ভাষাশহীদ আবদুস সালাম
আবদুস সালামের জন্ম ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর। ফেনী জেলার দাগনভূঁইয়া উপজেলার লক্ষ্মণপুর গ্রামে।
পিতা মুনশি আবদুল ফাজেল মিয়া এবং মা দৌলতেরনেছার ঘরে প্রথম সন্তান হিসেবে ঘর আলাে করে প্রথম পুত্র সন্তান আবদুস সালাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবা মায়ের ছয় সন্তানের ভেতর প্রথম সন্তান হিসেবে আবদুস সালাম ছিলেন অতি আদরের। সালামরা ছিলেন চার ভাই আর দুই বােন।
কৃষক পরিবারের সন্তান আমাদের ভাষা শহীদ আবদুস সালাম। বংশানুক্রমিক ভাবেই কৃষি কাজে জীবনধারণ করতেন। বাবা আবদুল ফাজেল নিজের যৎসামান্য জমির সাথে অন্যের জমি বর্গা চাষ করে কোনাে মতে সংসার চালাতেন। এতেও যখন সংসারের টানাপােড়েন ঘােচে না, মাঝে মাঝে তিনি গ্রামের বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কোরান খতম পড়ানাে ও কোরান তেলাওয়াতের কাজ করতেন। ফাজেল মিয়া শৈশবে কিছুদিন মাদ্রাসায় পড়াশােনা করেছিলেন সেই সুবাদে তিনি গ্রামের এই সব আচার অনুষ্ঠানে ডাক পেতেন। এ কারণে তিনি ধীরে ধীরে গ্রামের লােকজনের মাঝে ‘মুনশি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। স্থানীয় লােকজন কেউ কেউ তাকে ফাজেল মিয়া বলেও সম্বােধন করত।
১৯৭৬ সালে আবদুল ফাজেল মিয়া ইন্তেকাল করেন। উপার্জনক্ষম বড়পুত্র শহীদ হওয়ার পর ফাজেল মিয়া আরাে তীব্র অর্থকষ্টে পড়ে যান। কারণ কিশাের বয়সেই সালাম সংসারের অর্থ কষ্ট, অভাব-অনটন দেখে অর্থ উপার্জনে নেমে পড়েছিলেন। শহরে থেকে নিজের চলার মতাে টাকা রেখে তিনি সব টাকা গ্রামে পাঠাতেন বাবার কাছে মানি অর্ডার করে। বাবা ফাজেল মিয়া পুত্রের টাকায় কিছু সচ্ছলতার ঠিকানার সন্ধান না পেতেই ১৯৫২ সালে ভাষা শহীদের তালিকায় নাম লিখিয়ে বাবা ফাজেল মিয়ার চোখে অন্ধকার নামিয়ে দিলেন শহীদ সালাম।
১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংবিধানে স্থান পাওয়ার পর সেই সাল থেকেই পাকিস্তান সরকার পুত্রহারা ফাজেল মিয়ার জন্যে ভাতা হিসেবে মাসিক কিছু টাকা বরাদ্দ করে। কিন্তু সত্যি সেলুকাস, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই ভাতা প্রদান বন্ধ হয়ে যায়।
বাবা, মা, ভাই, বােন সালামের পরিবারের বর্তমানে কেউ জীবিত নেই। সবাই পরপারের বাসিন্দা হয়েছেন, সালামের সঙ্গে পরপারে মিলিত হয়েছেন।
আপনজনদের সাথে সুখে ঘুমাও সালাম, আমরা জেগে আছি বিশ কোটি বাঙালি বাংলাদেশী।
ভাষা শহীদ আবদুস সালামের শৈশব কেটেছে জন্মস্থান লক্ষ্মণপুর গ্রামেই। অভাবী সংসারের যথাযথ পুষ্টির অভাবে শৈশবে গা-গতরে খুব একটা নাদুস-নুদুস ছিলেন না। তার জেঠাতাে ভাই মাহমুদুর রহমানের বর্ণনা অনুযায়ী সালাম ছিলেন একহারা লম্বাটে গড়নের। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা।। | শৈশবে সালামের শিক্ষা জীবন শুরু হয় গ্রামের কৃষ্ণরামপুর প্রাইমারি স্কুলে। কত সালে সেটা ইতিহাসে আবদুস সালামের জীবনীতে পাওয়া যায় নাই। তবে মেধাবী ছাত্র হিসেবে স্কুলে পরিচিতি পান। পড়াশােনায় ভালাে। আচার ব্যবহারে নম্র ভদ্র। খেলাধুলায়ও আগ্রহী। সহপাঠী এবং শিক্ষকদের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেন।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে সালাম ভর্তি হন দাগনভূইয়া আতাতুর্ক হাই স্কুলে।
