। কিন্তু সিপিআই-এর বড় সমস্যা ছিল অন্যত্র ।

তারা কখনাে কখনাে কাগজেকলমে সংগ্রামের মতপথ অর্থাৎ নীতি ও কৌশল বিচারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে । কিন্তু তা বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে পারেনি। পার্টির নীতি নির্ধারণে শুরু থেকেই ছিল বাইরে থেকে আসা ‘থিসিস’ অনুসরণ- এবং তা দেশীয় বাস্তবতা হিসাবনিকাশ না করে। পার্টিতে বিদগ্ধ তাত্ত্বিকদের উপস্থিতি সত্ত্বেও নিজ পথ নিজে নির্ধারণের বিষয়টা আমলে আনা হয়নি। কাজেই মতপথের ভুলভ্রান্তি যথেষ্ট মাত্রায় চলেছে। এ বিষয় নিয়ে একাধিক ডক্টোরাল থিসিস রচিত হতে পারে। যাইহােক মূল প্রসঙ্গে ফিরি তার আগে বহুবার লেখা কথাটা প্রাসঙ্গিকতার টানে বলতে হয় যে রাজনীতি-সচেতন ভারতবাসী বিশেষ করে বাঙালি বিশ্বযুদ্ধে প্রবলভাবে ইংরেজ-বিরােধী। এ অবস্থায়ও ১৯৪১-এর শেষদিকে সিপিআই-এর সিদ্ধান্ত : বিশ্বের একমাত্র সমাজতন্ত্রী দেশ সােভিয়েত ইউনিয়ন নাৎসি বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার কারণে যুদ্ধের চরিত্রবদল ঘটেছে। এ যুদ্ধ এখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির একার যুদ্ধ নয়, এটা এখন সমাজবাদ রক্ষার দায়ে জনযুদ্ধ। এ যুদ্ধে মিত্রশক্তি তথা সােভিয়েত পক্ষে কাজ করতে হবে ভারতকে। এ পার্শ্বপরিবর্তনের কারণ সম্ভবত ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির ভারত ও যুদ্ধবিষয়ক থিসিসের প্রভাব। বিশেষ করে কিছুটা দক্ষিণঘেঁষা ব্রিটিশ কমরেড রজনী পামদত্তের লেখার প্রভাব। লক্ষণীয় যে, এক্ষেত্রেও ব্রিটিশের জাতীয় স্বার্থ ব্রিটিশ মার্কসবাদীদের বিচার-বিশ্লেষণে প্রাধান্য পেয়েছে, যা আমরা পরবর্তীকালে দেখব মস্কো, বেইজিং-এর নীতিগত বিবেচনায়। এই উদ্ভট নীতির চরম প্রকাশ: চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ শ্লোগান।  

এক্ষেত্রে অবশ্য সিপিআই-এর হিসেবে আন্তর্জাতিকতা প্রাধান্য পেয়েছে স্বদেশী স্বার্থের চেয়ে। এ জাতীয় এ ভুল আমরা সবাই করেছি, বরাবর করেছি। পার্টির সংহত সাংগঠনিক কাঠামাের মধ্যেও নাকি এ বিষয়ে সাধারণ সদস্যের পক্ষ থেকে ভিন্নমত, বিরুদ্ধমত উচ্চারিত হয়েছিল (একাধিক সূত্র থেকে উদ্ধৃতি, সুনীতি ঘােষ)। হওয়ারই কথা। কারণ জনস্তরে ব্রিটিশের পক্ষে সমর্থন মেনে নেয়ার কথা নয়। ছাত্র ও শিক্ষিতদের সম্বন্ধে আমাদের অভিজ্ঞতাও একই রকম। তবু সিপিআই এ নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়েছে যেমন ছাত্রফ্রন্টে তেমনি বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনে- যথা শ্রমিক ফ্রন্ট ও পেশাজীবী সংগঠনে, এমনকি কিসান সভায়। বাদ পড়েনি সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলাে। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ থেকে ফ্যাসিস্ট-বিরােধী সংগঠনগুলাে জোরেশােরে এ নীতি চালু করেছে। তাই তারা চিহ্নিত হয়েছে ইংরেজের দালাল’ পরিচয়ে। সংঘাতমূলক পরিবেশ তৈরি হয়েছে কংগ্রেস, ফরােয়ার্ড ব্লক, সিএসপি, আরএসপিআই-এর মতাে রাজনৈতিক সংগঠনগুলাের সঙ্গে। শহর ঢাকায় তুলনামূলক বিচারে কংগ্রেস, ফরােয়ার্ড ব্লক ও আরএসপিআই ছিল। সংগঠনগত দিক থেকে যথেষ্ট শক্তিমান। ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে দলগত রেষারেষি। আর কমিউনিস্ট পার্টির ফ্যাসিস্ট-বিরােধী জমায়েত কেন্দ্র করেই ঢাকায় সংঘটিত হয় তরুণ লেখক-কমিউনিস্ট নেতা সােমেনু চন্দ হত্যাকাণ্ডের বর্বরতা। এতেই বােঝা যায় বিষয়টা রাজনৈতিক আবেগ কতখানি স্পর্শ করেছিল। অবশ্য এতে দলগত দ্বন্দ্বও ছিল প্রধান। আপাতত এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, ফ্যাসিস্ট-বিরােধী ভূমিকা গ্রহণের পেছনে যুক্তি থাকলেও এ যুদ্ধকে ‘জনযুদ্ধ’ হিসেবে গ্রহণ করা ব্রিটিশ আধিপত্যের পরাধীন ভারতে প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। অন্তত জনচিন্তার আলােকে। মানুষ চেয়েছে ইংরেজের পরাজয় । আগস্ট আন্দোলন থেকে ‘৪৫ সাল পর্যন্ত নানা। উত্তেজক ঘটনা তার প্রমাণ।

