You dont have javascript enabled! Please enable it!

ক্রিপস প্রস্তাব নিয়ে নানা টানাপড়েন

সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার একটি ছত্র, এখানে অবশ্য ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত : সময় হয়েছে নতুন খবর আনার’। ব্রিটেন-ভারতের দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিরসনে সমঝােতার নয়া বার্তা নিয়ে ভারতে এসে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলােচনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন উদারপন্থী রাজনীতিবিদ স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস। ভারতীয় রাজনীতিকদের জন্য এই প্রথম ব্রিটিশরাজ-এর তরফ থেকে নতুন বার্তা নিয়ে দিল্লি আসেন তাদের প্রতিনিধি স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস । সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের রাজশক্তি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিপ্লবী তৎপরতা শক্ত হাতে, ডাণ্ডা হাতে ঠাণ্ডা করেছে। গুলি, ফাসি, জেল-জুলুমনির্যাতন কিংবা আন্দামান কিছুই বাদ যায়নি ভারত দখলের একশ বছরের মাথায় যে বিদ্রোহ তা নৃশংস বর্বরতায় দমন করা হয়। তাতে ছিল প্রতিহিংসার প্রকাশ। পরবর্তী ৯০ বছরের লড়াই ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে ১৯৩০-৩১ সময়-পর্বের বিপ্লবী সংগ্রাম। বেশ চলেছে তাদের বিভাজন নীতি, সম্প্রদায়গত বিভাজনের চতুর খেলা। * কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝড়াে হাওয়া উপনিবেশ শাসনের নিশ্চিন্ত আরাম হারাম করে দেয়। ইউরােপে জার্মান-ঝড়ের পর এশিয়ায় তথা ভারত মহাসাগরে জাপানি পীতবােমার হঠাৎ হামলা। পদ্ধতি জার্মান ‘রিৎসক্ৰিগের মতােই। পাখিদের মতাে ঝাকবেঁধে হামলা। পার্ল হার্বার ঘাঁটি ধ্বংসের দুমাস পর আবার হঠাৎ জাপানি আক্রমণ- সিঙ্গাপুর ও বার্মার যথাক্রমে পতন ১৫ ফেব্রুয়ারি (১৯৪২) ও ৭ মার্চ (১৯৪২)। ব্রিটিশ বাহিনীর বিপর্যস্ত পরাজয়ের কালাে ছায়া পূর্ব ভারতের আকাশে। এ অবস্থায় পীত আগ্রাসন থেকে ভারতবর্ষকে রক্ষা করতে এবং সেখানকার রাজনৈতিক, অস্থিরতা প্রশমনে নতুন করে ভারত-নীতি প্রণয়নের প্রয়ােজন পড়ে। প্রয়ােজন ভারতের নানামাত্রিক সহায়তা। যুদ্ধ মােকাবেলায় ব্রিটেনে তখন সর্বদলীয় যুদ্ধমন্ত্রিসভা ক্ষমতাসীন। প্রধানমন্ত্রী চার্চিল রক্ষণশীল রাজনীতির হলেও পার্লামেন্টে উদারপন্থীদের প্রাধান্য। তারা ভারত সম্বন্ধে কিছুটা নমনীয় । হয়তাে তাদের মাথায় সংস্কৃত শ্লোকের নীতিকথার মতাে চিন্তা কাজ করেছে যে সর্বনাশের মুখে অর্ধেক পরিত্যাগ বিচক্ষণতার পরিচায়ক। অর্থাৎ আলােচনা ও সমঝােতার মাধ্যমে ভারতকে ডােমিনিয়ন মর্যাদা দিয়েও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থরক্ষা সম্ভব ।

নিদেনপক্ষে ভবিষ্যতে স্বাধীনতার ছাড়পত্র দিতে হলে কমনওয়েলথ’-এর গােয়ালে ধরে রাখা। এ উপলক্ষে মন্ত্রিসভার প্রথম পরিকল্পনায় পেরেক ঠোকেন ভাইসরয় লিনলিথগাে । ভাইসরয়ের আপত্তির মুখে অ্যাটলি সাহেবের সভাপতিত্বে নতুন কমিটির তৈরি খসড়া প্রস্তাব কিছুটা বাস্তববাচিত হলেও ধােপে টেকেনি। ইতিমধ্যে এসেছে ভাইসরয়েরও একটি বিকল্প প্রস্তাব। কিন্তু ওই যে বলে, ব্যাটে-বলে হচ্ছে না। ভাইসরয় এবং মন্ত্রীমণ্ডলের মতের মিল হচ্ছে না । ভাইসরয়ের গুরুত্ব এক্ষেত্রে অধিক এ কারণে যে সমঝােতা প্রস্তাব গৃহীত হলে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব ভাইসরয়ের। তাই তাকে ঝেড়ে ফেলা যাচ্ছে না। আমার বিশ্বাস লিনলিথগাে এ সুযােগটাই নিচ্ছিলেন। ভারতীয় স্বশাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি।  এ তাত্ত্বিক অচলাবস্থা দূর করতে শেষ পর্যন্ত স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপসকে পরিত্রাতার ভূমিকায় নামতে হয়। বিশেষ করে ভারত সম্বন্ধে তার পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে। তিনি ভারতবান্ধব হিসেবে পরিচিত। বিশ্বযুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পর তার বেসরকারি ভারত সফর, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলােচনা বিশেষ করে যুদ্ধে ভারতের সহযােগিতা সম্পর্কে। ওই সফরে মাওলানা আজাদ তাকে বলেছিলেন, ‘সবই নির্ভর করছে ব্রিটিশরাজের সদিচ্ছার ওপর।  এরপর স্টাফোর্ড ক্রিপস মস্কোতে যান ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত হয়ে। তার দৌত্যে মস্কো-লন্ডন সম্পর্কে উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। মাওলানা আজাদের মতে, এ সময় কূটনীতিক হিসেবে তার সাফল্য নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রশংসা তার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে নতুন মাত্রা যােগ করে। দেশে ফিরে যুদ্ধ-মন্ত্রিসভায় যােগ দেন, নির্বাচিত হন কমন্স সভায় দলনেতা। সংবাদপত্র ও রাজনৈতিক মহলের চাপা আলােচনার মধ্যমণি স্যার ক্রিপসের মাথায় ব্যর্থতার বােঝা চাপিয়ে তার রাজনৈতিক জীবনে ধস নামাতেই কি চার্চিলের কূটবুদ্ধি স্যার ক্রিপসকে ভারত মিশনে পাঠাতে বেছে নেয়? হতে পারে।

দিল্লি সফরকালে স্যার ক্রিপস কথা প্রসঙ্গে হডসনকে জানান, তিনি প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ‘ভারতীয় সমস্যার সমাধান অবশ্যই করতে হবে। আমার বিশ্বাস, ভারতের স্বশাসন সম্বন্ধে ঘরে-বাইরে চাপের কারণে বিরক্ত চার্চিল হয়তাে ভারত সম্পর্কে অতিউৎসাহী ক্রিপসের  রাজনৈতিক ডানা হেঁটে ফেলতে ও এক ঢিলে দুই পাখি মারতে তাকে সমঝােতা প্রস্তাব দিয়ে ভারতে পাঠান যা ‘ক্রিপস প্রস্তাব’ নামে রাজনৈতিক ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। চার্চিলের জানা ছিল ভারতে হিন্দু-মুসলমান ও লীগ-কংগ্রেসের দ্বন্দ্ব এবং সাম্প্রদায়িকতার পাথুরে দেয়াল এত শক্ত যে তা ভেঙে রাজনৈতিক সমঝােতায় পৌছানাে ক্রিপস কেন, কারাে পক্ষেই সহজ নয়। তদুপরি রয়েছে ভাইসরয়ের এ বিষয়ে ভিন্নমত । কাজটা তার জন্য কঠিনই হবে, অসম্ভবও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ক্রিপসের ব্যর্থতা তার জনপ্রিয়তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য। ঘটনার তেমন পরিণামই ইতিহাসে লেখা রয়েছে। এ নাটকের নায়ক প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ও ভাইসরয় লিনলিথগাে। আর পরােক্ষে গান্ধি-জিন্না অর্থাৎ লীগ-কংগ্রেস দ্বন্দ্ব। | প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ১১ মার্চ (১৯৪২) কমন্সসভায় জানান, স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপসকে ভারতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য দিল্লিতে পাঠানাে হচ্ছে। নীতি হিসেবে তিনি ঘুরে-ফিরে ভাইসরয়ের আগস্ট (১৯৪০) প্রস্তাবের গুরুত্ব উল্লেখ করেন যা প্রধান ভারতীয় রাজনৈতিক দূলুগুলাে গ্রহণ করেনি। এমন একটি প্রস্তাব নিয়ে ক্রিপস ভারতে আসেন যা একদিকে কাটলেও অন্যদিকে কাটবে। তদুপরি ভারতের শাসকগােষ্ঠীতে ছিল একাধিক প্রতিকূল স্রোত যা ক্রিপসদৌত্য ব্যর্থ করার পক্ষে যথেষ্ট শক্তিমান। | এইচ ভি হডসন তখন ভারতে রিফর্মস কমিশনার। ভাইসরয় লিনলিথগাের সঙ্গে বেশ দহরম-মহরম। অনেক সময় বড় সাহেবের রাজনৈতিক পরিকল্পনার শাব্দিক রূপ তৈরি করে দেন চৌকস লেখনীতে। এভাবে হয়ে ওঠেন বড়লাটের কাছের মানুষ । কাজেই রাজনীতির হাঁড়ির খবর তার জানা। তার জবানিতে জানা যায়, ব্রিটিশ কেবিনেটের নমনীয় সিদ্ধান্ত পছন্দসই ছিল না বড়লাট লিনলিথগোের। আবার তার সঙ্গে সহমত পােষণ করেন দক্ষিণ এশীয় যুদ্ধে পিছুহটা ব্রিটিশ বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপতি লর্ড ওয়াভেল।

ভারতে ব্রিটিশ শাসনদণ্ডের দুই প্রধান ব্যক্তির সঙ্গে ব্রিটিশরাজের ভারত নিয়ে ভাবনায় প্রচ্ছন্ন মতানৈক্য যে স্টাফোর্ড ক্রিপসের ভারত-পরিকল্পনার ওপর বিরূপ ছায়া ফেলবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যতই তাদের মতামত অগ্রাহ্য করে ক্রিপস তার নিজস্ব চিন্তা এবং ব্রিটিশ উদারনীতিকদের মনােভাবের প্রকাশ ঘটান না কেন তার ভারত বিষয়ক রাজনৈতিক প্রস্তাবে।  ভারতের রাজনৈতিক আবহাওয়ায় তখন অস্থিরতা বিরাজ করছে। সে অস্থিরতার অবসান ঘটাতেই ক্রিপস পরিকল্পনা। যুদ্ধ পরিস্থিতির অনুধাবনে ব্রিটিশরাজের ইচ্ছা ভারতকে যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট করা, ভারত থেকে সৈন্য সংগ্রহ করা এবং যুদ্ধের পক্ষে প্রয়ােজনীয় সুযােগ-সুবিধা নেয়া। পরিবর্তে ভারতকে রাজনৈতিক সুবিধাদান। কিন্তু লীগ-কংগ্রেস অনৈক্য এবং ঝানু ব্রিটিশ আমলাদের অনিচ্ছা ক্রিপসের সাফল্যে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বড় বাধা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ও ভারতীয় ভাইসরয় লিনলিথগো । দুজনই নাটের গুরু। তাই ১৪ মার্চ হডসনের এক প্রশ্নের জবাবে ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগাে স্পষ্টই বলেন, “ব্রিটিশরাজের নীতি বাস্তবায়ন ক্রিপসের পক্ষে সম্ভব হবে না।’ তার অনেক তির্যক কথার মর্মার্থ থেকে বুঝতে পারা যায়, ভারতীয় শ্বেতাঙ্গ শাসক ও আমলাগগাষ্ঠী তাদের প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা নিয়ে ক্রিপসকে সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিল না। হােক না তা রাজাদেশ বা রাজপরিকল্পনা। তাই ক্রিপসের রাজনৈতিক দেনদরবারের প্রক্রিয়া থেকে কূট চাতুর্যে নিজেদের সরিয়ে রেখেছিলেন ভাইসরয়। অবশ্যই তার পার্ষদগণ ছিলেন একই পথের যাত্রী। লিনলিথগাে বিষয়টাকে যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়েছিলেন তা বােঝা যায় হডসনকে বলা আরাে কিছু কথায়। তার মতে ক্রিপসের উচ্চাশা ভবিষ্যতে ভারতের ভাইসরয় বা ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়া। কিন্তু ভাইসরয় হওয়ার পথ তাে এটা নয়। আর প্রধানমন্ত্রী? কোনো বিচক্ষণ রাজনীতিক কি ব্যর্থতার ঝুঁকি নিয়ে এমন কাজে হাত লাগাবে এবং পাঠক ভেবে দেখতে পারেন ক্রিপস প্রস্তাব নিয়ে সাতসাগরের এপারে ওপারে কত বিচিত্র স্রোত উপস্থিত ছিল। তাই ক্রিপসের সেসব স্রোতে হাবুডুবু খাওয়াই স্বাভাবিক।

ক্রিপস তার প্রস্তাব নিয়ে দিল্লিতে আসেন ১৯৪২ সালের ২৩ মার্চ। এরপর কত যে আলােচনা বিভিন্ন দলের সঙ্গে, নিজেদের মধ্যে আর টাইপরাইটারের ক্রমাগত খটাখট, পাতার পর পাতা বদল! আজাদ, নেহরু, গান্ধি, জিন্নার সঙ্গে পালাক্রমে একাধিকবার সাক্ষাৎকার আর পরিকল্পনায় কাটছাট ও যােগবিয়ােগ । স্বভাবতই ক্রিপসের জন্য এ দৌত্য ছিল নানা স্রোতের টানে নাকানি-চুবানি খাওয়ার শামিল। বাস্তবে তাই ঘটেছে। তবে এ ক্ষেত্রে হডসনের একটি মন্তব্য খুবই যুক্তিনিষ্ঠ যে ভারতীয় রাজনীতির মূলে রয়েছে দুটো উপাদান। কংগ্রেসের অনমনীয় লক্ষ্য অবিলম্বে ক্ষমতা হাতে পাওয়া আর মুসলিম লীগের দাবি সমান ক্ষমতার অধিকার ও ভবিষ্যতে ক্ষমতার টানাপড়েনে ভেটো দেয়ার অধিকার। এমন এক জটিল পরিস্থিতিতে ভাইসরয় লিনলিথগাের উদ্দেশ্য ছিল এ টানাপড়েনের সুযােগ নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে রাজনৈতিক খেলা চালু রাখা, যাতে  প্রদত্ত কাঠামাের বাইরে তাদের যেতে না হয়। কিন্তু হডসনের ভাষায় লন্ডনস্থ মন্ত্রীদের ভাবনা ছিল ভিন্নরকম । বিস্তারিত বিবরণে না গিয়ে হডসনের জবানিতে বলা যায় যে, ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার পরিকল্পনার সঙ্গে লিনলিথগাে ওয়াভেলের ভাবনাগত মিল ছিল না নানা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে এবং লিনলিথগাে হডসনকে দিয়ে পাল্টা পরিকল্পনা তৈরি করে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন যাতে ক্রিপস খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে পৌছাতে না পারেন। এর মধ্যে আবার ঘটে মার্কিনি অনুপ্রবেশ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট চার্চিলের ওপর ক্রমাগত চাপ দিতে থাকেন। যাতে ব্রিটিশসিংহ ভারত থেকে তাদের থাবা গুটিয়ে নেয় এবং কংগ্রেসের ভিন্নমতের নেতারা ভারতীয় শাসকগােষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধবিষয়ক সমঝােতায় পৌছাতে ইচ্ছুক হয়ে ওঠেন। উল্লেখ্য যে নেহরু ও রাজাগােপালাচারি এবং শর্তসাপেক্ষে মাওলানা আজাদ প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন। শর্ত হচ্ছে যুদ্ধশেষে তাদের দাবি মেনে নেয়া। | পরিস্থিতি সে ক্ষেত্রে এমনই দাঁড়ায় যে নেহরু ক্রিপস প্রস্তাবের পক্ষে, এমনকি জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ শুরু করারও পক্ষে।

ইতিপূর্বে দেখা গেছে তার সুভাষবিরােধী ভূমিকা । ধীরন্ধুির রাজাগােপালাচারি প্রস্তাবের পক্ষে, আজাদের কথা ইতিমধ্যে বলা হয়েছে। অন্যদিকে গান্ধি-প্যাটেল, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, কৃপালনিসহ গান্ধিপন্থীরা ক্রিপস প্রস্তাবের বিরুদ্ধে। কিন্তু কেন? কারণ গান্ধির দৃঢ় ধারণা জন্মেছিব যে, এ যুদ্ধে মিত্রশক্তির পরাজয় নিশ্চিত। কাজেই সম্ভাব্য পরাজিত শক্তির সঙ্গে সমঝােতা আলােচনা অর্থহীন। গান্ধির ভাষায় ক্রিপস প্রস্তাব প্রকৃতপক্ষে একটি দেউলিয়া ব্যাংকের ওপর দেয়া ‘পােস্টডেটেড চেক’ বৈ কিছু নয়” । এমন ধারণার প্রধান কারণ জাপানি বাহিনীর ক্রমান্বয় অগ্রযাত্রা ও ব্রিটিশ বাহিনীর ক্রমাগত পিছু হটা। কাজেই গান্ধি ও তার সমর্থকরা ক্রিপস প্রস্তাব মেনে নিতে আগ্রহী ছিলেন না। তারা নিশ্চিত যে ব্রিটিশ বাহিনীর পরাজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র । এমনিতেই ঘটনার নেপথ্যে ছিল মতামতের সংঘাত, এর মধ্যে নতুন জটিলতা আমেরিকান অনুপ্রবেশে। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের ব্যক্তিগত প্রতিনিধি কর্নেল জনসনের দলেবলে দিল্লি আগমন এবং ক্রিপস-প্রস্তাবের আলােচনায় অংশগ্রহণ বিষয়টাকে আরাে জটিল করে তােলে, অন্তত হডসনের এমনই ধারণা। প্রস্তাব নিয়ে নেপথ্যে যে নাটক অভিনীত হলাে তার অবশেষ পরিণতি জনসন- ক্রিপস ফর্মুলা, যা নিয়ে আবার টানাপড়েন। | আর এ নয়া প্রস্তাব ক্রিপসকেই উভয় সঙ্কটে ফেলে দেয় গ্রহণ-বর্জন নিয়ে মার্কিন ও ব্রিটিশ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিত বিচারে। এরপরও চলেছে প্রস্তাবের ওপর প্রলেপ বুলানাে, চলেছে ভাইসরয় মহােদয়ের চতুর খেলা। কয় দিক। সমালাবেন স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস? না, পারেননি স্যার ক্রিপস। নিজেদের অন্দরমহলেই নয়, কংগ্রেসেরও নেতিবাচক ভূমিকা ছিল এক্ষেত্রে। ছিল জিন্নার দড়ি টানাটানি। আশ্চর্য যে রাজনীতির এ চতুর খেলায় নানাজনের সঙ্গত অংশগ্রহণের মধ্যে ভাইসরয়ের কল্যাণে একজন রিফর্মস কমিশনারের মতাে আমলাও গুরুত্বপূর্ণ নায়ক হয়ে ওঠেন এবং স্যার ক্রিপসকে বারবার তার শরণাপন্ন হতে হয়। ভাইসরয় লিনলিথগাের মতামত তথা তার দাবার চাল জানতে । ক্রিপস কি বুঝতে পারেননি যে, এ মানুষটি একান্তই ভাইসরয়ের খাস তালুকের লােক। তার কাছ থেকে কি সত্যের সন্ধান মিলবে? ভাইসরয়ের সঙ্গে টেক্কা দিতে গিয়ে মূল প্রস্তাব থেকে অনেকটা সরে এসেছিলেন স্যার ক্রিপস । একের পর এক পরিমার্জিত রূপে প্রস্তাবনা যেখানে ভাইরয় ও সেনাপ্রধানের সংশােধনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

