1971.09.09 | ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ | আজকের এদিনে (with references)
ত্রাণ মন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান বলেছেন পাকিস্তানী জান্তার সাথে তাদের রাজনৈতিক মীমাংসার কোন প্রশ্নই উঠে না। তিনি বলেন বাঙ্গালীরা পশ্চিম পাকিস্তানী শোষক ও হত্যাকারীদের সাথে এখন আর এক চালের নীচে বসবাস করার আর চিন্তাই করেনা। তিনি বলেন আমরা ক্রমেই সাফল্য এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি এবং এ সময় বেশী দূরে নয় যে আমরা স্বাধীন হব। তিনি বলেন সুনামগঞ্জের দিরাই থানা মুক্তিবাহিনী দখল করে নিয়েছে। সেখানে মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছে থানার সকল পুলিশ তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। দিরাই দখলে ২২ জন পাক সেনা নিহত হয়েছে। প্রচুর অস্র মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়েছে। [জন্মভুমি ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
মুজিবনগর প্রশাসনের বরাত দিয়ে যুগান্তর পত্রিকা বলেছে মুক্তিবাহিনী মাগুরার শ্রীপুর থানা দখল করে নিয়েছে। সেখানে মুক্তি বাহিনী বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছে এবং থানার সকল কর্মচারী মুক্তিবাহিনীর আনুগত্য স্বীকার করেছে। এ দখল অভিযানে ১২৫ জন পাক সৈন্য ও তাদের সহযোগী নিহত হয়েছে। [যুগান্তর ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
ভোলা থানা শান্তি কমিটি আহবায়ক আবুল কাশেম মিয়া ও মহকুমা শান্তি কমিটি আহবায়ক ইলিয়াস মিয়া মাস্টারের সুত্র উল্লেখ করে সংগ্রাম পত্রিকা বলেছে ভোলা মহকুমার বিভিন্ন সময়ে পলাতক ৩৪ জন বাঙ্গালী সৈন্য স্থানীয় শান্তি কমিটির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এদের মধ্যে একজন সুবেদার আব্দুল কাদের। স্থানীয় সামরিক প্রশাসন তাদের সনদ দিয়ে স্ব স্ব ইউনিটে প্রেরন করেছে। শান্তি কমিটি সাধারন ক্ষমার সুযোগ নিয়ে বাকী বিদ্রোহীদেরও আত্মসমর্পণের আহবান জানিয়েছেন। [সংগ্রাম ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
প্রাদেশিক সরকার এখন থেকে পুলিশে মাদ্রাসা ছাত্র নিয়োগ দিবে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব সুলতান মোহাম্মদ খান মস্কো সফর করে দেশে ফিরে এসে বলেন তার সফর সফল হয়েছে। ভারতের পত্রিকা গুলি অবশ্য বলেছে সুলতান মোহাম্মদ খানের সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে পাকিস্তানের কোন লাভ হয়নি। তারা বলেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানকে বলে দিয়েছে ভারত আক্রমণে না যাওয়ার জন্য। সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো ও তাঁর সহকারী ফিরুবিনের সঙ্গে আলোচনার সময় সুলতান মহম্মদ খান পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতার ব্যাপারে ভারতের যোগসাজশ ও ষড়যন্ত্র এবং পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য তথাকথিত ব্যবস্থা ইত্যাদি বোঝানোর চেষ্টা করেন। মস্কোর কূটনৈতিক মহল জানায়, পাকিস্তানের ব্যাখ্যা সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের মনে কোনো দাগ কাটতে পারেনি। [যুগান্তর ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
পিপিপি প্রধান জুলফিকার আলী ভূট্টো বলেছেন পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এখন পশ্চিমের প্রদেশ গুলোতে এবং কেন্দ্রে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা নেই।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্য প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য কংগ্রেস সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ৬টি দেশের জন্য ৪০ কোটি ৭০ লক্ষ ডলার সাহায্য প্রস্তাব পেশ করেছেন। পাকিস্তানে সাহায্যের কারন হিসেবে তিনি বলেছেন পূর্ব পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষের আশংকা বিদ্যমান। তিনি বলেন পূর্ব পাকিস্তানে আমরা ৫ কোটি ডলার সাহায্য দিয়েছি এবং প্রয়োজন অনুসারে আরও মানবিক সাহায্য দিব। [পাকিস্তান ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
অল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘ সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী যশোরে শহর শাখার এক সভায় বলেন পূর্ব পাকিস্তানে যা কিছু ঘটছে তা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক কিন্তু সবকিছু অপ্রত্যাশিত নয়। কিছু সংখ্যক অপরিনামদর্শী নেতার বল্গাহীন রাজনীতি এর জন্য দায়ী । গত নির্বাচনে জাতীয় দলগুলি ও আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে আদর্শ গত পার্থক্য ছিল। সম্প্রতি যারা পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল আল্লাহ তাদের প্রত্যেককে লাঞ্ছিত করেছেন। যারা পাকিস্তানকে যারা আজিমপুর গোরস্থান বলেছিল তাদেরকে পাকিস্তানের মাটি গ্রহন করে নাই। তাদের জন্য কলকাতা আর আগরতলার শ্মশান অপেক্ষা করছে। তিনি দেশের জনগণকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলেন অতীতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন আর না ঘটে। তিনি দুঃখ করে বলেন ৬৫ সনের ঐক্যবদ্ধ জাতি মাত্র ৬ বছরে কেন ভুলে এত বড় সর্বনাশ ডেকে আনছে। সমাবেশ ছাড়াও দলের কর্মী সভায় পাকিস্তান বিরোধী সকল কর্মচারীকে ছাটাই করার জন্য সরকারের প্রতি আবেদন সম্বলিত এক প্রস্তাব গ্রহন করা হয়। সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ইসলামী ছাত্র সংঘের যশোর জেলা সাধারন সম্পাদক মোঃ জিয়াউল হক, শহর শাখার সভাপতি নুরুল ইসলাম, ও কর্মী আজিজুল হক বক্তব্য প্রদান করেন। [সংগ্রাম ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
জাতিসংঘ সাধারন পরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের দল নেতা পিডিপি ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আলী ঢাকায় বলেছেন ভারত বা অন্য কোন দেশ যদি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের সামিল কোন পদক্ষেপ গ্রহন করে তবে পাকিস্তান প্রচণ্ডভাবে তার মোকাবেলা করবে। তিনি বলেন জাতিসংঘে পাকিস্তান অতীতের ন্যায় বিশ্ব এর নির্যাজিত জনগনের পক্ষে কথা বলবে। তিনি জাতির আশা আকাংখার মর্যাদা রাখতে সক্ষম প্রমানিত হবার জন্য আল্লাহর রহমত ও দেশবাসীর শুভেচ্ছা কামনা করেন। তাকে ভারতের শক্তিশালী প্রতিনিধিদল গঠনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন আমরা প্রচণ্ড ভাবেই তাদের মোকাবেলা করবো। তিনি বলেন পাকিস্তান জাতিসংঘে আরব ও চীনের পক্ষেও জোরালো ভুমিকা রাখবে। তিনি বলেন ১৯ সেপ্টেম্বর দেশ ত্যাগের আগে তিনি একবার রাওয়ালপিন্ডি যাবেন। [সংগ্রাম/পাকিস্তান/অবজারভার।ইত্তেফাক/পূর্বদেশ ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
কাউন্সিল মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান সভাপতি খাজা খয়ের উদ্দিন করাচীতে বলেছেন প্রেসিডেন্ট এর সাধারন ক্ষমা ইসলাম প্রিয় ও পাকিস্তানপন্থীদের মাঝে হতাশার সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন আওয়ামী দলীয় পরিষদ সদস্যদের যারা হত্যা লুট অগ্নিসংযোগ গুণ্ডামিতে জড়িত ছিল তাদের ক্ষমা থেকে পৃথক রাখা উচিত ছিল। তিনি বলেন যারা পাকিস্তান রক্ষায় নিজের জীবন বিপন্ন করে সরকারকে সহযোগিতা করছে পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা করেছে তারা প্রেসিডেন্ট এর ক্ষমা ঘোষণায় হতাশ হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন আগামী উপনির্বাচনে এ ক্ষমার প্রভাবও পড়তে পারে। দেশপ্রেমিকরা এ ঘটনায় নির্বাচন থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে পারে। তিনি বলেন গভর্নর মালিক তার মন্ত্রীসভায় আওয়ামী লীগের কতিপয় সদস্যকেও গ্রহন করবেন। এতে মন্ত্রীসভার গোপন তথ্যাদি সীমান্তের ওপারেও চলে যেতে পারে। তিনি বলেন পূর্ব পাকিস্তানে আমরা নতুন ভাবে নির্বাচন দাবী করছি। তিনি বলেন প্রদেশে এখন দরকার সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং দ্বি জাতি তত্ত্ব এর গুরুত্ব জনগনের কাছে তুলে ধরা। [সংগ্রাম/পাকিস্তান/অবজারভার।ইত্তেফাক/পূর্বদেশ ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরণ সিং উপমহাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করতে শ্রীলংকা গিয়েছেন। তিনি সেখানে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী বন্দরনায়েকের সাথে বৈঠক করবেন। [কালান্তর/যুগান্তর ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
ভারত সফররত যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ এবং ভারতে দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক জন কেনেথ গলব্রেথ কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে কলকাতায় সাংবাদিকদের বলেছেন, পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে, এ ব্যাপারে তাঁর কোনো সন্দেহ নেই। এই গণহত্যা সংঘটনে যারা অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে, তারাও গণহত্যাকারীর মতো সমান অপরাধে অপরাধী। তিনি কলকাতার যুগান্তর পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন মুজিবের বিচার করার ক্ষমতা আর পাকিস্তানের নেই। পাকিস্তান যদি মুজিবের বিচার করে তা হবে তাদের অমার্জনীয় অপরাধ। তিনি বলেন পৃথিবীর সকল দেশই মুজিবকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে। তিনি বলেন বাংলাদেশকে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দিলে বাংলাদেশ সমস্যার একটি সমাধান হতে পারে। এ সমাধান সকল দেশের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে। তিনি সোভিয়েত ভারত চুক্তিকে সমর্থন করেন।[যুগান্তর ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
জনসংঘ সভাপতি বাজপেয়ী দিল্লীতে বলেছেন যতক্ষন পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত শরণার্থীদের তাদের দেশে ফিরে যাওয়ার কথা বলা নিতান্তই অর্থহীন। তিনি বলেন ভারতের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি এবং মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করা উচিত। তিনি বলেন ভারতের সাহায্য পেলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা তরান্বিত হবে। তিনি বলেন বর্ষার পর পাক বাহিনী মুক্তিবাহিনীর উপর জোরালো আক্রমণ চালাবে তাই এখন মুক্তিবাহিনীকে বিমানবাহিনী সহায়তা দেয়া প্রয়োজন। [কালান্তর ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
ভারতে নিউজিল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত হাই কমিশনার ডানলপ পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছেন। [কালান্তর/যুগান্তর ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
Prepared by Salah Uddin