দৈশিক বাস্তবতা বিচারে কমিউনিস্ট পার্টির সংগ্রাম হওয়া দরকার ছিল দুই ফ্রন্টে- যেমন ফ্যাসিস্ট-বিরােধিতায়, তেমনি সংঘবদ্ধভাবে স্থানীয় সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধিতায়। এ দুয়ের সমম্বিত যাত্রায়, সঠিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে জনসমর্থন পাওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু ওই একতরফা জনযুদ্ধ’ শ্লোগানের কারণে ওই কটা বছর কমিউনিস্ট পার্টি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আমাদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন নয়। তাৎক্ষণিক এ নীতির কারণে ক্রিপস প্রস্তাব তাদের বিচারে ‘অসম্পূর্ণ হলেও ইতিবাচক ও আলােচনাযােগ্য। এমন পরামর্শই তারা দেন লীগ-কংগ্রেসকে।  সেই সঙ্গে তাদের প্রতি আহ্বান, যাতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলাে জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট-বিরােধী যুদ্ধে সদর্থক ভূমিকা পালন করে। জার্মানি-জাপান-ইতালিয় অক্ষশক্তির পরাজয়ে সহযােগিতা করে। কিন্তু কংগ্রেসসহ অন্য বাম দলগুলাে উল্লিখিত পথে হাঁটতে রাজি ছিল না। রাজি না হওয়ার প্রধান কারণ ভারতে ইংরেজ শাসকের অনুসৃত জনবিরােধী নীতি। খাদ্য মজুতদারির পাশাপাশি খাদ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা ও নৌকা বাজেয়াপ্ত করার মতাে ঘটনাবলী বাংলায় চরম জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে বার্মা ফেরত শ্বেতাঙ্গ অশ্বেতাঙ্গ ফৌজের ক্ষেত্রে খাদ্য, আশ্রয়, পরিবহন বিষয়ক চরম বৈষম্যমূলক আচরণ এবং খাদ্য ও পানির অভাবে বার্মা। ফেরত হাজার হাজার সাধারণ উদ্বাস্তুর নিদারুণ দুর্দশা ও মৃত্যুর ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়ে জনমনে প্রবল বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যা কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলে ক্রিস প্রস্তাবের বিপক্ষে। তবু ক্রিস প্রস্তাবে গ্রহণ-বর্জন দুদিকেরই বাস্তবতা স্বীকার্য । এ উপলক্ষে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার ভারত বিষয়ক স্বশাসনের ঘােষণা আন্তর্জাতিক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায়, যে জন্য প্রায় চার বছর পর আবারও তাদের অনুরূপ মিশন পাঠাতে হয়। ভারতে। তবে এ কথাও সত্য যে, তাদের অনুসৃত পরােক্ষ সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি মুসলিম লীগের শক্তিবৃদ্ধি এবং দেশবিভাগের পটভূমি তৈরি করে।

আশ্চর্য যে বিভাগপূর্ব এক দশকের ১৯৩৭-১৯৪৭) প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনা যেন এক অদৃশ্য শক্তির টানে অনাকাক্ষিত পরিণতির দিকে এগিয়ে চলে, অনিবার্য হয়ে ওঠে দেশবিভাগ। সে শক্তির একটি বড় অংশে রয়েছে ব্রিটিশ চাতুর্য, রাজনৈতিক খেলা। অবশেষে মতাদর্শগত বাস্তবতার নিরিখে জনযুদ্ধ বিষয়ক তৎপরতার চরিত্র বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন বােধহয় দরকার। দরকার বিশেষ করে এ কারণে যে আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্বের বিষয়টি ভারতীয় কমিউনিস্টদের কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় যে সেখানে স্বদেশী স্বার্থ ঠাই পায় না। এমনকি স্বদেশের মুক্তিসংগ্রামও অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। স্বদেশের স্বার্থ ও আন্তর্জাতিক স্বার্থের সমম্বয় ঘটানাের কথা তাদের বিবেচেনায় আসেনি। দুই ফ্রন্টে সংগ্রামের নীতি সঠিকভাবে গ্রহণ করতে না পারার কারণে দেশের আর্থসামাজিক সমস্যা, সঙ্কট নিরসনের ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টি সংস্কারবাদী বদ্ধাবস্থায় আটকে পড়ে। সরকারের জনস্বার্থবিরােধী নীতির কারণে চাল, নুন,চিনিসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের সঙ্কট সমাধানে ‘ফুড কমিটি’তে অংশ নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি মজুতদারি, কালােবাজারির বিরুদ্ধে সামাজিক সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে কথা বলেছে ঠিকই, কিন্তু সরকারি নীতির ভুলভ্রান্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়নি। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির শ্লোগান ভুল ছিল না। কিন্তু গরিব কৃষকের পক্ষে সামন্তবিরােধী শ্লোগান জোরেশােরে উচ্চারিত হওয়া দরকার ছিল। 

জনযুদ্ধের টানে সােভিয়েত ইউনিয়নকে বাঁচাতে গিয়ে স্বদেশ বা স্বদেশীদের বাঁচানাের গুরুত্ব গৌণ হয়ে দাঁড়ায় কমিউনিস্ট নেতৃত্বের বিচারে। সমাজবাদী মতাদর্শ রক্ষার পাশাপাশি স্বদেশী জনগােষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের তথা স্বাধীনতার দাবি যে মার্কসবাদী বিচারেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, এ সংগ্রামী সত্য মনে হয় ভারতীয় কমিউনিস্টদের হিসাবে ছিল না। থাকলে প্রতিটি দেশের জাতীয় সংগ্রামের গুরুত্ব তাদের চেতনায় প্রতিফলিত হতাে। হতাে স্বদেশে জাতীয় সংগ্রামের গুরুত্ব। এবং উদাহরণ হিসেবে চার্চিলের যুদ্ধকালীন উপনিবেশ বিষয়ক বক্তৃতা তাদের মতাদর্শগত নীতি নির্ধারণে সহায়ক হতাে। বিশেষ করে পূর্বঘােষণাদি ভুলে গিয়ে যখন প্রধানমন্ত্রী চার্চিল বলেন (নভেম্বর, ১৯৪২) যে ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ধ্বংসযজ্ঞে সভাপতিত্ব করার জন্য তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হননি।’ জনযুদ্ধবাদীরা এ সহজ সত্য বুঝতে চাননি যে দুর্যোগের মুখে গর্তে পড়ে গেলেও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চরিত্র পাল্টায় না। ভারতীয় ভাইসরয় ও ব্রিটেনের শাসককুল তাদের পিছুহটা অবস্থায়ও ভারতীয়দের সঙ্গত দাবির ক্ষেত্রে নমনীয় হয়নি, দাবি মেনে নেয়া তাে দূরের কথা। ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগাে থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। আসলে বিশ্বযুদ্ধ ভারতের স্বাধীনতা আদায়ে এক মহাসঙ্কট ও জটিলতা সৃষ্টি করেছিল। আরাে একটি বিষয় প্রসঙ্গত বিবেচ্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চরিত্র বিচারে ততক্ষণ পর্যন্ত সহযােগিতার যুদ্ধ হিসেবে গ্রহণযােগ্য যতক্ষণ সমাজতন্ত্রী দেশ সােভিয়েত ইউনিয়ন ফ্যাসিস্ট শক্তি দ্বারা আক্রান্ত ও বিপর্যস্ত। কিন্তু তারা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পর ইঙ্গমার্কিন যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত হওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে ভারত-ব্রিটিশ দ্বন্দ্ব তখন পূর্ব গুরুত্ব পেয়ে যায় ।

