You dont have javascript enabled! Please enable it!

ফ্যাসিস্টশক্তির অগ্রযাত্রায় স্থানিক প্রতিক্রিয়া

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯) ইউরােপে শুরু হলেও এর প্রভাব বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় ভাইসরয় যখন বলেন, ভারত এখন যুদ্ধাবস্থায় তখন বুঝতে পারা যায় যুদ্ধের বাতাস ভারতের গায়েও লাগছে । জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকা দিয়ে তা শুরু। তবে রাজনৈতিক অঙ্গনে সে প্রভাব বিশেষভাবে দেখা যায় ২২ জুন, ১৯৪১ থেকে যখন অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে হিটলার হঠাৎ সােভিয়েত ভূখণ্ডে আক্রমণ চালায়। ঘটে বিশ্বযুদ্ধে গুণগত পরিবর্তন, চরিত্রগত পরিবর্তন, যা যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি পাল্টে দেয়। বিশ্বের প্রগতিবাদী রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে উঠে আসে যুদ্ধের নতুন ব্যাখ্যা। দেখা দেয় সংকট। | সােভিয়েত ভূখণ্ডে জার্মান আক্রমণের প্রচণ্ডতা ( রিসক্রিগ) এতটাই ছিল যে, প্রাথমিক পর্বে বিশ্ববাসীর মনে এমন ধারণা জন্মে যে অচিরেই হিটলার রুশ দেশ দখল করে নেবে। হতে পারে রুশী শীতের প্রবলতা মাথায় রেখে (নেপােলিয়নের পরাজয় স্মরণে রেখে) হিটলার বাহিনী মধ্যগ্রীষ্মে আক্রমণ শুরু করে এবং দ্রুত বেশ কিছু অঞ্চল দখল করে নেয়। যুদ্ধবিশারদরা বলতে পারবেন সময়, প্রস্তুতি ও কৌশল বিবেচনায় রাশিয়া শুরুতেই সর্বশক্তির প্রতিরােধ তৈরি না করে জার্মান বাহিনীকে দেশের ভেতরে টেনে নিয়েছিল। কিনা। কারণ পরবর্তী রুশী প্রতিরোেধ বিশ্ববাসীকে চমকে দেয়। যুদ্ধের বিস্তার ও আক্রমণের তীব্রতা সােভিয়েত রাশিয়াকে বাধ্য করে সম্পূর্ণ ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে । সেই সঙ্গে মতাদর্শের ক্ষেত্রে নমনীয়তায় সমঝােতার পথ ধরতে। কারণ বিষয়টা অস্তিত্ব রক্ষার।

তাই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের সঙ্গে মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষর করতে হয়। এভাবে যুদ্ধে মিত্রশক্তির আবির্ভাব। আতঙ্কিত বিশ্বপরিস্থিতিতে গণতন্ত্রী বিশ্বকে আশ্বস্ত করতে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি ঐতিহাসিক ঘােষণা ‘আটলান্টিক সনদ’। ১৯৪১ সালের আগস্টে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল আটলান্টিক মহাসাগরে ‘অগাস্টা’ নামক রণতরীতে বসে যুদ্ধনীতি তথা শান্তিনীতির যে ঘােষণা দেন তাতে যেকোনাে জনগােষ্ঠীর তাদের ইচ্ছামতাে পদ্ধতির সরকার গঠনের অধিকার স্বীকৃতি পায় এবং জোর করে যাদের সে  অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে তাদের সেই সার্বভৌম অধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা। তারা দেখতে চান। এটাই আটলান্টিক চার্টারের মূলকথা।  এ ঘােষণা পরাধীন দেশগুলােতে বিশেষ করে ভারতে আশার সঞ্চার ঘটায়। আর সে আশায় পানি ঢেলে দিয়ে রক্ষণশীল দলীয় চতুর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল অতি দ্রুত (৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪১) কমন্স সভায় এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আটলান্টিক চার্টারের সুবিধা ভারত ও বার্মার মতাে উপনিবেশের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। বরং ১৯৪০ সালের আগস্টে ভারত সরকার যে সমঝােতা ঘােষণা দিয়েছিল ব্রিটিশ নীতি সে পথ ধরেই চলবে (ভিপি মেনন)। আসলে যুদ্ধের প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতির মুখে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তার উপনিবেশ সম্পদ হাতছাড়া করতে রাজি ছিল না ।। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতি তখনাে মিত্রশক্তি বা ব্রিটেনের অনুকূলে নয় । বিশ্বফ্যাসিস্ট শক্তি ইতালি, জার্মানি, জাপান তখন এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিশ্বজয়ের পরিকল্পনা করছে। জার্মানির অব্যাহত অগ্রগতি তাদের উৎসাহিত করছে। তাদের লক্ষ্য ভাগ করে বিশ্বশাসন এবং ভােগদখল । জয়ের উন্মাদনায় তারা মার্কিন রণশক্তি পরিমাপ করতে ভুল করেছিল সে ভুলের টানে জাপান প্রশান্ত মহাসাগরীয় মার্কিন নৌঘাঁটি ব্যাপক বােমাবর্ষণে ধ্বংস করে ফেলে, আমেরিকাকে যুদ্ধে টেনে আনে। এ ভুলের মাসুল ভালােভাবেই জাপানকে দিতে হয়েছে এবং তারা এখনাে তা দিচ্ছে আমেরিকা যুদ্ধে যােগ না দিলে অন্তত দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধের ফল কী হর্তো বলা কঠিন। 

মনে হয় পরিকল্পনা এমন ছিল যাতে এশিয়ায় জাপান, ইউরােপে জার্মানি এবং অন্যত্র বিশেষত আফ্রিকায় জাপান ও ইতালি তাদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে । কিন্তু আমেরিকা যুদ্ধে যােগ দেয়ার ফলে মিত্রপক্ষের রণশক্তি অনেক বেড়ে যায়। একটি পূর্ণাঙ্গ মহাদেশ হাতের মুঠোয় থাকার বহুমাত্রিক সুবিধা। তাছাড়া রয়েছে তাদের ভৌগােলিক অবস্থানগত সুবিধা। এত সব সুবিধা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের রণপ্রস্তুতির কারণে জার্মানি ও জাপানের প্রাথমিক রণসাফল্য ছিল অভাবিত। জার্মানির ইউরােপ দখলের মতােই জাপানেরও একই ব্লিৎসক্রিগ কায়দায় পার্ল হার্বার ধ্বংস ৭ ডিসেম্বরে (১৯৪১), এক সপ্তাহ পর সিঙ্গাপুর দখল । এরপর বার্মা  স্বভাবতই জাপানের নজর ভারতের দিকে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। জার্মানি ও জাপান মিলে ইউরােপ ও এশিয়ায় যেন নরকের আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। কেমন ছিল ভারতে বা বঙ্গে এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়া। এ সময়কার কাগজগুলােতে ছিল যুদ্ধে পিছু হটা ব্রিটিশ সিংহকে নিয়ে বিদ্রুপ ও ঠাট্টাতামাশা বিশেষ করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর দক্ষিণ এশিয়ায় সম্মানজনক পশ্চাদপসরণ’  নিয়ে। সারা ভারতে যেমনই হােক বঙ্গের রাজনীতিমনস্ক শিক্ষিতশ্রেণী উল্লসিত জাপানি অগ্রযাত্রায় | জাপানি বেতারে প্রচার চলে যাতে এ সুযােগে ভারত তার পরাধীনতা ঘােচাতে ঘুরে দাঁড়ায়। জাপানি অগ্রযাত্রার সমর্থনে বাঙালির উল্লাস মহকুমা শহর পর্যন্ত দেখা গেছে। যত আলােচনা স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে তার চেয়ে কম নয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পিছু হটার সুসংবাদে।

ঔপনিবেশিক শাসকশক্তির প্রতি পরাধীন দেশের মানুষের এ বিরূপতা যুক্তিসঙ্গত। তাই জাপানি আগ্রাসনে জাতীয়তাবাদী চেতনার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু ভেবে দেখেনি চীনে জাপানি সেনাদের বর্বরতা ও নৃশংসতার কথা। সুভাষচন্দ্রের জাপানে অবস্থান বিষয়টিকে জটিল করে তােলে। কড়াই থেকে উনানে পড়ার কথা না ভেবেই ইংরেজের পরাজয়ের সম্ভাবনায় রাজনীতিমনস্ক মানুষ খুশি। এ বিষয়ে কংগ্রেসে মতভেদ। নেহরুআজাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না ফ্যাসিস্ট শাসককে সমর্থন। কিন্তু তা সম্ভব হয় গান্ধি, প্যাটেল ও প্রসাদের পক্ষে। অন্যদিকে যে বিষয়টা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে অধিকতর বিতর্ক তা হলাে সােভিয়েত ভূমিতে জার্মান আগ্রাসনের ফলে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি এ যুদ্ধ ফ্যাসিস্টবিরােধী যুদ্ধ, জনযুদ্ধ হিসাবে চিহ্নিত করে যুদ্ধে সরকারের প্রতি সমর্থনের নীতি ঘােষণা করে। আর্তে কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের তিক্ত সম্পর্ক তৈরি হয়, এমনকি হয় ফরােয়ার্ড ব্লকের সঙ্গেও। বাঙালি বুদ্ধিবৃত্তিক জগতও একইভাবে বিভাজিত হয় অনেকটা রাজনৈতিক অঙ্গনের মতােই। | একদিকে কমিউনিস্ট পার্টির চেষ্টায় গড়ে ওঠে ফ্যাসিস্ট বিরােধী কবিশিল্পী-নাট্যকার-সংগীতকারদের নিয়ে সংগঠন। আর তাই নিয়ে কংগ্রেস ও ফরােয়ার্ড ব্লকের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব, দ্বন্দ্ব আরএসপির সঙ্গেও। যা পরে দেখা যাবে ব্যাপকভাবে, তীব্রভাবে ভারত ছাড়াে নামের আগস্ট আন্দোলনের (১৯৪২) সময়। গােপাল হালদারের মতাে ধীরস্থির বুঝদার লেখকও আগস্ট আন্দোলনের সমর্থকদের রচনা চিহ্নিত করেন বিয়াল্লিশি বিলাস’ বলে। আপাতত থাক সেসব কথা। পরে যথাস্থানে তা আলােচিত হবে। | কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে কংগ্রেস সাহিত্য সংঘ ও প্রগতিবাদীদের ফ্যাসিস্ট বিরােধী লেখক-শিল্পী সংঘের বিবাদ বিশ্বযুদ্ধ উপলক্ষ নতুন করে দেখা গেলেও মূল বিরােধিতা ছিল আদর্শভিত্তিক। অনেক সময় এক মঞ্চে দাঁড়িয়েও দুই পক্ষ দুই মেরুতে । আসলে বিশ্বযুদ্ধ সবকিছুই তালগােল পাকিয়ে দিয়েছিলরাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে পরস্পর বিরােধিতায় । 

যেমন যুদ্ধের সমর্থন ও বিরােধিতা নিয়ে কংগ্রেসের ভেতরেই মতভেদ। বারদৌলি কংগ্রেস (ডিসেম্বর ১৯৪১) তার প্রমাণ। নেহরু-আজাদ প্রমুখ নেতা অহিংসার নীতি বর্জন করে শর্তসাপেক্ষে ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে আগ্রহী। অন্যদিকে গান্ধি ও তার অনুসারী প্যাটেল, রাজেন্দ্রপ্রসাদ প্রমুখ নেতা কোনােক্রমেই অহিংসানীতি বর্জনে রাজি নন। এমনকি স্বাধীনতার বিনিময়েও নন, শেষ কথাটা গান্ধির । এবং তা ওয়ার্ধা বৈঠকে। | ভারত বা বঙ্গের রাজনীতি তখন এমন এক অদ্ভুত দোটানায়, তিনটানায়বলা চলে অনিশ্চিত টানাপড়েনে। মতভেদ যেমন কংগ্রেস হাইকমান্ডে, তেমনি কংগ্রেস বনাম ফরােয়ার্ড ব্লকে কেন্দ্রবিন্দুতে সুভাষ । অন্যদিকে প্রবল বিরােধিতা কংগ্রেস ও জনযুদ্ধের শ্লোগান- তােলা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। দুপক্ষের সংস্কৃতি অঙ্গন যুদ্ধতালে সমান তৎপর। যুদ্ধের শুরুতে কমিউনিস্ট নেতারা সবাই সরকারি কল্যাণে কারাগারে। জনযুদ্ধের কল্যাণে তারা সবাই মুক্ত । যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থার কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত। চাল, কাপড়, চিনি, কেরােসিন, নুন ইত্যাদি ক্রমে দুমূল্য ও দু’প্রাপ্য হতে শুরু করেছে। নিজের অভিজ্ঞতা বলি। সিনিয়র স্কুলছাত্র বিমলের জবরদস্তিতে শহরতলি পেরিয়ে গ্রামে ঘুরে এসেছি। মানুষ কেন জানি শঙ্কায় ভুগছে। বিমল ছাত্র ফেডারেশন কর্মী। সাধারণ শিক্ষিত সমাজ তাদের সমর্থক নয় । যুদ্ধ-বিষয়ক নিরাপত্তা বিবেচনায় সরকার গড়ে তুলেছে শহরের জন্য ‘সিভিকগার্ড ও গ্রামের জন্য হোমগার্ড বাহিনী অনেকটা পুলিশ কনস্টেবল ক্যাডার পর্যায়ের। জনসেবায় আত্মনিয়ােগ করেছে কমিউনিস্ট কর্মীরা। তাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বােধহয় সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। মহকুমা শহরে বসে এসব তৎপরতা চোখে পড়ছে। মাঝে মধ্যে টাউন হলে এসব বিষয়ে সরকারি তত্ত্বাবধানে সভাবৈঠক হয়। কী হচ্ছে দেখার ও বােঝার জন্য একবার এমন এক সভার সর্বপেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারি চারদেয়ালের বাইরে মানুষ যুদ্ধে ব্রিটিশবিরােধী, ইংরেজের পরাজয় প্রত্যাশী। হােমগার্ড, সিভিকগার্ডদের নিয়ে শহুরে মানুষের মধ্যে অনেক ঠাট্টারসিকতার প্রচলন বুঝিয়ে দেয় শিক্ষিত শ্রেণী এসব প্রচেষ্টা কী চোখে দেখেছে। তখন ঠিক বােঝা যায়নি সামাজিক দুরবস্থার মূল কারণ শাসনব্যবস্থায় নৈরাজ্য ও যুদ্ধকালীন অভ্যন্তরীণ সরকারি নীতি। প্রদেশ থেকে প্রদেশে খাদ্য চলাচল নিয়েও ছিল খবরদারি। কারাে মানবিক চেতনায় প্রশ্নটা ঘণ্টা বাজায়নি যে খাদ্যসামগ্রী চলাচলে কড়াকড়ি ও অবহেলা এ দুই কারণে, প্রান্তিক প্রদেশে সাধারণ মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। 

জাপানি আক্রমণের অগ্রযাত্রা এবং যুদ্ধে ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীর ক্রমাগত পরাজয় ও পিছু হটা ব্রিটিশ রাজের মনােবলে কিছুটা হলেও চিড় ধরিয়ে ছিল। তা না হলে তাদের কাজকর্মে অস্থিরতা ও অবিবেচনা দেখা দিত না। এ সবের সর্বাধিক প্রভাব পড়ে বঙ্গদেশে, পূর্বপ্রান্তের ও বার্মাসংলগ্ন প্রদেশ হওয়ার কারণে। জাপানি আতঙ্ক যে শাসকদের কতটা প্রভাবিত করেছিল তার প্রমাণ মেলে বঙ্গে নৌকা ধ্বংস করার উন্মাদ আচরণে । ভাবখানা এমন যে, জাপানিরা ঠিকই বার্মা হয়ে পূর্ববঙ্গে পৌছে যাবে এবং নৌকা না পেলে তারা আর এখান থেকে এগােতে পারবে না। যত হাস্যকর চিন্তা ও কর্মকাণ্ড! আর এ পাগলামির কারণে বছরখানেক পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় পদ্মাবােটটি রক্ষা করতে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওই বােটটিকে নিয়ে গঙ্গা-পদ্মা পাড়ি দিয়ে সুদূর পতিসরে গিয়েছিলেন । এসব বেশ কিছু সময় পরের কথা। কিন্তু এ সময়ের স্থানীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির জনযুদ্ধের ঘােষণা এবং মূলত কংগ্রেস ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ব্যাপক কমিউনিস্ট বিরােধী প্রচার এবং সেই সঙ্গে মুসলিম লীগেরও ভূমিকা। কমিউনিস্ট পার্টি তাদের অনুগত অনুসারীদের বাইরে অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কংগ্রেসের সাধারণ সমর্থকদের দৃষ্টিতে তখন তারা ইংরেজ শাসকের দালাল।  এ পরিস্থিতি বিশেষভাবে তৈরি হয় ১৯৪২ সালে কংগ্রেসের ভারত ছাড়াে আন্দোলনের ব্যাপক প্রতিক্রিয়ায় । রাজনীতিমনস্ক শিক্ষিত জনশ্রেণী পরাধীনতা বনাম স্বাধীনতার বিষয়টাকে সঙ্গত কারণে এতটা গুরুত্বে গ্রহণ করে যে তারা ফ্যাসিস্ট বিরােধিতার রাজনৈতিক তাৎপর্যের বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। প্রায় দুশাে বছরের উপনিবেশবাদী শাসকদের পরাজয় ছিল তাদের কাম্য। | কিন্তু তারা হিসাব করতে চাননি যে ইংরেজ রাজশক্তির পরাজয়ের জের ধরে জাপানের মতাে নতুন পরাক্রমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভারতের শাসনভার হাতে নিয়ে নিতে পারে। তারা নতুন করে ভারতে উপনিবেশ স্থাপন করতে পারে । সেদিক থেকে জাপান তাে এক পায়ে খাড়া। কারণ তারা ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে মণিপুর কোহিমায় কড়া নাড়তে শুরু করেছে। আজাদ হিন্দ ফৌজের কি সাধ্য ছিল তাদের প্রতিহত করে? দিল্লির লােভনীয় সিংহাসনের অধিকার ছেড়ে দেয়া কি সম্ভব হতাে বিজয়ী জাপানের পক্ষে? যতই তারা প্রতিশ্রুতি দিক সুভাষ ও তার ফৌজি নায়কদের? রাজনীতির এ কূট হালচাল শিক্ষিত বঙ্গবাসীর বড়সড় অংশ আমলে নেয়নি।  

তারা বুঝতে চাননি যে যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্বল ব্রিটিশরাজের সঙ্গে যুক্তিসঙ্গত সমঝােতার ভিত্তিতে ফ্যাসিস্টবিরােধী যুদ্ধে সহায়তাদানই ভারতবাসীর জন্য ভবিতব্য হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা। কিন্তু সেক্ষেত্রে যুদ্ধশেষে ক্ষমতার হস্তান্তর নিয়ে বড় বাধা লীগ-কংগ্রেসের পারস্পরিক বৈরিতা এবং তা আবার সাম্প্রদায়িক টানাপড়েনে। কোনাে প্রস্তাবেই তারা একমত হতে পারেনি। এটা ছিল স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারতবাসীর জন্য বড় দুর্ভাগ্য। তবু শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশরাজকে মিত্রশক্তির বিজয় লাভের দুবছরের মধ্যে ভারতের শাসন ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়। এবং তা সমঝােতার ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে। ১৯৪২ সাল থেকে ক্রিপস প্রস্তাবের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া শুরু এবং ১৯৪৭-এর মধ্যআগস্টে সমঝােতা প্রক্রিয়া শেষ । মধ্যিখানে সাম্প্রদায়িক সংঘাতে রক্তস্রোতের বড় বড় ঢেউ- কী প্রবল অমানবিক বিদ্বেষ ও ঘৃণার প্রকাশ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে! অন্যদিকে জনযুদ্ধের নামে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার চালচিত্রটা ছিল ব্যাপক, যে কথা আগে বলা হয়েছে। কিন্তু সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ফ্যাসিস্টবিরােধী তৎপরতাও নেহাৎ কম শক্তিমান ছিল না। তিরিশের কবি বিষ্ণু দের একাধিক কবিতা ২২ জুনই শুধু নয়, আরাে অনেকের যেমন সমর সেনের বা সুভাষ-সুকান্তর কবিতায়, লেখায় তা প্রকট। বিস্ময়ের। ঘটনা যে মৃত্যুপথযাত্রী রবীন্দ্রনাথ সােভিয়েত-ভূমির প্রতি সহমর্মিতায় নিয়মিত খবর নিতেন যুদ্ধের, যদিও রুশী জয়টা দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু সুস্থ অবস্থায় ‘বোঁচা গোঁফের হুমকি’ নিয়ে তির্যক ছড়া কাটতে কসুর করেননি। তবে এ যুদ্ধ যে নতুন রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক পরাশক্তির উদ্ভব ঘটাতে যাচ্ছে সে অশুভ বার্তা তার জানা ছিল না। জানার কথাও নয়। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে নানা তথ্যে ওই মহাসত্যটার ইঙ্গিত মেলে। 

 

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!