তাছাড়া ক্রিপস ক্ষুব্ধ হন তার পেছনে অর্থাৎ তার অজান্তে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার কাছে ভাইসরয়ের টেলিগ্রাম পাঠানাের ঘটনায়। তাদেরই প্রস্তাব আর তা নিয়ে তাদের মধ্যেই দ্বন্দ্ব- ভাইসরয় হয়ে ওঠেন ক্রিপসের শক্তিমান প্রতিপক্ষ- দাবার ছকে মন্ত্রী না হলেও ঘােড়া- লাফিয়ে চলায় যার শক্তি। যুদ্ধাবস্থায় ভারতকে স্বশাসনের প্রস্তাব দিয়ে এই খেলা, বলা যেতে পারে নাটক । এটা সত্যিই আকাঙ্ক্ষিত ছিল না। তবু ঘটেছে। তাই বিলম্বিত হয়েছে ভারতের স্বশাসন এক-তা ঘটেছে রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে। অ্যাটলি সাহেবের ইচ্ছাপূরণ হয়নি তাদের কুশীলবদের নানামুখী চালের জন্য। পরে এই অ্যাটলির প্রধানমন্ত্রিত্বকালেই ভারতীয় রাজনীতিকদের হাতে ক্ষমতার হস্তান্তর (আগস্ট, ১৯৪৭)। | অথচ পরিমার্জিত ক্রিপস প্রস্তাব খুব একটা অগ্রহণযােগ্য ছিল না। একজন হিন্দু ও একজন মুসলমান ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়ে যুদ্ধ মন্ত্রিসভার অভ্যন্তরে আরেক যুদ্ধ মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব মন্দ ছিল কি? লীগ কংগ্রেসের পক্ষে গ্রহণযােগ্য হওয়ারই কথা। জিন্নার জন্য এক-তৃতীয়াংশের বদলে অর্ধাংশ পাওয়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্রিপস প্রস্তাব অর্থাৎ ভারতের স্বশাসন প্রস্তাব ব্যর্থতায় পরিণত হয়। এর জন্য কে বা কারা দায়ী? এ বিষয়ে নানা মুনির নানা মত। যেমন তখনকার ওই অদ্ভুতনাট্যের চরিত্র গান্ধি, নেহরু, আজাদ কিংবা লিনলিথগাে, ওয়াভেল, আমলা হডসন প্রমুখ, তেমনি ক্ষমতা হস্তান্তর’ শীর্ষক তথ্য-সঙ্কলনের মধ্যমণি ভিপি মেনন। মনােযােগী পাঠক লক্ষ্য করতে পারেন এদের, বিশেষ  করে লেখকদের প্রবণতা ব্যক্তিবিশেষ বা সংগঠনের কাধে দায়িত্ব চাপানাে, অবশ্য তথ্য, উক্তি, বিবৃতি বা ঘটনা উদ্ধৃত করেই। | তবু ফাঁক থেকে যায় । রবীন্দ্রনাথের কাব্যভাষায় বলা যায়, ব্যাখ্যায় করিতে পারি ওলটপালট’।

নকশাল নেতা সুনীতিকুমার ঘােষের তথ্যবহুল দুইখণ্ডের রচনা ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য রাজ’-এর মূল টার্গেট কংগ্রেস, বিশেষ করে গান্ধি, অংশত জওহরলাল । সম্প্রতি এ বিষয়ের লেখায় যশবন্ত সিং প্রায় একই পথের যাত্রী। তিনি দেশভাগের জন্য মূলত কংগ্রেসকেই দায়ী করেছেন। | তবে ক্রিপস মিশন সম্পর্কে তার একটি উদ্ধৃতি তাৎপর্যপূর্ণ। উদ্ধৃতিটি রুজভেল্ট-প্রতিনিধি জনসনের বক্তব্য। তার মতে এ ব্যর্থতার দায় ক্রিপসের নয়, দায় প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের। মনে হয় এ মন্তব্য খুব একটা ভুল নয়। জনসন ঠিকই ধরে ছিলেন চার্চিলের চাতুরী । তার মতে ভারতের স্বরাজ সম্বন্ধে ক্রিপস আন্তরিক ছিলেন এমনই তার অভিমত। প্রস্তাব নিয়ে উদ্ভূত সমস্যা পাঁচ মিনিটে নিষ্পত্তি করা যেত । যদি তার হাতে যথেষ্ট স্বাধীনতা থাকত ও তার প্রধানমন্ত্রী অতটা অনড় না হতেন। চার্চিল চেয়েছিলেন ভাইসরয় ও সেনাপ্রধানের যৌথ সম্মতি। নেপথ্য চিন্তা- প্রস্তাবকের ব্যর্থতা, এবং কংগ্রেসকে এ বিষয়ে কালােভেড়া’ বানানাে ও প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে পাল্টা জবাব দেয়া। এটাই চতুর রাজনীতিক চার্চিলের এক ঢিলে দুই পাখি মারা। তবে শেষ রক্ষা হয়নি, এই যা। দেখা যাক ঘটনার ভেতরমহলের চালচিত্রটা কেমন?  

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!