ব্রিটিশ রাজশক্তির সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর লড়াই তখন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিমুখী লড়াইয়ের তত্ত্ব উপনিবেশ দেশগুলাের জন্য বিশেষভাবে সত্য। লড়াই ছাড়া প্রকৃত মুক্তি কখনাে অর্জিত হয় না। ভারতে শাসকদের হাত দিয়ে ক্ষমতার হস্তান্তর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্বেচ্ছাকৃত নয়।১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলনের তীব্রতা থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত বাংলা এবং ভারতজুড়ে যে ধর্মঘট আর বিদ্রোহ, মিছিলে মিছিলে আন্দোলন সেসবের অভিঘাত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের জীর্ণ ক্ষয়িষ্ণু ও পােকায় কাটা শিকড় ধরে টান দিয়েছিল। | প্রত্যক্ষ না হলেও এসবের পরােক্ষ প্রভাব ব্রিটিশরাজকে বাধ্য করেছিল ভারতীয় রাজনীতিকদের সঙ্গে আলােচনায় বসতে, সমঝােতা প্রস্তাব নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌছাতে । সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌছাতে না পারা সত্ত্বেও ভারত পরিত্যাগ করা ছাড়া তাদের জন্য কোনাে বিকল্প ছিল না। সবদিক বিচারে তাই কমিউনিস্ট পার্টির ‘জনযুদ্ধ’তত্ত্ব ছিল নির্দিষ্ট ঘটনানির্ভর সময়-পরিসরে সাময়িক সত্য, পরে যার চরিত্রবদল ঘটে । ঘটে পঞ্চাশের মন্বন্তরে গ্রামের লাখ লাখ দরিদ্র কৃষক-কারিগর শ্রেণীর নারী-পুরুষ-শিশুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। অসংখ্য মৃতদেহের ওপর দাঁড়িয়ে জয় জনযুদ্ধের নয়, জয় মিত্রশক্তির। সে জয়ের সুফল পেতে ভারতবাসীকে যুদ্ধশেষে আরাে দুবছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ক্ষমতার বহু-আকাঙিক্ষত হস্তান্তর ঘটেছে কংগ্রেসের অনাকাক্ষিত দেশবিভাগ ও সামপ্রদায়িক সংঘাতের রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে। মুসলিম লীগের মতাে ভূস্বামী-প্রধান উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠনকে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি কীভাবে সমর্থন জানাতে পারে তা বুঝে ওঠা কঠিন। আর সাজ্জাদ জহিরের মতাে ধীমান কমিউনিস্ট নেতাইবা কীভাবে জিন্না-লীগের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন কিংবা কংগ্রেস-লীগ ঐক্যের পক্ষে শ্লোগান তােলেন তাও বুঝে ওঠা মুশকিল। চৈতন্যে আদর্শগত দুর্বলতার জন্যই কি তিনি নিজ জন্মভূমি ভারতের যুক্তপ্রদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে হিজরত করেন? তার চেয়েও দুর্বোধ্য কংগ্রেসের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসা কমিউনিস্ট নেতৃত্ব কোন্ যুক্তিতে জিন্না-লীগের দেশবিভাগ সমর্থন করে, যে-বিভাগ দেশময়। রক্তস্রোত বইয়ে দিয়েছিল। তাও আবার নেতাদের নয়, নিরপরাধ সাধারণ মানুষের। রাজাজি ফর্মুলায় দেশবিভাগ সমর্থন কমিউনিস্ট নীতির জন্য বিস্ময়কর বটে! দেশবিভাগ সমর্থন এক পর্যায়ে কংগ্রেসেরও।

জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’- বহুকথিত এ নীতি এক্ষেত্রে খাটে এ কারণে যে, ধর্মীয় সম্প্রদায় ও জাতিসত্তা এক বিষয় নয়। জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বের ভূত কমিউনিস্ট নেতাদের কাঁধে চেপেছিল, বিশেষ করে চল্লিশের দশকে এসে। তারা বুঝতে চাননি যে জিন্নার ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ তথা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উস্কানির ফল কী ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত দেশবিভাগের পটভূমি তৈরি করে।  যাক সেসব কথা। জনযুদ্ধের বাস্তবতা ও অবাস্তবতার সঠিক নীতিগত মূল্যায়ন করতে পারেনি তাত্ত্বিক কমিউনিস্ট ধীমানগণ। তাদের একপেশে ও ভুল দৃষ্টিভঙ্গি মাঝে মধ্যে গৃহীত সঠিক নীতি হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছে। জনযুদ্ধের টানে তারা আগস্ট আন্দোলনের (১৯৪২) সঠিক মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থ হয়েছে কংগ্রেস-সমর্থক কমিউনিস্ট পার্টি ওই আন্দোলনের চরিত্র নির্ধারণে । কারণ গান্ধি-সূচিত ওই আন্দোলন দ্রুতই জনতার আন্দোলনে পরিণত হয় রাঢ়বঙ্গ থেকে বিহার ও উত্তর ভারতীয় অঞ্চলে। আর সে কারণে গান্ধি নিজেই ওই আন্দোলন প্রত্যাহার করেন আন্দোলন হিংসাশ্রয়ী’- এ অজুহাতে, যেমন করেছিলেন চৌরিচৌরার ঘটনায়। আন্দোলন তবু চলেছে। নেতৃত্বহীন নৈরাজ্যে, সে জন্য লিনলিথগাের পক্ষে প্রচণ্ড দমননীতি তথা ফাসিজেল-জুলুমের মাধ্যমে ওই আন্দোলন দমন করা সম্ভব হয়। বাদ যায় নি। আকাশ থেকে বােমা বর্ষণ । 

 

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!