অভাব অনটনের সংসারে অতি কষ্টে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশােনা করেন। কিন্তু মেট্রিক পরীক্ষার ফরম ফিলাপের টাকা জোগাড় করতে না পারায় সালামের আর পরীক্ষা দেয়া হলাে না। পিতা আর ছেলের পড়াশােনা চালিয়ে নিতে পারলেন না। সালামের শিক্ষা জীবন শেষ হয়ে গেল এখানেই। মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও। বাবার বড় আফসােস ছিল গরিবের ঘরে জন্ম নেয়া এই মেধাবী সন্তানটির জন্যে। কিন্তু তিনি ছিলেন নিরুপায়।
লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার পর সংসারের অভাব অনটন ঘুচানাের জন্যে আবদুস সালাম গ্রাম ছেড়ে পাড়ি দেন কলকাতায়। কলকাতা বিশাল শহর, এই অল্প বিদ্যা নিয়ে কী করে খাবেন, থাকবেন এই বিশাল কলকাতায়। সৃষ্টিকর্তা সহায় হলেন। আর হলেন তাঁর এক ভগ্নীপতি। সেই ভগ্নীপতি আবদুল কাদেরের প্রচেষ্টায় আবদুস সালাম কলকাতায় একটি চাকরি পেয়ে যান। ভগ্নীপতি চাকরি করতেন কলকাতা বন্দরে। কলকাতায় সালাম ভগ্নীপতির সঙ্গে একত্রে বাস করতেন।
তবে যে স্বপ্ন নিয়ে সালাম কলকাতায় পাড়ি দিয়েছিলেন, তা সফল করার সুযােগ পাননি তিনি বেশি দিন। কারণ কলকাতাও তখন ছিল উত্তাল। একদিকে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার দামামা, অন্যদিকে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ব্রিটিশ খেদাও ভারত স্বাধীন কর। ফলে দেশ ভাগ সব মিলে কলকাতায় থাকা সম্ভব হলাে না। কলকাতার জীবনে বেশি দিন কাটাতে হলাে না। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পরপরই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে সালামকে চলে আসতে হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। গ্রামে ফিরে যান তিনি। আবার অনটন পরিবারকে ঘিরে ধরে। গ্রাম ছেড়ে চলে আসেন ঢাকায়। উদ্দেশ্য চাকরির সন্ধান। এবং অল্পদিনের মধ্যেই মিন্টো রােডে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান শিল্প দপ্তরে রেকর্ড কিপার পদে চাকরি পেয়ে যান।
সংসারে অভাব ঘােচানাের জন্য তিনি চাকরির বেতন পেয়েই বাবার কাছে টাকা পাঠানাে শুরু করেন। থাকেন ঢাকার আজিমপুর এলাকায় এক আত্মীয়ের সঙ্গে এক মেসে। তখন সেটা-নীলক্ষেত ব্যারাক নামে পরিচিত ছিল।
সালামের গ্রাম প্রতিবেশী নূর আহমদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে সালাম কয়েকদিনের ছুটিতে বাড়ি আসেন, ছুটি কাটিয়ে আবার কর্মস্থলে ফিরে আসেন মধ্য ফেব্রুয়ারিতে। এটাই সালামের শেষ ক্লাসে যাওয়া এবং পরিবারের একান্ত সান্নিধ্য কটা দিন কাটানাে। | ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা তখন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে উত্তাল।
২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র জনতা সরকারের ঘােষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের শপথে রাজপথে নেমে আসে। ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় মিটিং করে চলমান বাজেটে অধিবেশন অভিমুখে মিছিল নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের গেটের সামনে এসে মিছিলকারীরা পুলিশের বাধার সম্মুখীন হন। পুলিশ জনতা ছাত্র বেঁধে যায় সংঘর্ষ। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছােড়ে। ছাত্র জনতা পুলিশের উপর ইট-পাটকেল ছােড়ে। এক পর্যায়ে পুলিশ মিছিলে গুলি ছােড়ে। মেডিক্যালের পাশেই ছিল সালামের মেসবাড়ি। হয় সালাম পুলিশ জনতার লড়াই দেখতে রাস্তায় এসেছিলেন অথবা ছাত্র জনতার সাথে একাত্ম হয়ে ভাষার দাবিতে মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন।।
পুলিশের ছোড়া এলােপাথাড়ি গুলি এসে এফোড় ওফোড় করে দেয় আবদুস সালামকে। সালামের পিঠে গুলি লেগেছিল। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সালাম। মিছিলকারীরা ধরাধরি করে তাঁকে মেডিক্যালের বারান্দায় নিয়ে শােয়ায়। অনেক পরে তাকে চিকিৎসার জন্য ইমারজেন্সিতে নেয়া হয়। দীর্ঘ সময়ে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে সালামের অবস্থা এখন মুমূর্ষ।
পুলিশ পাহারায় তার চিকিৎসা চলে দীর্ঘ দেড় মাস। হাসপাতালে দেড়মাস মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ৭ এপ্রিল ১৯৫২ আবদুস সালাম শহিদী মৃত্যুবরণ করেন। অন্য ভাষা শহীদদের মতাে আবদুস সালামের লাশও পুলিশ সালামের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেনি। অবশ্য সালামের পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ লাশ নিতে আসেননি।
ঢাকায় আসার মতাে অবস্থা তাদের ছিল না আর সরকার বা আত্মীয়স্বজনের পক্ষ থেকে গ্রামে তাঁর পিতাকে সালাম গুলিতে আহত হয়েছে এ সংবাদও দেয়া হয়নি। তার কারণে ছেলের আহত হওয়ার কথা ফাজেল মিয়া দীর্ঘদিন জানতে পারেনি। | আজিমপুর মেসের এক বাসিন্দা কদিন পর একটি পােস্টকার্ডে সালামের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর দিয়ে একটি চিঠি পাঠান ফাজেল মিয়ার কাছে। কিন্তু সে পােস্টকার্ডের চিঠিও পান তিনি অনেক দেরিতে। চিঠি পেয়েই তিনি রওনা দিতে পারেনি। কারণ ঢাকা আসা যাওয়ার মতাে খরচের টাকা ছিল না ফাজেল মিয়ার কাছে। ছেলে আহত হওয়ার সংবাদ পেয়ে ২ আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা ধারদেনা করে ৮ এপ্রিল যখন তিনি ঢাকা পৌছালেন তখন সব শেষ। ছেলের লাশটিও দেখতে পেলেন না হতভাগ্য পিতা। আগের রাতেই পুলিশ আজিমপুর কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করেছে ভাষা শহীদ আবদুস সালামের নধর দেহ।
ক্ষতিপূরণ স্বরূপ পূর্বপাকিস্তান সরকার তাঁর পিতাকে নগদ দুই হাজার টাকা এবং দুই বান্ডিল ঢেউ টিন প্রদান করে ১৯৫৪ সালে।
১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখের দৈনিক ইত্তেফাকে একটি সংবাদ ছাপা হয় ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলীবর্ষণের ফলে নিহত জনাব রফিক, জনাব আবুল বরকত, জনাব আবদুল জব্বার এবং জনাব আবদুস সালামের পরিবারবর্গের জন্যে পূর্ব পাকিস্তান সরকার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ২ হাজার টাকা করিয়া সাহায্য মঞ্জুর করিয়াছেন বলিয়া জানা গিয়াছে। সূত্র : (ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা (সংকলন) বাংলা একাডেমি। ঢাকা-১৯৯১ পৃ: ১০৪-১০৫)
আজিমপুর কবরস্থানে শত শত কবরের মধ্যে কোনটি সালামের কবর তা সনাক্ত করা যায় না। সালামের কবরও সংরক্ষণ করা হয়নি। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ভাষা শহীদ সিরিজ গ্রন্থের তালিকায় ভাষা শহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থের তথ্যানুসারে ১৯৫২ সালে আজিমপুর কবরস্থানের একটি কবরের জায়গার দাম ছিল ১০১ টাকা। তৎকালীন ঢাকা পৌরসভা আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত শহীদ পরিবারদের চিঠি দিয়েছিল ১০১ টাকা জমির দাম পরিশােধ করলে তাঁদের কবর সংরক্ষণ করা হবে। যে সব শহীদ পরিবার কবরের জমির দাম পরিশােধ করেছিলেন, তাদের কবর সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় শহীদ রফিক ও শহীদ সালামের পরিবারের ১০১ টাকা দেবার সামর্থ্য ছিল না। এ দুজন ভাষা শহীদের কবর সংরক্ষণ করা হয়নি। রফিক আর সালাম লক্ষ শহীদের সাথে মিছে গেছে বাংলার মাটিতে। জাতির কাছে সালামের নিজস্ব কোনাে ছবি নেই। অভাবী সংসারে হুটহাট ছবি তােলার মতাে বিলাসিতা দেখাতে পারেন নাই। তাই তাঁর ছবি বেশি ছিল না। চাকরির প্রয়ােজনে হয়তাে দুবার দুটো ছবি তুলেছিলেন। তারই একটি করে কপি ছিল তার পিতার কাছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবীগণ ছবিগুলাে সালামের পিতার কাছ থেকে নিয়ে আসে সালাম এবং তার পরিবারকে আরাে কিছু পাইয়ে দেয়ার প্রলােভন দেখিয়ে কিন্তু তারা কিছুই করেননি। মাঝখান থেকে সালামের ছবি এবং তার পিতার কাছে অতিযত্নে রঞ্জিত রক্তমাখা শার্ট পাজামা খােয়া গেল। বর্তমানে সালামের যে ছবিটি আমরা দেখতে পাই তা প্রতীকী ছবি। ২০০০ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি ভাস্কর বাসার তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের কয়েকজন বিশিষ্ট শিল্পীকে দিয়ে সালামের ছবি ও একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। শিল্পগীণ সালামের ভাই বােনদের দেয়া বিবরণ, ছােট ভাই করিমের চেহারার সাথে মিল করে এবং তাদের বর্ণনা অনুসারে কয়েকটি ছবি আঁকেন। প্রতিকৃতি তৈরির পর ভাই বােনদের মতের সঙ্গে যে ছবিটির বেশি মিল সেটিকেই রেখে দেয়া হয় সালামের প্রতিকৃতি হিসেবে।
২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আবদুস সালামকে সরকারিভাবে মরণােত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
২০০০ সালেই স্থানীয়ভাবে গঠিত হয় ভাষাশহীদ আবদুস সালাম স্মৃতি পরিষদ। এই স্মৃতি পরিষদ সালামের স্মৃতি রক্ষার্থে বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাবে।
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম