You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিশ্বযুদ্ধের কল্যাণে প্রধান বিশ্বশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

বিশ্বযুদ্ধের দুবছর পেরিয়ে গেছে, তবু চলছে নরহত্যার নির্বিকার প্রক্রিয়া । ১৯৪২ সালের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গােটা বছরটা উত্তেজক ঘটনাবলীতে জারিত । যেমন আন্তর্জাতিক পরিসরে তেমনি আমাদের দেশি রাজনীতির ক্ষেত্রে। এ সময় বিশ্বযুদ্ধের যেমন বাঁক ফেরার ইঙ্গিত তেমনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের চাপে রক্ষণশীল ব্রিটিশমন্ত্রী চার্চিলের ভারতে সমঝােতা দূত পাঠানাে ছিল এক ঢিলে দুই পাখি মারার কূট-চাতুরী । অন্যদিকে হঠাৎ করেই গান্ধিরাজনীতির পার্শ্ব পরিবর্তন। পার্ল হার্বার অঘটনের প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকার যুদ্ধে যােগদান আসলেই ছিল রাজনৈতিক বিচারে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা । মিত্রশক্তি যেমন তাতে শক্ত মাটিতে পা রাখার সুযােগ পায় তেমনি এটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে যুক্তরাষ্ট্রই মিত্রবাহিনীতে বড় তরফ। যুদ্ধের বাঁক-ফেরা গুতিযেমন তাতে বেড়েছে তেমনি বেড়েছে সর্বত্র মার্কিনি প্রভাব। তাই আশ্চর্য হওয়ার কথা নয় যদি বঙ্গের এক অখ্যাত মহকুমা শহরে ডাকবাংলাের মাঠে তাঁবুতে থাকা তিন সৈনিকের মূল ব্যক্তিটি একজন। তরুণ আমেরিকান (শ্বেতাঙ্গ) হয়ে থাকে। মনে হয় ওদের অন্য কোনাে দায়িত্ব ছিল না ঘুরেফিরে শহরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ ছাড়া। অন্তত ওদের দেখে আমার তা-ই মনে হয়েছিল। যুদ্ধে যােগ দিয়ে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিচক্ষণ বা দূরদর্শী কোনাে কোনাে মার্কিন কূটনীতিকের বােধহয় তাদের ভবিষ্যৎ শক্তি ও অবস্থান সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণাই হয়ে থাকবে। তা না হলে ব্রিটেনে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ কেনেডি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে পাঠানাে তার গােপন ডেসপাচে এমন ইঙ্গিত দিতে পারতেন না যে, যুদ্ধের ফল যা-ই হােক এ যুদ্ধ ব্রিটেনকে বিশ্বশক্তির ওপরের ধাপ থেকে নিচে নামিয়ে আনবে। ইংরেজিভাষী বিশ্বের নেতৃত্ব আমাদের হাতেই আসবে (উদ্ধৃতি কুইট ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের)। আসলে ইংরেজিভাষী নয়, গােটা বিশ্বের নেতৃত্বই যুদ্ধের পরিণামে ক্রমে তাদের হাতে পৌছেছে। 

ওই ঘটনা যুদ্ধের সূচনালগ্নের এবং এক বছর পর বিষয়টা আরাে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন একজন বিশিষ্ট মার্কিন শিল্পপতি ভার্জিল জর্ডান বলেন, ‘যুদ্ধের পর নব্য সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতায় ব্রিটেন হবে বড়জোর আমাদের এক কনিষ্ঠ অংশীদার। কারণ অর্থনৈতিক, সামরিক, এমনকি নৌ-শক্তি সবকিছুরই মূল কেন্দ্রীয় শক্তি হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাস্তবিকই এরা বিশ্বরাজনীতির ভবিষ্যৎটা দেখতে পেয়েছিলেন তাদের বাস্তবচিন্তায় । আর নেহরুর (জওহরলাল) মার্কিনি শক্তি সম্পর্কে মন্তব্য কী ভেবে লিখিত বলা কঠিন। কারণ আপাতবিচারে এবং মাঝে মধ্যে কথাবার্তায় সমাজবাদী বক্তব্য প্রদানে অভ্যস্ত নেহরু (যে জন্য গান্ধি চিন্তিত ছিলেন না। কারণ তিনি জানতেন ঘরের পাখি ঠিক সময়ে ঘরে ফিরবে- এবং সেজন্যই তিনি নেহরুকে তার উত্তরাধিকারী ঘােষণা করতে দ্বিধা করেননি) মার্কিনি গণতন্ত্রের প্রশংসা করে লিখতে পেরেছেন যে ‘বিশ্বে পরবর্তী শতক হবে আমেরিকার শতক’। তার ভবিষ্যদ্বাণী যে সত্যে পরিণত হবে সেকথা হয়তাে তিনি ভাবেন নি। এ কথাও লেখেন যে, আমেরিকার ওপর রয়েছে দায়িত্বের বিশাল বােঝা এবং সঠিক নেতৃত্বের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছে বিশ্বের লক্ষ কোটি মানুষ।’ সত্যই কি তাই? সমাজবাদী গণতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত জওহরলাল নেহরুর পক্ষে এ ধরনের মতামত বিস্ময়কর নয় এ কারণে যে রাজনীতিতে তিনি বরাবর স্ববিরােধী বক্তব্য ও আচরণের জন্য পরিচিত। তৎকালীন কংগ্রেসী রাজনীতিতে তিনি সুভাষ-বিরােধিতার জন্যও পরিচিত। কখনাে কখনাে চড়াসুরে বা আবেগে সমাজতন্ত্রের পক্ষে বক্তব্য রের্থেওঁ বারবার ওয়ার্ধায় গান্ধিক্যাম্পে ফিরে গেছেন। এবং সেটা গান্ধির রাশটানার কারণে । গান্ধি নেহরু-চরিত্র সঠিকভাবে মেপে নিতে পেরেছিলেন বলেই জওহরলালের আবেগদৃপ্ত ভাষণে বিচলিত হতেন না- তা সে ভাষণ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে থােক বা সমাজতন্ত্রের পক্ষে হােক।  তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই যখন সমাজবাদী চেতনার রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত জওহরলাল নেহরু ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চারিত জনযুদ্ধ শ্লোগানের সমালােচনা করেন এবং কানপুরে অনুষ্ঠিত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সম্মেলনে (ফেব্রুয়ারি, ১৯৪২) কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে অভিযােগের আঙুল তুলে বলেন যে, তারাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে শক্তি জুগিয়ে চলেছে (নির্বাচিত রচনাবলী)। | মিত্রশক্তির সদস্য হওয়ার কারণে রাশিয়া ও চিয়াং কাইশেকের চীনের তিনি কঠোর সমালােচনা করেন। এবং শ্রমজীবী জনতাকে সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশরাজের কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে সক্রিয় হওয়ার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান। আবার এই জওহরলালই যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে। 

চিয়াং কাইশেকের সম্মানীয় অতিথি হয়ে চীন ভ্রমণ করে আসেন এবং ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারিতে চিয়াং কাইশেক যখন সদলবলে ভারতে আসেন তখন তার সঙ্গে সৌহার্দ্যমূলক রাজনৈতিক আলােচনায়ও মিলিত হন। বিশ্বযুদ্ধের অবস্থাদৃষ্টে নেহরুর মনে হয়তাে এমন ধারণা জন্মে যে, ক্ষয়িষ্ণু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন আসন্ন। এটা নেহাৎ সময়ের ব্যাপার মাত্র। হয়তাে ভেবে থাকবেন, ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য সময়ের নিয়মে ভেতর থেকে ক্রমশ ক্ষয় পেতে পেতে এক সময় তা স্বাভাবিক নিয়মে বা বিশেষ কোনাে ঘটনার চাপে হঠাৎ করেই ভেঙে পড়বে। ঘটনা সেক্ষেত্রে উপলক্ষ মাত্র । ইতিহাসে তা প্রায়ই দেখা যায়। যেমন ভারতবর্ষে দীর্ঘকালীন পাল সাম্রাজ্য বা মুঘল সাম্রাজ্য। এ বিষয়ে গান্ধির ধারণাও ভিন্ন ছিল না। হয়তাে ব্রিটেনের বাস্তবচিন্তার রাজনীতিক কারাে কারাে মনেও এমন ধারণা বাসা বেঁধে থাকতে পারে, যেমন শ্রমিক দল ও উদারনৈতিক দলের সদস্য ক্লিমেন্ট অ্যাটলি ও তার সহযােগী কেউ কেউ । তাই তাদের চিন্তা ভারতের সঙ্গে একটা সম্মানজনক সমঝােতার পক্ষে-যাতে ‘রাজ’-এর ঐতিহ্যবাহী গৌরব নষ্ট হয়, আবার বাস্তব অবস্থাও সামাল দেয়া যায় সে সমঝােতার মধ্যমণি স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস।  এ ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিম রুজভেল্টের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়, অন্তত ভারতবাসীর জন্য । ইতিহাস পাঠকের মনে থাকতে পারে, নাৎসি বাহিনীর ইউরােপ আক্রমণের বর্বরতা লক্ষ্য করে রবীন্দ্রনাথ তাদের বাঁচাতে, বিশেষ করে ফ্যাসিস্টদের প্রতিরােধে সাহায্য করতে রুজভেল্টের কাছে তারবার্তা পাঠিয়ে বাঙালি শিক্ষিত সমাজের একাংশে সমালােচিত হয়েছিলেন। শুধু প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টই নন, একাধিক রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে ব্রিটেনের ওপর এ চাপ তৈরি হয়েছিল। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কমন্স সভায় রক্ষণশীল প্রাধান্য সত্ত্বেও জাতীয় স্বার্থে ব্রিটেনে তখন শ্রমিক দল ও উদারনৈতিক দল নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হয়, যাতে সমস্যার কার্যকর মােকাবেলা সহজ হতে পারে । ভাবতে অবাক লাগে আমরা রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক বিধি-বিধানাদি পাশ্চাত্য থেকে, ব্রিটেন বা আমেরিকা থেকে আমদানি করলেও তাদের স্বদেশহিতকর ভূমিকা অনুসরণ করি না। সঙ্কটে জাতীয় সরকার গঠন দূরে থাক, দলীয় সঙ্কীর্ণতার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারি না । রাজনীতির এসব দিক বিবেচনায় আমরা বড়ই অদূরদর্শী। জাতীয় স্বার্থ আমাদের কাছে কখনাে প্রাধান্য পায় না। পায় ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থ । এদিক থেকে পশ্চিমের রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রশংসা দাবি করতে পারে। 

ব্রিটিশ রাজনীতিতে ভারত বিষয়ক সমঝােতার ধারণা সৃষ্টি হওয়ার প্রধান কারণ দক্ষিণ এশিয়ায় জাপানের দ্রুত আগ্রাসী তৎপরতা। মার্কিন প্রেসিডেন্টের মতাে তাদের মনেও ভয় পাছে জাপান ভারত আক্রমণ করে বসে। রেঙ্গুন থেকে। আসাম বা পুবের বঙ্গদেশ তাে একেবারে হাতের নাগালে। তদুপরি সুভাষচন্দ্রের রয়েছে নিজস্ব ফৌজ নিয়ে দিল্লি দখলের পরিকল্পনা। সুভাষচন্দ্রের যুদ্ধশ্লোগান- ‘চল চল দিল্লি চল, লালকেল্লা দখল কর’ বাঙালি তরুণদের মাতিয়ে তুলেছিল। সঙ্গত কারণে এবং পূর্ববাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে জাপানি আগ্রাসন সম্বন্ধে চীনের ভয়ভীতিও কম ছিল না। চীনের জাতীয়তাবাদী নেতা চিয়াং কাইশেক তখন চীনের হর্তাকর্তা-বিধাতা। চীনও তখন বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর সদস্য। চীনেরও ইচ্ছা ভারতবর্ষ এ যুদ্ধে মিত্রশক্তির সহায়তায় এগিয়ে আসুক। এ চিন্তা মাথায় রেখে ফেব্রুয়ারিতে (১৯৪২) ভারত সফরের সময় চিয়াং মাদাম চিয়াং কাইশেকসহ ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এ বিষয়ে মতবিনিময় করেন। বিষয়টা মাওলানা আজাদের আত্মজীবনীতেও যথাযথ গুরুত্বে স্থান পেয়েছে । আজাদ লিখেছেন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের ভারতবিষয়ক সহানুভূতির কথা। সেই সঙ্গে লিখেছেন যে, চীনের রাষ্ট্রনায়ক চিয়াং কাইশেকও একই অভিমত পােষণ করতেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই তিনি জোরের সঙ্গে একটা মিটমাট করে নেয়ার জন্য ইংরেজদের পরামর্শ দিচ্ছিলেন। জাপান পার্ল হার্বার আক্রমণের পর তিনি আরাে জোরের সঙ্গে তার অভিমত ব্যক্ত করতে থাকেন’। তার ভাষায় : | ‘চিয়াং কাইশেক প্রথম থেকেই ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে ভারতের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়ার জন্য চাপ দিয়ে এসেছেন। তিনি এই অভিমত পােষণ করতেন, ভারতবর্ষ স্বেচ্ছায় যুদ্ধের ব্যাপারে সহযােগিতা না করলে তার কাছ থেকে যথােপযুক্ত সাহায্য পাওয়া যাবে না। তবে ভারতে কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে আলােচনার সময় চিয়াং কাইশেক অবশ্য তাৎক্ষণিক স্বাধীনতার বদলে পর্যায়ক্রমে স্বাধীনতা প্রাপ্তির কথা উল্লেখ করেছিলেন। | আর কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মাওলানা আজাদ চিয়াং কাইশেককে বলেছিলেন, ‘ব্রিটেন যদি যুদ্ধ চলাকালে ভারতকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেয় এবং শাসনকার্যে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় প্রতিনিধিদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয় তাহলে কংগ্রেস অবশ্যই ব্রিটিশ সরকারের প্রস্তাব মেনে নেবে।’ 

তিনি আরাে বলেছিলেন, ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট যদি যুদ্ধের পরে ভারতকে স্বাধীনতা দেয়ার কথা স্বীকার করে তাহলে আমরা নিশ্চয়ই তাদের সঙ্গে সর্বব্যাপারে সহযােগিতা করতে প্রস্তুত আছি।’  কিন্তু সমস্যা ছিল লড়াইয়ের মতােই রাজনীতির একাধিক ফ্রন্টে। যেমন। মাওলানা আজাদের মতামত নিয়ে তাদের দুই বিপরীত গ্রুপেই ভিন্নমত ছিল । এবং তা মূলত পূর্ণ স্বাধীনতার ঘােষণা ও অহিংসা নীতি নিয়ে। অন্যদিকে ব্রিটিশ পক্ষেও ছিল ভিন্নমত প্রচ্ছন্নভাবে, কূটনৈতিক ও রাজনীতিক চাতুরীর মাধ্যমে। ক্রিপস সাহেবের সমঝােতা-দৌত্য ব্যর্থ হওয়ার সেটাও বােধহয় অন্যতম কারণ । দায় অবশ্য ভারতীয় রাজনীতিকদেরও ছিল। এ ক্ষেত্রে মাওলানা আজাদ ছিলেন স্পষ্টবাদী, রাজনৈতিক কূটকৌশল বা ছলচাতুরীতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না। কিন্তু কূটনৈতিক খেলা রাজনীতির বড় তরফ। সেখানে নীতি-নৈতিকতা অপাঙক্তেয়। ধর্মের জয় অধর্মের ক্ষয়’, অর্থাৎ সত্যের জয় অসত্যের পরাজয় নিছক আপ্তবাক্য। যে যত চাতুর্যে খেলতে পারবে দাবার ছকের লড়াইয়ে তারই জয় । বিয়াল্লিশে ভারতীয় ভবিষ্যৎ নিয়ে কত যে কুশীলবের প্রকাশ্য ও নেপথ্য চাল- তাই নিয়ে ঐতিহাসিক নাটক রচিত হতে পারে। আমরা আশ্চর্য হই দেখে। যে একপক্ষেই একাধিক সােত, তার কিছু প্রকাশ্য, অনেকটাই প্রচ্ছন্ন। এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও অহমবেধ প্রাধান্য পেয়েছে, নষ্ট করেছে জাতীয় স্বার্থ, দেশি স্বার্থ । ব্রিটিশ-ভারতীয় মঞ্চে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় কত বড় এক মহাকাব্যিক নাটক যে অভিনীত হয়েছিল, সংখ্যায় কত যে এর পাত্রপাত্রী এবং কী অবিশ্বাস্য গুরুত্বে ও তাৎপর্যে সেই খেলা, ক্ষমতার হস্তান্তরের বিপুল পরিমাণ তথ্যাবলীতে তার কিছুটা আভাস মেলে।

ঘটনার পরস্পরবিরােধী স্রোতের অবিশ্বাস্য পরিণামে এ যেন মিনি কুরুক্ষেত্রেরও অধিক। সংঘাতময় কুটিল-জটিল এ মহানাটক, যে যেমনই বলুক, আমার বিশ্বাস ১৯৪২ থেকে ‘৪৭ আগস্ট পর্যন্ত। বিস্তৃত। অর্থাৎ ক্রিপস মিশন থেকে কেবিনেট মিশন পর্যন্ত এ নাট্য-অভিনয় চলেছে- মধ্যখানে বিচিত্র ঘটনাবলীর টানাপড়েন। রয়েছে এর পূর্বকথা শুরু থেকে, সঙ্গে নানা স্রোত অনুকূল-প্রতিকূল, অন্তত ভারতের ভবিষ্যৎ পরিণাম রচনায়। সেখানে রক্তস্রোতও কম ছিল না। বরং সেটাই ছিল বিভাজনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’ (বাঁকফেরা বিন্দু)।  বিভাজনের চাবিকাঠি যেসব ঘটনাতেই থাকুক, ভারতবাসীর হাতে ব্রিটিশরাজের ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রধান প্রেক্ষাপট ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের ক্ষয়ক্ষতি ও অর্থনৈতিক মন্দা। নিয়মমাফিক অর্থনৈতিক  মন্দা কাটাতে উপনিবেশ ধরে রাখা এবং শাসন-শােষণ অব্যাহত রাখারই কথা। সে চেষ্টা যে ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে ব্রিটেন করেনি তা নয়। যে জন্য যুদ্ধাবস্থায়ই সমঝােতা মিশন পাঠানাে। লক্ষ্য করার বিষয় যে এসব সত্ত্বেও ভারতীয় উপনিবেশ ছেড়ে আসার ব্যাপারে মনস্থির করতে তাদের অন্তত ৫ বছর সময় লেগেছে- অর্থাৎ ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ।  ক্ষমতা ছাড়ার পক্ষে যেমন প্রবল চাপ ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের দিক থেকে তেমনি ছিল ভারতীয় রাজনীতির অভ্যন্তরীণ চাপ । ছিল ভূকম্পনের মতাে ভারতীয় রাজনীতির বিরূপ পরিবেশ। এমনকি ‘রাজ সমর্থকদেরও কেউ কেউ রীতিমতাে নড়েচড়ে ওঠেন, আহ্বান জানান সুসম্পর্ক বজায় রেখে আসন ছেড়ে দিতে। অন্যদিকে গান্ধি যতই কংগ্রেসে অহিংসার পক্ষে প্রস্তাব পাস করান

কেন তার বুঝতে বাকি থাকে না যে অহিংসা-বিরােধীদের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। তাই তিনি যখন তার ওপর অর্পিত একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিকে চিঠি লেখেন তখন তা গৃহীত হয়। অন্যদিকে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি সরকারের প্রতি সহযােগিতার নীতিই বহাল রাখে এবং তা বরাবরের মতাে লীগ ওমুসলিম স্বার্থ বিষয়ক দাবি মেনে নেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। বলা দরকার যে, ভাইসরয় লিনলিথগাের রক্ষণশীল চাতুর্যের কারণে ক্ষমতার হস্তান্তর বিলম্বিত হয়েছে, ক্রিপস প্রস্তাব ব্যর্থ হয়ে অবাঞ্ছিত পথে ক্ষমতার হস্তান্তর সম্পন্ন হয়েছে । | ভি.পি মেনন ঠিকই বলেছেন, ১৯৪২ সালের শুরুতে বহু সংখ্যক ভারতীয় নেতা ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য বিলেতে ব্রিটিশরাজের প্রতি জোরালাে আহ্বান জানাতে শুরু করেন। যেমন তেজবাহাদুর সাঞ্জু, এম জয়কর, শ্রীনিবাস শাস্ত্রী, স্যার রাধাকৃষ্ণান, মুহম্মদ ইউনূস, স্যার জগদীশ প্রসাদ, স্যার শিবস্বামী আয়ার প্রমুখ খেতাবপ্রাপ্ত বিদগ্ধজন। আমরা দেখেছি, এর আগে ফজলুল হকআল্লাবক্স-সিকান্দার হায়াত খান প্রমুখ রাজনীতিক একই দাবি জানিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন। এক কথায়, ক্ষুব্ধ ভারতভূমি। অন্যদিকে বিশ্বযুদ্ধের মানসিক ও অর্থনৈতিক চাপ। এমনকি চাপ ‘জাতীয় সরকারের উদারনৈতিক সদস্যদের পক্ষ থেকে। স্বভাবতই বেনিয়া চাতুর্যের প্রতিনিধি উইনস্টন চার্চিল একজন উদারনৈতিক সদস্যকেই সমঝােতা প্রস্তাবসহ ভারতে পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেন। উদ্দেশ্য এক ঢিলে দুই পাখি মারা। 

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!