ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতা ও ব্রিটিশ চাতুর্য
স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস তার লক্ষ্য নিয়ে আন্তরিক হলেও তার প্রস্তাবে ও তা বাস্তবায়নে ছিল অনেক জটিলতা। ক্রিপস প্রস্তাব গ্রহণ-বর্জনের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। রয়েছে একাধিক ব্যক্তির ক্ষমতাস্পৃহা ও অহবােধ, সেই সঙ্গে ব্যক্তিবিশেষের বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক উপলব্ধি ও ঘটনার ভুল মুল্যায়ন। ইংরেজ নায়কদের আপাতত একপাশে রেখে দেখা যাক দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন জাতীয় কংগ্রেস এবং তার সভাপতি মাওলানা আজাদ এ সম্বন্ধে কী বলেন । মাওলানা আজাদ ক্রিপস প্রস্তাব কেন গ্রহণযােগ্য নয় সে সম্বন্ধে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে যা বলেছেন তার মর্মার্থ হলাে প্রস্তাব যেভাবে উত্থাপিত তাতে দেশি প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কাউন্সিলের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা (ডিফেন্স) ব্যবস্থার ক্ষেত্রে। যুদ্ধাবস্থায় ভাইসরয় ও সেনাধ্যক্ষের প্রাধান্যই থাকবে কাউন্সিলের ওপর। এ ব্যবস্থা গ্রহণযােগ্য নয়। অন্যদিকে যুদ্ধশেষে ভারতের স্বাধীনতার কথা প্রস্তাবে বলা হয়েছে ঠিকই কিন্তু তাতে অনিশ্চয়তাও রয়েছে। আর প্রদেশগুলাের ফেডারেশনে যােগদান বিষয়ক স্বাধীনতা কংগ্রেস মেনে নিতে পারছে না। কারণ কংগ্রেস বরাবরই অখণ্ড, ঐক্যবদ্ধ ভারতের স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে এসেছে। দেশীয় রাজ্যগুলাে সম্বন্ধেও একই রকম আপত্তি কংগ্রেসের। কাজেই কংগ্রেস ক্রিপস প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারছে না। এ সম্বন্ধে মাওলানা আজাদের ব্যক্তিগত অভিমত হলাে প্রাথমিক অবস্থায় ক্রিপস প্রস্তাবের গ্রহণযােগ্যতা অনেকখানিই ছিল। কিন্তু আলােচনার শেষ। পর্যায়ে ক্রিপস সম্ভবত ভাইসরয় ও তার বশংবদ ব্যক্তিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তার পূর্বভূমিকা থেকে সরে গেছেন। তাছাড়া সরে যাওয়ার অন্য কারণ হতে পারে লন্ডন থেকে প্রাপ্ত নতুন কোনাে নির্দেশ। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের প্রশ্ন ওঠে। আসলে এটাই বড় কথা।
চার্চিলের পরবর্তী সময়ের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, তিনি ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন না। অ্যাটলি প্রমুখ উদারনৈতিক নেতা এবং মূলত মার্কিন প্রেসিডেন্টের চাপের মুখে তিনি সমঝােতার প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন। অবশ্য ব্রিটিশ উপনিবেশের সূর্যাস্তকাল যে তখন আসন্ন সে সত্য তার মতাে বিচক্ষণ রাজনীতিকের না বােঝার কথা নয়। তবু কি কেউ স্বেচ্ছায় নিজের সংসার ভাঙতে চায়? কিন্তু ৭ই মার্চ (১৯৪২) জাপানিরা রেঙ্গুন দখল করে নেয়ার পর বার্মা থেকে একদিকে শ্বেতাঙ্গ সৈন্য, অন্যদিকে বাদামি রং সেনা, এছাড়া অসংখ্য ভারতীয় বাস্তুত্যাগী বেসামরিক মানুষের কাফেলা এক অবিশ্বাস্য করুণ কাহিনী তৈরি করেছিল। সব কিছু মিলেই হয়তাে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্রিপসকে ভারতে পাঠানাে । এবং ক্রিপসের ব্যর্থতায় চার্চিলের ইচ্ছাপূরণ । কিন্তু প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে এতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে, ক্রিপস দৌত্যের ব্যর্থতা তিনি মেনে নিতে পারেননি। নিয়তিতাড়িত ১০ এপ্রিলের (১৯৪২) দিনটিতে যখন কংগ্রেস ক্রিপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের ঘােষণা দেয় এবং ১১ এপ্রিল চার্চিল প্রেসিডেন্ট রজভেল্টকে সে সংবাদ জানিয়ে দেন তখনও আশা ছাড়েননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তিনি তক্ষুনি চার্চিলকে এই বলে পাল্টা তারবার্তা পাঠান যে, ক্রিস আরাে কটা দিন ভারতে অবস্থান করুন, আরেকবার শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক। জবাবে সম্ভবত হাসি চেপে রেখে প্রধানমন্ত্রী চার্চিল মার্কিন প্রেসিডেন্টকে জানান ক্রিপস ইতিমধ্যে লন্ডনের পথে ভারত ত্যাগ করেছেন। তাই নতুন করে আলােচনার কোনাে সুযােগ নেই।
কিন্তু কেন এ অবস্থা? কাদের চালে সব সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেল? কংগ্রেস সভাপতি তাে কিছুটা আশাবাদীই ছিলেন? কিন্তু গান্ধি? তার বরাবরই এমন বিশ্বাস দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধপরিস্থিতি পর্যালােচনা করে যে, ইংরেজের পরাজয় নিশ্চিত। তাহলে কেন পরাজিতদের সঙ্গে সমঝােতা আলােচনা? একমাত্র স্বাধীনতা ঘােষণার বিনিময়ে বিশ্বযুদ্ধে যােগদান সম্ভব। এ দুই ভাবনার মধ্যবিন্দুতে নেহরু- কিন্তু পেন্ডুলামের মতাে একবার এ প্রান্ত, পরক্ষণে অপর প্রান্ত ছুঁয়ে যাচ্ছেন। কী ঘটেছে পর্দার আড়ালে যে বারবার স্যার ক্রিপসকে প্রস্তাবের শর্তগুলাের অদল-বদল করতে হচ্ছে। কখনাে তাতে কংগ্রেসের আধা-সম্মতি, কখনাে অসম্মতি। সেই নাটকের কুশীলবদের একজন তাে রিফর্মস কমিশনার হডসন। তার বিবরণের মর্মার্থ থেকে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে, প্রথম থেকেই ভাইরসয় লিনলিথগাে সমঝােতা প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন না। তার ইচ্ছা ছিল না ভারত ক্রিপসের মাধ্যমে কোনাে রকম রাজনৈতিক সুযােগ-সুবিধা পাক। হয়তাে তাই সর্বশেষ সংশােধিত প্রস্তাবও গ্রহণযােগ্য মনে করেননি ভাইসরয় এবং ব্রিটিশ সরকার ভাইসরয়ের মতামতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। এ অবস্থায় ক্রিপস দৌত্য ব্যর্থ হতে বাধ্য। | ক্রিপস খুব আশা নিয়ে খুশিমনে ভারতে এসেছিলেন। পূর্ব সফরের অভিজ্ঞতা থেকে তার মনে হয়েছিল ভারতীয় রাজনীতিকদের তিনি সমঝােতার বৃত্তে নিয়ে আসতে পারবেন। সম্ভবত সেই আত্মবিশ্বাস থেকে এবং তার পেছনে ব্রিটিশরাজ তথা মন্ত্রিসভার সমর্থন রয়েছে ধরে নিয়ে স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ভাইসরয়কে তার করণীয় বিষয় সম্পর্কে আলােচনায় হয়তাে ততটা গুরুত্ব দেননি যতটা ভাইসরয় প্রয়ােজন মনে করেছেন। কিন্তু ভাইসরয় তাে ভুলতে পারেন না যে তিনি ভারতের হর্তাকর্তা বিধাতা ।
তিনি ভাইসরয় । তার মাধ্যমেই সব কিছু ঘটবে। এর মধ্যে গােল বাধায় প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের দূত জনসনের অনধিকার প্রবেশ। অনধিকার এ জন্য যে ক্রিপস প্রস্তাবের আলােচনায় তার অংশগ্রহণের কোনাে বৈধতা ছিল না। যেহেতু বিষয়টাতে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের বিশেষ আগ্রহ ছিল হয়তাে তাই স্যার ক্রিপস কর্নেল জনসনকে দূরে ঠেলে দিতে পারেননি। বিশেষ করে যখন বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা মিত্রশক্তির সহায়ক বড়তরফ। কিন্তু বড়তরফ হলে কী হবে? ব্রিটিশ রাজমহিমার আভিজাত্যবােধ আলাদা। রাজসিংহাসন-মনােনীত লর্ড-ব্যারনদের মতাে অভিজাতকুলের সদস্যগণই সাধারণত ভারতশাসক (ভাইসরয়-গভর্নর জেনারেল) হয়ে থাকেন। স্বভাবতই ঘটনাক্রমে ভাইসরয় লিনলিথগাের আঁতে ঘা লাগার কথা। সেখানে আবার সমর্থন জানাচ্ছেন আরেক লর্ড, যদিও পরাজিত পিছুহটা সেনাপতি, ওয়াভেল। আরাে চমৎকার যে বিষয়টি নিয়ে ভাইসরয় আলাপ করেছেন এমন একজনের সঙ্গে যিনি লর্ড, ব্যারন বা শাসকশ্রেণীর শীর্ষসদস্য নন, তিনি একজন আমলা অর্থাৎ রিফর্মস কমিশনার। ভাইসরয়ের প্রচ্ছন্ন মনােবেদনা বুঝতে হডসনের অসুবিধা হয়নি। বরং বড়লাটের একান্তজন হওয়ার সুবাদে তার। জানতে বাকি থাকেনি যে ক্রিপস প্রস্তাবের বাহারি বেলুন ফুটো হওয়ার পেছনে চক্রান্তে ছিল ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগাের হাত। তাতে হাওয়া জুগিয়েছিলেন দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের সেনাপতি লর্ড ওয়াভেল। ব্রিটিশ রাজশাসনের পেছনে বণিকগােষ্ঠীর যত অবদানই থাকুক বিশেষ করে ভারত জয়ের ক্ষেত্রে, সিংহাসনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অধিকাংশই ছিলেন। রাজপুরুষ । তাই রাজআভিজাত্য, রাজমহিমা তাদের শাসন পরিচালনায় অংশ হয়ে থেকেছে। পরবর্তীকালে কমন্সসভা তথা জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে দেশশাসন নয়, দেশ পরিচালনা করেছেন। মূল শাসক ওই রাজপুরুষ লর্ড, ব্যারনগণই। লর্ড সভার প্রচ্ছন্ন ক্ষমতা নেহাৎ কম। ছিল না। বিশেষ করে উপনিবেশ শাসনের ক্ষেত্রে। তাই কূটনীতির চালে ভুল করেছিলেন স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস রাজপুরুষকে যথাযােগ্য মর্যাদা না দিয়ে। তাই চালে মাত হয়ে গেলেন তিনি। কূটনীতির রাজনীতিতে পরাজিত হয়ে ব্যর্থতার গ্লানি মাথায় নিয়ে দিল্লি থেকে লন্ডন ফিরে গেলেন সম্ভাব্য পরবর্তী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস। এ যাত্রা সফল হলে তার মাথায় পরবর্তী প্রধানমন্ত্রিত্বের ‘তাজ’ শােভা পেতেও পারত।
কারণ জনমত যাচাইয়ে দেখা গেছে কথিত লৌহমানব চার্চিলের প্রধানমস্ত্রিত্বে (রক্ষণশীল টোরি দলের নেতা) বিশ্বযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধশেষে শ্রমিক দলই (লেবার পার্টি) জনসমর্থন আদায় করে নেয়, রক্ষণশীল দল নয়। এবং পূর্বোক্ত সিনিয়র নেতা ক্লেমেন্ট অ্যাটলি হন প্রধানমন্ত্রী। যদিও এসব পরের কথা তবু প্রাসঙ্গিকতার সূত্রে বলি যুদ্ধশেষে টালমাটাল ভারতীয় রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে যখন একই উদ্দেশ্যে গঠিত ‘কেবিনেট মিশন’ ১৯৪৬এর মার্চে দিল্লিতে আসে সেই মিশনের তিন সদস্যের একজন (অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি) ছিলেন স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিস । তিনি তখন অ্যাটলি মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। কেবিনেট মিশনের এক নম্বর ব্যক্তি অবশ্য সঙ্গতকারণেই হন বিদেশ সচিব লর্ড পেথিক লরেন্স। | সব বিবরণ বিবেচনায় যেকোনাে নিরপেক্ষ ইতিহাস পাঠকের মনে হবে ক্রিপস সমঝােতা প্রস্তাব ব্যর্থ করার উদ্দেশ্যে চক্রান্ত করেন ভাইসরয় লিনলিথগাে লর্ড ওয়াভেলের সমর্থন নিয়ে। তার বিরােধিতা স্বচ্ছ হলে মিশনপ্রধান ক্রিপসের অজ্ঞাতে অর্থাৎ গােপনে তার আপত্তি জোরালাে ভাষায় জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের কাছে তারবার্তা পাঠাতেন না। এবং চার্চিলেরও এমন পরিণাম আকাক্ষিত ছিল বলে ক্রিপসের সঙ্গে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে কোনাে রকম আলােচনা না করেই তাকে দ্রুত দিল্লি ত্যাগের নির্দেশ দেন তিনি। দ্বিতীয় চিন্তা না করে ভাইসরয়ের মতে মত মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নেন। এসবের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা ও কমন্সসভার উদারপন্থীদের একহাত নেয়া । ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব নিয়ে অধিকাংশ সময় চুপচাপই ছিল জিন্না-মুসলিম লীগ। জিন্না ঘটনাস্রোত পর্যবেক্ষণে মনোেযােগী ছিলেন। প্রস্তাবে প্রদেশগুলাের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ঘােষণা করা হলেও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ আসাম (যদিও সিলেট জেলা এককভাবে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ) এক সমস্যা এবং ফজলুল হকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ বিভক্ত ও দুর্বল বলেই বােধহয় দ্বিতীয় বিবেচনায় জিন্না ক্রিপস প্রস্তাব শেষ মুহূর্তে প্রত্যাখ্যান করেন। লিনলিথগাে শাসনের সঙ্গে একাত্ম এবং রাজশক্তির প্রতি সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেয়া জিন্নার ওই প্রত্যাখ্যানে ছিল রাজনৈতিক কূটচাতুর্য । তার পদক্ষেপে সম্ভবত অখুশি হননি ভাইসরয় । জিন্নার উদ্দেশ্য ছিল আসাম বাংলা মিলে পাকিস্তান। কিন্তু কংগ্রেসের ক্রিপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পেছনে ছিল একাধিক স্ববিরােধী কারণ। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মতামতও ছিল দ্বিভাজিত। নেহরু, আজাদ, রাজাগােপালাচারি প্রমুখ অনেকেই প্রস্তাব গ্রহণের পক্ষে ছিলেন। মাদ্রাজের বিশিষ্ট নেতা রাজাগােপালাচারি প্রয়ােজনে নীতি হিসেবে ভারত বিভাগ মেনে নিয়েও মুসলিম লীগের সঙ্গে সমঝােতার প্রবক্তা ছিলেন।
তিনি ক্রিপস প্রস্তাববিষয়ক কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির গৃহীত সিদ্ধান্ত সঠিক বলে মনে করেননি। তিনি এ যুদ্ধে মিত্রশক্তিকে সমর্থনের পক্ষে ছিলেন। | মদ্রাজের এ প্রবীণ নেতা মাদ্রাজ কংগ্রেসের বিধায়কদের এক সভা ডেকে তার বক্তব্য তুলে ধরেন এবং পূর্বে উদ্ধৃত তার মতামতনির্ভর সিদ্ধান্ত কংগ্রেস কমিটিতে পাঠিয়ে দেন (২৩ এপ্রিল, ১৯৪২ সেসব মতামত ২৯ এপ্রিল নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির এলাহাবাদ অধিবেশনে বাতিল হয়ে যায় । প্রতিবাদে রাজাজি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। শুধু তাই নয়, মাদ্রাজ বিধানসভার সাত জন অনুসারীসহ ওই বিধানসভার সদস্য পদ থেকেও অব্যাহতি নেন। এরপর প্রচার করতে থাকেন তার নিজস্ব মতামত। যে জন্য তিনি নিন্দিত হন পাকিস্তানপন্থী হিসেবে। এ ঘটনা তখন খুবই আলােড়ন তােলে এবং দৈনিকগুলােতেও এ বিষয়ে লেখালেখি চলে । বেশ মনে আছে ওই সময় ক্রিপস প্রস্তাব গ্রহণ-বর্জনের চুলচেরা বিশ্লেষণ না করেই দেশের স্বাধীনতাপন্থীরা রাজাজির সমালােচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। সেই ঢেউ দিল্লিকলকাতা হয়ে দূর মহকুমা শহরকেও স্পর্শ করে। প্রশ্ন উঠতে পারে, ভারতবর্ষকে সত্যকার অর্থে স্বশাসনের অধিকার দেয়ার। জন্যই কি স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে ভারতে পাঠানাে হয়েছিল? প্রশ্নের উত্তর হ্যা’ এবং না’ দুই-ই। কারণ তৎকালীন যুদ্ধমন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের অনিচ্ছা। সত্ত্বেও প্রভাবশালী সদস্য ও শ্রমিক দলের নেতা অ্যাটলিসহ একাধিক উদারপন্থী রাজনৈতিক নেতা যুদ্ধ-পরিস্থিতি ও ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতা লক্ষ্য করে মূলত যুদ্ধে ভারতীয় সহযােগিতা লাভের জন্য ভারতকে রাজনৈতিক সুবিধাদানের সিদ্ধান্ত নেন। তারা মন্ত্রিসভাকে বােঝাতে সমর্থ হন যে বিরাজমান পরিস্থিতিতে ব্রিটেনের স্বার্থে এ ব্যবস্থাই সর্বোত্তম পন্থা । তদুপরি ভারতের শাসনের জন্য মন্ত্রিসভার ওপর যথেষ্ট চাপ ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের।
এখানে আরাে একটি প্রশ্ন উঠে আসে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওই প্রচেষ্টা কি একেবারেই নিঃস্বার্থ ছিল? আমার ধারণা বিশাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভঙ্গুর অবস্থায় সদ্যজাগ্রত মার্কিন রাজনৈতিক শক্তি তার গণতন্ত্রী ভাবমূর্তি বিশ্বের সামনে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে ভারতপন্থী ভূমিকা নিয়েছিল। ইচ্ছা, একটি আদর্শগত উদাহরণ তৈরি। তবে কেউ কেউ মনে করেন জীর্ণ, ভগ্নদশা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্থান ভিন্নভাবে দখল করা এবং এশিয়া-আফ্রিকা মহাদেশে আপন প্রভুত্ব স্থাপনের লক্ষ্য নিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ আপাত-গণতান্ত্রিক চিন্তার পদক্ষেপ । এমন ধারণা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাদের মূল উদ্দেশ্য বিশ্বউপনিবেশে ও অন্যত্র মার্কিন পণ্যের জন্য বাজার দখল এবং সেই সঙ্গে নতুনরূপে বিশ্ব রাষ্ট্রসভায় নেতৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করা। আরাে স্পষ্টভাষায় ব্রিটিশ উপনিবেশগুলােতে অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তার এবং তা সরাসরি পুরনাে উপনিবেশবাদী পন্থায় নয়। মার্কিন রাজনৈতিক প্রশাসন ও শিল্পপতিদের স্বপ্ন : ইংরেজ কয়েক শতক ধরে উপনিবেশের রস আস্বাদন করেছে। এবারের শতক নয়া সামরিক শক্তি আমেরিকার । বিশ্বযুদ্ধ তাদের জন্য এ সুফল বয়ে এনেছে। বাস্তবিক তাদের স্বপ্ন যেসত্য হয়েছে তার প্রমাণ এখন বিশ্ববাসীর চোখের সামনে। এবার পূর্বোক্ত প্রশ্নের জবাবে বলা যায় অ্যাটলি, ক্রিপসসহ শ্রমিক দলীয় নেতাদের পাঠানাে প্রস্তাবের পেছনে সদিচ্ছার অভাব হয়তাে ছিল না। প্রমাণ ১৯৪৬-এ আবার কেবিনেট মিনা পাঠানাে এবং তাদের ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাটলি মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তক্রমে ১৯৪৭-এর আগস্টে ব্রিটিশরাজের ভারত ত্যাগ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী চার্চিল, ভারতীয় ভাইসরয় লিনলিথগাে ও শ্বেতাঙ্গ আমলাদের কূটবুদ্ধি মূলত ক্রিপস দৌত্য ব্যর্থ হবার কারণ । অবশ্য এতে ভারতীয় রাজনীতিকদেরও কিছুটা ভূমিকা ছিল। তবে বিদায় নেয়ার আগে ভারতবর্ষকে দুভাগ করার ব্রিটিশ রাজনীতির চাতুরী যে,ইংরেজের চিরাচরিত বেনিয়া বুদ্ধিজাত সে বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক